চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106821 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সনদ (চুক্তিনামা)

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম

এ চুক্তিনামা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানগণ এবং তাদের অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পাদন করেন।

ধারা : ১

উপধারা ১ : এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষরকারিগণ এক জাতি হিসাবে পরিগণিত হবে। কুরাইশ মুহাজিরগণ তাদের ইসলামপূর্ব নিয়মানুযায়ী রক্তপণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। যদি তাদের কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে অথবা তাদের কেউ বন্দী হয় তবে এ ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। অর্থাৎ সমবেতভাবে ঐ রক্তপণ আদায় করবে ও বন্দীকে মুক্ত করতে হবে।

উপধারা ২ : বনি আওফ কুরাইশ মুহাজিরদের ন্যায় এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ববর্তী আইন অনুসরণ করবে এবং তাদের গোত্রের বন্দীদেরকে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে। তেমনিভাবে আনসারদের মধ্যে যে সব গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে,যেমন বনি সায়েদা,বনি হারিস,বনি জুশাম,বনি নাজ্জার,বনি আমর ইবনে আওফ,বনি নাবিত ও বনি আওস,তারাও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের গোত্রের কোন ব্যক্তির রক্তপণ সমবেতভাবে প্রদান করবে এবং তাদের বন্দীদেরকে গোত্রের সকলে সমবেতভাবে মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে মুক্ত করবে।

উপধারা ৩ : আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে মুসলমানগণ সমবেতভাবে সাহায্য করবে। কোন মুসলমান যদি রক্তপণ অথবা মুক্তিপণ প্রদানের কারণে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তবে সকলে মিলে তাকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ৪ : পরহেজগার মুমিনগণ তাদের কোন ব্যক্তি অবাধ্য হলে এবং অনাচার করলে তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে,যদিও সে ব্যক্তি তাদের কারো সন্তান হয়।

উপধারা ৫ : কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানের সন্তান অথবা দাসের সঙ্গে তার পিতা ও মনিবের অনুমতি ব্যতিরেকে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না।

উপধারা ৬ : কোন কাফিরকে হত্যা করার দায়ে কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করার অধিকার কোন মুমিনের নেই। কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সহযোগিতা করা যাবে না।

উপধারা ৭ : চুক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মুসলমান সমান। এ দৃষ্টিতে উচ্চ-নিচ সকল মুসলমানই সমানভাবে কাফেরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে।

উপধারা ৮ : মুসলমানগণ একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী।

উপধারা ৯ : ইয়াহুদীদের মধ্য হতে যে আমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণ করে সে আমাদের সহযোগিতা পাবে। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে অন্য মুসলমানের কোনই পার্থক্য নেই এবং তার প্রতি অবিচার করার অধিকার করো নেই। তার বিরুদ্ধে কাউকে ক্ষেপিয়ে তোলা ও তার শত্রুকে সাহায্য করা যাবে না।

উপধারা ১০ : সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অপর মুসলমানের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং সাম্য ও ন্যায়ের প্রতি যথাযথ দৃষ্টিদান না করে সন্ধি চুক্তি করা যাবে না।

উপধারা ১১ : মুসলমানদের বিভিন্ন দল পালাক্রমে যুদ্ধে (জিহাদে) অংশগ্রহণ করবে যাতে আল্লাহর পথে তাদের রক্ত সমভাবে উৎসর্গীকৃত হয়।

উপধারা ১২ : মুসলমানদের অনুসৃত পথ সর্বোত্তম পথ।

উপধারা ১৩ : কুরাইশ মুশরিকদের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সহযোগিতা করার কোন অধিকার মদীনার মুশরিকদের নেই এবং তাদের সঙ্গে তারা কোনরূপ চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। তাদেরকে মুসলমানদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

উপধারা ১৪ : যদি কোন মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং তার এ অপরাধ শরীয়তগতভাবে প্রমাণিত হয়,তাহলে হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। তবে নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি তাকে ক্ষমা করে দেয় তবে তাকে প্রাণদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এ উভয় ক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব হলো হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ।

উপধারা ১৫ : যে ব্যক্তিই এ চুক্তিনামার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করবে তার এ চুক্তিনামা লঙ্ঘনের ও কোন অপরাধীকে সহযোগিতা ও আশ্রয় দানের কোন অধিকার নেই। যে কেউই অপরাধীকে সহযোগিতা করলে কিংবা আশ্রয় দিলে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে সকল ক্ষতির দায়-দায়িত্ব তার।

উপধারা ১৬ : যে কোন বিভেদের ফায়সালার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল।

ধারা : ২

উপধারা ১৭ : মদীনাকে রক্ষার জন্য মুসলমানরা যুদ্ধ করলে ইয়াহুদীদেরকে অবশ্যই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে হবে।

উপধারা ১৮ : বনি আওফের ইয়াহুদীরা মুসলমানদের সঙ্গে এক জাতি হিসাবে পরিগণিত এবং মুসলমান ও ইয়াহুদীরা তাদের ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। তাদের দাসরা এ বিধানের অন্তর্গত অর্থাৎ তারাও এ ক্ষেত্রে স্বাধীন। তবে যে সকল অন্যায়কারী তার নিজ ও পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তারা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এ ব্যতিক্রমের ফলে ঐক্য কেবল শান্তিপ্রিয় মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়েছে।

উপধারা ১৯ : বনি নাজ্জার,বনি হারিস,বনি সায়েদা,বনি জুশাম,বনি আওস,বনি সায়ালাবা ও বনি শাতিবার ইয়াহুদীরাও বনি আওফ গোত্রের ইয়াহুদীদের ন্যায় উপরিউক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সায়ালাবা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত জাফনা গোত্র এবং বনি শাতিবার অন্তর্ভুক্ত সকল উপগোত্রও বনি আওফের ন্যায় অধিকার ভোগ করবে।

উপধারা ২০ : এ চুক্তির অধীন সকলকেই তাদের মন্দের ওপর ভালো বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিজয়ী করতে হবে।

উপধারা ২১ : বনি সায়ালাবার অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহ বনি সায়ালাবার জন্য প্রযোজ্য বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২২ : ইয়াহুদীদের উপরিউক্ত গোত্রসমূহের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গ এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত।

উপধারা ২৩ : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউই এ চুক্তিবদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

উপধারা ২৪ : এ চুক্তির অধীন প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত সম্মানিত (অর্থাৎ আহত ও নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির রক্তের মর্যাদার বিধান রয়েছে)। যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তবে তার ওপর কিসাসের বিধান কার্যকরী হবে। এর (হত্যার) মাধ্যমে সে যেন নিজ ও স্বীয় পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করল। কিন্তু হত্যাকারী যদি অত্যাচারিত হয় তবে তার বিধান ভিন্ন।

উপধারা ২৫ : যদি মুসলমান ও ইয়াহুদীরা সমবেতভাবে যুদ্ধ করে তবে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে যুদ্ধের খরচ বহন করবে। যদি কেউ চুক্তিবদ্ধ জোটের কোন এক অংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে জোটের অন্তর্ভুক্ত সকল পক্ষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

