চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106922 / ডাউনলোড: 9721
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

আমরা এখানে নবীর প্রতি মদীনার আনসারদের ভালোবাসার কিছু ক্ষুদ্র নমুনা তুলো ধরছি :

আমর ইবনে জুমুহ বনি সালমা গোত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিল। তার গৃহে একটি বিশেষ মূর্তি ছিল। মদীনার যুবকরা এ মূর্তির অক্ষমতা প্রমাণের জন্য তার গৃহ থেকে সেটি চুরি করে নিয়ে আসে ও তার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত পায়খানার গর্তে তা ফেলে দেয়। সে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মূর্তিটি সেখানে পায় এবং সেটি ধুয়ে-মুছে স্বস্থানে পুনঃস্থাপন করে। কিন্তু যুবকরা আবার তা চুরি করে ঐ গর্তে ফেলে দেয়। এভাবে তিন বার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে সে মূর্তিটির ঘাড়ে একটি তরবারি ঝুলিয়ে মূর্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে যদি এ বিশ্বে তোমার কোন ক্ষমতা থাকে তবে নিজেকে এর মাধ্যমে রক্ষা কর। কিন্তু তার এ কর্ম কোন ফল দেয় নি। যুবকরা পুনরায় তা চুরি করে একটি কুকুরের মৃতদেহের সঙ্গে বেঁধে অন্য একটি গর্তে ফেলে দেয়। সে অনেক খোঁজার পর ঐ গর্তে মূর্তিটিকে তরবারিহীন অবস্থায় পায়। এ ঘটনা থেকে সে বুঝতে পারে,মানুষ মাটি ও পাথরের মূর্তির সামনে অবনত হওয়া হতে ঊর্ধ্বের এক অস্তিত্ব। অতঃপর সে নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করে :

تالله لو كنت إلها لم تكن

أنت و كلب وسط بئر في قرن

فالحمد لله العلى ذي المنن

ألواهب الرزاق و ديان الدين

هو الذي انقذنى من قبل أن

أكون في ظلمة قبر مرتهن

যদি তুমি উপাস্য হতে তবে কখনই মৃত কুকুরের সঙ্গে একত্রে এক গর্তে পড়ে থাকতে না। সে আল্লাহর প্রশংসা যিনি নেয়ামতের অধিকারী,রিযিকদাতা ও পুরস্কারদাতা। তিনিই আমাকে কবরের অন্ধকার হতে মুক্তি দিয়েছেন। ৪১০

রাসূল (সা.) মদীনার দিকে যাত্রা করে মদীনার সন্নিকটে অবস্থিত সানিয়াতুল বিদা নামক স্থানে পৌঁছলে মুসলমানগণ ও মদীনার যুবকরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসল। তারা স্বাগতসূচক গান গেয়ে মদীনার অকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলল। তাদের পঠিত গজলটি ছিল নিম্নরূপ :

طلع البدر علينا

من ثنيات الوداع

وجب الشّكر علينا

ما دعا لله داع

أيّها المبعوث فينا

جئت بالأمر المطاع

সানিয়াতুল বিদা হতে চন্দ্র উদিত হয়েছে,আমাদের ওপর এ নেয়ামতের শোকর করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। হে সেই মহান যাঁকে আল্লাহ্ আমাদের হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছেন এবং যাঁর নির্দেশ আমাদের নিকট অবশ্য পালনীয়।

আমর ইবনে আওফ গোত্র নবীর প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়ে বলল, আমরা অত্যন্ত পরিশ্রমী,যোদ্ধা ও সংগ্রামী জাতি। আপনি আমাদের মাঝেই থেকে যান। রাসূল (সা.) তাঁর অসম্মতির কথা তাদেরকে বুঝিয়ে বললেন। রাসূল মদীনার নিকটবর্তী হয়েছেন জানতে পেরে আওস ও খাজরাজ গোত্র তরবারী হাতে গজল গেয়ে তাঁর অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে এল। তারা তাঁর উটের চারিদিক ঘিরে ধরল। তিনি যখনই যে গোত্রের এলাকা অতিক্রম করছিলেন ঐ গোত্রের লোকেরা তাঁর উটের রশি ধরে টেনে আহবান জানাচ্ছিল তাদের গোত্রের মেহমান হওয়ার জন্য। নবী (সা.) তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,خلوا سبيلها فانها مامورة উটের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত কর,সে-ই দায়িত্বপ্রাপ্ত (অর্থাৎ উট যেখানে বসে পড়বে সেখানেই আমি নামব)। অবশেষে উটটি আসআদ ইবনে জুরারাহ্৪১১ নামক এক ব্যক্তির অভিভাবকত্বে থাকা সাহল ও সুহাইল নামক দু ইয়াতীমের অধিকৃত স্থানে বসে পড়ে। স্থানটি খেজুর ও অন্যান্য ফসল শুকানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর গৃহ এর সন্নিকটেই ছিল। তাঁর মাতা চতুরতার সাথে গোপনে রাসূলের আসবাবপত্র তাঁর গৃহে নিয়ে উঠালেন। এদিকে সকলে নবীকে নিজ গৃহে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। মহানবী তাদের থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,أين الرحل (আমার) আসবাবপত্র কোথায়? সকলে বলল, আবু আইয়ুবের মাতা তা নিয়ে গেছেন। মহানবী বললেন,المرء مع رحله লোকেরা সেখানেই ওঠে যেখানে তার আসবাবপত্র থাকে। অতঃপর আসআদ ইবনে জুরারাহ্ উটের রশি ধরে নবীকে সেখানে পৌঁছে দেন।

