চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106828 / ডাউনলোড: 9707
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ নিষিদ্ধ হলো

আবু সুফিয়ান মক্কাবাসীদের ক্রোধকে উজ্জীবিত রাখা ও তাদের বীরদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহাকে জাগরিত করার লক্ষ্যে ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল ও কবিতা পাঠের আসর হতে নিবৃত হওয়ার নির্দেশ দিল। কারণ ক্রন্দন ও শোকগাথা পাঠ প্রতিশোধ স্পৃহাকে স্তিমিত করে এবং শত্রুর মনোবলকে বাড়িয়ে দেয়। সে মক্কাবাসীদের জন্য ফরমান জারি করল যে,মুসলমানদের কাছ থেকে কুরাইশরা রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যেন স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত না হয়।

আসওয়াদ মুত্তালিব তার তিন পুত্রকে হারানোর ফলে ক্রোধ ও প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন এক নারীকে ক্রন্দন ও আহাজারি করতে শুনে মৃতদের জন্য ক্রন্দনের অনুমতি দেয়া হয়েছে মনে করে খুশী হলো। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে এক ব্যক্তিকে ঐ নারীর ক্রন্দনের কারণ জানার জন্য প্রেরণ করল। ঐ ব্যক্তি খবর আনল,সে নারী তার উট হারিয়ে যাওয়ার ফলে ক্রন্দন করছে। এজন্য ক্রন্দন করা আবু সুফিয়ানের আইনে নিষিদ্ধ ছিল না। এ কথা শুনে সে এতটা প্রভাবিত হলো যে,দু লাইন কবিতা রচনা করল।

أ تبكي أن تضل لها بعير

و يمنعها من النوم السهود

فلا تبكي على بكر و لكن

على بدر تقاصرت الجدود

এর অর্থ হলো :

ঐ নারী তার হারানো উটের জন্য রাত জেগে অশ্রুপাত করছে।

তরুণ উটের জন্য ক্রন্দন করা তার জন্য মানায় না,

বরং তার উচিত সে সব তরুণ মৃতের জন্য ক্রন্দন করা

যাদের মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ৫৮৯

বন্দীদের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত

বদর যুদ্ধে বন্দীদের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে,তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদের প্রত্যেকে মুসলিম শিশুদের ১০ জনকে শিক্ষা দান করবে। যারা অশিক্ষিত তারা তাদের অর্থনৈতিক পদমর্যাদা অনুযায়ী এক হাজার হতে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ হিসাবে দিবে। যাদের কোন অর্থসম্পদ নেই তারা কোন মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি লাভ করবে। এ খবর মক্কাবাসীদের নিকট পৌঁছলে বন্দীদের আত্মীয়স্বজনরা খুব খুশী হলো। তারা তাদের বন্দীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করল। তারা মুক্তিপণ দানের মাধ্যমে নিজ নিজ আত্মীয়দের মুক্ত করে নিল। যখন সুহাইল ইবনে আমর মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ লাভ করল তখন রাসূলের এক সাহাবী তাঁর নিকট অনুমতি চাইলেন সুহাইলের সামনের দাঁতগুলো উপড়ে ফেলার জন্য যাতে করে সে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে না পারে। মহানবী (সা.) অনুমতি দিলেন না,বরং বললেন, এরূপ অঙ্গহানি করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় নি।

রাসূলের কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল আস একজন ব্যবসায়ী ও মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইসলামপূর্ব যুগে রাসূলের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। মহানবীর নবুওয়াত লাভের পর তাঁর স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি অমুসলিম থেকে যান।

বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। সে সময় তাঁর স্ত্রী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। স্বামীর বন্দী হওয়ার কথা শুনে তাঁকে মুক্ত করার জন্য স্বীয় গলার হার যা তাঁর মা হযরত খাদীজাহ্ তাঁকে তাঁর বিবাহের রাতে উপহার দিয়েছিলেন তা মদীনায় পাঠালেন। মহানবী হযরত খাদীজার হারটির প্রতি লক্ষ্য করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি তাঁর জীবনের সংকটময় মুহূর্তে হযরত খাদীজার ভূমিকার কথা স্মরণ করে কাঁদছিলেন। কারণ সংকটময় সেই মুহূর্তে হযরত খাদীজাহ্ তাঁর পাশে ছিলেন এবং তাঁর সমস্ত সম্পদ ইসলামের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) মুসলমানদের বায়তুল মাল (সাধারণ সম্পদ) সংরক্ষণে খুব তৎপর ছিলেন। মুসলমানদের অধিকার যেন সংরক্ষিত থাকে এজন্য তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, এই গলার হারটি তোমাদের সকলের সম্পদ,যদি তোমরা অনুমতি দাও তবে আবুল আসকে কোন মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দিয়ে এ গলার হারটি যয়নাবকে ফিরিয়ে দেব। রাসূলের সঙ্গীরা সর্বসম্মতভাবে তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলেন। মহানবী আবুল আসকে মুক্ত করে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন যে,যয়নাবকে তিনি মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দেবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যয়নাবকে মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।৫৯০

