চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103685
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103685 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের ঘটনা

মহানবী (সা.)-এর উটটি যেখানে বসে পড়েছিল সে স্থানটি দশ দিনারে ক্রয় করা হয়েছিল। সকল মুসলমানই মসজিদ ও গৃহ নির্মাণে হাতে হাত রেখে সেখানে কাজ করছিলেন,এমনকি মহানবীও অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে পাথর আনয়নের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উসাইদ ইবনে হাদির (হাজীর) নামক এক আনসার নবীর নিকট গিয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বসুন,আমরা এ পাথর বয়ে নিয়ে যাই। তিনি তাঁকে বলেন,إذهب فاحمل غيره যাও অন্য পাথর নিয়ে আস। নবী (সা.) তাঁর এ কর্মের মাধ্যমে তাঁর মহান মিশনে তিনি যে শুধু কথায় নয়,কাজেও অনুরূপ তা বুঝিয়ে দেন। এ সময় একজন মুসলমান নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করে :

لئن قعدنا و النّبيّ يعمل

فذاك منّا العمل المضلّل

যদি আমরা বসে থাকি আর নবী কাজ করেন,

তবে তা আমাদের বিচ্যুতির কারণ হবে।

নবী করীম (সা.) ও অন্যান্য মুসলমান কাজ করার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ছিলেন :

لا عيش إلّا عيش الآخرة اللهم ارحم الأنصار و المهاجرة

প্রকৃত জীবন আখেরাতের জীবন। হে আল্লাহ্! আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।

হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান সব সময় মাটি ও ধুলা-বালি থেকে দূরে থাকতেন এবং পোশাকের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন। এ কারণেই মসজিদ নির্মাণের সময় তিনি তাঁর পোশাক পরিষ্কার রাখার নিমিত্তে অন্যান্যের বিপরীতে কাজে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির হযরত আলীর নিকট থেকে একটি কবিতা শিখেছিলেন যা ঐ সকল ব্যক্তির সমালোচনায় রচিত ছিল যারা ধুলা-বালি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে কাজ হতে বিরত থাকে। হযরত উসমানের কাজের সমালোচনায় হযরত আম্মার এ কবিতাটি পাঠ করছিলেন :

لا يستوي من يعمر المساجدا

يدأب فيها قائما قاعدا

و من يرى عن الغبار حائدا

কবিতাটির ভাবার্থ এরূপ যে,যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণের জন্য দাঁড়িয়ে এবং বসে সর্বদা প্রচেষ্টায় লিপ্ত এবং যে ব্যক্তি ধুলা-বালি থেকে বাঁচা এবং পোশাক পরিষ্কার রাখার নিমিত্তে মসজিদ নির্মাণ করা থেকে বিরত থাকে তারা উভয়ে সমান নয়।416

কবিতাটির উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে হযরত উসমান খুবই রাগান্বিত হলেন এবং তাঁর হাতের লাঠিটি আম্মারকে দেখিয়ে বললেন, এ লাঠি দিয়ে তোমার নাক ভেঙে দিলে বুঝতে পারবে। মহানবী (সা.) ঘটনাটি সম্পূর্ণ জানতে পেরে বলেন, আম্মারকে ছেড়ে দাও,আম্মার তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান জানাচ্ছে আর তারা তাকে আহবান জানাচ্ছে দোযখের দিকে।

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির ইসলামের সেবক ও এক শক্তিশালী যুবক ছিলেন। তিনি মসজিদ নির্মাণের সময় কয়েকটি করে পাথর বহন করছিলেন। কেউ কেউ তাঁর নিষ্ঠা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে তাঁর প্রতি অবিচার করছিল এবং তাঁর ক্ষমতার অধিক পাথর তাঁর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিল। হযরত আম্মার বলেন, আমি একটি পাথর নিজের নিয়্যতে এবং অপর একটি পাথর রাসূল (সা.)-এর নিয়্যতে বহন করছিলাম। একবার রাসূল (সা.) তাঁকে তিনটি পাথর বহন করতে দেখলেন। আম্মার রাসূলের উদ্দেশে অনুযোগের সুরে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আপনার সঙ্গীদের আমার প্রতি মন্দ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তারা আমার মৃত্যু কামনা করে;তারা প্রত্যেকে একটি করে পাথর বহন করে,অথচ আমার কাঁধে তিনটি করে পাথর চাপিয়ে দেয়। নবী (সা.) তাঁর হাত ধরে পিঠের ধুলা-বালি পরিষ্কার করতে লাগলেন এবং ঐতিহাসিক এ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন : তারা তোমার হত্যাকারী নয়,তোমার হত্যাকারী একদল অত্যাচারী ব্যক্তি। (তারা তোমাকে হত্যা করবে) তুমি তাদেরকে সত্যের দিকে আহবানকারী অবস্থায়। 417

