চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106825 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত ও আনসার দলপতির মত

যে মতগুলো এতক্ষণ উপস্থাপিত হয়েছে তা ব্যক্তিগত মত হিসাবেই প্রণিধানযোগ্য। মূলত পরামর্শ সভার লক্ষ্য ছিল আনসারদের মত জানা। যতক্ষণ আনসাররা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিবে ততক্ষণ ছোট কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণও সম্ভব ছিল না। এতক্ষণ মতামত দানকারী ব্যক্তিবর্গের সকলেই ছিলেন মুহাজির। এ কারণেই মহানবী (সা.) আনসারদের মত নেয়ার জন্য তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, তোমরা তোমাদের মত প্রদান কর।

সা দ ইবনে মায়ায আনসারী দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি কি আমাদের মত চাচ্ছেন? রাসূল বললেন, হ্যাঁ। মায়ায বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি আপনার আনীত ধর্ম সত্য। এ বিষয়ে আমরা আপনার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হয়েছি। তাই আপনি যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন,আমরা তারই অনুসরণ করব। সেই আল্লাহর শপথ,যিনি আপনাকে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যদি আপনি সমুদ্রেও প্রবেশ করেন (লোহিত সাগরের দিকে ইশারা করে) তবে আমরাও আপনার পশ্চাতে তাতে প্রবেশ করব। আমাদের এক ব্যক্তিও আপনার অবাধ্য হবে না। আমরা শত্রুর মুখোমুখি হতে কুণ্ঠিত নই। আত্মত্যাগের ক্ষেত্রে আমরা এতটা প্রমাণ করব যে,এতে আপনার চক্ষু উজ্জ্বল হবে। আপনি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের যেখানেই যেতে বলবেন,আমরা যেতে প্রস্তুত।

সা দের এ বক্তব্য মহানবীর অন্তরে প্রফুল্লতা বয়ে আনল এবং তাঁর সত্য ও লক্ষ্যের পথে দৃঢ়তা এবং জীবনসঞ্চারক আশার বাণী হতাশা ও শঙ্কার কালো ছায়াকে দূরীভূত করল।

সত্যের এ সাহসী সৈনিকের বক্তব্য এতটা উদ্দীপক ছিল যে,মহানবী (সা.) সাথে সাথে যাত্রার নির্দেশ দিয়ে বললেন,

যাত্রা শুরু কর। তোমাদের জন্য সুসংবাদ,হয় তোমরা কাফেলার মুখোমুখি হবে ও তাদের সম্পদ ক্রোক করবে,নতুবা কাফেলার সাহায্যে এগিয়ে আসা দলের মুখোমুখি হয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমি কুরাইশদের নিহত হওয়ার স্থানটি দেখতে পাচ্ছি,তাদের ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

মুসলিম সেনাদল নবীর পশ্চাতে যাত্রা শুরু করল এবং বদরের প্রান্তরে পানির আধারের নিকট ছাউনী ফেলল।

শত্রুর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ

যদিও বর্তমানে সামরিক নীতি ও যুদ্ধকৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও পূর্ববর্তী সময় থেকে তার পার্থক্য স্পষ্ট তদুপরি এখনও শত্রুর অবস্থা,যুদ্ধকৌশল,সামরিক শক্তি ও অন্যান্য গোপন তথ্য সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা পূর্বের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এ সকল তথ্য এখনও মৌলিক বলে বিবেচিত। অবশ্য বর্তমানে তথ্য সংগ্রহের এ জ্ঞানটি সামরিক শিক্ষাদানের অন্যতম পাঠ্যের রূপ নিয়েছে এবং গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য বিশেষ ক্লাস ও পাঠ্যসূচী প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্লকের দেশগুলোর সামরিক অবস্থান তাদের গোয়েন্দা সংস্থার বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল মনে করে। কারণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমেই তারা শত্রুর সম্ভাব্য শক্তি ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে পূর্বে অবহিত হয়ে তাদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করে।

এ কারণেই মুসলিম সেনাবাহিনী এমন এক স্থানে অবস্থান নিল যাতে করে এ মৌলনীতি সংরক্ষিত হয় এবং কোনরূপেই যেন গোপন তথ্যসমূহ প্রকাশিত না হয়। অন্যদিকে একদল সংবাদ বাহককে কুরাইশ সেনাদল ও বাণিজ্য কাফেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিয়োগ করা হলো। প্রেরিত সংবাদ বাহকরা তথ্যসমূহ নিম্নরূপ পদ্ধতিতে হস্তগত করেছিল :

১. প্রথম দলে স্বয়ং নবী (সা.) ছিলেন। তিনি একজন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে কিছু পথ অগ্রসর হয়ে একজন গোত্রপ্রধানের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তাকে প্রশ্ন করলেন, কুরাইশ এবং মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে আপনি কোন তথ্য জানেন কি?

সে বলল, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে,মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়েছে। যদি এ খবরটি সত্য হয়,তবে তারা অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (সে এমন স্থানের নাম বলল রাসূল ও তাঁর সঙ্গীরা ঠিক সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন)। কুরাইশরাও অমুক দিন মক্কা থেকে যাত্রা করেছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। যদি এ খবরটিও সঠিক হয় তবে কুরাইশ অমুক স্থানে অবস্থান নিয়েছে (এ ক্ষেত্রে সে কুরাইশদের অবস্থান নেয়া স্থানের নামই উল্লেখ করল।)

২. যুবাইর ইবনে আওয়াম,সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও আরো কিছু সঙ্গী হযরত আলীর নেতৃত্বে বদরের কূপের নিকটবর্তী স্থানে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরিত হয়েছিল। এ স্থানটি তথ্য সংগ্রহের জন্য আনাগোনার স্থান হিসাবে সংবাদ বাহকদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রেরিত দলটি কূপের নিকট কুরাইশদের দু জন দাসের সাক্ষাৎ লাভ করল। তাঁরা তাদের বন্দী করে রাসূল (সা.)-এর নিকট আনয়ন করলেন। এ দুই দাস কুরাইশের দু গোত্র বনি হাজ্জাজ ও বনি আ সের পক্ষ থেকে কুরাইশদের জন্য পানি নেয়ার উদ্দেশ্যে কূপের নিকট এসেছিল।

রাসূল (সা.) তাদেরকে কুরাইশদের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় পর্বতের পশ্চাতের সমতল ভূমিতে তারা অবস্থান নিয়েছে। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তারা অবগত নয় বলে জানাল। মহানবী (সা.) প্রশ্ন করলেন, প্রতিদিন তারা খাদ্যের জন্য কতটি উট জবাই করে। তারা বলল, কোন দিন দশটি,কোন দিন নয়টি। মহানবী ধারণা করলেন তাদের সংখ্যা নয়শ থেকে এক হাজার। অতঃপর তাদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসেছে প্রশ্ন করলে জানায়,উতবা ইবনে রাবীয়া,শাইবা ইবনে রাবীয়া,আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম,আবু জাহল ইবনে হিশাম,হাকিম ইবনে হাজাম,উমাইয়্যা ইবনে খালাফ প্রমুখ তাদের মধ্যে রয়েছে। এ সময় রাসূল (সা.) সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন,

هذه مكّة قد القت اليكم افلاذ كبدها

মক্কা শহর তার কলিজার টুকরোগুলোকে বের করে দিয়েছে। ৫৬৫

অতঃপর তিনি এ দু ব্যক্তিকে বন্দী রাখার নির্দেশ দিয়ে তথ্য সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিলেন।

৩. দু ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হলো বদর প্রান্তে গিয়ে কুরাইশ কাফেলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার। তাঁরা একটি কূপের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করে পানি পানের উদ্দেশ্যে এসেছেন এমন ভান করে কূপের নিকট পৌঁছলেন। সেখানে দু নারীর সাক্ষাৎ লাভ করলেন যারা পরস্পর কথা বলছিল। তাদের একজন আরেক জনকে বলছিল, আমার প্রয়োজন আছে জেনেও কেন আমার ধার পরিশোধ করছ না? অন্যজন বলল, কাল অথবা পরশু বাণিজ্য কাফেলা এসে পৌঁছবে। আমি কাফেলার জন্য শ্রম দিয়ে তোমার অর্থ পরিশোধ করব। মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তি এ দু নারীর নিকট দাঁড়িয়েছিল। সেও ঋণগ্রস্ত মহিলার কথাকে সমর্থন করে বলল, কাফেলা দু এক দিনের মধ্যেই এসে পৌঁছবে।

সংবাদ বাহক দু ব্যক্তি এ কথা শুনে আনন্দিত হলেন,তবে সাবধানতা ও গোপনীয়তা বজায় রেখে ফিরে এলেন এবং রাসূল (সা.)-কে তথ্যটি অবহিত করলেন। যখন মহানবী কুরাইশদের অবস্থান ও বাণিজ্যিক কাফেলার আগমন সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পেলেন তখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।

আবু সুফিয়ানের পলায়ন

কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাপ্রধান আবু সুফিয়ান কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গমনের সময় একদল মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। তাই সে ভালোভাবে জানত যে,ফিরে আসার সময় অবশ্যই মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হবে। এ কারণেই সে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকায় প্রবেশের পরপরই তার কাফেলাকে এক স্থানে বিশ্রাম নিতে বলে স্বয়ং তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বদর এলাকায় প্রবেশ করে। সেখানে সে মাজদি ইবনে আমরের সাক্ষাৎ পেল। তাকে সে প্রশ্ন করল, অত্র এলাকায় সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিকে দেখেছ কি? সে বলল, সন্দেহ হতে পারে এমন কিছু দেখি নি দুই উষ্ট্রারোহীকে কূপের নিকট অবতরণ করে পানি পান করে চলে যেতে দেখেছি। আবু সুফিয়ান কূপের নিকট এসে উষ্ট্রের বসার স্থানটিতে উষ্ট্রের মল পড়ে থাকতে দেখল। সে মলগুলোকে আঘাত করে ভেঙে দেখল তাতে খেজুরের বীজ রয়েছে। সে বুঝতে পারল উটগুলো মদীনা থেকে এসেছে। সে দ্রুত কাফেলার নিকট ফিরে এসে কাফেলাকে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন এলাকা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিল এবং কাফেলার পথকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। অতঃপর সে কুরাইশদের নিকট বার্তা পাঠাল যে,কাফেলা মুসলমানদের অধীন এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে এবং কুরাইশ সেনাদল যেন যে পথে এসেছে সে পথে মক্কায় ফিরে যায়। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উপযুক্ত শিক্ষাদানের দায়িত্বটি যেন আরবদের ওপর ছেড়ে দেয়।

