চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড4%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 106928 / ডাউনলোড: 9721
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

একত্রিশতম অধ্যায় : বনী কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীদের অপরাধসমূহ

বদর যুদ্ধ ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর ও আতংক সৃষ্টিকারী তুফান যা সমগ্র আরব উপদ্বীপের বুকে বইতে লাগল। এটি ছিল এমন এক উত্তাল ঝাঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ ঝড় যা শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রাচীন মূলগুলোর একটি অংশ উপড়ে ফেলেছিল। কুরাইশদের একদল বীরপুরুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল এবং একদল বন্দী হয়েছিল এবং আরেকদল পূর্ণ হীনতা-দীনতা সহকারে ও সম্পূর্ণ অক্ষম ও নিরুপায় হয়ে পলায়ন করেছিল। কুরাইশ বাহিনীর পরাজিত হবার খবর সমগ্র আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এ ঝড়ের পর ভয়-ভীতি ও মানসিক অস্থিরতা মিশ্রিত এক ধরনের থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই থমথমে অবস্থার কারণ ছিল আরব উপদ্বীপের সার্বিক ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি।

আরব উপদ্বীপের মুশরিক গোত্রগুলো এবং মদীনা,খায়বর ও ওয়াদীউল কুরার ধনাঢ্য ইয়াহুদিগণ সবাই (মদীনার) সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রশাসন ও সরকারের শক্তি ও ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং নিজেদের অস্তিত্বকেই হুমকি ও ধ্বংসের মুখোমুখি দেখতে পেয়েছিল। কারণ তারা কখনই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে,মহানবী (সা.)-এর অবস্থা এতটা শক্তিশালী ও উন্নত হবে এবং কুরাইশদের প্রাচীন ও পুরানো শক্তি ও ক্ষমতাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে।

বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা যারা মদীনা নগরীর ভিতরে বসবাস করত এবং মদীনার অর্থনীতি যাদের হাতের মুঠোয় ছিল তারা অন্য সবার চেয়ে বেশি ভয় ও শঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের জীবন মুসলমানদের সাথে সম্পূর্ণ মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর মদীনার বাইরে খায়বর ও ওয়াদিউল কুরায় বসবাসকারী ইয়াহুদীরা যেহেতু মুসলমানদের ক্ষমতা ও প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিল সেহেতু তাদের অবস্থা ছিল এদের চাইতে ভিন্ন ধরনের। এ কারণেই বনি কাইনুকার ইয়াহুদীরা আঘাতকারী ঘৃণ্য স্লোগান ও চরম অবমাননাকর কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক ঠাণ্ডাযুদ্ধ শুরু করে দেয় এবং তারা মহানবী (সা.)-এর সাথে যে সন্ধি চুক্তি করেছিল কার্যত তা ভেঙে ফেলে। আমরা ইতোমধ্যে এ চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছি।

তবে এই ঠাণ্ডাযুদ্ধ এই অনুমতি দেয় না যে,এ সব ইয়াহুদীর জবাব মুসলমানরা যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে দেবে। কারণ যে গিঁট আঙ্গুল দিয়ে খোলা সম্ভব তা অবশ্যই দাঁত দিয়ে কামড়ে খোলা অনুচিত। আর তখন মদীনা নগরীর রাজনৈতিক ঐক্য ও সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা মহানবী (সা.)-এর জন্য অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী ছিল।

মহানবী (সা.) চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বনি কাইনুকা গোত্রের বাজারে যে বিরাট সমাবেশ ও জমায়েত হতো সেখানে ভাষণ দিলেন। এ সমাবেশের ভাষণে মহানবী (সা.)-এর ক্ষুরধার দিকটি ছিল বনি কাইনুকার ইয়াহুদীদের উদ্দেশে প্রদত্ত। তিনি তাঁর এ ভাষণে বলেছিলেন, কুরাইশদের কাহিনী তোমাদের জন্য শিক্ষাস্বরূপ। আমি ভয় পাচ্ছি যে,যে বিপদ কুরাইশদের ওপর আপতিত হয়েছে তা তোমাদের ওপরও আপতিত হবে। তোমাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন। তাদের কাছ থেকে তোমরা যাচাই করে দেখ তাহলে তারাও তোমাদেরকে যতটা পূর্ণতার সাথে সম্ভব ততটা স্পষ্ট করে বলতে পারবেন যে,আমি মহান আল্লাহর নবী। আর এ বিষয়টি তোমাদের আসমানী গ্রন্থেও বিদ্যমান।

চরম একগুঁয়ে ও দাম্ভিক ইয়াহুদীরা মহানবী (সা.)-এর ভাষণের ব্যাপারে নীরব থাকে নি,বরং তারা ধারালো কণ্ঠে মহানবীর পাল্টা জবাব দানের জন্য দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, আপনি ভেবেছেন যে,আমরা দুর্বল ও অক্ষম এবং কুরাইশদের মতো যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ? আপনি এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন যারা সামরিক কলাকৌশল ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ। আর কাইনুকা গোত্রের বীর সন্তানদের শক্তি ও ক্ষমতা ঠিক তখনই আপনার সামনে উন্মোচিত হবে যখন আপনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। ৬০৪

বনী কাইনুকার ইয়াহুদীদের চরম বেয়াদবীপূর্ণ কড়া বক্তব্য এবং তাদের নরম তুলতুলে বীরদের রণসংগীত ও বীরত্বগাথা মুসলমানদের মন-মানসিকতায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না। তবে ইসলামের রাজনৈতিক মূলনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং এতদভিন্ন আরেক পথে জট (ইয়াহুদীদের ঠাণ্ডা যুদ্ধের জট) খোলা অত্যাবশ্যক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। এর অন্যথা হলে দিন দিন ইয়াহুদীদের স্পর্ধা,সীমা লঙ্ঘন ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। এ কারণেই মহানবী (সা.) এমন এক উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন যাতে করে তিনি তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে সক্ষম হন ।

একটি স্ফুলিঙ্গ থেকে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত হওয়া

কখনো কখনো অনেক ক্ষুদ্র ঘটনা বিরাট সামাজিক ঘটনা ও পরিবর্তনের সূচনা করে। অর্থাৎ কোন একটি ক্ষুদ্র ঘটনা অনেক বড় বড় ঘটনার উদ্গাতা হিসাবে কাজ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যা মানব জাতির ইতিহাসের এক বৃহত্তম ঘটনা তা সংঘটিত হওয়ার কারণও ছিল একটি ক্ষুদ্র ঘটনা যা বৃহৎ শক্তিবর্গের হাতে যুদ্ধ বাধানোর অজুহাত ও সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। যে ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা ছিল অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফ্রীন্যান্ডের হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ড ২৮ জুন সংঘটিত হয়েছিল এবং এর একমাস ও কিছুদিন পরে ৩ আগস্ট বেলজিয়ামে জার্মানির আক্রমণের মধ্যদিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়। এ যুদ্ধে এক কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং দু কোটি লোক আহত হয়।

বনি কাইনুকার ইয়াহুদীদের ঔদ্ধত্য ও উগ্রতার কারণে মুসলমানরাও তীব্রভাবে অসন্তষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তাই তারা ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে অপরাধমূলক কোন কাজ সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা করছিল যা সংঘটিত হলে তারা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। হঠাৎ এক আরব মহিলা বনি কাইনুকার বাজারে এক ইয়াহুদী স্বর্ণকারের দোকানের পাশে নিজের সাথে আনা পণ্য বিক্রি করছিল। ঐ মহিলাটি সম্পূর্ণরূপে সতর্ক ছিল যেন কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। তবে কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা তার মুখের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলার জন্য জোর-জবরদস্তি করতে লাগল। ঐ আরব মহিলাটি পরপুরুষদের সামনে তার চেহারা অনাবৃত করতে চায় নি বলেই ঐ স্বর্ণকার দোকান থেকে বের হয়ে এসে ঐ মহিলার অজান্তে তার পোশাকের প্রান্ত তার পোশাকের পিঠের অংশের সাথে সেলাই করে দেয়। ঐ মহিলা যখন উঠে দাঁড়াল তখন তার দেহের কিছু অংশ অনাবৃত ও দৃশ্যমান হয়ে গেল এবং বনি কাইনুকার যুবকরা ঐ মহিলাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে লাগল। মান-মর্যাদা ও সম্ভ্রম প্রতিটি সমাজ ও সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে পরিগণিত। আরবদের মধ্যে এ বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে,আরবের মরুচারী বেদুইন গোত্রগুলো মান-সম্ভ্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করত। এ কারণেই একজন আগন্তুক মহিলার এহেন অবস্থা (বিশেষ করে ইয়াহুদীদের হাতে তার লাঞ্ছিত হওয়া) একজন মুসলমানের আত্মসম্মানবোধকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল। সে তৎক্ষণাৎ অস্ত্র দিয়ে ঐ ইয়াহুদী স্বর্ণকারকে হত্যা করে। ফলে বাজারের ইহুদীরাও একযোগে তাকে হত্যা করে।

