চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103676
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103676 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

কুরাইশের বাণিজ্য পথ হুমকির সম্মুখীন

আনন্দ-বেদনার প্রথম হিজরী বর্ষ অতিবাহিত হয়ে মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গী মুহাজিরদের মদীনা পদার্পণের দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হলো। দ্বিতীয় হিজরীতে লক্ষণীয় বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটে। তন্মধ্যে দু টি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যার প্রথমটি হলো কিবলা পরিবর্তন এবং দ্বিতীয়টি হলো বদর যুদ্ধ। বদর যুদ্ধের কারণ উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে এর কিছু পটভূমি আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ পটভূমি আলোচনার মাধ্যমে বদর যুদ্ধের লক্ষ্যের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রথম হিজরীর শেষ দিকে ও দ্বিতীয় হিজরীর প্রথমাংশে মহানবী (সা.) বেশ কিছু টহলদার সেনা436 কুরাইশদের বিভিন্ন বাণিজ্য পথে নিয়োজিত করেন। আমরা পরবর্তীতে দেখব এ সব টহলদার সেনা নিয়োগের কারণ কি ছিল।

ঐতিহাসিকগণ রাসূলের জীবনী গ্রন্থে দু টি শব্দ অনেক বার ব্যবহার করেছেন যার একটি হলো গাজওয়া এবং অপরটি হলো সারিয়া । গাজওয়া হলো সে সকল সেনা অভিযান যাতে স্বয়ং রাসূল (সা.) অংশগ্রহণ করেছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। সারিয়া হলো যে সকল সামরিক অভিযানে রাসূল সেনাদল প্রেরণ করেছেন,কিন্তু নিজে অংশগ্রহণ করেন নি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি অন্য কারো নেতৃত্বে সেনাদল প্রেরণ করেছেন। মহানবীর নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের সংখ্যা ঐতিহাসিকগণ 26 অথবা 27টি বলেছেন। এ মতপার্থক্যের কারণ হলো খাইবারের যুদ্ধ ও ওয়াদিউল কুরার যুদ্ধ কোন বিরতি ছাড়াই সংঘটিত হওয়ায় কেউ কেউ এ দু টিকে একটি যুদ্ধ বলে ধরেছেন আবার কেউ স্বতন্ত্র যুদ্ধ হিসাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।437

রাসূলের জীবদ্দশায় কতটি সারিয়া সংঘটিত হয়েছিল সে সংখ্যার বিষয়েও বিভিন্ন মত রয়েছে। ঐতিহাসিকগণ সারিয়ার সংখ্যা 35,36,48,এমনকি কেউ কেউ 66 পর্যন্ত বলেছেন। সংখ্যার এ ভিন্নতার কারণ হলো যে সকল সেনা অভিযানে সৈন্যের সংখ্যা খুব কম ছিলকোন কোন ঐতিহাসিক সেগুলোকে হিসাব করেন নি;এ কারণেই সংখ্যার এ তারতম্য দেখা দিয়েছে। ঐতিহাসিকদের অনুকরণে আমরাও এখন থেকে যে সকল যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অংশগ্রহণ করেন নি সেগুলোকে সারিয়া এবং যে সকল যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ অংশগ্রহণ করেছিলেন সেগুলোকে গাজওয়া নামে অভিহিত করব। আমরা বর্ণনা সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে সারিয়াসমূহের উল্লেখ হতে বিরত থাকব। তবে প্রথম হিজরীর সারিয়াসমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে প্রদান করব। কারণ কোন কোন যুদ্ধে,বিশেষত বদরের যুদ্ধে এ সকল সারিয়ার প্রভাব ছিল। এখানে আমরা কয়েকটি গাজওয়া ও সারিয়ার বর্ণনা প্রদান করছি :

