চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83765 / ডাউনলোড: 7914
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)

দ্বিতীয় খণ্ড

আয়াতুল্লাহ্ জা ফার সুবহানী

অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)

মূল : আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী

অনুবাদ : মোহাম্মদ মুনীর হোসেন খান

সম্পাদনা : অধ্যাপক সিরাজুল হক

তত্ত্বাবধানে : শাহাবুদ্দীন দারায়ী

কালচারাল কাউন্সেলর

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস,ঢাকা

প্রকাশকাল : সফর-১৪২৭,চৈত্র-১৪১২,মার্চ-২০০৬

প্রকাশনায় :

কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস

বাড়ী নং ৫৪, সড়ক নং ৮/এ ,

ধানমন্ডি আ/এ ,ঢাকা-১২০৯,বাংলাদেশ

প্রচ্ছদ:রফিকউল্লাহ গাযালী

মুদ্রণে:চৌকস প্রিন্টার্স লিঃ

১৩১ ডিআইটি এক্সটেনশন রোড (৪র্থ তলা),ঢাকা-১০০০

Chirobhashwor Mahanabi (Sm.),Bengali translation of ‘Forugh-e-Abadiyyat’ Written by: Ayatollah Jafar Sobhani;Translated by: Mohammad Munir Hossain Khan;Edited by: Abdul Muqit Chowdhury;Supervised by: Dr. Reza Hashemi,Cultural Counsellor,Embassy of the Islamic Republic of Iran,Dhaka,Bangladesh;Published on: Rabi-al-Awwal ১৪২৭,Chaitra ১৪১২,April ২০০৬.

ভূমিকা

ধর্মীয় আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার বিশেষত্ব

মহানবী (সা.)-এর জীবনী লেখার মৌলিক ও প্রাথমিক উৎস

মানব জাতিকে কল্পকাহিনী ও কুসংস্কার এবং শক্তি মদমত্তদের ক্ষমতার দাপট থেকে মুক্তিদানের জন্য মহান নবী-রাসূলগণ যে খোদায়ী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন,তা হচ্ছে সাগর তরঙ্গের মতো,যা শুরুতে একটি ছোট গোলকের আকৃতিতে সৃষ্টি হয়;এরপর ঐ গোলকের কোণ থেকে যতই দূরে সরে যায়,ততই তার ব্যাস ও পরিধি ব্যাপকতর এবং তার শক্তি তীব্রতর ও প্রচণ্ডতর হতে থাকে এবং শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করে।

পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী (সা.)-এর হাতে যে ধর্মীয় আন্দোলন ও আধ্যাত্মিক বিপ্লবের গোড়াপত্তন হয়,তা প্রথমেই হেরা গুহা,খাদীজার বাড়ি ও মক্কার জীর্ণ কুটিরগুলোকেই আলোকিত করে। সময় যত বয়ে যায়,সে আন্দোলন ততই ব্যাপকতা লাভ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত ছেয়ে ফেলে। ফলে বিশ্বের বিশাল অঞ্চল জুড়ে (ফ্রান্স থেকে চীনের প্রাচীর পর্যন্ত) তাওহীদের বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।

এ ধরনের ধর্মীয় আন্দোলনের যাঁরা গোড়াপত্তন করেন,তাঁরা শ্রেষ্ঠ নৈতিক চরিত্র ও মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী হন। ফলে সাগরের তরঙ্গমালার মতো তাঁদের ওপর যতই সময়ের প্রবাহ বয়ে যায়,তাঁদের ব্যক্তিত্ব ততই বিকশিত ও ব্যাপকতর হয়।

নবী-রাসূল অর্থাৎ ওহীর ধারক ও বাহকগণ যেন বিশ্বপ্রকৃতিরই হুবহু প্রতিলিপি। তার মানে প্রকৃতি নিয়ে যত বেশি গবেষণা ও অধ্যয়ন করা যাবে,তার গুরুত্ব ও রহস্য তত বেশি প্রকাশিত হবে এবং প্রকৃত অবস্থা ও বাস্তবতা অধিক অধিক আবিষ্কৃত হবে;ঠিক একইভাবে মহান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের জীবন নিয়ে যতই গবেষণা ও পর্যালোচনা করা হবে এবং তাঁদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি যতই গভীর হবে,তাঁদের জীবনের নিত্য-নতুন দিকও তত বেশি উদ্ঘাটিত হবে।

আমাদের এ বক্তব্যের সাক্ষী হচ্ছে সেই অগণিত রচনাসম্ভার,যা জীবনী লেখক,ইতিহাসবেত্তা ও ইলমে রিজালের গবেষকগণ ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু এ সত্বেও যতই দিন গত হচ্ছে,মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি যতই প্রসারিত হচ্ছে,গবেষকগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এই মহামানবের জীবন সংক্রান্ত নতুন নতুন দিগন্তের সন্ধান পাচ্ছেন।

শুরুতে মহানবীর জীবন ও জীবনী তাঁর সাহাবিগণের স্মৃতি ও শ্রুতির উপর নির্ভরশীল ছিল। তাঁর ওফাতের পর যখন ইতিহাসে তাবেঈন নামে পরিচিত নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে,তাঁদের সময় মহানবীর হাদীস,সুন্নাহ্ ও তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং তাঁর সময়ের যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস নতুন দীপ্তি লাভ করে। এই নতুন প্রজন্ম মহানবীর হাদীস এবং তাঁর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ রফ্ত করার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ ও আবেগ অনুভব করেন। অনুরূপভাবে এ জাতীয় ইসলামী জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস সাহাবা ও তাবেঈন যখন একের পর এক মৃত্যুবরণ করতে থাকেন,তাঁদের মৃত্যুর সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পায়,ততই মহানবীর হাদীস ও তাঁর জীবনের সকল বৈশিষ্ট্য শিক্ষা লাভের জন্য মুসলমানদের মধ্যে তীব্র পিপাসার সৃষ্টি হয় এবং তা অনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে একদল সাহাবী মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে যেসব হাদীস শুনেছিলেন,হাদীস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে দ্বিতীয় খলীফার প্রচণ্ড বাধা ও কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে সেসব তাঁদের মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পরও এ নিষেধাজ্ঞা বেশ কিছুদিন বলবৎ ছিল। অবশেষে মধ্যপন্থী উমাইয়্যা খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজ মদীনার প্রশাসক ও কাযী আবু বকর ইবনে হাযমকে একখানা পত্র লিখে মহানবীর হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। কারণ তিনি (খলীফা) জ্ঞান লোপ পাওয়া ও হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন।

সীরাত রচনায় অগ্রণীগণ

সৌভাগ্যবশত খলীফা শুধু মহানবী (সা.)-এর হাদীস লিখতে নিষেধ করেন। মহানবীর নবুওয়াতের সময়কালের ঘটনাবলী লেখার ব্যাপারে তত বেশি সীমাবদ্ধতা ছিল না। এ কারণে সেই সীমাবদ্ধতা থাকা অবস্থায়ই মহানবীর জীবন সম্পর্কে গ্রন্থাদি রচনা করা হয়। রিসালতের সময়ের ঘটনাবলী লেখকদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবী যুবাইর ইবনে আওয়ামের পুত্র উরওয়া। তিনি হিজরী ৯২ বা ৯৬ সালে ইন্তেকাল করেন। তারপর একদল মদীনায় এবং আরো কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বসরায় মহানবীর সীরাত এবং সশস্ত্র জিহাদের ঘটনাবলী সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত হন। তাঁদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব বর্ণনা আমাদের এ আলোচনার গণ্ডির বাইরে।

