চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 103688
ডাউনলোড: 9120


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 242 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 103688 / ডাউনলোড: 9120
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

একত্রিশতম অধ্যায় : বনী কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীদের অপরাধসমূহ

বদর যুদ্ধ ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর ও আতংক সৃষ্টিকারী তুফান যা সমগ্র আরব উপদ্বীপের বুকে বইতে লাগল। এটি ছিল এমন এক উত্তাল ঝাঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ ঝড় যা শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রাচীন মূলগুলোর একটি অংশ উপড়ে ফেলেছিল। কুরাইশদের একদল বীরপুরুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল এবং একদল বন্দী হয়েছিল এবং আরেকদল পূর্ণ হীনতা-দীনতা সহকারে ও সম্পূর্ণ অক্ষম ও নিরুপায় হয়ে পলায়ন করেছিল। কুরাইশ বাহিনীর পরাজিত হবার খবর সমগ্র আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এ ঝড়ের পর ভয়-ভীতি ও মানসিক অস্থিরতা মিশ্রিত এক ধরনের থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই থমথমে অবস্থার কারণ ছিল আরব উপদ্বীপের সার্বিক ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি।

আরব উপদ্বীপের মুশরিক গোত্রগুলো এবং মদীনা,খায়বর ও ওয়াদীউল কুরার ধনাঢ্য ইয়াহুদিগণ সবাই (মদীনার) সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রশাসন ও সরকারের শক্তি ও ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং নিজেদের অস্তিত্বকেই হুমকি ও ধ্বংসের মুখোমুখি দেখতে পেয়েছিল। কারণ তারা কখনই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে,মহানবী (সা.)-এর অবস্থা এতটা শক্তিশালী ও উন্নত হবে এবং কুরাইশদের প্রাচীন ও পুরানো শক্তি ও ক্ষমতাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে।

বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা যারা মদীনা নগরীর ভিতরে বসবাস করত এবং মদীনার অর্থনীতি যাদের হাতের মুঠোয় ছিল তারা অন্য সবার চেয়ে বেশি ভয় ও শঙ্কার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের জীবন মুসলমানদের সাথে সম্পূর্ণ মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর মদীনার বাইরে খায়বর ও ওয়াদিউল কুরায় বসবাসকারী ইয়াহুদীরা যেহেতু মুসলমানদের ক্ষমতা ও প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিল সেহেতু তাদের অবস্থা ছিল এদের চাইতে ভিন্ন ধরনের। এ কারণেই বনি কাইনুকার ইয়াহুদীরা আঘাতকারী ঘৃণ্য স্লোগান ও চরম অবমাননাকর কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক ঠাণ্ডাযুদ্ধ শুরু করে দেয় এবং তারা মহানবী (সা.)-এর সাথে যে সন্ধি চুক্তি করেছিল কার্যত তা ভেঙে ফেলে। আমরা ইতোমধ্যে এ চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছি।

তবে এই ঠাণ্ডাযুদ্ধ এই অনুমতি দেয় না যে,এ সব ইয়াহুদীর জবাব মুসলমানরা যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে দেবে। কারণ যে গিঁট আঙ্গুল দিয়ে খোলা সম্ভব তা অবশ্যই দাঁত দিয়ে কামড়ে খোলা অনুচিত। আর তখন মদীনা নগরীর রাজনৈতিক ঐক্য ও সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা মহানবী (সা.)-এর জন্য অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী ছিল।

মহানবী (সা.) চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বনি কাইনুকা গোত্রের বাজারে যে বিরাট সমাবেশ ও জমায়েত হতো সেখানে ভাষণ দিলেন। এ সমাবেশের ভাষণে মহানবী (সা.)-এর ক্ষুরধার দিকটি ছিল বনি কাইনুকার ইয়াহুদীদের উদ্দেশে প্রদত্ত। তিনি তাঁর এ ভাষণে বলেছিলেন, কুরাইশদের কাহিনী তোমাদের জন্য শিক্ষাস্বরূপ। আমি ভয় পাচ্ছি যে,যে বিপদ কুরাইশদের ওপর আপতিত হয়েছে তা তোমাদের ওপরও আপতিত হবে। তোমাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন। তাদের কাছ থেকে তোমরা যাচাই করে দেখ তাহলে তারাও তোমাদেরকে যতটা পূর্ণতার সাথে সম্ভব ততটা স্পষ্ট করে বলতে পারবেন যে,আমি মহান আল্লাহর নবী। আর এ বিষয়টি তোমাদের আসমানী গ্রন্থেও বিদ্যমান।

