চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103686
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103686 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হিজরী তারিখ সম্বলিত মহানবীর কয়েকটি পত্র

1. হযরত সালমান ফার্সী তাঁর ভ্রাতা ও পরিবারবর্গের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক একটি পত্র লেখার আহবান জানালে মহানবী হযরত আলীকে ডেকে পাঠান ও উপদেশমূলক একটি পত্র তাঁর দ্বারা লেখান যে পত্রের শেষে লেখা রয়েছে :

و كتب علي بن أبي طالب بأمر رسول الله في رجب سنة تسع من الهجرة

এ পত্রটি রাসূলের নির্দেশে আলী ইবনে আবি তালিব কর্তৃক লিখিত যা হিজরতের নবম বর্ষের রজব মাসে লেখা হলো। 388

2. প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক বালাজুরী তাঁর ফুতুহুল বুলদান গ্রন্থে মাকনার ইয়াহুদীদের সঙ্গে রাসূলের সম্পাদিত চুক্তির বিবরণ দিয়েছেন যা একজন মিশরীয় ব্যক্তি পুরাতন লাল চামড়ায় লিপিবদ্ধ দেখেছিল এবং তা নিজে লিখে রেখেছিল। সে ব্যক্তি বালাজুরীর নিকট সম্পূর্ণ পত্রটি পড়ে শোনায়। পত্রের শেষে বলা হয়েছে, আলী ইবনে আবু তালিব কর্তৃক নবম হিজরীতে লিখিত । উল্লেখ্য যে,যদিও আরবী ব্যাকরণবিধি অনুযায়ী আলী ইবনে আবি তালিব কর্তৃক লিখিত বলা উচিত,তা সত্ত্বেও পত্রে আলী ইবনে আবু তালিব বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ কুরাইশরা সকল অবস্থায়ই আব শব্দটিকে আবু উচ্চারণ করে থাকে। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ আসমায়ী এ বক্তব্যটি সত্য বলে স্বীকার করেছেন।

আল ওয়াসাকুস সিয়াসিয়া নামক গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ্ বলেছেন, আমি 1358 হিজরীতে পবিত্র মদীনা নগরীতে গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। সে সময় হযরত আলীর হস্তলিখিত কিছু পত্রের সন্ধান পেয়েছিলাম389 যাতে লেখা ছিল :أنا علي بن أبو طالب আমি আলী ইবনে আবু তালিব

3. দামেস্কের অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি যা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কর্তৃক লিখিত হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদের জীবন,সম্পদ ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা দান করা হয়েছিল তাতে লেখা ছিল তের হিজরীতে লিখিত হয়েছে390

আমরা জানি যে,দামেস্ক প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিজিত হয়। যে সকল ঐতিহাসিক বলেছেন,দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের নির্দেশে এবং হযরত আলীর পরামর্শে হিজরী বর্ষ প্রবর্তিত হয় তাঁরা মনে করেন,ষোড়শ অথবা সপ্তদশ হিজরীতে তা ঘটেছিল। অথচ এ পত্রটি এর চার বছর পূর্বে লিখিত এবং তাতে হিজরী তারিখ সংযুক্ত ছিল।

4. রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আলী নাজরানের খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সম্পাদিত যে সন্ধিপত্রটি লিখেন তাতে পঞ্চম হিজরী সাল সংযোজিত রয়েছে। পত্রে এরূপ লেখা রয়েছে :

و امر عليا أن يكتب فيه أنّه كتب لخمس من الهجرة

তিনি আলীকে লেখার নির্দেশ দেন,এ সন্ধি পত্রটি পঞ্চম হিজরীতে লিখিত হয়েছে। 391 এ বাক্যটি প্রমাণ করে যে,স্বয়ং রাসূলই হিজরী বর্ষের প্রবর্তক এবং তিনিই আলীকে পত্রসমূহের শেষে হিজরী তারিখ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

5. সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ার শুরুতে রাসূল (সা.)-এর একটি স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা হযরত জিবরাইল দিয়েছেন তা এরূপ : ইসলামের যাঁতাটি হিজরতের নবম ও দশম বর্ষ পর্যন্ত ঘুরবে। অতঃপর থেমে যাবে এবং হিজরতের 35তম বছর থেকে পুনরায় তা পাঁচ বছরের জন্য ঘূর্ণায়মান থাকবে এবং সে সময় গোমরাহী তার সঠিক কেন্দ্রে আবর্তিত হবে।392