ইবনে আবিল হাদীদের বক্তব্য

তিনি বলেন,হযরত যয়নাবের এ ঘটনাটি আমার শিক্ষক আবু জাফর বাসরী আলাভীকে বললাম। তিনি ঘটনাটি সত্য বলে যোগ করলেন,ফাতিমার মর্যাদা কি যয়নাবের চেয়ে বেশি নয়? যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে কেন খলীফারা হযরত ফাতিমাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে ফাদাক তাঁর হাতে অর্পণ করলেন না? যদিও আমরা ধরে নিই,এটি মুসলমানদের সাধারণ সম্পদ ছিল। আমি বললাম,নবীর হাদিস অনুযায়ী নবীরা কোন উত্তরাধিকারী রেখে যান না৫৯১ তাই ফাদাক যেহেতু মুসলমানদের সাধারণ সম্পদ ছিল তাঁদের পক্ষে তা ফাতিমাকে দেয়া সম্ভব ছিল কি? তিনি বললেন,(আবুল আসের মুক্তির জন্য প্রেরিত) যয়নাবের গলার হারটিও কি মুসলমানদের সাধারণ সম্পদ ছিল না?

আমি বললাম,মহানবী নিজে শরীয়তের প্রবক্তা ছিলেন এবং তাঁর নির্দেশের বিশেষ মূল্য ছিল। কিন্তু খলীফাদের এমন অধিকার ছিল না। আমার শিক্ষক বললেন,আমি বলছি না যে,খলীফারা জোরপূর্বক মুসলমানদের কাছ থেকে ফাদাককে গ্রহণ করে হযরত ফাতিমাকে দিবেন। বরং আমি বলতে চাচ্ছি কেন খলীফা এ বিষয়ে সাধারণ মুসলমানদের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে তা প্রদানের ব্যবস্থা করলেন না। কেন তিনি মহানবীর ন্যায় মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন না, হে লোকসকল! ফাতিমা রাসূলের সন্তান,তিনি চান রাসূলের সময়ের ন্যায় এখনও ফাদাক তাঁর অধিকারে থাকুক। তোমরা কি রাজী আছ সন্তুষ্ট চিত্তে এ সম্পদটি রাসূলের কন্যাকে সমর্পণ করতে?

ইবনে আবিল হাদীদ সব শেষে উল্লেখ করেছেন,আমার শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে আমার বলার কিছু ছিল না। তাই তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করে বললাম,আবুল হাসান আবদুল জব্বার খলীফাদের কাজের সমালোচনা করে বলেন,যদিও তাঁদের গৃহীত কর্মপন্থা শরীয়তসম্মত ছিল,তদুপরি এতে হযরত ফাতিমার সম্মান রক্ষিত হয় নি।

ত্রিশতম অধ্যায় : ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া

হযরত ফাতিমার বিবাহ ৫৯২

নারী-পুরুষের যৌনপ্রবণতা ও চাহিদা বিশেষ এক বয়ঃসন্ধিক্ষণে বিকশিত ও প্রকাশিত হয়। সঠিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ না থাকার জন্য এবং যৌনাকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা পূরণ করার উপায়-উপকরণ বিদ্যমান ও হাতের নাগালে না থাকার দরুন যুবক-যুবতী রসাতলে নিমজ্জিত হবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় এবং তখন যা ঘটা অনুচিত তা-ই ঘটে যায়।

সর্বজনীন চারিত্রিক শালীনতা ও পবিত্রতা বজায় রাখার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বিবাহ। ইসলাম ধর্মও সহজাত মানব-প্রকৃতির বিধান অনুসারে বিশেষ শর্ত ও অবস্থাধীনে নারী-পুরুষকে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদেরকে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল বলে বিবেচনা করে। তাই এতদ্প্রসঙ্গে ইসলামী শরীয়ত বিভিন্ন শিরোনামে বেশ কিছু বক্তব্যও রেখেছে যেগুলোর কয়েকটি নিচে বর্ণনা করা হলো :

পুরুষ ও নারিগণ পরস্পর বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হবে এবং দারিদ্র্য ও কপর্দকহীনতার ভীতি যেন তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত না রাখে। মহান আল্লাহ্ তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। (সূরা নূর : ২৩)

মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কামনা করে যে,সে বিশুদ্ধ ও পবিত্র চিত্তে মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ করবে সে যেন বিবাহ করে। ৫৯৩

তিনি আরো বলেছেন, আমি কিয়ামত দিবসে আমার উম্মতের সংখ্যাধিক্যের দ্বারা অন্যান্য জাতির ওপর গৌরববোধ করব।