এসব গ্রন্থ পরবর্তীকালে মহানবী (সা.)-এর সীরাত বা ইসলামের ইতিহাস আকারে লেখা গ্রন্থাবলীর প্রাথমিক উৎসস্বরূপ। হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথমার্ধ থেকে মহানবীর জীবনী রচনার কাজটি খুব সুন্দররূপে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে শিয়া মনীষী মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (ওফাত ১৫১ হিজরী) ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব,যিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ ও রেওয়ায়েতসমূহ অবলম্বনে মহানবীর জীবনের ঘটনাবলী ও ইসলামের ইতিহাস এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ বা সমগ্র আকারে লিপিবদ্ধ করেন।

ইসলামের যুদ্ধসমূহ তথা সশস্ত্র জিহাদের বর্ণনা বিস্তারিত আকারে প্রথম লিপিবদ্ধ করেন মাগাযী ফুতূহুশ্ শাম -এর লেখক ওয়াকিদী। তিনি ২০৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

ইবনে ইসহাকের সীরাহর সারসংক্ষেপ করেন ইবনে হিশাম আবু মুহাম্মদ আবদুল মালিক (ওফাত ২১৮ হিজরী)। এ গ্রন্থ সীরাতে ইবনে হিশাম নামে বিখ্যাত। এ গ্রন্থ এখনো মহানবী (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত। এসব মনীষীর কথা বাদ দিলেও অপর দু জন মনীষীর নাম উল্লেখ করা যায়,যাঁরা মহানবীর জীবনী রচনায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

১. মুহাম্মদ ইবনে সা দ কাতিব-ই-ওয়াকিদী (আল ওয়াকিদীর সচিব)। তিনি ২৩০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তিনি তাবাকাতুল কুবরা র রচয়িতা। এ গ্রন্থে মহানবী (সা.) ও তাঁর সম্মানিত সাহাবিগণের জীবনী সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ গ্রন্থ অতীতে লন্ডনে এবং সম্প্রতি লেবাননে নয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

২. মুহাম্মদ ইবনে জরীর তাবারী (ওফাত ৩১০ হিজরী)। তিনি বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ তারিখুল উমাম ওয়াল মুলূক -এর রচয়িতা।

তাঁদের পরিশ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের অর্থ এই নয় যে,তাঁরা যা কিছু লিখেছেন,তা (সবই) সঠিক ও যথার্থ। বরং তাঁদের রচনাও অন্যান্য গ্রন্থের মতো বেশ সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের দাবী রাখে। তাঁদের পর প্রতি শতকেই মহানবী (সা.)-এর জীবনী লেখার কাজটি অব্যাহত থাকে। বর্তমান শতকেও বিভিন্ন আঙ্গিকে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মহানবীর জীবন নিয়ে বই রচনার কাজ ব্যাপকভাবে চলছে। ইসলামের মহান নবীর জীবনের যে পূর্ণাঙ্গতা,সেই বৈশিষ্ট্যর কারণেই এ কাজ অব্যাহত থাকবে।

এ গ্রন্থের  লেখক তাঁর সীমিত সামর্থ্য নিয়ে চেষ্টা করেছেন যাতে মহানবীর জীবনের একটি বিশদ ব্যাখ্যা পেশ করা যায়। এক্ষেত্রে দুই পক্ষের অর্থাৎ শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য সূত্রসমূহের শরণাপন্ন হতে কুণ্ঠিত হন নি,যদিও সূত্র উল্লেখের সময় মাক্কী সূত্রসমূহের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং প্রথম খণ্ডের শুরুতে তার কৈফিয়ত দিয়েছেন।

এ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড মহানবী (সা.)-এর তের বছরের মক্কার জীবন এবং হিজরত-পরবর্তী দু বছরের ঘটনাবলী সম্পর্কিত। এখন হিজরতের পর বাকী আট বছরের ঘটনাবলী শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গের খেদমতে পেশ করা হলো।

জাফর সুবহানী

হাওযা-ই-এলমীয়াহ্,কোম

বত্রিশতম অধ্যায় : তৃতীয় হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

উহুদ যুদ্ধ

দৃষ্টিকাড়া ঘটনাবলীর দিক থেকে হিজরতের তৃতীয় বছরটি দ্বিতীয় বছরের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হিজরী দ্বিতীয় সালে যদি বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে থাকে,তৃতীয় হিজরীতে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। দু টি যুদ্ধই ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উহুদ যুদ্ধই তৃতীয় হিজরীর একমাত্র যুদ্ধ নয়;বরং ঐ বছর কতকগুলো সারিয়াসহ বাহরান ও হামরাউল আসাদের মতো আরো কিছু গায্ওয়াহ্ (যুদ্ধ) সংঘটিত হয়। তন্মধ্যে আমরা এখানে একটি সারিয়া ও দু টি গায্ওয়ার বিবরণ পেশ করব।

মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার সারিয়া

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের খবর দু জন মুসলমান সৈনিকের মাধ্যমে মদীনায় পৌঁছে। তখনও বিজয়ী মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসেনি,ইত্যবসরে মায়ের দিক থেকে ইহুদী এবং কবিতা ও বাগ্মিতায় পারদর্শী কা ব আশরাফ মুসলমানদের এ বিজয়ে দারুণভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। সে গুজব রটনায় নেমে পড়ে এবং মদীনায় নানা অপ্রীতিকর সংবাদ ছড়ায়। সে সবসময়,এমনকি বদর যুদ্ধের আগেও তার কবিতায় মহানবী (সা.)-এর নিন্দা করত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদের উত্তেজিত করত। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের সংবাদ শুনে সে মন্তব্য করে : ভূ-গর্ভ বা মাটির তলদেশ ভূ-পৃষ্ঠ অপেক্ষা উত্তম। এরপর সে মক্কার পথে রওয়ানা হয়। মক্কায় সে কবিতা রচনা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের উত্তেজিত করে। সে মদীনায় ফিরে আসার সময় মুসলমানদের অবমাননা করার ক্ষেত্রে এতখানি বেড়ে গিয়েছিল যে,তার কবিতায় মুসলিম মহিলাদের নাম উল্লেখ করে তাঁদের ব্যাপারে অবমাননাকর মন্তব্য করে। এ ধরনের লোক সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের বাস্তব নমুনা ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত মহানবী (সা.) সিদ্ধান্ত নেন,তিনি তার অনিষ্টতা থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করবেন। তাই তার দফা রফা করার দায়িত্ব তিনি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে অর্পণ করেন। তিনি কা বকে হত্যা করার জন্য একটি চমৎকার পরিকল্পনা নেন। এর জন্য তিনি একটি দল গঠন করেন। ঐ দলে কা ব-এর দুধ-ভাই আবু নায়েলাকেও শামিল করেন যাতে করে তিনি এভাবে তাঁর পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। কা ব-এর দুধ-ভাই আবু নায়েলা কা ব-এর কাছে গেলেন। তাঁরা দু জন বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন এবং কবিতাও পাঠ করলেন। এক সময় আবু নায়েলা কা বের উদ্দেশে বললেন : আমার একটি গোপন কথা আছে,যা তোমার কাছে বলতে চাই;কিন্তু তোমাকে অবশ্যই তা গোপন রাখতে হবে। সেই গোপন কথাটি হচ্ছে এ লোকটি (রাসূল) আমাদের শহরটিকে বিপদ-আপদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। গোটা আরব জাতি আমাদের সথে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে। সবাই আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। এখন আমাদের পরিবার কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে অত্যন্ত অসহায় হয়ে গেছে।