আমাদের এতে কোন কাজ নেই যে,একজন মহিলার মান-সম্ভ্রমের ওপর হামলা করার অপরাধে ঐ ইয়াহুদী লোকটির রক্ত ঝরানো যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত ছিল কিনা। তবে কয়েকশ ইয়াহুদী কর্তৃক একযোগে আক্রমণ চালিয়ে একজন অসহায় নারীর মান-সম্ভ্রাম রক্ষাকারী একজন মুসলমানের রক্ত ঝরানো দারুণ অবমাননাকর ও অপমানজনক ছিল। এ কারণেই অত্যন্ত নিষ্ঠুর পন্থায় একজন মুসলমানের হত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলমানদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং সকল দুর্নীতি ও অপরাধের আখড়া  সমূলে ধ্বংস করে দেবার ব্যাপারে তাদেরকে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

বনি কাইনুকা গোত্রের রণ উদ্দীপনা উদ্রেককারী কবিতা আবৃত্তিকারী বীরেরা অনুভব করতে পারল যে,অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। তাই মদীনার বাজার ও রাস্তাঘাট থেকে কেনা-বেচা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করা আর তাদের ঠিক হবে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুউচ্চ ও মজবুত দুর্গগুলোর মধ্যে অবস্থিত নিজেদের ঘর-বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া এবং এ সব কবিতা ও বীরত্বগাথা গাইতে গাইতে পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পশ্চাদপসরণ করার মধ্যেই তারা যেন তাদের কল্যাণ দেখতে পেল।

আর ইয়াহুদীদের এ পরিকল্পনাটি ছিল মারাত্মক ভুল। যদি তারা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করত তাহলে মহানবী (সা.)-এর যে অতিমাত্রায় ক্ষমা,মহানুভবতা ও উদারতা বিদ্যমান ছিল সে কারণে তারা নিশ্চিতভাবে মুসলমানদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারত। তাই দুর্গসমূহে অবস্থান গ্রহণ ছিল যুদ্ধ ও শত্রুতার পুনঃপ্রকাশেরই নিদর্শনস্বরূপ। মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে শত্রু দুর্গ অবরোধ করা এবং বাইরে থেকে দুর্গের ভিতরে সাহায্য ও রসদ পত্রের আগমনে বাধা দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তাই বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হলো। দুর্গের ইয়াহুদীরা অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে একেবারে নতজানু হয়ে পড়ল এবং আত্মসমর্পণের কথা প্রকাশ করে তারা ঘোষণা করল যে,মহানবী (সা.) যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে।

মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত এটিই ছিল যে,মদীনায় গোলযোগ সৃষ্টিকারী ও রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্টকারীদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন। কিন্তু তিনি মদীনার মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের পীড়াপীড়িতে শাস্তি প্রদান করা থেকে বিরত থাকলেন। আর এই আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই বাহ্যত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করত। ঠিক করা হলো যে,বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা যত শীঘ্র সম্ভব তাদের অস্ত্র ও সম্পদ হস্তান্তর করে মদীনা ত্যাগ করবে এবং উবাদাতা ইবনে সামেত নামক একজন কর্মকর্তার তদারকিতে ও পর্যবেক্ষণে এ কাজগুলো সমাধা করবে। তখন ওয়াদিউল কুরা এবং সেখান থেকে আযরুআত নামক শামের একটি এলাকার উদ্দেশে মদীনা ত্যাগ করা ব্যতীত বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীদের আর কোন উপায় ছিল না।

বনি কাইনুকা গোত্রের বহিষ্কারের মাধ্যমে মদীনায় রাজনৈতিক ঐক্য ফিরে আসে। তবে এ বারে ধর্মীয় ঐক্যের সাথে যুক্ত হয়ে গেল মদীনার রাজনৈতিক ঐক্যও। কারণ মদীনায় মুসলমানদের কেবল এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যতীত আর কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীই দৃষ্টিগোচর হতো না। আর মূর্তিপূজারী আরব বেদুইন ও মুনাফিকচক্র এ অসাধারণ ঐক্যের বরাবরে ছিল নিতান্তই নগণ্য।৬০৫

মদনীয় বেশ কিছু নতুন খবর আসতে থাকা

সাধারণত একটি ক্ষুদ্র পরিবেশ ও পরিসরে সংবাদগুলো বিদ্যুৎ চমকানোর মতো অতি দ্রুতগতিতে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। তাই যে কোন এলাকায় অধিকাংশ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র এবং ইসলামবিরোধী সমাবেশসমূহের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে নিরপেক্ষ পথিক অথবা সচেতন বন্ধুদের দ্বারা ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যেত। এছাড়াও এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) নিজেই ছিলেন অত্যন্ত সজাগ এবং সূক্ষ্মদর্শী। এ কারণেই বেশিরভাগ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যেত। যখনই সংবাদ আসত যে,কোন একটি গোত্র অস্ত্র ও যোদ্ধা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে তখনই তিনি তৎক্ষণাৎ শত্রুর যে কোন অপতৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করতেন অথবা তিনি নিজেই বিদ্যুৎ গতিতে উপযুক্ত সৈন্যসমেত শত্রু এলাকা ঘেরাও করে ফেলতেন এবং এভাবে তিনি শত্রুর সব ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নীলনকশা ব্যর্থ করে দিতেন। এখন আমরা হিজরী ২য় বর্ষের কতিপয় গাযওয়ার (যুদ্ধের) সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দান করব :

১. গাযওয়াতুল কাদার : বনি সালীম গোত্রের কেন্দ্রস্থল ছিল আল কাদার। মদীনায় একটি গোপন খবর এসে পৌঁছায় যে,উক্ত গোত্র ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ মদীনা নগরী আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। মহানবী (সা.) যখনই মদীনার বাইরে যেতেন তখনই তিনি কোন ব্যক্তিকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করে মদীনার প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর হাতে অর্পণ করতেন। এবার তিনি ইবনে উম্মে মাকতুমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে একটি সেনাবাহিনী নিয়ে আল কাদার-এর কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ইসলামী সেনাবাহিনী পৌঁছানোর পূর্বেই শত্রুবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। মহানবী (সা.) বিনা সংঘর্ষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।৬০৬

২. গাযওয়াতুস সুওয়াইক৬০৭ : জাহেলিয়াতের যুগের আরবগণ অনেক অদ্ভুত নযর (মানত) করত। যেমন বদরের যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ান নযর করেছিল যে,যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের কাছ থেকে নিহত কুরাইশদের প্রতিশোধ নিতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করা থেকে বিরত থাকবে। তাই তার এ নযর পুরো করার জন্য তাকে বাধ্য হয়েই আক্রমণ চালাতে হয়েছিল। সে দু লোক নিয়ে রওয়ানা হয় এবং মদীনার বাইরে বসবাসকারী ইয়াহুদী বনি নাযির গোত্রের প্রধান সালাম বিন মুশকামের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনায় একজন মুসলমানকে হত্যা করে এবং আরিয নামক একটি এলাকার একটি খেজুর বাগানে অগ্নিসংযোগ করে। এক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে পুরো ঘটনা মদীনায় এসে মহানবী (সা.)-কে অবগত করে। মহানবী মদীনা থেকে বের হয়ে কিছুদূর শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান ও তার সৈন্যরা মুসলমানদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল এবং এ পথে শত্রু সেনাদলের ফেলে যাওয়া সুওয়াইকের বেশ কিছু বস্তা মুসলমানদের হস্তুগত হয়েছিল। এ কারণেই এ যুদ্ধের নাম হয়েছিল গাযওয়াতুস সুওয়াইক।৬০৮

