চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106817 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের ঘটনা

মহানবী (সা.)-এর উটটি যেখানে বসে পড়েছিল সে স্থানটি দশ দিনারে ক্রয় করা হয়েছিল। সকল মুসলমানই মসজিদ ও গৃহ নির্মাণে হাতে হাত রেখে সেখানে কাজ করছিলেন,এমনকি মহানবীও অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে পাথর আনয়নের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উসাইদ ইবনে হাদির (হাজীর) নামক এক আনসার নবীর নিকট গিয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বসুন,আমরা এ পাথর বয়ে নিয়ে যাই। তিনি তাঁকে বলেন,إذهب فاحمل غيره যাও অন্য পাথর নিয়ে আস। নবী (সা.) তাঁর এ কর্মের মাধ্যমে তাঁর মহান মিশনে তিনি যে শুধু কথায় নয়,কাজেও অনুরূপ তা বুঝিয়ে দেন। এ সময় একজন মুসলমান নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করে :

لئن قعدنا و النّبيّ يعمل

فذاك منّا العمل المضلّل

যদি আমরা বসে থাকি আর নবী কাজ করেন,

তবে তা আমাদের বিচ্যুতির কারণ হবে।

নবী করীম (সা.) ও অন্যান্য মুসলমান কাজ করার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ছিলেন :

لا عيش إلّا عيش الآخرة اللهم ارحم الأنصار و المهاجرة

প্রকৃত জীবন আখেরাতের জীবন। হে আল্লাহ্! আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।

হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান সব সময় মাটি ও ধুলা-বালি থেকে দূরে থাকতেন এবং পোশাকের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন। এ কারণেই মসজিদ নির্মাণের সময় তিনি তাঁর পোশাক পরিষ্কার রাখার নিমিত্তে অন্যান্যের বিপরীতে কাজে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির হযরত আলীর নিকট থেকে একটি কবিতা শিখেছিলেন যা ঐ সকল ব্যক্তির সমালোচনায় রচিত ছিল যারা ধুলা-বালি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে কাজ হতে বিরত থাকে। হযরত উসমানের কাজের সমালোচনায় হযরত আম্মার এ কবিতাটি পাঠ করছিলেন :

لا يستوي من يعمر المساجدا

يدأب فيها قائما قاعدا

و من يرى عن الغبار حائدا

কবিতাটির ভাবার্থ এরূপ যে,যে ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণের জন্য দাঁড়িয়ে এবং বসে সর্বদা প্রচেষ্টায় লিপ্ত এবং যে ব্যক্তি ধুলা-বালি থেকে বাঁচা এবং পোশাক পরিষ্কার রাখার নিমিত্তে মসজিদ নির্মাণ করা থেকে বিরত থাকে তারা উভয়ে সমান নয়।৪১৬

কবিতাটির উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে হযরত উসমান খুবই রাগান্বিত হলেন এবং তাঁর হাতের লাঠিটি আম্মারকে দেখিয়ে বললেন, এ লাঠি দিয়ে তোমার নাক ভেঙে দিলে বুঝতে পারবে। মহানবী (সা.) ঘটনাটি সম্পূর্ণ জানতে পেরে বলেন, আম্মারকে ছেড়ে দাও,আম্মার তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান জানাচ্ছে আর তারা তাকে আহবান জানাচ্ছে দোযখের দিকে।

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির ইসলামের সেবক ও এক শক্তিশালী যুবক ছিলেন। তিনি মসজিদ নির্মাণের সময় কয়েকটি করে পাথর বহন করছিলেন। কেউ কেউ তাঁর নিষ্ঠা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে তাঁর প্রতি অবিচার করছিল এবং তাঁর ক্ষমতার অধিক পাথর তাঁর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিল। হযরত আম্মার বলেন, আমি একটি পাথর নিজের নিয়্যতে এবং অপর একটি পাথর রাসূল (সা.)-এর নিয়্যতে বহন করছিলাম। একবার রাসূল (সা.) তাঁকে তিনটি পাথর বহন করতে দেখলেন। আম্মার রাসূলের উদ্দেশে অনুযোগের সুরে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আপনার সঙ্গীদের আমার প্রতি মন্দ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তারা আমার মৃত্যু কামনা করে;তারা প্রত্যেকে একটি করে পাথর বহন করে,অথচ আমার কাঁধে তিনটি করে পাথর চাপিয়ে দেয়। নবী (সা.) তাঁর হাত ধরে পিঠের ধুলা-বালি পরিষ্কার করতে লাগলেন এবং ঐতিহাসিক এ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন : তারা তোমার হত্যাকারী নয়,তোমার হত্যাকারী একদল অত্যাচারী ব্যক্তি। (তারা তোমাকে হত্যা করবে) তুমি তাদেরকে সত্যের দিকে আহবানকারী অবস্থায়। ৪১৭

মহানবী (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর সত্যবাদিতা ও নবুওয়াতের আরেকটি প্রমাণ। মহানবী যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনিভাবেই ঘটনাটি ঘটেছিল। কারণ পরিশেষে হযরত আম্মার ৯০ বছর বয়সে সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধরত অবস্থায় মুয়াবিয়ার অনুচরদের দ্বারা নিহত হন। হযরত আম্মারের জীবদ্দশায় এ গায়েবী খবর মুসলমানদের ওপর আশ্চর্য প্রভাব ফেলেছিল। তারা রাসূলের এ ভবিষ্যদ্বাণীর পর হযরত আম্মারকে সত্যের মানদণ্ড মনে করত এবং হযরত আম্মার কোন্ পক্ষে যোগ দিচ্ছেন তা দেখে ঐ পক্ষের দাবির সত্যতা যাচাই করত।

সিফ্ফিনের যুদ্ধে যখন হযরত আম্মার শহীদ হন তখন মুয়াবিয়ার বাহিনীর সিরীয়দের মধ্যে আশ্চর্যজনক মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়। যে সব ব্যক্তি মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আসের বিষাক্ত অপপ্রচারে হযরত আলীর সত্যতার বিষয়ে সন্দেহে পতিত হয়েছিল তাদের অনেকেরই তখন সন্দেহের অপনোদন হয়। হুজাইমা ইবনে সাবিত আনসারী যিনি হযরত আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনে গিয়েছিলেন,কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন,তিনি আম্মার ইবনে ইয়াসিরের শাহাদাতের পর তরবারি উন্মুক্ত করেন ও সিরীয় বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।৪১৮