চরম একগুঁয়ে ও দাম্ভিক ইয়াহুদীরা মহানবী (সা.)-এর ভাষণের ব্যাপারে নীরব থাকে নি,বরং তারা ধারালো কণ্ঠে মহানবীর পাল্টা জবাব দানের জন্য দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, আপনি ভেবেছেন যে,আমরা দুর্বল ও অক্ষম এবং কুরাইশদের মতো যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ? আপনি এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন যারা সামরিক কলাকৌশল ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অজ্ঞ। আর কাইনুকা গোত্রের বীর সন্তানদের শক্তি ও ক্ষমতা ঠিক তখনই আপনার সামনে উন্মোচিত হবে যখন আপনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। 604

বনী কাইনুকার ইয়াহুদীদের চরম বেয়াদবীপূর্ণ কড়া বক্তব্য এবং তাদের নরম তুলতুলে বীরদের রণসংগীত ও বীরত্বগাথা মুসলমানদের মন-মানসিকতায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না। তবে ইসলামের রাজনৈতিক মূলনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং এতদভিন্ন আরেক পথে জট (ইয়াহুদীদের ঠাণ্ডা যুদ্ধের জট) খোলা অত্যাবশ্যক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। এর অন্যথা হলে দিন দিন ইয়াহুদীদের স্পর্ধা,সীমা লঙ্ঘন ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। এ কারণেই মহানবী (সা.) এমন এক উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন যাতে করে তিনি তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে সক্ষম হন ।

একটি স্ফুলিঙ্গ থেকে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত হওয়া

কখনো কখনো অনেক ক্ষুদ্র ঘটনা বিরাট সামাজিক ঘটনা ও পরিবর্তনের সূচনা করে। অর্থাৎ কোন একটি ক্ষুদ্র ঘটনা অনেক বড় বড় ঘটনার উদ্গাতা হিসাবে কাজ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যা মানব জাতির ইতিহাসের এক বৃহত্তম ঘটনা তা সংঘটিত হওয়ার কারণও ছিল একটি ক্ষুদ্র ঘটনা যা বৃহৎ শক্তিবর্গের হাতে যুদ্ধ বাধানোর অজুহাত ও সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। যে ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা ছিল অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফ্রীন্যান্ডের হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ড 28 জুন সংঘটিত হয়েছিল এবং এর একমাস ও কিছুদিন পরে 3 আগস্ট বেলজিয়ামে জার্মানির আক্রমণের মধ্যদিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়। এ যুদ্ধে এক কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং দু কোটি লোক আহত হয়।

বনি কাইনুকার ইয়াহুদীদের ঔদ্ধত্য ও উগ্রতার কারণে মুসলমানরাও তীব্রভাবে অসন্তষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তাই তারা ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে অপরাধমূলক কোন কাজ সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা করছিল যা সংঘটিত হলে তারা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। হঠাৎ এক আরব মহিলা বনি কাইনুকার বাজারে এক ইয়াহুদী স্বর্ণকারের দোকানের পাশে নিজের সাথে আনা পণ্য বিক্রি করছিল। ঐ মহিলাটি সম্পূর্ণরূপে সতর্ক ছিল যেন কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। তবে কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা তার মুখের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলার জন্য জোর-জবরদস্তি করতে লাগল। ঐ আরব মহিলাটি পরপুরুষদের সামনে তার চেহারা অনাবৃত করতে চায় নি বলেই ঐ স্বর্ণকার দোকান থেকে বের হয়ে এসে ঐ মহিলার অজান্তে তার পোশাকের প্রান্ত তার পোশাকের পিঠের অংশের সাথে সেলাই করে দেয়। ঐ মহিলা যখন উঠে দাঁড়াল তখন তার দেহের কিছু অংশ অনাবৃত ও দৃশ্যমান হয়ে গেল এবং বনি কাইনুকার যুবকরা ঐ মহিলাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে লাগল। মান-মর্যাদা ও সম্ভ্রম প্রতিটি সমাজ ও সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে পরিগণিত। আরবদের মধ্যে এ বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে,আরবের মরুচারী বেদুইন গোত্রগুলো মান-সম্ভ্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করত। এ কারণেই একজন আগন্তুক মহিলার এহেন অবস্থা (বিশেষ করে ইয়াহুদীদের হাতে তার লাঞ্ছিত হওয়া) একজন মুসলমানের আত্মসম্মানবোধকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল। সে তৎক্ষণাৎ অস্ত্র দিয়ে ঐ ইয়াহুদী স্বর্ণকারকে হত্যা করে। ফলে বাজারের ইহুদীরাও একযোগে তাকে হত্যা করে।

