চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106925 / ডাউনলোড: 9721
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

হিজরী তারিখ সম্বলিত মহানবীর কয়েকটি পত্র

১. হযরত সালমান ফার্সী তাঁর ভ্রাতা ও পরিবারবর্গের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক একটি পত্র লেখার আহবান জানালে মহানবী হযরত আলীকে ডেকে পাঠান ও উপদেশমূলক একটি পত্র তাঁর দ্বারা লেখান যে পত্রের শেষে লেখা রয়েছে :

و كتب علي بن أبي طالب بأمر رسول الله في رجب سنة تسع من الهجرة

এ পত্রটি রাসূলের নির্দেশে আলী ইবনে আবি তালিব কর্তৃক লিখিত যা হিজরতের নবম বর্ষের রজব মাসে লেখা হলো। ৩৮৮

২. প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক বালাজুরী তাঁর ফুতুহুল বুলদান গ্রন্থে মাকনার ইয়াহুদীদের সঙ্গে রাসূলের সম্পাদিত চুক্তির বিবরণ দিয়েছেন যা একজন মিশরীয় ব্যক্তি পুরাতন লাল চামড়ায় লিপিবদ্ধ দেখেছিল এবং তা নিজে লিখে রেখেছিল। সে ব্যক্তি বালাজুরীর নিকট সম্পূর্ণ পত্রটি পড়ে শোনায়। পত্রের শেষে বলা হয়েছে, আলী ইবনে আবু তালিব কর্তৃক নবম হিজরীতে লিখিত । উল্লেখ্য যে,যদিও আরবী ব্যাকরণবিধি অনুযায়ী আলী ইবনে আবি তালিব কর্তৃক লিখিত বলা উচিত,তা সত্ত্বেও পত্রে আলী ইবনে আবু তালিব বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ কুরাইশরা সকল অবস্থায়ই আব শব্দটিকে আবু উচ্চারণ করে থাকে। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ আসমায়ী এ বক্তব্যটি সত্য বলে স্বীকার করেছেন।

আল ওয়াসাকুস সিয়াসিয়া নামক গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ্ বলেছেন, আমি ১৩৫৮ হিজরীতে পবিত্র মদীনা নগরীতে গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। সে সময় হযরত আলীর হস্তলিখিত কিছু পত্রের সন্ধান পেয়েছিলাম৩৮৯ যাতে লেখা ছিল :أنا علي بن أبو طالب আমি আলী ইবনে আবু তালিব

৩. দামেস্কের অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি যা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কর্তৃক লিখিত হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদের জীবন,সম্পদ ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা দান করা হয়েছিল তাতে লেখা ছিল তের হিজরীতে লিখিত হয়েছে৩৯০

আমরা জানি যে,দামেস্ক প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিজিত হয়। যে সকল ঐতিহাসিক বলেছেন,দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের নির্দেশে এবং হযরত আলীর পরামর্শে হিজরী বর্ষ প্রবর্তিত হয় তাঁরা মনে করেন,ষোড়শ অথবা সপ্তদশ হিজরীতে তা ঘটেছিল। অথচ এ পত্রটি এর চার বছর পূর্বে লিখিত এবং তাতে হিজরী তারিখ সংযুক্ত ছিল।

৪. রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আলী নাজরানের খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সম্পাদিত যে সন্ধিপত্রটি লিখেন তাতে পঞ্চম হিজরী সাল সংযোজিত রয়েছে। পত্রে এরূপ লেখা রয়েছে :

و امر عليا أن يكتب فيه أنّه كتب لخمس من الهجرة

তিনি আলীকে লেখার নির্দেশ দেন,এ সন্ধি পত্রটি পঞ্চম হিজরীতে লিখিত হয়েছে। ৩৯১ এ বাক্যটি প্রমাণ করে যে,স্বয়ং রাসূলই হিজরী বর্ষের প্রবর্তক এবং তিনিই আলীকে পত্রসমূহের শেষে হিজরী তারিখ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

৫. সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার শুরুতে রাসূল (সা.)-এর একটি স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা হযরত জিবরাইল দিয়েছেন তা এরূপ : ইসলামের যাঁতাটি হিজরতের নবম ও দশম বর্ষ পর্যন্ত ঘুরবে। অতঃপর থেমে যাবে এবং হিজরতের ৩৫তম বছর থেকে পুনরায় তা পাঁচ বছরের জন্য ঘূর্ণায়মান থাকবে এবং সে সময় গোমরাহী তার সঠিক কেন্দ্রে আবর্তিত হবে।৩৯২

৬. মুসলিম হাদীসবিদগণ উল্লেখ করেছেন,রাসূল (সা.) উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাকে বলেছেন, আমার সন্তান হুসাইন হিজরতের ষাট বছরের মাথায় নিহত হবে। ৩৯৩

৭. আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.)-এর সঙ্গীরা আমাকে খবর দিয়েছেন,তিনি বলেছেন : আমার হিজরতের একশ বছর অতিক্রান্ত হলে তোমাদের সকলের চোখই বন্ধ হয়ে যাবে অর্থাৎ তোমরা সকলেই মৃত্যুবরণ করবে। ৩৯৪