উপধারা ২৬ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহ কল্যাণের ভিত্তিতে পরস্পরের সহযোগী- অকল্যাণের ভিত্তিতে নয়।

উপধারা ২৭ : চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষই অন্য কোন পক্ষের ওপর অবিচার করার অধিকার রাখে না। কেউ এরূপ করলে সকলকে অবশ্যই অত্যাচারিত পক্ষকে সাহায্য করতে হবে।

উপধারা ২৮ : চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষের জন্য মদীনা নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত হলো।

উপধারা ২৯ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষের কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রতিবেশীকে আশ্রয় দান করে তবে তার জীবন অন্য সকলের জীবনের ন্যায় সম্মানার্হ এবং কোনক্রমেই তার ক্ষতি করা যাবে না।

উপধারা ৩০ : কোন নারীকেই তার নিকটাত্মীয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

উপধারা ৩১ : চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহের সকল ব্যক্তি ও গোত্র মুমিন হোক বা কাফের তাদের দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির সঙ্গে রয়েছেন যে ব্যক্তি এ চুক্তিনামার প্রতি সর্বাধিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

উপধারা ৩২ : কুরাইশ ও তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি ও গোত্রকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

ধারা : ৩

উপধারা ৩৩ : এ চুক্তি স্বাক্ষরকারী সকল পক্ষ সমবেতভাবে মদীনাকে রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

উপধারা ৩৪ : যদি মুসলমানরা ইয়াহুদীদেরকে কোন শত্রুর সঙ্গে সন্ধির আহবান জানায় তবে তাদেরকে তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপ ইয়াহুদীরা যদি মুসলমানদের কোন শত্রুপক্ষের সঙ্গে সন্ধির আহবান জানায় তবে মুসলমানগণ তা গ্রহণে বাধ্য। তবে যদি ঐ শত্রুপক্ষ ইসলামের শত্রু ও ইসলাম প্রচারের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে তবে তা গ্রহণীয় নয়।

উপধারা ৩৫ : আওস গোত্রের গোলাম-মনিব নির্বিশেষে সকল ইয়াহুদী এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।

ধারা : ৪

উপধারা ৩৬ : এ চুক্তিনামা অত্যাচারী ও অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না।

উপধারা ৩৭ : মদীনায় অবস্থানকারী যে কোন ব্যক্তি নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী এবং মদীনা থেকে যারা বাইরে যাবে তারাও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী,তবে এ বিধান অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

এ চুক্তিনামার শেষ বাক্যটি ছিল :إنّ الله جار لمن برّ واتّقى و محمد رسول الله সৎকর্মপরায়ণ এবং পরহেজগার ব্যক্তির নিরাপত্তা দানকারী স্বয়ং আল্লাহ্ এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। ৪২৯

এ রাজনৈতিক চুক্তিপত্রটির কিছু অংশ আমরা অনুবাদ করেছি। ইসলামে চিন্তার স্বাধীনতা,সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজের প্রয়োজনে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি এতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। সর্বোপরি এ চুক্তিপত্রে নেতার দায়িত্ব ও ইখতিয়ার এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী সর্বসাধারণের দায়িত্বের বিষয়টি পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে।

যদিও এ চুক্তিনামায় শুধু আওস ও খাজরাজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ইয়াহুদীরা স্বাক্ষর করেছিল এবং ইয়াহুদীদের বড় তিন গোত্র বনি কুরাইযাহ্,বনি নাদির ও বনি কাইনুকা অংশগ্রহণ করে নি,কিন্তু পরবর্তীতে তারাও মুসলমানদের নেতা মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে স্বতন্ত্র চুক্তি করেছিল। এ চুক্তিনামার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নিম্নরূপ :

এ তিন গোত্র স্বতন্ত্রভাবে রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে,তারা রাসূল ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালাবে না। তারা তাদের মুখ ও হাতের দ্বারা নবী (সা.)-এর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না এবং মুসলমানদের শত্রুদের অস্ত্র ও যুদ্ধবাহন সরবরাহ করবে না। যদি কখনও তারা এ চুক্তিপত্রের বিরোধী কিছু করে তবে তাদের রক্ত ঝরানো মহানবীর জন্য বৈধ হয়ে যাবে এবং তাদের সম্পদ ক্রোক এবং নারী ও সন্তানদের বন্দী করা হবে। এ চুক্তিপত্রে বনি নাদিরের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব,বনি কুরাইযার পক্ষে কায়াব ইবনে আসাদ এবং বনি কাইনুকার পক্ষে মুখাইরিক স্বাক্ষর করে।৪৩০

এ চুক্তিনামার ফলশ্রুতিতে মদীনা নিষিদ্ধ (হারাম) ও নিরাপদ এলাকায় পরিণত হলো। এখন মহানবী (সা.) প্রথম সমস্যা অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা শুরু করলেন। কারণ যতক্ষণ তাঁর দীনের প্রচারের প্রতিবন্ধক এ শত্রু বিদ্যমান রয়েছে ততক্ষণ তাঁর দীনের প্রচার কার্যক্রম সফলতা লাভ করতে পারবে না।

ইয়াহুদীদের অপচেষ্টাসমূহ

ইসলামের মহান শিক্ষা ও মহানবী (সা.)-এর উন্নত নৈতিক চরিত্র ও আচরণের প্রভাবে দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগল ও সে সাথে তাদের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিও সুসংহত হলো। মুসলমানদের এ অগ্রগতি মদীনার ইয়াহুদীদের মধ্যে ভীতি ও অস্থিরতার সৃষ্টি করল। কারণ তারা ভেবেছিল ইসলামের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা মহানবীকে নিজেদের দিকে টানতে পারবে। তারা কখনই ভাবতে পারে নি যে,একদিন মহানবীর শক্তি ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের ছাড়িয়ে যাবে। এ কারণেই তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা সাধারণ মুসলমানদের নিকট ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন জটিল প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে মহানবীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টির দ্বারা তাঁর প্রতি তাদের বিশ্বাসকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালাত। কিন্তু তাদের এ ষড়যন্ত্র প্রকৃত মুসলমানদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় নি। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা ও সূরা নিসায় তাদের উপস্থাপিত এরূপ বিতর্কিত কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্মানিত পাঠকগণ এ দু টি সূরা পাঠ করলে ইয়াহুদীদের একগুঁয়েমি ও শত্রুতামূলক মনোভাবের পরিচয় পাবেন। যদিও তারা যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করত তার স্পষ্ট উত্তর দেয়া হতো তদুপরি তারা ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য অজুহাত দেখাত এবং নবীর আহবানের উত্তরে বলত :قلوبنا غلف আমাদের অন্তর পর্দাবৃত,আমরা আপনার কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারছি না৪৩১

