চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79218
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79218 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

প্রাচ্যবিদগণ এবং হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশের বিয়ে

যাইদ ইবনে হারিসার আগের স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশের সাথে মহানবীর বিয়ে একটি সাদামাটা ও সব ধরনের অস্পষ্টতা থেকে মুক্ত বিষয়। তবে যেহেতু কতিপয় প্রাচ্যবিদ সরলমনা ও অনবহিত লোককে ধোঁকা দেয়া ও বিভ্রান্ত করার জন্য এ ঘটনাকে দলিল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে এবং এভাবে মহানবীর জীবন-চরিত সম্পর্কে যাদের সঠিক জ্ঞান নেই,তাদের ঈমান দুর্বল করার চেষ্টা করেছে,সেহেতু এ গোষ্ঠীটির বক্তব্য উল্লেখ করে এ বিষয়টি অধ্যয়ন করব।

বলার অপেক্ষা রাখে না,প্রাচ্যের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ কেবল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে না,বরং কখনো কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার ধুয়ো তুলে প্রাচ্যে অনুপ্রবেশ করে এবং সূক্ষ্ম পরিকল্পনা সহ সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ের দাসত্ব অর্থাৎ চিন্তামূলক দাসত্ব বাস্তবায়িত করে। আসলে প্রাচ্যবিদ হচ্ছে ঐ সাম্রাজ্যবাদী,যে এক বিশেষ ভাবমূর্তি নিয়ে সমাজের অভ্যন্তরে এবং বুদ্ধিজীবীদের মাঝে কর্মতৎপরতা শুরু করে এবং শিক্ষিত ও সুধী শ্রেণীর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করে নিজস্ব উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে।

অনেক সুধী লেখক এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-প্রেমিক আমাদের এ বক্তব্য গ্রহণ করতে নাও পারেন এবং আমাদেরকে গোঁড়া’ ও প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে অভিযুক্ত করতে পারেন। তাঁরা ভাবতে পারেন,জাতিগত (সাম্প্রদায়িক) বা ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের পাশ্চাত্য সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতে প্ররোচিত করেছে। তবে প্রাচ্যবিদদের রচনাবলী এবং ইসলামের ইতিহাসের ব্যাপারে তাদের সত্য গোপন রাখা এবং উদ্দেশ্যমূলক আচরণ এ বিষয়ের উজ্জ্বল দলিল যে,তাদের অনেকের মাঝেই জ্ঞানগত উদ্দেশ্য খুব কম এবং তাদের রচনাবলী কতকগুলো ধর্মবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা মিশ্রিত।106

এর প্রমাণ হচ্ছে আমাদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু। তারা পশ্চিমা ধাঁচের ধারণার বশবর্তী হয়ে এ বিয়ে-যা একটি ভ্রান্ত জাহিলী প্রথা বিলোপ করার জন্য বাস্তবায়িত হয়েছিল,তা পরকীয়া ও প্রণয়াসক্তির রঙে রাঙিয়েছে এবং ঔপন্যাসিক ও গল্পকারদের মতো যতটা সম্ভব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটি বানোয়াট ইতিহাস বর্ণনা করেছে এবং তা মানব জাতির সবচেয়ে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত করে তাঁর পবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে।

যা হোক,তাদের এ ভিত্তিহীন উপাখ্যানের ভিত্তি হচ্ছে ঐ সব বর্ণনা যেগুলো ইবনে আসীর107 ,তাঁর পূর্বে তাবারী এবং আরো কতিপয় মুফাসসির বর্ণনা করেছেন। আর তা হলো : একদিন অনিচ্ছাকৃতভাবে মহানবীর দৃষ্টি যাইদের সহধর্মিনী যায়নাবের ওপর পড়ে। যাইদ বুঝতে পারে যে,মহানবী যায়নাবের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং মহানবীর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা থাকার কারণে তিনি মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে যায়নাবকে তালাক দেয়ার বিষয় উপস্থাপন করেন,যাতে করে মহানবীর যায়নাবকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে ছোট-খাটো কোন বাধাও যেন বিদ্যমান না থাকে। মহানবী (সা.) যাইদকে তাঁর স্ত্রী যায়নাবকে তালাক দেয়ার ব্যাপারে বারবার নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি যায়নাবকে তালাক দেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে বিয়ে করেন।