কুরাইশ কাফেলার পরিত্রাণ লাভের ঘটনা সম্পর্কে মুসলমানদের তথ্য লাভ

কুরাইশ কাফেলার পলায়নের ঘটনাটি মুসলমানদের নিকট পৌঁছলে যে সকল ব্যক্তি বাণিজ্য পণ্য লাভের নেশায় বুঁদ হয়েছিল তারা বেশ অসন্তুষ্ট হলো। তখন মহান আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

) و إذا يعدكم الله إحدى الطائفتين أنّها لكم و توّدون أنّ غير ذات الشوكة تكون لكم و يريد الله أن يحقّ الحقّ بكلماته و يقطع دابر الكافرين(

স্মরণ কর ঐ মুহূর্তকে যখন আল্লাহ্ দু টি দলের একটিকে মুখোমুখি হওয়ার সুসংবাদ তোমাদের দিলেন এবং তোমরা অমর্যাদার দলটির (বাণিজ্য কাফেলা) মুখোমুখি হওয়ার আশা করছিলে;অন্যদিকে আল্লাহ্ চেয়েছেন সত্যকে পৃথিবীর ওপর সুদৃঢ় করতে এবং কাফির দলের মূলোৎপাটন করতে। ৫৬৬

কুরাইশদের মতদ্বৈততা

যখন আবু সুফিয়ানের প্রেরিত ব্যক্তি কুরাইশ সেনাদলের নিকট তার বার্তা নিয়ে পৌঁছল তখন এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে ব্যাপক মতদ্বৈততা সৃষ্টি হলো। বনি যোহরা ও আখনাস ইবনে শারীক তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পক্ষসমূহকে নিয়ে প্রাঙ্গন ত্যাগ করল। কারণ তাদের ভাষ্য ছিল : আমরা বনি যোহরা গোত্রের বাণিজ্য পণ্যসমূহ রক্ষার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলাম। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। হযরত আবু তালিবের পুত্র তালিব,যিনি বাধ্য হয়ে কুরাইশদের সঙ্গে এসেছিলেন তিনিও কুরাইশদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পর মক্কায় ফিরে গেলেন।

আবু জাহল আবু সুফিয়ানের মতের বিপরীতে নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, আমরা বদর প্রান্তে তিন দিনের জন্য অবস্থান নেব। সেখানে উট জবাই করে,শরাব পান করে ও গায়িকাদের গান শুনে কাটাব। সে সাথে আমাদের শক্তির মহড়া প্রদর্শন করব যাতে করে সকল আরব আমাদের শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং চিরকাল তা স্মরণ রাখে।

আবু জাহলের মনভোলানো কথায় প্ররোচিত হযে কুরাইশরা বদর প্রান্তরের দিকে ধাবিত হয়ে একটি উঁচু টিলার পশ্চাতে উঁচু সমতল ভূমিতে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। অবশ্য সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় কুরাইশদের চলাচলই মুশকিল হয়ে পড়ল ও তারা আরো অগ্রসর হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঐ টিলা থেকে একটু দূরেই অবস্থান নিতে বাধ্য হলো।

অন্যদিকে মহানবী (সা.) বদরের যে প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সেখানে বৃষ্টির কোন নেতিবাচক প্রভাব ছিল না। এ প্রান্তটি উদওয়াতুদ দুনিয়া নামে প্রসিদ্ধ।

বদর অঞ্চলটি একটি বিস্তৃত ভূমি যার দক্ষিণ প্রান্ত উঁচু ও উদওয়াতুল কাছওয়া নামে পরিচিত এবং উত্তর প্রান্তটি নিচু ও ঢালু। এ প্রান্তটি উদওয়াতুদ দুনিয়া নামে পরিচিত। এ বিস্তৃত ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের কূপ থাকার কারণে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ ছিল এবং সব সময় কাফেলাসমূহ এ স্থানে অবতরণ করে বিশ্রাম নিত।

হাব্বাব ইবনে মুনযার নামক এক মুসলিম সেনাপতি রাসূল (সা.)- কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আল্লাহর নির্দেশে এখানে অবস্থান নিয়েছেন নাকি এ স্থানে অবস্থানগ্রহণ যুদ্ধের জন্য উপযোগী মনে করে অবস্থান করছেন? মহানবী (সা.) বললেন, এ বিষয়ে বিশেষ কোন নির্দেশ অবতীর্ণ হয় নি। যদি তোমার মতে অন্য কোন স্থান এটি হতে উপযোগী হয় তা বলতে পার। যদি যুদ্ধের জন্য অধিকতর উপযোগী স্থান পাওয়া যায়,আমরা সেখানে স্থানান্তরিত হব। ৫৬৭

হাব্বাব বললেন, আমরা শত্রুর নিকটবর্তী পানির কিনারে অবস্থান নিলে ভালো হবে। সেখানে বড় চৌবাচ্চা তৈরি করলে আমাদের এবং চতুষ্পদ প্রাণীগুলোরও সার্বক্ষণিক পানির ব্যবস্থা হবে। মহানবী (সা.) তাঁর কথা পছন্দ করলেন এবং সকলকে ঐ স্থানের দিকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনাটি প্রমাণ করে যে,রাসূল সামাজিক বিষয়ে সব সময় জনমত ও সার্বিক পরামর্শের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।

নেতৃত্ব মঞ্চ

সা দ ইবনে মায়ায মহানবী (সা.)-এর নিকট প্রস্তাব করলেন, আপনার জন্য উঁচু টিলার ওপর তাঁবু তৈরি করি যেখান থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণের ওপর আপনি দৃষ্টি রাখতে পারবেন। তদুপরি আপনার জন্য কয়েকজন রক্ষী নিয়োজিত করি যাতে করে তারা আপনার নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারে এবং আপনার নির্দেশসমূহ যুদ্ধে নিয়োজিত সেনাপতিদের নিকট পৌঁছাতে পারে।

সর্বোপরি যদি এ যুদ্ধে মুসলমানগণ জয়ী হন তবে তো কথাই নেই। আর যদি পরাজিত হন ও সকলে নিহত হন,হে নবী! আপনি দ্রুতগামী উষ্ট্রের সাহায্যে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবেন। আপনার দেহরক্ষী সৈন্যরা কৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধের গতিকে শিথিল করে দিয়ে শত্রুর অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করবে এবং এ সুযোগে আপনি মদীনায় পৌঁছে যাবেন। মদীনায় অনেক মুসলমান রয়েছেন যাঁরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অনবগত। যখন তাঁরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হবে তখন আপনাকে পূর্ণরূপে সহায়তা দেবে এবং আপনার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করবে।

মহানবী (সা.) সা দ ইবনে মায়াযের জন্য দোয়া করলেন এবং নির্দেশ দিলেন তাঁর জন্য টিলার ওপর নিরাপত্তা তাঁবু স্থাপন করার যাতে করে সমগ্র প্রাঙ্গণের অবস্থার ওপর দৃষ্টি রাখতে পারেন। মহানবী (সা.)-এর কথা অনুযায়ী নেতৃত্ব মঞ্চ স্থানান্তরিত করা হলো।

নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চের ওপর দৃষ্টিপাত

মহানবী (সা.)-এ জন্য নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চ প্রস্তুত ও সা দ ইবনে মায়ায ও অন্যান্য আনসার যুবক কর্তৃক তাঁর প্রহরার বিষয়টি তাবারী৫৬৮ ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন এবং অন্যরাও তাঁর অনুসরণে তা তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থে এনেছেন। কিন্তু নিম্নোক্ত যুক্তিসমূহের ভিত্তিতে বলা যায় যে,এ বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথমত এ বিষয়টি সৈন্যদের মনোবলকে নিঃসন্দেহে কমিয়ে দেবে এবং তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদি কোন সেনানায়ক শুধু নিজের জীবন ও নিরাপত্তার কথাই চিন্তা করেন তাঁর অনুগত সেনাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেন না,সেরূপ সেনানায়ক তাঁর অনুগত সেনাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম নন।

দ্বিতীয়ত এ কাজটি মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রাপ্ত ঐশী আয়াতে উল্লিখিত সুসংবাদের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যশীল নয়। তিনি কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বেই তাঁর সঙ্গীদের সুসংবাদ দিয়ে বলেছিলেন, স্মরণ কর যখন আল্লাহ্ তোমাদের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দান করলেন যে,দুই দলের (বাণিজ্য কাফেলা ও কুরাইশদের সাহায্যকারী দলের) একদলের মুখোমুখি হওয়ার যাতে তোমাদেরই জয় হবে।

তাবারীর মতে এরূপ সুসংবাদ পাওয়ার পরও যখন বাণিজ্য কাফেলা হাতছাড়া হয়েছিল ও সাহায্যকারী দলটি সামনে উপস্থিত হয়েছিল তখন মহানবী (সা.)-এর জন্য নিরাপদ নেতৃত্ব মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। এ সুসংবাদ মতে মুসলমানরা বিজয়ী হবেন এ কথা আগেই জেনেছিলেন। তাই পরাজিত হওয়ার শঙ্কা তাঁদের ছিল না এবং সে আশংকায় নবী (সা.)-এর জন্য নিরাপত্তা মঞ্চ তৈরি ও দ্রুতগামী উষ্ট্র প্রস্তুত রাখার বিষয়টি অর্থহীন ছিল।

ইবনে সা দ তাঁর তাবাকাত৫৬৯   গ্রন্থে হযরত উমর ইবনে খাত্তাবের নিকট হতে বর্ণনা করেছেন, যখন নিম্নোক্ত আয়াতটি৫৭০ অবতীর্ণ হয় এবং একটি দলের পরাজয়ের কথা বলা হয় তখন আমি মনে মনে বললাম : এ আয়াতটিকে কোন্ দলের পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে? বদর যুদ্ধের দিন দেখলাম রাসূল (সা.) যুদ্ধের পোশাক পরিধান করেছেন ও জোশের সঙ্গে এ আয়াতটি পড়ছেন। তখন বুঝতে পারলাম আমাদের প্রতিপক্ষ এ দলের পরাজয়ের কথাই এতে বলা হয়েছে।

ইতিহাসের এ অংশটি লক্ষ্য করেও কি আমরা মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের অন্তরে পরাজয়ের শঙ্কা ছিল বলে মনে করব?