৮. রাসূলের সাহাবিগণ তাঁর জীবদ্দশায় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাকে তাঁর হিজরতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করতেন। যেমন তাঁরা বলতেন,মসজিদুল আকসা (আল কুদস) থেকে কাবার দিকে কিবলা পরিবর্তন হিজরতের সপ্তদশ অথবা অষ্টাদশ মাসে সংঘটিত হয়েছিল।৩৯৫

রামাজান মাসের রোযা হিজরতের অষ্টাদশ মাসে ফরয করা হয়।৩৯৬

রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রেরিত মুবাল্লিগ আবদুল্লাহ্ ইবনে উনাইস বলেন, আমি হিজরতের চুয়ান্নতম মাসে মুহররমের পঞ্চম দিবসে সোমবারে মদীনা থেকে যাত্রা করি। ৩৯৭

মুহাম্মদ ইবনে সালমা কুরতার যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন, দশই মুহররম মদীনা থেকে বের হই। অতঃপর ১৯ দিন বাইরে থাকার পর হিজরতের পঞ্চান্নতম মাসের (মুহররম) শেষ দিনে মদীনায় ফিরে আসি। ৩৯৮

এরূপ তারিখ সম্বলিত করা থেকে বোঝা যায় যে,মুসলমানগণ পঞ্চম হিজরী পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা নবীর হিজরতের সঙ্গে মাসের তুলনা করে হিসাব রাখতেন। পঞ্চম হিজরী থেকে নবীর নির্দেশ মোতাবেক বর্ষ অনুযায়ী হিজরী সাল গণনা শুরু হয় যার নমুনা আমরা চার নম্বর উদাহরণে উল্লেখ করেছি যাতে নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্র হযরত আলী রাসূলের নির্দেশ মতো বর্ষ হিসাবে লিখেন।

৯. তদুপরি হাদীসবেত্তাগণ মুহাদ্দিস জুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন,যখন মহানবী মদীনায় প্রবেশ করেন (রবিউল আউয়াল মাসে) তখন স্বয়ং হিজরতের ভিত্তিতে দিনপঞ্জী নির্ধারণের নির্দেশ দান করেন।

১০. হাকিম নিশাবুরী ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন হিজরী সাল নবীর হিজরতের বছরেই প্রবর্তিত হয় এবং সে বছরই আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর জন্মগ্রহণ করেন।

এ সকল বর্ণনা প্রমাণ করে যে,ইসলামের মহান নেতা মহানবী (সা.) প্রথম মদীনায় পদার্পণ করেই তাঁর হিজরতের বছরকে ইসলামী বর্ষের শুরু বলে ঘোষণা করেন। তবে হিজরতের পর প্রথম পাঁচ বছর মাসের ভিত্তিতে তারিখ গণনা করা হতো এবং পঞ্চম হিজরীর পর থেকে তা বর্ষের ভিত্তিতে করা হয়।

একটি প্রশ্নের উত্তর

হয়তো কেউ বলবেন,যদি মহানবী স্বয়ং হিজরী বছরের ভিত্তিতে বর্ষপঞ্জী নির্ধারণ করে থাকেন তবে বিভিন্ন হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক যে ভিন্ন বর্ণনা করেছেন তার কারণ কি? যে সকল বর্ণনায় এসেছে যে,একবার এক ব্যক্তি তার পাওনা হিসাবের খাতা দ্বিতীয় খলীফার নিকট আনলে খলীফা লক্ষ্য করেন তাতে লেখা রয়েছে,এ হিসাবের সময়সীমা শাবান মাস পর্যন্ত। খলীফা তাকে জিজ্ঞাসা করেন,এর সময়সীমা এ বছরের শাবান মাস,নাকি গত বছরের,নাকি আগামী বছরের? তখন খলীফা নিজে অন্যান্য সাহাবীকে ডেকে আহবান জানান সাধারণের সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জী প্রস্তুত করার যাতে করে তারা তাদের দেনা-পাওনা আদায় ও পরিশোধের বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন না হয়। সাহাবীদের কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন ফার্সী বর্ষ অনুসরণের। ফার্সী বর্ষপঞ্জী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতায় অভিষিক্তের বর্ষের ভিত্তিতে ছিল। যখন কোন শাসক মারা যেত তখন অন্য শাসকের ক্ষমতায় অভিষিক্তের বছর বর্ষপঞ্জীর জন্য নির্ধারিত হতো। কেউ কেউ পরামর্শ দেন রোমীয় বর্ষপঞ্জী অনুসরণের। তারা আলেকজান্ডারের প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করত। কেউ কেউ বললেন,নবী (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির বছরের ভিত্তিতে বর্ষপঞ্জী নির্ধারিত হোক। এ সময় হযরত আলী (আ.) প্রস্তাব করলেন,নবী (সা.)-এর হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনা করা উচিত। কারণ নবীর জন্ম ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির বর্ষ অপেক্ষা হিজরতের বর্ষ আমাদের জন্য অধিকতর গুরুত্ববহ ছিল। হযরত উমর এ মতটি পছন্দ করেন ও নির্দেশ দেন নবীর হিজরতের বর্ষকে ইসলামী তারিখ হিসাবে গ্রহণের।৩৯৯ ইয়াকুবী তাঁর তারিখ গ্রন্থে বলেছেন,হিজরী বর্ষপঞ্জীর ঘোষণা ষোড়শ হিজরীতে দেয়া হয়েছিল।৪০০