মহানবী (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর সত্যবাদিতা ও নবুওয়াতের আরেকটি প্রমাণ। মহানবী যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনিভাবেই ঘটনাটি ঘটেছিল। কারণ পরিশেষে হযরত আম্মার 90 বছর বয়সে সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধরত অবস্থায় মুয়াবিয়ার অনুচরদের দ্বারা নিহত হন। হযরত আম্মারের জীবদ্দশায় এ গায়েবী খবর মুসলমানদের ওপর আশ্চর্য প্রভাব ফেলেছিল। তারা রাসূলের এ ভবিষ্যদ্বাণীর পর হযরত আম্মারকে সত্যের মানদণ্ড মনে করত এবং হযরত আম্মার কোন্ পক্ষে যোগ দিচ্ছেন তা দেখে ঐ পক্ষের দাবির সত্যতা যাচাই করত।

সিফ্ফিনের যুদ্ধে যখন হযরত আম্মার শহীদ হন তখন মুয়াবিয়ার বাহিনীর সিরীয়দের মধ্যে আশ্চর্যজনক মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। যে সব ব্যক্তি মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আসের বিষাক্ত অপপ্রচারে হযরত আলীর সত্যতার বিষয়ে সন্দেহে পতিত হয়েছিল তাদের অনেকেরই তখন সন্দেহের অপনোদন হয়। হুজাইমা ইবনে সাবিত আনসারী যিনি হযরত আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনে গিয়েছিলেন,কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন,তিনি আম্মার ইবনে ইয়াসিরের শাহাদাতের পর তরবারি উন্মুক্ত করেন ও সিরীয় বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।418

জুলকালা হামিরি 20 হাজার সৈন্য নিয়ে (যাদের সকলেই তার গোত্রভুক্ত ছিল) হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিফ্ফিনে এসেছিল। এ যুদ্ধের জন্য মুয়াবিয়া তার ওপরেই বেশি নির্ভর করছিলেন এবং তার সাহায্যের আশ্বাস পেয়েই তিনি যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতারিত এ গোত্রপতি সিফ্ফিনে এসে যখন শুনল যে,আম্মার ইবনে ইয়াসির আলীর পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছেন তখন সে যেন প্রকম্পিত হলো। মুয়াবিয়ার অনুচররা সিফ্ফিনে হযরত আম্মারের উপস্থিতির বিষয়টি তার নিকট সন্দেহপূর্ণ করার নিমিত্তে বলল,আম্মার সিফ্ফিনে আসেন নি এবং ইরাকীরা মিথ্যা প্রচারে অভ্যস্ত বলে আম্মার সিফ্ফিনে এসেছেন বলে প্রচার করছে। কিন্তু জুলকালা এতে সন্তুষ্ট হলো না,সে আমর ইবনুল আসকে লক্ষ্য করে বলল, নবী (সা.) কি আম্মার সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন? আমর ইবনুল আস বলল, হ্যাঁ,নবী (সা.) এমন কথা বলেছেন। কিন্তু আম্মার আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনে আসেন নি। জুলকালা বলল, আমি নিজেই বিষয়টি যাচাই করতে চাই। তাই সে তার গোত্রের কিছু লোককে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য খোঁজ-খবর নিতে বলল। মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আস সত্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত হলেন। কারণ এর ফলে সিরীয় বাহিনীর মধ্যে অনৈক্যের সম্ভাবনা ছিল। পরবর্তীতে সিরীয় এ সেনা ও গোত্রপতি রহস্যজনকভাবে নিহত হয়।