তৃতীয়ত হযরত আলী (আ.) যুদ্ধক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর যে রূপ বর্ণনা করেছেন তার সঙ্গে এ কৌশলটি সংগতিশীল নয়। তিনি হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যখনই যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ লাভ করত আমরা মহানবীর পশ্চাতে আশ্রয় গ্রহণ করতাম। তখন কোন ব্যক্তিই মহানবী (সা.) হতে শত্রুর নিকটবর্তী থাকত না। ৬৭১ যে ব্যক্তির অবস্থাকে তাঁর প্রথম ছাত্র এভাবে বর্ণনা করেন তাঁর সম্পর্কে কিরূপে আমরা এ সম্ভাবনার কথা বলব যে,তিনি মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধে রক্ষণাত্মক ও পলায়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।

তাই আমরা ধরে নিতে পারি,নেতৃত্ব মঞ্চটি নিরাপত্তার দৃষ্টিতে নয়,বরং নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করেই প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে করে তিনি সমগ্র রণক্ষেত্রের ওপর দৃষ্টি রাখতে পারেন। কারণ যদি সমরনায়ক সমগ্র রণক্ষেত্রের ওপর নজর রাখতে না পারেন তাহলে তাঁর পক্ষে যুদ্ধকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

কুরাইশ গোত্রের কার্যক্রম

দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসের সতের তারিখের সকালে কুরাইশগণ টিলার ওপর হতে বদরের সমতল প্রান্তরে নেমে আসে। যখন মহানবী (সা.) তাদেরকে টিলার ওপর হতে নিচে নামতে দেখলেন তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আল্লাহ্! আপনি জানেন কুরাইশরা অহংকার ও গর্বের সাথে আপনার দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে,তারা আপনার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। হে প্রভু! আমাকে সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন তা কার্যকরী করুন ও আমার শত্রুদের আজ ধ্বংস করুন।

কুরাইশদের পরামর্শ সভা

কুরাইশরা বদর এলাকার এক প্রান্তে অবস্থান নিলেও মুসলমানদের সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। তাই মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে কোন সমাবেশের লোকসংখ্যা নির্ণয়ে অভিজ্ঞ উমাইর ইবনে ওয়াহাব নামের এক সাহসী ব্যক্তিকে প্রেরণ করল। সে একটি অশ্বে আরোহণ করে মুসলমানদের সেনাছাউনীর চারিদিকে ঘুরে এসে জানাল তাদের সংখ্যা প্রায় তিনশ । তবে সে এও বলল,আরো একবার ঘুরে দেখে আসা উত্তম,কেননা হতে পারে পেছনে অন্য কেউ লুকিয়ে আছে অথবা কোন সাহায্যকারী দল অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে।

সে সমগ্র বদর প্রান্তরে একবার ভালোভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে আতংকজনক খবর আনয়ন করল। সে বলল, মুসলমানদের পেছনে কোন আশ্রয়স্থল নেই,কিন্তু তোমাদের জন্য মদীনা হতে আগত মৃত্যুর বার্তা বহনকারী উটসমূহকে আমি দেখেছি। অতঃপর বলল, মুসলমানদের এক দলকে দেখলাম তাদের তরবারি ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। তাদের প্রত্যেকে তোমাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা না করা পর্যন্ত নিহত হবে না। যদি তারা তোমাদের হতে তাদের সমসংখ্যক ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে তোমাদের জীবনের মূল্য কি? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে ভেবে দেখ। ৫৭২

ওয়াকেদী ও আল্লামা মাজলিসী তার বক্তব্যে নিম্নোক্ত কথাগুলোও ছিল বলে উল্লেখ করেছেন: তোমরা কি লক্ষ্য করেছ তারা নীরব ও কোন কথা বলছে না,কিন্তু তাদের ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ়তা তাদের চেহারায় স্পষ্ট। তারা বিষাক্ত সাপের মতো জিহ্বাকে মুখের চারিদিকে আবর্তন করাচ্ছে ও ছোবল হানার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ৫৭৩

কুরাইশরা দু দলে বিভক্ত

এই সাহসী বিচক্ষণ সৈনিকের কথা কুরাইশদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলল। আতঙ্ক ও ত্রাস সমগ্র সেনাদলকে আচ্ছন্ন করল। হাকিম ইবনে হাজাম উতবার নিকট গিয়ে বলল, উতবা! তুমি কুরাইশদের নেতা। কুরাইশ তাদের বাণিজ্যপণ্য রক্ষার জন্য মক্কা থেকে এসেছিল। তাদের বাণিজ্যপণ্য রক্ষা হয়েছে। তাদের অবস্থানও পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। এ অবস্থায় হাদরামীর (হাজরামীর) হত্যা ও রক্তপণ এবং মুসলিমদের মাধ্যমে তার সম্পদ লুণ্ঠন ব্যতীত আর কোন সমস্যা নেই। তাই তোমরা হাদরামীর রক্তপণ নিজেরাই আদায় করে মুহাম্মদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হও। হাকিমের বক্তব্য উতবার ওপর আশ্চর্য প্রভাব ফেলল। সে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে আকর্ষণীয় বক্তব্যে বলল, হে লোকসকল! তোমরা মুহাম্মদের ব্যাপারটি আরবদের ওপর ছেড়ে দাও। যখন আরবরা তার আনীত ধর্মের মূলোৎপাটন করবে ও তার শক্তির ভিতকে উপড়ে ফেলবে তখন আমরাও তার হাত থেকে মুক্তি পাব। আর যদি মুহাম্মদ সফলও হয় সে আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। কারণ আমরা আমাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে যুদ্ধ না করে ফিরে যাব। উত্তম হলো আমরা যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে যাই।

হাকিম উতবার কথাটি আবু জাহলকে জানাল। সে সময় আবু জাহল যুদ্ধের বর্ম পরিধান করছিল। উতবার কথা শুনে সে খুবই রাগান্বিত হলো। সে এক ব্যক্তিকে হাদরামীর ভ্রাতা আমের হাদরামীর নিকট পাঠিয়ে জানাল, যখন তুমি তোমার ভ্রাতার রক্ত ঝরতে দেখছ তখন তোমার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ উতবা জনতাকে তোমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নিতে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে। তাই কুরাইশদেরকে তোমার ভ্রাতার রক্তের বদলা নেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দাও ও তোমার ভ্রাতার মৃত্যুর জন্য মর্সিয়া পড়।

আবু আমের তার মাথাকে অনাবৃত করে সাহায্যের আহবান জানিয়ে আর্তনাদ করে বলল, হায় আমের! হায় আমের!

আবু আমেরের আর্তনাদ ও মর্সিয়া কুরাইশদের ধমনীতে আত্মসম্মানবোধের শোনিতধারা প্রবাহিত করল। তারা যদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। উতবার আহবান তাদের জোশে স্তিমিত হয়ে গেল। এমনকি গোত্রপ্রীতি ও সম্মানবোধের এ সার্বিক অনুভূতি উতবাকেও প্রভাবিত করল। সেও উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো।৫৭৪

কখনো কখনো যে,ভিত্তিহীন উত্তেজনা ও অনুভূতি চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে নির্বাপিত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশাকে নস্যাৎ করে দেয় এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। যে ব্যক্তি কিছুক্ষণ পূর্বেও শান্তি ও সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থানের আহবান জানাচ্ছিল,সেই গোত্রপ্রীতির গোঁড়ামির অনুভূতিতে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অগ্রগামী হলো।

কুরাইশদের কল্পরাজ্য

খোদা না করুন যে,এই মানুষ একদিন তার জীবনের দিকচক্রবাল রেখা পরিষ্কার ও উজ্জ্বল দেখতে পেয়ে নিজের জন্য এক কাল্পনিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রবক্তা হয়ে যায়। তখনই সে অস্তিত্ব ও জীবনকে কেবল তারই সাথে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করবে এবং অন্য মানুষের জন্য স্বল্পতম জীবনধারণের ন্যূনতম অধিকার ও সম্মানের স্বীকৃতি দেবে না।

সকলের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য কুরাইশগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে,তারা মক্কা শরীফের বাইরে নির্ধারিত এলাকার  (حل )114 অধিবাসীদের ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেবে না। কারণ তারা বলত, সাধারণ আরব আমাদের ইবাদাতগাহের প্রতি মুখাপেক্ষী। আর আরব জাতির সবাই প্রত্যক্ষ করেছে,আমরা কাবার দেব-দেবীদের কৃপাদৃষ্টিতে আছি।” তখন থেকেই কুরাইশদের কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যায়। তারা জোরজুলুম চালিয়ে হিল-এর অধিবাসীদেরকে বাধ্য করেছিল যে,হজ্ব ও উমরার জন্য মক্কায় প্রবেশ করলে তারা তাদের নিজেদের সাথে আনা খাদ্য ভক্ষণ করতে পারবে না। হারামের অধিবাসীদের খাবারই তাদের খেতে হবে। তাওয়াফের সময় তাদেরকে মক্কার স্থানীয় পোশাক পরিধান করতে হবে। আর এখানে স্মর্তব্য যে,এ স্থানীয় পোশাকে গোত্রীয় দিক প্রতিফলিত হয়েছিল। কোন ব্যক্তি মক্কার স্থানীয় পোশাক সংগ্রহ করতে না পারলে তাকে অবশ্যই দিগম্বর হয়ে পবিত্র কাবার চারপাশে তাওয়াফ করতে হবে। তবে যে কতিপয় (অ-কুরাইশ) আরব গোত্রপতি এ বিষয়টি মেনে নেয় নি তাদের ব্যাপারে স্থির করা হয় যে,তাওয়াফ শেষ করার পর তারা দেহ থেকে পোশাক পরিচ্ছদ বের করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কোন ব্যক্তির হক নেই ঐ সব পোশাকে হাত দেয়ার। তবে সবক্ষেত্রেই মহিলারা বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করতে বাধ্য ছিল। তাদেরকে (মহিলাদের) তাওয়াফ করার সময় কেবল নিজেদের মাথা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে বিশেষ ধরনের একটি কবিতা115 গুনগুন করে পড়তে হতো।

খ্রিষ্টান আবরাহার আক্রমণের পর কোন ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানের পবিত্র মক্কায় প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে যে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান কোন মক্কাবাসীর বেতনভূক কর্মচারী হতো সে হতো ব্যতিক্রম (অর্থাৎ সে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করতে পারত)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজ ধর্ম সম্পর্কে ন্যূনতম কথা বলার অধিকার তার থাকত না।

কুরাইশদের গর্ব ও অহংকার এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে,হজ্বের কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান যা হারামের বাইরে আঞ্জাম দিতে হয় তা তারা বর্জন করেছিল এবং এ কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে116 অবস্থান করত না ( আরাফাত’হারামের বাইরে একটি স্থানের নাম যেখানে হাজীদেরকে অবশ্যই যিলহজ্ব মাসের নবম দিবসে যোহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়।)। অথচ তাদের পূর্বপুরুষগণ (হযরত ইসমাঈল-এর সন্তানগণ) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকে হজ্ব অনুষ্ঠানের একটি অংশ বলে গণ্য করতেন। আর কুরাইশদের পুরো বাহ্যিক সম্মান ও মর্যাদা পবিত্র কাবা ও হজ্বের এ সব আচার-অনুষ্ঠানের কাছেই ঋণী ছিল। আরব উপদ্বীপের সকল স্থান থেকে জনগণ প্রতি বছর শুষ্ক ও পানিহীন এ মরু এলাকায় হজ্বব্রত পালনের জন্য আসতে বাধ্য ছিল। এখানে যদি কোন তাওয়াফ করার স্থান (পবিত্র কাবা) ও মাশআর (হাজীদের নির্দিষ্ট ইবাদাতের স্থান-যেখানে হাজীরা আরাফাহ্ থেকে বের হয়ে রাত্রিযাপন করে ফজরের সময় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ফরয অবস্থান করার জন্য এবং এরপর তারা মীনায় হজ্বের বাকি কাজগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্য বের হয়ে যায়) না থাকত তাহলে কোন ব্যক্তিই জীবনে একবারের জন্যও এ স্থান অতিক্রম করার ইচ্ছা প্রকাশ করত না।