আবদুল্লাহ্ ইবনে সালামের ঈমান আনয়ন

এ সকল বিতর্ক যদিও ইয়াহুদীদের গোয়ার্তুমি আরো বাড়িয়ে দিত তবুও কখনো কখনো দেখা যেত কেউ কেউ এর ফলে ঈমান আনত। আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যিনি ইয়াহুদী ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার৪৩২ পর ঈমান আনয়ন করেন। এর কিছুদনি পর অপর ইয়াহুদী ধর্মযাজক মুখাইরিকও ঈমান আনেন। আবদুল্লাহর ঈমান আনার বিষয়টি যদি তাঁর গোত্র জানতে পারে তবে তাঁর নামে কুৎসা রটনা করবে এ আশংকায় তিনি মহানবীকে প্রথমেই তাঁর ঈমান আনয়নের বিষয়টি প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানালেন। মহানবী (সা.) তদনুযায়ী প্রথমে তাঁর ঈমান আনয়নের ঘটনা প্রকাশ না করে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিরূপ- এ সম্পর্কে ইয়াহুদীদের প্রশ্ন করলেন। তারা সমবেতভাবে তাঁকে জ্ঞানী ব্যক্তি হিসাবে তাদের অন্যতম পুরোধা বলে ঘোষণা করল। এ সময় আবদুল্লাহ্ তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজ ঈমান গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। এ কথা শোনামাত্র তারা আবদুল্লাহর ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হলো ও তাকে ফাসেক ও নির্বোধ বলে অপবাদ দেয়া শুরু করল,অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও তারা তাঁকে নিজেদের ধর্মীয় পুরোধা ও জ্ঞানী ব্যক্তি বলে স্বীকার করেছিল।

ইসলামী হুকুমতকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র

ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের বিতর্কসমূহ ও জটিল প্রশ্নসমূহ উত্থাপনের বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাসকে শুধু বাড়িয়েই দেয় নি,সেই সাথে তাঁর উচ্চমর্যাদা ও গায়েবী জ্ঞান সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণাকে আরো স্পষ্ট ও দৃঢ় করেছিল। এ সকল বিতর্কের ফলশ্রুতিতেই আরো কিছু মূর্তিপূজক ও ইয়াহুদী ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইয়াহুদীরা এ পন্থায় ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রের অন্য পন্থা গ্রহণ করেছিল;তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা আঁটছিল। তাই তারা আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে শতাধিক বছরের যে দ্বন্দ্ব ছিল এবং ইসলাম ও ঈমানের ছায়াতলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে যা চাপা পড়ে গিয়েছিল তা পুনরুজ্জীবিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করার ষড়যন্ত্র করল যাতে মুসলমানরা সকলেই এর শিকারে পরিণত হয়।

একদিন আওস ও খাজরাজ গোত্রের সকলে এক জায়গায় সৌহার্দপূর্ণ এক সমাবেশে মিলিত হয়েছিল। বিগত দিনের পরস্পর চরম শত্রু এ দু গোত্রের একক এ সমাবেশ ইয়াহুদীদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মধ্যকার শাস নামক এক খলনায়ক পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপর এক ইয়াহুদী যুবকের প্রতি ইশারা করে এ দু গোত্রের পূর্ব শত্রুতার বিষয়টি উপস্থাপন করতে বলল। সেই যুবক আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের তিক্ত ঘটনাগুলো বর্ণনা শুরু করল,বিশেষত বুয়া নামক যুদ্ধের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করল যাতে আওস গোত্র খাজরাজ গোত্রের ওপর বিজয়ী হয়েছিল। এ দু গোত্রের বীরত্বের কাহিনী সে এমনভাবে বর্ণনা করা শুরু করল যাতে ইসলাম গ্রহণকারী এ দু গোত্রের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়।

ঘটনাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে,উভয় গোত্র আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে অপর পক্ষকে আক্রমণ শুরু করল ও তাদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখা দিল। এ খবরটি মহানবী (সা.)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ কয়েকজন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং ইসলামের মহান লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ইসলাম তোমাদেরকে পরস্পরের ভাই বানিয়ে দিয়েছে এবং তোমাদের মধ্যকার সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যেতে বলেছে। অতঃপর তাদেরকে কিছু উপদেশ দিলেন এবং বিভেদের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করলেন। মহানবীর মর্মস্পর্শী বক্তব্যে তারা এতটা প্রভাবিত হলো যে,তারা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করল এবং পরস্পরের ভ্রাতৃত্বকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শপথ গ্রহণ করল। তারা তাদের অজ্ঞতাজনিত কর্মের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল।৪৩৩

ইয়াহুদীদের অপচেষ্টা এখানেই শেষ হয় নি,বরং ধীরে ধীরে তারা চুক্তি ভঙ্গের ন্যায় বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের দিকে অগ্রসর হলো। তারা আওস ও খাজরাজের কিছু মুশরিক ও মুনাফিক ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করল। তারা মুসলমানদের সাথে কুরাইশদের যুদ্ধে প্রকাশ্য ভূমিকা নিয়ে মূর্তিপূজকদের সপক্ষে জোরেশোরে কাজ করতে লাগল।

কুরাইশ মুশরিকদের সঙ্গে ইয়াহুদীদের প্রকাশ্য ও গোপন যোগসাজশের বিষয়টি মুসলমান ও ইয়াহুদীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেয়। ফলশ্রুতিতে মদীনায় ইয়াহুদীদের স্থায়ী অবস্থানের অবসান ঘটে। এ ঘটনাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী সালের ঘটনাপ্রবাহে প্রদান করব। সে সম্পর্কিত আলোচনায় পাঠকবৃন্দ স্পষ্টরূপে দেখবেন ইয়াহুদীরা কিরূপে পূর্বোল্লিখিত দু টি চুক্তি যা নবীর উদারপন্থী ও সৌহার্দপূর্ণ নীতির পরিচায়ক তা ভঙ্গ করেছে এবং ইসলাম,মুসলমানগণ ও স্বয়ং মহানবীর বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ইসলামের শত্রুদের সহযোগিতা করেছে! তারা রাসূলকে উপরিউক্ত দু টি চুক্তিনামা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য করেছিল।

রাসূল (সা.) হিজরী প্রথম বর্ষের রবিউল আউয়াল মাস হতে দ্বিতীয় হিজরী বর্ষের সফর মাস পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এ সময়েই মসজিদ ও মসজিদকে কেন্দ্র করে গৃহসমূহ নির্মিত হয় এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত উপগোত্রসমূহের প্রায় সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। এ দু গোত্রের খুব কম সংখ্যক লোকই তখনও ইসলাম গ্রহণ করে নি। বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে।৪৩৪

 

সাতাশতম অধ্যায় : দ্বিতীয় হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

যুদ্ধ ও সামরিক মহড়া

যুদ্ধের প্রস্তুতির লক্ষ্যেই এ ধরনের সামরিক মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ সামরিক মহড়াসমূহ প্রথম হিজরীর অষ্টম মাস হতে শুরু হয় এবং দ্বিতীয় হিজরীর রামযান মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এটি মুসলমানদের প্রথম সামরিক মহড়া। এ ধরনের সামরিক মহড়ার সঠিক ব্যাখ্যা ও রহস্য উদ্ঘাটন আমাদের জন্য তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা এ ঘটনাপ্রবাহের সঠিক তথ্য ইতিহাস গ্রন্থসমূহ৪৩৫ থেকে কোনরূপ কম-বেশি ছাড়াই অনুবাদ করব এবং বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকদের অকাট্য মতসমূহ পাঠকদের সমীপে উপস্থাপন করব।