হযরত আম্মার সম্পর্কিত এ হাদীসটি শিয়া-সুন্নী উভয় সূত্রেই এতটা প্রসিদ্ধ যে,হাদীসটির সূত্র উল্লেখের তেমন প্রয়োজন পড়ে না।

আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন,যখন সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আম্মার শহীদ হলেন তখন আমর ইবনে হাজম আমর ইবনুল আসের নিকট এসে বললেন,আম্মার নিহত হয়েছেন এবং রাসূল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন :تقتله الفئة الباغية তাকে একদল বিদ্রোহী জালেম হত্যা করবে। আমর ইবনুল আস আর্তনাদ করে বলল, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন তিনি মুয়াবিয়াকে গিয়ে ঘটনাটি জানালেন। মুয়াবিয়া এ কথা শ্রবণে বললেন, আমরা আম্মারের হত্যাকারী নই,বরং আলী ও তার অনুসারীরা তাকে হত্যা করেছে। কারণ তারা তাকে সঙ্গে করে এনেছে এবং আমাদের তরবারির মুখে ঠেলে দিয়েছে। 419

এটি সুস্পষ্ট যে,মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এরূপ অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সিরীয় সেনাদের অবচেতন করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। এরূপ ব্যাখ্যা কখনই আল্লাহর ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে গ্রহণীয় নয়। তাই বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন ব্যক্তি বুঝবেন এরূপ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। যদি মুয়াবিয়ার এ কথাটি গ্রহণ করা হয় তবে তা স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করার নামান্তর। অর্থাৎ স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে ইজতিহাদকে গ্রহণ এবং এরূপ কর্ম সম্পূর্ণ মন্দ। এরূপ বাতিল ইজতিহাদই (যার অবস্থান কোরআনের আয়াত ও হাদীসের বাণীর সম্পূর্ণ বিপরীতে) পরবর্তী সময়ে অনেক বড় অপরাধীর অপরাধকে অপব্যাখ্যা করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

উপরিউক্ত ঘটনাকে কিরূপে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে তার নমুনা আমরা নিম্নে বর্ণনা করছি :

অষ্টম হিজরী শতাব্দীর বিশিষ্ট সিরীয় ঐতিহাসিক আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের রচয়িতা ইবনে কাসির এরূপ অপব্যাখ্যাকারীদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ঐতিহাসিক মুয়াবিয়ার সমর্থনে তাঁর গ্রন্থে420 বলেছেন, নবী (সা.) যে হযরত আম্মারের হত্যাকারীদের জালেম বলে অভিহিত করেছেন তার অর্থ এ নয় যে,তারা কাফির। কারণ যদিও তারা ভুল করেছেন এবং হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন,কিন্তু তাঁরা ঈমান নিয়েই ইজতিহাদের ভিত্তিতে এটি করেছেন। এ কারণেই তাঁদেরকে কাফির ও বিভ্রান্ত বলা যাবে না। অতঃপর তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) যে বলেছেন: আম্মার তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান জানাবে,কিন্তু আম্মারের হত্যাকারীরা তাকে দোযখের দিকে আহবান করবে421 -এর অর্থ হযরত আম্মার তাদেরকে ঐক্যের দিকে আহবান করবেন যা বেহেশতের নামান্তর,কিন্তু আম্মারের হত্যাকারীরা হযরত আলী খেলাফতের জন্য সবচেয়ে উপয্ক্তু জানা সত্ত্বেও মুয়াবিয়াকে তাদের নেতা নির্বাচিত করায় ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র শাসনকর্তার আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত করে মুসলমানদের মধ্যে গভীর বিভেদ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করেছে যা নবী (সা.) দোযখ বলে অভিহিত করেছেন।