এ সময়ে কা ব আবু নায়েলার বক্তব্যের সমর্থনে বলে : আমি এ কথাটি তোমাকে আগেও বলেছিলাম। এখন আমার কাছে কী চাও? আবু নায়েলা জবাব দিলেন : আমি কিছু খাদ্য-দ্রব্য কিনতে এসেছি। আমার যেহেতু নগদ টাকা-পয়সা নেই,আমার কাছ থেকে কিছু জিনিস বন্ধক নাও। তোমার কাছ থেকে আমি সদ্ব্যবহারই আশা করি। কা ব বলল : তুমি কি তোমার স্ত্রীদের বন্ধক রাখতে পার? আবু নায়েলা বললেন : এটা কি ঠিক হবে যে,আমার স্ত্রীদেরকে তোমার কাছে বন্ধক রাখব। অথচ তুমি হলে ইয়াসরিবের (মদীনা) একজন সুদর্শন তরুণ। তখন কা ব বলল : তা হলে তোমার ছেলেকে আমার কাছে বন্ধক রেখে যাও। নায়েলা বলল : তুমি কি আমাকে অপমানিত করতে চাও? তখন তিনি বললেন : আমি তো একা নই যে,তোমার কাছ থেকে খাদ্য-শস্য কিনতে চাই। আরো একদল লোক আমার সাথে আছে,তারাও এভাবে বন্ধক রেখে খাদ্য-শস্য কিনতে চায়। তারা তোমার কাছ থেকে খাদ্য-শস্য কিনে এর মূল্যের বিপরীতে তাদের যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রাখতে চায়। কা ব বলল : অসুবিধা নেই। অবশ্য যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রাখার প্রস্তাব ওঠানোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী বৈঠকে সশস্ত্র লোকদের দেখে সে যেন ঘাবড়ে না যায়;বরং ভাবে যে,এরা যুদ্ধাস্ত্র বন্ধক রাখার জন্য তার কাছে এসেছে।

আবু নায়েলা এরপর সেখান থেকে চলে গেলেন এবং এমন একটি দলের সাথে মিলিত হলেন যাদের সাথে কা ব-এর বাড়িতে গিয়ে খাদ্য-সামগ্রী কেনা ও অস্ত্র বন্ধক রাখার নামে উপরিউক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ছিল।

রাতের বেলা এ দলটি কা ব-এর বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তার বাড়ি ছিল একটি দুর্গের মাঝখানে। সেখানেই সে বসবাস করত। আবু নায়েলা কেল্লার দরজার বাইরে থেকে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল। কা ব দরজা খুলে দেয়ার জন্যে কক্ষের বাইরে গেল। সে সময় তার অল্পবয়ষ্কা স্ত্রী তাকে বাইরে যেতে বারণ করার চেষ্টা করছিল। সে বলছিল : আমি এই ডাকের মধ্যে বিপদের আশংকা করছি। কিন্তু কা ব দরজা খুলে দিল এবং বাহ্যত খাদ্য-শস্য কেনার জন্য আসা দলটির সাথে কথা-বার্তায় মশগুল হলো। কথা-বার্তা নানা দিক থেকে জমে উঠল এবং বেশ অন্তরঙ্গ আসরের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তখন আবু নায়েলা আনুরোধ করলেন,বাদবাকী রাত শেবুল আজূয অর্থাৎ বৃদ্ধাদের গিরিপথে গিয়ে সেখানেই খোশগল্পের আসরটা চালিয়ে যাওয়া হোক। সবাই প্রস্তাব মতো ঐ দিকে পথ চলতে লাগল। পথিমধ্যে আবু নায়েলা কা ব-এর কানের লতির চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিয়ে নাকে শুঁকে বললেন : আজ রাত পর্যন্ত এমন সুঘ্রাণ আমি কোনদিন শুঁকি নি। তিনি আরো একবার এ কাজটি করলেন। তৃতীয় বারে তিনি তাঁর হাতটি কানের লতি বরাবর চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে শক্ত মুঠি করে চুল টেনে ধরলেন এবং সঙ্গীদের বললেন : হত্যা কর। আল্লাহর দুশমনকে হত্যা কর। সাথে সাথে এই ফিতনাসৃষ্টিকারীর দেহের ওপর তরবারিগুলো পতিত হলো। তার চিৎকারে কোন লাভ হলো না। আবু নায়েলাও তাঁর হাতের ছুরিটি কা ব-এর নাভির নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে তার দফা রফা করে দিলেন। কা ব-এর লাশ মাটিতে ফেলে রেখে তাঁরা চলে এলেন। মদীনার জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে পৌঁছে সবাই তাকবীর ধ্বনি দিলেন এবং এর মাধ্যমে তাঁরা জানিয়ে দিলেন যে,তাঁদের অভিযান সফল হয়েছে। এভাবে মুসলমানদের সম্মুখ-পথ থেকে এক বিপজ্জনক উপাদান অপসারিত হলো।

আরেক দুষ্ট নিধন

ইহুদী আবু রাফেও কা ব-এর ভূমিকাই পালন করত। তার গোয়েন্দাগিরি আর উত্তেজনার বিষ ছড়ানোর মাত্রা কা ব-এর চেয়ে কম ছিল না। কা বকে হত্যার অল্প দিনের ব্যবধানেই সে নিহত হয়। এর বিবরণ ঐতিহাসিক ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।