2. এ সেনা অভিযানে মহানবী (সা.) উবাইদাতা ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে ষাট অথবা আশি জন মুহাজিরকে কুরাইশ কাফেলার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি সেনাদল নিয়ে সানিয়াতুল মাররার পাদদেশে প্রবাহমান বারিধারা পর্যন্ত পৌঁছান। তিনি সেখানে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে আসা দু ব্যক্তির এক কাফেলার মুখোমুখি হন। উভয় দল কোন সংঘর্ষ ছাড়াই নিজ নিজ পথে ফিরে যায়;তবে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন কাফেলা হতে দু ব্যক্তি (যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল) মুসলমানদের সঙ্গে মদীনায় চলে আসে। এ অভিযানে সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস আবু সুফিয়ানের কাফেলার দিকে একটি তীর নিক্ষেপ করেছিলেন।

3. প্রথম হিজরী বর্ষের জিলহজ্ব মাসে মহানবী (সা.) সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে আটজনের একটি সেনা দলকে (যাঁদের সকলেই মুহাজির ছিলেন) কুরাইশদের খবর নিতে মদীনার বাইরে প্রেরণ করেন। তিনি খার্রার নামক স্থান পর্যন্ত গিয়ে কাউকে না দেখে ফিরে আসেন।

কয়েকটি ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) স্বয়ং কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবন করেন :

4. দ্বিতীয় হিজরী বর্ষের সফর মাসে একদল মুহাজির ও আনসারকে সঙ্গে নিয়ে মহানবী কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবন ও বনি দামারার (জামারার) সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আবওয়া পর্যন্ত আসেন। তিনি মদীনায় ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের ভার সা দ ইবনে ওবাদার ওপর অর্পণ করেন। মহানবী আবওয়া পর্যন্ত পৌঁছলেও কুরাইশ কাফেলার দেখা পান নি এবং তিনি বনি দামারাহ্ গোত্রের সঙ্গে চুক্তি করে মদীনায় ফিরে আসেন।

5. দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তিনি সায়েব ইবনে উসমান অথবা সা দ ইবনে মায়াজের ওপর মদীনার দায়িত্ব অর্পণ করে দু ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে বাওয়াত438 (بواط ) পর্বত পর্যন্ত গমন করেন,কিন্তু উমাইয়্যা ইবনে খালফের নেতৃত্বাধীন একশ ব্যক্তির কাফেলাটিকে ধরতে সক্ষম হন নি এবং মদীনায় ফিরে আসেন।

6. দ্বিতীয় হিজরীর জমাদিউল উলা মাসের মধ্যভাগে মদীনায় খবর পৌঁছে যে,আবু সুফিয়ান এক কাফেলা নিয়ে সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেছে। মহানবী (সা.) আবু সালামাকে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে জাতুল উশাইরার দিকে যাত্রা করেন। তিনি উশাইরাতে জমাদিউস সানির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আবু সুফিয়ানের কাফেলার প্রতীক্ষায় থাকেন। কিন্তু তাদের সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসেন। ফেরার পথে তিনি বনি মাদলাজ গোত্রের সঙ্গে চুক্তি করেন। এ চুক্তির বিষয়বস্তু ইতিহাস গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত হয়েছে।439

ইবনে আসির440 বলেছেন,এ সেনা অভিযানে মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা এক স্থানে যাত্রাবিরতি করে রাত্রি যাপন করেছিলেন। সে রাত্রিতে তিনি ঘুমন্ত হযরত আলী ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরের শিয়রে এসে দাঁড়ান এবং তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগান। তিনি আলীর মাথা ও মুখমণ্ডল ধুলায় আবৃত দেখেন। তিনি আলীকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আবু তোরাব (মাটি দ্বারা আবৃত)! কি হয়েছে? (তখন থেকে তিনি মুসলমানদের মধ্যে আবু তোরাব নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।) অতঃপর তিনি উভয়ের উদ্দেশে বলেন, পৃথিবীর ওপর বিচরণকারী সবচেয়ে কঠোর হৃদয়ের ব্যক্তি কে তা কি তোমাদের বলব? তাঁরা উভয়েই বললেন, অবশ্যই,হে রাসূলাল্লাহ্। তিনি বললেন, পৃথিবীর ওপর বিচরণকারী দু ব্যক্তি সবচেয়ে কঠোর হৃদয়ের অধিকারী। তাদের প্রথম জন হলো যে হযরত সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রীকে হত্যা করে আর তাদের দ্বিতীয় জন হলো যে আলীর মাথায় তরবারি দ্বারা আঘাত করবে ও তার শ্মশ্রু ও মুখমণ্ডলকে রক্তরঞ্জিত করবে।