জুলকালা হামিরি ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে (যাদের সকলেই তার গোত্রভুক্ত ছিল) হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিফ্ফিনে এসেছিল। এ যুদ্ধের জন্য মুয়াবিয়া তার ওপরেই বেশি নির্ভর করছিলেন এবং তার সাহায্যের আশ্বাস পেয়েই তিনি যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতারিত এ গোত্রপতি সিফ্ফিনে এসে যখন শুনল যে,আম্মার ইবনে ইয়াসির আলীর পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছেন তখন সে যেন প্রকম্পিত হলো। মুয়াবিয়ার অনুচররা সিফ্ফিনে হযরত আম্মারের উপস্থিতির বিষয়টি তার নিকট সন্দেহপূর্ণ করার নিমিত্তে বলল,আম্মার সিফ্ফিনে আসেন নি এবং ইরাকীরা মিথ্যা প্রচারে অভ্যস্ত বলে আম্মার সিফ্ফিনে এসেছেন বলে প্রচার করছে। কিন্তু জুলকালা এতে সন্তুষ্ট হলো না,সে আমর ইবনুল আসকে লক্ষ্য করে বলল, নবী (সা.) কি আম্মার সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন? আমর ইবনুল আস বলল, হ্যাঁ,নবী (সা.) এমন কথা বলেছেন। কিন্তু আম্মার আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনে আসেন নি। জুলকালা বলল, আমি নিজেই বিষয়টি যাচাই করতে চাই। তাই সে তার গোত্রের কিছু লোককে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য খোঁজ-খবর নিতে বলল। মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আস সত্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত হলেন। কারণ এর ফলে সিরীয় বাহিনীর মধ্যে অনৈক্যের সম্ভাবনা ছিল। পরবর্তীতে সিরীয় এ সেনা ও গোত্রপতি রহস্যজনকভাবে নিহত হয়।

হযরত আম্মার সম্পর্কিত এ হাদীসটি শিয়া-সুন্নী উভয় সূত্রেই এতটা প্রসিদ্ধ যে,হাদীসটির সূত্র উল্লেখের তেমন প্রয়োজন পড়ে না।

আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন,যখন সিফ্ফিনের যুদ্ধে হযরত আম্মার শহীদ হলেন তখন আমর ইবনে হাজম আমর ইবনুল আসের নিকট এসে বললেন,আম্মার নিহত হয়েছেন এবং রাসূল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন :تقتله الفئة الباغية তাকে একদল বিদ্রোহী জালেম হত্যা করবে। আমর ইবনুল আস আর্তনাদ করে বলল, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন তিনি মুয়াবিয়াকে গিয়ে ঘটনাটি জানালেন। মুয়াবিয়া এ কথা শ্রবণে বললেন, আমরা আম্মারের হত্যাকারী নই,বরং আলী ও তার অনুসারীরা তাকে হত্যা করেছে। কারণ তারা তাকে সঙ্গে করে এনেছে এবং আমাদের তরবারির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ৪১৯

এটি সুস্পষ্ট যে,মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এরূপ অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সিরীয় সেনাদের অবচেতন করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। এরূপ ব্যাখ্যা কখনই আল্লাহর ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে গ্রহণীয় নয়। তাই বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোন ব্যক্তি বুঝবেন এরূপ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। যদি মুয়াবিয়ার এ কথাটি গ্রহণ করা হয় তবে তা স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করার নামান্তর। অর্থাৎ স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে ইজতিহাদকে গ্রহণ এবং এরূপ কর্ম সম্পূর্ণ মন্দ। এরূপ বাতিল ইজতিহাদই (যার অবস্থান কোরআনের আয়াত ও হাদীসের বাণীর সম্পূর্ণ বিপরীতে) পরবর্তী সময়ে অনেক বড় অপরাধীর অপরাধকে অপব্যাখ্যা করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

উপরিউক্ত ঘটনাকে কিরূপে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে তার নমুনা আমরা নিম্নে বর্ণনা করছি :

অষ্টম হিজরী শতাব্দীর বিশিষ্ট সিরীয় ঐতিহাসিক আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের রচয়িতা ইবনে কাসির এরূপ অপব্যাখ্যাকারীদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ঐতিহাসিক মুয়াবিয়ার সমর্থনে তাঁর গ্রন্থে৪২০ বলেছেন, নবী (সা.) যে হযরত আম্মারের হত্যাকারীদের জালেম বলে অভিহিত করেছেন তার অর্থ এ নয় যে,তারা কাফির। কারণ যদিও তারা ভুল করেছেন এবং হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন,কিন্তু তাঁরা ঈমান নিয়েই ইজতিহাদের ভিত্তিতে এটি করেছেন। এ কারণেই তাঁদেরকে কাফির ও বিভ্রান্ত বলা যাবে না। অতঃপর তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) যে বলেছেন: আম্মার তাদেরকে বেহেশতের দিকে আহবান জানাবে,কিন্তু আম্মারের হত্যাকারীরা তাকে দোযখের দিকে আহবান করবে৪২১ -এর অর্থ হযরত আম্মার তাদেরকে ঐক্যের দিকে আহবান করবেন যা বেহেশতের নামান্তর,কিন্তু আম্মারের হত্যাকারীরা হযরত আলী খেলাফতের জন্য সবচেয়ে উপয্ক্তু জানা সত্ত্বেও মুয়াবিয়াকে তাদের নেতা নির্বাচিত করায় ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র শাসনকর্তার আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত করে মুসলমানদের মধ্যে গভীর বিভেদ ও অনৈক্যের সৃষ্টি করেছে যা নবী (সা.) দোযখ বলে অভিহিত করেছেন।

আমরা এ বিষয়ে যতই চিন্তা করি না কেন এ অপব্যাখ্যাকে সত্যকে বিকৃত করার প্রয়াস ব্যতীত আর কিছুই বলতে পারি না। আম্মারের হত্যাকারী বিদ্রোহী জালেমের দলনেতারা সত্যকে বিকৃত ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করায় অত্যন্ত দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারে নি যদিও রাসূল (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী তাদের বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক ইবনে কাসির মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি - এ প্রবাদটির সত্যতা প্রমাণ করে সত্যকে বিকৃত করার এমন এক প্রয়াস নিয়েছেন যা তাদের মাথায়ও আসে নি।