যুদ্ধের ব্যয়ভার কুরাইশদের গ্রহণ

বহুদিন আগে থেকেই মক্কায় বিপ্লব ও বিদ্রোহের বীজ বপন করা হয়েছিল। কান্নাকাটিতে বাধাদান কুরাইশদের মাঝে প্রতিশোধের স্পৃহা তীব্রতর করেছিল। মদীনা ও ইরাকের মধ্য দিয়ে মক্কাবাসীদের বাণিজ্যপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া তাদের সাংঘাতিকভাবে অসন্তুষ্ট ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। কা ব আশরাফ অসন্তুষ্টির এ আগুনে ইন্ধন যুগিয়ে আরো প্রজ্বলিত করেছিল। এসব কারণে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ্ ও আবু জাহলের পুত্র ইকরামাহ্ আবু সুফিয়ানের কাছে প্রস্তাব দিল,যেহেতু কুরাইশ গোত্রপতি ও নেতারা এবং আমাদের বীরেরা মক্কার বাণিজ্য কাফেলার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়,কাজেই ঐ কাফেলায় যে ব্যক্তিরই ব্যবসায়িক পণ্য-সামগ্রী থাকুক,তাকে যুদ্ধের খরচ বাবদ কিছু পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। এই প্রস্তাব আবু সুফিয়ান কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা বাস্তবায়ন করা হয়। কুরাইশ নেতারা মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং নিকট থেকে তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের প্রমাণ বদরের প্রান্তরে দেখেছিল। কাজেই তারা সিদ্ধান্ত নিল,আরবের অধিকাংশ গোত্রের দক্ষ বীরদের নিয়ে গঠিত একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সাহায্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

আমর ইবনুল আস এবং আরো কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় যাতে তারা কিনানাহ্ ও সাকীফ গোত্রে গিয়ে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে। আর সেসব গোত্রের বীরদের মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নানাভাবে আহবান জানায় এবং তারা প্রতিশ্রুতি দেয়,যুদ্ধ এবং যাবতীয় সামরিক সাজ-সরঞ্জামের ব্যয়ভার কুরাইশরা বহন করবে। তারা ব্যাপক তৎপরতার মাধ্যমে কিনানাহ্ ও তিহামাহ্ গোত্র থেকে বেশ কিছুসংখ্যক বীর যোদ্ধা যোগাড় করতে এবং চার হাজার যোদ্ধার এক বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।১০

যা কিছু বলা হলো,তা ঐসব লোকের সংখ্যা যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের যদি গণনায় নেয়া হয়,তা হলে সংখ্যা অনেক বেশি হবে। আরবদের মধ্যে এ প্রথার প্রচলন ছিল না যে,তারা মহিলাদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাবে। কিন্তু এবার কুরাইশদের মূর্তিপূজারী মহিলারাও পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আসে।

যুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল এই যে,সৈন্যদের সারিগুলোর মাঝে তারা ঢোল-তবলা বাজাবে আর কবিতা পাঠ করবে এবং উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে পুরুষদের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উৎসাহ যোগাবে।

মহিলাদের যুদ্ধের ময়দানে আনার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল (সৈনিকদের) যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবার পথ বন্ধ করা। কেননা,যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর অর্থ ছিল তাদের স্ত্রী ও মেয়েদের বন্দী হবার ব্যবস্থা করা,আর আরবদের যে সাহসিকতা ও জাত্যাভিমানবোধ ছিল,তা কিছুতেই এমন কাজ করার প্রশ্রয় দিত না।

বহু ক্রীতদাস নানা ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি পেয়ে কুরাইশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। হাবশী গোলাম ওয়াহ্শী ইবনে হারব ছিল মুত্ইমের ক্রীতদাস। যুদ্ধাস্ত্র যুবীন ব্যবহারে সে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। তাকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল,যদি সে ইসলামের প্রধান তিন ব্যক্তির (মুহাম্মদ-আলী-হামযা) মধ্য হতে কোন একজনকে হত্যা করতে পারে,তা হলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। মোটকথা অনেক কষ্টে তারা একটি সেনাবাহিনী গঠন করে যেখানে সাত শ বর্মধারী সৈনিক,তিন হাজার উট,দু শ অশ্বারোহী ও একদল পদাতিক সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মহানবী (সা.)-এর গোপন গোয়েন্দা

তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়,মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাস ছিলেন একজন সত্যিকারের মুসলমান। কিন্তু তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখেন। তিনি কুরাইশদের যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে মহানবীকে অবহিত করেন। আব্বাস তাঁর স্বাক্ষর ও মোহরযুক্ত একখানা পত্র স্বহস্তে লিখে তা বনী গিফার গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে অর্পণ করে প্রতিশ্রুতি নেন,তিন দিনের মধ্যে পত্রটি মহানবীর হাতে পৌঁছে দেবে। পত্রবাহক এমন সময় পত্রটি পৌঁছে দেয় যখন মহানবী শহরের বাইরে এক বাগানে অবস্থান করছিলেন। লোকটি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে খামে বন্ধ পত্রটি মহানবীর হাতে অর্পণ করে। মহানবী পত্রটি পড়লেন;কিন্তু পত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সাহাবিগণকে কিছুই বললেন না।১১

আল্লামা মাজলিসী১২ ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণনা করেন,মহানবী (সা.) পত্র লিখতেন না;কিন্তু পাঠ করতেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না,মহানবী অবিলম্বে শত্রুদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর সঙ্গীদের অবহিত করার তাকীদ অনুভব করেন। কাজেই মদীনা নগরীতে ফিরে আসার পর সবার উদ্দেশে পত্রটি পাঠ করা হয়।

কুরাইশ বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা

কুরাইশ বাহিনী যাত্রা করে কিছু দূর অতিক্রম করার পর আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছে,যেখানে মহানবীর মা হযরত আমেনাকে দাফন করা হয়েছিল। কুরাইশ বাহিনীর অস্থির-মস্তিষ্ক যুবকরা চাচ্ছিল,মহানবীর মায়ের কবর খনন করবে এবং তাঁর লাশ বের করে আনবে। কিন্তু তাদের মধ্যকার দূরদর্শী লোকেরা এই কাজের তীব্র নিন্দা করে। তারা বলল,এমন কাজ করলে তা পরবর্তীতে প্রথায় পরিণত হতে পারে,আর তখন বনী বকর ও বনী খোজাআ গোত্রভুক্ত আমাদের শত্রুরা আমাদের মৃত লোকদের কবর খুঁড়ে লাশ বের করতে পারে।

মহানবী (সা.) হিজরী তৃতীয় সালের ৫ শাওয়াল বৃহস্পতিবার রাতে ফুজালার পুত্র আনাস ও মুনিসকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মদীনার বাইরে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল,কুরাইশদের গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর নিয়ে আসা। ঐ দু জন যুবক সংবাদ নিয়ে এল,কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছেছে এবং তাদের বাহনগুলোকে মদীনার কৃষিভূমিতে চরার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। হাব্বাব ইবনে মুনযির সংবাদ নিয়ে এল,কুরাইশ বাহিনীর অগ্রবর্তী দল মদীনার নিকটবর্তী হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ কথার আরো সমর্থন পাওয়া গেল যে,মদীনার দিকে কুরাইশ বাহিনী আরো এগিয়ে এসেছে এবং উহুদ পর্বতের পাদদেশে তারা সেনা মোতায়েন করেছে। মুসলমানরা আশংকা করছিল,কুরাইশ বাহিনী রাতের বেলা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিসাধন করবে। এ কারণে আউস ও খাযরাজ গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে মসজিদে অবস্থান করে। রাত কেটে দিনের আলো বের হওয়া এবং যুদ্ধের কৌশলগত দিক থেকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তারা মহানবীর বাসগৃহ এবং মদীনা নগরীর প্রবেশদ্বারগুলো পাহারা দিচিছল।