6. মুসলিম হাদীসবিদগণ উল্লেখ করেছেন,রাসূল (সা.) উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাকে বলেছেন, আমার সন্তান হুসাইন হিজরতের ষাট বছরের মাথায় নিহত হবে। 393

7. আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.)-এর সঙ্গীরা আমাকে খবর দিয়েছেন,তিনি বলেছেন : আমার হিজরতের একশ বছর অতিক্রান্ত হলে তোমাদের সকলের চোখই বন্ধ হয়ে যাবে অর্থাৎ তোমরা সকলেই মৃত্যুবরণ করবে। 394

8. রাসূলের সাহাবিগণ তাঁর জীবদ্দশায় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাকে তাঁর হিজরতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করতেন। যেমন তাঁরা বলতেন,মসজিদুল আকসা (আল কুদস) থেকে কাবার দিকে কিবলা পরিবর্তন হিজরতের সপ্তদশ অথবা অষ্টাদশ মাসে সংঘটিত হয়েছিল।395

রামাজান মাসের রোযা হিজরতের অষ্টাদশ মাসে ফরয করা হয়।396

রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রেরিত মুবাল্লিগ আবদুল্লাহ্ ইবনে উনাইস বলেন, আমি হিজরতের চুয়ান্নতম মাসে মুহররমের পঞ্চম দিবসে সোমবারে মদীনা থেকে যাত্রা করি। 397

মুহাম্মদ ইবনে সালমা কুরতার যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন, দশই মুহররম মদীনা থেকে বের হই। অতঃপর 19 দিন বাইরে থাকার পর হিজরতের পঞ্চান্নতম মাসের (মুহররম) শেষ দিনে মদীনায় ফিরে আসি। 398

এরূপ তারিখ সম্বলিত করা থেকে বোঝা যায় যে,মুসলমানগণ পঞ্চম হিজরী পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা নবীর হিজরতের সঙ্গে মাসের তুলনা করে হিসাব রাখতেন। পঞ্চম হিজরী থেকে নবীর নির্দেশ মোতাবেক বর্ষ অনুযায়ী হিজরী সাল গণনা শুরু হয় যার নমুনা আমরা চার নম্বর উদাহরণে উল্লেখ করেছি যাতে নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্র হযরত আলী রাসূলের নির্দেশ মতো বর্ষ হিসাবে লিখেন।

9. তদুপরি হাদীসবেত্তাগণ মুহাদ্দিস জুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন,যখন মহানবী মদীনায় প্রবেশ করেন (রবিউল আউয়াল মাসে) তখন স্বয়ং হিজরতের ভিত্তিতে দিনপঞ্জী নির্ধারণের নির্দেশ দান করেন।

10. হাকিম নিশাবুরী ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন হিজরী সাল নবীর হিজরতের বছরেই প্রবর্তিত হয় এবং সে বছরই আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর জন্মগ্রহণ করেন।

এ সকল বর্ণনা প্রমাণ করে যে,ইসলামের মহান নেতা মহানবী (সা.) প্রথম মদীনায় পদার্পণ করেই তাঁর হিজরতের বছরকে ইসলামী বর্ষের শুরু বলে ঘোষণা করেন। তবে হিজরতের পর প্রথম পাঁচ বছর মাসের ভিত্তিতে তারিখ গণনা করা হতো এবং পঞ্চম হিজরীর পর থেকে তা বর্ষের ভিত্তিতে করা হয়।

