চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83922 / ডাউনলোড: 7971
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

প্রাচ্যবিদগণ এবং হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশের বিয়ে

যাইদ ইবনে হারিসার আগের স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশের সাথে মহানবীর বিয়ে একটি সাদামাটা ও সব ধরনের অস্পষ্টতা থেকে মুক্ত বিষয়। তবে যেহেতু কতিপয় প্রাচ্যবিদ সরলমনা ও অনবহিত লোককে ধোঁকা দেয়া ও বিভ্রান্ত করার জন্য এ ঘটনাকে দলিল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে এবং এভাবে মহানবীর জীবন-চরিত সম্পর্কে যাদের সঠিক জ্ঞান নেই,তাদের ঈমান দুর্বল করার চেষ্টা করেছে,সেহেতু এ গোষ্ঠীটির বক্তব্য উল্লেখ করে এ বিষয়টি অধ্যয়ন করব।

বলার অপেক্ষা রাখে না,প্রাচ্যের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ কেবল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে না,বরং কখনো কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার ধুয়ো তুলে প্রাচ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং সূক্ষ্ম পরিকল্পনা সহ সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ের দাসত্ব অর্থাৎ চিন্তামূলক দাসত্ব বাস্তবায়িত করে। আসলে প্রাচ্যবিদ হচ্ছে ঐ সাম্রাজ্যবাদী,যে এক বিশেষ ভাবমূর্তি নিয়ে সমাজের অভ্যন্তরে এবং বুদ্ধিজীবীদের মাঝে কর্মতৎপরতা শুরু করে এবং শিক্ষিত ও সুধী শ্রেণীর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে নিজস্ব উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে।

অনেক সুধী লেখক এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-প্রেমিক আমাদের এ বক্তব্য গ্রহণ করতে নাও পারেন এবং আমাদেরকে গোঁড়া’ ও প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে অভিযুক্ত করতে পারেন। তাঁরা ভাবতে পারেন,জাতিগত (সাম্প্রদায়িক) বা ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের পাশ্চাত্য সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতে প্ররোচিত করেছে। তবে প্রাচ্যবিদদের রচনাবলী এবং ইসলামের ইতিহাসের ব্যাপারে তাদের সত্য গোপন রাখা এবং উদ্দেশ্যমূলক আচরণ এ বিষয়ের উজ্জ্বল দলিল যে,তাদের অনেকের মাঝেই জ্ঞানগত উদ্দেশ্য খুব কম এবং তাদের রচনাবলী কতকগুলো ধর্মবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা মিশ্রিত।১০৬

এর প্রমাণ হচ্ছে আমাদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু। তারা পশ্চিমা ধাঁচের ধারণার বশবর্তী হয়ে এ বিয়ে-যা একটি ভ্রান্ত জাহিলী প্রথা বিলোপ করার জন্য বাস্তবায়িত হয়েছিল,তা পরকীয়া ও প্রণয়াসক্তির রঙে রাঙিয়েছে এবং ঔপন্যাসিক ও গল্পকারদের মতো যতটা সম্ভব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটি বানোয়াট ইতিহাস বর্ণনা করেছে এবং তা মানব জাতির সবচেয়ে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত করে তাঁর পবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে।

যা হোক,তাদের এ ভিত্তিহীন উপাখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে ঐ সব বর্ণনা যেগুলো ইবনে আসীর১০৭ ,তাঁর পূর্বে তাবারী এবং আরো কতিপয় মুফাসসির বর্ণনা করেছেন। আর তা হলো : একদিন অনিচ্ছাকৃতভাবে মহানবীর দৃষ্টি যাইদের সহধর্মিনী যায়নাবের ওপর পড়ে। যাইদ বুঝতে পারে যে,মহানবী যায়নাবের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং মহানবীর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা থাকার কারণে তিনি মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে যায়নাবকে তালাক দেয়ার বিষয় উপস্থাপন করেন,যাতে করে মহানবীর যায়নাবকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে ছোট-খাটো কোন বাধাও যেন বিদ্যমান না থাকে। মহানবী (সা.) যাইদকে তাঁর স্ত্রী যায়নাবকে তালাক দেয়ার ব্যাপারে বারবার নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি যায়নাবকে তালাক দেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে বিয়ে করেন।

তবে প্রাচ্যবিদরা ইতিহাসের সনদ ও দলিল-প্রমাণ যাচাই করার স্থলে এ ভিত্তিহীন ইতিহাসের পাঠ নিয়েই কেবল সন্তুষ্ট থাকে নি,বরং তারা এটাকে অলংকার পরিয়েছে যে,তা এক হাজার এক রজনীর উপাখ্যান’ -এর রূপ পরিগ্রহ করেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়,যাঁরা মহানবীর পবিত্র জীবন চরিত সম্পর্কে অবগত,তাঁরা এ কল্পকাহিনীর মূল ও এর শাখা-প্রশাখাকে কল্পনার ফসল বলেই জানেন এবং মহানবীর পবিত্র জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়সমূহের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে বিবেচনা করেন। এমনকি ফখরুদ্দীন রাযী ও আলূসীর মতো পণ্ডিতগণও যতটা স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ভাষায় সম্ভব,সেভাবে এ কাহিনীটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে,ইসলামের শক্ররা এ সব কল্প-কাহিনী তৈরি করেছে এবং মুসলিম লেখক ও পণ্ডিতদের মধ্যে তা প্রচার করেছে।১০৮

এ কথা কিভাবে বলা সম্ভব যে,এ কল্পকাহিনীটি তাবারী ও ইবনে আসীরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য,অথচ তাঁরা তার কয়েক গুণ বেশি এ কল্পকাহিনীর পরিপন্থী বিষয় বর্ণনা করেছেন এবং তাঁরা মহানবীকে সব ধরনের পাপ ও কলুষতা থেকে মুক্ত বলে বিশ্বাস করেন?