আহমদ ইবনে হাম্বল বর্ণনা করেছেন যে,দু ব্যক্তি মুয়াবিয়ার নিকট উপস্থিত হয়ে উভয়েই আম্মারের হত্যাকারী হিসাবে নিজেকে দাবি করল। আমর ইবনুল আসের পুত্র আবদুল্লাহ্ তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

তোমাদের একজনের এ দাবি প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। কারণ আমি মহানবীকে বলতে শুনেছি যে,একদল অত্যাচারী ব্যক্তি আম্মারকে হত্যা করবে। এ সময় মুয়াবিয়া আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করে বললেন, যদি আমরা সেই অত্যাচারীর দল হয়ে থাকি,তবে কেন তুমি আমাদের সঙ্গে রয়েছ? তিনি জবাবে বললেন, একদিন আমার পিতা মহানবীর নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে পিতার আনুগত্যের নির্দেশ দেন। সে কারণেই আমি আপনার সঙ্গে রয়েছি। কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকাকে শ্রেয় মনে করছি।

ইবনে কাসির আমর ইবনুল আসের পুত্র আবদুল্লাহর যুদ্ধে অংশগ্রহণের অপারগতার ওজরকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন,মুয়াবিয়া স্বীয় ইজতিহাদ ও ঈমানের ভিত্তিতে এ যুদ্ধ করেছিলেন যদিও এ ইজতিহাদে তিনি ভুল করেছিলেন। অপরদিকে আবদুল্লাহ্ পিতার আনুগত্যের লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু আমরা জানি,পিতার আনুগত্য শরীয়তের পরিপন্থী কাজে হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

) و إن جاهداك لتشرك بي ما ليس لك به علم فلا تطعهما(

যদি তোমার পিতা-মাতা শিরক করার জন্য তোমাকে নির্দেশ দেয় যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই,তাহলে কখনই তাদের আনুগত্য করবে না। ৪২২

অনুরূপ ইজতিহাদ বা স্বীয় মত প্রদান তখনই সঠিক হবে যখন রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে স্পষ্ট হাদীস না থাকবে। তাই মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসদের ইজতিহাদ মহানবী (সা.)-এর সুস্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে বাতিল ও ভ্রান্তিপূর্ণ এবং যদি এরূপ ক্ষেত্রেও ইজতিহাদের দ্বার উন্মোচন করা হয় তবে নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে মুশরিক ও মুনাফিকদের যুদ্ধগুলোকেও তাদের ইজতিহাদের ভিত্তিতে সঠিক বলতে হবে। এরূপ ইজতিহাদের কারণেই ইয়াযীদ ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মতো ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর পবিত্র ব্যক্তিদের হত্যার পরও নিরপরাধ বলে ঘোষিত হয়েছে।

যা হোক আম্মার ও মহানবী (সা.)-এর অন্যান্য সাহাবীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অবশেষে মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত হলো। দিন দিন মসজিদের কর্মকাণ্ডের পরিসীমা বাড়তে লাগল। মসজিদের পাশেই মুহাজির ও অন্যান্য নিরাশ্রয় ব্যক্তির জন্য কুটির নির্মিত হলো যা সোফ্ফা নামে পরিচিত। এ সকল ব্যক্তির কোরআন শিক্ষাদানের জন্য ওবাদা ইবনে সামিতকে নিয়োজিত করা হলো।

ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : ঈমানের সর্বোত্তম বিচ্ছুরণ

মদীনায় মুসলমানদের কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষয়টি নবী (সা.)-এর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। মদীনায় হিজরতের পূর্বে তিনি শুধু ইসলামের প্রচার ও এ ধর্মের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন,কিন্তু হিজরতের পর থেকে একজন দক্ষ ও পরিপক্ব রাজনীতিবিদের ন্যায় তাঁর দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাঁর নিজ ও সমর্থকদের যথাযথ সংরক্ষণ করার এবং কোন অবস্থাতেই বাইরের ও ভিতরের শত্রুদেরকে ক্ষতিসাধন করতে না দেয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি তিনটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন :

. কুরাইশসহ আরব উপদ্বীপের সকল মূর্তিপূজকের নিকট থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা;

. মদীনা ও মদীনার বাইরে অবস্থানরত অর্থনৈতিক শক্তিধর ইয়াহুদী গোষ্ঠী;এবং

. আওস,খাজরাজ ও মুহাজিরদের কারো কারো মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য।

মুহাজির ও আনসারগণ দু টি ভিন্ন পরিবেশে প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের মধ্যে চিন্তা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ধরনে বেশ পার্থক্য ছিল। তদুপরি আনসারগণ আওস ও খাজরাজ নামক দু গোত্রের সমষ্টি ছিল- যাদের মধ্যে ১২০ বছরব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং তারা একে অপরের ঘোর শত্রু ছিল। তাই যদি তাদের (আওস,খাজরাজ ও মুহাজিরগণ) মধ্যে বিদ্যমান এ অনৈক্য অব্যাহত থাকত তবে তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবন অব্যাহত রাখা কখনই সম্ভব হতো না। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর প্রজ্ঞাজনোচিত নির্দেশনার মাধ্যমে এ সকল সমস্যার উত্তম সমাধান দান করেছিলেন। প্রথম দু টি সমস্যার বিষয়ে তিনি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। তৃতীয় সমস্যাটি যা তাঁর সমর্থকদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমাধান করেন। তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাজির ও আনসারদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। তিনি একদিন আনসার ও মুহাজিরদের এক সমাবেশে ঘোষণা করেন :تأخّوا في الله اخوين اخوين তোমরা দু জন দু জন করে একে অপরের ভাই হয়ে যাও। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিশেষত ইবনে হিশাম দু জন দু জন করে যে সকল ব্যক্তি পরস্পরের ভাই হয়েছিলেন তাঁদের নামসমূহ লিপিবদ্ধ করেছেন।৪২৩

তিনি এ পরিকল্পনার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করেন। এ ঐক্যবন্ধনই মহানবী (সা.)-কে প্রথম দু টি সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছিল।