সামাজিক হিসাব-নিকাশের দৃষ্টিতে এ সব দুর্নীতি ও বৈষম্যের উদ্ভব আসলে এড়ানো সম্ভব নয়। একটি মৌলিক বিপ্লব ও শক্তিশালী আন্দোলনের জন্য বিশ্বের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর পরিবেশ অবশ্যই সীমাহীন দুর্নীতি ও কলঙ্কের মধ্যে নিমজ্জিত হতেই হবে।

এ সব বঞ্চনা,আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি পবিত্র মক্কা নগরীর পরিবেশ-পরিস্থিতিকে একজন বিশ্বসংস্কারক নেতার আবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত ও উপযুক্ত করে তুলছিল। আর এ বিষয়টি মোটেও অনর্থক ও অসমীচীন হবে না যে,আরবদের পণ্ডিত বলে খ্যাত ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল যিনি তাঁর শেষ জীবনে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইঞ্জিল শরীফ সংক্রান্ত জ্ঞানও অর্জন করেছিলেন তিনি যখনই মহান আল্লাহ্ ও নবীদের সম্পর্কে কথা বলতেন তখনই তিনি মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ানের ক্রোধ ও উষ্মার শিকার হতেন। আবু সুফিয়ান তখন বলত, এমন স্রষ্টা ও নবীর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। কারণ আমরা প্রতিমা ও মূর্তিদের দয়া ও কৃপার মধ্যেই আছি।”

6. মহানবীর পিতা আবদুল্লাহ্

যেদিন আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর জীবন মহান আল্লাহর পথে 100 উট কোরবানী করার মাধ্যমে পুনঃক্রয় করেছিলেন তখনও তাঁর (আবদুল্লাহর) জীবনের 24টি বসন্ত অতিবাহিত হয়নি। এ ঘটনার কারণে আবদুল্লাহ্ কুরাইশ বংশীয়দের মধ্যে প্রশংসনীয় মর্যাদা ও খ্যাতির অধিকারী হওয়া ছাড়াও নিজ বংশে,বিশেষ করে আবদুল মুত্তালিবের কাছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন। কারণ যে জিনিসের জন্য মানুষকে তার জীবনে চড়া মূল্য দিতে হয় এবং বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় সে জিনিসের প্রতি তার টান সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ কারণেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ অস্বাভাবিক ধরনের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।

যেদিন আবদুল্লাহ্ পিতার সাথে কোরবানী করার স্থানে গমন করছিলেন সেদিন তাঁর মধ্যে পরস্পর ভিন্নধর্মী আবেগ ও অনুভূতির উদ্ভব হয়েছিল। পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর সার্বিক দুঃখ-কষ্ট বরণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনুভূতি তাঁর গোটা অস্তিত্বকে ঘিরে রেখেছিল;আর এ কারণেই আত্মসমর্পণ করা ব্যতীত তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে,যেহেতু ভাগ্যবিধি চাচ্ছিল তাঁর জীবন-বসন্তের ফুলগুলোকে শরৎকালীন পত্রের মতো শুকিয়ে বিবর্ণ ও মলিন করে দিতে সে কারণে তাঁর অন্তরের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতাও দেখা দিয়েছিল।

আবদুল্লাহ্ ঈমান এবং আবেগ-অনুভূতি-এ দু টি শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে গিয়েছিলেন এবং এ ঘটনাপ্রবাহ তাঁর অন্তরে বেশ কিছু অপূরণীয় অস্বস্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। তবে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে সমস্যার সমাধান হলে আবদুল মুত্তালিব আমেনার সাথে আবদুল্লাহর বিবাহের ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করার মাধ্যমে এ তিক্ত অনুভূতির তাৎক্ষণিক অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহর জীবনসূত্র যা ছিন্ন-ভিন্ন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তা জীবনের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়ের (অর্থাৎ বিবাহ) সাথে এখন সংযুক্ত হয়ে গেল।

আবদুল মুত্তালিব কোরবানীর স্থল থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরে সরাসরি ওয়াহাব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যাহরার গৃহে চলে গেলেন। ওয়াহাবের মেয়ে আমেনার সাথে আবদুল্লাহকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলেন। উল্লেখ্য যে,ওয়াহাব-কন্যা আমেনা ছিলেন পুণ্যবতী ও সচ্চরিত্রা নারী। আর তিনি (আবদুল মুত্তালিব) ঐ একই অনুষ্ঠানে আমেনার চাচাতো বোন দালালাকে বিবাহ করেন। মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত হামযাহ্117 এই দালালার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হযরত হামযাহ্ ছিলেন মহানবীর সমবয়সী।

সমসাময়িক ঐতিহাসিক আবদুল ওয়াহ্হাব (মিশর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক,যিনি তারীখে ইবনে আসীরের ওপর কিছু মূল্যবান ও উপকারী টীকা লিখেছেন) উপরিউক্ত ঘটনাকে একটি অসাধারণ ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ঐ দিনই ওয়াহ্হাবের গৃহে আবদুল মুত্তালিবের গমন,তা-ও আবার দু টি মেয়ের বিবাহ প্রস্তাব দেয়া-একটি মেয়েকে নিজে বিয়ে করার জন্য এবং অপর মেয়েকে পুত্র আবদুল্লাহর সাথে বিবাহ দেয়ার জন্য আসলেই সামাজিক লোকাচার ও রীতিনীতি বহির্ভূত। ঐ ঐতিহাসিক দিনে যা তাঁর জন্য শোভনীয় ছিল তা হলো বিশ্রাম নেয়া ও ক্লান্তি-অবসাদ দূর করা। তাঁদের নিজেদের ক্লান্তি দূর করে নিজ নিজ কাজে হাত দেয়াটিই ছিল (তাঁদের জন্য একান্ত) স্বাভাবিক।118

কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি,লেখক যদি বিষয়টিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করতেন,তাহলে তাঁর পক্ষে তা বিশ্বাস করা সহজ হতো।

যা হোক অতঃপর আবদুল মুত্তালিব বধূবরণের জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করেন। নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে কুরাইশদের প্রচলিত প্রথানুযায়ী হযরত আমেনার পিতৃগৃহে বিবাহ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়। কিছুদিন আমেনার সাথে একত্রে বসবাস করার পর আবদুল্লাহ্ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শামের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং শাম থেকে ফেরার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা এতৎসংক্রান্ত বিশদ বিবরণ পরে যথাস্থানে উল্লেখ করব।

রহস্যজনক চক্রান্তকারীদের আনাগোনা

এতে কোন সন্দেহ নেই যে,ইতিহাসের পাতায় পাতায় জাতিসমূহের উজ্জ্বল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকসমূহ শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে সকল যুগ ও শতাব্দীতে ভালোবাসা ও ঘৃণা,আপোষকামিতা,উপেক্ষা ও শৈথিল্য,সৃজনশীলতা,অভূতপূর্ব বক্তব্য,লেখনী শক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং এ ধরনের আরো অনেক কারণ ইতিহাস রচনা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে এবং ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাগুলোকে মিথ্যা কল্প-কাহিনীর সাথে সংমিশ্রিত করে ফেলেছে। আর এটি হচ্ছে সেই ইতিহাসবেত্তার জন্য এক বিরাট সমস্যা যিনি ইতিহাসশাস্ত্রের তাত্ত্বিক মূলনীতিসমূহ বাস্তবে প্রয়োগ করে সত্য ও মিথ্যাকে পৃথক করে থাকেন।

উপরিউক্ত কারণসমূহ ইসলামের ইতিহাস রচনা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাসমূহের বিকৃতি সাধনে অদৃশ্য হাতসমূহ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য কখনো কখনো বন্ধুদের তরফ থেকে এমন সব শোভাবর্ধনকারী অলংকারিক বক্তব্য প্রদান ও প্রশংসাব্যঞ্জক কথা বলা হয়েছে যেগুলোর মাঝে মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার নিদর্শন স্পষ্ট বিদ্যমান।

আমরা ইতিহাসে পাঠ করি যে,হযরত আবদুল্লাহর ললাটে সব সময় নবুওয়াতের নূর (আলো) চমকাত।119 আমরা আরো জেনেছি,অনাবৃষ্টির বছরগুলোতে আবদুল মুত্তালিব তাঁর সন্তান আবদুল্লাহর হাত ধরে পাহাড়ের দিকে চলে যেতেন এবং আবদুল্লাহর ললাটের নূরের উসিলায় মহান আল্লাহর কাছে দয়া ও কৃপা প্রার্থনা করতেন।

এ বিষয়টি (আবদুল্লাহর কপালে নবুওয়াতের নূরের অস্তিত্ব) বহু শিয়া-সুন্নী আলেম বর্ণনা করেছেন। আর এ বিষয়টির অসত্য হওয়ার পক্ষে কোন দলিল বিদ্যমান নেই। তবে কতিপয় ইতিহাস গ্রন্থে বিষয়টি এমন এক কল্প-কাহিনী বা উপাখ্যানের উপজীব্য হয়েছে যা আমরা কখনই সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শোভা হিসাবে গ্রহণ করতে পারি না।

ফাতিমা খাসআমীয়ার কাহিনী

ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ ছিল ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের ভগ্নি। ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল ছিলেন আরবের অন্যতম পণ্ডিত ও ভবিষ্যদ্বক্তা। তিনি ইঞ্জিল সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার শুরুতে হযরত খাদীজার সাথে তাঁর কথোপকথন ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ আছে। আমরা তা যথাস্থানে আলোচনা করব।