বর্তমান যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যাসমূহ

আমাদের যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে সমস্যা একটি দু টি নয়। আজ নারী ও পুরুষ প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারছে না। দেশের সংবাদপত্রসমূহ পারিবারিক বিষয়ে অজস্র সমস্যার কথা উল্লেখ করছে। তবে অধিকাংশ সমস্যা এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে যে,আমাদের সমাজের যুবক-যুবতীরা- যে ধরনের পরিবার ও দাম্পত্য জীবন তাদের প্রকৃত সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধানকারী- তাতে মোটেও আগ্রহী নয়। কোন কোন ব্যক্তি বিবাহের মাধ্যমে মূল্যবান ও অতি সংবেদনশীল সামাজিক মর্যাদা ও পদ অধিকার করতে এবং এ পথে প্রচুর টাকা-পয়সা ও সম্পদ অর্জন করতে চায়। আজ যে জিনিসটির প্রতি সবচেয়ে কম মনোযোগ দেয়া হয় তা হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা ও শালীনতা। আর যদি তা কখনো কখনো বিবেচনা করা হয় তাহলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিহার্য বিষয় বলে গণ্য করা হয় না। এর প্রমাণস্বরূপ,যে সব পাত্রীর পারিবারিক সুখ্যাতি রয়েছে তাদেরকে বিয়ে করার জন্যই সমস্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিয়োজিত করা হয়,অথচ এ সব পাত্রী চরিত্র ও নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ততটা প্রশংসাযোগ্য নয়। কিন্তু সমাজে অনেক গুণবতী ও সচ্চরিত্রের অধিকারী পাত্রী হাড়ভাঙ্গা দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যে জীবনযাপন করছে অথচ তাদের প্রতি খুব একটা মনোযোগ দেয়া হয় না।

এ সব কিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে বিয়ের আক্দ অনুষ্ঠান এবং এতদ্সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠনিকতা ও সামাজিক প্রথাসমূহ যেগুলো বর এবং কনের পিতা-মাতাকে ক্লান্ত করে ফেলে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে মোটা অংকের মোহরানা যা দিনের পর দিন ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে,একদল ব্যক্তি বৈবাহিক বন্ধনকে অগ্রাহ্য করে ও দূরে ঠেলে দিয়ে উচ্ছৃঙ্খলতা ও লাগামহীনতার বানে ভেসে গিয়ে নিজেদের যৌনক্ষুধা নিবারণ করছে।৫৯৪

এ সব সমস্যার বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সংগ্রাম

এগুলো হচ্ছে এমন সব সামাজিক সমস্যা যা প্রতিটি সমাজেই কিছু না কিছু বিদ্যমান আছে। মহানবী (সা.)-এর জীবনকালকে এ সব সমস্যা থেকে আলাদা করা যাবে না। আরবের সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা তাদের কন্যাসন্তানদেরকে এমন সব পাত্রের সাথে বিবাহ দিত যারা গোত্র,শক্তি ও ধন-সম্পদের দিক থেকে তাদেরই সমকক্ষ হতো। এর অন্যথা হলে বিয়ের প্রস্তাব দানকারীদেরকে প্রত্যাখ্যান করত।

প্রাচীন এ অভ্যাস ও প্রথার বশবর্তী হয়েই আরবের সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও গোত্রীয় নেতা ও সর্দারগণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কে বিবাহ করার ব্যাপারে খুব চাপ প্রয়োগ ও জোরাজুরি করেছিল। কারণ তারা মনে করেছিল যে,মহানবী (সা.) এ কাজে কড়াকড়ি করবেন না। তারা ভেবেছিল যে,কনে ও কনের পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপায়-উপকরণ (সম্পদ ও সম্পত্তি) রয়েছে। তাছাড়া মহানবী (সা.) তাঁর অন্যান্য মেয়ে,যেমন রুকাইয়া ও যয়নাবের বিয়ের ব্যাপার তেমন একটা কড়াকড়ি করেন নি।

কিন্তু তারা সকলেই একটি ব্যাপারে উদাসীন ছিল এবং ভেবেও দেখে নি যে,মহানবী (সা.)-এর এই মেয়ে তাঁর অন্য মেয়েদের থেকে স্বতন্ত্র। ফাতিমা এমন এক মেয়ে,আয়াতে মুবাহালা৫৯৫ অবতীর্ণ হওয়ার কারণে যিনি অতি সুউচ্চ আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারিণী।৫৯৬ বিবাহের প্রস্তাবকারিগণ এ ক্ষেত্রে ভুলই করেছিল। তারা জানত না যে,প্রস্তাবিত ব্যক্তিকে (কুফু) মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী,তাকওয়া-পরহেজগারী,ঈমান ও ইখলাসের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই হযরত ফাতিমার সমকক্ষ হতে হবে। যদি হযরত ফাতিমা (আ.) (পবিত্র কোরানের সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত) আয়াতে তাতহীরের কারণে নিষ্পাপ (মাসুমাহ্) হন তাহলে তাঁর স্বামীও তাঁরই মতো নিষ্পাপ হবেন।

ধন-সম্পদ,অর্থকড়ি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা সমকক্ষ ও মর্যাদাবান হওয়ার মাপকাঠি নয়। যদিও ইসলাম বলে থাকে যে,তোমরা তোমাদের মেয়েদেরকে তাদের সমকক্ষ ও সমান মর্যাদাসম্পন্ন পাত্রদের কাছে বিয়ে দেবে,আসলে ইসলাম এই সমমর্যাদা ও সমকক্ষ হওয়াকে পাত্র-পাত্রী উভয়ের মুমিন ও মুসলিম হওয়ার ভিত্তিতেই ব্যাখ্যা করেছে।

মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাবকারীদের এ উত্তর দিতে আদিষ্ট হয়েছিলেন যে,হযরত ফাতিমার বিবাহ অবশ্যই মহান আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন হবে। আর তিনি এ উত্তর দানের মাধ্যমে প্রকৃত বাস্তবতা সকলের সামনে বেশ কিছুটা উন্মোচন করেছিলেন। এর ফলে মহানবী (সা.)-এর সাহাবিগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে,হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কোন ব্যক্তি বৈষয়িকভাবে যত বড় ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন সে (এ কারণে) হযরত ফাতিমাকে বিবাহ করতে পারে না। হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন- সততা,সত্যবাদিতা,নিষ্ঠা,পবিত্রতা,ঈমান,আধ্যাত্মিকতা ও চারিত্রিক গুণাবলীর মাপকাঠিতে অবশ্যই মহানবী (সা.)-এর পরই হবে যাঁর অবস্থান। আর এ সব বৈশিষ্ট্য একমাত্র হযরত আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব ব্যতীত আর কোন ব্যক্তির মধ্যে সন্নিবেশিত হয় নি। তারা পরীক্ষা করার জন্য হযরত আলীকে মহানবীর কন্যা ফাতিমাকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দেবার জন্য উৎসাহিত করতে লাগল।৫৯৭ হযরত আলীও আন্তরিকভাবে এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। কেবল তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নিজেই মহানবী (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন এমন অবস্থায় যে,তাঁর পুরো অস্তিত্ব লজ্জায় ভরে গিয়েছিল। তিনি মাথা নিচু করে ছিলেন আর যেন তিনি কিছু বলতে চাচ্ছিলেন,কিন্তু  লজ্জা তাঁর বাকশক্তি যেন রহিত করে দিয়েছিল। মহানবী (সা.) তাঁকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তিনি কিছু কথা বলার মাধ্যমে তাঁর মনস্কামনা ও আসল উদ্দেশ্য বুঝাতে সক্ষম হলেন। এ ধরনের বিয়ের প্রস্তাব আসলে ইখলাস,সততা ও আন্তরিকতার পরিচায়ক। বিশ্বে বিদ্যমান যাবতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান আজও বিয়ের প্রস্তাবকারী যুবকদেরকে এ ধরনের তাকওয়া,বিশ্বাস ও নিষ্ঠাপূর্ণ স্বাধীনচেতা মনোভাবের শিক্ষা দিতে পারে নি।

মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-এর প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর যাতে করে আমি ফাতিমার কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করতে পারি। যখন তিনি ফাতিমা (আ.)-এর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলেন তখন মৌনতা ফাতিমা (আ.)-এর পুরো অস্তিত্বকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তখন মহানবী (সা.) উঠে বললেন, আল্লাহু আকবর (আল্লাহ্ মহান),ফাতিমার মৌনতাই তার সম্মতি। ৫৯৮

তখন হযরত আলী (আ.)-এর সহায়-সম্বল বলতে একটি তরবারি ও বর্ম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হযরত আলী (আ.) বিয়ের প্রাথমিক প্রস্তুতি ও প্রাথমিক ব্যয় যোগাড় করার জন্য আদিষ্ট হলেন। তিনি বর্ম বিক্রি করে এর সমুদয় অর্থ নিয়ে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন। মহানবী (সা.) গণনা না করেই ঐ অর্থের একটি অংশ বিলালকে দিলেন যাতে করে তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর জন্য কিছু সুগন্ধি দ্রব্য কেনেন। আর অবশিষ্টাংশ হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের হাতে দিলেন যাতে মদীনার বাজার থেকে বর ও কনের জন্য তাঁরা প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী জিনিসপত্র ক্রয় করেন। তাঁরা মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে বাজারে গিয়ে নিম্নোক্ত সামগ্রীগুলো ক্রয় করলেন,আসলে যেগুলো ছিল হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহের উপহারস্বরূপ এবং তাঁরা সেগুলো মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসলেন।

হযরত ফাতিমার বিবাহের উপহার সামগ্রীর বিবরণ

 ১. একটি কামিজ যা সাত দিরহামে ক্রয় করা  হয়েছিল।

 ২. স্কার্ফ যার মূল্য ছিল এক দিরহাম।

 ৩. কালো রংয়ের বড় তোয়ালে যা সমগ্র দেহ ঢাকার জন্য যথেষ্ট ছিল না।

 ৪. একটি আরবীয় চেয়ার যা ছিল খেজুর গাছের কাঠ ও আঁশ দিয়ে তৈরি।

 ৫. মিশরীয় কাতাননির্মিত দু টি তোষক যার একটি ছিল পশমী,অপরটি ছিল আঁশ দিয়ে তৈরি।

 ৬. চারটি বালিশ যেগুলোর দু টি পশম এবং অন্য দু টি খেজুরের আঁশ দ্বারা তৈরি ছিল।

 ৭. পর্দা।

 ৮. মাদুর।

 ৯. যাঁতা।

১০. চামড়ার তৈরি মশক।

১১. দুধ পান করার জন্য একটি কাঠের পেয়ালা।

১২. পানি রাখার জন্য চামড়ার তৈরি একটি পাত্র।

১৩. সবুজ রঙের একটি ঝুঁড়ি।

১৪. কয়েকটি মৃৎপাত্র।

১৫. দু টি রৌপ্যনির্মিত বাজুবন্দ।

১৬. একটি তাম্রনির্মিত পাত্র।

যখন মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি এ সব জিনিসের ওপর পড়ল তখন তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহ্! ঐ সব সম্প্রদায় যাদের অধিকাংশ পাত্রই হচ্ছে সিরামিক বা চীনা মাটির তৈরি তাদের চেয়েও এদের সাংসারিক জীবনকে আশীর্বাদপুষ্ট করে দিন। ৫৯৯