আমাদের এতে কোন কাজ নেই যে,একজন মহিলার মান-সম্ভ্রমের ওপর হামলা করার অপরাধে ঐ ইয়াহুদী লোকটির রক্ত ঝরানো যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত ছিল কিনা। তবে কয়েকশ ইয়াহুদী কর্তৃক একযোগে আক্রমণ চালিয়ে একজন অসহায় নারীর মান-সম্ভ্রাম রক্ষাকারী একজন মুসলমানের রক্ত ঝরানো দারুণ অবমাননাকর ও অপমানজনক ছিল। এ কারণেই অত্যন্ত নিষ্ঠুর পন্থায় একজন মুসলমানের হত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলমানদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং সকল দুর্নীতি ও অপরাধের আখড়া  সমূলে ধ্বংস করে দেবার ব্যাপারে তাদেরকে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

বনি কাইনুকা গোত্রের রণ উদ্দীপনা উদ্রেককারী কবিতা আবৃত্তিকারী বীরেরা অনুভব করতে পারল যে,অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। তাই মদীনার বাজার ও রাস্তাঘাট থেকে কেনা-বেচা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করা আর তাদের ঠিক হবে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুউচ্চ ও মজবুত দুর্গগুলোর মধ্যে অবস্থিত নিজেদের ঘর-বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া এবং এ সব কবিতা ও বীরত্বগাথা গাইতে গাইতে পূর্ণ সাহসিকতার সাথে পশ্চাদপসরণ করার মধ্যেই তারা যেন তাদের কল্যাণ দেখতে পেল।

আর ইয়াহুদীদের এ পরিকল্পনাটি ছিল মারাত্মক ভুল। যদি তারা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করত তাহলে মহানবী (সা.)-এর যে অতিমাত্রায় ক্ষমা,মহানুভবতা ও উদারতা বিদ্যমান ছিল সে কারণে তারা নিশ্চিতভাবে মুসলমানদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারত। তাই দুর্গসমূহে অবস্থান গ্রহণ ছিল যুদ্ধ ও শত্রুতার পুনঃপ্রকাশেরই নিদর্শনস্বরূপ। মহানবী (সা.) মুসলমানদেরকে শত্রু দুর্গ অবরোধ করা এবং বাইরে থেকে দুর্গের ভিতরে সাহায্য ও রসদ পত্রের আগমনে বাধা দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তাই বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হলো। দুর্গের ইয়াহুদীরা অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে একেবারে নতজানু হয়ে পড়ল এবং আত্মসমর্পণের কথা প্রকাশ করে তারা ঘোষণা করল যে,মহানবী (সা.) যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে।

মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত এটিই ছিল যে,মদীনায় গোলযোগ সৃষ্টিকারী ও রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্টকারীদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন। কিন্তু তিনি মদীনার মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের পীড়াপীড়িতে শাস্তি প্রদান করা থেকে বিরত থাকলেন। আর এই আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই বাহ্যত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করত। ঠিক করা হলো যে,বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীরা যত শীঘ্র সম্ভব তাদের অস্ত্র ও সম্পদ হস্তান্তর করে মদীনা ত্যাগ করবে এবং উবাদাতা ইবনে সামেত নামক একজন কর্মকর্তার তদারকিতে ও পর্যবেক্ষণে এ কাজগুলো সমাধা করবে। তখন ওয়াদিউল কুরা এবং সেখান থেকে আযরুআত নামক শামের একটি এলাকার উদ্দেশে মদীনা ত্যাগ করা ব্যতীত বনি কাইনুকা গোত্রের ইয়াহুদীদের আর কোন উপায় ছিল না।

বনি কাইনুকা গোত্রের বহিষ্কারের মাধ্যমে মদীনায় রাজনৈতিক ঐক্য ফিরে আসে। তবে এ বারে ধর্মীয় ঐক্যের সাথে যুক্ত হয়ে গেল মদীনার রাজনৈতিক ঐক্যও। কারণ মদীনায় মুসলমানদের কেবল এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যতীত আর কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীই দৃষ্টিগোচর হতো না। আর মূর্তিপূজারী আরব বেদুইন ও মুনাফিকচক্র এ অসাধারণ ঐক্যের বরাবরে ছিল নিতান্তই নগণ্য।605