একটি প্রশ্নের উত্তর

হয়তো কেউ বলবেন,যদি মহানবী স্বয়ং হিজরী বছরের ভিত্তিতে বর্ষপঞ্জী নির্ধারণ করে থাকেন তবে বিভিন্ন হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক যে ভিন্ন বর্ণনা করেছেন তার কারণ কি? যে সকল বর্ণনায় এসেছে যে,একবার এক ব্যক্তি তার পাওনা হিসাবের খাতা দ্বিতীয় খলীফার নিকট আনলে খলীফা লক্ষ্য করেন তাতে লেখা রয়েছে,এ হিসাবের সময়সীমা শাবান মাস পর্যন্ত। খলীফা তাকে জিজ্ঞাসা করেন,এর সময়সীমা এ বছরের শাবান মাস,নাকি গত বছরের,নাকি আগামী বছরের? তখন খলীফা নিজে অন্যান্য সাহাবীকে ডেকে আহবান জানান সাধারণের সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জী প্রস্তুত করার যাতে করে তারা তাদের দেনা-পাওনা আদায় ও পরিশোধের বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন না হয়। সাহাবীদের কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন ফার্সী বর্ষ অনুসরণের। ফার্সী বর্ষপঞ্জী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতায় অভিষিক্তের বর্ষের ভিত্তিতে ছিল। যখন কোন শাসক মারা যেত তখন অন্য শাসকের ক্ষমতায় অভিষিক্তের বছর বর্ষপঞ্জীর জন্য নির্ধারিত হতো। কেউ কেউ পরামর্শ দেন রোমীয় বর্ষপঞ্জী অনুসরণের। তারা আলেকজান্ডারের প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করত। কেউ কেউ বললেন,নবী (সা.)-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির বছরের ভিত্তিতে বর্ষপঞ্জী নির্ধারিত হোক। এ সময় হযরত আলী (আ.) প্রস্তাব করলেন,নবী (সা.)-এর হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনা করা উচিত। কারণ নবীর জন্ম ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির বর্ষ অপেক্ষা হিজরতের বর্ষ আমাদের জন্য অধিকতর গুরুত্ববহ ছিল। হযরত উমর এ মতটি পছন্দ করেন ও নির্দেশ দেন নবীর হিজরতের বর্ষকে ইসলামী তারিখ হিসাবে গ্রহণের।399 ইয়াকুবী তাঁর তারিখ গ্রন্থে বলেছেন,হিজরী বর্ষপঞ্জীর ঘোষণা ষোড়শ হিজরীতে দেয়া হয়েছিল।400

জবাব

ইতিহাসের এ অংশটি মহানবী (সা.) কর্তৃক হিজরী বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের দলিলের বিপরীতে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও ইতিহাসের বর্ণনা সঠিক বলে ধরি তবে বলতে হবে,নবী (সা.) যে হিজরী বর্ষপঞ্জীর প্রবর্তন করেছিলেন তা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাপক প্রচলন লাভ করে নি এবং বিষয়টি দ্বিতীয় খলীফার সময় আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে।

দু টি দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়

1. দ্বিতীয় খলীফার আহবানের প্রেক্ষিতে মহানবীর সাহাবিগণ যে সকল পরামর্শ দিয়েছিলেন তার মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ভিত্তিতে প্রবর্তিত খ্রিষ্টীয় সালের কোন প্রস্তাব ছিল না। কারণ খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জী চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে খ্রিষ্টানগণ প্রচলন করে। ইতিপূর্বে এ বর্ষপঞ্জীর প্রচলন ছিল না।

2. বর্তমান সময়ে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পূর্বের সকল সময় অপেক্ষা ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। ইসলামী তারিখ ও বর্ষপঞ্জী ঐক্যসাধনের অন্যতম উপকরণ হতে পারে। এ কারণে সকল মুসলিম দেশ হিজরতের ভিত্তিতে (সৌরবর্ষ অথবা চান্দ্রবর্ষ ধরে) বর্ষপঞ্জীর প্রচলনের উদ্যোগ নিতে পারে এবং এর ভিত্তিতে কর্মসূচীসমূহ নির্ধারণ করতে পারে। মুসলিম দেশসমূহ তাদের ঐক্যকে দৃঢ়তর করার লক্ষ্যে এক বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারে যাতে ইসলামী বিশ্বের সকল বিশেষ ব্যক্তিত্ব সমবেত হয়ে পাশ্চাত্যের অনুসরণ হতে বেরিয়ে ইসলামী বর্ষপঞ্জী প্রতিস্থাপনের সম্ভাব্য পথ নির্ণয় ও উদ্যোগ নিতে পারেন।

খুবই দুঃখজনক যে,ইসলামী বিশ্বের অনেক দেশ,এমনকি আরব বিশ্বেরও অনেকেই হিজরী সালকে পাশ কাটিয়ে খ্রিষ্ট বর্ষপঞ্জীকে তাদের রাষ্ট্রীয় ও দৈনন্দিন সকল কাজের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে। এমনকি সুন্নী বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মশিক্ষা কেন্দ্র আল আযহারের প্রধানও তাঁর পত্রে খ্রিষ্ট বর্ষ অনুযায়ী তারিখ লিখে থাকেন;সেখানে হিজরী বর্ষের কোন উল্লেখও তিনি করেন না।401