সামরিক অভিযানসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

১. মদীনায় মহানবী (সা.)-এর হিজরতের অষ্টম মাসে তিনি ইসলামের বীর সৈনিক হযরত হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে ত্রিশজন মুহাজিরের একটি দলকে লোহিত সাগরের তীরবর্তী পথ অবরোধের উদ্দেশ্যে পাঠান। এ পথে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করত। হযরত হামযার নেতৃত্বাধীন দল আইস (عيص ) নামক স্থানে কুরাইশদের তিনশ ব্যক্তির একটি কাফেলার মুখোমুখি হয়। কুরাইশ কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু জাহল। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন সংঘর্ষ হয় নি। কারণ মাজদী ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে উভয় দলের সুসম্পর্ক ছিল এবং সে এ দু দলের মধ্যে সমঝোতা করে। ফলে প্রেরিত সেনাদল মদীনায় ফিরে আসে।

অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া মানুষের উন্নতির কারণ

বস্তুতঃ মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে , প্রাকৃতিক , প্রাণীজ ও মানব-জাত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষ এ সব প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে এবং এমন সব বিস্ময়কর আবিষ্কার-উদ্ভাবন করেছে যা মানবসভ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। আর সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সব ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টিলোকে নিহিত সকল প্রাকৃতিক বিধিবিধান উদ্ঘাটন করবে ও নিজেদের কল্যাণের জন্য তা কাজে লাগাবে। কিন্তু কথিত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াসমূহ না থাকলে মানুষ আবিষ্কার-উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত হতো না।

অবশ্য প্রাকৃতিক জগতে , বিশেষতঃ প্রাণীজগতে এমন অনেক উপায়-উপকরণ পরিলক্ষিত হয় যার মধ্যে দৃশ্যতঃ অকল্যাণ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ নিহিত নেই। মানুষ মনে করে , এ সব সৃষ্টি না থাকলেই বা কী অসুবিধা ছিলো ?

আসলে বাহ্যতঃ অকল্যাণকর হিসেবে পরিদৃষ্ট সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও যে কল্যাণ নিহিত নেই এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাহ্যিক ক্ষতিকর উপাদান বা প্রাণী থেকে এমন সব কল্যাণকর উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষ পূর্বে কল্পনাও করতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সাপের ন্যায় মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাণীর বিষ মানুষের বিরাট কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম ওযনের স্বর্ণের তুলনায় বিষের দাম কয়েক গুণ বেশী দেখা যায়।

ক্ষতিকারকতা আপেক্ষিক

এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , সৃষ্টিকুলের সকল সৃষ্টির মধ্যেই কল্যাণকারিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যতঃ ক্ষতিকারক যা পরিলক্ষিত হয় তার ক্ষতিকারকতাও আপেক্ষিক। প্রথমতঃ অনেক প্রাণীর ক্ষতিকারকতা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য। যেমন: সাপের বিষ এবং বাঘ ও সিংহের দন্ত-নখর তাদের আত্মরক্ষার জন্য যরূরী। দ্বিতীয়তঃ এক সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা কেবল অন্য সৃষ্টির সংস্পর্শেই অর্থাৎ পারস্পরিক সংঘাতের পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। অন্যথায় প্রতিটি সৃষ্টিই তার তার নিজস্ব অবস্থানে সুন্দর। একটি সাপকে বা একটি সিংহকে তাদের নিজস্ব অবস্থানে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে তার সৌন্দর্য ও তার সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টিকুশলতাই ধরা পড়বে । তেমনি একটি কাঁটাগাছকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে দেখলে তাকেও সুন্দর ও সুকৌশল সৃষ্টি রূপে দেখা যাবে।

এরপর আসে মানুষের মধ্যকার অবাঞ্ছিত দিকসমূহের কথা। ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে , প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ কমবেশী স্বাধীনতার অধিকারী। আর এদের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও অনিবার্য।

ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক ব্যবহার

প্রাণী হিসেবে অপরিহার্য স্বাধীনতার অতিরিক্ত মানুষের রয়েছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা যাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তার ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য প্রাণীর ইচ্ছাশক্তির ন্যায় শুধু সহজাত প্রবণতা তথা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই উদ্ভূত নয় , বরং সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে ধরণীর বুকে স্বীয় নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , আধিপত্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এ প্রবণতা থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের ইচ্ছা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানুষের এ বিশেষ ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা খারাপ কিছু তো নয়ই , বরং এ হচ্ছে তার এক বিরাট ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফলে অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষতিকারকতা রোধ করতে হলে হয় তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে হতো , অথবা এ ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হতো। কিন্তু তাহলে তার পরিণতি কী হতো ?

প্রাণী হিসেবে প্রদত্ত স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষকে প্রদত্ত ম্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাকে দেয়া না হলে মানুষ মানুষ হতো না ; স্রেফ একটি উন্নত স্তরের প্রাণীপ্রজাতি হতো। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। অন্যদিকে তাকে সৃজনক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি তার অপব্যবহার করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হলে কার্যতঃ সে ফেরেশতার কাছাকাছি কোনো প্রাণীতে পরিণত হতো , মানুষ হতো না এবং মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণের (সীমিত মাত্রায় হলেও) যে সমাহার দেখা যাচ্ছে তথা সে যেভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটতো না। অন্য কথায় , তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার যে সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ঘটতো না। কারণ , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মানে হচ্ছে তাঁর গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো , যদিও সৃষ্টি ও সসীম হবার কারণে এ সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সে গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সীমিত পরিমাণে। সে সীমা কতখানি তা বড় কথা নয় , তবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণাবলী সর্বোচ্চ যে মাত্রায় দেয়া সম্ভব তিনি তাকে তা সে মাত্রায়ই প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক , অন্যথায় এ সৃষ্টি না সর্বোত্তম হবে , না তাঁর প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি হবে।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণ সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রদানের মানেই হচ্ছে তাকে শুধু সৃষ্টির ক্ষমতাই দেয়া হবে না , বরং ধ্বংসের ক্ষমতাও দেয়া হবে , যদিও উভয়ই সীমিত পরিমাণে ; এ সীমা কতোখানি তা বড় কথা নয় , তবে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার মানেই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিলোকের ওপর স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে শুধু কল্যাণ-ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে বা অকল্যাণ-ইচ্ছা দেয়া সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন অসম্ভব করে দেয়া হলে তার মানে হতো তার স্বাধীনতাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া তথা তাকে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় স্রষ্টার সকল গুণ না দেয়া। আর তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার বহিঃপ্রকাশ বা তাঁর সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিনিধি হতো না। সে অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী বহুলাংশে অপ্রকাশিত থেকে যেতো।

মূলতঃ প্রতিনিধিত্বের শর্তই হচ্ছে প্রতিনিধিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে প্রদত্ত এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দু টি জিনিস: প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বিধিবিধান , দ্বিতীয়তঃ নৈতিক বিধিবিধান তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধ। মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী এ দু টি জিনিস। প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করার সাধ্য মানুষের নেই। (অবশ্য অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব থেকে জ্ঞাত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। এরূপ হলে প্রকৃত পক্ষে তাকে প্রাকৃতিক বিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য করা চলে না।) কিন্তু নৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ তার রয়েছে।

তবে যে মানুষ স্বীয় স্বরূপ তথা সে যে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করছে - এ সত্য যথাযথভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যে সৃষ্টি প্রকৃতই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি সে জ্ঞানের আলোয় এতোখানি উদ্ভাসিত যে , নৈতিক বিধান লঙ্ঘনের বর্তমান (ইহজাগতিক) ও ভবিষ্যৎ (পরজাগতিক) প্রতিক্রিয়া তার সামনে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। ফলে স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়।

পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?

সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?

আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।

তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?

নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।

তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?

অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।

সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।

এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।

সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।

বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।

চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।

তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।

মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।

তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।

অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম ব্যক্তিগত মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমি কেন তুমি হলাম না ?!

এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।

ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।

-এর যে প্রাণবীজ -এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে -এর -বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হয়ে -এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে -এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে -এর জন্ম হতো না , বরং -এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ -এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে , -এর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।

ওপরের উদাহরণের -এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে। এখন -এর পক্ষে কী করে হওয়া বা -এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?

অনুরূপভাবে -এর প্রাণবীজ দ্বারা -এর পরিবর্তে গর্ভবতী হলে সে সন্তান হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে , -এর -প্রাণবীজ থেকেই গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব , -প্রাণবীজ থেকে -এর পরিবর্তে -এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম রাখা হলেও।

আর -এর গর্ভে -এর -প্রাণবীজের পরিবর্তে -এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে -এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।

আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।

অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া মানুষের উন্নতির কারণ

বস্তুতঃ মানব প্রজাতির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে , প্রাকৃতিক , প্রাণীজ ও মানব-জাত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। মানুষ এ সব প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছে এবং এমন সব বিস্ময়কর আবিষ্কার-উদ্ভাবন করেছে যা মানবসভ্যতার সৃষ্টি করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। আর সৃষ্টিলোকের চূড়ান্ত লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সব ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টিলোকে নিহিত সকল প্রাকৃতিক বিধিবিধান উদ্ঘাটন করবে ও নিজেদের কল্যাণের জন্য তা কাজে লাগাবে। কিন্তু কথিত অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াসমূহ না থাকলে মানুষ আবিষ্কার-উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত হতো না।

অবশ্য প্রাকৃতিক জগতে , বিশেষতঃ প্রাণীজগতে এমন অনেক উপায়-উপকরণ পরিলক্ষিত হয় যার মধ্যে দৃশ্যতঃ অকল্যাণ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ নিহিত নেই। মানুষ মনে করে , এ সব সৃষ্টি না থাকলেই বা কী অসুবিধা ছিলো ?

আসলে বাহ্যতঃ অকল্যাণকর হিসেবে পরিদৃষ্ট সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও যে কল্যাণ নিহিত নেই এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ , ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাহ্যিক ক্ষতিকর উপাদান বা প্রাণী থেকে এমন সব কল্যাণকর উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে যা মানুষ পূর্বে কল্পনাও করতে পারতো না। উদাহরণ স্বরূপ , সাপের ন্যায় মারাত্মক প্রাণঘাতী প্রাণীর বিষ মানুষের বিরাট কল্যাণ সাধনে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সম ওযনের স্বর্ণের তুলনায় বিষের দাম কয়েক গুণ বেশী দেখা যায়।

ক্ষতিকারকতা আপেক্ষিক

এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে , সৃষ্টিকুলের সকল সৃষ্টির মধ্যেই কল্যাণকারিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহ্যতঃ ক্ষতিকারক যা পরিলক্ষিত হয় তার ক্ষতিকারকতাও আপেক্ষিক। প্রথমতঃ অনেক প্রাণীর ক্ষতিকারকতা তাদের আত্মরক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য। যেমন: সাপের বিষ এবং বাঘ ও সিংহের দন্ত-নখর তাদের আত্মরক্ষার জন্য যরূরী। দ্বিতীয়তঃ এক সৃষ্টির ক্ষতিকারকতা কেবল অন্য সৃষ্টির সংস্পর্শেই অর্থাৎ পারস্পরিক সংঘাতের পরিস্থিতিতেই প্রকাশ পায়। অন্যথায় প্রতিটি সৃষ্টিই তার তার নিজস্ব অবস্থানে সুন্দর। একটি সাপকে বা একটি সিংহকে তাদের নিজস্ব অবস্থানে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে তার সৌন্দর্য ও তার সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার চমৎকার সৃষ্টিকুশলতাই ধরা পড়বে । তেমনি একটি কাঁটাগাছকে তার নিজস্ব অবস্থানে রেখে দেখলে তাকেও সুন্দর ও সুকৌশল সৃষ্টি রূপে দেখা যাবে।

এরপর আসে মানুষের মধ্যকার অবাঞ্ছিত দিকসমূহের কথা। ইতিপূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে , প্রাণীকুল , বিশেষতঃ মানুষ কমবেশী স্বাধীনতার অধিকারী। আর এদের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতও অনিবার্য।

ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক ব্যবহার

প্রাণী হিসেবে অপরিহার্য স্বাধীনতার অতিরিক্ত মানুষের রয়েছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা যাকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নামে অভিহিত করা যায়। অর্থাৎ তার ইচ্ছাশক্তি অন্যান্য প্রাণীর ইচ্ছাশক্তির ন্যায় শুধু সহজাত প্রবণতা তথা আত্মরক্ষার তাগিদ থেকেই উদ্ভূত নয় , বরং সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার মধ্যে রয়েছে ধরণীর বুকে স্বীয় নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , আধিপত্য , শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এ প্রবণতা থেকে উদ্ভূত বিশেষ ধরনের ইচ্ছা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানুষের এ বিশেষ ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা খারাপ কিছু তো নয়ই , বরং এ হচ্ছে তার এক বিরাট ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্যকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার না করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফলে অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষতিকারকতা রোধ করতে হলে হয় তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে হতো , অথবা এ ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হতো। কিন্তু তাহলে তার পরিণতি কী হতো ?