মদনীয় বেশ কিছু নতুন খবর আসতে থাকা

সাধারণত একটি ক্ষুদ্র পরিবেশ ও পরিসরে সংবাদগুলো বিদ্যুৎ চমকানোর মতো অতি দ্রুতগতিতে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। তাই যে কোন এলাকায় অধিকাংশ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র এবং ইসলামবিরোধী সমাবেশসমূহের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে নিরপেক্ষ পথিক অথবা সচেতন বন্ধুদের দ্বারা ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যেত। এছাড়াও এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) নিজেই ছিলেন অত্যন্ত সজাগ এবং সূক্ষ্মদর্শী। এ কারণেই বেশিরভাগ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যেত। যখনই সংবাদ আসত যে,কোন একটি গোত্র অস্ত্র ও যোদ্ধা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে তখনই তিনি তৎক্ষণাৎ শত্রুর যে কোন অপতৎপরতা নস্যাৎ করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করতেন অথবা তিনি নিজেই বিদ্যুৎ গতিতে উপযুক্ত সৈন্যসমেত শত্রু এলাকা ঘেরাও করে ফেলতেন এবং এভাবে তিনি শত্রুর সব ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ও নীলনকশা ব্যর্থ করে দিতেন। এখন আমরা হিজরী 2য় বর্ষের কতিপয় গাযওয়ার (যুদ্ধের) সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দান করব :

1. গাযওয়াতুল কাদার : বনি সালীম গোত্রের কেন্দ্রস্থল ছিল আল কাদার। মদীনায় একটি গোপন খবর এসে পৌঁছায় যে,উক্ত গোত্র ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ মদীনা নগরী আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। মহানবী (সা.) যখনই মদীনার বাইরে যেতেন তখনই তিনি কোন ব্যক্তিকে তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করে মদীনার প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর হাতে অর্পণ করতেন। এবার তিনি ইবনে উম্মে মাকতুমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে একটি সেনাবাহিনী নিয়ে আল কাদার-এর কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ইসলামী সেনাবাহিনী পৌঁছানোর পূর্বেই শত্রুবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। মহানবী (সা.) বিনা সংঘর্ষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।606

2. গাযওয়াতুস সুওয়াইক607 : জাহেলিয়াতের যুগের আরবগণ অনেক অদ্ভুত নযর (মানত) করত। যেমন বদরের যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ান নযর করেছিল যে,যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের কাছ থেকে নিহত কুরাইশদের প্রতিশোধ নিতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করা থেকে বিরত থাকবে। তাই তার এ নযর পুরো করার জন্য তাকে বাধ্য হয়েই আক্রমণ চালাতে হয়েছিল। সে দু লোক নিয়ে রওয়ানা হয় এবং মদীনার বাইরে বসবাসকারী ইয়াহুদী বনি নাযির গোত্রের প্রধান সালাম বিন মুশকামের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনায় একজন মুসলমানকে হত্যা করে এবং আরিয নামক একটি এলাকার একটি খেজুর বাগানে অগ্নিসংযোগ করে। এক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে পুরো ঘটনা মদীনায় এসে মহানবী (সা.)-কে অবগত করে। মহানবী মদীনা থেকে বের হয়ে কিছুদূর শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান ও তার সৈন্যরা মুসলমানদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল এবং এ পথে শত্রু সেনাদলের ফেলে যাওয়া সুওয়াইকের বেশ কিছু বস্তা মুসলমানদের হস্তুগত হয়েছিল। এ কারণেই এ যুদ্ধের নাম হয়েছিল গাযওয়াতুস সুওয়াইক।608