হযরত আলীর দু টি শ্রেষ্ঠত্ব

অধিকাংশ শিয়া-সুন্নী হাদীস বিশারদ ও ঐতিহাসিক এ স্থানে হযরত আলীর দু টি বিশেষ ফজিলত লাভের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তা বর্ণনা করছি। মহানবী আনসার ও মুহাজিরদের তিনশ ব্যক্তির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দেন।

তিনি নিজে একজনকে অপর একজনের ভাই বলে ঘোষণা করেন। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ঘোষণা সমাপ্ত হলে হযরত আলী অশ্রুসিক্ত নয়নে রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে রাসূলাল্লাহ্! আপনি আপনার সঙ্গীদের প্রত্যেককে অপর একজনের ভাই বলে ঘোষণা দিয়েছেন,কিন্তু আমাকে কারো ভাই বলে ঘোষণা করেন নি। মহানবী (সা.) তখন হযরত আলীকে বললেন,

أنت أخي في الدّنيا و الآخرة

তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।

কানদুজী হানাফী এ ঘটনাকে অপেক্ষাকৃত পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,রাসূল (সা.) হযরত আলীর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি মানুষের হেদায়েতের জন্য আমাকে সত্যনবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন;তোমার ভ্রাতৃত্বের ঘোষণাটি এজন্যই সবশেষে প্রদান করছি যে,আমি তোমাকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করব। কারণ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হারুন ও মূসার ন্যায়। তবে পার্থক্য এই যে,আমার পরে নবী নেই এবং তুমি ভাই ও উত্তরাধিকারী। ৪২৪

ইবনে কাসির৪২৫ এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাঁর এ সন্দেহ তাঁর মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। কারণ মুয়াবিয়া ও তাঁর অনুসারীদের ইচ্ছাই তাঁর ইচ্ছা। তাই তাঁর বক্তব্য খণ্ডনের কোন প্রয়োজন অনুভব করছি না।

হযরত আলীর অপর ফজিলতের ঘটনা এরূপ :

মসজিদ নির্মাণের সমাপ্তি ঘটলে মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা মসজিদকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ গৃহ নির্মাণ করেন এবং গৃহের একটি বিশেষ দ্বার মসজিদের দিকে উন্মুক্ত রাখেন। এ দ্বার দিয়ে বের হয়ে মসজিদে প্রবেশ করা যেত। কিছু দিন পরই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে হযরত আলীর দ্বার ব্যতীত মসজিদের দিকে উন্মুক্ত বিশেষ সব দ্বার বন্ধ করার। সে মতে ইবনুল জাউযী বর্ণনা করেছেন,এ ঘোষণাটি বেশ হট্টগোলের সৃষ্টি করে। অনেকেই ভাবতে লাগলেন নবী আলীর প্রতি ভালোবাসার কারণে এমনটি করেছেন। মহানবী (সা.) তাঁদের মনোভাব বুঝতে পেরে এ বক্তব্য প্রদান করেন, আমি নিজের পক্ষ থেকে দ্বারসমূহ বন্ধের এ ঘোষণা দেইনি,বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসার পর তা করেছি। ৪২৬

মহানবী (সা.) ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এ ঘোষণার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্যের অবসান ঘটান। এতে করে তিনটি সমস্যার মধ্যে একটির সমাধান হলো।

ইয়াসরিবের ইয়াহুদীদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রতিরক্ষা চুক্তি

দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল মদীনার ইয়াহুদীদের নিয়ে যারা মদীনা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাস করত এবং ব্যবসা ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত।

রাসূল (সা.) এ বিষয়টি ভালোভাবেই বুঝতেন যে,যদি মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং মদীনার ইয়াহুদীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না হওয়া যায় তবে তাঁর শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কখনই সম্ভব হবে না। এর ফলে ইসলামের চারা গাছটি ঐ পরিবেশে সঠিক পরিচর্যা পাবে না। ইসলাম যদি উপযুক্তভাবে বেড়ে না উঠতে পারে তবে প্রথম সমস্যা অর্থাৎ আরব উপদ্বীপের মূর্তিপূজকদের বিশেষত কুরাইশদের সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। অর্থাৎ বহিঃশত্রুর মোকাবিলার মাধ্যমে তাঁর হুকুমতের নিরাপত্তা বিধানে সক্ষম হবেন না।

মহানবীর মদীনায় প্রবেশের সময় থেকেই মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ তারা উভয়ই মূর্তিপূজার বিরোধী এবং আল্লাহর উপাসক হওয়ায় ইয়াহুদীরা ভেবেছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারা রোমের খ্রিষ্টানদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে। অন্যদিকে আওস ও খাজরাজ গোত্রের সঙ্গে তাদের অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন চুক্তি ছিল।

এ বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখেই মহানবী (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের নিমিত্তে একটি চুক্তিনামা প্রস্তুত করেন। আনসারদের দু গোত্র আওস ও খাজরাজের মধ্যেও স্বল্প সংখ্যক ইয়াহুদী ছিল। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে সম্পাদিত এ চুক্তিতে তারাও স্বাক্ষর করেছিল।৪২৭ মহানবী (সা.) তাদের রক্ত ও সম্পদকে এ চুক্তিনামায় মর্যাদা দিয়েছেন। ঐতিহাসিকগণ এ চুক্তিনামাটি পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন।৪২৮ যেহেতু এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তিনামা যাতে শৃঙ্খলা,স্বাধীনতা ও ন্যায়ের মূলনীতির প্রতি মহানবী (সা.)-এর মহান দৃষ্টিভঙ্গির উত্তম প্রতিফলন ঘটেছে এবং এ বিষয়গুলোর প্রতি মহানবীর সম্মান প্রদান ও বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁর প্রয়াস প্রভৃতি দিকসমূহ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে,সেহেতু আমরা এ চুক্তিনামার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি। এতে তৎকালীন বিশ্বে নতুন ধর্ম হিসাবে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের দিকটি ফুটে উঠেছে।

ষষ্ঠ অধ্যায় : মহানবী (সা.)-এর শৈশবকাল

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনটাই-শৈশবের শুরু থেকে যে দিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সেই দিন পর্যন্ত আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহের সমন্বয়ে গঠিত। আর এ সব আশ্চর্যজনক ঘটনা অলৌকিকত্বের প্রমাণ বহন করে। এ সব কিছু থেকে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল একটি অসাধারণ জীবন।