যা হোক,আমরা পরবর্তী কয়েকটি পৃষ্ঠায় এ কাহিনী ভিত্তিহীন হওয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করব এবং বিষয়টি এতটা স্পষ্ট যে,এর চেয়ে বেশি আলোচনা করা নিস্প্রয়োজন বলে মনে করি। আমাদের প্রমাণসমূহ হলো :

১. উপরিউক্ত কাহিনীটি ইসলাম ও মুসলমানদের অকাট্য প্রামাণ্য দলিল ও সনদের পরিপন্থী। কারণ,পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ৩৭ তম আয়াতের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায়,আরবদের বাতিল (ভ্রান্ত) প্রথা বিলোপ করার জন্যই যায়নাবের সাথে মহানবীর বিয়ে হয়েছিল। আরবদের প্রথা ছিল এই যে,পালিত পুত্রের বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার অধিকার কারো নেই। আর এ বিয়ে মহান আল্লাহর আদেশেই সংঘটিত হয়েছিল। তবে তা পরকীয়া প্রেম ছিল না। কেউই ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ বিষয়টি অস্বীকার করে নি। আর পবিত্র কুরআনের বক্তব্য যদি বস্তুনিষ্ঠ না হতো,তা হলে ইহুদী,খ্রিষ্টান এবং মুনাফিক চক্র তাৎক্ষণিকভাবে মহানবীর ব্যাপারে সমালোচনামুখর হয়ে যেত এবং হৈ চৈ সৃষ্টি করত। অথচ তাঁর শত্রুরা,যারা সবসময় ওঁৎ পেতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকত,তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায় নি।

২. যায়নাব হচ্ছেন সেই মহিলা যাইদের সাথে বিয়ে হবার আগেই যিনি মহানবীর কাছে তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে যায়নাবের এ বিয়েতে তীব্র আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মহানবী তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত দাস যাইদকে যেন যাইনাব বিয়ে করেন,এ ব্যাপারে তাকীদ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) যদি তাঁকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে থাকতেন,তা হলে ঐ দিন তাঁকে বিয়ে করার ব্যাপারে ক্ষুদ্রতম বাধা-বিপত্তিও ছিল না। অথচ তিনি তখন যায়নাবকে কেন বিয়ে করলেন না? বরং আমরা দেখতে পাই,যায়নাব তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ইতিবাচক সাড়া তো দেন নি;বরং তাঁকে অন্য একজনকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

ইতিহাসের এ ভিত্তিহীন কাহিনী প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক সেনাদের এ ঘটনাকে রঙ লাগিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বর্ণনা করার আর কোন ক্ষেত্র বিদ্যমান থাকে না। এ গোষ্ঠীটির ঘৃণ্য ও মর্যাদাহানিকর মন্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করা অপেক্ষা আমরা মহানবীর জীবনচরিত ও ইতিহাসের পৃষ্ঠাসমূহকে অধিক পবিত্র ও উচ্চ বলে বিবেচনা করি। মহানবী (সা.) ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর চেয়ে ১৮ বছরের ছোট যায়নাবের সাথে (একই সমাজে) বসবাস করেছেন। এ কারণেই আমরা এখানে প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য উদ্ধৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকলাম।

প্রয়োজন দু টি কথার ব্যাখ্যা

আলোচনার পূর্ণতা বিধানের জন্য এ প্রসঙ্গে যে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল,তা এবং এর দু খানা বাক্য,যা স্বল্প জ্ঞান ও তথ্যের অধিকারী কিছুসংখ্যক লোকের দ্বিধা ও সংশয়ের কারণ হয়েছিল,এখানে উল্লেখ করে এসবের ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করব। নিচে এ আয়াত উদ্ধৃত করা হলো :

) و إذ تقول للّذى أنعم الله عليه و أنعمت عليه أمسك عليك زوجك و اتّق الله(

“স্মরণ করুন,আল্লাহ্ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন,আপনি তাকে বলছিলেন : তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর’ ।” (সূরা আহযাব : ৩৭)

এ অংশের বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা নেই। এখন যে বাক্যদ্বয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন,তা নিচে উল্লেখ করা হলো :

১.و تُخفى فِى نفسك ما الله مبديه - আপনি যা নিজ অন্তরে গোপন রাখছেন,তা মহান আল্লাহ্ প্রকাশ করে দেবেন।”

যাইদকে এতসব উপদেশ দেয়ার পর মহানবী (সা.) নিজ অন্তরে এমন কোন্ বিষয় গোপন রেখেছিলেন যা মহান আল্লাহ্ স্পষ্ট প্রকাশ করে দেয়ার কথা বলেছেন?

এমনটা হয় তো কেউ ভাবতে পারে যে,মহানবী (সা.) যে বিষয় গোপন রাখতেন,তা ছিল এই যে,যদিও তিনি যাইদকে তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে বারণ করতেন,তবুও তিনি মনে মনে ঠিকই চাইতেন যে,যাইদ তাঁর স্ত্রীকে তালাক প্রদান করুন এবং এরপর তিনি তাঁকে বিয়ে করবেন।

এ ধরনের সম্ভাবনা কোনভাবেই সঠিক নয়। কারণ মহানবী (সা.) যদি মনে মনে এরূপ ধারণা পোষণ করবেন,তা হলে মহান আল্লাহ্ কেন অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে তাঁর এ গোপন আকাঙ্ক্ষা ফাঁস করে দিলেন না? অথচ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,মহানবী যা কিছু অন্তরে গোপন রেখেছেন,তা তিনি প্রকাশ করে দেবেন,যেমনটি তিনি এ আয়াতে বলেছেন :الله مبديه অর্থাৎ (আপনি যা গোপন রাখছেন) তা মহান আল্লাহ্ প্রকাশ করে দেবেন।