প্রাণী হিসেবে প্রদত্ত স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষকে প্রদত্ত ম্বাধীন ইচ্ছাশক্তি তাকে দেয়া না হলে মানুষ মানুষ হতো না ; স্রেফ একটি উন্নত স্তরের প্রাণীপ্রজাতি হতো। সে ক্ষেত্রে তার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার সৃষ্টি হতো না। অন্যদিকে তাকে সৃজনক্ষমতা প্রদান করার পাশাপাশি তার অপব্যবহার করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করে দেয়া হলে কার্যতঃ সে ফেরেশতার কাছাকাছি কোনো প্রাণীতে পরিণত হতো , মানুষ হতো না এবং মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণের (সীমিত মাত্রায় হলেও) যে সমাহার দেখা যাচ্ছে তথা সে যেভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটতো না। অন্য কথায় , তার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার যে সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা ঘটতো না। কারণ , সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিক্ষমতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মানে হচ্ছে তাঁর গুণাবলীর অনুরূপ গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটানো , যদিও সৃষ্টি ও সসীম হবার কারণে এ সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সে গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সীমিত পরিমাণে। সে সীমা কতখানি তা বড় কথা নয় , তবে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণাবলী সর্বোচ্চ যে মাত্রায় দেয়া সম্ভব তিনি তাকে তা সে মাত্রায়ই প্রদান করবেন এটাই স্বাভাবিক , অন্যথায় এ সৃষ্টি না সর্বোত্তম হবে , না তাঁর প্রতিচ্ছবি বা প্রতিনিধি হবে।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সকল গুণ সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রদানের মানেই হচ্ছে তাকে শুধু সৃষ্টির ক্ষমতাই দেয়া হবে না , বরং ধ্বংসের ক্ষমতাও দেয়া হবে , যদিও উভয়ই সীমিত পরিমাণে ; এ সীমা কতোখানি তা বড় কথা নয় , তবে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার মানেই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টিলোকের ওপর স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে শুধু কল্যাণ-ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে বা অকল্যাণ-ইচ্ছা দেয়া সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন অসম্ভব করে দেয়া হলে তার মানে হতো তার স্বাধীনতাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দেয়া তথা তাকে সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় স্রষ্টার সকল গুণ না দেয়া। আর তাহলে সে সৃষ্টিকর্তার সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার বহিঃপ্রকাশ বা তাঁর সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রার প্রতিনিধি হতো না। সে অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী বহুলাংশে অপ্রকাশিত থেকে যেতো।

মূলতঃ প্রতিনিধিত্বের শর্তই হচ্ছে প্রতিনিধিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাকে প্রদত্ত এ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দু টি জিনিস: প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বিধিবিধান , দ্বিতীয়তঃ নৈতিক বিধিবিধান তথা ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধ। মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী এ দু টি জিনিস। প্রাকৃতিক বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করার সাধ্য মানুষের নেই। (অবশ্য অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক বিধান আবিষ্কার করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব থেকে জ্ঞাত প্রাকৃতিক বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব হতে পারে। এরূপ হলে প্রকৃত পক্ষে তাকে প্রাকৃতিক বিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য করা চলে না।) কিন্তু নৈতিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের সুযোগ তার রয়েছে।

তবে যে মানুষ স্বীয় স্বরূপ তথা সে যে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধিত্ব করছে - এ সত্য যথাযথভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। যে সৃষ্টি প্রকৃতই সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি সে জ্ঞানের আলোয় এতোখানি উদ্ভাসিত যে , নৈতিক বিধান লঙ্ঘনের বর্তমান (ইহজাগতিক) ও ভবিষ্যৎ (পরজাগতিক) প্রতিক্রিয়া তার সামনে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট থাকে। ফলে স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে নৈতিক বিধান লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়।

পিতামাতার কারণে সন্তানের দুর্ভাগ্য কেন ?

সবশেষে আরো একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক ক্ষেত্রেই পিতামাতার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের পরিণামে সন্তান সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়। ধনীর সন্তান ধনী , গরীবের সন্তান গরীব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন রোগগ্রস্ত পিতা বা মাতার সন্তান জন্মগতভাবে রোগগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ ক্ষেত্রে একজনের কর্মফল আরেক জন ভোগ করবে কেন ?

আসলে কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে , সুখ-দুঃখের স্বরূপ কি মানুষ উদ্ঘাটন করতে পেরেছে ? সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য প্রতিটি মানুষের বর্তমান , অতীত ও সম্ভাব্য বা প্রার্থিত ভবিষ্যৎ অবস্থার মধ্যে তুলনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃত পক্ষে বিষয়টি আপেক্ষিক। সে কী আছে , কী চায় এবং কী হলো - এ তিনের সমন্বয় হচ্ছে তার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নির্ণয়ের প্রকৃত মানদণ্ড।

তাই প্রশ্ন করতে হয় , জন্মগতভাবে বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা সুন্দর , স্বাস্থ্যবান , শক্তিশালী , শক্তিক্ষমতার অধিকারী ও প্রভূত ধনসম্পদের মালিক মাত্রই কি ভাগ্যবান ? তাদের প্রত্যেকেই কি সুখী ? তাদের সকলেই কি শান্তির অধিকারী ?

নিঃসন্দেহে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে একই শ্রেণীর সকলের জবাব এক নয়।

তেমনি জন্মগতভাবে অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী তথা অসুন্দর , স্বাস্থ্যহীন , দুর্বল , শক্তিক্ষমতাহীন ও দরিদ্র বস্তিবাসীমাত্রই কি দুঃখী ? এ প্রশ্নের জবাবও একই শ্রেণীর সকল বস্তিবাসীর ক্ষেত্রে অভিন্ন নয়। আর এদের মধ্যে যদি কেউ নিজেকে দুঃখী বলে অনুভব না করে তাহলে তাকে ভাগ্যহীন বলা চলে কি ?

অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির সকল সময়ের অবস্থা এক নয়। একই ধনী ব্যক্তি যেমন কখনো সুখী , কখনো অসুখী , তেমনি একই বস্তিবাসী ব্যক্তি কখনো সুখী , কখনো অসুখী।

সুখ-দুঃখ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের বাহ্যিক ও পার্থিব মানদণ্ড যদি চূড়ান্ত হতো তাহলে রাজপুত্র স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে ফকীর-দরবেশ হয়ে যেতো না , ধনী যাত্রীর ভুল করে ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকা গরীব রিকশাওয়ালা ফেরত দিতে যেতো না , দেশ বা ধর্মের জন্য বা মানবতার জন্য কেউ প্রাণ উৎসর্গ করতো না।

এখানে মনে রাখার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এই যে , প্রতিটি ব্যক্তি যেমন একেকটি একক সত্তা তেমনি সে তার পরিবার , সমাজ , দেশ ও বিশ্বের এবং সর্বোপরি গোটা সৃষ্টিলোকের সত্তারও অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ বটে।

সন্তান নিঃসন্দেহে পিতামাতার সত্তার অংশবিশেষ এবং পিতামাতাও সন্তানের সত্তার অংশবিশেষ। এভাবে পরস্পরের সত্তার অংশবিশেষ হওয়ার কারণেই তারা শারীরিকভাবে পরস্পর স্বাধীন সত্তা হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের সুখ-দুঃখ , ভালো-মন্দ ও সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দ্বারা পারস্পরিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই পিতামাতার সন্তান-জন্মলাভপূর্ব অবস্থার দ্বারা সন্তানের প্রভাবিত হওয়ার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক প্রভাব সীমাবদ্ধ নয় , বরং সন্তানের জন্মপরবর্তী-কালীন পারস্পরিক সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যও তাদেরকে পারস্পরিকভাবে স্পর্শ করে। অনেক সময় সন্তানের দুর্ভাগ্য স্বয়ং সন্তানের তুলনায় পিতামাতার জন্য অধিকতর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