মহানবীর এ সব অলৌকিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সীরাত রচয়িতাগণ দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন :

1. বস্তুবাদী কতিপয় প্রাচ্যবিদের দৃষ্টিভঙ্গি : বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিকগণ বস্তুবাদী ভূয়োদর্শন পোষণ করেন এবং অস্তিত্বকে কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন। তাঁরা সকল প্রপঞ্চ ও ঘটনাকে বস্তুগত প্রপঞ্চ ও ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন এবং প্রতিটি ঘটনা ও প্রপঞ্চেরই প্রাকৃতিক (বস্তুগত) কারণ নির্ধারণ করেন। তাঁরা এ সব অলৌকিক ঘটনা ও প্রপঞ্চের প্রতি মোটেও গুরুত্ব দেন না। কারণ বস্তুবাদী নীতিমালা অনুসারে এ ধরনের ঘটনা ও প্রপঞ্চের উৎপত্তি অসম্ভব;আর ইতিহাসের পাতায় পাতায় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেই তাঁরা এগুলোকে ধর্মের অনুসারীদের কল্পনা এবং ভক্তি-ভালোবাসাপ্রসূত বলে বিবেচনা করেন।

একদল প্রাচ্যবিদ যাঁরা নিজেদেরকে বাহ্যত তাওহীদবাদী ও খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেন এবং অতি প্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক) জগতের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করেন,কিন্তু তাঁদের ঈমানী দুর্বলতা ও জ্ঞানগত গর্ব এবং তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার ওপর বস্তুবাদিতার প্রাধান্য থাকার কারণে ঘটনা বিশ্লেষণ করার সময় তাঁরা বস্তুবাদী মূলনীতিসমূহের অনুসরণ করেন। আমরা বারবার তাঁদের বক্তব্য ও আলোচনার মধ্যে এ সব বাক্য লক্ষ্য করেছি যে, নবুওয়াত আসলে এক ধরনের মানবীয় প্রতিভা , নবী হচ্ছেন একজন সামাজিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর নিজের আলোকিত চিন্তাধারা দিয়ে মানব জীবনের গতিধারা ও পথকে আলোকিত করেন’...।

প্রাচ্যবিদদের এ ধরনের বক্তব্য আসলে বস্তুবাদী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত যা সকল ধর্মকে মানব চিন্তা ও কল্পনাপ্রসূত বলে বিবেচনা করে। অথচ আস্তিক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সাধারণ নবুওয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় প্রমাণ করেছেন যে,নবুওয়াত মহান আল্লাহর ঐশী দান ও অনুগ্রহ যা সকল আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা (ইলহাম) ও যোগাযোগের উৎস। মহান নবীদের পরিকল্পনাসমূহ,তাঁদের চিন্তা,ধারণা ও প্রতিভা প্রসূত নয়;বরং অবস্তুগত আধ্যাত্মিকজগৎ থেকে প্রেরিত ইলহাম ও প্রত্যাদেশ ব্যতীত তাঁদের এ সব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আর কোন উৎসমূল নেই। কিন্তু যখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী প্রাচ্যবিদগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিষয়ে দৃক্পাত করেন এবং সমস্ত ঘটনা ও প্রপঞ্চকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক মূলনীতি ও সূত্রের আলোকে পরিমাপ করেন তখন যে সব ঘটনা ও প্রপঞ্চের অলৌকিকত্বের দিক রয়েছে অর্থাৎ মুজিযা সেগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন এবং মূল থেকে সেগুলো অস্বীকার করেন।

2 . স্রষ্টা পূজারিগণ : ঐ সব ব্যক্তি মহান আল্লাহর উপাসনাকারী যারা বিশ্বাস করে যে,বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য ও চি হ্নসমূহ অন্য জগতের পরিচালনাধীন এবং অতি প্রাকৃতিক অবস্তুগতজগৎ এ প্রাকৃতিক ও বস্তুগত বিশ্বের সার্বিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যভাবে বলা যায়,বস্তুজগৎ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। সকল ব্যবস্থা এবং এগুলোর প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উচ্চতর অস্তিত্বময় সত্তাসমূহ,বিশেষ করে মহান আল্লাহর ইচ্ছার সৃষ্টি। মহান আল্লাহ্ বস্তুর অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাঝে কতগুলো সুষ্ঠু নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং বস্তুর অস্তিত্বের স্থায়িত্বকে কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যদিও এই গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুন ও সূত্রসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং প্রাকৃতিক বস্তুনিচয়ের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ যেগুলো বিজ্ঞান কর্তৃক সমর্থিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্যও আন্তরিকভাবে মেনে নিয়েছে,তারপরও তারা বিশ্বাস করে যে,এ ধরনের প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ধ্রুব নয়। তারা বিশ্বাস করে যে,শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর জগৎ (যা বস্তুজগৎ থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ) যখনই চাইবে ঠিক তখনই কতিপয় মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ ও রেওয়াজের পথ পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম;শুধু তা-ই নয় বরং কতিপয় ক্ষেত্রে উচ্চতর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তা

বাস্তবে কার্যকরও করেছে।

অন্যভাবে বলতে গেলে অলৌকিক কাজসমূহ আসলে কারণহীন নয়;তবে এগুলোর সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ নেই;আর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ না থাকা কারণের অনস্তিত্ব নির্দেশ করে না। সৃষ্টিজগতের নিয়ম,সূত্র ও বিধানসমূহও এমন নয় যে,সেগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিবর্তিত হয় না।

তারা বলে যে,মহান নবিগণের অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক কার্যাবলী যা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সীমারেখার বাইরে,সেগুলো এ পথেই (স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে) সংঘটিত ও বাস্তবায়িত হয়। এ গোষ্ঠীটি অতি প্রাকৃতিক কার্যসমূহ (মুজিযা ও কারামত) যেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদীসসমূহে অথবা বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে তা স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুনের সাথে খাপ খায় না বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এ সব ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছে।