এ কারণেই মুফাসসিরগণ বলেন : মহানবী (সা.) যা নিজ অন্তরে গোপন রেখেছিলেন,তা ছিল ঐ ওহী যা মহান আল্লাহ্ তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেছিলেন। এর ব্যাখ্যা হলো : মহান আল্লাহ্ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করে জানিয়েছিলেন : যাইদ তার পত্নীকে তালাক দেবে। আর আপনি আরবদের কু-প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য তাকে বিয়ে করবেন। যে মুহূর্তে তিনি যাইদকে উপদেশ দিচ্ছিলেন,সে মুহূর্তেও এ ইলাহী বাণীর প্রতি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল। তবে তিনি যাইদ ও অন্যান্য ব্যক্তির কাছে এ বাণী গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্ এ বাক্যে মহানবীকে জানিয়ে দেন : আপনার অন্তঃকরণে যা আছে,মহান আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দেবেন এবং আপনার গোপন রাখার কারণে তা গোপন থাকবে না।

এ বক্তব্যের প্রমাণ হচ্ছে এই যে,পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এ বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন :

) فلمّا قضي زيد منها وطرا زوّجناكها لكى لا يكون علي المؤمنين حرج فِى أزواج أدعيائهم(

“অতঃপর যখন যাইদ যায়নাবকে তালাক দিল,তখন আমরা তাকে আপনার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলাম,যাতে ঈমানদারদের দত্তক পুত্ররা যখন তাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে,তখন সেসব রমণীকে বিয়ে করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।”

এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.) যা গোপন রেখেছিলেন,তা ছিল ঐ খোদায়ী প্রত্যাদেশ যাতে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে,তিনি ভুল প্রথা বিলোপ করার জন্য বিয়ে বিচ্ছেদের পর পালিত পুত্রের সহধর্মিণীকে অবশ্যই বিয়ে করবেন।

২.و تخشي النّاس و الله أحقّ أن تخشاه - আর আপনি জনগণকে ভয় পাচ্ছেন,অথচ মহান আল্লাহ্ই হচ্ছেন সবচেয়ে উপযুক্ত সত্তা যাঁকে আপনার ভয় করা উচিত।”

এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় বাক্য যার অস্পষ্টতা প্রথম বাক্যের তুলনায় অনেক কম। কারণ,একটি কলুষিত পরিবেশে বহু বছর ধরে প্রচলিত একটি ঘৃণ্য প্রথা পদতলে পিষ্ট করা অর্থাৎ পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার সাথে স্বভাবতই এক ধরনের আত্মিক অশান্তি ও উদ্বেগ বিদ্যমান,যা মহান নবীগণের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আদেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যায়।

মহানবীর মাঝে যদি কোন উদ্বেগ থেকে থাকে বা তাঁর মাঝে যদি কোন উৎকণ্ঠার উদ্ভব ঘটে থাকে,তা হলে তা এ কারণে হয়েছিল যে,তিনি চিন্তা করতেন আরব জাতি-যারা জাহিলী যুগ এবং অপবিত্র ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাস থেকে সদ্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে),-তারা হয় তো বলবে যে,মহানবী (সা.) একটি জঘন্য কাজ করেছেন;অথচ তা প্রকৃতপক্ষে কখনোই ঘৃণ্য ও অন্যায় কাজ ছিল না।

সাঁইত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

আহযাব অর্থাৎ জোটবদ্ধ দলসমূহের যুদ্ধ ১০৯

হিজরতের পঞ্চম বর্ষে মহানবী (সা.) বেশ কিছু যুদ্ধ বা গাযওয়ায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং শত্রুদের সম্ভাব্য চক্রান্ত প্রশমনের জন্য বেশ কিছু সারিয়াহ্ বা সামরিক অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন। এখন আমরা হিজরতের পঞ্চম বর্ষের কয়েকটি গাযওয়ার বিবরণ প্রদান করব :

১. গাযওয়া-ই-দাওমাতুল জান্দাল১১০

পবিত্র মদীনা নগরীতে গোপন সংবাদ এসে পৌঁছায় যে, দাওমাতুল জান্দাল’ নামক অঞ্চলে একদল লোক সংঘবদ্ধ হয়ে মুসাফির ও পথচারীদের ওপর অত্যাচার করছে এবং মদীনা নগরী অবরোধ করার অভিপ্রায় পোষণ করছে। মহানবী (সা.) তাদেরকে দমন করার জন্য এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা নগরী ত্যাগ করেন। তিনি রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনের বেলা যাত্রা-বিরতি করতেন ও বিশ্রাম নিতেন। শত্রুরা মহানবী (সা.)-এর সেনা অভিযানের ব্যাপারে অবগত হলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এরপর মহানবী (সা.) সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন এবং তিনি এ অঞ্চলের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিদল আশে-পাশের অঞ্চলগুলোয় প্রেরণ করেন।

মহানবী (সা.) ২০ রবীউস সানী মদীনার উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং ফেরার সময় তিনি ফিযার গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মহানবী (সা.) তাকে মদীনার চারণক্ষেত্রগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দেন। কারণ তার গোত্র দুর্ভিক্ষ ও খরা কবলিত হয়েছিল।১১১

২. খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ

আমাদের ইতোমধ্যে উল্লেখ মতো মহানবী (সা.) হিজরতের চতুর্থ বর্ষে বনী নাযীরের ইহুদীদের চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে পবিত্র মদীনা নগরী থেকে বহিষ্কার এবং তাদের কিছু ধন-সম্পদও জব্দ করেন। বনী নাযীর খাইবরের দিকে যেতে এবং সেখানে বসবাস করতে বা শামের দিকে যেতে বাধ্য হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর এ বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ঐ চুক্তি মোতাবেক ছিল যাতে দু পক্ষ স্বাক্ষর করেছিলেন। মহানবীর এ পদক্ষেপই বনী নাযীর গোত্রের নেতাদেরকে ষড়যন্ত্র করতে এবং মক্কা গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধে উস্কানি দিতে প্রভাবিত করেছিল। এখন এ যুদ্ধের একটি বিশদ বিবরণ দেয়া হলো :