হযরত ফাতিমার মোহরানাও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় ও সূক্ষ্ম বিবেচনাযোগ্য। তাঁর মোহরানাকে মাহরুস্ সুন্নাহ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাহ্সম্মত মোহরানাও বলা হয়। এর পরিমাণ ৫০০ দিরহাম।৬০০

বিবাহ অনুষ্ঠান

বর ও কনের পক্ষ থেকে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর সম্মানিতা নবপরিণীতা স্ত্রীর সম্মানে একটি ওয়ালীমাহ্ অর্থাৎ বিবাহ উপলক্ষে ভোজ সভার আয়োজন করেন। খাওয়া-দাওয়ার পর মহানবী (সা.) হযরত ফাতিমা (আ.)-কে নিজের কাছে ডাকলেন। হযরত ফাতিমার সমগ্র অস্তিত্ব তখন লজ্জায় ভরে গিয়েছিল। ঐ অবস্থায় অত্যন্ত লাজুকতার সাথে মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছলেন। তাঁর পবিত্র কপাল থেকে লাজুকতামিশ্রিত ঘাম ঝরছিল। যখন তাঁর দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর ওপর স্থির হলো তখন তাঁর পা পিছলে গেলে তাঁর প্রায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মহানবী (সা.) ঐ মুহূর্তে হযরত ফাতিমার হাত ধরে তাঁর জন্য মহান আল্লাহ্পাকের কাছে প্রার্থনা করলেন, মহান আল্লাহ্ তোমাকে সব ধরনের স্খলন থেকে রক্ষা করুন। ৬০১ তখন তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর মুখমণ্ডল অনাবৃত করলেন এবং কনের হাত বরের হাতের ওপর রেখে বললেন, হে আলী! মহান আল্লাহ্ তোমার জন্য রাসূলুল্লাহর কন্যাকে বরকতময় করে দিন। ফাতিমা অতি উত্তম স্ত্রী। এরপর তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আলী অতি উত্তম স্বামী।

আরেক কথায় মহানবী (সা.) ঐ রাতে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। এত প্রগতি ও পূর্ণতাসত্ত্বেও আমাদের বর্তমান সমাজে এ ধরনের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার অস্তিত্ব নেই। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর হাত ধরে তা হযরত আলী (আ.)-এর হাতে রেখে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে হযরত আলী (আ.)-এর গুণাবলী বর্ণনা করলেন। এরপর তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর সুমহান ব্যক্তিত্ব এবং এ কথা যে, হযরত আলী (আ.) যদি সৃষ্টি না হতেন তাহলে ফাতিমা (আ.)-এর সমমর্যাদাসম্পন্ন স্বামীই পাওয়া যেত না স্মরণ ও ব্যক্ত করলেন। পরে তিনি ঘরের কাজকর্ম ও দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ ভাগ করে দিলেন। তিনি ঘরের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম হযরত ফাতিমা (আ.)-এর ওপর এবং ঘরের বাইরের দায়িত্ব ও কর্তব্য হযরত আলী (আ.)-এর ওপর অর্পণ করলেন।

এরপর কতিপয় ঐতিহাসিকের অভিমত অনুযায়ী মহানবী (সা.) মুহাজির ও আনসার রমণীদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তাঁরা হযরত ফাতিমার উষ্ট্রীর চারপাশে জড়ো হয়ে তাঁকে স্বামীর গৃহে পৌঁছে দেন। এভাবে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীর বিবাহ অনুষ্ঠান ও শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হলো।

কখনো কখনো বলা হয় যে,হযরত সালমানের মতো অত্যন্ত মর্যাদাবান ব্যক্তিকে মহানবী (সা.) হযরত ফাতিমা (আ.)-এর উটের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে মহানবী (সা.) তাঁর মেয়ের সুমহান মর্যাদা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। সবচেয়ে মুধুর আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল ঐ মুহূর্ত যখন বর ও কনে বাসর ঘরে প্রবেশ করলেন,অথচ তখন তাঁরা উভয়েই লজ্জাবশত জমিনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মহানবী (সা.) সেখানে প্রবেশ করলেন এবং একটি পানির পাত্র হাতে নিয়ে শুভ লক্ষণ হিসাবে তা থেকে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর মাথায় এবং তাঁর দেহের চারপাশে ছিটালেন। কারণ এ পানিই জীবনের ভিত্তি। এরপর তিনি বর-কনের জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বললেন,

اللهمّ هذه ابنتي و أحبّ الخلق إليّ و هذا أخي و أحبّ الخلق إليّ اللهمّ اجعله وليّا و...