এখন আমরা মহানবী (সা.)-এর শৈশবকালের আশ্চর্যজনক ও রহস্যময় ঘটনাবলী উল্লেখ করব। এ বক্তব্য ও ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বিবেচনায় রাখি,তাহলে এ ধরনের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আমাদের আর কোন সংশয় থাকবে না।

1. ইতিহাস রচয়িতাগণ হালীমার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যখন আমি আমেনার নবজাতক শিশুর (মহানবী) প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন তার মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্তন্য দান করতে চাইলাম। আমার বাম স্তন যা দুধে পরিপূর্ণ ছিল তা তার মুখে রাখলাম,কিন্তু নবজাতক শিশুটি আমার ডান স্তনের প্রতি যেন বেশি আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু আমি যে দিন সন্তান প্রসব করেছিলাম সে দিন থেকেই আমার ডান স্তনে দুধ ছিল না। নবজাতক শিশুর পীড়াপীড়িতে আমি আমার দুধবিহীন ডান স্তনটি তার মুখে রাখলাম। তখনই সে তা চুষতে লাগল এবং স্তনের শুষ্ক দুগ্ধগ্রন্থিগুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ ঘটনা উপস্থিত সকল ব্যক্তিকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। 140

2. তাঁর নিকট থেকে আরো বর্ণিত আছে : যে দিন আমি শিশু মুহাম্মদকে আমার গৃহে আনলাম সে দিন থেকে আমার ঘরে কল্যাণ ও বরকত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার সম্পদ ও গবাদিপশুও বৃদ্ধি পেতে লাগল। 141

নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে বস্তুবাদীরা এবং যারা তাদের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অনুসরণ করে তারা এ সব বিষয়ে তাওহীদপন্থী স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। বস্তুবাদী নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীরা যেহেতু এ ধরনের বিষয়াদি প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম সেহেতু তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলে যে,এ সব ঘটনা ও বিষয় মানুষের কল্পনাপ্রসূত। যদি তারা খুব ভদ্র ও মার্জিত হয় তাহলে বলে যে,মহানবী এ সব অলৌকিক কাজের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে,তিনি এ সব বিষয়ের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তবে অমুখাপেক্ষিতা একটি বিষয় এবং কোন একটি বিষয় সত্য ও মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করা আরেকটি বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি প্রকৃতিজগতে বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিশ্ব-ব্র‏‏ হ্মাণ্ডের মহান স্রষ্টার ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানে এবং বিশ্বাস করে যে,সবচেয়ে ক্ষুদ্র অস্তিত্ববান সত্তা (পরমাণু) থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি (নীহারিকাপুঞ্জ) পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-ব্র হ্মাণ্ড তাঁর (স্রষ্টা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাই এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই সে এ সব ঘটনা ও বিষয়ের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে;আর যদি সে এ সব ঘটনা যাচাই-বাছাই এবং এগুলোর দলিল-প্রমাণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে না-ও পারে তবুও সে এ সব বিষয় ও ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে না।

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত ঈসা ইবনে মরিয়মের ক্ষেত্রে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যেমন পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন হযরত মরিয়মের সন্তান প্রসবের সময় নিকটবর্তী হলো তখন তিনি একটি খেজুর গাছের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং তিনি (তীব্র ব্যথা,একাকিত্ব ও দুর্নামের ভয়ে) মহান আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ সময় তিনি একটি আহবান ধ্বনি শুনতে পেলেন :

) لا تحزني قد جعل ربّك تحتك سريّا و هزّي إليك بجذع النّخلة تساقط عليك رطبا جنيّا(

“দুঃখভারাক্রান্ত হয়ো না। তোমার প্রভু তোমার পায়ের তলদেশে পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছেন এবং (শুষ্ক) খেজুর গাছটি ঝাঁকি দাও তাহলে তাজা খেজুর তোমার ওপর পতিত হবে। (সূরা মরিয়ম : 24-25)

আমরা পবিত্র কোরআনে হযরত মরিয়ম সম্পর্কে অন্যান্য বিষয়ও জানতে পারি। তাঁর নিষ্পাপ হওয়া ও তাকওয়া তাঁকে এমন এক সুমহান স্থানে উন্নীত করেছিল যে,যখনই হযরত যাকারিয়া (আ.) হযরত মরিয়মের ইবাদাত-বন্দেগী করার স্থানে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি তাঁর কাছে বেহেশতের খাবার দেখতে পেতেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এ রুজী (খাবার) কোথা থেকে এসেছে? হযরত মরিয়ম তাঁকে জবাবে বলতেন, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। 142

অতএব,এ ধরনের অলৌকিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ করা এবং এগুলো অসম্ভব বলে মনে করা অনুচিত।

মরুভূমিতে পাঁচ বছর

আবদুল মুত্তালিবের অনাথ নাতি মহানবী (সা.) বনি সা দ গোত্রের মাঝে পাঁচ বছর অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি ভালোভাবে বেড়ে ওঠেন। এ দীর্ঘ পাঁচ বছর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে দু তিন বার মা আমেনার কাছে এনেছিলেন এবং শেষ বারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে অর্পণ করেছিলেন।

দুগ্ধপানকাল শেষ হওয়ার পর বিবি হালীমাহ্ তাঁকে প্রথম বারের মতো পবিত্র মক্কায় এনেছিলেন। জোরাজুরি করে হালীমাহ্ তাঁকে পুনরায় বনি সা দ গোত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করার কারণ ছিল এই যে,এ অনাথ শিশুর উসিলায় তাঁর প্রভূত কল্যাণ ও বরকত হয়েছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীতে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় হযরত আমেনাও হালীমাহর অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন।

একদল আবিসিনীয় আলেম একবার হিজাযে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বনি সা দ গোত্রে শিশু মহানবীকে দেখতে পেলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে,হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী নবীর নিদর্শনাদি যা আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে তা এ শিশুটির সাথে মিলে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে,যেভাবেই হোক তাঁরা এ শিশুকে অপহরণ করে আবিসিনিয়ায় নিয়ে যাবেন এবং এ হবে তাঁদের গৌরবের বিষয়। তাই এ সব ব্যক্তির হাত থেকে শিশু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ রাখার জন্য বিবি হালীমাহ্ তাঁকে দ্বিতীয় বারের মতো পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন।143