নিফাকের উৎপত্তি

আওস ও খাজরাজ গোত্র মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে (মুনাফিক নেতা বলে প্রসিদ্ধ) মদীনার সর্বময় নেতা বলে গ্রহণ করার। কিন্তু নবীর সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় ঐ সিদ্ধান্ত কার্যত বাতিল হয়ে পড়েছিল। ফলে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহর অন্তরে ইসলামের মহান নেতা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠে এবং শেষ জীবন পর্যন্ত সে অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে নি। সে যখন রাসূলের প্রতি আওস ও খাজরাজ গোত্রের হৃদয় নিংড়ানো অভ্যর্থনা লক্ষ্য করল তখন তার অন্তরে বিদ্যমান হিংসা ও শত্রুতা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

يا هذا إذهب إلى الذين غرّوك و أتوابك فانزل عليهم و لا تغشنا في ديارنا

হে অনাহুত! যারা তোমাকে প্রতারিত করেছে তাদের নিকট ফিরে যাও,আমাদের প্রতারিত করতে এখানে এসো না। ৪১২

মহানবী যেন তার কথায় সকলের প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ না হন এজন্য সা দ ইবনে উবাদা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে বললেন, এ ব্যক্তি আপনার প্রতি বিদ্বেষবশত এ কথা বলেছে। যেহেতু সে আওস ও খাজরাজের একচ্ছত্র নেতা হতে যাচ্ছিল এবং আপনার আগমনের মাধ্যমে তা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে মহানবী (সা.) শুক্রবার মদীনায় প্রবেশ করেন এবং বনি সালিম গোত্রের আবাসস্থলের নিকট সাহাবীদের নিয়ে জুমআর নামায পড়েন। তিনি নামাযের পূর্বে একটি অনলবর্ষী খুতবা দেন যা তারা পূর্বে কখনই শোনে নি এবং এ ধরনের শব্দ ও বাক্যের সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিল না। এ খুতবা তাদের অন্তরে গভীর ও চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে। ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে এবং আল্লামা মাজলিসী তাঁর বিহার গ্রন্থে খুতবাটি বর্ণনা করেছেন।৪১৩ অবশ্য আল্লামা মাজলিসীর বক্তব্যের সঙ্গে ইবনে হিশামের বর্ণনার পার্থক্য রয়েছে।

ছাব্বিশতম অধ্যায় : হিজরতের প্রথম বর্ষের ঘটনাপ্রবাহ

হিজরতের প্রথম বর্ষের৪১৪ ঘটনাপ্রবাহ

মহানবীর প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহ

মসজিদ : ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র

আনসার যুবক এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের অধিকাংশ ব্যক্তির উষ্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা মহানবীকে ঐক্যবদ্ধ সুন্দর সমাজ গঠনের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি জ্ঞানচর্চা,প্রশিক্ষণ,রাজনীতি ও বিচারকার্য সম্পাদনের কেন্দ্র হিসাবে মসজিদকে বেছে নিয়েছিলেন। যেহেতু তাওহীদ বা একত্ববাদের বিষয়টি ইসলামী কর্মসূচীর প্রথম ধাপ সেহেতু তিনি সব কিছুর পূর্বে এক আল্লাহর ইবাদাত ও স্মরণের লক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য মসজিদ তৈরি করেন।