জবাব

ইতিহাসের এ অংশটি মহানবী (সা.) কর্তৃক হিজরী বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের দলিলের বিপরীতে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও ইতিহাসের বর্ণনা সঠিক বলে ধরি তবে বলতে হবে,নবী (সা.) যে হিজরী বর্ষপঞ্জীর প্রবর্তন করেছিলেন তা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাপক প্রচলন লাভ করে নি এবং বিষয়টি দ্বিতীয় খলীফার সময় আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে।

দু টি দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়

১. দ্বিতীয় খলীফার আহবানের প্রেক্ষিতে মহানবীর সাহাবিগণ যে সকল পরামর্শ দিয়েছিলেন তার মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ভিত্তিতে প্রবর্তিত খ্রিষ্টীয় সালের কোন প্রস্তাব ছিল না। কারণ খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জী চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে খ্রিষ্টানগণ প্রচলন করে। ইতিপূর্বে এ বর্ষপঞ্জীর প্রচলন ছিল না।

২. বর্তমান সময়ে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পূর্বের সকল সময় অপেক্ষা ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। ইসলামী তারিখ ও বর্ষপঞ্জী ঐক্যসাধনের অন্যতম উপকরণ হতে পারে। এ কারণে সকল মুসলিম দেশ হিজরতের ভিত্তিতে (সৌরবর্ষ অথবা চান্দ্রবর্ষ ধরে) বর্ষপঞ্জীর প্রচলনের উদ্যোগ নিতে পারে এবং এর ভিত্তিতে কর্মসূচীসমূহ নির্ধারণ করতে পারে। মুসলিম দেশসমূহ তাদের ঐক্যকে দৃঢ়তর করার লক্ষ্যে এক বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারে যাতে ইসলামী বিশ্বের সকল বিশেষ ব্যক্তিত্ব সমবেত হয়ে পাশ্চাত্যের অনুসরণ হতে বেরিয়ে ইসলামী বর্ষপঞ্জী প্রতিস্থাপনের সম্ভাব্য পথ নির্ণয় ও উদ্যোগ নিতে পারেন।

খুবই দুঃখজনক যে,ইসলামী বিশ্বের অনেক দেশ,এমনকি আরব বিশ্বেরও অনেকেই হিজরী সালকে পাশ কাটিয়ে খ্রিষ্ট বর্ষপঞ্জীকে তাদের রাষ্ট্রীয় ও দৈনন্দিন সকল কাজের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে। এমনকি সুন্নী বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মশিক্ষা কেন্দ্র আল আযহারের প্রধানও তাঁর পত্রে খ্রিষ্ট বর্ষ অনুযায়ী তারিখ লিখে থাকেন;সেখানে হিজরী বর্ষের কোন উল্লেখও তিনি করেন না।৪০১

তাগুতী ষড়যন্ত্র

ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে ইরান পূর্ব থেকেই হিজরী বর্ষ অনুযায়ী তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ও এর সংরক্ষণে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু ইরানের তাগুতী শাসক ১৩৫৬ হিজরী সৌরবর্ষে এক ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ইসলামী বর্ষকে তাগুতী পাহলভী বর্ষে পরিবর্তনের প্রয়াস চালায়। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমসমূহে প্রচারণা শুরু হয় নতুন বর্ষপঞ্জী হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনার।

তাগুতী শাসক ভেবেছিল ইসলামী বর্ষপঞ্জী পরিবর্তন করে রাজকীয় পাহলভী বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের শাসনকে দৃঢ় করবে এবং তাদের অত্যাচারী শাসনকে আরো কিছু দিন অব্যাহত রাখবে। কিন্তু মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে ও আমাদের শ্রদ্ধেয় ও মহান শিক্ষক আয়াতুল্লাহ্ আল উযমা ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সাহসী এ জাতি এ ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। অবশেষে এ জাতির বিপ্লবী উত্থানে রাজতান্ত্রিক পাহলভী শাসনের মূলোৎপাটিত হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় এবং ইসলামী বর্ষপঞ্জী আবার প্রতিষ্ঠা পায়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে,ধর্মীয়,সামরিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল কর্মকাণ্ডে হিজরী চন্দ্র ও সৌর উভয় বর্ষের উল্লেখ অপরিহার্য। কারণ প্রথমটি আমাদের ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ পালন ও অনুষ্ঠানাদি উদযাপনে সহায়ক নির্দেশনা দেবে এবং দ্বিতীয়টি আমাদের অফিস-আদালতের কাজ,গ্রীষ্মকালীন ও অন্যান্য ছুটিকে নির্দিষ্ট করবে যাতে করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা সম্ভব হয়। তাই উভয় বর্ষই অনুসরণ অপরিহার্য। একটি বর্ষপঞ্জী সকল প্রয়োজন পূরণে সক্ষম নয়।