এ ব্যাপারটি মোটেও অসম্ভব ও কাল্পনিক নয়। কারণ পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারে মহানবীর নিদর্শনসমূহ ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের আসমানী গ্রন্থাদির বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যে পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত নিদর্শনসমূহের ভিত্তিতে উক্ত নিদর্শনসমূহের অধিকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে :

) و إذا قال عيسى بن مريم يا بني إسرائيل إنّي رسول الله إليكم مصدّقا لما بين يديّ من التّوراة و مبشّرا برسول يأتي من بعدي اسمه أحمد فلمّا جاءهم بالبيّنات قالوا هذا سحر مبين(

“আর স্মরণ করুন তখনকার কথা যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম (বনি ইসরাইলকে) বলেছিল : নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল। আমার সামনে বিদ্যমান আসমানী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী এবং আমি তোমাদেরকে আমার পরে যে রাসূল আগমন করবে তার সুসংবাদ প্রদান করছি। উক্ত রাসূলের নাম হবে আহমাদ। অতঃপর সেই (প্রতিশ্রুত) রাসূল তাদের কাছে (নিদর্শন ও মুজিযাসহ) আগমন করল। তখন তারা বলল : এ (এ সব মুজিযা ও পবিত্র কোরআন) তো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা সাফ : 6)

এতৎসংক্রান্ত আরো বহু আয়াত রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চি হ্ন ও নিদর্শনাদি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিল।144

সপ্তম অধ্যায় : মাতৃক্রোড়ে প্রত্যাবর্তন

মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তিকে কোন না কোন দায়িত্ব পালনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কাউকে জ্ঞানার্জনের জন্য,কাউকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করার জন্য,আবার কাউকে কর্ম ও পরিশ্রম করার জন্য,কোন কোন মানুষকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দান করার জন্য,আবার কিছু সংখ্যক মানুষকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্য সম্পাদন করার জন্য এবং এভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষকে জগতের বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

আন্তরিক ও হৃদয়বান প্রশিক্ষকগণ যাঁরা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি কামনা করেন তাঁরা কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার আগেই তার অভিরুচি পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে থাকেন। আর যে ব্যক্তির যে কাজের প্রতি ঝোঁক এবং সামর্থ্য রয়েছে তাঁরা তাকে কেবল সেই কাজেরই দায়িত্ব দেন। কারণ এর অন্যথা হলে সমাজের দু টি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে :

ক. যে কাজ ঐ ব্যক্তি সম্পন্ন করতে পারত তা সে সম্পন্ন করতে পারবে না এবং

খ. যে কাজ সে আঞ্জাম দিয়েছে তা নিষ্ফল হতে বাধ্য।

বলা হয় যে,প্রতিটি রহস্যে একটি আনন্দ ও উদ্দীপনা আছে। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার নিজ আনন্দ ও উদ্দীপনা উপলব্ধি করে।

এক শিক্ষক তাঁর এক অলস ছাত্রকে উপদেশ প্রদান করতেন এবং আলস্যের অনিষ্ট এবং যে সব ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেনি ও নিজেদের জীবনের বসন্তকাল অর্থাৎ যৌবনকে আলস্য ও প্রবৃত্তির পূজায় নিঃশেষ করেছে তাদের জীবনের করুণ পরিণতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতেন। তিনি দেখতে পেলেন যে,ঐ ছাত্রটি তাঁর কথা শ্রবণরত অবস্থায় মাটির ওপর পড়ে থাকা এক টুকরা কয়লার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে পারলেন এ ছেলেটি লেখাপড়া শেখা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য সৃষ্ট হয়নি;বরং স্রষ্টা তাকে চিত্রাঙ্কন করার মনোবৃত্তি ও রুচি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই উক্ত শিক্ষক ছাত্রটির পিতা-মাতাকে ডেকে বলেছিলেন, জ্ঞানার্জন ও লেখা-পড়া শেখার ব্যাপারে আপনাদের সন্তানের আগ্রহ অত্যন্ত কম,কিন্তু চিত্রাঙ্কন করার রুচি ও ঝোঁক তার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই আছে এবং এ ব্যাপারে তার স্পৃহা ও আগ্রহ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।” শিক্ষকের পরামর্শ ছাত্রের পিতা-মাতার কাছে মনোঃপুত হলে অতি অল্প দিনের মধ্যে ছাত্রটি চিত্রাঙ্কন ও শিল্পকলা বেশ দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলে এবং এ ক্ষেত্রে সে যুগশ্রেষ্ঠ শিল্পীতে পরিণত হয়।

শৈশবকাল শিশুদের অভিভাবকদের জন্য সন্তানদের রুচিবোধ ও সামর্থ্য পরীক্ষা এবং তাদের কাজ-কর্ম,আচার-আচরণ,চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি সম্পর্কে ধারণা লাভ করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ শিশুর চিন্তা-ভাবনা,কার্যকলাপ এবং মিষ্টি-মধুর কথা-বার্তা আসলে তার যোগ্যতা ও সামর্থ্যরেই আয়নাস্বরূপ। স্মর্তব্য যে,তার সামর্থ্য বিকাশের যাবতীয় পূর্বশর্ত ও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে তা সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগানো সম্ভব।

নবুওয়াত ঘোষণা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত,আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ তাঁর জীবন এবং তাঁর মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের পটভূমি আমাদের মানসপটে চিত্রিত করে। তাঁর শৈশবের ইতিহাস অধ্যয়ন ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা কেবল তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই অবগত হব না;বরং যে দিন তাঁর নবুওয়াত ঘোষিত হয়েছিল এবং তিনি নিজেকে সমাজের নেতা ও পথ-প্রদর্শক বলে ঘোষণা করেছিলেন সে দিন পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনেতিহাস তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অবগত করে এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে,এ ব্যক্তি কোন্ কাজের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন? আর তাঁর রিসালাত ও নেতৃত্বের দাবি কি তাঁর জীবন-কাহিনীর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল? চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনেতিহাস,তাঁর আচার-আচরণ,চরিত্র,কর্ম,কথা এবং জনগণের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশা তাঁর সত্য নবী ও রাসূল হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করে কি?