তাগুতী ষড়যন্ত্র

ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে ইরান পূর্ব থেকেই হিজরী বর্ষ অনুযায়ী তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ও এর সংরক্ষণে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু ইরানের তাগুতী শাসক 1356 হিজরী সৌরবর্ষে এক ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ইসলামী বর্ষকে তাগুতী পাহলভী বর্ষে পরিবর্তনের প্রয়াস চালায়। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমসমূহে প্রচারণা শুরু হয় নতুন বর্ষপঞ্জী হিসাবে কার্যক্রম পরিচালনার।

তাগুতী শাসক ভেবেছিল ইসলামী বর্ষপঞ্জী পরিবর্তন করে রাজকীয় পাহলভী বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের শাসনকে দৃঢ় করবে এবং তাদের অত্যাচারী শাসনকে আরো কিছু দিন অব্যাহত রাখবে। কিন্তু মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে ও আমাদের শ্রদ্ধেয় ও মহান শিক্ষক আয়াতুল্লাহ্ আল উযমা ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সাহসী এ জাতি এ ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। অবশেষে এ জাতির বিপ্লবী উত্থানে রাজতান্ত্রিক পাহলভী শাসনের মূলোৎপাটিত হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় এবং ইসলামী বর্ষপঞ্জী আবার প্রতিষ্ঠা পায়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে,ধর্মীয়,সামরিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল কর্মকাণ্ডে হিজরী চন্দ্র ও সৌর উভয় বর্ষের উল্লেখ অপরিহার্য। কারণ প্রথমটি আমাদের ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ পালন ও অনুষ্ঠানাদি উদযাপনে সহায়ক নির্দেশনা দেবে এবং দ্বিতীয়টি আমাদের অফিস-আদালতের কাজ,গ্রীষ্মকালীন ও অন্যান্য ছুটিকে নির্দিষ্ট করবে যাতে করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখা সম্ভব হয়। তাই উভয় বর্ষই অনুসরণ অপরিহার্য। একটি বর্ষপঞ্জী সকল প্রয়োজন পূরণে সক্ষম নয়।

হিজরতের সফরনামা

হিজরতের জন্য রাসূলকে প্রায় চারশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা অতি উষ্ণ মরু আবহাওয়ায় অত্যন্ত কঠিন এবং এজন্য সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। দিনের আলোয় মক্কার কোন কাফেলার সাথে দেখা হতে পারে এ আশংকায় তাঁরা রাত্রিতে পথ চলতেন এবং দিনে বিশ্রাম করতেন।

সতর্কতা সত্ত্বেও এক উষ্ট্রারোহী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখে ফেলে এবং দ্রুত নিজ কাফেলার নিকট ফিরে এসে এ ঘটনা জানায়। কাফেলার অন্যতম সদস্য সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশাস মাদলাকী একাই পুরস্কার লাভের মনোবৃত্তিতে তাদেরকে বলল, তারা মুহাম্মদ ও তার সঙ্গী নয়,অন্য কেউ হবে। তোমাদের তাদের অনুসরণের প্রয়োজন নেই। অতঃপর সে মক্কায় পৌঁছে একটি দ্রুতগামী অশ্ব ও অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে রাসূলকে হত্যার উদ্দেশ্যে মদীনার পথে যাত্রা করে এবং নবী (সা.) ও তার সঙ্গীদ্বয়কে এক স্থানে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে পায়।

ইবনে আসির402 বর্ণনা করেছেন,এ দৃশ্যের অবতারণা হলে মহানবীর সঙ্গী হযরত আবু বকর ভীত হয়ে পড়েন এবং পুনরায় রাসূলকে বলেন, আমরা কিরূপে বাঁচব? মহানবী (সা.) দ্বিতীয় বারের মতো নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন বলে তাঁকে সান্ত্বনা দেন।