উহুদ প্রান্তর

যে দীর্ঘ ও বিশাল উপত্যকা শামের বাণিজ্য-পথকে ইয়েমেনের সাথে যুক্ত করেছিল,সেই উপত্যকাকে ওয়াদিউল কুরা নামে অভিহিত করা হতো। এখানকার যেখানেই বসতি স্থাপন করা সম্ভবপর ছিল,সেখানেই বিভিন্ন আরব ও ইহুদী গোত্র বসতি স্থাপন করেছিল। এদিক থেকে উপত্যকা জুড়ে বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম গড়ে উঠেছিল,যেগুলোর চতুর্দিক পাথর দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। এসব জনপদের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত হতো ইয়াসরিব যা মদীনাতুর রাসূল বা সংক্ষেপে মদীনা নামে অভিহিত হয়। মক্কা থেকে মদীনায় কেউ এলে তাকে অবশ্যই দক্ষিণ দিক থেকে এই কেন্দ্রীয় জনপদে প্রবেশ করতে হতো। কিন্তু এলাকাটি পাথুরে ও কংকরময় ছিল বলে সেখানে সৈন্য পরিচালনার কাজটি কষ্টকর ছিল। কুরাইশ বাহিনী যখন মদীনার কাছাকাছি পৌঁছে,তখন যাত্রাপথ থেকে সরে এসে মদীনার উত্তর দিকে আকীক উপত্যকায় উহুদ পর্বতের পাদদেশে সেনা মোতায়েন করে। খেজুর বাগান এবং সমতলভূমি না থাকায় জায়গাটি সব ধরনের সামরিক তৎপরতার জন্য উপযোগী ছিল। এদিক থেকেই মদীনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। কেননা এই এলাকায় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অপেক্ষাকৃত কমই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।

কুরাইশ বাহিনী তৃতীয় হিজরীর 5 শাওয়াল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উহুদ পর্বতের পাদদেশে শিবির স্থাপন করে। মহানবী (সা.) সেই দিন এবং শুক্রবার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) মদীনায় অবস্থান করেন এবং শুক্রবার সামরিক পরামর্শ সভা ডাকেন। তিনি প্রতিরক্ষার কৌশল ও ধরন সম্পর্কে দূরদর্শী ব্যক্তি ও সমরবিশেষজ্ঞগণের সাথে পরামর্শ করেন।

প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ

মহানবী (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ-সামরিক ও এ জাতীয় অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গিগণের সাথে পরামর্শ করতে হবে এবং নিজের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে,যাতে করে তিনি এ কাজের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের জন্য একটি মহান আদর্শ ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন এবং সাহাবিগণের মাঝে গণমতসহ সত্যান্বেষণ এবং বাস্তবদর্শিতার মনোবৃত্তির উন্মেষ ঘটান। তবে এ ধরনের পরামর্শের দ্বারা কি মহানবী লাভবান হতেন? তাঁদের (সঙ্গী-সাথীদের) পরামর্শে তাঁর কি কোন উপকার হতো? ইলমে কালাম-এর মহীরূহ হিসেবে স্বীকৃত মনীষীগণ এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিশদভাবে জানতে হলে সম্মানিত পাঠকদের ধর্মতত্ত্ববিদগণের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের শরণাপন্ন হতে হবে।13

এসব পরামর্শ একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া যা মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত হিসেবে আজও বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর এ পদ্ধতি এতটা শিক্ষণীয় ও প্রভাবশালী ছিল যে,তাঁর ইন্তিকালের পর ইসলামের খলীফাগণ এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তাঁরা সামরিক বিষয় ও সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে আমীরুল মুমিনীনের সমুন্নত চিন্তা ও মতামতকে পুরোপুরি স্বাগত জানিয়েছেন।14

সামরিক পরিষদ

সেখানে সমবেত ইসলামী বাহিনীর বীর সৈনিক ও সেনাপতিগণের এক বিরাট সমাবেশে মহানবী (সা.) বলিষ্ঠ কণ্ঠে আহবান জানালেন : সেনাপতি ও সৈনিকরা! তাওহীদের চৌহদ্দির মধ্যে কুরাইশ বাহিনীর পক্ষ থেকে যে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে,তা প্রতিরোধ পদ্ধতি কী হতে পারে,সে সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত কর।

মদীনার মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই দুর্গ রক্ষার প্রস্তাব উত্থাপন করল। দুর্গ রক্ষার প্রস্তাব দানের উদ্দেশ্য ছিল এই যে,মুসলমানরা যেন মদীনার বাইরে না যায়;দালান-কোঠা ও বাড়ির ছাদ ব্যবহার করে যেন তারা যুদ্ধ করে। মহিলারা ঘরের ছাদ ও উঁচু দালান থেকে দুশমনের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবে,আর পুরুষরা রাস্তায় রাস্তায় হাতাহাতি যুদ্ধ করবে।

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই তার কথা এভাবে শুরু করে : আমরা অতীতে দুর্গ রক্ষার কৌশল ব্যবহার করতাম। মহিলারা ঘরের ছাদ থেকে আমাদের সাহায্য করত। এ কারণেই ইয়াসরিব নগরী এখনো অক্ষত রয়েছে। শত্রুরা এ পর্যন্ত এ নগরী দখল করতে পারে নি। যখনই প্রতিরক্ষার জন্য আমরা এ পন্থা গ্রহণ করেছি,বিজয়ী হয়েছি। আর যখনই শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করেছি,ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।

মুজাহিদ ও আনসারগণের মধ্যকার বয়ষ্ক ব্যক্তিরা এ প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তরুণরা,বিশেষ করে যারা বদরের যুদ্ধে অংশ নেয় নি এবং যাদের মাথায় যুদ্ধের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল,তারা এ প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করছিল এবং বলছিল : প্রতিরক্ষার এ কৌশল শত্রুদের সাহস বাড়িয়ে দেবে। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা যে গৌরবের অধিকারী হয়েছিল,তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এটা কি দূষণীয় নয় যে,আমাদের বীর সেনানী এবং আত্মোৎসর্গকারী যোদ্ধারা ঘরে বসে থেকে শত্রুকে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে? আমরা বহুদিন থেকে এমন দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন সে সুযোগ আমাদের সামনে উপস্থিত। ইসলামের সাহসী বীর সেনাধ্যক্ষ হামযাহ্ বললেন : সেই মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি,যিনি পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। শহরের বাইরে গিয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত আজ খাদ্য গ্রহণ করব না। শেষ কথা হলো ইসলামী সেনাবাহিনীকে নগরীর বাইরে যেতে এবং নগরীর বাইরে গিয়েই শত্রুর সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।15

শাহাদাতের জন্য লটারী

জাগ্রত ও প্রাণবন্ত হৃদয়ের অধিকারী বৃদ্ধ খুসাইমাহ্ দাঁড়িয়ে বললেন : হে রাসূলাল্লাহ্! কুরাইশরা পুরো একটি বছর চেষ্টা করে আরব গোত্রগুলোকে নিজেদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে। যদি আমরা এ নগরী রক্ষার জন্য বাইরে না যাই,তা হলে তারা মদীনা অবরোধ করবে। তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে মক্কায় ফিরে যেতেও পারে। কিন্তু এ কাজই তাদের স্পর্ধার কারণ হবে। আমরা ভবিষ্যতে তাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারব না। আমি এজন্য আফসোস করছি,বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয় নি,যদিও আমি এবং আমার সন্তান আন্তরিকভাবেই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছিলাম। আমরা উভয়ে এ সৌভাগ্যের ব্যাপারে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছিলাম।