হিজরতের সফরনামা

হিজরতের জন্য রাসূলকে প্রায় চারশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা অতি উষ্ণ মরু আবহাওয়ায় অত্যন্ত কঠিন এবং এজন্য সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। দিনের আলোয় মক্কার কোন কাফেলার সাথে দেখা হতে পারে এ আশংকায় তাঁরা রাত্রিতে পথ চলতেন এবং দিনে বিশ্রাম করতেন।

সতর্কতা সত্ত্বেও এক উষ্ট্রারোহী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখে ফেলে এবং দ্রুত নিজ কাফেলার নিকট ফিরে এসে এ ঘটনা জানায়। কাফেলার অন্যতম সদস্য সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশাস মাদলাকী একাই পুরস্কার লাভের মনোবৃত্তিতে তাদেরকে বলল, তারা মুহাম্মদ ও তার সঙ্গী নয়,অন্য কেউ হবে। তোমাদের তাদের অনুসরণের প্রয়োজন নেই। অতঃপর সে মক্কায় পৌঁছে একটি দ্রুতগামী অশ্ব ও অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে রাসূলকে হত্যার উদ্দেশ্যে মদীনার পথে যাত্রা করে এবং নবী (সা.) ও তার সঙ্গীদ্বয়কে এক স্থানে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে পায়।

ইবনে আসির৪০২ বর্ণনা করেছেন,এ দৃশ্যের অবতারণা হলে মহানবীর সঙ্গী হযরত আবু বকর ভীত হয়ে পড়েন এবং পুনরায় রাসূলকে বলেন, আমরা কিরূপে বাঁচব? মহানবী (সা.) দ্বিতীয় বারের মতো নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন বলে তাঁকে সান্ত্বনা দেন।

অন্যদিকে অস্ত্র হাতে আত্মগর্বিত সুরাকা আরবের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভের আশায় নবীর রক্ত ঝরানোর উদ্দেশ্যে তাঁর দিকে অগ্রসর হলো। তিনি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! এ ব্যক্তির অনিষ্ট হতে আমাদের রক্ষা কর। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল সুরাকার অশ্ব উত্তেজিত হয়ে তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। সুরাকা বুঝতে পারল এর পেছনে কোন ঐশী কারণ রয়েছে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তার অসৎ উদ্দেশ্যের কারণেই তা ঘটেছে।৪০৩ তাই সে রাসূলকে অনুরোধ করল, আমার ক্রীতদাস ও অশ্ব তোমাকে দিলাম এবং তুমি আমার নিকট কিছু চাইলে আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি। রাসূল তাকে বললেন, তোমার কোন কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। আল্লামা মজলিসীর৪০৪ বর্ণনায় এসেছে,রাসূল তাকে বলেন, তুমি ফিরে যাও এবং অন্যদের আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখ। সুরাকা প্রত্যাবর্তনের পথে যাকেই দেখত তাকেই বলত এ পথে মুহাম্মদের কোন চি‎‎ হ্নই নেই।

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল জীবনী লেখক মদীনার পথে রাসূলের তেরটি মুজিযা প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি :

উম্মে মা বাদ নামে এক সম্মানিতা নারী ছিলেন। খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে তাঁর সকল মেষ দুধশূন্য হয়ে পড়েছিল। নবী (সা.) হিজরতের পথে তাঁর তাঁবু অতিক্রম করেন এবং লক্ষ্য করেন রুগ্ন ও শীর্ণকায় এক মেষ তাঁর তাঁবুর পাশে বাঁধা রয়েছে। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, হে উম্মে মা বাদ! এ মেষটির কি দুধ রয়েছে? তিনি জবাব দেন, এ মেষটি দুধ দেয়ার উপযোগিতা হারিয়েছে। মহানবী আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! এ মেষটিকে এ নারীর জন্য বরকতময় করে দাও। নবীর দোয়ার বরকতে মেষের স্তন থেকে দুধ ঝরে পড়তে লাগল। মহানবী তাঁকে একটি পাত্র আনতে বললেন ও স্বহস্তে দুধ দোহন করলেন। অতঃপর দুধপূর্ণ পাত্রটি উম্মে মা বাদের হাতে দিলেন। তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে ঐ মেষের দুধ হতে পান করালেন এবং নিজেও তা পান করলেন। আবার মেষকে দুইয়ে দুধ উম্মে মা বাদের হাতে দিয়ে সঙ্গীদ্বয়সহ মদীনার পথ ধরলেন।

মুজিযার এ ঘটনাটি বিভিন্ন ইতিহাস ও জীবনী গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। ঐশী শক্তিতে বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতির ওপর ক্রিয়াশীল কারণসমূহের অন্যতম হলো দোয়া। প্রকৃতির ওপর দোয়ার ক্রিয়াশীলতার বিষয়ে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে অসংখ্য উদাহরণ এসেছে এবং মানব অভিজ্ঞতাও এ বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করে।

কুবা গ্রামে রাসূল (সা.)-এর প্রবেশ

কুবা মদীনা থেকে দু ফারসাখ দূরের একটি গ্রাম যেখানে বনি আমর ইবনে আওফ গোত্র বাস করত। রাসূল (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল সেখানে পৌঁছে গোত্রপতি কুলসুম ইবনুল হাদামের গৃহে অবস্থান করেন। মদীনা থেকে আগত কিছু আনসার এবং মক্কার মুহাজিরদের অনেকেই সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মহানবী (সা.) সপ্তাহের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে হযরত আলীর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। অনেকেই তাঁকে দ্রুত মদীনায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি যান নি। কুবায় তিনি বনি আমর ইবনে আওফের জন্য একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।