হে আল্লাহ্! এ আমার কন্যা এবং আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর হে আল্লাহ্! এ আমার ভ্রাতা এবং আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়! হে আল্লাহ্ এ দু জনের ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় ও মজবুত করে দিন।... ৬০২

আমরা এখানে মহানবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা ( আ.)-এর সুমহান মর্যাদার হক আদায় করার জন্য নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করব :

আনাস ইবনে মালেক৬০৩ বর্ণনা করেছেন : মহানবী (সা.) পুরো ছয় মাস ফজরের নামাযের সময় ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা হতেন এবং নিয়মিত তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন:

الصّلاة يا أهل البيت،) إنّما يُريد الله ليُذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يُطهّركم تطهيرا (

হে আমার আহলে বাইত! নামায (নামাযের কথা সর্বদা স্মরণ রেখ)। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ চান তোমাদের থেকে- হে আমার আহলে বাইত! সকল পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।

ফিজারের যুদ্ধসমূহ

এ ধরনের ঘটনাসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করা আমাদের আলোচনার গণ্ডির বাইরে। শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ যাতে করে এ সব যুদ্ধের সাথে অপরিচিত না থাকেন তাই এ সব যুদ্ধের কারণ ও পদ্ধতির ওপর সামান্য আলোকপাত করব। এখানে উল্লেখ্য যে,কেবল একদল ঐতিহাসিকের মতে ফিজারের যুদ্ধগুলোর কোন একটিতে মহানবী (সা.) যোগদান করেছিলেন।

জাহেলিয়াতের যুগে আরবরা পুরো বছরই যুদ্ধ ও লুটপাট করে কাটিয়ে দিত। আর এ ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকার জন্য আরবদের জাতীয় জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত ও কার্যত অচল হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই সমগ্র বছরের মধ্যে রজব,যিলক্বদ,যিলহজ্ব ও মুহররম-এ চার মাস আরবদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ রাখা হতো। যার ফলে তারা বাজার বসিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে এবং আপন পেশায় নিয়োজিত থাকতে সক্ষম হতো।166

এর ওপর ভিত্তি করেই এ দীর্ঘ চার মাসে উকায,মাজনাহ্ এবং যিল মাজাযের বাজারগুলোতে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হতো। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলেই একে অপরের পাশে বসে লেন-দেন করতো। একে অপরের বিপরীতে গর্ব ও অহংকারও প্রকাশ করা হতো। আরবের নামীদামী কণ্ঠশিল্পী ও কবি তাদের স্বরচিত কবিতা,গান ও কাসীদাহ্ ঐ সব মাহফিলে পরিবেশন করত। প্রসিদ্ধ বক্তাগণ ঐসব স্থানে বক্তৃতা করত। শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হয়েই ইয়াহুদী,খ্রিষ্টান এবং মূর্তিপূজকগণ এ সব স্থানে আরব বিশ্বের জনগণের কাছে নিজ নিজ আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মমত প্রচার করত।

কিন্তু আরব জাতির ইতিহাসে এ নিষিদ্ধ মাস চতুষ্টয়ের সম্মান চার বার লঙ্ঘিত হয়েছিল। এর ফলে কতিপয় আরব গোত্র পরস্পরের ওপর আক্রমণ করেছিল। যেহেতু এ সব যুদ্ধ নিষিদ্ধ (হারাম) মাসগুলোতে সংঘটিত হয়েছিল তাই এ সব যুদ্ধের নামকরণ করা হয়েছিল ফিজারের যুদ্ধ’। এখন আমরা সংক্ষেপে এ যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করব।

ফিজারের প্রথম যুদ্ধ

এ যুদ্ধে বিবদমান পক্ষদ্বয় ছিল কিনানাহ্ ও হাওয়াযিন গোত্র। এ যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে বদর বিন মাশা র নামক এক ব্যক্তি উকাযের বাজারে নিজের জন্য একটি স্থান তৈরি করে সেখানে প্রতিদিন জনগণের সামনে নিজের গৌরব জাহির করত। একদিন হাতে তলোয়ার নিয়ে বলল, হে লোকসকল! আমি সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। যে আমার কথা শুনবে না সে অবশ্যই এ তরবারি দ্বারা নিহত হবে।” ঐ সময় এক ব্যক্তি তার পায়ে তরবারি দিয়ে আঘাত করে তার পা কেটে ফেলে। এ কারণেই দু টি গোত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়,তবে কেউ নিহত হওয়া ব্যতিরেকেই তারা সংঘর্ষ করা থেকে বিরত হয়।

ফিজারের দ্বিতীয় যুদ্ধ

এ যুদ্ধের কারণ ছিল এই যে,বনি আ মের গোত্রের একজন সুন্দরী মহিলা এক যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে-মহিলাদের প্রতি দৃষ্টি দেয়াই ছিল যার অভ্যাস। যুবকটি তার মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করার জন্য অনুরোধ করলে ঐ রমণী তা প্রত্যাখ্যান করে। প্রবৃত্তির পূজারী যুবকটি রমণীর পেছনে বসে তার লম্বা গাউনের প্রান্তগুলো গাছের কাটা দিয়ে এমনভাবে পরস্পর গেঁথে দিয়েছিল যে,বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ানোর সময় ঐ রমণীর মুখমণ্ডল অনাবৃত হয়ে যায়। এ সময় ঐ রমণী ও যুবক তাদের নিজ নিজ গোত্রকে আহবান করলে সংঘর্ষ বেঁধে যায় এবং কিছুসংখ্যক লোকের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে অবশেষে সংঘর্ষের অবসান ঘটে।