তবে প্রাচ্যবিদরা ইতিহাসের সনদ ও দলিল-প্রমাণ যাচাই করার স্থলে এ ভিত্তিহীন ইতিহাসের পাঠ নিয়েই কেবল সন্তুষ্ট থাকে নি,বরং তারা এটাকে অলংকার পরিয়েছে যে,তা এক হাজার এক রজনীর উপাখ্যান’ -এর রূপ পরিগ্রহ করেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়,যাঁরা মহানবীর পবিত্র জীবন চরিত সম্পর্কে অবগত,তাঁরা এ কল্পকাহিনীর মূল ও এর শাখা-প্রশাখাকে কল্পনার ফসল বলেই জানেন এবং মহানবীর পবিত্র জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়সমূহের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে বিবেচনা করেন। এমনকি ফখরুদ্দীন রাযী ও আলূসীর মতো পণ্ডিতগণও যতটা স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ভাষায় সম্ভব,সেভাবে এ কাহিনীটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে,ইসলামের শক্ররা এ সব কল্প-কাহিনী তৈরি করেছে এবং মুসলিম লেখক ও পণ্ডিতদের মধ্যে তা প্রচার করেছে।108

এ কথা কিভাবে বলা সম্ভব যে,এ কল্পকাহিনীটি তাবারী ও ইবনে আসীরের কাছে বিশ্বাসযোগ্য,অথচ তাঁরা তার কয়েক গুণ বেশি এ কল্পকাহিনীর পরিপন্থী বিষয় বর্ণনা করেছেন এবং তাঁরা মহানবীকে সব ধরনের পাপ ও কলুষতা থেকে মুক্ত বলে বিশ্বাস করেন?

যা হোক,আমরা পরবর্তী কয়েকটি পৃষ্ঠায় এ কাহিনী ভিত্তিহীন হওয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করব এবং বিষয়টি এতটা স্পষ্ট যে,এর চেয়ে বেশি আলোচনা করা নিস্প্রয়োজন বলে মনে করি। আমাদের প্রমাণসমূহ হলো :

1. উপরিউক্ত কাহিনীটি ইসলাম ও মুসলমানদের অকাট্য প্রামাণ্য দলিল ও সনদের পরিপন্থী। কারণ,পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের 37 তম আয়াতের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায়,আরবদের বাতিল (ভ্রান্ত) প্রথা বিলোপ করার জন্যই যায়নাবের সাথে মহানবীর বিয়ে হয়েছিল। আরবদের প্রথা ছিল এই যে,পালিত পুত্রের বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার অধিকার কারো নেই। আর এ বিয়ে মহান আল্লাহর আদেশেই সংঘটিত হয়েছিল। তবে তা পরকীয়া প্রেম ছিল না। কেউই ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ বিষয়টি অস্বীকার করে নি। আর পবিত্র কুরআনের বক্তব্য যদি বস্তুনিষ্ঠ না হতো,তা হলে ইহুদী,খ্রিষ্টান এবং মুনাফিক চক্র তাৎক্ষণিকভাবে মহানবীর ব্যাপারে সমালোচনামুখর হয়ে যেত এবং হৈ চৈ সৃষ্টি করত। অথচ তাঁর শত্রুরা,যারা সবসময় ওঁৎ পেতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকত,তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা যায় নি।

2. যায়নাব হচ্ছেন সেই মহিলা যাইদের সাথে বিয়ে হবার আগেই যিনি মহানবীর কাছে তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে যায়নাবের এ বিয়েতে তীব্র আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মহানবী তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত দাস যাইদকে যেন যাইনাব বিয়ে করেন,এ ব্যাপারে তাকীদ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) যদি তাঁকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে থাকতেন,তা হলে ঐ দিন তাঁকে বিয়ে করার ব্যাপারে ক্ষুদ্রতম বাধা-বিপত্তিও ছিল না। অথচ তিনি তখন যায়নাবকে কেন বিয়ে করলেন না? বরং আমরা দেখতে পাই,যায়নাব তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ইতিবাচক সাড়া তো দেন নি;বরং তাঁকে অন্য একজনকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

ইতিহাসের এ ভিত্তিহীন কাহিনী প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক সেনাদের এ ঘটনাকে রঙ লাগিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বর্ণনা করার আর কোন ক্ষেত্র বিদ্যমান থাকে না। এ গোষ্ঠীটির ঘৃণ্য ও মর্যাদাহানিকর মন্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করা অপেক্ষা আমরা মহানবীর জীবনচরিত ও ইতিহাসের পৃষ্ঠাসমূহকে অধিক পবিত্র ও উচ্চ বলে বিবেচনা করি। মহানবী (সা.) 50 বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর চেয়ে 18 বছরের ছোট যায়নাবের সাথে (একই সমাজে) বসবাস করেছেন। এ কারণেই আমরা এখানে প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য উদ্ধৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকলাম।