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখানে মহানবীর জীবনের প্রথম দিনগুলো (শৈশব,কৈশোর ও যৌবন) সম্পর্কে আলোচনা করব।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাই-মা হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেছিলেন। এ সময় তিনি খাঁটি বলিষ্ঠ আরবী ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সে কারণে তিনি পরবর্তীকালে গৌরববোধ করতেন। পাঁচ বছর পর হযরত হালীমাহ্ তাঁকে পবিত্র মক্কা নগরীতে নিয়ে আসেন। মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর বেশ কিছুদিন তিনি মাতৃস্নেহ লাভ করেছিলেন এবং এ সময় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মক্কাধিপতি হযরত আবদুল মুত্তালিবের কাছে পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি।145

ইয়াসরিবে সফর

যে দিন আবদুল মুত্তালিবের পুত্রবধু (আমেনা) তাঁর যুবক স্বামীকে হারালেন সে দিন থেকে তিনি সর্বদা ইয়াসরিব গমন করে স্বামীর কবর যিয়ারত এবং সে সাথে ইয়াসরিবস্থ নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে,একটি সঠিক সুযোগ এসে গেছে এবং তাঁর প্রাণাধিক পুত্রসন্তান (মুহাম্মদ)ও এখন বড় হয়েছে এবং সেও এ পথে তাঁর শোকের অংশীদার হতে পারবে। তাঁরা  উম্মে আইমানকে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং পূর্ণ এক মাস সেখানে অবস্থান করেন। শিশু মহানবীর জন্য এ সফর শোক ও বেদনা বয়ে এনেছিল। কারণ প্রথম বারের মতো তাঁর দৃষ্টি যে ঘরে তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইন্তেকাল করেছিলেন এবং চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল।146

শিশু মহানবীর অন্তরে পিতৃশোক স্তিমিত হতে না হতেই হঠাৎ আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। এর ফলে শোক আরো বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পবিত্র মক্কায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর স্নেহময়ী মা হযরত আমেনা পথিমধ্যে আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন।147

এ ঘটনা বনি হাশিম ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শিশু মহানবীকে স্নেহভাজন করেছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমতাবোধের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তিনি ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ ও হযরত আমেনার পুষ্পোদ্যানের একমাত্র পুষ্প-তাঁদের পুণ্যস্মৃতি। এ কারণেই শিশু মহানবী দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিবের অশেষ ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পিতামহের প্রাণাধিক প্রিয় নাতি। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে তাঁর সকল সন্তান অপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। তিনি সকলের ওপর তাঁকেই অগ্রাধিকার প্রদান করতেন।

কাবার চারদিকে কুরাইশপ্রধান আবদুল মুত্তালিবের জন্য কার্পেট বিছানো হতো। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এবং তাঁর সন্তানগণ তাঁর কার্পেটের চারপাশে বসত। আবদুল্লাহর কথা স্মরণ হলেই তিনি (আবদুল মুত্তালিব) যে কার্পেটের ওপর উপবিষ্ট থাকতেন সে কার্পেটে প্রয়াত পুত্র আবদুল্লাহর একমাত্র স্মৃতি-চি হ্ন শিশু হযরত মুহাম্মদকে এনে তাঁর পাশে বসানোর নির্দেশ দিতেন।148

পবিত্র কোরআনের সূরা দোহায় মহানবী (সা.)-এর শৈশব ও ইয়াতিম অবস্থার কথা উল্লিখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) أ لم يجدك يتيما فآوى(

“তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম পাওয়ার পর (প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য হযরত আবু তালিবের) আশ্রয় দেন নি? (সূরা দোহা : 6)

মহানবীর ইয়াতিম হওয়ার অন্তর্নিহিত মূল রহস্য আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা এতটুকু জানি যে,ঘটনাসমূহ যা সংঘটিত হয়েছে তা প্রজ্ঞাবিহীন নয়। এতদসত্ত্বেও আমরা ধারণা করতে পারি যে,মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন মানব জাতি ও বিশ্বের মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল দায়িত্বভার গ্রহণ এবং নেতৃত্বদান শুরু করার আগেই যেন জীবনের সুখ,শান্তি,মাধুর্য ও তিক্ততার স্বাদ আস্বাদন করেন এবং জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হন। এর ফলে তিনি মহান আত্মা এবং অত্যন্ত ধৈর্যশীল হৃদয়ের অধিকারী হতে পারবেন,দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজেকে কঠিন বিপদাপদ,কষ্ট এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।

মহান আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যেন কারও আনুগত্য তাঁর স্কন্ধের ওপর না থাকে;আর তিনি জন্মগ্রহণের পরপর অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকেই যেন স্বাধীন থাকেন। তিনি যেন আত্মগঠনে নিয়োজিত মনীষীদের ন্যায় তাঁর আত্মিক-আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ভিত্তিসমূহ নিজ হাতে গঠন করতে সক্ষম হন। যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে,তাঁর প্রতিভা আসলে সাধারণ মানবীয় প্রতিভা নয় এবং তাঁর ভাগ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা-মাতার কোন ভূমিকাই ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা আসলে ওহীর উৎসমূল থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।

আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু

হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ সব সময় মানব জীবনের পথ-পরিক্রমণে আবির্ভূত হয়। সেগুলো সমুদ্রের পর্বত প্রমাণ উত্থাল তরঙ্গমালার ন্যায় একের পর এক উত্থিত হয়ে মানুষের জীবন-তরীকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং মানব মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

মহানবী (সা.)-এর অন্তঃকরণে (মায়ের মৃত্যুতে) শোক ও দুঃখ তখনও বিরাজ করছিল ঠিক এমতাবস্থায় তৃতীয় বারের মতো এক বড় বিপদ তাঁর ওপর আপতিত হয়েছিল। তাঁর জীবনের অষ্টম বসন্তকাল অতিবাহিত হতে না হতেই অভিভাবক ও পিতামহ হযরত আবদুল মুত্তালিবকে তিনি হারিয়েছিলেন। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যু তাঁর কোমল আত্মার ওপর এতটা গভীর দাগ কেটেছিল যে,দাদা আবদুল মুত্তালিব যে দিন মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দিন তিনি সমাধিস্থলে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা পর্যন্ত অশ্রুপাত করেছিলেন এবং তিনি কখনই পিতামহ আবদুল মুত্তালিবকে ভুলেন নি।149


20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61