গাযওয়াতু যিল আমর

এ মর্মে মদীনায় একটি সংবাদ এসে পৌঁছায় যে,গাতফান গোত্র একত্র হয়ে মদীনা দখলের পাঁয়তারা করছে। তাই মহানবী (সা.) ৪৫০ জন যোদ্ধা নিয়ে শত্রু সেনাদলের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। শত্রুরা ঘাবড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিল। এ সময় মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলে মহানবী (সা.)-এর পোশাক-পরিচ্ছদ ভিজে গেল। মহানবী তাঁর সেনাদল থেকে একটু দূরে থেকে ভিজা পোশাকটি খুলে (শুকানোর জন্য) একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। আর তিনি একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শত্রুরা পাহাড়ের ওপর থেকে মহানবীর গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল। শত্রুপক্ষীয় এক বীর যোদ্ধা এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এল। সে মহানবী (সা.)-এর মাথার ওপর তরবারি উঠিয়ে অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় বলল, আজ আমার ধারালো তরবারি থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? মহানবী (সা.) উচ্চৈঃস্বরে বললেন, মহান আল্লাহ্। এ কথা তার মধ্যে এতটা প্রভাব ফেলল যে,সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহ কাঁপতে লাগল। এমতাবস্থায় তার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল। মহানবী তখনই উঠে দাঁড়িয়ে এ তরবারিটা হাতে নিলেন এবং তাঁকে আক্রমণ করে বললেন, এখন আমার হাত থেকে তোমার জীবন কে রক্ষা করবে? যেহেতু ঐ লোকটি ছিল মুশরিক এবং তার কাষ্ঠনির্মিত উপাস্যগুলো যে তাকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ মুহূর্তে রক্ষা করতে অক্ষম এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারল,সেহেতু সে মহানবী (সা.)-এর উত্তরে বলল, কেউ নেই।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে,ঐ লোকটি তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর ভয় পেয়ে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি। কারণ পরবর্তীকালে সে ইসলাম ধর্মের ওপর অটল ও দৃঢ় থেকেছে। তার মুসলমান হওয়ার কারণ ছিল তার নির্মল সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত) জাগ্রত হওয়া। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্বাভাবিক পরাজয় তাকে অন্য জগতের প্রতি মনোযোগী ও আগ্রহী করে তুলেছিল এবং সে নিজেও বুঝতে পেরেছিল যে,অন্য জগতের সাথে মহানবী (সা.)-এর যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে। মহানবী (সা.) ঐ লোকটির ঈমান গ্রহণ মেনে নিলেন এবং তার হাতে তার তরবারিটা ফেরত দিলেন। সে কয়েক কদম চলে যাওয়ার পর আবার ফিরে এসে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে তরবারি রেখে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং বলল, আপনি যেহেতু এ সংস্কারকামী সেনাদলের সর্বাধিনায়ক সেহেতু আপনি এ তরবারির জন্য অধিক উপযুক্ত। ৬০৯

কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার গতিপথ পরিবর্তন

লোহিত সাগরের উপকূল মুসলিম সেনাবাহিনী এবং যারা মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল তাদের দ্বারা (মুশরিক কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য) অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসঙ্কুল হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা পুনরায় পরামর্শ সভার আয়োজন করল এবং নিজেদের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখল। আলোচনা-পর্যালোচনা করার পর সকলেই বলল, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের পুঁজি হারাব এবং এর ফলে আমরা মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হব। আর যদি আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে মশগুল হই তাহলেও এ কাজে আমাদের সাফল্যের কোন আশা নেই। কারণ মুসলমানরা এ পথেও আমাদের বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রীগুলো জব্দ করতে পারে।

তখন তাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি ইরাকের ওপর দিয়ে শামে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। তার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। কুরাইশদের বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রী বহনকারী বাণিজ্যিক কাফেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আবু সুফিয়ান এবং সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা নিজেরাই বাণিজ্য কাফেলার তদারকি ও পরিচালনার ভার নিল। আর তারা ফুরাত ইবনে হাইয়ান নামক বনি বকর গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ বাণিজ্য কাফেলার পথপ্রদর্শক করে নিয়ে গেল।

মাকরীযী৬১০ লিখেছেন, মদীনাবাসী এক ব্যক্তি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মদীনায় ফিরে এসে নিজ বন্ধুকে জানায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) এ ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর যায়েদ ইবনে হারেসের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী বাণিজ্য-কাফেলাকে বাধা দেয়ার জন্য প্রেরণ করেন। এ সেনাদলটি দু ব্যক্তিকে বন্দী ও বাণিজ্য কাফেলা জব্দ করার মাধ্যমে কুরাইশদেরকে নতুন পথে শামের উদ্দেশে সফর করা থেকে বিরত রাখে।

প্রথম খণ্ড সমাপ্ত

মানুষ বিশেষ পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী

আমরা জানি যে , মানুষ অন্যান্য প্রাণী প্রজাতির ন্যায় বেঁচে থাকা ও বিকাশের জন্য স্রষ্টা প্রদত্ত সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী। এছাড়াও ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানও সে সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতির মধ্যকার একটি মৌলিক পার্থক্য এই যে , তার জন্য পথনির্দেশের ক্ষেত্র ও প্রয়োজন অনেক বেশী , কিন্তু সে অনুপাতে তার প্রাপ্ত সহজাত পথনির্দেশের পরিমাণ ও মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। তবে সহজাত পথনির্দেশ বিহীন এই ক্ষেত্রগুলোতে পথনির্দেশ গ্রহণের জন্য তার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা নিহিত রাখা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ , বাবুই পাখীর আশ্রয়ের জন্য যে ধরনের গৃহের (বাসার) প্রয়োজন সহজাতভাবেই সে তা তৈরীর জ্ঞানের অধিকারী। এ ক্ষেত্রে কোনো বাবুই পাখীই ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানবসন্তান সহজাতভাবে এরূপ বা অন্য কোনো ধরনের একটি শিল্পগুণ সমৃদ্ধ বাসগৃহ তৈরীর সহজাত জ্ঞানের অধিকারী নয়। তবে তার মধ্যে বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরনের গৃহ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করার সম্ভাবনা (প্রতিভা) নিহিত রয়েছে। সে গৃহনির্মাণের কৌশল শিক্ষা করে এবং বিচিত্র ধরনের গৃহ তৈরী করে ; বাবুই পাখীর মতো শুধু এক ধরনের গৃহ নির্মাণ করে না। অন্যদিকে গৃহনির্মাণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সব বাবুই পাখী অভিন্ন হলেও এ ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান নয়। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম ; সকলে সকল ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম নয়। অন্যান্য শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা।

এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে , মানুষ তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করে এবং আগ্রহ , ঝোঁকপ্রবণতা , মনোযোগ , নিষ্ঠা ও সুযোগ-সুবিধার পার্থক্যের কারণে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের মধ্যে পার্থক্য ঘটে থাকে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে , যে কোনো শিল্প বা জ্ঞানের প্রথম উদ্ভাবক অন্য কোনো মানুষের কাছ থেকে তা শিখে নি। তাহলে সে তা পেলো কোথায় ? এ ক্ষেত্রে সে দু টি সূত্র থেকে তা পেতে পারে: হয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে চিন্তাগবেষণার মাধ্যমে , নয়তো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত পথনির্দেশের মাধ্যমে। দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রে অনেক সময় সে বুঝতেও পারে না যে , সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ পাচ্ছে।

মানব জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সূচনার ইতিহাস হচ্ছে এরূপ যে , ব্যক্তি তা স্বপ্নে দেখেছে অথবা সহসাই তার মনে বিষয়টি খেলে গেছে - যার পিছনে কোনো পার্থিব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় তা যে সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশ তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এই যে , এ ধরনের পথনির্দেশ সকল মানুষের কাছে আসে না। একেকটি বিষয়ের পথনির্দেশ একজন বা দু জন লাভ করেন এবং তারা তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। এভাবে গোটা মানবজাতি তা থেকে উপকৃত হতে পারে।