ইসলামের সৈনিকগণ যেন প্রতি সপ্তাহের বিশেষ দিনে সেখানে সমবেত হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণের বিষয়ে পরামর্শ করতে পারে সে লক্ষ্যেও নবী (সা.) এ কেন্দ্রটি স্থাপন করেছিলেন। মুসলমানগণ সেখানে প্রত্যহ সমবেত হতেন এবং বছরে দু বার ঈদের জামায়াতে সকল প্রান্ত হতে মুসলমানগণ সেখানে আসতেন।

মসজিদ শুধু ইবাদাতের কেন্দ্রই ছিল না,বরং সে সাথে ইসলামী বিধিবিধান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কার্যক্রমও সেখানে সম্পাদিত হতো। ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা ছাড়াও লিখন ও পঠন শিক্ষা দান করা হতো। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত মসজিদ পাঞ্জেগানা নামাযের বাইরের সময়গুলোতে মাদ্রাসা বা দীনী শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।৪১৫ পরবর্তীতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ রূপে আবির্ভূত হয়। ইসলামের অনেক মনীষীই মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ও পাঠচক্রের ফসল।

কখনো কখনো মদীনার মসজিদ সাহিত্য চর্চা কেন্দ্রের রূপ নিত। আরবের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ তাঁদের রচিত যে সব কবিতা ইসলামী নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণপদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল ছিল তা মসজিদে নববীর সামনে পাঠ করে শুনাতেন। আরবের বিশিষ্ট কবি কা ব ইবনে যুহাইর মহানবী (সা.)-এর প্রশংসায় রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ বানাত সুয়াদ কাসীদাটি এ মসজিদেই মহানবীর সামনে পাঠ করে শুনান এবং তাঁর নিকট থেকে মূল্যবান পুরস্কার লাভ করেন। অপর এক প্রসিদ্ধ কবি হাসসান ইবনে সাবিত,যিনি ইসলাম ও নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসায় অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি এ মসজিদেই তাঁর কবিতাসমূহ পাঠ করে শুনাতেন।

মহানবী (সা.)-এর সময় মদীনার মসজিদে শিক্ষার আসরগুলো এতটা আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত ছিল যে,বনি সাকিফের সফরকারী প্রতিনিধিরা তা দর্শনে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। ধর্মীয় বিধিবিধান ও জ্ঞান শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ লক্ষ্য করে তারা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল।

অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের কার্যটিও মসজিদে সম্পাদিত হতো। সে সময় মসজিদ প্রকৃত অর্থেই একটি বিচারালয় ছিল। এ ছাড়া কাফির ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জিহাদের আহবান জানিয়ে অনলবর্ষী বক্তৃতাসমূহ রাসূল (সা.) মসজিদেই দিতেন। সম্ভবত ধর্ম ও জ্ঞানকে মসজিদে সমন্বিত করার যে প্রয়াস মহানবী নিয়েছিলেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল এই যে,তিনি দেখিয়ে যেতে চেয়েছেন জ্ঞান ও ঈমান (বিশ্বাস) পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই যেখানেই ঈমানের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন একই সঙ্গে তা জ্ঞানকেন্দ্রও হতে হবে। বিচারকার্য,সামাজিক সেবাদান ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ঘোষণা প্রদানের কার্যসমূহ মসজিদে এ লক্ষ্যেই সম্পাদিত হতো যে,নবী (সা.) বুঝাতে চেয়েছেন তাঁর প্রতি অবতীর্ণ শরীয়ত শুধু আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়,বরং মানুষের বৈষয়িক কার্যসমূহও তার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এ ধর্ম মানুষকে ঈমান ও তাকওয়ার দিকেই শুধু দাওয়াত দেয় না,সে সাথে সমাজ সংস্কার ও পরিচালনার বিষয়ের প্রতিও দৃষ্টি দেয় এবং এ দিকগুলোর প্রতি অসচেতন নয়।

জ্ঞান ও ঈমানের সমন্বয়ের বিষয়টি এখনও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান। এ কারণেই মহানবীর যুগের পরবর্তী সময়ে যখন শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ বিশেষ রূপধারণ করে তখনও দেখা গেছে মসজিদকে কেন্দ্র করেই শিক্ষাঙ্গন ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা (মুসলমানগণ) বিশ্ববাসীর নিকট প্রমাণ করতে চেয়েছে যে,মানুষের সৌভাগ্যের নিয়ামক এ দু টি উপকরণ (জ্ঞান ও ঈমান) পরস্পর অবিচ্ছেদ্য।

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149


20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61