হযরত আলী রাসূলের মক্কা ত্যাগের কয়েকদিন পর একটি উচ্চস্থানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন,

من كان له قبل محمد أمانة أو وديعة فليأت فلنودّ إليه أمانة

যারা মুহাম্মদের নিকট আমানত হিসাবে কিছু গচ্ছিত রেখেছ অথবা কাউকে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট দিয়েছ,তারা আমার নিকট থেকে তা নিয়ে যাও। ৪০৫

যারা নবীর নিকট কিছু আমানত রেখেছিল তারা প্রমাণ দেখিয়ে তা নিয়ে গেল। অতঃপর হযরত আলী (আ.) রাসূলের নির্দেশমতো হাশিমী বংশের নারীদেরসহ মদীনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। এঁদের মধ্যে নবীর কন্যা ফাতিমা (আ.),স্বীয় মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ এবং যুবাইরের কন্যা ফাতিমা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অন্য যে সব মুসলমান তখনও মদীনায় হিজরত করতে সক্ষম হন নি তিনি তাদেরও হিজরতের জন্য প্রস্তুত করেন। প্রস্তুতি সমাপ্ত হলে তিনি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এক রাত্রিতে যি তোয়া র পথ ধরে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন।

শেখ তুসী তাঁর আমালী ৪০৬ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,কুরাইশ গুপ্তচররা মুসলমানগণসহ হযরত আলীর মক্কা ত্যাগের বিষয়টি অবহিত হয় এবং তারা তাঁকে অনুসরণ করে দ্বাজনান নামক স্থানে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। দীর্ঘক্ষণ হযরত আলী ও তাদের মধ্যে তর্ক চলে এবং নারীরা ভীত হয়ে চিৎকার করে ক্রন্দন করতে থাকে। যখন আলী দেখলেন ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মান রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ ব্যতীত কোন উপায় নেই তখন তিনি তাদেরকে বললেন,

فمن سره أن أفرى لحمه و أهريق دمه فليدن منّي

তোমাদের মধ্যে যার ইচ্ছা তার দেহ ছিন্নভিন্ন ও তার রক্ত প্রবাহিত হোক (সে) আমার সামনে এসে দাঁড়াক। আলীর দৃঢ়তা ও রুদ্রমূর্তি দেখে তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং তাঁর পথ ছেড়ে দিয়ে মক্কায় ফিরে যায়।

ইবনে আসির বর্ণনা করেছেন,হযরত আলী যখন কুবায় পৌঁছান তখন তাঁর পা দু টি এতটা জখম হয়ে গিয়েছিল যে,তিনি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি ক্ষত-বিক্ষত পা নিয়ে বসে পড়েছিলেন। রাসূল (সা.)-কে খবর দেয়া হলে তিনি সেখানে পৌঁছে আলীকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি আলীর ক্ষত-বিক্ষত পদযুগল লক্ষ্য করে কেঁদে ফেলেন।৪০৭

রাসূলুল্লাহ্ ১২ রবিউল আউয়াল কুবায় পৌঁছেছিলেন এবং আলী ১৫ রবিউল আউয়াল সেখানে পৌঁছেন। এর সপক্ষে দলিল হলো তাবারী তাঁর তারিখ গ্রন্থে বলেছেন,আলী মহানবীর হিজরতের৪০৮ পর তিন দিন মক্কায় অবস্থান করেন ও আমানতসমূহ ফিরিয়ে দেন।৪০৯

মদীনায় আনন্দের ঢল

মদীনার জনসাধারণ হিজরতের তিন বছর পূর্বে রাসূলের ওপর ঈমান এনেছিলেন। প্রতি বছরই তাঁরা মক্কায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রতিনিধি দল পাঠাতেন। যে নবীর ওপর তাঁরা বিগত তিন বছর ধরে তাঁদের নামাযে দরুদ পড়েছেন,তাঁর পবিত্র নাম বারবার স্মরণ করেছেন,এখন তিনি মদীনার মাত্র দু ফারসাখ দূরে অবস্থান করছেন এবং খুব শীঘ্রই মদীনায় এসে পৌঁছবেন। মহানবীকে কাছে পাওয়া যাবে এ অনুভূতি তাঁদের মধ্যে আশ্চর্য শিহরণ এনেছিল। তাঁদের মধ্যে যে আনন্দ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল তা বর্ণনা করা কখনই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আনসার যুবকরা ইসলামের মহান ও প্রাণসঞ্চারক কর্মসূচীর জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল। তারা নবীর আগমনের পূর্বেই মদীনার পরিবেশকে যতটা সম্ভব মূর্তিপূজার আবহ ও চি হ্ন হতে মুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছিল। তারা মদীনার গৃহ ও বাজারগুলো থেকে মূর্তি অপসারণ করে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