বস্তুতঃ একেকটি বিষয়বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরূপ ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের নিকট এ ধরনের পথনির্দেশ আসা যরূরী নয় ; একজনের কাছে আসা এবং অন্যদের তার কাছ থেকে শিখে নেয়াই যথেষ্ট। অন্যথায় প্রতিটি মানুষকে এ ধরনের পথনির্দেশ দেয়া হলে প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে অনাগত ভবিষ্যতের শেষ মানুষটি পর্যন্ত প্রত্যেকের নিকটই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের পথনির্দেশ আসতে হতো। তাহলে আর একে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আবিষ্কার-উদ্ভাবন বলা যেতো না , বরং বলতে হতো সহজাত জ্ঞান। সে ক্ষেত্রে মানবজাতির সদস্যদের মধ্যে জ্ঞানসাধনা ও অধ্যবসায় বলতে কিছু থাকতো না ; তাদের কাজের মধ্যে তেমন কোনো বৈচিত্র্যও থাকতো না। তাদের ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে তেমন কোনো গুণগত পার্থক্য থাকতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে , বিশেষ অর্থে মানুষ যে স্বাধীনতার অধিকারী , তার তা থাকতো না। তার স্বাধীনতা হতো পশুপাখীর স্বাধীনতার সমতুল্য। সে পরিণত হতো জৈবিক যন্ত্রে। এ অবস্থায় মেধা-প্রতিভা , জ্ঞান , জ্ঞানের বিকাশ , জ্ঞানচর্চা , অধ্যবসায় ইত্যাদি বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , মানবপ্রজাতি যে সর্বজনীন সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী তার বাইরে মানবজীবনের এমন সব ক্ষেত্র রয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যে জন্য পথনির্দেশের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ পথনির্দেশ সর্বজনীন হওয়া প্রয়োজন বা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক যে , কিছু লোক এ ধরনের পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং অন্যদেরকে তা পৌঁছে দেবেন বা শিক্ষা দেবেন।

মানুষের জন্য এ ধরনের বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন কেবল শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সামাজিক , রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে এর অধিকতর প্রয়োজন। বলা চলে যে , যদিও শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবন সম্পর্কিত পথনির্দেশ খুবই কাম্য , তথাপি তা না পেলেও খুব বড় ধরনের ক্ষতি নেই। কারণ , মানুষ যদি বাড়ীঘর ও সভ্যতার উপকরণ নির্মাণ করতে না জানতো , চিকিৎসা শাস্ত্রের বিকাশ ঘটাতে না পারতো , শিল্প ও কলা সৃষ্টি করতে না পারতো , বরং বনে-জঙ্গলে , পাহাড়-পর্বতে , গাছের ডালে/ নীচে/ কোটরে বা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো , বুনো ফল-শাকসব্জি ও কাঁচা মাছ-মাংস খেতো এবং রোদ-বৃষ্টি , হিংস্র বন্য প্রাণী ও রোগব্যাধির কারণে স্বল্পজীবী হতো ; তাতে তার তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। কারণ , শেষ পর্যন্ত তো তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হয়। অতএব , তার আয়ু বিশ বছর , নাকি বিশ হাজার বছর তাতে তেমন কোনো পার্থক্য হতো না।

কিন্তু মানুষ যখন জানে যে , তার জন্য মৃত্যুর পরে এক অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে যেখানে তাকে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পরিপূর্ণ প্রতিফল ভোগ করতে হবে , তখন তার জন্য সামষ্টিক জীবনে সঠিক আচরণ তথা অন্যদের অধিকার বিনষ্ট না করা , বরং তার ওপর অন্যদের যে অধিকার রয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা অপরিহার্য। কিন্তু এ ব্যাপারে তার মধ্যে যে সহজাত পথনির্দেশ রয়েছে তাকে সে যথেষ্ট মনে করে না।

মানুষের এ বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তা কতোগুলো ক্ষেত্রে খুবই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন: মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। প্রকৃতিতে পান ও ভক্ষণের উপযোগী অনেক কিছু রয়েছে এবং মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানের দ্বারা নতুন নতুন কৃত্রিম বা যৌগিক খাদ্য-পানীয় প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু কতক খাদ্য-পানীয় তার শরীর , মন ও চরিত্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে এর ক্ষতিকারকতা অত্যন্ত দেরীতে প্রকাশ পেতে পারে এবং তার প্রভাব অত্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদী , এমনকি পুরুষানুক্রমে বিস্তৃত হতে পারে। এসব ক্ষতিকারক খাদ্য-পানীয় ব্যক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার (অভিজ্ঞতার) মাধ্যমে চিহ্নিত করা খুবই ঝুঁকিবহুল ; এমনকি ঝুঁকি নিয়েও যথাসময়ে তা চিহ্নিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে , বরং ঐ সব বস্তু ভক্ষণের ক্ষতি প্রকাশ পেতে বিলম্ব হওয়ায় ইতিমধ্যে আরো অনেকে তা পান বা ভক্ষণ করে বসতে পারে। অতএব , এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন যাতে পথনির্দেশ লাভকারী ব্যক্তি অন্যদেরকে তা পৌঁছে দিতে পারেন।

দ্বিতীয়তঃ মানুষের স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে পথনির্দেশ লঙ্ঘনের ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এবং তার এরূপ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া মানে তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু এ ধরনের লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের বিচারবুদ্ধি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে , ফলে তার মধ্যকার সহজাত পথনির্দেশ , বিশেষতঃ ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের অনুভূতি বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে ; অন্ততঃ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ কারণে তার জন্য এমন কোনো পথনির্দেশকের প্রয়োজন যার মধ্যে কোনো অবস্থায়ই ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের সহজাত অনুভূতি বিন্দু পরিমাণেও বিনষ্ট বা দুর্বল হবে না। এরূপ ব্যক্তি সৃষ্টকর্তা অপরিহার্য সত্তার কাছ থেকে পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেবেন।

তৃতীয়তঃ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন জগতে মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে এমন এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে যে , সহজাত পথনির্দেশের ভিত্তিতে সে যে সব কর্তব্যবোধ অনুভব করে তার মধ্যকার দু টি কর্তব্যবোধ পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এমতাবস্থায় সে বুঝতে পারছে না তার করণীয় কী। উদাহরণস্বরূপ , সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে সে জানে যে , মিথ্যা বলা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। অন্যদিকে সে এ-ও জানে যে , কোনো যালেমকে সাহায্য করা বা সরাসরি সাহায্য না করলেও যার ফলে যালেমের জন্য যুলুম করার পথ খুলে যায় এমন কাজ সম্পাদন করা মস্ত বড় অন্যায়। একই সাথে , যে কোনো মূল্যে নিজেকে যুলুম-নির্যাতন ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য তার মধ্যে রয়েছে দুর্বার সহজাত আকাঙ্ক্ষা। এমতাবস্থায় , ধরা যাক , এক ব্যক্তি কোনো যালেমের দ্বারা তাড়িত হয়ে এসে এই ব্যক্তির গৃহে আত্মগোপন করলো। অতঃপর অচিরেই উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে একজন যালেম এসে তার কাছে জানতে চাইলো পলাতক ব্যক্তিকে দেখেছে কিনা। এ ক্ষেত্রে সে বুঝতে পারছে না , সত্য বলবে , নাকি মিথ্যা বলে মযলূম লোকটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে , নাকি সত্য বলবে কিন্তু মযলূমকে যালেমের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে নিজের নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করবে। এমতাবস্থায় সে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ পথনির্দেশ কামনা করে।

চতুর্থতঃ মানুষ তার নিজের ও পারিপার্শ্বিক বিশ্বের পিছনে নিহিত বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা এবং সুশৃঙ্খল পরিচালনা লক্ষ্য করে সৃষ্টিকর্তার মহানত্ব ও মহত্ব স্মরণ করে বিস্ময়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়। সেই সাথে সে তার নিজের প্রতি স্রষ্টার সীমাহীন অনুগ্রহ দেখেও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে দেয়। তার মন বলে , মহান সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্বজগৎকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেন নি। নিঃসন্দেহে এর কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তেমনি তার মতো বিস্ময়কর ও জটিল বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী সৃষ্টি এবং তার প্রতি এতো দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন , তার জন্মের আগে থেকেই মাতৃদুগ্ধ , স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা , খাদ্য-পানীয় , আলো-বাতাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এ কোনো অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। পরম জ্ঞানী স্রষ্টার পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। তার মনে প্রশ্ন জাগে , কী সে উদ্দেশ্য ?