ওয়ারাকার বোন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিল যে,ইসমাঈলের বংশধারায় এক ব্যক্তি নবী হবেন। এ কারণে সে সব সময় তাঁর সন্ধান করত। যেদিন আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে কোরবানীর স্থল থেকে বের হয়ে হযরত আমেনার পিতৃগৃহের দিকে যাচ্ছিলেন তখন ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তার ঘরের পাশে দণ্ডায়মান ছিল। তার চোখ একটি আলোর প্রতি নিবদ্ধ হয় অনেকদিন ধরে সে যার সন্ধান করে এসেছেন। সে বলল, আবদুল্লাহ্! তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার পিতা যেসব উট তোমার মুক্তির জন্য কোরবানী করেছেন তা আমি এক শর্তে দিতে প্রস্তুত। আর তা হলো তুমি আমার সাথে সহবাস করবে।” তখন আবদুল্লাহ্ বললেন, এখন আমি আমার পিতার সাথে আছি। এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” আবদুল্লাহ্ ঐ দিনই আমেনার সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং একরাত তাঁর সাথে অতিবাহিত করেন। পরের দিন তিনি ফাতিমা খাসআমীয়ার ঘরে ছুটে যান এবং তার পূর্বপ্রদত্ত প্রস্তাবে তিনি যে সম্মত ও প্রস্তুত আছেন তা তাকে জানান। ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ বলল, আজ তোমাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তোমার কপালে যে নূর আগে প্রত্যক্ষ করতাম তা এখন আর নেই এবং তোমা থেকে তা চলে গেছে। 120

কখনো কখনো বলা হয়েছে যে,ফাতিমা তার প্রয়োজনের কথা আবদুল্লাহর কাছে প্রকাশ করলে তিনি (আবদুল্লাহ্) তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নোক্ত দু টি পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

أما الحرام فالممات دونه

والحل لأحل فاستبينه

فكيف بالأمر الذي تبغينه

يحمي الكريم عرضه و دينه

“যেখানে এ ব্যাপারে আমি ভাবতেও পারি না সেখানে আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাবে সাড়া দেয়া কিভাবে সম্ভব? মহৎ ব্যক্তি তার নিজ সম্মান ও ধর্ম সংরক্ষণ করে।”

কিন্তু আমেনার সাথে তাঁর বিবাহের তিন দিন অতিবাহিত হতে না হতেই প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা আবদুল্লাহকে ফাতিমা খাসআমীয়ার গৃহপানে তাড়িত করে। ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তখন তাঁকে বলেছিল, তোমার কপালে যে দ্যুতি ছিল সে কারণেই আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই দ্যুতিটি আর নেই। মহান আল্লাহ্ যে স্থানে তা রাখতে চেয়েছিলেন সেখানেই রেখেছেন।” আবদুল্লাহ্ বললেন, হ্যাঁ আমি আমেনাকে বিবাহ করেছি। 121

এ ঘটনাটি বানোয়াট ও মিথ্যা হবার প্রমাণ

এ কাহিনীর জালকারী কিছু কিছু দিক উপেক্ষা করেছে এবং কাহিনীটির মিথ্যা ও কৃত্রিম হওয়ার চি হ্নগুলো দূর করতে পারে নি। যদি সে ঠিক এতটুকু পরিমাণের ওপরই নির্ভর করত যে,একদিন বাজারে অথবা গলিতে আবদুল্লাহর সাথে ফাতিমা খাসআমীয়ার দেখা হলে আবদুল্লাহর কপালে নবুওয়াতের দ্যুতি প্রত্যক্ষ করেছিল;এ দ্যুতি তাকে আবদুল্লাহর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল,তাহলে তা বিশ্বাস করা যেত। কিন্তু কাহিনীটির মূল ভাষ্য অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে যা নিম্নোক্ত কারণসমূহের আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়:

1. এ কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয় যে,যখন ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তার কামনা-বাসনার কথা প্রকাশ করল তখন আবদুল্লাহর হাত পিতা আবদুল মুত্তালিবের হাতের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। এমতাবস্থায় এ মেয়েটির পক্ষে তার মনোবাসনা ব্যক্ত করা কি আসলেই সম্ভব এবং আবদুল মুত্তালিবের মতো কুরাইশপ্রধানের সামনে তার এ কথা বলতে কি মোটেও লজ্জা হলো না? কারণ আবদুল মুত্তালিব ছিলেন ঐ ব্যক্তি যিনি মহান আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীর পথে নিজ সন্তানকে পর্যন্ত কোরবানী করতে মোটেও ভীত ও শঙ্কিত ছিলেন না। আর যদি আমরা বলি,ফাতিমা খাসআমীয়ার মনবাসনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বৈধ ছিল (অর্থাৎ সে আবদুল্লাহর কাছে বৈধ বিবাহের প্রস্তাবই পেশ করেছিল) তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ্ তাঁকে লক্ষ্য করে যে পঙ্ক্তিদ্বয় আবৃত্তি করেছিলেন সেগুলোর সাথে তা মোটেও খাপ খায় না।

2. এ থেকেও জটিলতর হচ্ছে আবদুল্লাহর পুরো ব্যাপারটা। কারণ যে সন্তান পিতার জন্য নিজে নিহত হয়েও অর্থাৎ নিজের জীবন প্রাণ উৎসর্গ করে হলেও সম্মান প্রদর্শন করে সে কিভাবে পিতার সামনে উপরিউক্ত কথাগুলো বলতে পারে? আসলে যে যুবক কয়েক মিনিট আগে তরবারির নিচে জবাই হওয়া থেকে নিস্কৃতি পেয়েছে সে তো তীব্রভাবে আত্মিক-মানসিক অস্থিরতার শিকার। তার পক্ষে কিভাবে এক রমণীর কামনা-বাসনার প্রতি সাড়া দেয়া সম্ভব?! ঐ রমণীর কি তাহলে সময়জ্ঞান বলতে কিছুই ছিল না? অথবা জালকারী কি কাহিনীটির এ সব দুর্বল ও উজ্জ্বল দিকের প্রতি উদাসীন থেকেছে?

কাহিনীর দ্বিতীয় রূপটি আরো বেশি অপমানজনক ও লজ্জাকর। কারণ প্রথমেই আবদুল্লাহ্ (অবৈধ কাজের আহবান শোনামাত্রই) ঐ দুটি পঙ্ক্তি আবৃত্তি করে প্রস্তাব দানকারিণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই অবৈধ কাজ যা ধর্ম ও মানমর্যাদা নষ্ট করে দেয় তা অপেক্ষা মৃত্যুও আমার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সহজ।” অতঃপর আত্মমর্যাদাবোধে উদ্দীপ্ত এ যুবকের পক্ষে এ ধরনের বিচ্যুত চিন্তাধারার কাছে নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণ করা কিভাবে সম্ভব হলো অথচ যার এখনো বিয়ের পর তিন রাতের বেশি সময় অতিবাহিত হয় নি। আর এরই মধ্যে যৌন তাড়না তাকে ফাতিমা খাসআমীয়ার গৃহপানে তাড়িত করেছিল!

আমরা কখনই মেনে নিতে পারব না যে,বনি হাশিম গোত্রে প্রতিপালিত আবদুল্লাহর মতো কোন যুবকের মাথায় এ ধরনের তাকওয়াবহির্ভূত চিন্তাধারার উদ্ভব হতে পারে যেখানে আবদুল্লাহকে মহান আল্লাহ্ একজন শ্রেষ্ঠ মহামানবের পিতা হিসাবে মনোনীত করেছেন। অধিকন্তু শিয়া-সুন্নী আলেমগণ মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারণকারিণীদের চারিত্রিক পবিত্রতার পক্ষে যে সব দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন তা এ ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য এবং উপরিউক্ত কাহিনীটি মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ মিথ্যা কল্পকাহিনী যদি অজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতের মুঠোয় তুলে দেয়া না হতো তাহলে আমরা মূলত তা আলোচনাই করতাম না।

 ‘ কিতাবে পিয়াম্বার গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টিপাত

কিতাবে পিয়াম্বার গ্রন্থটিতে যদি দৃষ্টিপাত করুন এবং এ কাহিনীটি লালন করার জন্য লেখক যে সব অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে এ গ্রন্থের লেখকের আসল উদ্দেশ্যের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারব। মহানবী (সা.)-এর জীবনী গল্পাকারে লেখাই হচ্ছে লেখকের মূল উদ্দেশ্য যাতে করে এ গল্পের প্রতি আগ্রহী তরুণগণ মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হয়। এটি এরকমই এক মহৎ,পবিত্র ও প্রশংসনীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য,তবে এ শর্তে যে,তা অবশ্যই ধর্মীয় নীতিমালার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,উপরিউক্ত গ্রন্থের ভাষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে,দুর্বলতম রেওয়ায়েত এবং সবচেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন কল্পকাহিনীই হচ্ছে লেখকের মূল দলিল;আবার কখনো কখনো লেখক নিজ থেকেই এগুলোর সাথে কয়েকগুণ বেশি বানোয়াট কথাবার্তা ও ভিত্তিহীন তথ্য যোগ করেছেন।

ফাতিমা খাসআমীয়ার কাহিনীটি ঠিক এমনই যা আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। যদি ধরে নেয়া হয় যে,উক্ত গল্পটি একটি মৌলিক গল্প বা কাহিনী,তারপরেও ঘটনাটির মূল বিবরণ ঠিক এটিই যা আদি ঐতিহাসিক সূত্রসমূহ থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।122

‘মহানবী’(সা.) গ্রন্থের লেখক,এমন সব ঘৃণ্য ও মর্যাদাহানিকর কথা অলঙ্কারসূচক গুণ হিসাবে এ ঘটনার সাথে উল্লেখ করেছেন যা বনি হাশিম গোত্রের মান-সম্মান,বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতার খোদাভীরুতা ও পূতঃপবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপন করে। আর এভাবে লেখক চেয়েছেন,যে গল্প বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে ভিত্তিহীন তা অধিকতর সুপাঠ্য করতে। লেখক এমনভাবে সরলমতি আরব ললনা ফাতিমা খাসআমীয়ার চারিত্রিক আচার-আচরণ বর্ণনা করেছেন যেন দীর্ঘকাল অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত ছিল।

লেখক এমনভাবে এ রমণীর প্রতি আবদুল্লাহর প্রেমাসক্তি বর্ণনা করেছেন,আবদুল্লাহর সুউচ্চ মর্যাদার সাথে যার ক্ষুদ্রতম সম্পর্কও নেই। আবদুল্লাহর সুমহান মর্যাদার প্রমাণ এটিই যে,মহান আল্লাহ্ তাঁরই ঔরসে নবুওয়াত ও তাকওয়ার নূর আমানতস্বরূপ স্থাপন করেছিলেন।