একটি জন্মান্ধ শিশু পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কী জানে না এবং তা তাকে হাজারো ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তাই পার্থিব জগতের সৌন্দর্য দেখতে না পারার কারণে তার তেমন কোনো দুঃখ হবার কথা নয় , কিন্তু সন্তানের জন্মান্ধতার কষ্ট এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে , অনেক সময় পিতামাতা সন্তানের অন্ধত্ব দেখার আগে নিজেদের মৃত্যু হলো না কেন - এ মর্মে আফসোস করে থাকে।

বিষয়টি একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের সাথে তুলনীয়। একই দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে তা দ্বারা সুস্থ অঙ্গও প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে যে অঙ্গের সাথে যে অঙ্গের দূরত্বগত বা কর্মগত নৈকট্য বেশী সে সব অঙ্গ পরস্পর অধিকতর প্রভাবিত হয়। তেমনি সমাজ , দেশ ও বিশ্বের সামগ্রিক পরস্থিতির ভালো-মন্দ দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় , কারণ , সে সমাজ , দেশ ও বিশ্বের অংশ।

চিকিৎসাযোগ্য নয় এমন কোনো ব্যাধি কোনো ব্যক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এলে এবং তা সমাজে সংক্রামিত হলে তাতে একজন সুস্থ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার এবং তা থেকে আদৌ সুস্থ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্কও তেমনি। সন্তানের জন্মগ্রহণপূর্ব তথা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম থাকে বিধায় সন্তানের মধ্যে পিতামাতার ভালোমন্দ বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে বেশী। পিতার দেহের প্রাণবীজ থেকে মাতৃগর্ভে সন্তানের সূচনা হয় এবং মাতৃদেহের উপাদানে পরিপুষ্ট হয়ে সে একটি পরিপূর্ণ শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ হয়। ফলে পিতামাতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে সর্বাধিক মাত্রায় স্থানান্তরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এ বিষয়টিকে গাছের বীজ থেকে গাছ হওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। টক আমের আঁটি থেকে টক আমের গাছই হবে , মিষ্টি আমের গাছ হবে না। অন্যদিকে যে মাটিতে এ আঁটি বপন করা হয়েছে তার প্রভাবও গাছ ও তার ফলে বিস্তার লাভ করবে। বলা হয় , ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে ছাতকের কমলা পাওয়া যাবে না , তেমনি হুবহু দার্জিলিং-এর কমলাও পাওয়া যাবে না , বরং ছাতক ও দার্জিলিং উভয় জাতের কমলাগাছের কমলা থেকে তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা স্বতন্ত্র হবে। এর বিপরীত করা হলেও তার ফল হবে প্রায় অনুরূপ। তবে বীজ থেকে চারা গজানোর পর সে চারা তুলে নিয়ে তৃতীয় কোন জায়গায় লাগালে এর বৈশিষ্ট্য হবে আরো ভিন্ন ধরনের। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে বীজ , জন্মকালীন পরিপুষ্টি ও জন্মপরবর্তী পরিপুষ্টি তিনটিই প্রভাবশালী হবে এবং মিশ্র ফলাফল প্রদান করবে।

তেমনি পোকায় ধরা , ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল বীজ থেকে সৃষ্ট গাছ এবং দূষিত মাটিতে বপনকৃত ভালো বীজ থেকে সৃষ্ট গাছও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে - এটাই স্বাভাবিক।

মানুষের বেলায় , একই প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রভাবের পাশাপাশি জন্মপরবর্তী পরিবেশ ও শিক্ষাও প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তবে মানুষ তার বিচারবুদ্ধির পরিপক্বতায় উপনীত হবার পর স্বীয় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে জন্ম , পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত অবাঞ্ছিত প্রভাব শারীরিক ও পার্থিব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এবং নৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি কাটিয়ে ঊঠতে পারে।

তৃতীয়তঃ সৃষ্টির সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে সে জন্মগতভাবে যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে তার বিকাশ ও পূর্ণতায় উপনীত হওয়া বা না-হওয়াতে , অন্যের অনুরূপ হওয়া বা না-হওয়াতে নয়। বিড়ালের জন্য পরিপূর্ণ বিড়াল হওয়াতেই সার্থকতা , বাঘ হতে না পারা তার জন্য ব্যর্থতা নয়। একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। অন্যদিকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মূল পার্থক্য তার বিচারবুদ্ধি ও ঐশী গুণাবলী , অতএব , তার সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হচ্ছে এ গুণাবলীর বিকাশ ও ব্যবহার। এতে যে সফল , সে-ই প্রকৃত সফল এবং এতে যে ব্যর্থ সে-ই প্রকৃত ব্যর্থ।

অন্যদিকে পার্থিব ও অপার্থিব মিলিয়ে ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে স্বতন্ত্র। তাই দেখা যায় যে , এক ব্যক্তি যা পাওয়ার জন্য লালায়িত এবং না পাওয়ার দুঃখে বুক ফেটে মারা যাবার উপক্রম , আরেক ব্যক্তি তা-ই অবজ্ঞাভরে পরিহার করছে। অতএব , সাফল্য-ব্যর্থতার অন্যতম ব্যক্তিগত মানদণ্ড এই আশা-আকাঙ্ক্ষও বটে , তবে কারো ব্যক্তিগত মানদণ্ড প্রকৃত বিচারে যথার্থ হতে পারে এবং কারো মানদণ্ড অযথার্থও হতে পারে। এ মানদণ্ডের যথার্থতা-অযথার্থতা নির্ণীত হবে অপার্থিব মানবিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে। কারণ , এটাই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছে যে , বস্তুজগতের সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক , অপ্রাকৃতিক ও মানবিক কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , তেমনি মরণশীল মানুষের জন্য তা খুবই অস্থায়ী। অন্যদিকে মানুষ অবস্তুগত যা কিছু অর্জন করে তা বস্তুজগতের কারণাদির প্রভাবে তার হাতছাড়া হয় না এবং তা চিরস্থায়ী। তাই তার উচিত মানবিক ও আত্মিক সম্পদ অর্জনকেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা এবং পার্থিব জীবন ও উপায়-উপকরণকে এ লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা।

মোদ্দা কথা , সৃষ্টিলোকে যা কিছু অবাঞ্ছিত উপাদান ও কারণ বলে মনে হয় তা মোটেই অযথা , বা অবাঞ্ছিত , বা অকল্যাণকর নয়। বরং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে সব কিছুতেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমি কেন তুমি হলাম না ?!