অন্যদিকে অস্ত্র হাতে আত্মগর্বিত সুরাকা আরবের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভের আশায় নবীর রক্ত ঝরানোর উদ্দেশ্যে তাঁর দিকে অগ্রসর হলো। তিনি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! এ ব্যক্তির অনিষ্ট হতে আমাদের রক্ষা কর। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল সুরাকার অশ্ব উত্তেজিত হয়ে তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। সুরাকা বুঝতে পারল এর পেছনে কোন ঐশী কারণ রয়েছে এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তার অসৎ উদ্দেশ্যের কারণেই তা ঘটেছে।403 তাই সে রাসূলকে অনুরোধ করল, আমার ক্রীতদাস ও অশ্ব তোমাকে দিলাম এবং তুমি আমার নিকট কিছু চাইলে আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি। রাসূল তাকে বললেন, তোমার কোন কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। আল্লামা মজলিসীর404 বর্ণনায় এসেছে,রাসূল তাকে বলেন, তুমি ফিরে যাও এবং অন্যদের আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখ। সুরাকা প্রত্যাবর্তনের পথে যাকেই দেখত তাকেই বলত এ পথে মুহাম্মদের কোন চি‎‎ হ্নই নেই।

শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকল জীবনী লেখক মদীনার পথে রাসূলের তেরটি মুজিযা প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি :

উম্মে মা বাদ নামে এক সম্মানিতা নারী ছিলেন। খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে তাঁর সকল মেষ দুধশূন্য হয়ে পড়েছিল। নবী (সা.) হিজরতের পথে তাঁর তাঁবু অতিক্রম করেন এবং লক্ষ্য করেন রুগ্ন ও শীর্ণকায় এক মেষ তাঁর তাঁবুর পাশে বাঁধা রয়েছে। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, হে উম্মে মা বাদ! এ মেষটির কি দুধ রয়েছে? তিনি জবাব দেন, এ মেষটি দুধ দেয়ার উপযোগিতা হারিয়েছে। মহানবী আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! এ মেষটিকে এ নারীর জন্য বরকতময় করে দাও। নবীর দোয়ার বরকতে মেষের স্তন থেকে দুধ ঝরে পড়তে লাগল। মহানবী তাঁকে একটি পাত্র আনতে বললেন ও স্বহস্তে দুধ দোহন করলেন। অতঃপর দুধপূর্ণ পাত্রটি উম্মে মা বাদের হাতে দিলেন। তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে ঐ মেষের দুধ হতে পান করালেন এবং নিজেও তা পান করলেন। আবার মেষকে দুইয়ে দুধ উম্মে মা বাদের হাতে দিয়ে সঙ্গীদ্বয়সহ মদীনার পথ ধরলেন।

মুজিযার এ ঘটনাটি বিভিন্ন ইতিহাস ও জীবনী গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। ঐশী শক্তিতে বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব নয়। কারণ প্রকৃতির ওপর ক্রিয়াশীল কারণসমূহের অন্যতম হলো দোয়া। প্রকৃতির ওপর দোয়ার ক্রিয়াশীলতার বিষয়ে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে অসংখ্য উদাহরণ এসেছে এবং মানব অভিজ্ঞতাও এ বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করে।

কুবা গ্রামে রাসূল (সা.)-এর প্রবেশ

কুবা মদীনা থেকে দু ফারসাখ দূরের একটি গ্রাম যেখানে বনি আমর ইবনে আওফ গোত্র বাস করত। রাসূল (সা.) 12 রবিউল আউয়াল সেখানে পৌঁছে গোত্রপতি কুলসুম ইবনুল হাদামের গৃহে অবস্থান করেন। মদীনা থেকে আগত কিছু আনসার এবং মক্কার মুহাজিরদের অনেকেই সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মহানবী (সা.) সপ্তাহের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে হযরত আলীর আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। অনেকেই তাঁকে দ্রুত মদীনায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি যান নি। কুবায় তিনি বনি আমর ইবনে আওফের জন্য একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।

হযরত আলী রাসূলের মক্কা ত্যাগের কয়েকদিন পর একটি উচ্চস্থানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন,

من كان له قبل محمد أمانة أو وديعة فليأت فلنودّ إليه أمانة

যারা মুহাম্মদের নিকট আমানত হিসাবে কিছু গচ্ছিত রেখেছ অথবা কাউকে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট দিয়েছ,তারা আমার নিকট থেকে তা নিয়ে যাও। 405