7. মহানবীর পূর্বোক্ত অভিযান হতে মদীনায় ফিরে আসার দশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই খবর পাওয়া যায় যে,কারাজ ইবনে জাবের নামক এক ব্যক্তি মদীনা হতে উষ্ট্র ও মেষসমূহ জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছে। এ ব্যক্তিকে ধরার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নিয়ে বদর নামক স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু তাকে না পেয়ে মদীনায় ফিরে আসেন এবং শাবান মাস পর্যন্ত মদীনাতেই অবস্থান করেন।441

8. দ্বিতীয় হিজরী সালের রজব মাসে মহানবী আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ নামক এক সাহাবীর নেতৃত্বে আশি জন মুহাজিরকে কুরাইশ কাফেলার অনুসন্ধানে পাঠান। তিনি এ সেনাদলের নেতার হাতে একটি পত্র দিয়ে বলেন, দু দিন যাত্রার পর পত্রটি খুলে সেই নির্দেশমতো কাজ করবে442 এবং অধীন ব্যক্তিদের কোন কাজে বাধ্য করবে না। তিনি দু দিন পথযাত্রার পর পত্রটি খুলে দেখেন তাকে মহানবী নির্দেশ দিয়েছেন মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাহলাহ্ নামক স্থানে অবস্থানের এবং সেখান হতে কুরাইশদের কাফেলাসমূহের ও অন্যান্য খবর সংগ্রহের চেষ্টা করার।

আবদুল্লাহ্ পত্রের নির্দেশ মতো তাঁর অনুগত সকল সৈন্যকে নিয়ে নাহলায় অবস্থান নেন। তখন তায়েফ হতে কুরাইশদের একটি কাফেলা আমর খাদরামীর (খাজরামীর) নেতৃত্বে মক্কায় ফিরছিল। মুসলমানগণ তাদের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করছিল। মুসলমানগণ শত্রুদেরকে নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে মাথা কামিয়ে ফেলেন যাতে তারা মনে করে মুসলমানগণ মক্কায় যিয়ারতের উদ্দেশ্যে এসেছে। কুরাইশগণ মুসলমানদের এ অবস্থায় দেখে নিশ্চিত হলো যে,তারা উমরার উদ্দেশ্যে এসেছে এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

অপর দিকে মুসলমানগণ যুদ্ধের লক্ষ্যে পরামর্শ সভাতে বসল। সভায় কুরাইশদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। কিন্তু সে দিন ছিল হারাম মাস (যে মাসে যুদ্ধ হারাম) রজবের শেষ দিন। এ কারণে মুসলমানগণ আক্রমণের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। অন্যদিকে সে দিনই কুরাইশদের ঐ স্থান ত্যাগ করে মক্কার হারামে প্রবেশ করার সম্ভাবনা ছিল। সে ক্ষেত্রে হারামের সীমানায় যুদ্ধ করাও হারাম হয়ে যাবে। তাই মুসলমানরা হারামের পরিসীমায় যুদ্ধ করা অপেক্ষা হারাম মাসে যুদ্ধ করাকে প্রাধান্য দেয়। এ লক্ষ্যে তারা শত্রুকে বিভ্রান্তিতে ফেলে যুদ্ধ শুরু করে। এতে কাফেলার প্রধান ওয়াকেদ ইবনে আবদুল্লাহ্ তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। তার অধীন ব্যক্তিরাও পালিয়ে যায়। কিন্তু উসমান ইবনে আবদুল্লাহ্ ও হাকাম ইবনে কাইসান নামক দু ব্যক্তি মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। টহলদার সেনাপতি আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ বন্দী ঐ দু ব্যক্তিকে নিয়ে তাদের ব্যবসালব্ধ সম্পদসহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