প্রয়োজন দু টি কথার ব্যাখ্যা

আলোচনার পূর্ণতা বিধানের জন্য এ প্রসঙ্গে যে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল,তা এবং এর দু খানা বাক্য,যা স্বল্প জ্ঞান ও তথ্যের অধিকারী কিছুসংখ্যক লোকের দ্বিধা ও সংশয়ের কারণ হয়েছিল,এখানে উল্লেখ করে এসবের ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করব। নিচে এ আয়াত উদ্ধৃত করা হলো :

) و إذ تقول للّذى أنعم الله عليه و أنعمت عليه أمسك عليك زوجك و اتّق الله(

“স্মরণ করুন,আল্লাহ্ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন,আপনি তাকে বলছিলেন : তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর’ ।” (সূরা আহযাব : 37)

এ অংশের বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা নেই। এখন যে বাক্যদ্বয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করা প্রয়োজন,তা নিচে উল্লেখ করা হলো :

1.و تُخفى فِى نفسك ما الله مبديه - আপনি যা নিজ অন্তরে গোপন রাখছেন,তা মহান আল্লাহ্ প্রকাশ করে দেবেন।”

যাইদকে এতসব উপদেশ দেয়ার পর মহানবী (সা.) নিজ অন্তরে এমন কোন্ বিষয় গোপন রেখেছিলেন যা মহান আল্লাহ্ স্পষ্ট প্রকাশ করে দেয়ার কথা বলেছেন?

এমনটা হয় তো কেউ ভাবতে পারে যে,মহানবী (সা.) যে বিষয় গোপন রাখতেন,তা ছিল এই যে,যদিও তিনি যাইদকে তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে বারণ করতেন,তবুও তিনি মনে মনে ঠিকই চাইতেন যে,যাইদ তাঁর স্ত্রীকে তালাক প্রদান করুন এবং এরপর তিনি তাঁকে বিয়ে করবেন।

এ ধরনের সম্ভাবনা কোনভাবেই সঠিক নয়। কারণ মহানবী (সা.) যদি মনে মনে এরূপ ধারণা পোষণ করবেন,তা হলে মহান আল্লাহ্ কেন অন্যান্য আয়াতের মাধ্যমে তাঁর এ গোপন আকাঙ্ক্ষা ফাঁস করে দিলেন না? অথচ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,মহানবী যা কিছু অন্তরে গোপন রেখেছেন,তা তিনি প্রকাশ করে দেবেন,যেমনটি তিনি এ আয়াতে বলেছেন :الله مبديه অর্থাৎ (আপনি যা গোপন রাখছেন) তা মহান আল্লাহ্ প্রকাশ করে দেবেন।

এ কারণেই মুফাসসিরগণ বলেন : মহানবী (সা.) যা নিজ অন্তরে গোপন রেখেছিলেন,তা ছিল ঐ ওহী যা মহান আল্লাহ্ তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেছিলেন। এর ব্যাখ্যা হলো : মহান আল্লাহ্ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করে জানিয়েছিলেন : যাইদ তার পত্নীকে তালাক দেবে। আর আপনি আরবদের কু-প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য তাকে বিয়ে করবেন। যে মুহূর্তে তিনি যাইদকে উপদেশ দিচ্ছিলেন,সে মুহূর্তেও এ ইলাহী বাণীর প্রতি তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল। তবে তিনি যাইদ ও অন্যান্য ব্যক্তির কাছে এ বাণী গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ্ এ বাক্যে মহানবীকে জানিয়ে দেন : আপনার অন্তঃকরণে যা আছে,মহান আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দেবেন এবং আপনার গোপন রাখার কারণে তা গোপন থাকবে না।

এ বক্তব্যের প্রমাণ হচ্ছে এই যে,পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে এ বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন :

) فلمّا قضي زيد منها وطرا زوّجناكها لكى لا يكون علي المؤمنين حرج فِى أزواج أدعيائهم(

“অতঃপর যখন যাইদ যায়নাবকে তালাক দিল,তখন আমরা তাকে আপনার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলাম,যাতে ঈমানদারদের দত্তক পুত্ররা যখন তাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে,তখন সেসব রমণীকে বিয়ে করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।”

এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.) যা গোপন রেখেছিলেন,তা ছিল ঐ খোদায়ী প্রত্যাদেশ যাতে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে,তিনি ভুল প্রথা বিলোপ করার জন্য বিয়ে বিচ্ছেদের পর পালিত পুত্রের সহধর্মিণীকে অবশ্যই বিয়ে করবেন।

2.و تخشي النّاس و الله أحقّ أن تخشاه - আর আপনি জনগণকে ভয় পাচ্ছেন,অথচ মহান আল্লাহ্ই হচ্ছেন সবচেয়ে উপযুক্ত সত্তা যাঁকে আপনার ভয় করা উচিত।”

এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় বাক্য যার অস্পষ্টতা প্রথম বাক্যের তুলনায় অনেক কম। কারণ,একটি কলুষিত পরিবেশে বহু বছর ধরে প্রচলিত একটি ঘৃণ্য প্রথা পদতলে পিষ্ট করা অর্থাৎ পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার সাথে স্বভাবতই এক ধরনের আত্মিক অশান্তি ও উদ্বেগ বিদ্যমান,যা মহান নবীগণের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আদেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যায়।

মহানবীর মাঝে যদি কোন উদ্বেগ থেকে থাকে বা তাঁর মাঝে যদি কোন উৎকণ্ঠার উদ্ভব ঘটে থাকে,তা হলে তা এ কারণে হয়েছিল যে,তিনি চিন্তা করতেন আরব জাতি-যারা জাহিলী যুগ এবং অপবিত্র ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাস থেকে সদ্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে),-তারা হয় তো বলবে যে,মহানবী (সা.) একটি জঘন্য কাজ করেছেন;অথচ তা প্রকৃতপক্ষে কখনোই ঘৃণ্য ও অন্যায় কাজ ছিল না।

সাঁইত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

আহযাব অর্থাৎ জোটবদ্ধ দলসমূহের যুদ্ধ 109

হিজরতের পঞ্চম বর্ষে মহানবী (সা.) বেশ কিছু যুদ্ধ বা গাযওয়ায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং শত্রুদের সম্ভাব্য চক্রান্ত প্রশমনের জন্য বেশ কিছু সারিয়াহ্ বা সামরিক অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন। এখন আমরা হিজরতের পঞ্চম বর্ষের কয়েকটি গাযওয়ার বিবরণ প্রদান করব :

1. গাযওয়া-ই-দাওমাতুল জান্দাল110

পবিত্র মদীনা নগরীতে গোপন সংবাদ এসে পৌঁছায় যে, দাওমাতুল জান্দাল’ নামক অঞ্চলে একদল লোক সংঘবদ্ধ হয়ে মুসাফির ও পথচারীদের ওপর অত্যাচার করছে এবং মদীনা নগরী অবরোধ করার অভিপ্রায় পোষণ করছে। মহানবী (সা.) তাদেরকে দমন করার জন্য এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা নগরী ত্যাগ করেন। তিনি রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনের বেলা যাত্রা-বিরতি করতেন ও বিশ্রাম নিতেন। শত্রুরা মহানবী (সা.)-এর সেনা অভিযানের ব্যাপারে অবগত হলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এরপর মহানবী (সা.) সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন এবং তিনি এ অঞ্চলের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিদল আশে-পাশের অঞ্চলগুলোয় প্রেরণ করেন।

মহানবী (সা.) 20 রবীউস সানী মদীনার উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং ফেরার সময় তিনি ফিযার গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মহানবী (সা.) তাকে মদীনার চারণক্ষেত্রগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দেন। কারণ তার গোত্র দুর্ভিক্ষ ও খরা কবলিত হয়েছিল।111

2. খন্দক বা পরিখার যুদ্ধ

আমাদের ইতোমধ্যে উল্লেখ মতো মহানবী (সা.) হিজরতের চতুর্থ বর্ষে বনী নাযীরের ইহুদীদের চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে পবিত্র মদীনা নগরী থেকে বহিষ্কার এবং তাদের কিছু ধন-সম্পদও জব্দ করেন। বনী নাযীর খাইবরের দিকে যেতে এবং সেখানে বসবাস করতে বা শামের দিকে যেতে বাধ্য হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর এ বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ঐ চুক্তি মোতাবেক ছিল যাতে দু পক্ষ স্বাক্ষর করেছিলেন। মহানবীর এ পদক্ষেপই বনী নাযীর গোত্রের নেতাদেরকে ষড়যন্ত্র করতে এবং মক্কা গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধে উস্কানি দিতে প্রভাবিত করেছিল। এখন এ যুদ্ধের একটি বিশদ বিবরণ দেয়া হলো :