মহানবী (সা.)-এর নামকরণ

মহানবী (সা.)-এর জন্মগ্রহণের পর সপ্তম দিবস উপস্থিত হলো। আবদুল মুত্তালিব মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য একটি দুম্বা যবেহ করলেন। মহানবীর নাম রাখার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে সকল কুরাইশ নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর নাম মুহাম্মদ’রাখলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন আপনার নাতির নাম মুহাম্মদ’রাখলেন,অথচ আরবদের মধ্যে এ নামটি অত্যন্ত বিরল? তখন তিনি বললেন, আমি চেয়েছিলাম যে,সে আকাশ ও পৃথিবীতে প্রশংসিত হোক।” এ সম্পর্কে কবি হাসসান ইবনে সাবিত লিখেছেন :

فشق له من اسمه ليبجله

فذو العرش محمود و هذا محمّد

নবীর সম্মান ও মর্যাদার জন্য স্রষ্টা তাঁর নিজ নাম থেকে তাঁর (নবীর) নাম নিষ্পন্ন করেছেন;তাই আরশের অধিপতি (মহান আল্লাহ্) মাহমুদ (প্রশংসিত) এবং ইনি (তাঁর নবী) মুহাম্মদ (অর্থাৎ প্রশংসিত)।”

আর এ দু টি শব্দই (মাহমুদ ও মুহাম্মদ) একই উৎসমূল (হাম্দ) থেকে উৎসারিত এবং উক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থও একই। নিঃসন্দেহে এ নাম চয়ন করার ক্ষেত্রে ঐশী অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। কারণ মুহাম্মদ নামটি যদিও আরবদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল,কিন্তু সে সময় খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তির নামই মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল। কতিপয় ঐতিহাসিক যে সূক্ষ্ম পরিসংখ্যান দিয়েছেন তদনুযায়ী ঐ দিন পর্যন্ত সমগ্র আরবে কেবল 16 ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ’রাখা হয়েছিল। তাই এতৎসংক্রান্ত কবির উক্তি প্রণিধানযোগ্য :

أنّ الّذين سموا باسم محمّد

من قبل خير النّاس ضعف ثمان

মহানবীর আগে যাদের নাম মুহাম্মদ রাখা হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল 8-এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ষোল। 132

বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে,একটি শব্দের বাস্তব নমুনা যত কম হবে এতে ভুলভ্রান্তিও তত কমে যাবে। আর যেহেতু পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ তাঁর নাম,চি হ্ন এবং আত্মিক ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই মহানবীর শনাক্তকারী নিদর্শন অবশ্যই এতটা উজ্জ্বল হতে হবে যে,তাতে কোন ভুলভ্রান্তির অবকাশই থাকবে না। তাঁর অন্যতম নিদর্শন তাঁর নাম। এ নামের বাস্তব নমুনা অর্থাৎ যাদের নাম মুহাম্মদ বাস্তবে তাদের সংখ্যা এতটা কম হবে যে,ব্যক্তি মহানবীকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সন্দেহ আর বিদ্যমান থাকবে না। বিশেষ করে যখন তাঁর পবিত্র নামের সাথে তাঁর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হবে। এমতাবস্থায় তাওরাত ও ইঞ্জিলে যে ব্যক্তির আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তাকে খুব স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

প্রাচ্যবিদদের ভুলভ্রান্তি

পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-কে দু বা ততোধিক নামে পরিচিত করিয়েছে।133 সূরা আলে ইমরান,সূরা মুহাম্মদ,সূরা ফাত্হ ও সূরা আহযাবের 138,2,29 ও 40 নং আয়াতে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে এবং সূরা সাফের 6 নং আয়াতে তাঁকে আহমদ’নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর এ দু নাম থাকার কারণ হচ্ছে এই যে,মহানবীর মা হযরত আমেনা দাদা আবদুল মুত্তালিবের আগেই তাঁর নাম আহমদ’রেখেছিলেন। আর এ বিষয়টি ইতিহাসেও উল্লিখিত হয়েছে।134 অতএব,কতিপয় প্রাচ্যবিদ যে দাবি করেছেন,সূরা সফের 6 নং আয়াতে পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিল শরীফ যে নবীর আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়েছে তাঁর নাম আহমদ,তিনি মুহাম্মদ নন;আর মুসলমানগণ যে ব্যক্তিকে তাদের নিজেদের নেতা বলে বিশ্বাস করে তিনি মুহাম্মদ,তিনি আহমদ নন”-তাঁদের এ দাবি সর্বৈব ভিত্তিহীন। কারণ পবিত্র কোরআন আমাদের নবীকে আহমদ’নামেও পরিচিত করিয়েছে এবং কতিপয় স্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’নামে অভিহিত করেছে। যদি এ নবীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তাঁদের দলিল পবিত্র কোরআনই হয়ে থাকে (আর এ ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যাপার ঠিক এটিই) তাহলে এ ক্ষেত্রে বলতে হয়,পবিত্র কোরআন তাঁকে এ দু টি নামেই অভিহিত করেছে অর্থাৎ একস্থানে তাঁকে মুহাম্মদ’এবং অন্যস্থানে আহমদ’নামে অভিহিত করেছে। এ আপত্তিটির মূলোৎপাটন করার জন্য আমরা নিচে আরো বেশি ব্যাখ্যা দেব।