সে চিন্তা করে , স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক কী ? তার নিকট স্রষ্টার কোনো দাবী আছে কি ? থাকলে কী সে দাবী ? কীভাবে সে দাবী পূরণ করতে হবে ? কীভাবে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে ? এ জন্যও সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ কামনা করে। সে চায় , সৃষ্টিকর্তাই তাকে তাঁর পসন্দনীয় পথ দেখিয়ে দিন।

আইনপ্রণেতার প্রয়োজনীয়তা

মানুষ সামাজিক প্রাণী। কিন্তু পিপিলিকা বা মৌমাছির ন্যায় সামাজিক প্রাণীর জীবন থেকে মানুষের সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। অন্যান্য সামাজিক প্রাণীর সমাজবদ্ধতা সম্পূর্ণরূপে বা প্রায় সম্পূর্ণরূপে সহজাত পথনির্দেশের অধীন যার লঙ্ঘন তাদের পক্ষে সম্ভব নয় , বা একান্তই ব্যতিক্রম। ফলে ঐ সব প্রাণীর সামাজিক শৃঙ্খলা ও শাসন-প্রশাসনও সহজাত এবং জটিলতামুক্ত।

কিন্তু মানুষের সামাজিক জীবন পুরোপুরি সহজাত প্রবণতার অধীন নয়। মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন সমাজবদ্ধ জীবনের সহজাত প্রবণতা রয়েছে , অন্যদিকে রয়েছে স্বাধীনতার সহজাত অনুভূতি। ফলে মানুষ চাইলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন বা সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতেও সক্ষম। অন্যান্য সমাজবদ্ধ প্রাণীকুলের সমাজে শাসন-প্রশাসন এবং কর্মবিভাজনও সহজাত। ফলে সেখানে শাসন-প্রশাসন ও কর্মবিভাজন নিয়ে কোনোরূপ অসন্তোষ , বিরোধ , বিসম্বাদ ও বিদ্রোহের প্রশ্ন আসে না। (অবশ্য সর্বসাম্প্রতিক আবিষ্কার অনুযায়ী পিপিলিকা সমাজ ব্যতিক্রম ; সেখানে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহ-ষড়যন্ত্রও আছে , তবে নিঃসন্দেহে মানব সমাজের পর্যায়ের নয়।) কিন্তু মানবসমাজে শাসন-প্রশাসন এবং কর্মবিভাজন ও ভালোমন্দ কর্মের প্রতিদান নিয়ে অহরহ মতপার্থক্য ও সংঘাত দেখা দেয়। তাই মতপার্থক্য ও সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে মানুষের সমাজের জন্য আইন প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , এ আইন প্রণয়ন করবে কে ? এ আইন প্রণয়নের দায়িত্ব যিনি বা যারা পালন করবেন তাঁকে বা তাঁদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। নয়তো তাঁরা তাঁদের প্রণীত আইনের দ্বারা সমাজের অন্ততঃ কিছু মানুষকে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত করবেন।

মানুষের সমাজ পরিচালনার লক্ষ্যে যিনি একদিকে মানুষের জন্য কল্যাণকর , অন্যদিকে নির্ভুল ও ক্ষতিকারকতামুক্ত - এমন আইন , বিশেষতঃ মৌলিক আইন প্রণয়ন করতে চাইবেন তাঁর জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন সংক্ষেপে তা হচ্ছে:

1) তাঁকে মানুষ বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ বিশেষজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে মানুষের শরীর ও মনের ছোট-বড় সকল তথ্য , সকল বৈশিষ্ট্য ও রহস্য , তার সহজাত প্রবণতাসমূহ , আবেগ-উদ্দীপনা , আশা-আকাঙ্ক্ষা , সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি এবং শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে খুটিনাটি সহ পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

2) তাঁকে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সব রকমের সম্ভাব্য পারস্পরিক সম্পর্ক ও তা থেকে সমাজে যে সব পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া সম্ভব এবং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল হতে হবে।

3) ব্যক্তি-মানুষের ও মানব সমাজের মধ্যে যে সব প্রতিভা ও সম্ভাবনা এবং পূর্ণতার বীজ সুপ্ত বা লুক্কায়িত রয়েছে সে সম্বন্ধে তাঁর পুরোপুরি জানা থাকতে হবে।

4) নিকট ও দূর ভবিষ্যতে মানবসমাজে যে সব ঘটনা সংঘটিত হবার সম্ভাবনা আছে এবং তা ব্যক্তি ও সমাজের ওপর কী ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর জানা থাকতে হবে।

5) যে সব নীতি অনুসরণ করে মানুষের পক্ষে পূর্ণতায় উপনীত হওয়া সম্ভব তার সব কিছু সম্বন্ধে এবং যে সব নীতি তার পূর্ণতায় উপনীত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সে সম্বন্ধেও তাঁকে ওয়াকিফহাল থাকতে হবে। তেমনি তাঁকে পূর্ণতা অভিমুখী বিভিন্ন পথের মধ্য থেকে নিকটতম পথ বেছে চিহ্নিত করা ও মানুষকে সেদিকে চালিত করার যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে।

6) সমাজে তাঁর এমন কোনো স্বার্থ থাকবে না যা আইন প্রণয়নকালে তাঁকে সমাজের বা সমাজের সদস্যদের একাংশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে প্ররোচিত করতে পারে ।

7) তাঁকে সকল প্রকার অপরাধপ্রবণতা এবং ভুল-ত্রুটি ও অপরাধের সম্ভাবনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে হবে এবং ভাবাবেগ , অনুনয়-বিনয় ও তোষামোদীতে নরম না হওয়া ও কোনো রকম চাপের মুখে নতি স্বীকার না করার মতো দৃঢ়তার অধিকারী হতে হবে।

নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ পথনির্দেশ ও জ্ঞান এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সংরক্ষণের অধিকারী ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষে এরূপ গুণের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়।

স্রষ্টা মনোনীত পথনির্দেশক

বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের পথনির্দেশ প্রত্যেকের নিকট আসার প্রয়োজন হয় না। কারণ , তাহলে তা হতো সহজাত পথনির্দেশ এবং তার ফলে মানুষের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যেতো। আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই যে , আমাদের সকলের নিকট এ ধরনের পথনির্দেশ আসে নি। তাই কোনো জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে এ ধরনের পথনির্দেশ পাঠাতে হলে তা দু একজনের নিকট আসাই যথেষ্ট - যারা তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেবেন। শুধু তা-ই নয় , তাঁরা লোকদেরকে তা শিক্ষা দেবেন এবং তদনুযায়ী চলতে সাহায্য করবেন।

এ ধরনের ব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)-কে জাগ্রত ও শানিত করা এবং অসুস্থতা ও বিকৃতি থেকে সুস্থ ও মুক্ত করা , মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ , ন্যায়-অন্যায় ও ঔচিত্য-অনৌচিত্যের যে সহজাত পথনির্দেশ রয়েছে তাকে শক্তিশালী ও দ্বিধাদ্বন্দ্বমুক্ত করা , মানুষের বিচারবুদ্ধি যে সব বিষয়ে সঠিক ধারণায় পৌঁছতে সক্ষম নয় বা সঠিক ও ভুল সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম নয় সে সব বিষয়ে সঠিক পথনির্দেশ প্রদান করা এবং যারা সহজাত পথপ্রদর্শন লঙ্ঘন করে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে অথচ সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাদেরকে হাত ধরে সঠিক পথে তুলে আনা ও সে পথে চলতে সহায়তা করা।