এ যুদ্ধে আরব মুশরিক ও ইহুদীদের সেনাবাহিনীকে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হয়েছিল। তারা একটি শক্তিশালী সামরিক ঐক্যজোট গঠন করে প্রায় দীর্ঘ এক মাস মদীনা নগরী অবরোধ করে রেখেছিল। আর যেহেতু এ যুদ্ধে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী যোগদান করেছিল এবং শত্রুবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য মুসলমানরা মদীনার চারপাশে পরিখা খনন করেছিল,সেহেতু এ যুদ্ধকে আহযাব’ বা দলসমূহের যুদ্ধ’ এবং কখনো কখনো পরিখার যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।

যেভাবে আমরা উল্লেখ করেছি,বনী নাযীর গোত্রের ইহুদী নেতারা এবং বনী ওয়ায়েল গোত্রের একদল লোক ছিল এ যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলনকারী। বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীরা মুসলমানদের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছিল,সে কারণে এবং বাধ্য হয়ে তাদের মদীনা ত্যাগ করতে হয়েছিল এবং তাদের একদল খাইবরে আবাসন নিয়েছিল বিধায় তারা ইসলাম ধর্মের মূলোৎপাটনের একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। তারা আসলেই একটি অদ্ভূত পরিকল্পনা এঁটেছিল এবং মুসলমানদেরকে তারা বিভিন্ন দলের মুখোমুখি করে দিয়েছিল,যা ছিল আরব জাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

এ পরিকল্পনার ছত্রছায়ায় অগণিত আরব গোত্র ও গোষ্ঠী ইহুদীদের অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছিল এবং মুসলমানদের বিরোধী সেনাবাহিনীর জন্য সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল।

পরিকল্পনাটি ছিল এই যে,সাল্লাম ইবনে আবীল হুকাইক এবং হুইয়াই ইবনে আখতাবের মতো বনী নাযীর গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে পবিত্র মক্কায় গিয়ে কুরাইশ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল এবং তাদেরকে বলেছিল : মুহাম্মদ আপনাদের ও আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছে এবং বনী কাইনুকা গোত্র ও বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদেরকে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

আপনারা কুরাইশ গোত্র (মুহাম্মদের বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ান এবং আপনাদের মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্য নিন;আর মদীনার প্রবেশ মুখের কাছে আমাদেরও সাত শ’ ইহুদী তীরন্দাজ সৈন্য আছে এবং তাদের সবাই আপনাদের সাহায্যার্থে দ্রুত ছুটে আসবে। যদিও বাহ্যত মুহাম্মদের সাথে বনী কুরাইযা গোত্রের ইহুদীদের প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি আছে তবুও আমরা তাদেরকে এ চুক্তি উপেক্ষা করে আপনাদের সহযোগী হবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করব। 112

তাদের দম্ভোক্তি ও আস্ফালন-কুরাইশ নেতৃবর্গ,যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে গিয়েছিল,তাদের মধ্যে কার্যকর প্রভার বিস্তার করেছিল এবং ইহুদী নেতৃবর্গের পরিকল্পনাটি তাদের মনঃপূত হয়েছিল এবং তারা তাদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছিল। তবে (চূড়ান্ত) সম্মতি দানের কথা ঘোষণা করার আগেই তারা ইহুদী নেতৃবর্গকে জিজ্ঞেস করেছিল :

“আপনারা আহলে কিতাব সম্প্রদায় এবং আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারী। আপনারা সত্য ও মিথ্যা শরীয়তকে ভালোভাবেই পৃথক করতে সক্ষম। আর আপনারা জানেন,তার (মুহাম্মদ) ধর্ম যা আমাদের ধর্মের পরিপন্থী,কেবল তা ছাড়া মুহাম্মদের সাথে আমাদের কোন মতপার্থক্য নেই। সত্যি করে আমাদের বলুন তো,আমাদের ধর্ম উত্তম,নাকি তার ধর্ম-যা একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত?