আহমদ মহানবী (সা.)-এর নামসমূহের একটি

মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে যাঁদের সংক্ষিপ্ত তথ্য ও জ্ঞান রয়েছে তাঁরা জানেন যে,হযরত মুহাম্মদ (সা.) শৈশব ও বাল্যকাল থেকেই আহমদ’ও মুহাম্মদ’এ দু নামে পরিচিত ছিলেন। জনগণের কাছে তিনি এ দু নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর জন্য মুহাম্মদ’এবং তাঁর মা আমেনা আহমদ’নামটি মনোনীত করেছিলেন। এ বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত এবং সকল সীরাত রচয়িতা এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবং এতৎসংক্রান্ত বিশদ বর্ণনা সীরাতে হালাবীতে রয়েছে যা পাঠকবর্গ পড়ে দেখতে পারেন।135

দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর পিতৃব্য আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বর্ণনাধিক ভালোবাসা,মমতা ও স্নেহ দিয়ে পুরো 42 বছর মহানবীর পবিত্র অস্তিত্ব প্রদীপের চারদিকে পতঙ্গের মতো লেগে থেকেছেন। তিনি মহানবীর প্রাণ রক্ষা করার জন্য তাঁর নিজ জান-মাল উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবীর শানে যে কবিতা আবৃত্তি করেছেন তাতে তিনি কখনো তাঁকে মুহাম্মদ’নামে আবার কখনো আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। আর সে সাথে এ বিষয়টি থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,তখন থেকেই আহমদ’নামটি তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ নাম হিসাবেই প্রচলিত ছিল।

এখন আমরা নিচে নমুনাস্বরূপ আরো কতিপয় পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দেব যেগুলোতে তিনি মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছিলেন।

إن يكن ما أتى به أحمد اليوم

سناء و كان في الحشر دينا

“আজ আহমদ যা আনয়ন করেছেন তা আসলে নূর (আলো) এবং কিয়ামত দিবসের পুরস্কার।”

و قوله لأحمد أنت أمرء

خلوف الحديث ضعيف النسب

“শত্রুরা বলছে : আহমদের বাণী ও কথাগুলো নিরর্থক এবং সে নিম্নবংশীয় অর্থাৎ দুর্বল বংশমর্যাদার অধিকারী।”

و ان كان أحمد قد جاء هم

بحق و لم يأتهم بالكذب

“নিঃসন্দেহে আহমদ তাদের কাছে সত্যধর্ম সহকারে এসেছেন,তিনি কোন মিথ্যা ধর্ম নিয়ে আসেন নি।”

ارادو قتل أحمد ظالموه

و ليس بقتلهم  فيهم زعيم

“যারা আহমদের ওপর জুলুম করেছে তারা চেয়েছিল তাঁকে হত্যা করতে,কিন্তু এ কাজে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ ছিল না।”

ইতিহাস ও হাদীসশাস্ত্রের গবেষক,পণ্ডিত ও আলেমগণ যে সব কবিতা আবু তালিবের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলোতে তিনি তাঁর ভাতিজা মহানবী (সা.)-কে আহমদ’নামে অভিহিত করেছেন। যা কিছু এখন আমরা বর্ণনা করেছি তার সব কিছুই আমরা তাঁর দিওয়ান (কাব্যসমগ্র)-এর 19,25 ও 29 পৃষ্ঠা হতে নিয়েছি। এ ব্যাপারে আগ্রহী পাঠকবর্গকে আমরা নিম্নোক্ত দু টি গ্রন্থ অধ্যয়ন করার অনুরোধ করছি। গ্রন্থদ্বয় হলো :

1. আহমাদ,মওউদুল ইঞ্জিল (ইঞ্জিলের প্রতিশ্রুত নবী আহমদ),পৃ. 101-107;

2. মাফাহীমুল কোরআন।

মহানবীর স্তন্যপানের সময়কাল

নবজাতক শিশু মুহাম্মদ (সা.) কেবল তিনদিন মাতৃস্তন্য পান করেছিলেন। এরপর দু জন মহিলা মহানবীর স্তন্যদানকারিণী দাই মা হওয়ার গৌরব লাভ করেছিলেন। তাঁরা হলেন :

1. আবু লাহাবের দাসী সাভীবাহ্ : তিনি তাঁকে চার মাস স্তন্যদান করেছিলেন। তাঁর এ কাজের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রী হযরত খাদীজাহ্ তাঁর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি পূর্বে মহানবীর চাচা হযরত হামযাকেও স্তন্যদান করেছিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর মহানবী (সা.) আবু লাহাবের কাছ থেকে তাঁকে ক্রয় করার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন,কিন্তু আবু লাহাব তাঁকে বিক্রয় করতে সম্মত হয় নি। কিন্তু মহানবী তাঁকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সাহায্য করেছেন। মহানবী যখন খাইবার যুদ্ধ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন তিনি সাভীবার মৃত্যু সংবাদ পান এবং তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে গভীর শোক ও বেদনার চি হ্ন ফুটে ওঠে। তিনি সওবিয়ার সন্তান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন যাতে করে তাঁর ব্যাপারে তিনি ইহ্সান করতে পারেন। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন যে,সেও তার মায়ের আগে মৃত্যুবরণ করেছে।136