শেষ পর্যন্ত সে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে এবং আমি সফল হই নি। আমি বদর যুদ্ধে আমার ছেলেকে বলেছিলাম,তুমি তরুণ,তোমার বহু চাওয়া-পাওয়া আছে। তুমি তোমার যৌবনকালকে এমন পথে ব্যয় করতে পার যে পথে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু আমার জীবন তো ফুরিয়ে এসেছে। আমার ভবিষ্যত পরিষ্কার নয়। আমার এই পবিত্র জিহাদে (বদর যুদ্ধে) অংশগ্রহণ করতে হবে। তুমি আমার স্থানে থেকে আমার পরিবার-পরিজনের দেখাশুনার দয়িত্ব পালন কর। কিন্তু এ ব্যাপারে তার প্রচণ্ড আগ্রহ ও প্রচেষ্টা এত অধিক ছিল যে,দু পক্ষ লটারী করতে বাধ্য হলাম। লটারীতে তার নাম ওঠে। সে বদর যুদ্ধে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে। গত রাতে এ দুর্গের সর্বত্র কুরাইশদের অবরোধ নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সে চিন্তা নিয়েই আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার প্রিয় সন্তানকে স্বপ্নে দেখতে পেলাম। সে বেহেশতের বাগানসমূহে পায়চারী করছে। সে সেখানকার ফলমূল খাচ্ছে। সে ভালোবাসায় ভরা ব্যাকুল কণ্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল : আব্বাজান! আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। হে রাসূলাল্লাহ্! আমার দাঁড়ি সাদা এবং আমার হাঁড়গুলো দুর্বল হয়ে গেছে। আমার একান্ত অনুরোধ,আমার জন্য আপনি আল্লাহর দরবারে শাহাদাত লাভের দুআ করুন। 16

ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের আত্মত্যাগী ও শাহাদাত পিপাসু বহু ব্যক্তিত্বকেই দেখতে পাওয়া যায়। যে আদর্শ অস্তিত্বশীল জগতের উৎসমূল ও পরকালের আদর্শে বিশ্বাসী নয়,সে আদর্শের পক্ষে খাইসামার মতো আত্মত্যাগী বীর যোদ্ধা সৃষ্টি করা সহজ কাজ নয়।

এ বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের মনোবল,এ ত্যাগ ও প্রাণপণ সংগ্রাম-যা একজন যোদ্ধা মহান আল্লাহর বাণী ও তাওহীদী ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং শাহাদাত লাভের পথে ক্রন্দন করার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা করে,তা মহান নবিগণের আদর্শ ছাড়া দ্বিতীয় কোন আদর্শে পাওয়া সম্ভব নয়।

আজকের বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা ও অধিনায়কদের জীবন-মানের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এ সত্বেও যুদ্ধগুলোয় যেহেতু তাদের লক্ষ্য থাকে বিদ্যমান অবস্থা বহাল রাখা বা আরো উন্নত জীবনের অধিকারী হওয়া,সেহেতু তাদের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু মহান নবিগণের আদর্শে লড়াই করতে হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শাহাদাতই একমাত্র পথ। তাই আল্লাহর সৈনিকরা কোন ভয়-ভীতি ছাড়াই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজেদের সব ধরনের বিপদের মুখে সঁপে দেয়।

শূরা বা পরামর্শ সভার ফলাফল

মহানবী (সা.) অধিকাংশের মতামতকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেন। তিনি নগরীর বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করাকে দুর্গ রক্ষা এবং হাতাহাতি লড়াই বা মল্লযুদ্ধের ওপর স্থান দেন। আসলে হামযাহ্ ও সা দ ইবনে উবাদার মতো সেনাধ্যক্ষগণের পক্ষ হতে জোর দাবি ওঠার পর মদীনার চিহ্নিত মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের মতামত গ্রহণ ও অগ্রাধিকার প্রদান করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

এসব ছাড়াও মদীনার সরু অলি-গলিতে বিশৃঙ্খল হাতাহাতি লড়াই,নারীদের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োগ,নিজেরা ঘরে বসে থেকে শত্রুর জন্য প্রবেশপথ খুলে দেয়া মুসলমানদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের পরিচায়ক ছিল।

বদর যুদ্ধে যেভাবে শক্তির মহড়া দেয়া হয়েছে,তার সাথে কোনভাবেই এগুলো তুলনীয় ও সংগতিশীল ছিল না। মদীনা অবরোধ,শহরের প্রবেশপথে শত্রুসেনা মোতায়েন হওয়া ও তাদের মুকাবিলায় ইসলামের সৈনিকদের নির্বিকার থাকা ইসলামের মুজাহিদগণের শৌর্য-বীর্যের চেতনা ও মনোবল ধ্বংস করে দিত।

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি দুরভিসন্ধি এঁটেছিল। হয় তো তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবীর ওপর একটি মারাত্মক আঘাত হানা। মহানবী যুদ্ধের পোশাক পরিধান করলেন এবং প্রতিরক্ষার কৌশল নির্ধারণের পর বাড়ির ভেতর গেলেন। তিনি বর্ম পরলেন এবং তরবারী ঝুলিয়ে নিলেন। পিঠের উপর একখানা ঢাল,কাঁধে একটি ধনুক ঝুলিয়ে এবং হাতে বল্লম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

এ দৃশ্য দেখে মুসলমানরা প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হলেন। কেউ কেউ ধারণা করলেন,নগরীর বাইরে যাবার জন্য তারা যে পীড়াপীড়ি করেছেন,তাতে তাঁর সম্মতি ছিল না। তাঁরা অনর্থক তাঁকে মদীনার বাইরে যেতে বাধ্য করেছেন। এ কারণে তাঁরা দোষ স্বীকারের উদ্দেশ্যে আরজ করলেন : আমরা প্রতিরক্ষার কৌশলের ক্ষেত্রে আপনার মতামতের অধীন। বাইরে যাওয়া যদি কল্যাণকর না হয়,তা হলে আমরা এখানেই অবস্থান করব। মহানবী বললেন :

ما ينبغى لنبِى إذا لبس لامته أن يضعها حتّي يُقاتل

কোন নবী যখন বর্ম পরিধান করেন,তখন শত্রুর সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত তা খুলে ফেলা উচিত নয়। 17

মহানবী (সা.)-এর মদীনার বাইরে গমন

মহানবী (সা.) জুমআর নামায আদায় করেন এবং এক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী সাথে নিয়ে উহুদের উদ্দেশে মদীনা ত্যাগ করেন। তিনি উসামাহ্,যাইদ ইবনে হারিসাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের মতো যারা অল্পবয়স্ক ছিল,তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুমতি দিলেন না;কিন্তু সুমরা রাফে নামের অনূর্ধ 15 বছরের দুই কিশোরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন। কেননা তারা ছোট হলেও তীর নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিল।

ইতোমধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ একদল ইহুদী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মহানবী বিশেষ বিবেচনার কারণে তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন নি। মাঝপথে ইসলামী বাহিনী যখন মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শওত নামক স্থানে পৌঁছল,তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-মহানবী (সা.) যুবকদের মতামত গ্রহণ করেছেন,তার মতামতকে গুরুত্ব দেন নি-এ অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। শুধু তা-ই নয়,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের স্বগোত্রীয় আউস গোত্রের তিন শ ব্যক্তি মাঝপথ থেকে ফিরে যায়। কাজেই এ যুদ্ধে না ইহুদীরা অংশগ্রহণ করেছে,না মুনাফিক গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছে।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ চেয়েছিলেন,নিকটতম পথ অতিক্রম করে নিজস্ব সেনাশিবিরে গিয়ে পৌঁছবেন। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তিনি মুরাব্বা নামক এক মুনাফিকের বাগান অতিক্রম করে যেতে বাধ্য হন। তার ভূ-সম্পত্তিতে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করায় একগুঁয়েমিবশত সে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। এমনকি সে মহানবীর প্রতি বেয়াদবীপূর্ণ উক্তিও করে। মহানবীর সাহাবীগণ তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বললেন : এই অন্ধ হৃদয়ের অধিকারী গোঁয়ার লোকটিকে বাদ দাও। 18

দু জন আত্মোৎসর্গী সৈনিক

মহানবী (সা.) এক জায়গায় তাঁর সৈনিকদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। তাদের আত্মোৎসর্গী অবয়ব ও উজ্জ্বল চেহারা তরবারির ঝলকানির মাঝে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে চমকাচ্ছিল। মহানবী ইসলাম ধর্মের প্রতিরক্ষার জন্য যে সেনাবাহিনী উহুদ প্রান্তরে নিয়ে এসেছেন,বয়সের দিক থেকে তাদের মধ্যে অনেক তারতম্য ছিল। অনেকেই ছিলেন বয়ষ্ক,আবার একদল ছিলেন আত্মোৎসর্গী যুবক,যাদের বয়স 15 বছর অতিক্রম করে নি।

তাদের প্রেরণার একমাত্র উৎস পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ও আগ্রহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না,যা তাওহীদী আদর্শ রক্ষা করার আলোকে তাদের মধ্যে অস্তিত্ব লাভ করেছিল ও বিদ্যমান ছিল। বিষয়টি প্রমাণের জন্য আমরা এক বৃদ্ধ ও এক তরুণের কাহিনী তুলে ধরব,যার সদ্য বিয়ের পর একটি মাত্র রাত অতিক্রান্ত হয়েছিল।

1. আমর ইবনে জমূহ : বয়সের ভারে ন্যূজ বৃদ্ধ;দৈহিক শক্তি বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। একটি ঘটনায় তাঁর এক পায়ে আঘাত লেগেছিল। তিনি তাঁর সাহসী চার পুত্রসন্তানকে ইসলাম ধর্ম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করেন। তাঁর হৃদয় শুধু এ কারণে আলোকিত হয়েছিল যে,তাঁর সন্তানরা সত্যের পথে তরবারি চালনা করছে।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন,যুদ্ধ থেকে তাঁর দূরে থাকা অন্যায় হবে। কেন তিনি এমন সৌভাগ্য হাতছাড়া করবেন? তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছিল। তারা জোরালো ভাষায় বলছিল : ইসলামের বিধি-বিধান আপনার কাঁধ থেকে সব ধরনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে অর্থাৎ আপনাকে অব্যাহতি দিয়েছে। তাদের কথা এ বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তিনি নিজেই মহানবীর নিকট উপস্থিত হন এবং বলেন : আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে জিহাদের ময়দানে যেতে বাধা দিচ্ছে। আপনার মত কী? আমার মনে শাহাদাত লাভ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। আমি বেহেশতের দিকে উড়ে যেতে চাই। মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন :

اما انت فقد عذرك الله و لا جهاد عليك

মহান আল্লাহ্ আপনাকে অপারগ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার কোন দায়িত্ব নেই। 19

তিনি অনুরোধের পর অনুরোধ করেন;কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে বেষ্টন করে রেখেছিল। মহানবী তাঁর আত্মীয়-স্বজনের উদ্দেশে বললেন : যে ইসলামের রাস্তায় শাহাদাতের শরবত পান করতে চায়,তাকে তোমরা বাধা দিও না। অতঃপর তিনি বাড়ি ত্যাগ করে রওয়ানা হন এবং রওয়ানা হওয়ার সময়ে বলেন :

اللهم ارزقنِى الشهادة و لا تردّنِى إلى أهلى

  হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার রাস্তায় শহীদ হবার তওফীক দাও। আমাকে আর ঘরে ফিরিয়ে এনো না।

উহুদ যুদ্ধের উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোর অন্যতম ছিল এই বৃদ্ধ খোঁড়া লোকটির বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ। তিনি খোঁড়া পায়ে আক্রমণ করছিলেন এবং বলছিলেন : আমার প্রত্যাশা বেহেশত। তাঁর এক ছেলেও পিতার পেছনে পেছনে চলছিল। দু জনই এত প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করেন যে,উভয়ে শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর অপর ভাই আবদুল্লাহ্ও এ যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করেন।20

2. হানযালা : তিনি ছিলেন এমন এক যুবক যাঁর জীবন-বসন্ত থেকে 24 বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয় নি। তিনিيُخرج الحىّ من الميّت তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন অর্থাৎ অপবিত্র পিতাদের থেকে পবিত্র সন্তানদের সৃষ্টি করেন-এ আয়াতের বাস্তব নমুনা ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর শত্রু আবু আমীরের সন্তান ছিলেন। সে ছিল ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত,যারা ইসলাম ধর্মের অনিষ্ট কামনা করত। সে মহানবীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধের উস্কানিদাতাদের মধ্যে গণ্য ছিল। সে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করার ব্যাপারে অবহেলা করে নি। সে মসজিদে যেরার ঘটনার অন্যতম নায়ক ছিল। (আমরা নবম হিজরীর ঘটনাবলীর বিবরণে সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পেশ করব।)

সন্তানের পিতার প্রতি যে আবেগ,তা কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে উহুদের ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হানযালাকে বাধা দেয় নি। উহুদ যুদ্ধের আগের রাতটি ছিল তাঁর বিয়ের রাত। আউস গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বাধ্য হয়ে ঐ রাতেই তাঁকে বাসর রাতের অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করতে হয়েছিল।

যুদ্ধের ডাক তাঁর কানে এসে বাজলে তিনি অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের সামনে উপস্থিত হয়ে একটি রাত মদীনায় অবস্থান করা এবং পরের দিনই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাওয়া ছাড়া তিনি আর কোন উপায় দেখতে পেলেন না। মরহুম মাজলিসীর বর্ণনা অনুযায়ী নিম্নের আয়াত তাঁর শানেই নাযিল হয়েছে21 :