আমরা এ বিষয়ে যতই চিন্তা করি না কেন এ অপব্যাখ্যাকে সত্যকে বিকৃত করার প্রয়াস ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারি না। আম্মারের হত্যাকারী বিদ্রোহী জালেমের দলনেতারা সত্যকে বিকৃত ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করায় অত্যন্ত দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারে নি যদিও রাসূল (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী তাদের বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক ইবনে কাসির মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি - এ প্রবাদটির সত্যতা প্রমাণ করে সত্যকে বিকৃত করার এমন এক প্রয়াস নিয়েছেন যা তাদের মাথায়ও আসে নি।

আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন যে,দু ব্যক্তি মুয়াবিয়ার নিকট উপস্থিত হয়ে উভয়েই আম্মারের হত্যাকারী হিসাবে নিজেকে দাবি করল। আমর ইবনুল আসের পুত্র আবদুল্লাহ্ তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

তোমাদের একজনের এ দাবি প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। কারণ আমি মহানবীকে বলতে শুনেছি যে,একদল অত্যাচারী ব্যক্তি আম্মারকে হত্যা করবে। এ সময় মুয়াবিয়া আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করে বললেন, যদি আমরা সেই অত্যাচারীর দল হয়ে থাকি,তবে কেন তুমি আমাদের সঙ্গে রয়েছ? তিনি জবাবে বললেন, একদিন আমার পিতা মহানবীর নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে পিতার আনুগত্যের নির্দেশ দেন। সে কারণেই আমি আপনার সঙ্গে রয়েছি। কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকাকে শ্রেয় মনে করছি।

ইবনে কাসির আমর ইবনুল আসের পুত্র আবদুল্লাহর যুদ্ধে অংশগ্রহণের অপারগতার ওজরকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন,মুয়াবিয়া স্বীয় ইজতিহাদ ও ঈমানের ভিত্তিতে এ যুদ্ধ করেছিলেন যদিও এ ইজতিহাদে তিনি ভুল করেছিলেন। অপরদিকে আবদুল্লাহ্ পিতার আনুগত্যের লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু আমরা জানি,পিতার আনুগত্য শরীয়তের পরিপন্থী কাজে হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

) و إن جاهداك لتشرك بي ما ليس لك به علم فلا تطعهما(

যদি তোমার পিতা-মাতা শিরক করার জন্য তোমাকে নির্দেশ দেয় যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই,তাহলে কখনই তাদের আনুগত্য করবে না। 422

অনুরূপ ইজতিহাদ বা স্বীয় মত প্রদান তখনই সঠিক হবে যখন রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে স্পষ্ট হাদীস না থাকবে। তাই মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসদের ইজতিহাদ মহানবী (সা.)-এর সুস্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে বাতিল ও ভ্রান্তিপূর্ণ এবং যদি এরূপ ক্ষেত্রেও ইজতিহাদের দ্বার উন্মোচন করা হয় তবে নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে মুশরিক ও মুনাফিকদের যুদ্ধগুলোকেও তাদের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সঠিক বলতে হবে। এরূপ ইজতিহাদের কারণেই ইয়াযীদ ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মতো ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর পবিত্র ব্যক্তিদের হত্যার পরও নিরপরাধ বলে ঘোষিত হয়েছে।

যা হোক আম্মার ও মহানবী (সা.)-এর অন্যান্য সাহাবীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অবশেষে মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত হলো। দিন দিন মসজিদের কর্মকাণ্ডের পরিসীমা বাড়তে লাগল। মসজিদের পাশেই মুহাজির ও অন্যান্য নিরাশ্রয় ব্যক্তির জন্য কুটির নির্মিত হলো যা সোফ্ফা নামে পরিচিত। এ সকল ব্যক্তির কোরআন শিক্ষাদানের জন্য ওবাদা ইবনে সামিতকে নিয়োজিত করা হলো।

ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : ঈমানের সর্বোত্তম বিচ্ছুরণ

মদীনায় মুসলমানদের কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষয়টি নবী (সা.)-এর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মদীনায় হিজরতের পূর্বে তিনি শুধু ইসলামের প্রচার ও এ ধর্মের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন,কিন্তু হিজরতের পর থেকে একজন দক্ষ ও পরিপক্ব রাজনীতিবিদের ন্যায় তাঁর দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাঁর নিজ ও সমর্থকদের যথাযথ সংরক্ষণ করার এবং কোন অবস্থাতেই বাইরের ও ভিতরের শত্রুদেরকে ক্ষতিসাধন করতে না দেয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি তিনটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন :

. কুরাইশসহ আরব উপদ্বীপের সকল মূর্তিপূজকের নিকট থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা;

. মদীনা ও মদীনার বাইরে অবস্থানরত অর্থনৈতিক শক্তিধর ইয়াহুদী গোষ্ঠী;এবং

. আওস,খাজরাজ ও মুহাজিরদের কারো কারো মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য।

মুহাজির ও আনসারগণ দু টি ভিন্ন পরিবেশে প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের মধ্যে চিন্তা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ধরনে বেশ পার্থক্য ছিল। তদুপরি আনসারগণ আওস ও খাজরাজ নামক দু গোত্রের সমষ্টি ছিল- যাদের মধ্যে 120 বছরব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং তারা একে অপরের ঘোর শত্রু ছিল। তাই যদি তাদের (আওস,খাজরাজ ও মুহাজিরগণ) মধ্যে বিদ্যমান এ অনৈক্য অব্যাহত থাকত তবে তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবন অব্যাহত রাখা কখনই সম্ভব হতো না। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর প্রজ্ঞাজনোচিত নির্দেশনার মাধ্যমে এ সকল সমস্যার উত্তম সমাধান দান করেছিলেন। প্রথম দু টি সমস্যার বিষয়ে তিনি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। তৃতীয় সমস্যাটি যা তাঁর সমর্থকদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমাধান করেন। তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাজির ও আনসারদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। তিনি একদিন আনসার ও মুহাজিরদের এক সমাবেশে ঘোষণা করেন :تأخّوا في الله اخوين اخوين তোমরা দু জন দু জন করে একে অপরের ভাই হয়ে যাও। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিশেষত ইবনে হিশাম দু জন দু জন করে যে সকল ব্যক্তি পরস্পরের ভাই হয়েছিলেন তাঁদের নামসমূহ লিপিবদ্ধ করেছেন।423

তিনি এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করেন। এ ঐক্যবন্ধনই মহানবী (সা.)-কে প্রথম দু টি সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছিল।

হযরত আলীর দু টি শ্রেষ্ঠত্ব

অধিকাংশ শিয়া-সুন্নী হাদীস বিশারদ ও ঐতিহাসিক এ স্থানে হযরত আলীর দু টি বিশেষ ফজিলত লাভের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তা বর্ণনা করছি। মহানবী আনসার ও মুহাজিরদের তিনশ ব্যক্তির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দেন।

তিনি নিজে একজনকে অপর একজনের ভাই বলে ঘোষণা করেন। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ঘোষণা সমাপ্ত হলে হযরত আলী অশ্রুসিক্ত নয়নে রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আপনি আপনার সঙ্গীদের প্রত্যেককে অপর একজনের ভাই বলে ঘোষণা দিয়েছেন,কিন্তু আমাকে কারো ভাই বলে ঘোষণা করেন নি। মহানবী (সা.) তখন হযরত আলীকে বললেন,

أنت أخي في الدّنيا و الآخرة

তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।

কানদুজী হানাফী এ ঘটনাকে অপেক্ষাকৃত পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,রাসূল (সা.) হযরত আলীর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি মানুষের হেদায়েতের জন্য আমাকে সত্যনবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন;তোমার ভ্রাতৃত্বের ঘোষণাটি এজন্যই সবশেষে প্রদান করছি যে,আমি তোমাকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করব। কারণ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হারুন ও মূসার ন্যায়। তবে পার্থক্য এই যে,আমার পরে নবী নেই এবং তুমি ভাই ও উত্তরাধিকারী। 424

ইবনে কাসির425 এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাঁর এ সন্দেহ তাঁর মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। কারণ মুয়াবিয়া ও তাঁর অনুসারীদের ইচ্ছাই তাঁর ইচ্ছা। তাই তাঁর বক্তব্য খণ্ডনের কোন প্রয়োজন অনুভব করছি না।