এ যুদ্ধে আরব মুশরিক ও ইহুদীদের সেনাবাহিনীকে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হয়েছিল। তারা একটি শক্তিশালী সামরিক ঐক্যজোট গঠন করে প্রায় দীর্ঘ এক মাস মদীনা নগরী অবরোধ করে রেখেছিল। আর যেহেতু এ যুদ্ধে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী যোগদান করেছিল এবং শত্রুবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য মুসলমানরা মদীনার চারপাশে পরিখা খনন করেছিল,সেহেতু এ যুদ্ধকে আহযাব’ বা দলসমূহের যুদ্ধ’ এবং কখনো কখনো পরিখার যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।

যেভাবে আমরা উল্লেখ করেছি,বনী নাযীর গোত্রের ইহুদী নেতারা এবং বনী ওয়ায়েল গোত্রের একদল লোক ছিল এ যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলনকারী। বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীরা মুসলমানদের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিল,সে কারণে এবং বাধ্য হয়ে তাদের মদীনা ত্যাগ করতে হয়েছিল এবং তাদের একদল খাইবরে আবাসন নিয়েছিল বিধায় তারা ইসলাম ধর্মের মূলোৎপাটনের একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। তারা আসলেই একটি অদ্ভূত পরিকল্পনা এঁটেছিল এবং মুসলমানদেরকে তারা বিভিন্ন দলের মুখোমুখি করে দিয়েছিল,যা ছিল আরব জাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

এ পরিকল্পনার ছত্রছায়ায় অগণিত আরব গোত্র ও গোষ্ঠী ইহুদীদের অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছিল এবং মুসলমানদের বিরোধী সেনাবাহিনীর জন্য সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল।

পরিকল্পনাটি ছিল এই যে,সাল্লাম ইবনে আবীল হুকাইক এবং হুইয়াই ইবনে আখতাবের মতো বনী নাযীর গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে পবিত্র মক্কায় গিয়ে কুরাইশ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল এবং তাদেরকে বলেছিল : মুহাম্মদ আপনাদের ও আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছে এবং বনী কাইনুকা গোত্র ও বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদেরকে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

আপনারা কুরাইশ গোত্র (মুহাম্মদের বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ান এবং আপনাদের মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য নিন;আর মদীনার প্রবেশ মুখের কাছে আমাদেরও সাত শ’ ইহুদী তীরন্দাজ সৈন্য আছে এবং তাদের সবাই আপনাদের সাহায্যার্থে দ্রুত ছুটে আসবে। যদিও বাহ্যত মুহাম্মদের সাথে বনী কুরাইযা গোত্রের ইহুদীদের প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি আছে তবুও আমরা তাদেরকে এ চুক্তি উপেক্ষা করে আপনাদের সহযোগী হবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করব। ১১২

তাদের দম্ভোক্তি ও আস্ফালন-কুরাইশ নেতৃবর্গ,যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে গিয়েছিল,তাদের মধ্যে কার্যকর প্রভার বিস্তার করেছিল এবং ইহুদী নেতৃবর্গের পরিকল্পনাটি তাদের মনঃপূত হয়েছিল এবং তারা তাদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছিল। তবে (চূড়ান্ত) সম্মতি দানের কথা ঘোষণা করার আগেই তারা ইহুদী নেতৃবর্গকে জিজ্ঞেস করেছিল :

“আপনারা আহলে কিতাব সম্প্রদায় এবং আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারী। আপনারা সত্য ও মিথ্যা শরীয়তকে ভালোভাবেই পৃথক করতে সক্ষম। আর আপনারা জানেন,তার (মুহাম্মদ) ধর্ম যা আমাদের ধর্মের পরিপন্থী,কেবল তা ছাড়া মুহাম্মদের সাথে আমাদের কোন মতপার্থক্য নেই। সত্যি করে আমাদের বলুন তো,আমাদের ধর্ম উত্তম,নাকি তার ধর্ম-যা একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত?

এখন অবশ্যই দেখা উচিত,এ গোষ্ঠীটি (ইহুদীরা),যারা নিজেদেরকে পৃথিবীর বুকে তাওহীদের (একত্ববাদ) ধ্বজাধারী বলে মনে করে,ঐ অজ্ঞ গোষ্ঠীর প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছিল,যারা তাদেরকে বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য করে তাদের কাছে নিজেদের সমস্যাগুলো উপস্থাপন করেছিল? তারা চরম নির্লজ্জ ভাবে বলেছিল : মূর্তিপূজা মুহাম্মদের ধর্ম অপেক্ষা উত্তম। আপনারা আপনাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবেন এবং তার ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র ঝোঁক প্রদর্শন করবেন না। ১১৩

তারা এ বক্তব্যের দ্বারা আসলে নিজেদেরকেই কলঙ্কিত করেছে এবং এর ফলে ইহুদী জাতির ইতিহাস,যা আগে থেকেই কালো ছিল,আরো কালো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। এ স্খলন এতটাই অমার্জনীয় ছিল যে,স্বয়ং ইহুদী লেখকরাও এ ধরনের ঘটনায় অস্বাভাবিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ড. ইসরাইল ইহুদী জাতি ও আরবোদ্বীপের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন :

“যদি কুরাইশরা ইহুদীদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানও করত,তবুও ইহুদীদের এ ধরনের ভুল ও অন্যায় করা শোভনীয় ছিল না। অধিকন্তু,পৌত্তলিকদের শরণাপন্ন হওয়া ইহুদী জাতির জন্য কখনোই ঠিক হয় নি। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ আসলে তাওরাতের শিক্ষা ও নীতিমালারই পরিপন্থী। ১১৪

আসলে এটা হচ্ছে এমন এক অভিমত যা বর্তমান কালের রাজনীতিবিদরা নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে কোন ধরনের বৈধ-অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করা উচিত। আর এ কথাটিই এ মতাদর্শের পূর্বসূরি মেকিয়াভেলী বলেছেন : লক্ষ্য মাধ্যমকে বৈধতা ও সিদ্ধতা প্রদান করে” (অর্থাৎ লক্ষ্য যদি মহান হয়,তা হলে তা অর্জন করার জন্য বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থা অবলম্বন করা যাবে এবং তা বৈধ হবে)। আর তাঁদের মতাদর্শে চারিত্রিক গুণাবলী (আখলাক) হচ্ছে এমন বিষয় যা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সহায়ক।