এ প্রসঙ্গে আনুষঙ্গিক হিসেবে আরো একটি বিষয়ের ওপরে সংক্ষেপে হলেও আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তা হচ্ছে , অনেক সময় অপূর্ণতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দেখা যায়। যেমন: বলা হয় , সৃষ্টিকর্তা অমুককে বিকলাঙ্গ করে সৃষ্টি করলেন কেন ? আমি কেন সুন্দর চেহারার অধিকারী হলাম না ? তিনি কেন আমাকে ধনীর ঘরে পাঠালেন না অর্থাৎ আমি কেন ধনীর সন্তান হলাম না ? আমার মেধা-প্রতিভা অমুকের তুলনায় কম হলো কেন ? এ পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণেই আমি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের জবাবে যা বলতে হয় তা হচ্ছে , সৃষ্টিপ্রকৃতিতে অপূর্ণতা বলতে স্বতন্ত্র কিছু নেই , বরং পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতিই অপূর্ণতা। আর পূর্ণতার অভাব বা ঘাটতি সৃষ্টিজগতের কার্যকারণ থেকেই উদ্ভূত হয় ; সৃষ্টিকর্তা পরিকল্পিতভাবে কারো মধ্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে দেন না বা কাউকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করেন না। বিশেষ করে মানুষের ক্ষেত্রে এই অপূর্ণতা বা ঘাটতি অজ্ঞতা বা ভুল পদক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়।

ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোনো বীজে ত্রুটি থাকলে বা ত্রুটিপূর্ণ মাটিতে বীজ বপন করা হলে অথবা পরিবেশগত অবনতি ঘটলে একটি বীজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ গাছ জন্ম নিতে পারে এবং তা স্বাভাবিক পরিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও স্বাভাবিক ফল প্রদানে অসমর্থ হতে পারে। অনুরূপভাবে পিতার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণবীজে বা মাতার ডিম্বে বা শরীরে ত্রুটি থাকলে অথবা পারিপার্শ্বিক ত্রুটির কারণে (যেমন: হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ-পরবর্তীকালে সেখানকার বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ঘটেছে) বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। অতএব , এ জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

সুন্দর চেহারার অধিকারী বা ধনীর সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। বিষয়টি নিম্নোক্ত উদাহরণের সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যেতে পারে।

-এর যে প্রাণবীজ -এর গর্ভে মানবশিশুতে পরিণত হয়েছে তা-ই রূপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং উক্ত প্রাণবীজ ও গর্ভধারিনীর গর্ভকালীন অবস্থার ফলে যে ধরনের শিশু তৈরী হওয়া সম্ভব সে শিশুরূপেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যে সময়ে -এর -বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হয়ে -এর ভ্রূণ তৈরী হয়েছে সে সময় তা না হয়ে অন্য সময় হলে -এর অন্য কোনো বীজ দ্বারা -এর গর্ভসঞ্চার হলে তাতে -এর জন্ম হতো না , বরং -এর জন্ম হতো এবং হয়তোবা বীজ অথবা গর্ভকালীন অবস্থার পার্থক্যের কারণে সুন্দর চেহারা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতো। অর্থাৎ -এর পক্ষে যা হওয়া সম্ভব ছিলো সে তা-ই হয়েছে , -এর পক্ষে হওয়া সম্ভব ছিলো না , কারণ উভয়ই স্বতন্ত্র।

ওপরের উদাহরণের -এর পক্ষে ধনীর সন্তান বা নামীদামী লোকের সন্তান হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ , বরং এর অসম্ভাব্যতা অধিকতর সুস্পষ্ট। কারণ , দরিদ্র -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে এবং ধনী -এর -প্রাণবীজ থেকে -এর জন্ম হয়েছে। এখন -এর পক্ষে কী করে হওয়া বা -এর সন্তান হওয়া সম্ভব হতো ?

অনুরূপভাবে -এর প্রাণবীজ দ্বারা -এর পরিবর্তে গর্ভবতী হলে সে সন্তান হতো না। এমনকি যদি ধরে নেয়া হয় যে , -এর -প্রাণবীজ থেকেই গর্ভবতী হয়েছে তথাপি সে সন্তান হতো না। কারণ , বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বীজের ভূমিকা মুখ্য হলেও মাটির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয় , যে কারণে ছাতকের কমলার বীজ দার্জিলিং-এ লাগালে তাতে না ছাতকের কমলা হয় , না দার্জিলিং-এর , বরং তৃতীয় ধরনের কমলা হয়ে থাকে। অতএব , -প্রাণবীজ থেকে -এর পরিবর্তে -এর গর্ভে সন্তান হলে সে বর্তমান থেকে ভিন্ন এক ব্যক্তিরূপে জন্ম নিতো , এমনকি তার নাম রাখা হলেও।

আর -এর গর্ভে -এর -প্রাণবীজের পরিবর্তে -এর কোনো প্রাণবীজ থেকে গর্ভসঞ্চার হলে তা থেকে -এর জন্মগ্রহণের তো দূরতম সম্ভাবনাও থাকে না। কারণ , সন্তানের ব্যক্তিসত্তা নির্ধারণের মূল উপাদান হচ্ছে প্রাণবীজ ; ল্যাংরা আমের বীজ থেকে ল্যাংরা আম এবং ফজলী আমের বীজ থেকে ফজলী আম জন্ম নেবে ; মাটির অভিন্নতা একটিকে আরেকটিতে পরিবর্তিত করে দেয় না , যদিও মাটির পরিবর্তনে একই বীজের গাছের বৈশিষ্ট্যে অনেকখানি পার্থক্য হয়ে থাকে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে , যারা অসুন্দর , হীনস্বাস্থ্য , দুর্বল , বিকলাঙ্গ , ক্ষমতাহীন বা নিঃস্ব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে অন্য কেউ হয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব ছিলো না। অবশ্য তার জন্ম না হওয়া সম্ভব ছিলো , (কারণ , সে একজন সম্ভব অস্তিত্ব)। কিন্তু বিষয়টি তার পিতামাতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার জন্মের জন্য তার পিতামাতার দায়িত্বহীন ইচ্ছা অথবা দায়িত্বহীন ইচ্ছা না থাকা সাপেক্ষে অজ্ঞতাই দায়ী।

আর ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: বিকলাঙ্গতা বা জন্মগত ব্যাধির ক্ষেত্রে) এ ধরনের সন্তানের জন্মগ্রহণের কারণে স্বয়ং সন্তানটির মনঃকষ্টের পরিমাণের চেয়ে তার পিতামাত্রার মনঃকষ্টের পরিমাণ অনেক গুণে বেশী হয়ে থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন: দারিদ্র্য ও অসৌন্দর্যের ক্ষেত্রে) সন্তানটি তার জন্মগ্রহণকে সম্ভাব্য জন্ম না নেয়ার ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কোনো দরিদ্রসন্তানকে যদি জানানো হয় যে , দারিদ্র্যজনিত কারণে তার পিতামাতাকে কেউ এ সন্তানটি গর্ভে থাকাকালে গর্ভপাত ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছিলো তখন ঐ পরামর্শদাতার প্রতি সন্তানটি সন্তুষ্ট হয় , নাকি অসন্তুষ্ট হয় তা লক্ষণীয়। নিঃসন্দেহে সে তার জন্ম না নেয়ার কথাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61