গাযওয়াতু যিল আমর

এ মর্মে মদীনায় একটি সংবাদ এসে পৌঁছায় যে,গাতফান গোত্র একত্র হয়ে মদীনা দখলের পাঁয়তারা করছে। তাই মহানবী (সা.) 450 জন যোদ্ধা নিয়ে শত্রু সেনাদলের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। শত্রুরা ঘাবড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিল। এ সময় মুষলধারে বৃষ্টিপাত হলে মহানবী (সা.)-এর পোশাক-পরিচ্ছদ ভিজে গেল। মহানবী তাঁর সেনাদল থেকে একটু দূরে থেকে ভিজা পোশাকটি খুলে (শুকানোর জন্য) একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। আর তিনি একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শত্রুরা পাহাড়ের ওপর থেকে মহানবীর গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল। শত্রুপক্ষীয় এক বীর যোদ্ধা এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এল। সে মহানবী (সা.)-এর মাথার ওপর তরবারি উঠিয়ে অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় বলল, আজ আমার ধারালো তরবারি থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে? মহানবী (সা.) উচ্চৈঃস্বরে বললেন, মহান আল্লাহ্। এ কথা তার মধ্যে এতটা প্রভাব ফেলল যে,সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহ কাঁপতে লাগল। এমতাবস্থায় তার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল। মহানবী তখনই উঠে দাঁড়িয়ে এ তরবারিটা হাতে নিলেন এবং তাঁকে আক্রমণ করে বললেন, এখন আমার হাত থেকে তোমার জীবন কে রক্ষা করবে? যেহেতু ঐ লোকটি ছিল মুশরিক এবং তার কাষ্ঠনির্মিত উপাস্যগুলো যে তাকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ মুহূর্তে রক্ষা করতে অক্ষম এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারল,সেহেতু সে মহানবী (সা.)-এর উত্তরে বলল, কেউ নেই।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে,ঐ লোকটি তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর ভয় পেয়ে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি। কারণ পরবর্তীকালে সে ইসলাম ধর্মের ওপর অটল ও দৃঢ় থেকেছে। তার মুসলমান হওয়ার কারণ ছিল তার নির্মল সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত) জাগ্রত হওয়া। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্বাভাবিক পরাজয় তাকে অন্য জগতের প্রতি মনোযোগী ও আগ্রহী করে তুলেছিল এবং সে নিজেও বুঝতে পেরেছিল যে,অন্য জগতের সাথে মহানবী (সা.)-এর যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে। মহানবী (সা.) ঐ লোকটির ঈমান গ্রহণ মেনে নিলেন এবং তার হাতে তার তরবারিটা ফেরত দিলেন। সে কয়েক কদম চলে যাওয়ার পর আবার ফিরে এসে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে তরবারি রেখে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং বলল, আপনি যেহেতু এ সংস্কারকামী সেনাদলের সর্বাধিনায়ক সেহেতু আপনি এ তরবারির জন্য অধিক উপযুক্ত। 609

কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার গতিপথ পরিবর্তন

লোহিত সাগরের উপকূল মুসলিম সেনাবাহিনী এবং যারা মুসলমানদের সাথে সন্ধি ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল তাদের দ্বারা (মুশরিক কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য) অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসঙ্কুল হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা পুনরায় পরামর্শ সভার আয়োজন করল এবং নিজেদের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখল। আলোচনা-পর্যালোচনা করার পর সকলেই বলল, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের পুঁজি হারাব এবং এর ফলে আমরা মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হব। আর যদি আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে মশগুল হই তাহলেও এ কাজে আমাদের সাফল্যের কোন আশা নেই। কারণ মুসলমানরা এ পথেও আমাদের বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রীগুলো জব্দ করতে পারে।

তখন তাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি ইরাকের ওপর দিয়ে শামে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। তার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। কুরাইশদের বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রী বহনকারী বাণিজ্যিক কাফেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আবু সুফিয়ান এবং সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা নিজেরাই বাণিজ্য কাফেলার তদারকি ও পরিচালনার ভার নিল। আর তারা ফুরাত ইবনে হাইয়ান নামক বনি বকর গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ বাণিজ্য কাফেলার পথপ্রদর্শক করে নিয়ে গেল।

মাকরীযী610 লিখেছেন, মদীনাবাসী এক ব্যক্তি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মদীনায় ফিরে এসে নিজ বন্ধুকে জানায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) এ ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর যায়েদ ইবনে হারেসের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী বাণিজ্য-কাফেলাকে বাধা দেয়ার জন্য প্রেরণ করেন। এ সেনাদলটি দু ব্যক্তিকে বন্দী ও বাণিজ্য কাফেলা জব্দ করার মাধ্যমে কুরাইশদেরকে নতুন পথে শামের উদ্দেশে সফর করা থেকে বিরত রাখে।

প্রথম খণ্ড সমাপ্ত