মহানবী’গ্রন্থের পাঠকবর্গের মনে রাখা উচিত যে,এ গ্রন্থের কিছু কিছু বিষয় ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে এবং এ গ্রন্থের বেশ কিছু আলোচ্য বিষয়ের কাহিনীভিত্তিক ও ঔপন্যাসিক দিকও আছে। এ গ্রন্থের অনেক আলোচ্য বিষয়ই পাশ্চাত্যের লেখকদের থেকে ধার করা হয়েছে যেগুলোর কোন স্পষ্ট যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ আমাদের সামনে নেই। যেমন উক্ত গ্রন্থের 102 পৃষ্ঠায় আবদুল্লাহর বিয়ের রাতের ঘটনাপ্রবাহ ও আরবীয় নৃত্যপদ্ধতি সম্পর্কে এবং আমেনার সাথে আবদুল্লাহর বিয়ের রাতে আবদুল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার কারণে 200 কুমারী মেয়ে হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিল-এ উপাখ্যানটি গীবন লিখিত রোমান সাম্রাজ্যের পতন’গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থের পাঠকদের কাছে সবিনয় অনুরোধ করছি তাঁরা যেন এ গ্রন্থ পাঠ করার সময় এর দুর্বল ও শক্তিশালী দিকগুলো বেশি বেশি বিবেচনায় আনেন।

ইয়াসরিবে আবদুল্লাহর মৃত্যু

আমেনার সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আবদুল্লাহর জীবনের নব অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং আমেনার মতো স্ত্রী লাভ করার কারণে তাঁর জীবন আলোকিত হয়ে যায়। কিছুদিন অতিবাহিত হলে পবিত্র মক্কা থেকে একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি শামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠলে কাফেলা যাত্রা শুরু করে এবং শত শত হৃদয়কেও যেন সেই সাথে নিয়ে যায়। এ সময় হযরত আমেনা গর্ভবতী ছিলেন। কয়েক মাস পরে দূর থেকে কাফেলার নিশান দেখা গেলে কিছু ব্যক্তি ঐ কাফেলায় তাদের নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য শহরের বাইরে গমন করল।

হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর অপেক্ষায় ছিলেন। পুত্রবধু আমেনার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি কাফেলার মাঝে আবদুল্লাহকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরছিল। কিন্তু কাফেলার মাঝে তাঁর কোন চি‎‎ হ্নই পাওয়া গেল না। খোঁজাখুঁজির পর তাঁরা জানতে পারলেন,আবদুল্লাহ্ ফেরার পথে ইয়াসরিবে (মদীনায়) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই বিশ্রাম ও সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কিছুদিন অতিবাহিত করতে চেয়েছেন। এ খবর শোনার পর আবদুল মুত্তালিব ও আমেনার মুখমণ্ডলে দুশ্চিন্তা ও বিষাদের ছায়া বিস্তার করল এবং তাঁদের নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

আবদুল মুত্তালিব জ্যেষ্ঠ পুত্র হারেসকে ইয়াসরিবে গিয়ে আবদুল্লাহকে মক্কায় নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। হারেস ইয়াসরিবে পৌঁছে জানতে পারলেন যে,বাণিজ্য কাফেলা প্রস্থানের এক মাস পরে যে অসুস্থতার কারণে আবদুল্লাহ্ যাত্রাবিরতি করেছিলেন সেই অসুস্থতায় মৃতুবরণ করেছেন। হারেস মক্কায় ফিরে এসে পুরো ঘটনা হযরত আবদুল মুত্তালিবকে জানালেন এবং হযরত আমেনাকেও তাঁর স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করলেন। আবদুল্লাহ্ মৃত্যুর আগে যা কিছু উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল নিম্নরূপ : পাঁচটি উট,এক পাল দুম্বা এবং উম্মে আইমান নাম্নী এক দাসী যিনি পরবর্তীকালে মহানবী (সা.)-কে প্রতিপালন করেছিলেন ।123

কুরাইশদের কল্পরাজ্য

খোদা না করুন যে,এই মানুষ একদিন তার জীবনের দিকচক্রবাল রেখা পরিষ্কার ও উজ্জ্বল দেখতে পেয়ে নিজের জন্য এক কাল্পনিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রবক্তা হয়ে যায়। তখনই সে অস্তিত্ব ও জীবনকে কেবল তারই সাথে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করবে এবং অন্য মানুষের জন্য স্বল্পতম জীবনধারণের ন্যূনতম অধিকার ও সম্মানের স্বীকৃতি দেবে না।

সকলের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য কুরাইশগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল যে,তারা মক্কা শরীফের বাইরে নির্ধারিত এলাকার  (حل )114 অধিবাসীদের ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেবে না। কারণ তারা বলত, সাধারণ আরব আমাদের ইবাদাতগাহের প্রতি মুখাপেক্ষী। আর আরব জাতির সবাই প্রত্যক্ষ করেছে,আমরা কাবার দেব-দেবীদের কৃপাদৃষ্টিতে আছি।” তখন থেকেই কুরাইশদের কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যায়। তারা জোরজুলুম চালিয়ে হিল-এর অধিবাসীদেরকে বাধ্য করেছিল যে,হজ্ব ও উমরার জন্য মক্কায় প্রবেশ করলে তারা তাদের নিজেদের সাথে আনা খাদ্য ভক্ষণ করতে পারবে না। হারামের অধিবাসীদের খাবারই তাদের খেতে হবে। তাওয়াফের সময় তাদেরকে মক্কার স্থানীয় পোশাক পরিধান করতে হবে। আর এখানে স্মর্তব্য যে,এ স্থানীয় পোশাকে গোত্রীয় দিক প্রতিফলিত হয়েছিল। কোন ব্যক্তি মক্কার স্থানীয় পোশাক সংগ্রহ করতে না পারলে তাকে অবশ্যই দিগম্বর হয়ে পবিত্র কাবার চারপাশে তাওয়াফ করতে হবে। তবে যে কতিপয় (অ-কুরাইশ) আরব গোত্রপতি এ বিষয়টি মেনে নেয় নি তাদের ব্যাপারে স্থির করা হয় যে,তাওয়াফ শেষ করার পর তারা দেহ থেকে পোশাক পরিচ্ছদ বের করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কোন ব্যক্তির হক নেই ঐ সব পোশাকে হাত দেয়ার। তবে সবক্ষেত্রেই মহিলারা বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করতে বাধ্য ছিল। তাদেরকে (মহিলাদের) তাওয়াফ করার সময় কেবল নিজেদের মাথা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে বিশেষ ধরনের একটি কবিতা115 গুনগুন করে পড়তে হতো।

খ্রিষ্টান আবরাহার আক্রমণের পর কোন ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানের পবিত্র মক্কায় প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে যে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান কোন মক্কাবাসীর বেতনভূক কর্মচারী হতো সে হতো ব্যতিক্রম (অর্থাৎ সে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করতে পারত)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজ ধর্ম সম্পর্কে ন্যূনতম কথা বলার অধিকার তার থাকত না।

কুরাইশদের গর্ব ও অহংকার এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে,হজ্বের কিছু কিছু আচার-অনুষ্ঠান যা হারামের বাইরে আঞ্জাম দিতে হয় তা তারা বর্জন করেছিল এবং এ কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে116 অবস্থান করত না ( আরাফাত’হারামের বাইরে একটি স্থানের নাম যেখানে হাজীদেরকে অবশ্যই যিলহজ্ব মাসের নবম দিবসে যোহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়।)। অথচ তাদের পূর্বপুরুষগণ (হযরত ইসমাঈল-এর সন্তানগণ) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকে হজ্ব অনুষ্ঠানের একটি অংশ বলে গণ্য করতেন। আর কুরাইশদের পুরো বাহ্যিক সম্মান ও মর্যাদা পবিত্র কাবা ও হজ্বের এ সব আচার-অনুষ্ঠানের কাছেই ঋণী ছিল। আরব উপদ্বীপের সকল স্থান থেকে জনগণ প্রতি বছর শুষ্ক ও পানিহীন এ মরু এলাকায় হজ্বব্রত পালনের জন্য আসতে বাধ্য ছিল। এখানে যদি কোন তাওয়াফ করার স্থান (পবিত্র কাবা) ও মাশআর (হাজীদের নির্দিষ্ট ইবাদাতের স্থান-যেখানে হাজীরা আরাফাহ্ থেকে বের হয়ে রাত্রিযাপন করে ফজরের সময় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ফরয অবস্থান করার জন্য এবং এরপর তারা মীনায় হজ্বের বাকি কাজগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্য বের হয়ে যায়) না থাকত তাহলে কোন ব্যক্তিই জীবনে একবারের জন্যও এ স্থান অতিক্রম করার ইচ্ছা প্রকাশ করত না।

সামাজিক হিসাব-নিকাশের দৃষ্টিতে এ সব দুর্নীতি ও বৈষম্যের উদ্ভব আসলে এড়ানো সম্ভব নয়। একটি মৌলিক বিপ্লব ও শক্তিশালী আন্দোলনের জন্য বিশ্বের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর পরিবেশ অবশ্যই সীমাহীন দুর্নীতি ও কলঙ্কের মধ্যে নিমজ্জিত হতেই হবে।

এ সব বঞ্চনা,আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি পবিত্র মক্কা নগরীর পরিবেশ-পরিস্থিতিকে একজন বিশ্বসংস্কারক নেতার আবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত ও উপযুক্ত করে তুলছিল। আর এ বিষয়টি মোটেও অনর্থক ও অসমীচীন হবে না যে,আরবদের পণ্ডিত বলে খ্যাত ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল যিনি তাঁর শেষ জীবনে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইঞ্জিল শরীফ সংক্রান্ত জ্ঞানও অর্জন করেছিলেন তিনি যখনই মহান আল্লাহ্ ও নবীদের সম্পর্কে কথা বলতেন তখনই তিনি মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ানের ক্রোধ ও উষ্মার শিকার হতেন। আবু সুফিয়ান তখন বলত, এমন স্রষ্টা ও নবীর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। কারণ আমরা প্রতিমা ও মূর্তিদের দয়া ও কৃপার মধ্যেই আছি।”

6. মহানবীর পিতা আবদুল্লাহ্

যেদিন আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর জীবন মহান আল্লাহর পথে 100 উট কোরবানী করার মাধ্যমে পুনঃক্রয় করেছিলেন তখনও তাঁর (আবদুল্লাহর) জীবনের 24টি বসন্ত অতিবাহিত হয়নি। এ ঘটনার কারণে আবদুল্লাহ্ কুরাইশ বংশীয়দের মধ্যে প্রশংসনীয় মর্যাদা ও খ্যাতির অধিকারী হওয়া ছাড়াও নিজ বংশে,বিশেষ করে আবদুল মুত্তালিবের কাছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন। কারণ যে জিনিসের জন্য মানুষকে তার জীবনে চড়া মূল্য দিতে হয় এবং বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় সে জিনিসের প্রতি তার টান সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ কারণেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ অস্বাভাবিক ধরনের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন।