ফিজারের তৃতীয় যুদ্ধ

কিনান গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে বনি আ মের গোত্রের এক ব্যক্তির কিছু পাওনা ছিল। ঐ ঋণগ্রস্ত লোকটি আজ দেব,কাল দেব বলে পাওনাদার লোকটিকে ঘুরাচ্ছিল। এতে এ দু ব্যক্তির মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যক্তিদ্বয়ের নিজ নিজ গোত্রও পরস্পরকে হত্যা করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু শান্তির ব্যাপারে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে উভয় গোত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে।

ফিজারের চতুর্থ যুদ্ধ

এ যুদ্ধে মহানবী (সা.) অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তাঁর বয়স কত ছিল সে সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন,তখন মহানবীর বয়স ছিল 14 অথবা 15 বছর। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন,তখন তাঁর বয়স ছিল 20 বছর। যেহেতু এ যুদ্ধ 4 বছর স্থায়ী হয়েছিল তাই এতৎসংক্রান্ত বিদ্যমান সকল বর্ণনা বিশুদ্ধ হতে পারে।167

এ যুদ্ধের মূল কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,নূমান বিন মুনযির প্রতি বছর একটি বাণিজ্যিক কাফেলা প্রস্তুত করে ব্যবসায়িক পণ্য-সামগ্রী ঐ কাফেলার সাথে উকাযের মেলায় পাঠাত। ঐ সব পণ্যের বিনিময়ে চামড়া,দড়ি এবং স্বর্ণের কারুকাজ করা কাপড় ক্রয় করে আনার নির্দেশ দিত। উরওয়াতুর রিজাল নামক হাওয়াযিন গোত্রের এক ব্যক্তিকে কাফেলার রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বারাদ বিন কাইস (কিনান গোত্রের) হাওয়াযিন ব্যক্তিটির উন্নতির কারণে অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ল। সে নূমান বিন মুনযিরের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানাল,কিন্তু তার প্রতিবাদে কোন ফল হলো না। তার ভেতরে ক্রোধ ও হিংসার অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। সে সর্বদা উরওয়াতুর রিজালকে পথিমধ্যে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছিল। অবশেষে বনি মুররা গোত্রের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সে তাকে হত্যা করে। আর এভাবে হাওয়াযিন লোকটির রক্তে তার হাত রঞ্জিত হয়।

ঐ দিনগুলোতে কুরাইশ ও কিনানাহ্ গোত্র পরস্পর মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। আর এ ঘটনাটি ঐ সময় সংঘটিত হয় যখন আরব গোত্রগুলো উকাযের বাজারগুলোতে কেনা-বেচা ও লেন-দেনে ব্যস্ত ছিল। এক লোক কুরাইশ গোত্রকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে। হাওয়াযিন গোত্র ঘটনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার আগেই কুরাইশ ও কিনানাহ্ গোত্র নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে হারাম শরীফে আশ্রয় নেয়। কিন্তু হাওয়াযিন গোত্র তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পিছু নেয় ও ধাওয়া করে। হারাম শরীফে পৌঁছানোর আগেই এ দু দলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অবশেষে আবহাওয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলে যুদ্ধরত গোত্রগুলো যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। আর এটি ছিল আঁধারের মধ্যে হারাম শরীফের দিকে অগ্রসর এবং কুরাইশ ও কিনানাহ্ গোত্রের জন্য শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। ঐ দিন থেকে কুরাইশ ও তাদের মিত্ররা মাঝে-মধ্যে হারাম শরীফ থেকে বের হয়ে এসে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। চাচাদের সাথে মহানবীও কিছু দিন যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এ অবস্থা চার বছর স্থায়ী হয়েছিল। অবশেষে যুদ্ধে হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে থেকে যারা নিহত হয়েছিল তাদের রক্তপণ পরিশোধ করার মাধ্যমে ফিজারের চতুর্থ যুদ্ধের যবনিকাপাত হয়। উল্লেখ্য যে,এ যুদ্ধে কুরাইশদের চেয়ে হাওয়াযিন গোত্রের নিহতদের সংখ্যা বেশি ছিল।

হিলফুল ফুযূল (প্রতিজ্ঞা-সংঘ)

অতীতকালে হিলফুল ফুযূল’নামে একটি প্রতিজ্ঞা ও চুক্তি জুরহুম গোত্রের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এ প্রতিজ্ঞার মূল ভিত্তি ছিল অত্যাচারিত ও পতিতদের অধিকার সংরক্ষণ। এ চুক্তির স্থপতি ছিলেন ঐ সব ব্যক্তি যাদের প্রত্যেকের নাম ছিল ফযল ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী হিলফুল ফুযূলের প্রতিষ্ঠাতাদের নাম ছিল ফযল বিন ফাযালাহ্ (فضل بن فضالة ),ফযল বিন আল হারেস (فضل بن الحارث ) এবং ফযল বিন ওয়াদাআহ্

(فضل بن وداعة )।168

যেহেতু কয়েকজন কুরাইশ যে চুক্তি নিজেদের মধ্যে সম্পাদন করেছিলেন,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে তা হিলফুল ফুযূলের অনুরূপ ছিল সেহেতু এ ঐক্য ও চুক্তির নামও হিলফুল ফুযূল’দেয়া হয়েছিল।