) إنّما المؤمنون الّذين آمنوا بالله و رسوله و إذا كانوا معه علي أمر جامع لم يذهبوا حتّي يستأذنوه إنّ الّذين يستأذنونك أولئك الّذين يُؤمنون بالله و رسوله فإذا استأذنوك لبعض شأنهم فأذن لمن شئت منهم(

ঐ লোকেরাই মুমিন যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর যখন কোন সাধারণ জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কাজের জন্য তাঁর কাছে সবাই উপস্থিত হয়,তখন তাঁর অনুমতি গ্রহণ ব্যতীত তারা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। যারা আপনার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করে,তারাই আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে। যদি তারা তাদের কোন বিশেষ বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নেয়,তা হলে তাদের মধ্যে যাকে আপনার ইচ্ছা তাকে অনুমতি দিন। 22

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য রাসূল তাঁকে এক রাতের অনুমতি দান করেন। পরদিন সকালে হানযালা জানাবতের (যৌন কারণে অপবিত্রতার) গোসল না করইে ময়দানে ছুটে যান। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নববধূ-যার সাথে দাম্পত্য জীবনের মাত্র একটি রাত অতিবাহিত হয়েছিল-তাঁর দু চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। স্বামীর কাঁধে হাত রেখে অনুরোধ করলেন- আর কিছুক্ষণ থাক । তিনি যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত চার জন পুরুষকে সাক্ষী করলেন যে,বিগত রাতে তাঁর ও তাঁর স্বামীর মধ্যে মিলন হয়েছে।

হানযালা বাড়ী থেকে রওনা হন। নববধূ ঐ চার ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন : গতকাল আমি স্বপ্ন দেখেছি যে,আকাশ ফেটে গেছে এবং আমার স্বামী তাতে প্রবেশ করছেন। এরপর ফাটলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ স্বপ্ন দেখে আমি মনে করছি যে,আমার স্বামীর রূহ্ ঊর্ধ্ব আকাশ পানে পাড়ি জমাবে এবং তিনি শাহাদাতের শরবত পান করবেন।

হানযালা সেনাদলে শামিল হন। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আবু সুফিয়ানের প্রতি,যে দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানে টহল দিচ্ছিল। তিনি বীরত্বপূর্ণ হামলা চালিয়ে আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে তরবারির আঘাত হনলেন। কিন্তু তরবারি আঘাত করল আবু সুফিয়ানের ঘোড়ার পিঠে। আর আবু সুফিয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হৈ চৈ শুনে কুরাইশ বাহিনীর একদল সৈন্য তাকে ঘিরে ধরল। শাদ্দাদ লাইসী হানযালার ওপর হামলা করল। এ হামলার ফলে হানযালার হাত থেকে আবু সুফিয়ান রেহাই পেল। কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে বর্শাধারী এক সৈনিক হানযালার ওপর হামলা করল এবং তাঁর দেহে বর্শা ঢুকিয়ে দিল। হানযালা সেই যখম নিয়েই বর্শাধারীকে ধাওয়া করলেন এবং হাতের তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করলেন। তিনি নিজেও আঘাতের কারণে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

মহানবী (সা.) বলেছেন : আমি দেখতে পেলাম,ফেরেশতারা হানযালাকে গোসল দিচ্ছে। এ কারণে তাঁকেغسيل الملائكة গাসীলুল মালাইকাহ্ (ফেরেশতারা যাঁর লাশের গোসল দিয়েছে এমন ব্যক্তি) নামে আখ্যায়িত করা হয়। আউস গোত্র তাদের গৌরব কীর্তির কথা স্মরণ করলে এভাবে বলত :و منّا حنظلة غسيل الملائكة আমাদের মাঝে আছেন হানযালা,যাঁকে ফেরেশতারা গোসল দিয়েছিলেন।

আবু সুফিয়ান বলত : তারা যেহেতু বদর যুদ্ধে আমার ছেলে হানযালাকে হত্যা করেছে,সেহেতু আমিও উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের হানযালাকে হত্যা করেছি।

এই বর ও নববধূর ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক। কেননা তাঁরা ছিলেন সত্যের পথে কুরবান;অথচ নববধূ ও বর উভয়ের পিতারা ছিল ইসলামের চরম শত্রু। নববধূর পিতা ছিল মদীনার মুনাফিকদের সরদার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ইবনে আবী সালল। আর হানযালা ছিলেন জাহিলী যুগের পুরোহিত আবু আমীরের সন্তান। ইসলামের (চূড়ান্তভাবে) আবির্ভাবের পরে আবু আমীর মক্কার মুশরিকদের দলে যোগ দেয় এবং হিরাক্লিয়াসকে তরুণ ইসলামী হুকুমতকে ধ্বংস করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

দুই বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি

তৃতীয় হিজরীর 7 শাওয়াল ভোরে ইসলামী সেনাবাহিনী কুরাইশদের আগ্রাসী বাহিনীর মুকাবিলায় নিজেদের সারিবদ্ধ করে। ইসলামী সেনাবাহিনী এমন স্থানে মোতায়েন করা হয়,যার পশ্চাতে একটি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরক্ষা ব্যূহ অর্থাৎ উহুদ পর্বত ছিল। কিন্তু পাহাড়ের মাঝখানে একটি বিশেষ ফাটল ছিল। তাতে আশংকা ছিল,শত্রুবাহিনী উহুদ পর্বতের পেছন দিক থেকে এসে পাহাড়ের ঐ ফাটল বা গিরিপথ দিয়ে পেছন থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর হামলা করে বসতে পারে।

মহানবী (সা.) এ আশংকা দূর করার জন্য টিলার উপরে দুই দল তীর নিক্ষেপকারী সেনা মোতায়েন করেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরকে তাদের অধিনায়ক নিযুক্ত করে নির্দেশ দেন : তোমরা তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদের তাড়িয়ে দেবে। পেছন থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার সুযোগ দেবে না। আমাদের ওপর যেন তারা অতর্কিতে আক্রমণ করতে না পারে। আমরা যুদ্ধে জয়ী হই বা পরাজিত হই,তোমরা এ স্থান ছেড়ে চলে আসবে না। 23

উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে,এই গিরিপথটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ছিল। জয় লাভের পর মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটেছিল এ কারণে যে,(গিরিপথে মোতায়েন) তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিল এবং স্পর্শকাতর বাঙ্কারটি তারা ছেড়ে দিয়েছিল। এর ফলে পরাজিত পলাতক শত্রুবাহিনী সেই গিরিপথের পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে।

মহানবী (সা.) যে তীর নিক্ষেপকারী মুসলিম সেনাদের কোন অবস্থায়ই গিরিপথের মুখের অবস্থান ত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন,তা প্রমাণ করে যে,তিনি সামরিক কৌশল সম্পর্কে পূর্ণরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয়েছে যে,সেনাধিনায়কের সামরিক মেধা,দক্ষতা ও বিচক্ষণতাই বিজয়ের একমাত্র গ্যারান্টি নয়,যদি অধীন সৈনিকরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53