যেদিন আবদুল্লাহ্ পিতার সাথে কোরবানী করার স্থানে গমন করছিলেন সেদিন তাঁর মধ্যে পরস্পর ভিন্নধর্মী আবেগ ও অনুভূতির উদ্ভব হয়েছিল। পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁর সার্বিক দুঃখ-কষ্ট বরণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনুভূতি তাঁর গোটা অস্তিত্বকে ঘিরে রেখেছিল;আর এ কারণেই আত্মসমর্পণ করা ব্যতীত তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে,যেহেতু ভাগ্যবিধি চাচ্ছিল তাঁর জীবন-বসন্তের ফুলগুলোকে শরৎকালীন পত্রের মতো শুকিয়ে বিবর্ণ ও মলিন করে দিতে সে কারণে তাঁর অন্তরের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতাও দেখা দিয়েছিল।

আবদুল্লাহ্ ঈমান এবং আবেগ-অনুভূতি-এ দু টি শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে গিয়েছিলেন এবং এ ঘটনাপ্রবাহ তাঁর অন্তরে বেশ কিছু অপূরণীয় অস্বস্তি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। তবে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে সমস্যার সমাধান হলে আবদুল মুত্তালিব আমেনার সাথে আবদুল্লাহর বিবাহের ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করার মাধ্যমে এ তিক্ত অনুভূতির তাৎক্ষণিক অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহর জীবনসূত্র যা ছিন্ন-ভিন্ন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তা জীবনের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়ের (অর্থাৎ বিবাহ) সাথে এখন সংযুক্ত হয়ে গেল।

আবদুল মুত্তালিব কোরবানীর স্থল থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরে সরাসরি ওয়াহাব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যাহরার গৃহে চলে গেলেন। ওয়াহাবের মেয়ে আমেনার সাথে আবদুল্লাহকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলেন। উল্লেখ্য যে,ওয়াহাব-কন্যা আমেনা ছিলেন পুণ্যবতী ও সচ্চরিত্রা নারী। আর তিনি (আবদুল মুত্তালিব) ঐ একই অনুষ্ঠানে আমেনার চাচাতো বোন দালালাকে বিবাহ করেন। মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত হামযাহ্117 এই দালালার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হযরত হামযাহ্ ছিলেন মহানবীর সমবয়সী।

সমসাময়িক ঐতিহাসিক আবদুল ওয়াহ্হাব (মিশর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক,যিনি তারীখে ইবনে আসীরের ওপর কিছু মূল্যবান ও উপকারী টীকা লিখেছেন) উপরিউক্ত ঘটনাকে একটি অসাধারণ ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করে লিখেছেন, ঐ দিনই ওয়াহ্হাবের গৃহে আবদুল মুত্তালিবের গমন,তা-ও আবার দু টি মেয়ের বিবাহ প্রস্তাব দেয়া-একটি মেয়েকে নিজে বিয়ে করার জন্য এবং অপর মেয়েকে পুত্র আবদুল্লাহর সাথে বিবাহ দেয়ার জন্য আসলেই সামাজিক লোকাচার ও রীতিনীতি বহির্ভূত। ঐ ঐতিহাসিক দিনে যা তাঁর জন্য শোভনীয় ছিল তা হলো বিশ্রাম নেয়া ও ক্লান্তি-অবসাদ দূর করা। তাঁদের নিজেদের ক্লান্তি দূর করে নিজ নিজ কাজে হাত দেয়াটিই ছিল (তাঁদের জন্য একান্ত) স্বাভাবিক।118

কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি,লেখক যদি বিষয়টিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করতেন,তাহলে তাঁর পক্ষে তা বিশ্বাস করা সহজ হতো।

যা হোক অতঃপর আবদুল মুত্তালিব বধূবরণের জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করেন। নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে কুরাইশদের প্রচলিত প্রথানুযায়ী হযরত আমেনার পিতৃগৃহে বিবাহ অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়। কিছুদিন আমেনার সাথে একত্রে বসবাস করার পর আবদুল্লাহ্ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শামের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং শাম থেকে ফেরার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা এতৎসংক্রান্ত বিশদ বিবরণ পরে যথাস্থানে উল্লেখ করব।

রহস্যজনক চক্রান্তকারীদের আনাগোনা

এতে কোন সন্দেহ নেই যে,ইতিহাসের পাতায় পাতায় জাতিসমূহের উজ্জ্বল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকসমূহ শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে সকল যুগ ও শতাব্দীতে ভালোবাসা ও ঘৃণা,আপোষকামিতা,উপেক্ষা ও শৈথিল্য,সৃজনশীলতা,অভূতপূর্ব বক্তব্য,লেখনী শক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং এ ধরনের আরো অনেক কারণ ইতিহাস রচনা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে এবং ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাগুলোকে মিথ্যা কল্প-কাহিনীর সাথে সংমিশ্রিত করে ফেলেছে। আর এটি হচ্ছে সেই ইতিহাসবেত্তার জন্য এক বিরাট সমস্যা যিনি ইতিহাসশাস্ত্রের তাত্ত্বিক মূলনীতিসমূহ বাস্তবে প্রয়োগ করে সত্য ও মিথ্যাকে পৃথক করে থাকেন।

উপরিউক্ত কারণসমূহ ইসলামের ইতিহাস রচনা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাসমূহের বিকৃতি সাধনে অদৃশ্য হাতসমূহ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য কখনো কখনো বন্ধুদের তরফ থেকে এমন সব শোভাবর্ধনকারী অলংকারিক বক্তব্য প্রদান ও প্রশংসাব্যঞ্জক কথা বলা হয়েছে যেগুলোর মাঝে মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার নিদর্শন স্পষ্ট বিদ্যমান।

আমরা ইতিহাসে পাঠ করি যে,হযরত আবদুল্লাহর ললাটে সব সময় নবুওয়াতের নূর (আলো) চমকাত।119 আমরা আরো জেনেছি,অনাবৃষ্টির বছরগুলোতে আবদুল মুত্তালিব তাঁর সন্তান আবদুল্লাহর হাত ধরে পাহাড়ের দিকে চলে যেতেন এবং আবদুল্লাহর ললাটের নূরের উসিলায় মহান আল্লাহর কাছে দয়া ও কৃপা প্রার্থনা করতেন।

এ বিষয়টি (আবদুল্লাহর কপালে নবুওয়াতের নূরের অস্তিত্ব) বহু শিয়া-সুন্নী আলেম বর্ণনা করেছেন। আর এ বিষয়টির অসত্য হওয়ার পক্ষে কোন দলিল বিদ্যমান নেই। তবে কতিপয় ইতিহাস গ্রন্থে বিষয়টি এমন এক কল্প-কাহিনী বা উপাখ্যানের উপজীব্য হয়েছে যা আমরা কখনই সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শোভা হিসাবে গ্রহণ করতে পারি না।

ফাতিমা খাসআমীয়ার কাহিনী

ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ ছিল ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলের ভগ্নি। ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেল ছিলেন আরবের অন্যতম পণ্ডিত ও ভবিষ্যদ্বক্তা। তিনি ইঞ্জিল সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার শুরুতে হযরত খাদীজার সাথে তাঁর কথোপকথন ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ আছে। আমরা তা যথাস্থানে আলোচনা করব।

ওয়ারাকার বোন ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিল যে,ইসমাঈলের বংশধারায় এক ব্যক্তি নবী হবেন। এ কারণে সে সব সময় তাঁর সন্ধান করত। যেদিন আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে কোরবানীর স্থল থেকে বের হয়ে হযরত আমেনার পিতৃগৃহের দিকে যাচ্ছিলেন তখন ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তার ঘরের পাশে দণ্ডায়মান ছিল। তার চোখ একটি আলোর প্রতি নিবদ্ধ হয় অনেকদিন ধরে সে যার সন্ধান করে এসেছেন। সে বলল, আবদুল্লাহ্! তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার পিতা যেসব উট তোমার মুক্তির জন্য কোরবানী করেছেন তা আমি এক শর্তে দিতে প্রস্তুত। আর তা হলো তুমি আমার সাথে সহবাস করবে।” তখন আবদুল্লাহ্ বললেন, এখন আমি আমার পিতার সাথে আছি। এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” আবদুল্লাহ্ ঐ দিনই আমেনার সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং একরাত তাঁর সাথে অতিবাহিত করেন। পরের দিন তিনি ফাতিমা খাসআমীয়ার ঘরে ছুটে যান এবং তার পূর্বপ্রদত্ত প্রস্তাবে তিনি যে সম্মত ও প্রস্তুত আছেন তা তাকে জানান। ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ বলল, আজ তোমাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ তোমার কপালে যে নূর আগে প্রত্যক্ষ করতাম তা এখন আর নেই এবং তোমা থেকে তা চলে গেছে। 120

কখনো কখনো বলা হয়েছে যে,ফাতিমা তার প্রয়োজনের কথা আবদুল্লাহর কাছে প্রকাশ করলে তিনি (আবদুল্লাহ্) তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নোক্ত দু টি পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

أما الحرام فالممات دونه

والحل لأحل فاستبينه

فكيف بالأمر الذي تبغينه

يحمي الكريم عرضه و دينه

“যেখানে এ ব্যাপারে আমি ভাবতেও পারি না সেখানে আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাবে সাড়া দেয়া কিভাবে সম্ভব? মহৎ ব্যক্তি তার নিজ সম্মান ও ধর্ম সংরক্ষণ করে।”

কিন্তু আমেনার সাথে তাঁর বিবাহের তিন দিন অতিবাহিত হতে না হতেই প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা আবদুল্লাহকে ফাতিমা খাসআমীয়ার গৃহপানে তাড়িত করে। ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তখন তাঁকে বলেছিল, তোমার কপালে যে দ্যুতি ছিল সে কারণেই আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই দ্যুতিটি আর নেই। মহান আল্লাহ্ যে স্থানে তা রাখতে চেয়েছিলেন সেখানেই রেখেছেন।” আবদুল্লাহ্ বললেন, হ্যাঁ আমি আমেনাকে বিবাহ করেছি। 121

এ ঘটনাটি বানোয়াট ও মিথ্যা হবার প্রমাণ

এ কাহিনীর জালকারী কিছু কিছু দিক উপেক্ষা করেছে এবং কাহিনীটির মিথ্যা ও কৃত্রিম হওয়ার চি হ্নগুলো দূর করতে পারে নি। যদি সে ঠিক এতটুকু পরিমাণের ওপরই নির্ভর করত যে,একদিন বাজারে অথবা গলিতে আবদুল্লাহর সাথে ফাতিমা খাসআমীয়ার দেখা হলে আবদুল্লাহর কপালে নবুওয়াতের দ্যুতি প্রত্যক্ষ করেছিল;এ দ্যুতি তাকে আবদুল্লাহর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছিল,তাহলে তা বিশ্বাস করা যেত। কিন্তু কাহিনীটির মূল ভাষ্য অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে যা নিম্নোক্ত কারণসমূহের আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়:

1. এ কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয় যে,যখন ফাতিমা খাসআমীয়াহ্ তার কামনা-বাসনার কথা প্রকাশ করল তখন আবদুল্লাহর হাত পিতা আবদুল মুত্তালিবের হাতের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। এমতাবস্থায় এ মেয়েটির পক্ষে তার মনোবাসনা ব্যক্ত করা কি আসলেই সম্ভব এবং আবদুল মুত্তালিবের মতো কুরাইশপ্রধানের সামনে তার এ কথা বলতে কি মোটেও লজ্জা হলো না? কারণ আবদুল মুত্তালিব ছিলেন ঐ ব্যক্তি যিনি মহান আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীর পথে নিজ সন্তানকে পর্যন্ত কোরবানী করতে মোটেও ভীত ও শঙ্কিত ছিলেন না। আর যদি আমরা বলি,ফাতিমা খাসআমীয়ার মনবাসনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বৈধ ছিল (অর্থাৎ সে আবদুল্লাহর কাছে বৈধ বিবাহের প্রস্তাবই পেশ করেছিল) তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ্ তাঁকে লক্ষ্য করে যে পঙ্ক্তিদ্বয় আবৃত্তি করেছিলেন সেগুলোর সাথে তা মোটেও খাপ খায় না।

2. এ থেকেও জটিলতর হচ্ছে আবদুল্লাহর পুরো ব্যাপারটা। কারণ যে সন্তান পিতার জন্য নিজে নিহত হয়েও অর্থাৎ নিজের জীবন প্রাণ উৎসর্গ করে হলেও সম্মান প্রদর্শন করে সে কিভাবে পিতার সামনে উপরিউক্ত কথাগুলো বলতে পারে? আসলে যে যুবক কয়েক মিনিট আগে তরবারির নিচে জবাই হওয়া থেকে নিস্কৃতি পেয়েছে সে তো তীব্রভাবে আত্মিক-মানসিক অস্থিরতার শিকার। তার পক্ষে কিভাবে এক রমণীর কামনা-বাসনার প্রতি সাড়া দেয়া সম্ভব?! ঐ রমণীর কি তাহলে সময়জ্ঞান বলতে কিছুই ছিল না? অথবা জালকারী কি কাহিনীটির এ সব দুর্বল ও উজ্জ্বল দিকের প্রতি উদাসীন থেকেছে?

কাহিনীর দ্বিতীয় রূপটি আরো বেশি অপমানজনক ও লজ্জাকর। কারণ প্রথমেই আবদুল্লাহ্ (অবৈধ কাজের আহবান শোনামাত্রই) ঐ দুটি পঙ্ক্তি আবৃত্তি করে প্রস্তাব দানকারিণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই অবৈধ কাজ যা ধর্ম ও মানমর্যাদা নষ্ট করে দেয় তা অপেক্ষা মৃত্যুও আমার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সহজ।” অতঃপর আত্মমর্যাদাবোধে উদ্দীপ্ত এ যুবকের পক্ষে এ ধরনের বিচ্যুত চিন্তাধারার কাছে নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণ করা কিভাবে সম্ভব হলো অথচ যার এখনো বিয়ের পর তিন রাতের বেশি সময় অতিবাহিত হয় নি। আর এরই মধ্যে যৌন তাড়না তাকে ফাতিমা খাসআমীয়ার গৃহপানে তাড়িত করেছিল!

আমরা কখনই মেনে নিতে পারব না যে,বনি হাশিম গোত্রে প্রতিপালিত আবদুল্লাহর মতো কোন যুবকের মাথায় এ ধরনের তাকওয়াবহির্ভূত চিন্তাধারার উদ্ভব হতে পারে যেখানে আবদুল্লাহকে মহান আল্লাহ্ একজন শ্রেষ্ঠ মহামানবের পিতা হিসাবে মনোনীত করেছেন। অধিকন্তু শিয়া-সুন্নী আলেমগণ মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষ ও গর্ভধারণকারিণীদের চারিত্রিক পবিত্রতার পক্ষে যে সব দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন তা এ ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য এবং উপরিউক্ত কাহিনীটি মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ মিথ্যা কল্পকাহিনী যদি অজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতের মুঠোয় তুলে দেয়া না হতো তাহলে আমরা মূলত তা আলোচনাই করতাম না।

 ‘ কিতাবে পিয়াম্বার গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টিপাত

কিতাবে পিয়াম্বার গ্রন্থটিতে যদি দৃষ্টিপাত করুন এবং এ কাহিনীটি লালন করার জন্য লেখক যে সব অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে এ গ্রন্থের লেখকের আসল উদ্দেশ্যের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারব। মহানবী (সা.)-এর জীবনী গল্পাকারে লেখাই হচ্ছে লেখকের মূল উদ্দেশ্য যাতে করে এ গল্পের প্রতি আগ্রহী তরুণগণ মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হয়। এটি এরকমই এক মহৎ,পবিত্র ও প্রশংসনীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য,তবে এ শর্তে যে,তা অবশ্যই ধর্মীয় নীতিমালার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,উপরিউক্ত গ্রন্থের ভাষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে,দুর্বলতম রেওয়ায়েত এবং সবচেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন কল্পকাহিনীই হচ্ছে লেখকের মূল দলিল;আবার কখনো কখনো লেখক নিজ থেকেই এগুলোর সাথে কয়েকগুণ বেশি বানোয়াট কথাবার্তা ও ভিত্তিহীন তথ্য যোগ করেছেন।

ফাতিমা খাসআমীয়ার কাহিনীটি ঠিক এমনই যা আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। যদি ধরে নেয়া হয় যে,উক্ত গল্পটি একটি মৌলিক গল্প বা কাহিনী,তারপরেও ঘটনাটির মূল বিবরণ ঠিক এটিই যা আদি ঐতিহাসিক সূত্রসমূহ থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।122

‘মহানবী’(সা.) গ্রন্থের লেখক,এমন সব ঘৃণ্য ও মর্যাদাহানিকর কথা অলঙ্কারসূচক গুণ হিসাবে এ ঘটনার সাথে উল্লেখ করেছেন যা বনি হাশিম গোত্রের মান-সম্মান,বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় পিতার খোদাভীরুতা ও পূতঃপবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপন করে। আর এভাবে লেখক চেয়েছেন,যে গল্প বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে ভিত্তিহীন তা অধিকতর সুপাঠ্য করতে। লেখক এমনভাবে সরলমতি আরব ললনা ফাতিমা খাসআমীয়ার চারিত্রিক আচার-আচরণ বর্ণনা করেছেন যেন দীর্ঘকাল অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত ছিল।

লেখক এমনভাবে এ রমণীর প্রতি আবদুল্লাহর প্রেমাসক্তি বর্ণনা করেছেন,আবদুল্লাহর সুউচ্চ মর্যাদার সাথে যার ক্ষুদ্রতম সম্পর্কও নেই। আবদুল্লাহর সুমহান মর্যাদার প্রমাণ এটিই যে,মহান আল্লাহ্ তাঁরই ঔরসে নবুওয়াত ও তাকওয়ার নূর আমানতস্বরূপ স্থাপন করেছিলেন।

মহানবী’গ্রন্থের পাঠকবর্গের মনে রাখা উচিত যে,এ গ্রন্থের কিছু কিছু বিষয় ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে এবং এ গ্রন্থের বেশ কিছু আলোচ্য বিষয়ের কাহিনীভিত্তিক ও ঔপন্যাসিক দিকও আছে। এ গ্রন্থের অনেক আলোচ্য বিষয়ই পাশ্চাত্যের লেখকদের থেকে ধার করা হয়েছে যেগুলোর কোন স্পষ্ট যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ আমাদের সামনে নেই। যেমন উক্ত গ্রন্থের 102 পৃষ্ঠায় আবদুল্লাহর বিয়ের রাতের ঘটনাপ্রবাহ ও আরবীয় নৃত্যপদ্ধতি সম্পর্কে এবং আমেনার সাথে আবদুল্লাহর বিয়ের রাতে আবদুল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার কারণে 200 কুমারী মেয়ে হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিল-এ উপাখ্যানটি গীবন লিখিত রোমান সাম্রাজ্যের পতন’গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থের পাঠকদের কাছে সবিনয় অনুরোধ করছি তাঁরা যেন এ গ্রন্থ পাঠ করার সময় এর দুর্বল ও শক্তিশালী দিকগুলো বেশি বেশি বিবেচনায় আনেন।

ইয়াসরিবে আবদুল্লাহর মৃত্যু

আমেনার সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আবদুল্লাহর জীবনের নব অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং আমেনার মতো স্ত্রী লাভ করার কারণে তাঁর জীবন আলোকিত হয়ে যায়। কিছুদিন অতিবাহিত হলে পবিত্র মক্কা থেকে একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি শামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠলে কাফেলা যাত্রা শুরু করে এবং শত শত হৃদয়কেও যেন সেই সাথে নিয়ে যায়। এ সময় হযরত আমেনা গর্ভবতী ছিলেন। কয়েক মাস পরে দূর থেকে কাফেলার নিশান দেখা গেলে কিছু ব্যক্তি ঐ কাফেলায় তাদের নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য শহরের বাইরে গমন করল।

হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর অপেক্ষায় ছিলেন। পুত্রবধু আমেনার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি কাফেলার মাঝে আবদুল্লাহকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরছিল। কিন্তু কাফেলার মাঝে তাঁর কোন চি‎‎ হ্নই পাওয়া গেল না। খোঁজাখুঁজির পর তাঁরা জানতে পারলেন,আবদুল্লাহ্ ফেরার পথে ইয়াসরিবে (মদীনায়) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই বিশ্রাম ও সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য তিনি তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কিছুদিন অতিবাহিত করতে চেয়েছেন। এ খবর শোনার পর আবদুল মুত্তালিব ও আমেনার মুখমণ্ডলে দুশ্চিন্তা ও বিষাদের ছায়া বিস্তার করল এবং তাঁদের নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

আবদুল মুত্তালিব জ্যেষ্ঠ পুত্র হারেসকে ইয়াসরিবে গিয়ে আবদুল্লাহকে মক্কায় নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। হারেস ইয়াসরিবে পৌঁছে জানতে পারলেন যে,বাণিজ্য কাফেলা প্রস্থানের এক মাস পরে যে অসুস্থতার কারণে আবদুল্লাহ্ যাত্রাবিরতি করেছিলেন সেই অসুস্থতায় মৃতুবরণ করেছেন। হারেস মক্কায় ফিরে এসে পুরো ঘটনা হযরত আবদুল মুত্তালিবকে জানালেন এবং হযরত আমেনাকেও তাঁর স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করলেন। আবদুল্লাহ্ মৃত্যুর আগে যা কিছু উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল নিম্নরূপ : পাঁচটি উট,এক পাল দুম্বা এবং উম্মে আইমান নাম্নী এক দাসী যিনি পরবর্তীকালে মহানবী (সা.)-কে প্রতিপালন করেছিলেন ।123


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61