2. হালীমাহ্ বিনতে আবি যূইযাব : তিনি ছিলেন সা দ বিন বকর বিন হাওয়াযিন গোত্রীয়। তাঁর সন্তানদের নাম ছিল আবদুল্লাহ্,আনীসাহ্ ও শাইমা;তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মহানবীর সেবা-যত্ন করেছে। আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারবর্গের প্রথা ছিল তারা তাদের নবজাতক সন্তানদের ধাত্রী মায়েদের কাছে অর্পণ করত। এ সব দাই সাধারণত শহরের বাইরে বসবাস করত। যাতে করে মরুর নির্মল মুক্ত হাওয়া ও পরিবেশে কুরাইশদের নবজাতক শিশুরা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হয় ও সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠে এবং তাদের অস্থি দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়,শহরের বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি ও কলেরা যা নবজাতক শিশুদের জন্য ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক তা থেকে নিরাপদ থাকে সেজন্য কুরাইশরা তাদের নবজাতক সন্তানদের ঐ সব দাইয়ের হাতে তুলে দিত। কুরাইশ নবজাতকগণ দাই মায়েদের কাছে (আরব গোত্রসমূহের মাঝে প্রতিপালিত হওয়ার কারণে) বিশুদ্ধ আরবী ভাষা রপ্ত করে ফেলত। বনি সা দ গোত্রের দাইগণ এ ক্ষেত্রে খুবই খ্যাতি লাভ করেছিল। তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পবিত্র মক্কায় আসত এবং কোন নবজাতককে পেলেই নিজেদের সাথে নিয়ে যেত।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করার 4 মাস পরে বনি সা দের দাইগণ মক্কায় আসে এবং ঐ সময় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বলেই তারা সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাহায্যের প্রতি আগের চেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল।

কিছুসংখ্যক ঐতিহাসিক বলেন : কোন দাই হযরত মুহাম্মদকে দুধ দিতে রাজী হয় নি। তারা ইয়াতিম নয় এমন শিশুদের অগ্রাধিকার দিচ্ছিল। কারণ ঐ সব শিশুর পিতারা দাইদের বেশি সাহায্য করতে পারবে। তাই তারা অনাথ শিশুদের নিতে চাইত না,এমনকি হালীমাও নবজাতক হযরত মুহাম্মদকে নিয়ে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। তবে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন বলে কোন ব্যক্তিই তাঁর কাছে নিজ সন্তান অর্পণ করে নি। তিনি আবদুল মুত্তালিবের নাতিকেই অবশেষে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হালীমাহ্ তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, চল,খালি হাতে বাসায় না ফিরে এ অনাথ শিশুকেই গ্রহণ করি। আশা করা যায় যে,মহান আল্লাহর দয়া আমাদেরকেও শামিল করবে।” ঘটনাচক্রে তাঁর অনুমানই সত্য হলো। যে সময় থেকে তিনি অনাথ শিশু মহানবীর লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন সেদিন থেকেই মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহ তাঁর জীবনকে ঘিরে রেখেছিল।137

এ ঐতিহাসিক বর্ণনাটির প্রথম অংশ কাল্পনিক উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ বনি হাশিম বংশের সুমহান মর্যাদা এবং আবদুল মুত্তালিব-যাঁর দানশীলতা,পরোপকার এবং অভাবী-বিপদগ্রস্তদের সাহায্য প্রদানের বিষয়টি আপামর জনতার মুখে মুখে ফিরত তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের কারণে দাইগণ তো নবজাতক শিশু মুহাম্মদকে লালন-পালনের জন্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেই না,বরং তাঁকে নেয়ার জন্য তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এ কারণেই উপরিউক্ত ঐতিহাসিক বর্ণনার এ অংশ উপাখ্যান ব্যতীত আর কিছুই নয়।

অন্য দাইয়ের কাছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে না দেয়ার কারণ ছিল তিনি স্তন্যদানকারী কোন মহিলার স্তন মুখেই দিচ্ছিলেন না। অবশেষে হালীমাহ্ সাদীয়াহ্ এলে তিনি তাঁর স্তন মুখে দিয়েছিলেন। তাই তখন আবদুল মুত্তালিবের পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল।138

আবদুল মুত্তালিব হালীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোন্ গোত্রের? তিনি বললেন, আমি বনি সা দ গোত্রের।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, তোমার নাম কি? তিনি উত্তরে বললেন, হালীমাহ্।” আবদুল মুত্তালিব হালীমার নাম ও গোত্রের নাম শুনে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বললেন,بخّ بخّ سعد و حلم. خصلتان فيهما خير الدهر و عز الأبد يا حليمة বাহবা,বাহবা! হে হালীমাহ্ ! দু টি যথাযথ ও সুন্দর গুণ;একটি সৌভাগ্য [সাআদাত (سعادت )-যা থেকে হালীমার গোত্রের নাম বনি সা দ-এর উৎপত্তি)] এবং অপরটি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা [হিলমুন (حلم )-যা থেকে হালীমাহ্ নামের উৎপত্তি)] যেগুলোর মধ্যে রয়েছে যুগের কল্যাণ এবং চিরস্থায়ী সম্মান ও মর্যাদা। 139


19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61