হযরত আলীর অপর ফজিলতের ঘটনা এরূপ :

মসজিদ নির্মাণের সমাপ্তি ঘটলে মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা মসজিদকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ গৃহ নির্মাণ করেন এবং গৃহের একটি বিশেষ দ্বার মসজিদের দিকে উন্মুক্ত রাখেন। এ দ্বার দিয়ে বের হয়ে মসজিদে প্রবেশ করা যেত। কিছু দিন পরই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে হযরত আলীর দ্বার ব্যতীত মসজিদের দিকে উন্মুক্ত বিশেষ সব দ্বার বন্ধ করার। সে মতে ইবনুল জাউযী বর্ণনা করেছেন,এ ঘোষণাটি বেশ হট্টগোলের সৃষ্টি করে। অনেকেই ভাবতে লাগলেন নবী আলীর প্রতি ভালোবাসার কারণে এমনটি করেছেন। মহানবী (সা.) তাঁদের মনোভাব বুঝতে পেরে এ বক্তব্য প্রদান করেন, আমি নিজের পক্ষ থেকে দ্বারসমূহ বন্ধের এ ঘোষণা দেইনি,বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসার পর তা করেছি। 426

মহানবী (সা.) ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এ ঘোষণার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্যের অবসান ঘটান। এতে করে তিনটি সমস্যার মধ্যে একটির সমাধান হলো।

ইয়াসরিবের ইয়াহুদীদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রতিরক্ষা চুক্তি

দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল মদীনার ইয়াহুদীদের নিয়ে যারা মদীনা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাস করত এবং ব্যবসা ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত।

রাসূল (সা.) এ বিষয়টি ভালোভাবেই বুঝতেন যে,যদি মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং মদীনার ইয়াহুদীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না হওয়া যায় তবে তাঁর শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কখনই সম্ভব হবে না। এর ফলে ইসলামের চারা গাছটি ঐ পরিবেশে সঠিক পরিচর্যা পাবে না। ইসলাম যদি উপযুক্তভাবে বেড়ে না উঠতে পারে তবে প্রথম সমস্যা অর্থাৎ আরব উপদ্বীপের মূর্তিপূজকদের বিশেষত কুরাইশদের সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। অর্থাৎ বহিঃশত্রুর মোকাবিলার মাধ্যমে তাঁর হুকুমতের নিরাপত্তা বিধানে সক্ষম হবেন না।

মহানবীর মদীনায় প্রবেশের সময় থেকেই মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ তারা উভয়ই মূর্তিপূজার বিরোধী এবং আল্লাহর উপাসক হওয়ায় ইয়াহুদীরা ভেবেছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারা রোমের খ্রিষ্টানদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে। অন্যদিকে আওস ও খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে তাদের অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন চুক্তি ছিল।

এ বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখেই মহানবী (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের নিমিত্তে একটি চুক্তিনামা প্রস্তুত করেন। আনসারদের দু গোত্র আওস ও খাজরাজের মধ্যেও স্বল্প সংখ্যক ইয়াহুদী ছিল। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সম্পাদিত এ চুক্তিতে তারাও স্বাক্ষর করেছিল।427 মহানবী (সা.) তাদের রক্ত ও সম্পদকে এ চুক্তিনামায় মর্যাদা দিয়েছেন। ঐতিহাসিকগণ এ চুক্তিনামাটি পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন।428 যেহেতু এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তিনামা যাতে শৃঙ্খলা,স্বাধীনতা ও ন্যায়ের মূলনীতির প্রতি মহানবী (সা.)-এর মহান দৃষ্টিভঙ্গির উত্তম প্রতিফলন ঘটেছে এবং এ বিষয়গুলোর প্রতি মহানবীর সম্মান প্রদান ও বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁর প্রয়াস প্রভৃতি দিকসমূহ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে,সেহেতু আমরা এ চুক্তিনামার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি। এতে তৎকালীন বিশ্বে নতুন ধর্ম হিসাবে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের দিকটি ফুটে উঠেছে।