মহানবীর নবুওয়াত ঘোষণার 20 বছর পূর্বে যিলক্বদ মাসে এক ব্যক্তি পবিত্র মক্কা নগরীতে বাণিজ্যিক পণ্যসহ প্রবেশ করে। ঘটনাক্রমে আ স ইবনে ওয়ায়েল তা ক্রয় করে। কিন্তু যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সে ঐ লোকটিকে তা পরিশোধ না করলে তাদের মধ্যে তীব্র ঝগড়া বেঁধে যায়। যে সব কুরাইশ বংশীয় ব্যক্তি পবিত্র কাবার পাশে বসা ছিল তাদের প্রতি (হতভাগ্য) পণ্য বিক্রেতার দৃষ্টি পড়ল এবং তার আহাজারি ও ক্রন্দনধ্বনিও তীব্র ও উচ্চ হলো। সে কিছু কবিতা আবৃত্তি করল যা ঐ সব লোকের অন্তঃকরণে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিল যাদের ধমণীতে পৌরুষ ও শৌর্য-বীর্যের রক্ত প্রবাহমান ছিল। ইত্যবসরে যুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর সাথে আরো কতিপয় ব্যক্তিও আবদুল্লাহ্ ইবনে জাদআনের গৃহে একত্রিত হলেন। তাঁরা পরস্পর প্রতিজ্ঞা করলেন এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যতদূর সম্ভব অত্যাচারীর কাছ থেকে অত্যাচারিতের অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে শপথ করলেন। প্রতিজ্ঞা ও চুক্তি সম্পন্ন হলে তাঁরা আস ইবনে ওয়ায়েলের কাছে আসলেন এবং সে যে পণ্য কিনে মূল্য পরিশোধ করে নি তা তার থেকে নিয়ে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।

আরবের কবি-সাহিত্যিক ও গীতিকারগণ এ চুক্তির প্রশংসায় বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেছেন।169

মহানবী (সা.) উক্ত হিলফুল ফুযূলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কারণ তা মজলুমের জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করত। মহানবী এ চুক্তি ও প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে বেশ কিছু কথা বলেছেন যেগুলোর মধ্য থেকে এখানে কেবল দু টি বাণীর উদ্ধৃতি দেব :

لقد شهدت في دار عبد الله بن جدعان حلفا لو دعيت به في الأسلام لأجبت

“আবদুল্লাহ্ ইবনে জাদআনের ঘরে এমন একটি প্রতিজ্ঞা সম্পাদিত হবার বিষয় প্রত্যক্ষ করেছিলাম যদি এখনও (নবুওয়াত ঘোষণার পরেও) আমাকে উক্ত প্রতিজ্ঞার দিকে আহবান জানানো হয় তাহলেও আমি এতে সাড়া দেব।”

ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন : মহানবী (সা.) হিলফুল ফুযূল চুক্তির ব্যাপারে পরবর্তীকালে বলেছেন,

ما أحب أن لي به حمر النعم

“লাল পশম বিশিষ্ট উটের বদলেও এ চুক্তি ভঙ্গ করতে আমি মোটেও প্রস্তুত নই।”

হিলফুল ফুযূল এতটা দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত ছিল যে,ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এ চুক্তির অন্তর্নিহিত মূল বিষয় মেনে চলার ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব আছে বলে বিশ্বাস করত। মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে নিযুক্ত ওয়ালীদ ইবনে উতবাহ্ ইবনে আবু সুফিয়ানের পবিত্র মদীনা নগরীর প্রশাসক থাকাকালীন যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা এ বিষয়ের উৎকৃষ্ট দলিল। শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.) জীবনে কখনই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি। একবার একটি সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে মদীনার তৎকালীন শাসনকর্তার সাথে তাঁর মতপার্থক্য হয়েছিল। ইমাম হুসাইন অত্যাচার ও অন্যায়ের ভিত্তি ধ্বংস করা এবং জনগণকে ন্যায্য অধিকার আদায় করার প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত করানোর জন্য ঐ জালেম শাসনকর্তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, মহান আল্লাহর শপথ,যদি তুমি আমার ওপর অন্যায় ও জোরজবরদস্তি কর তাহলে আমি আমার তরবারি কোষমুক্ত করে মহানবী (সা.)-এর মসজিদে দাঁড়িয়ে ঐ চুক্তি ও প্রতিজ্ঞার দিকে সবাইকে আহবান করব যা তাদের পূর্ব পুরুষগণই সম্পাদন করেছিলেন।” তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইর দণ্ডায়মান হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন এবং আরো বললেন, আমরা সবাই রুখে দাঁড়াব এবং তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায় করব অথবা এ পথে আমরা সবাই নিহত হব।” ইমাম হুসাইন (আ.)-এর এ উদাত্ত আহবান ধীরে ধীরে আল মিসওয়ার ইবনে মিখরামাহ্ ও আবদুর রহমান ইবনে উসমানের মতো সকল আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির কর্ণগোচর হলে সবাই ইমাম হুসাইনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে গেলেন। ফলে ঐ অত্যাচারী শাসনকর্তা উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে যায় এবং ইমামের ওপর অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকে।170

 


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61