বিচারবুদ্ধির দাবী এই যে , এ ধরনের ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে শুধু পথনির্দেশই লাভ করবেন না , বরং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া ও যারা তা গ্রহণ করবে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বও লাভ করবেন এবং সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর বিশেষ পথনির্দেশ লাভ ও দায়িত্ব প্রাপ্তির বিষয়টি তাঁর নিজের নিকট এমনভাবে সুস্পষ্ট থাকবে যে , এ ব্যাপারে তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা অস্পষ্টতা থাকবে না। এ কারণেই কোনো রকমের বিপদাপদ , এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও তাঁকে স্বীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারবে না। তাঁর নিকট এ বিষয়ের সুস্পষ্টতা হতে হবে সাধারণ মানুষের নিকট পার্থিব বিষয়াদির সুস্পষ্টতারই অনুরূপ। অর্থাৎ তিনি পার্থিব জগতের পাশাপাশি ভিন্ন মাত্রার অপার্থিব জগতসমূহের সাথে , বিশেষতঃ সৃষ্টিকর্তার সাথে - পার্থিব জগতের সাথে আমাদের সম্পর্কের ন্যায় - সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত সম্পর্কের অধিকারী হবেন।

এ ধরনের লোকদেরকে আরবী ভাষায় নবী , ও রাসূল , ফার্সী ভাষায় পায়াম্বার্ পয়গাম্বর এবং ইংরেজী ভাষায় প্রোফেট্ বলা হয় । অন্যান্য ভাষায়ও একই তাৎপর্য বুঝাবার জন্য তাদের নিজ নিজ বিশেষ পরিভাষা আছে বা উল্লিখিত পরিভাষাসমূহের কোনো কোনোটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে ভাষায় যে পরিভাষাই ব্যবহৃত হোক না কেন , যুগে যুগে এ দায়িত্বের অধিকারী বহু ব্যক্তির আগমন ঘটে।

অবশ্য যে কোনো খাঁটি জিনিসের যেমন নকল থাকতে পারে তেমনি যুগে যুগ নবী-রাসূল হবার মিথ্যা দাবীদার লোকের আবির্ভাবও কম ঘটে নি। তাই এ দায়িত্ব লাভের দাবীদারদের দাবী অবশ্যই বিচারবুদ্ধির আলোকে পরীক্ষা করে নেয়া উচিত যাতে সত্য দাবীদার ও মিথ্যা দাবীদারদের মধ্যে পার্থক্য করা যায় এবং মিথ্যা দাবীদারদের প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা ও সত্য দাবীদারদের অনুসরণ করা সম্ভবপর হয়।

মানুষ বিশেষ পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী

আমরা জানি যে , মানুষ অন্যান্য প্রাণী প্রজাতির ন্যায় বেঁচে থাকা ও বিকাশের জন্য স্রষ্টা প্রদত্ত সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী। এছাড়াও ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানও সে সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতির মধ্যকার একটি মৌলিক পার্থক্য এই যে , তার জন্য পথনির্দেশের ক্ষেত্র ও প্রয়োজন অনেক বেশী , কিন্তু সে অনুপাতে তার প্রাপ্ত সহজাত পথনির্দেশের পরিমাণ ও মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। তবে সহজাত পথনির্দেশ বিহীন এই ক্ষেত্রগুলোতে পথনির্দেশ গ্রহণের জন্য তার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা নিহিত রাখা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ , বাবুই পাখীর আশ্রয়ের জন্য যে ধরনের গৃহের (বাসার) প্রয়োজন সহজাতভাবেই সে তা তৈরীর জ্ঞানের অধিকারী। এ ক্ষেত্রে কোনো বাবুই পাখীই ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানবসন্তান সহজাতভাবে এরূপ বা অন্য কোনো ধরনের একটি শিল্পগুণ সমৃদ্ধ বাসগৃহ তৈরীর সহজাত জ্ঞানের অধিকারী নয়। তবে তার মধ্যে বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরনের গৃহ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করার সম্ভাবনা (প্রতিভা) নিহিত রয়েছে। সে গৃহনির্মাণের কৌশল শিক্ষা করে এবং বিচিত্র ধরনের গৃহ তৈরী করে ; বাবুই পাখীর মতো শুধু এক ধরনের গৃহ নির্মাণ করে না। অন্যদিকে গৃহনির্মাণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সব বাবুই পাখী অভিন্ন হলেও এ ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান নয়। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম ; সকলে সকল ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে সক্ষম নয়। অন্যান্য শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা।

এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে , মানুষ তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করে এবং আগ্রহ , ঝোঁকপ্রবণতা , মনোযোগ , নিষ্ঠা ও সুযোগ-সুবিধার পার্থক্যের কারণে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন লোকের মধ্যে পার্থক্য ঘটে থাকে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে , যে কোনো শিল্প বা জ্ঞানের প্রথম উদ্ভাবক অন্য কোনো মানুষের কাছ থেকে তা শিখে নি। তাহলে সে তা পেলো কোথায় ? এ ক্ষেত্রে সে দু টি সূত্র থেকে তা পেতে পারে: হয় বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে চিন্তাগবেষণার মাধ্যমে , নয়তো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত পথনির্দেশের মাধ্যমে। দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রে অনেক সময় সে বুঝতেও পারে না যে , সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ পাচ্ছে।

মানব জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সূচনার ইতিহাস হচ্ছে এরূপ যে , ব্যক্তি তা স্বপ্নে দেখেছে অথবা সহসাই তার মনে বিষয়টি খেলে গেছে - যার পিছনে কোনো পার্থিব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় তা যে সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশ তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এই যে , এ ধরনের পথনির্দেশ সকল মানুষের কাছে আসে না। একেকটি বিষয়ের পথনির্দেশ একজন বা দু জন লাভ করেন এবং তারা তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। এভাবে গোটা মানবজাতি তা থেকে উপকৃত হতে পারে।

বস্তুতঃ একেকটি বিষয়বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এরূপ ঘটে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের নিকট এ ধরনের পথনির্দেশ আসা যরূরী নয় ; একজনের কাছে আসা এবং অন্যদের তার কাছ থেকে শিখে নেয়াই যথেষ্ট। অন্যথায় প্রতিটি মানুষকে এ ধরনের পথনির্দেশ দেয়া হলে প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে অনাগত ভবিষ্যতের শেষ মানুষটি পর্যন্ত প্রত্যেকের নিকটই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের পথনির্দেশ আসতে হতো। তাহলে আর একে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আবিষ্কার-উদ্ভাবন বলা যেতো না , বরং বলতে হতো সহজাত জ্ঞান। সে ক্ষেত্রে মানবজাতির সদস্যদের মধ্যে জ্ঞানসাধনা ও অধ্যবসায় বলতে কিছু থাকতো না ; তাদের কাজের মধ্যে তেমন কোনো বৈচিত্র্যও থাকতো না। তাদের ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে তেমন কোনো গুণগত পার্থক্য থাকতো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে , বিশেষ অর্থে মানুষ যে স্বাধীনতার অধিকারী , তার তা থাকতো না। তার স্বাধীনতা হতো পশুপাখীর স্বাধীনতার সমতুল্য। সে পরিণত হতো জৈবিক যন্ত্রে। এ অবস্থায় মেধা-প্রতিভা , জ্ঞান , জ্ঞানের বিকাশ , জ্ঞানচর্চা , অধ্যবসায় ইত্যাদি বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে , মানবপ্রজাতি যে সর্বজনীন সহজাত পথনির্দেশের অধিকারী তার বাইরে মানবজীবনের এমন সব ক্ষেত্র রয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যে জন্য পথনির্দেশের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ পথনির্দেশ সর্বজনীন হওয়া প্রয়োজন বা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক যে , কিছু লোক এ ধরনের পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং অন্যদেরকে তা পৌঁছে দেবেন বা শিক্ষা দেবেন।

মানুষের জন্য এ ধরনের বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন কেবল শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সামাজিক , রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে এর অধিকতর প্রয়োজন। বলা চলে যে , যদিও শিল্প , বস্তুবিজ্ঞান ও তদসংক্রান্ত আবিষ্কার-উদ্ভাবন সম্পর্কিত পথনির্দেশ খুবই কাম্য , তথাপি তা না পেলেও খুব বড় ধরনের ক্ষতি নেই। কারণ , মানুষ যদি বাড়ীঘর ও সভ্যতার উপকরণ নির্মাণ করতে না জানতো , চিকিৎসা শাস্ত্রের বিকাশ ঘটাতে না পারতো , শিল্প ও কলা সৃষ্টি করতে না পারতো , বরং বনে-জঙ্গলে , পাহাড়-পর্বতে , গাছের ডালে/ নীচে/ কোটরে বা পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো , বুনো ফল-শাকসব্জি ও কাঁচা মাছ-মাংস খেতো এবং রোদ-বৃষ্টি , হিংস্র বন্য প্রাণী ও রোগব্যাধির কারণে স্বল্পজীবী হতো ; তাতে তার তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। কারণ , শেষ পর্যন্ত তো তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হয়। অতএব , তার আয়ু বিশ বছর , নাকি বিশ হাজার বছর তাতে তেমন কোনো পার্থক্য হতো না।