পবিত্র কুরআন এ তিক্ত বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে বলেছে :

) ألم تر إلى الّذين أوتوا نصيبا من الكتاب يُؤمنون بالجبت و الطّاغوت و يقولون للّذين كفروا هؤلَاء أهدي من الّذين آمنوا سبيلا(

“তুমি কি তাদের দেখ নি,যাদের কিতাবের (ইলাহী গ্রন্থ) এক (সামান্য) অংশ দেয়া হয়েছিল,তারা জিব্ত (প্রতিমার নাম) ও আল্লাহ্ ছাড়া সব পূজ্য সত্তায় বিশ্বাস করে? তারা কাফেরদের সম্পর্কে বলে : এদের পথ মুমিনদের চেয়ে উত্তম।” (সূরা নিসা : ৫১)

এসব আলেম নামধারীদের (ইহুদী নেতাদের) বক্তব্য মূর্তিপূজকদের মন-মানসিকতার ওপর কার্যকর প্রভাব ফেলে এবং তারা তাদের সম্মতির কথা ঘোষণা করে এবং মদীনার দিকে অভিযানের সময়ও নির্ধারণ করা হয়।

যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলনকারীরা খুশী মনে পবিত্র মক্কা থেকে বের হয়ে ইসলাম ধর্মের চরম শত্রু গাতফান গোত্রের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নাজদ অভিমুখে যাত্রা করে। গাতফান গোত্রের মধ্য থেকে বনী ফাযারাহ্,বনী মুররাহ্ ও বনী আশজা-এ শাখা-গোত্রগুলো তাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়,এ শর্তে যে,বিজয়ের পর খাইবরের উৎপাদিত শস্য এক বছর পর্যন্ত তাদেরকে প্রদান করতে হবে।

তবে এখানেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় নি। কুরাইশরা তাদের মিত্র বনী সালীম গোত্রকে এবং গাতফান গোত্র তাদের মিত্র বনী আসাদ গোত্রকে পত্র লিখে তাদেরও ঐ সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করার আহবান জানায়। মিত্ররাও তাদের আহবানে সাড়া দেয়। এরপর একটি নির্দিষ্ট দিবসে এসব দল ও গোষ্ঠী আরবোপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মদীনা অবরোধ ও দখল করার উদ্দেশ্যে অকস্মাৎ বন্যার মতো ছুটে আসে।১১৫

সেনা মনোবল শক্তিশালী করণ

মহানবী (সা.) যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। এবারও যখন (মাঝপথ থেকে তিন শ লোকের মুনাফিক দলটি মুসলমানদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর) কেবল সাত শ মুসলিম যোদ্ধা তিন হাজার শত্রু-সৈন্যের মোকাবেলায় দাঁড়ালো তখন মহানবী এক ভাষণ প্রদান করে তাদের মনোবল দৃঢ় করেন। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদী বলেন :

মহানবী (সা.) আইনাইন গিরিপথে 50 জন তীর নিক্ষেপকারী সৈন্য মোতায়েন করেন;উহুদ পর্বত পেছনে এবং মদীনা সামনে রেখে অবস্থান নেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সৈন্যদের সারিগুলো বিন্যস্ত করছিলেন এবং প্রত্যেক অধিনায়কের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিলেন। একদলকে সামনে এবং একদলকে পেছনে রাখছিলেন। সৈন্যদের সারি সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্কতা দেখিয়েছিলেন যে,কোন সৈনিকের কাঁধ সামনের দিকে এগিয়ে আসলে সাথে সাথে তাকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

মহানবী সৈন্যদের সারি বিন্যস্ত করার পর মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন,আমি তা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : তোমরা মহান আল্লাহর আদেশের আনুগত্য কর। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকবে। এরপর তিনি বলেন : শত্রুর মুকাবেলা করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই শত্রুর মুকাবেলায় দৃঢ় পদ ও অবিচল থাকার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কেবল তারাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম,যাদের আল্লাহ্ হিদায়েত করেছেন এবং শক্তি যুগিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহর আদেশ পালনকারীদের সাথেই তিনি আছেন। শয়তান ঐ লোকদের সাথে আছে যারা মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। সবকিছুর আগে জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।24 ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা জিবরীল আমাকে বলেছেন : এ জগতে কোন ব্যক্তিই তার (জন্য বরাদ্দ) রিযকের সর্বশেষ দানাটি আহার না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না। যতক্ষণ যুদ্ধের নির্দেশ জারি না হয়,কেউ যেন আক্রমণ পরিচালনা না করে। 25

যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ শত্রুবাহিনী

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে বর্ম পরিহিত পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অধিনায়কত্বে একদলকে মোতায়েন করে ডান পাশে। অপর এক দলকে ইকরামার অধিনায়কত্বে মোতায়েন করে বাম দিকে।

এছাড়া সে অগ্রবর্তী দলরূপে একটি বিশেষ দলকে সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে মোতায়েন করে যার মধ্যে পতাকাবাহীও ছিল। এরপর বনী আবদুদ্দার গোত্রভুক্ত পতাকাবাহীদের সম্বোধন করে আবু সুফিয়ান বলল : সেনাবাহিনীর বিজয় তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা বদরের দিন এ অংশের দিক থেকেই আক্রান্ত হয়ে পরাজয় বরণ করেছি। যদি বনী আবদুদ্দার গোত্র পতাকা বহন ও রক্ষার ব্যাপারে যোগ্যতার প্রমাণ না দেয়,তা হলে পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রের কাঁধে চলে যাবে। কুরাইশ বাহিনীর প্রথম পতাকাবাহী বীর যোদ্ধা তালহা ইবনে আবি তালহার কাছে কথাটি মারাত্মক বলে মনে হলো। তাই সে তৎক্ষণাৎ ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিপক্ষের মল্লযোদ্ধাদের আহবান জানাল।

মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহ

যুদ্ধ শুরু হবার আগে মহানবী একখানা তরবারি হাতে নিলেন। স্বীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে তাদের লক্ষ্য করে বললেন : কোন্ ব্যক্তি এ তরবারি ধারণ করে তার হক আদায় করবে? 26 কিছু লোক সাড়া দিলেন। কিন্তু মহানবী তাদেরকে তরবারি দিতে সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অকুতোভয় সৈনিক আবু দুজানাহ্ সাড়া দিয়ে বললেন, এই তরবারীর হক বলতে কি বুঝায়? কিভাবে এর হক আদায় করা যাবে?”   মহানবী বললেন : এটা নিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবে যাতে তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানাহ্ বললেন : আমি এর হক আদায় করতে প্রস্তুত আছি। এরপর মৃত্যুর রুমাল নামে বিখ্যাত একটি লাল রঙের রুমাল মাথায় বেঁধে মহানবীর হাত থেকে ঐ তরবারি তুলে নেন। আবু দুজানাহ্ যখনই এ রুমালটি মাথায় বাঁধতেন,তখনই বোঝা যেত,যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে,ততক্ষণ তিনি লড়াই করে যাবেন।

তিনি এক গর্বিত চিতাবাঘের মতো পথ চলছিলেন। আজ তাঁর সৌভাগ্যের জন্য তিনি অতিশয় আনন্দিত। মাথায় লাল রংয়ের পট্টি তাঁর মর্যাদা ও গৌরব আরো বৃদ্ধি করছিল।27

সত্যিই যে সেনাবাহিনী একমাত্র সত্য ও নৈতিকতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়,যাদের সামনে নিজ বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই,তাদের জন্যে এ ধরনের মহড়া হচ্ছে সর্বোত্তম উদ্দীপক। মহানবীর লক্ষ্য কেবল আবু দুজানাকে উৎসাহিত করাই ছিল না;বরং তিনি এ কাজের দ্বারা সাহাবীগণের আবেগকেও শাণিত করেন। তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে,তাঁদের সিদ্ধান্ত ও বীরত্ব এমন পর্যায়ের হতে হবে যে,এর ফলে তাঁরাও এ ধরনের সামরিক পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

যুবাইর ইবনে আওয়াম ছিলেন এক বীর যোদ্ধা। মহানবী (সা.) হাতের তরবারিখানা তাঁকে না দেওয়ায় তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বললেন : আবু দুজানার বীরত্ব ও সাহসের মাত্রা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি তাঁর পিছু নেব। তিনি বললেন : আমি যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পেছনে পেছনে ছিলাম। দেখেছিলাম,যে বীর যোদ্ধাই তাঁর সামনে আসছিল,তিনি সাথে সাথে তাকে খতম করে দিচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এক বীর ছিল,যে মুসলমানদের মধ্যেকার আহতদের মাথা দ্রুত দ্বিখণ্ডিত করছিল। এ কাজ দেখে আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে লোকটি আবু দুজানার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বীরটি আবু দুজানার হাতে নিহত হলো। আর স্বয়ং আবু দুজানাহ্ও বর্ণনা করেছেন : একজনকে দেখলাম,যে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে যখন দেখল,তার মাথার উপর তরবারি,তখন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল। হঠাৎ দেখলাম এ হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। আমি মনে করলাম,হিন্দ্-এর মতো মহিলাকে হত্যা করে মহানবীর তরবারি অপবিত্র করা উচিত হবে না। 28

যুদ্ধের সূচনা

মদীনা হতে পলাতক আউস গোত্রের লোক আবু আমেরকে দিয়ে যুদ্ধ শরু হয়ে যায়। ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে সে মদীনা থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। আউস গোত্রের পনের ব্যক্তিও তার সাথে ছিল। আবু আমেরের ধারণা ছিল,আউস গোত্রের লোকেরা যখন তাকে দেখবে,তখন মহানবীকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যে সে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন সে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়,তখন সে তাদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কাজেই অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর সে রণাঙ্গন থেকে সরে পড়ে।29

উহুদের ময়দানে কয়েকজন যোদ্ধার লড়াই ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের মনে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার। ইবনে আব্বাস বলেন : হযরত আলী সকল যুদ্ধেই মসুলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন। সর্বদা দক্ষ,পরীক্ষিত ও অবিচল যোদ্ধাদের মধ্য থেকেই পতাকাধারী নির্বাচন করা হতো। উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর হাতে ছিল।

অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,মুসলমানদের পতাকাবাহী মুসআব ইবনে ওমাইর নিহত হবার পর মহানবী (সা.) আলীর হাতে পতাকা তুলে দেন। মুসআব প্রথম পতাকাবাহী হবার কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে,তিনি আবদুদ্দার গোত্রের লোক ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাধারীরাও এই গোত্রের লোক ছিল।30

তালহা ইবনে আবি তালহা,যাকেكبش الكتيبة কাবশুল কাতীবাহ্ বলা হতো,হুংকার দিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলো এবং চিৎকার দিয়ে বলল : হে মুহাম্মদের সাথীরা! তোমরা বল যে,আমাদের নিহত ব্যক্তিরা দোযখে আছে,আর তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে। এই অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে,আমি তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিই অথবা সে আমাকে দোযখে পাঠিয়ে দিক?”   তার কণ্ঠস্বর যুদ্ধের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলী (আ.) সামনে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি ঘাত-প্রতিঘাতের পর আলীর তরবারির আঘাতে তালহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তালহা নিহত হলে পতাকা বহনের পালা আসে পর্যাক্রমে তার দু ভাইয়ের ওপরে। উভয়ে আসেম ইবনে সাবিতের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।

দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত শূরার (পরামর্শ) সভায় আমীরুল মুমিনীনের (আলী) প্রদত্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় যে,কুরাইশ বাহিনী নয় জনকে পতাকা বহনের জন্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছিল। কথা ছিল,পর্যায়ক্রমে তারা সেনাবাহিনীর পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করবে। পর্যায়ক্রমটি ছিল প্রথম ব্যক্তি নিহত হলে পরের ব্যক্তি-এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পতাকা বহন করবে। এসব পতাকাবাহীর সবাই ছিল বনী আবদুদ্দার গোত্রের লোক। তারা সবাই উহুদ যুদ্ধের দিবসে হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে প্রাণ হারায়। এদের পর সাওআব নামক এক হাবশী ক্রীতদাস,যার দেহ-কাঠামো ছিল খুবই ভয়ানক এবং মুখমণ্ডল ছিল বীভৎস,সে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা ধারণ করেছিল। সেও ময়দানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আহবান করেছিল। সেই ক্রীতদাসও হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল।

আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের বিরাট পরামর্শসভায় তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,আমি বনী আবদুদ্দার গোত্রের নয় জনের অনিষ্টতা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছিলাম,যাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আহবান করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে পতাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিল। উপস্থিত ব্যক্তিদের সবাই হযরত আলীর বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।31

তিনি আবারো বললেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,ঐ নয় ব্যক্তির পরে হাবশী ক্রীতদাস সাওআব রণাঙ্গনে এসেছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহানবীকে হত্যা করা। সে এতখানি ক্রোধান্বিত ছিল যে,তার মুখ ফেনায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দু টি লাল হয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই ভয়ঙ্কর যোদ্ধাকে দেখে ভয়ে পিছু হটে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সামনে এগিয়ে যাই,তার কোমরের উপর আঘাত হানি এবং তাকে ধরাশায়ী করি। এবারও উপস্থিত সবাই হযরত আলীর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন।

প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করতে লড়ছিল যে জাতি

হিন্দ এবং অন্যান্য নারীরা কুরাইশ সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যেসব কবিতা আবৃত্তি করছিল ও গান গাইছিল,তাতে দফ ও খঞ্জনা বাজিয়ে তাদেরকে রক্তপাত ঘটানো ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করার আহবান জানাচ্ছিল। তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে,এই জাতি নৈতিক চেতনা,পবিত্রতা,স্বাধীনতা ও সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে লড়ছিল না;বরং তাদের জন্য উত্তেজক ছিল বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ও যৌন সম্ভোগ। দফ ও তবলাবাদক নারীরা কুরাইশ বাহিনীর মাঝখানে এক বিশেষ সুর মূর্চ্ছনায় গান গাইছিল :

نحـن بنات طـارق

نـمشى على النّـمارق

إن تـقبلـوا نعـانق

أو تــدبـروا نـفـارق

আমরা বালিকা পথের

গালিচার উপর দিয়ে করি পদচারণ।

যদি মুখোমুখি হও শত্রুর,করবো আলিঙ্গন

(আর) যদি শত্রু থেকে কর পৃষ্ঠ প্রদর্শন,

তা হলে ছেড়ে যাবো তোমাদের।

নিঃসন্দেহে,যে জাতির যুদ্ধ যৌন বিষয়াদির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য না থাকে;অন্যদিকে যে জাতি স্বাধীনতার প্রসার,চিন্তার উৎকর্ষতা,কাঠ ও মাটির মূর্তির উপাসনা ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে,-উভয়ের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য ও অতুলনীয় ব্যবধান রয়েছে। এ দু দলের মধ্যে ভিন্ন-ধর্মী দু ধরনের মনোবলের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইসলামের বীর সমরনায়কগণ,যেমন আলী,হামযাহ্,আবু দুজানাহ্,যুবাইর ও অন্যান্যের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগী লড়াইয়ের ফলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্র ও গনীমতের সম্পদ ফেলে রেখে অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পালাতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামের সৈনিকদের গৌরব একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে।32

বিজয়ের পর পরাজয়

ইসলামের সৈনিকরা এ কারণে বিজয়ী হয়েছিল যে,বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথে জিহাদ,তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের প্রচার এবং এ পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল,সেগুলো অপসারণ ছাড়া তাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না।

বিজয় লাভের পরে পরাজয় এজন্য হয়েছিল যে,অধিকাংশ মুসলমানের নিয়্যত ও লক্ষ্যে পরিবর্তন এসে যায়। কুরাইশ বাহিনী যেসব গনীমতের মাল ফেলে পালিয়েছিল,সেসবের প্রতি মনোযোগ তাদের ইখলাস (নিষ্ঠা) কলুষিত করেছিল এবং তারা মহানবীর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল।

ঘটনার বিবরণ

আমরা উহুদ প্রান্তরের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনায় এ বিষয় উল্লেখ করেছি যে,উহুদ পর্বতের মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের ফাটল ছিল। মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইরের অধিনায়কত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের ওপর রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগের এ গিরি প্রহরার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন,তীর নিক্ষেপ করে পাহাড়ের ফাটলের ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যদের আগমন ও চলাচল প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন,তারা কোন অবস্থায়ই তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না।

যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতার মধ্যে শত্রু সৈন্যরা যখনই এই গিরিপথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে,তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ও মালপত্র মাটিতে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলায়ন শুরু করে,তখন প্রাণপণ লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইসলামের মুষ্টিমেয় বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গিয়ে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত থাকে। তারা (শত্রুবাহিনীর) ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ও সম্পদ সংগ্রহে তৎপর হয়ে যায়। তারা ধরে নিয়েছিল,যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত সৈনিকরা সুবর্ণ সুযোগ ভেবে মনে মনে বলে : আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থক। আমাদেরও গনীমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের অধিনায়ক বললেন : মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী বাহিনী জয়ী হোক বা পরাজিত হোক,আমরা যেন এ স্থান ত্যাগ না করি। অধিকাংশ তীর নিক্ষেপকারী রক্ষী সেনা তাদের অধিনায়কের নির্দেশের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়ে বলে : এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল,যুদ্ধ চলাকালে আমরা যেন এ গিরিপথটি পাহারা দিই। এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । এর ভিত্তিতে চল্লিশ জন সৈন্য প্রহরার স্থান থেকে নিচে নেমে আসে। সেখানে কেবল দশ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ রইল না।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। শুরু থেকেই সে জানত,গিরিপথের মুখটি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি এবং সে বেশ কয়েক বার ঐ পথ দিয়ে রণাঙ্গনের পেছন দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবার প্রহরীদের তীর নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার সে তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগ গ্রহণ করে। সে কুরাইশ সৈন্যদের মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করতে নেতৃত্ব দেয়। সে এক দফায় অতর্কিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হয়। টিলার উপর মোতায়েন মুষ্টিমেয় তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যের প্রতিরোধে কোন লাভ হলো না। ঐ দশ ব্যক্তি প্রাণপণ লড়াই করে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসতর্ক ও নিরস্ত্র মুসলমানরা পেছন দিক থেকে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্পর্শকাতর স্থানটি দখল করে নেয়ার পর পরাজিত কুরাইশ বাহিনীর পলায়নপর সৈন্যদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার আহবান জানায়। সে চিৎকার করে ও শ্লোগান দিয়ে কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধ স্পৃহা এবং অবিচল থাকার মনোবৃত্তি চাঙ্গা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের যুদ্ধের সারি ছত্রভঙ্গ থাকার সুযোগে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। তারা পেছন ও সামনের দিক থেকে ইসলামী বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এ পরাজয়ের কারণ ছিল,ঐ দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি,যারা বস্তুগত লক্ষ্যের জন্য বাঙ্কার বা অবস্থানস্থল ছেড়ে এসেছিল এবং নিজেদের অজান্তেই শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর ফলে কুরাইশ বাহিনীর অশ্বারোহী দল খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে পেছন দিক থেকে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়ে।

আবু জাহলের ছেলে ইকরামার হামলায় খালিদের আক্রমণ অভিযান শক্তিশালী হয়। এ সময় ইসলামী বাহিনীতে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায়ন্তর দেখলেন না। কিন্তু চেইন অব কমান্ড যেহেতু ভেঙে পড়েছিল,সেহেতু ইসলামের সৈনিকরা সাফল্যজনক প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেন না। বরং তাঁরা বড় ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। কয়েকজন মুসলমান সৈনিকও অসর্তকতার কারণে অন্য মুসলিম সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। খালিদ ও ইকরামার আক্রমণ অভিযান কুরাইশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা করে। পলাতক কুরাইশ সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং তাদের শক্তি ও সমর্থন যোগাতে থাকে। এ অবস্থায় তারা মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের একদলকে হত্যা করে।

মহানবী (সা.)-এর নিহত হবার সংবাদ

কুরাইশ বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা লাইসী ইসলামী বাহিনীর বীর পতাকাবাহী মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর হামলা করে। তাদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ইসলামী বাহিনীর পতাকাধারী শাহাদাত লাভ করেন। ইসলামী যোদ্ধাদের চেহারা ঢাকা ছিল। সে ভাবল,নিহত ব্যক্তি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হবেন। তখনই সে চিৎকার দিল এবং সেনা অধিনায়কদের উদ্দেশে বলল : ভাইসব! মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদটি কুরাইশ বাহিনীর মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

কুরাইশ নেতারা এমন আনন্দিত হলো যে,তাদের আওয়াজ সমগ্র রণাঙ্গনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তারা সবাই বলছিল :ألا قد قُتل محمّد، ألا قد قُتل محمّد মুহাম্মদ নিহত হয়েছে,মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদ রটে যাওয়ায় দুশমনদের সাহস বেড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী তখন তরঙ্গমালার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল,মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটায় অংশ নেবে এবং এর মাধ্যমে শিরক ও পৌত্তলিকতার জগতে খ্যাতি অর্জন করবে।

এ গুজব দুশমন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে,ইসলামের মুজাহিদদের মনোবল ভেঙে দেয়াতেও ততখানি প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলমানদের বহু লোক যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মাত্র কয়েক মুজাহিদ যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকেন।

কিছুসংখ্যক লোকের পলায়ন কি অস্বীকার্য?

(উহুদের রণাঙ্গন থেকে) সাহাবীদের পলায়ন এবং তাঁদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। অথবা যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে সুখ্যাতি এবং উচ্চ মর্যাদা ও পদের অধিকারী হয়েছিলেন,সেহেতু তা আমাদের এ তিক্ত সত্য মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েও দাঁড়াবে না।

বিখ্যাত মুসলিম সীরাত রচয়িতা ইবনে হিশাম লিখেছেন,মুসলিম বাহিনী যখন চাপের মুখে পড়ে এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে,তখন অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবন রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং সবাই যে যার মতো একেক দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আনাস ইবনে মালিকের চাচা আনাস আনাস ইবনে নযর একদল মুজাহির ও আনসার,যাঁদের মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও ছিলেন,তাঁদেরকে দেখতে পেলেন যে,তাঁরা এক কোণায় বসে আছেন এবং নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছেন। তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠে তাঁদেরকে বললেন : আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন;তাই এখন য্দ্ধু করে কোন লাভ নেই। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন : যদি মহানবী নিহত হয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের এ জীবনের কোন লাভ নেই। আপনারাও সবাই উঠে যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন,সে পথে শহীদ হোন। 33 অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন,আনাস ইবনে নযর ঐ সময় বললেন : মুহাম্মদ যদি নিহত হয়েও থাকেন,মুহাম্মদের আল্লাহ্ তো জীবিত আছেন। এরপর তিনি দেখতে পেলেন যে,তাঁর কথা তাঁদের উপর কোন প্রভাব রাখছে না। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইবনে হিশাম বলেন,এ যুদ্ধে আনাসের দেহে 70টি ক্ষত বা আঘাত ছিল এবং তাঁর বোন ব্যতীত আর কেউই তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি।

একদল মুসলমান এতটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে,তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর দ্বারস্থ হতে চেয়েছিল যাতে সে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে।34


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53