যারা নবীর নিকট কিছু আমানত রেখেছিল তারা প্রমাণ দেখিয়ে তা নিয়ে গেল। অতঃপর হযরত আলী (আ.) রাসূলের নির্দেশমতো হাশিমী বংশের নারীদেরসহ মদীনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। এঁদের মধ্যে নবীর কন্যা ফাতিমা (আ.),স্বীয় মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ এবং যুবাইরের কন্যা ফাতিমা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অন্য যে সব মুসলমান তখনও মদীনায় হিজরত করতে সক্ষম হন নি তিনি তাদেরও হিজরতের জন্য প্রস্তুত করেন। প্রস্তুতি সমাপ্ত হলে তিনি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এক রাত্রিতে যি তোয়া র পথ ধরে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন।

শেখ তুসী তাঁর আমালী 406 গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,কুরাইশ গুপ্তচররা মুসলমানগণসহ হযরত আলীর মক্কা ত্যাগের বিষয়টি অবহিত হয় এবং তারা তাঁকে অনুসরণ করে দ্বাজনান নামক স্থানে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। দীর্ঘক্ষণ হযরত আলী ও তাদের মধ্যে তর্ক চলে এবং নারীরা ভীত হয়ে চিৎকার করে ক্রন্দন করতে থাকে। যখন আলী দেখলেন ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মান রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ ব্যতীত কোন উপায় নেই তখন তিনি তাদেরকে বললেন,

فمن سره أن أفرى لحمه و أهريق دمه فليدن منّي

তোমাদের মধ্যে যার ইচ্ছা তার দেহ ছিন্নভিন্ন ও তার রক্ত প্রবাহিত হোক (সে) আমার সামনে এসে দাঁড়াক। আলীর দৃঢ়তা ও রুদ্রমূর্তি দেখে তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং তাঁর পথ ছেড়ে দিয়ে মক্কায় ফিরে যায়।

ইবনে আসির বর্ণনা করেছেন,হযরত আলী যখন কুবায় পৌঁছান তখন তাঁর পা দু টি এতটা জখম হয়ে গিয়েছিল যে,তিনি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি ক্ষত-বিক্ষত পা নিয়ে বসে পড়েছিলেন। রাসূল (সা.)-কে খবর দেয়া হলে তিনি সেখানে পৌঁছে আলীকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি আলীর ক্ষত-বিক্ষত পদযুগল লক্ষ্য করে কেঁদে ফেলেন।407

রাসূলুল্লাহ্ 12 রবিউল আউয়াল কুবায় পৌঁছেছিলেন এবং আলী 15 রবিউল আউয়াল সেখানে পৌঁছেন। এর সপক্ষে দলিল হলো তাবারী তাঁর তারিখ গ্রন্থে বলেছেন,আলী মহানবীর হিজরতের408 পর তিন দিন মক্কায় অবস্থান করেন ও আমানতসমূহ ফিরিয়ে দেন।409

মদীনায় আনন্দের ঢল

মদীনার জনসাধারণ হিজরতের তিন বছর পূর্বে রাসূলের ওপর ঈমান এনেছিলেন। প্রতি বছরই তাঁরা মক্কায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রতিনিধি দল পাঠাতেন। যে নবীর ওপর তাঁরা বিগত তিন বছর ধরে তাঁদের নামাযে দরুদ পড়েছেন,তাঁর পবিত্র নাম বারবার স্মরণ করেছেন,এখন তিনি মদীনার মাত্র দু ফারসাখ দূরে অবস্থান করছেন এবং খুব শীঘ্রই মদীনায় এসে পৌঁছবেন। মহানবীকে কাছে পাওয়া যাবে এ অনুভূতি তাঁদের মধ্যে আশ্চর্য শিহরণ এনেছিল। তাঁদের মধ্যে যে আনন্দ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল তা বর্ণনা করা কখনই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আনসার যুবকরা ইসলামের মহান ও প্রাণসঞ্চারক কর্মসূচীর জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল। তারা নবীর আগমনের পূর্বেই মদীনার পরিবেশকে যতটা সম্ভব মূর্তিপূজার আবহ ও চি হ্ন হতে মুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছিল। তারা মদীনার গৃহ ও বাজারগুলো থেকে মূর্তি অপসারণ করে পুড়িয়ে দিয়েছিল।