কিন্তু মানুষ যখন জানে যে , তার জন্য মৃত্যুর পরে এক অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে যেখানে তাকে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পরিপূর্ণ প্রতিফল ভোগ করতে হবে , তখন তার জন্য সামষ্টিক জীবনে সঠিক আচরণ তথা অন্যদের অধিকার বিনষ্ট না করা , বরং তার ওপর অন্যদের যে অধিকার রয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা অপরিহার্য। কিন্তু এ ব্যাপারে তার মধ্যে যে সহজাত পথনির্দেশ রয়েছে তাকে সে যথেষ্ট মনে করে না।

মানুষের এ বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তা কতোগুলো ক্ষেত্রে খুবই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন: মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। প্রকৃতিতে পান ও ভক্ষণের উপযোগী অনেক কিছু রয়েছে এবং মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানের দ্বারা নতুন নতুন কৃত্রিম বা যৌগিক খাদ্য-পানীয় প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু কতক খাদ্য-পানীয় তার শরীর , মন ও চরিত্রের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে এর ক্ষতিকারকতা অত্যন্ত দেরীতে প্রকাশ পেতে পারে এবং তার প্রভাব অত্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদী , এমনকি পুরুষানুক্রমে বিস্তৃত হতে পারে। এসব ক্ষতিকারক খাদ্য-পানীয় ব্যক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার (অভিজ্ঞতার) মাধ্যমে চিহ্নিত করা খুবই ঝুঁকিবহুল ; এমনকি ঝুঁকি নিয়েও যথাসময়ে তা চিহ্নিত করা সম্ভব না-ও হতে পারে , বরং ঐ সব বস্তু ভক্ষণের ক্ষতি প্রকাশ পেতে বিলম্ব হওয়ায় ইতিমধ্যে আরো অনেকে তা পান বা ভক্ষণ করে বসতে পারে। অতএব , এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ পথনির্দেশের প্রয়োজন যাতে পথনির্দেশ লাভকারী ব্যক্তি অন্যদেরকে তা পৌঁছে দিতে পারেন।

দ্বিতীয়তঃ মানুষের স্বাধীনতার দাবী হচ্ছে পথনির্দেশ লঙ্ঘনের ক্ষমতার অধিকারী হওয়া এবং তার এরূপ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া মানে তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু এ ধরনের লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের বিচারবুদ্ধি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে , ফলে তার মধ্যকার সহজাত পথনির্দেশ , বিশেষতঃ ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের অনুভূতি বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে ; অন্ততঃ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এ কারণে তার জন্য এমন কোনো পথনির্দেশকের প্রয়োজন যার মধ্যে কোনো অবস্থায়ই ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের সহজাত অনুভূতি বিন্দু পরিমাণেও বিনষ্ট বা দুর্বল হবে না। এরূপ ব্যক্তি সৃষ্টকর্তা অপরিহার্য সত্তার কাছ থেকে পথনির্দেশ লাভ করবেন এবং তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেবেন।

তৃতীয়তঃ কারণ ও ফলশ্রুতি বিধির আওতাধীন জগতে মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে এমন এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে যে , সহজাত পথনির্দেশের ভিত্তিতে সে যে সব কর্তব্যবোধ অনুভব করে তার মধ্যকার দু টি কর্তব্যবোধ পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এমতাবস্থায় সে বুঝতে পারছে না তার করণীয় কী। উদাহরণস্বরূপ , সহজাত পথনির্দেশের মাধ্যমে সে জানে যে , মিথ্যা বলা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। অন্যদিকে সে এ-ও জানে যে , কোনো যালেমকে সাহায্য করা বা সরাসরি সাহায্য না করলেও যার ফলে যালেমের জন্য যুলুম করার পথ খুলে যায় এমন কাজ সম্পাদন করা মস্ত বড় অন্যায়। একই সাথে , যে কোনো মূল্যে নিজেকে যুলুম-নির্যাতন ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য তার মধ্যে রয়েছে দুর্বার সহজাত আকাঙ্ক্ষা। এমতাবস্থায় , ধরা যাক , এক ব্যক্তি কোনো যালেমের দ্বারা তাড়িত হয়ে এসে এই ব্যক্তির গৃহে আত্মগোপন করলো। অতঃপর অচিরেই উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে একজন যালেম এসে তার কাছে জানতে চাইলো পলাতক ব্যক্তিকে দেখেছে কিনা। এ ক্ষেত্রে সে বুঝতে পারছে না , সত্য বলবে , নাকি মিথ্যা বলে মযলূম লোকটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে , নাকি সত্য বলবে কিন্তু মযলূমকে যালেমের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে নিজের নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করবে। এমতাবস্থায় সে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ পথনির্দেশ কামনা করে।

চতুর্থতঃ মানুষ তার নিজের ও পারিপার্শ্বিক বিশ্বের পিছনে নিহিত বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা এবং সুশৃঙ্খল পরিচালনা লক্ষ্য করে সৃষ্টিকর্তার মহানত্ব ও মহত্ব স্মরণ করে বিস্ময়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়। সেই সাথে সে তার নিজের প্রতি স্রষ্টার সীমাহীন অনুগ্রহ দেখেও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে দেয়। তার মন বলে , মহান সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্বজগৎকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেন নি। নিঃসন্দেহে এর কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তেমনি তার মতো বিস্ময়কর ও জটিল বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী সৃষ্টি এবং তার প্রতি এতো দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন , তার জন্মের আগে থেকেই মাতৃদুগ্ধ , স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা , খাদ্য-পানীয় , আলো-বাতাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। এ কোনো অর্থহীন বা উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। পরম জ্ঞানী স্রষ্টার পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যহীন কাজ হতে পারে না। তার মনে প্রশ্ন জাগে , কী সে উদ্দেশ্য ?

সে চিন্তা করে , স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক কী ? তার নিকট স্রষ্টার কোনো দাবী আছে কি ? থাকলে কী সে দাবী ? কীভাবে সে দাবী পূরণ করতে হবে ? কীভাবে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে ? এ জন্যও সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পথনির্দেশ কামনা করে। সে চায় , সৃষ্টিকর্তাই তাকে তাঁর পসন্দনীয় পথ দেখিয়ে দিন।

আইনপ্রণেতার প্রয়োজনীয়তা

মানুষ সামাজিক প্রাণী। কিন্তু পিপিলিকা বা মৌমাছির ন্যায় সামাজিক প্রাণীর জীবন থেকে মানুষের সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। অন্যান্য সামাজিক প্রাণীর সমাজবদ্ধতা সম্পূর্ণরূপে বা প্রায় সম্পূর্ণরূপে সহজাত পথনির্দেশের অধীন যার লঙ্ঘন তাদের পক্ষে সম্ভব নয় , বা একান্তই ব্যতিক্রম। ফলে ঐ সব প্রাণীর সামাজিক শৃঙ্খলা ও শাসন-প্রশাসনও সহজাত এবং জটিলতামুক্ত।