মহানবী (সা.) টহলদার সেনাপতির ওপর এ কারণে তীব্র অসন্তুষ্ট হন যে,তিনি তাঁর নির্দেশ অমান্য করে হারাম মাসে যুদ্ধ করেছেন। তাই তিনি তাঁদেরকে বলেন, কখনই আমি তোমাদেরকে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতি দেই নি। 443 কুরাইশরা এ ঘটনাকে তাদের অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বলা শুরু করল যে,মুহাম্মদ হারাম মাসের সম্মান বিনষ্ট করেছে। মদীনার ইয়াহুদীরাও এ ঘটনাকে খারাপ লক্ষণ বলে প্রচার চালিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাল। মুসলমানগণ আবদুল্লাহ্ ও তাঁর অনুগত সৈনিকদের ভৎসনা করতে লাগল। মহানবী (সা.) তাঁদের আনীত গনীমতসমূহ কি করবেন এজন্য ওহীর প্রতীক্ষায় রইলেন। তখনই আল্লাহর তরফ থেকে হযরত জিবরাঈল নিম্নোক্ত আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হলেন :

) يسئلونك عن الشّهر الحرام قتال فيه، قل قتال فيه كبير و صدّ عن سبيل الله كفربه و المسجد الحرام و إخراج أهله منه أكبر عند الله و الفتنة أكبر من القتال(

তোমাকে তারা হারাম মাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে,তুমি (তাদেরকে) বল,হারাম মাসে যুদ্ধ গুরুতর অপরাধ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি,আল্লাহকে অস্বীকার করা,মসজিদুল হারামে বাধা দেয়া ও তার বাসিন্দাদেরকে তা থেকে বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকট হারাম মাসে যুদ্ধ অপেক্ষা বড় অপরাধ। ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়। 444

এ আয়াত অবতীর্ণের মাধ্যমে বলা হয় যে,হারাম মাসে যুদ্ধ করার মাধ্যমে মুসলমানগণ অন্যায় করেছে,কিন্তু কুরাইশদের অপরাধ তার থেকেও গুরুতর। কারণ তারা মসজিদুল হারামের অধিবাসী মুসলমানদের গৃহত্যাগে বাধ্য করে,তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ও ভীতি প্রদর্শন করে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তা এতটা গুরুতর যে,তারা মুসলমানদের কর্মের প্রতিবাদের অধিকার রাখে না।

সুতরাং এ আয়াত অবতীর্ণের ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো। মহানবী (সা.) যুদ্ধলব্ধ গনীমতের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করলেন। কুরাইশরা তাদের বন্দী দু ব্যক্তিকে মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্ত করতে চাইলে মহানবী তাদের হাতে বন্দী দু জন মুসলমানকে মুক্ত করার শর্তে তাতে রাজী হন। আর যদি তারা ঐ দু মুসলমানকে হত্যা করে থাকে তবে তাদের দু বন্দীকেও হত্যা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। কুরাইশরা বাধ্য হয়ে মুসলমান বন্দীদ্বয়কে মুক্ত করে দেয়। মহানবী কুরাইশ বন্দীদ্বয়ের মুক্তির নির্দেশ দেন। মহানবীর বদান্যতায় ঐ দু কুরাইশের একজন মুসলমান হয় এবং অপর জন মক্কায় ফিরে যায়।