এখন অবশ্যই দেখা উচিত,এ গোষ্ঠীটি (ইহুদীরা),যারা নিজেদেরকে পৃথিবীর বুকে তাওহীদের (একত্ববাদ) ধ্বজাধারী বলে মনে করে,ঐ অজ্ঞ গোষ্ঠীর প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছিল,যারা তাদেরকে বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য করে তাদের কাছে নিজেদের সমস্যাগুলো উপস্থাপন করেছিল? তারা চরম নির্লজ্জ ভাবে বলেছিল : মূর্তিপূজা মুহাম্মদের ধর্ম অপেক্ষা উত্তম। আপনারা আপনাদের ধর্মের ওপর অটল থাকবেন এবং তার ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র ঝোঁক প্রদর্শন করবেন না। 113

তারা এ বক্তব্যের দ্বারা আসলে নিজেদেরকেই কলঙ্কিত করেছে এবং এর ফলে ইহুদী জাতির ইতিহাস,যা আগে থেকেই কালো ছিল,আরো কালো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। এ স্খলন এতটাই অমার্জনীয় ছিল যে,স্বয়ং ইহুদী লেখকরাও এ ধরনের ঘটনায় অস্বাভাবিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ড. ইসরাইল ইহুদী জাতি ও আরবোদ্বীপের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন :

“যদি কুরাইশরা ইহুদীদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানও করত,তবুও ইহুদীদের এ ধরনের ভুল ও অন্যায় করা শোভনীয় ছিল না। অধিকন্তু,পৌত্তলিকদের শরণাপন্ন হওয়া ইহুদী জাতির জন্য কখনোই ঠিক হয় নি। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ আসলে তাওরাতের শিক্ষা ও নীতিমালারই পরিপন্থী। 114

আসলে এটা হচ্ছে এমন এক অভিমত যা বর্তমান কালের রাজনীতিবিদরা নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করে থাকেন। তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে কোন ধরনের বৈধ-অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করা উচিত। আর এ কথাটিই এ মতাদর্শের পূর্বসূরি মেকিয়াভেলী বলেছেন : লক্ষ্য মাধ্যমকে বৈধতা ও সিদ্ধতা প্রদান করে” (অর্থাৎ লক্ষ্য যদি মহান হয়,তা হলে তা অর্জন করার জন্য বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থা অবলম্বন করা যাবে এবং তা বৈধ হবে)। আর তাঁদের মতাদর্শে চারিত্রিক গুণাবলী (আখলাক) হচ্ছে এমন বিষয় যা লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সহায়ক।

পবিত্র কুরআন এ তিক্ত বিষয়টি সম্পর্কে এভাবে বলেছে :

) ألم تر إلى الّذين أوتوا نصيبا من الكتاب يُؤمنون بالجبت و الطّاغوت و يقولون للّذين كفروا هؤلَاء أهدي من الّذين آمنوا سبيلا(

“তুমি কি তাদের দেখ নি,যাদের কিতাবের (ইলাহী গ্রন্থ) এক (সামান্য) অংশ দেয়া হয়েছিল,তারা জিব্ত (প্রতিমার নাম) ও আল্লাহ্ ছাড়া সব পূজ্য সত্তায় বিশ্বাস করে? তারা কাফেরদের সম্পর্কে বলে : এদের পথ মুমিনদের চেয়ে উত্তম।” (সূরা নিসা : 51)

এসব আলেম নামধারীদের (ইহুদী নেতাদের) বক্তব্য মূর্তিপূজকদের মন-মানসিকতার ওপর কার্যকর প্রভাব ফেলে এবং তারা তাদের সম্মতির কথা ঘোষণা করে এবং মদীনার দিকে অভিযানের সময়ও নির্ধারণ করা হয়।

যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্বলনকারীরা খুশী মনে পবিত্র মক্কা থেকে বের হয়ে ইসলাম ধর্মের চরম শত্রু গাতফান গোত্রের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নাজদ অভিমুখে যাত্রা করে। গাতফান গোত্রের মধ্য থেকে বনী ফাযারাহ্,বনী মুররাহ্ ও বনী আশজা-এ শাখা-গোত্রগুলো তাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়,এ শর্তে যে,বিজয়ের পর খাইবরের উৎপাদিত শস্য এক বছর পর্যন্ত তাদেরকে প্রদান করতে হবে।

তবে এখানেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় নি। কুরাইশরা তাদের মিত্র বনী সালীম গোত্রকে এবং গাতফান গোত্র তাদের মিত্র বনী আসাদ গোত্রকে পত্র লিখে তাদেরও ঐ সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করার আহবান জানায়। মিত্ররাও তাদের আহবানে সাড়া দেয়। এরপর একটি নির্দিষ্ট দিবসে এসব দল ও গোষ্ঠী আরবোপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মদীনা অবরোধ ও দখল করার উদ্দেশ্যে অকস্মাৎ বন্যার মতো ছুটে আসে।115