কিন্তু মানুষের সামাজিক জীবন পুরোপুরি সহজাত প্রবণতার অধীন নয়। মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন সমাজবদ্ধ জীবনের সহজাত প্রবণতা রয়েছে , অন্যদিকে রয়েছে স্বাধীনতার সহজাত অনুভূতি। ফলে মানুষ চাইলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন বা সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতেও সক্ষম। অন্যান্য সমাজবদ্ধ প্রাণীকুলের সমাজে শাসন-প্রশাসন এবং কর্মবিভাজনও সহজাত। ফলে সেখানে শাসন-প্রশাসন ও কর্মবিভাজন নিয়ে কোনোরূপ অসন্তোষ , বিরোধ , বিসম্বাদ ও বিদ্রোহের প্রশ্ন আসে না। (অবশ্য সর্বসাম্প্রতিক আবিষ্কার অনুযায়ী পিপিলিকা সমাজ ব্যতিক্রম ; সেখানে অসন্তোষ এবং বিদ্রোহ-ষড়যন্ত্রও আছে , তবে নিঃসন্দেহে মানব সমাজের পর্যায়ের নয়।) কিন্তু মানবসমাজে শাসন-প্রশাসন এবং কর্মবিভাজন ও ভালোমন্দ কর্মের প্রতিদান নিয়ে অহরহ মতপার্থক্য ও সংঘাত দেখা দেয়। তাই মতপার্থক্য ও সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে মানুষের সমাজের জন্য আইন প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , এ আইন প্রণয়ন করবে কে ? এ আইন প্রণয়নের দায়িত্ব যিনি বা যারা পালন করবেন তাঁকে বা তাঁদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। নয়তো তাঁরা তাঁদের প্রণীত আইনের দ্বারা সমাজের অন্ততঃ কিছু মানুষকে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত করবেন।

মানুষের সমাজ পরিচালনার লক্ষ্যে যিনি একদিকে মানুষের জন্য কল্যাণকর , অন্যদিকে নির্ভুল ও ক্ষতিকারকতামুক্ত - এমন আইন , বিশেষতঃ মৌলিক আইন প্রণয়ন করতে চাইবেন তাঁর জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন সংক্ষেপে তা হচ্ছে:

1) তাঁকে মানুষ বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ বিশেষজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে মানুষের শরীর ও মনের ছোট-বড় সকল তথ্য , সকল বৈশিষ্ট্য ও রহস্য , তার সহজাত প্রবণতাসমূহ , আবেগ-উদ্দীপনা , আশা-আকাঙ্ক্ষা , সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি এবং শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে খুটিনাটি সহ পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

2) তাঁকে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সব রকমের সম্ভাব্য পারস্পরিক সম্পর্ক ও তা থেকে সমাজে যে সব পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া সম্ভব এবং মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল হতে হবে।

3) ব্যক্তি-মানুষের ও মানব সমাজের মধ্যে যে সব প্রতিভা ও সম্ভাবনা এবং পূর্ণতার বীজ সুপ্ত বা লুক্কায়িত রয়েছে সে সম্বন্ধে তাঁর পুরোপুরি জানা থাকতে হবে।

4) নিকট ও দূর ভবিষ্যতে মানবসমাজে যে সব ঘটনা সংঘটিত হবার সম্ভাবনা আছে এবং তা ব্যক্তি ও সমাজের ওপর কী ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর জানা থাকতে হবে।

5) যে সব নীতি অনুসরণ করে মানুষের পক্ষে পূর্ণতায় উপনীত হওয়া সম্ভব তার সব কিছু সম্বন্ধে এবং যে সব নীতি তার পূর্ণতায় উপনীত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সে সম্বন্ধেও তাঁকে ওয়াকিফহাল থাকতে হবে। তেমনি তাঁকে পূর্ণতা অভিমুখী বিভিন্ন পথের মধ্য থেকে নিকটতম পথ বেছে চিহ্নিত করা ও মানুষকে সেদিকে চালিত করার যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে।

6) সমাজে তাঁর এমন কোনো স্বার্থ থাকবে না যা আইন প্রণয়নকালে তাঁকে সমাজের বা সমাজের সদস্যদের একাংশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে প্ররোচিত করতে পারে ।

7) তাঁকে সকল প্রকার অপরাধপ্রবণতা এবং ভুল-ত্রুটি ও অপরাধের সম্ভাবনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে হবে এবং ভাবাবেগ , অনুনয়-বিনয় ও তোষামোদীতে নরম না হওয়া ও কোনো রকম চাপের মুখে নতি স্বীকার না করার মতো দৃঢ়তার অধিকারী হতে হবে।

নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ পথনির্দেশ ও জ্ঞান এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সংরক্ষণের অধিকারী ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষে এরূপ গুণের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়।

স্রষ্টা মনোনীত পথনির্দেশক

বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের পথনির্দেশ প্রত্যেকের নিকট আসার প্রয়োজন হয় না। কারণ , তাহলে তা হতো সহজাত পথনির্দেশ এবং তার ফলে মানুষের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যেতো। আর বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাই যে , আমাদের সকলের নিকট এ ধরনের পথনির্দেশ আসে নি। তাই কোনো জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে এ ধরনের পথনির্দেশ পাঠাতে হলে তা দু একজনের নিকট আসাই যথেষ্ট - যারা তা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেবেন। শুধু তা-ই নয় , তাঁরা লোকদেরকে তা শিক্ষা দেবেন এবং তদনুযায়ী চলতে সাহায্য করবেন।

এ ধরনের ব্যক্তিদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্)-কে জাগ্রত ও শানিত করা এবং অসুস্থতা ও বিকৃতি থেকে সুস্থ ও মুক্ত করা , মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ , ন্যায়-অন্যায় ও ঔচিত্য-অনৌচিত্যের যে সহজাত পথনির্দেশ রয়েছে তাকে শক্তিশালী ও দ্বিধাদ্বন্দ্বমুক্ত করা , মানুষের বিচারবুদ্ধি যে সব বিষয়ে সঠিক ধারণায় পৌঁছতে সক্ষম নয় বা সঠিক ও ভুল সিদ্ধান্তের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম নয় সে সব বিষয়ে সঠিক পথনির্দেশ প্রদান করা এবং যারা সহজাত পথপ্রদর্শন লঙ্ঘন করে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে অথচ সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাদেরকে হাত ধরে সঠিক পথে তুলে আনা ও সে পথে চলতে সহায়তা করা।

বিচারবুদ্ধির দাবী এই যে , এ ধরনের ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে শুধু পথনির্দেশই লাভ করবেন না , বরং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া ও যারা তা গ্রহণ করবে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্বও লাভ করবেন এবং সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর বিশেষ পথনির্দেশ লাভ ও দায়িত্ব প্রাপ্তির বিষয়টি তাঁর নিজের নিকট এমনভাবে সুস্পষ্ট থাকবে যে , এ ব্যাপারে তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা অস্পষ্টতা থাকবে না। এ কারণেই কোনো রকমের বিপদাপদ , এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও তাঁকে স্বীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারবে না। তাঁর নিকট এ বিষয়ের সুস্পষ্টতা হতে হবে সাধারণ মানুষের নিকট পার্থিব বিষয়াদির সুস্পষ্টতারই অনুরূপ। অর্থাৎ তিনি পার্থিব জগতের পাশাপাশি ভিন্ন মাত্রার অপার্থিব জগতসমূহের সাথে , বিশেষতঃ সৃষ্টিকর্তার সাথে - পার্থিব জগতের সাথে আমাদের সম্পর্কের ন্যায় - সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত সম্পর্কের অধিকারী হবেন।

এ ধরনের লোকদেরকে আরবী ভাষায় নবী , ও রাসূল , ফার্সী ভাষায় পায়াম্বার্ পয়গাম্বর এবং ইংরেজী ভাষায় প্রোফেট্ বলা হয় । অন্যান্য ভাষায়ও একই তাৎপর্য বুঝাবার জন্য তাদের নিজ নিজ বিশেষ পরিভাষা আছে বা উল্লিখিত পরিভাষাসমূহের কোনো কোনোটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে ভাষায় যে পরিভাষাই ব্যবহৃত হোক না কেন , যুগে যুগে এ দায়িত্বের অধিকারী বহু ব্যক্তির আগমন ঘটে।

অবশ্য যে কোনো খাঁটি জিনিসের যেমন নকল থাকতে পারে তেমনি যুগে যুগ নবী-রাসূল হবার মিথ্যা দাবীদার লোকের আবির্ভাবও কম ঘটে নি। তাই এ দায়িত্ব লাভের দাবীদারদের দাবী অবশ্যই বিচারবুদ্ধির আলোকে পরীক্ষা করে নেয়া উচিত যাতে সত্য দাবীদার ও মিথ্যা দাবীদারদের মধ্যে পার্থক্য করা যায় এবং মিথ্যা দাবীদারদের প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকা ও সত্য দাবীদারদের অনুসরণ করা সম্ভবপর হয়।


23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53

54

55

56

57

58

59

60

61