সামরিক অভিযান ও মহড়ার উদ্দেশ্য

এ সকল অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের বাণিজ্য পথের নিকট বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করা এবং কুরাইশদেরকে মুসলমানদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে অবহিত করা। বিশেষত যে সকল অভিযানে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার পথ অবরোধ করতেন সে অভিযানগুলোর মাধ্যমে মক্কার শাসকগোষ্ঠীকে বুঝিয়ে দিতেন : তোমাদের বাণিজ্য পথ সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তাই আমরা চাইলে যে কোন সময় সে পথ বন্ধ করে দিতে পারি।

মক্কার অধিবাসীদের জীবন ধারণের মূল উপায় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। সিরিয়া ও তায়েফ হতে যে সম্পদ আনা-নেয়া হতো তা দিয়েই মক্কাবাসীদের অর্থনৈতিক জীবন পরিচালিত হতো। যদি এ বাণিজ্য-পথটি নব্য শত্রু ও তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর (বনি দামারা,বনি মাদলাজ প্রভৃতি) দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে তাদের জীবনযাত্রাই স্তব্ধ হয়ে যাবে।

বাণিজ্য পথে টহলসেনা মোতায়েন ও সামরিক মহড়া প্রদর্শন করে কুরাইশদের বুঝিয়ে দেয়া হয় তাদের বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ মুসলমানদের হাতে। যদি তারা মুসলমানদের সঙ্গে অসদাচরণ করে,মক্কায় অবস্থানকারী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং পূর্বের ন্যায় একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বাধা প্রদান করে তবে তাদের জীবনযাত্রাকে মুসলমানরা অচল করে দেবে।

মোটামুটি এ সকল অভিযানের লক্ষ্য বলা যায় মুসলমানদের ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতা দানে কুরাইশদের বাধ্য করা যাতে একত্ববাদী এ ধর্মের আলো সমগ্র আরব উপদ্বীপ ও এর কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এর শক্তিশালী ও যুক্তিপূর্ণ বাণী এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের অন্তরে স্থান করে নিতে পারে। অন্যদিকে মুসলমানদের জন্য আল্লাহর ঘর যিয়ারতের পথও যেন উন্মুক্ত হয় সেটিও লক্ষ্য ছিল।

কোন আন্দোলনের নেতা যতই শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হন না কেন,শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে তিনি যতই নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার পরিচয় দিন না কেন,যদি সেখানে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ না থাকে তবে তিনি যথাযথভাবে অন্তরসমূহকে আলোকিত করতে সক্ষম হবেন না।

ইসলামের অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল কুরাইশগণ কর্তৃক সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ যা মুক্তভাবে ইসলাম প্রচারের পথকে রুদ্ধ করেছিল। এ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের একমাত্র পথ ছিল বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া এবং সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কুরাইশদের বাণিজ্য পথকে শঙ্কিত করে তাদেরকে অর্থনৈতিক চাপে রাখা।

মধ্যপ্রাচ্যবিদগণের দৃষ্টিতে এ অভিযানসমূহ

এ সামরিক অভিযানসমূহের বিশ্লেষণে মধ্যপ্রাচ্যবিদগণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা এমন অনেক কথা বলেছেন যা ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান সাক্ষ্য-প্রমাণের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা বলে থাকেন,রাসূল এ আক্রমণসমূহ পরিচালনার মাধ্যমে কুরাইশদের অর্থসম্পদ হস্তগত করে নিজ শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ বক্তব্য মদীনার অধিবাসীদের মানসিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ হত্যা ও লুণ্ঠন সভ্যতা বিবর্জিত আরব বেদুঈনের কাজ ছিল। মদীনার মুসলমানগণ এরূপ ছিলেন না। তাঁরা মূলত ছিলেন কৃষিজীবী। কখনই তাঁরা দস্যুবৃত্তি ও লুণ্ঠনের কাজ করতেন না। মদীনার অধিবাসীরা সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য মদীনার বাইরে কখনই আক্রমণ করে নি। আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হতো তা মদীনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত,তদুপরি এ সকল যুদ্ধের ইন্ধনদাতা ছিল মূলত মদীনার ইয়াহুদীরা। তারা নিজস্ব অবস্থানকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে আরবের এ দু গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখত।

মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী মুহাজিরগণের সম্পদ মক্কার কুরাইশ গোত্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হলেও কখনই মুসলমানগণ তার ক্ষতিপূরণের ইচ্ছা পোষণ করত না। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়,বদরের যুদ্ধের পর মুসলমানগণ কুরাইশদের কোন কাফেলার ওপর আক্রমণ করে নি এবং ইতিপূর্বে তারা যে কুরাইশ কাফেলার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখত ও তাদের পথের ওপর টহল সেনা মোতায়েন করেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল তথ্য সংগ্রহ। তদুপরি প্রেরিত টহল সেনার সংখ্যা কখনো 8 জন আবার কখনো 60 অথবা 80 জন ছিল। এ সংখ্যার সেনাদল কুরাইশদের বৃহৎ বাণিজ্য কাফেলার নিরাপত্তা রক্ষীদের তুলনায় অপ্রতুল ছিল বলা যায়। তাই তাদের পক্ষে এ সকল কাফেলার সম্পদ লুণ্ঠনের চিন্তা অবান্তর।

যদি সম্পদ লুণ্ঠনই মুসলমানদের উদ্দেশ্য হতো তবে কেন তারা শুধু কুরাইশ কাফেলার পশ্চাদ্ধাবন করত,অন্য কাফেলার প্রতি কোন দৃষ্টিই দিত না। কেন তারা একবারও অন্য কারো প্রতি তাদের হাত প্রসারিত করে নি? যদি সম্পদ লুণ্ঠন উদ্দেশ্য হতো তবে কেন এ সকল অভিযানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু মুহাজিরদের ব্যবহার করা হতো এবং আনসারদের সাহায্য নেয়া হতো না?

কখনো কখনো তাঁরা বলেন,মহানবী ও মুসলমানগণ কুরাইশদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্তে এরূপ করত। কারণ মুসলমানগণ মক্কাবাসীদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা স্মরণ করে প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অস্ত্রধারণের মাধ্যমে কুরাইশদের রক্ত ঝরানোর।

তাদের এ যুক্তিও প্রথম যুক্তির ন্যায় ভিত্তিহীন। কারণ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এ যুক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। ঐতিহাসিক বর্ণনামতে এ সকল অভিযানের উদ্দেশ্য কখনই যুদ্ধ,রক্তপাত ও প্রতিশোধস্পৃহা ছিল না। আমরা এ মতের অসারতা এখানে প্রমাণ করব।

প্রথমত যদি মহানবীর এ সকল অভিযানের উদ্দেশ্য যুদ্ধ ও গনীমত হতো তবে অবশ্যই প্রেরিত সেনাদলের সদস্যসংখ্যা আরো অধিক হতো এবং সম্পূর্ণ সুসজ্জিত হয়ে তাঁরা কাফেলাকে আক্রমণের জন্য যেতেন। কিন্তু আমরা দেখি তিনি হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে 30 জন,উবাইদাতা ইবনে হারিসকে 60 জন এবং সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে আরো কম সংখ্যক সেনাসহ প্রেরণ করেছিলেন। অথচ কুরাইশ কাফেলাগুলোর প্রহরী ও যোদ্ধার পরিমাণ তাঁদের থেকে অনেক বেশি ছিল। হযরত হামযাহ্ কুরাইশদের তিনশ ব্যক্তির এবং উবাইদাতা তাদের দু ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিশেষত কুরাইশরা যখন বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের চুক্তিবদ্ধ হওয়ার খবর পেয়েছিল তখন তারা তাদের কাফেলায় নিরাপত্তা প্রহরীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। যদি মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রেরিত সেনাদলের উদ্দেশ্য যুদ্ধ হতো তবে কেন অধিকাংশ অভিযানেই কোন রক্তপাতের ঘটনা সংঘটিত হয় নি? কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তির মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ পরস্পর হতে দূরত্বে অবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছিল।

দ্বিতীয়ত মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশের হাতে যে পত্রটি দেন তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,তাঁকে অভিযানে প্রেরণের উদ্দেশ্য কখনই যুদ্ধ ছিল না। কারণ ঐ পত্রে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলাতে অবস্থান গ্রহণ কর এবং কুরাইশদের প্রতীক্ষায় থেকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানাও । এ পত্র সাক্ষ্য বহন করে যে,আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশ যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি,বরং তাঁকে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাঁরা যে যুদ্ধ করেছিলেন এবং আমর ইবনে খাদরামীকে হত্যা করেছিলেন তার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিজেরাই আকস্মিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই যখন মহানবী রক্তপাতের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হলেন তখন তাদেরকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেন এবং বলেন, আমি তোমাদের যুদ্ধের কোন নির্দেশ প্রদান করি নি।

উল্লেখ না করলেও বোঝা যায় যে,এ সকল সেনা অভিযানের সবগুলো অথবা অধিকাংশই একই উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিল। কখনই বলা সম্ভব নয় যে,তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহাশকে আশি জন সহ তথ্য সংগ্রহ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন,অথচ হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে ত্রিশ জন সহ যুদ্ধের জন্য পাঠিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যবিদগণ দাবি করেছেন,হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব যুদ্ধের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁদের মতে প্রেরিত সেনাদল সাধারণত মুহাজিরদের মধ্য থেকে মনোনীত হতেন। কারণ মদীনার আনসারগণ আকাবাতে রাসূলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে,শত্রুর আক্রমণ থেকে তাঁকে রক্ষা করবেন। এ কারণেই মহানবী (সা.) এ ধরনের আক্রমণাত্মক অভিযানে তাঁদেরকে প্রেরণ করেন নি এবং নিজেও মদীনায় অবস্থান করতেন। কিন্তু যখন তিনি মদীনার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তখন আনসার ও মুহাজিরদের ঐক্যকে সুসংহত করার লক্ষ্যে আনসারদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে সঙ্গে নিতেন। এ লক্ষ্যেই বাওয়াত ও জাতুল উশাইরাতে আনসার ও মুহাজিরদের সম্মিলিত দল রাসূলুল্লাহর সহগামী ছিলেন।

পূর্বোল্লিখিত যুক্তির আলোকে মধ্যপ্রাচ্যবিদদের যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু অংশ স্বয়ং মহানবীর অভিযানে অংশগ্রহণের ফলশ্রুতিতে অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়েছে। কারণ বাওয়াত ও জাতুল উশাইরাতে তিনি শুধু মুহাজিরদের নিয়ে যান নি,বরং আনসারদের একটি দল তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অথচ আনসারগণ তাঁর সঙ্গে আক্রমণাত্মক যুদ্ধে সাহায্য করার চুক্তি করেন নি। সে ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) তাঁদেরকে কিভাবে যুদ্ধ ও রক্তপাতের দিকে আহবান করতে পারেন? আমাদের বক্তব্যের যথার্থতা পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত বিবরণে পাঠকদের নিকট স্পষ্ট হবে। আনসারগণ যতক্ষণ পর্যন্ত বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সম্মতি প্রদান করেন নি ততক্ষণ মহানবী (সা.) এ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি।

মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ সকল সেনা অভিযানকে গাজওয়া নামে অভিহিত করেছেন এ কারণে যে,তাঁরা চেয়েছেন এ সকল অভিযানকে এক শিরোনামে লিপিবদ্ধ করতে,যদিও এ সকল সেনা অভিযানের মূল লক্ষ্য যুদ্ধ ছিল না।