চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83937 / ডাউনলোড: 7980
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

আরব বাহিনীর কতিপয় বীর যোদ্ধার পরিখা অতিক্রম

আমর ইবনে আবদে উদ,ইকরামাহ্ ইবনে আবী জাহল,হুবাইরা ইবনে ওয়াহাব,নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ্ এবং যিরার ইবনে খাত্তাব নামের পাঁচ বীর যোদ্ধা যুদ্ধের পোশাক পরে দর্পভরে বনী কিনানার সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল : তোমার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। আজ তোমরা বুঝতে পারবে,কারা আরব বাহিনীর প্রকৃত বীর যোদ্ধা।” এরপর অশ্ব চালনা করে পরিখার যে অংশটির প্রস্থ কম ছিল,সেখান দিয়ে ঘোড়া সহ লাফ দিয়ে এ পাঁচ বীর যোদ্ধা সেখানে প্রহরারত মুসলিম তীরন্দায সৈন্যদের নাগালের বাইরে চলে যায়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে পরিখা পার হবার স্থান ঘেরাও করে ফেলা হয় এবং অন্যদের তা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে বাধা দান করা হয়।

মল্ল (দ্বৈত) যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আসা এ পাঁচ বীর যোদ্ধা পরিখা ও সালা পাহাড়ের (ইসলামী সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় শিবির) মাঝখানে এসে দাঁড়াল। এ আরব বীরেরা সেখানে অহংকারবশত নিজেদের অশ্বগুলোর সাথে ক্রীড়ায় লিপ্ত হলো এবং ইশারায় তাদের প্রতিপক্ষকে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাতে লাগল।১২৯

এ পাঁচ জনের মধ্যে বীরত্ব ও কৌশলের দিক থেকে বেশ বিখ্যাত বীর যোদ্ধাটি মুসলমানদের সামনে এসে দ্বৈত যুদ্ধে লিপ্ত হবার আহবান জানাল। সে মুহূর্তের পর মুহূর্ত ধরে নিজের কণ্ঠ উচ্চকিত করতে লাগল এবং মাতলামিপূর্ণ হুঙ্কারধ্বনি দিয়ে বলতে লাগল :هل من مبارز؟ তোমাদের মধ্যে কি কোন যোদ্ধা আছে?”   তার এ আস্ফালন সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এবং মুসলিম সৈন্যদের দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। মুসলমানদের নীরবতা তার স্পর্ধা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে (ব্যঙ্গচ্ছলে) বলছিল : বেহেশতের দাবীদাররা কোথায়? তোমরা মুসলমানরা কি বলো না যে,তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে এবং আমাদের নিহতরা জাহান্নামে যাবে? তোমাদের মধ্য থেকে কি একজনও আমাকে দোযখে পাঠানোর জন্য বা আমার পক্ষ থেকে তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়?

আর সে তার এ কথাগুলো বীরগাঁথায় এভাবে বলছিল :

و لقد بححت من النّداء

بجمعكم هل من مبارز

“উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার জন্য এবং মল্লযোদ্ধাকে আহবান জানাতে জানাতে আমার গলা বসে গেছে।”

ইসলামী বাহিনীর সমাবেশ কেন্দ্রে আমরের আস্ফালন ও দম্ভোক্তির বিপরীতে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। তখন মহানবী (সা.) বলছিলেন,মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন বের হয়ে এ লোকের অনিষ্ট থেকে মুসলমানদের রেহাই দিক। কিন্তু একমাত্র হযরত আলী ইবনে আবী তালিব ছাড়া আর কেউই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন না।

ওয়াকিদী লিখেছেন : যখন আমর মুসলমানদের মধ্য থেকে তার সমকক্ষ যোদ্ধাকে এসে তার সাথে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাচ্ছিল,তখন সকল মুসলিম যোদ্ধার মাঝে এতটা নীরবতা বিরাজ করতে লাগল যে,এমন প্রতীয়মান হচ্ছিল,তাঁদের মাথার উপর যেন পাখিও বসে থাকতে পারবে। ১৩০

অগত্যা এ সমস্যার সমাধান অবশ্যই হযরত আলী ইবনে আবী তালিবের হাতেই হতে হবে। মহানবী (সা.) তাঁর তরবারি হযরত আলী (আ.)-এর হাতে তুলে দিলেন এবং তাঁর বিশেষ পাগড়ী তাঁর মাথায় বেঁধে দিয়ে তাঁর জন্য দুআ করলেন : হে আল্লাহ্! আলীকে সব ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। হে প্রভু! বদরের যুদ্ধে উবাইদাহ্ ইবনে হারেসা এবং উহুদের যুদ্ধে শেরে খোদা (আল্লাহর ব্যাঘ্র) হামযাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। হে প্রভু! আলীকে শত্রুর আঘাত ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন।” এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন :

) ربّ لا تذرنِى فردا و أنت خير الوارثين(

“হে প্রভু! আমাকে একাকী করবেন না;আর আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী।” (সূরা

আম্বিয়া : ৮৯)

হযরত আলী বিলম্ব পুষিয়ে দেয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রওয়ানা হয়ে গেলেন। এ সময় মহানবী তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক এ উক্তি করেছিলেন :

برز الإيمان كلّه إلى الشّرك كلّه

“পূর্ণ শিরকের মোকাবেলা করতে পূর্ণ ঈমান (রণক্ষেত্রে) আবির্ভূত হয়েছে।”

হযরত আলী (আ.) তাঁর প্রতিপক্ষের বীরগাঁথার অনুরূপ বীরগাঁথা রচনা করে বললেন :

لا تعجلن فقد أتاك

مجيب صوتك غير عاجز

তাড়াহুড়ো করো না।

কারণ তোমার আহবানে সাড়াদানকারী তোমার কাছে এসেছে,

যে অক্ষম (দুর্বল) নয়।

হযরত আলী (আ.)-এর সমগ্র দেহ লৌহ নির্মিত ভারী বর্ম ও অস্ত্র-শস্ত্রে আচ্ছাদিত ছিল এবং তাঁর চোখদ্বয় কেবল শিরস্ত্রাণের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল। আমর প্রতিপক্ষকে চিনতে চাচ্ছিল। তাই সে হযরত আলী (আ.)-কে বলল : তুমি কে?”   স্পষ্টবাদিতার জন্য বিখ্যাত হযরত আলী বললেন : আলী ইবনে আবী তালিব।” আমর বলল : আমি তোমার রক্ত ঝরাব না। কারণ তোমার পিতা ছিলেন আমার পুরনো বন্ধু। আমি তোমার চাচাত ভাইয়ের ব্যাপারে ভেবে অবাক হচ্ছি,সে তোমাকে কোন ভরসায় আমার সাথে লড়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে? আমি তোমাকে না জীবিত,না মৃত এমন অবস্থার মধ্যে বর্শায় গেঁথে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে (শূন্যে) ঝুলিয়ে রাখতে পারি।”

ইবনে আবীল হাদীদ বলেন : আমার ইতিহাস বিষয়ক শিক্ষক (আবুল খাইর) ইতিহাসের এ অধ্যায় বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করতে গেলেই বলতেন : আমর আসলে আলীর সাথে দ্বৈত যুদ্ধে লিপ্ত হবার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল। কারণ সে বদর ও উহুদ যুদ্ধে উপস্থিত ছিল এবং হযরত আলীর বীরত্ব সে সচক্ষে দেখেছে। এ কারণেই সে আলীকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে চাচ্ছিল।”

হযরত আলী (আ.) বললেন : তুমি আমার মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি উভয় অবস্থায় (আমি নিহত হই বা তোমাকে হত্যা করি) সৌভাগ্যবান এবং আমার বাসস্থান বেহেশত। তবে সকল অবস্থায় দোযখ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” আমর মুচকি হেসে বলল : আলী! এ ধরনের বণ্টন ন্যায়ভিত্তিক নয় যে,বেহেশত ও দোযখ উভয়ই তোমার সম্পত্তি হবে।”

ঐ সময় আলী (আ.) আমর ইবনে আবদে উদকে ঐ প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন,যা একদিন কাবার পর্দা ছুঁয়ে নিজ প্রভুর (মহান আল্লাহর) সাথে করেছিল। আর তা ছিল,যুদ্ধের ময়দানে যদি কোন বীর তার প্রতিপক্ষকে তিনটি প্রস্তাব দেয়,তা হলে সেগুলোর যে কোন একটি তাকে গ্রহণ করতে হবে। এ কারণেই হযরত আলী (আ.) প্রস্তাব দিলেন,প্রথমে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। কিন্তু সে বলল : আলী! এটা বাদ দাও। কারণ তা সম্ভব নয়।” আলী (আ.) তাকে বললেন : যুদ্ধ থেকে ক্ষান্ত হও এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে চলে যাও।” সে বলল : এ প্রস্তাব আমার জন্য লজ্জাকর। কারণ আগামীকালই আরবের কবিরা আমার ব্যাপারে ব্যঙ্গ করবে এবং তারা ভাববে,আমি ভয় পেয়ে এ কাজ করেছি।” তখন আলী (আ.) বললেন : এখন যখন তোমার প্রতিপক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে,তখন তুমিও তোমার ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসো যাতে আমরা মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হই।” সে বলল: আলী! আসলে এটি একটি তুচ্ছ প্রস্তাব মাত্র। আমি কখনোই ভাবি নি যে,কোন আরব আমার কাছে এমন প্রস্তাব করতে পারে! ১৩১

দুই বীরের লড়াই শুরু

দুই বীরের মধ্যে তীব্র মল্লযুদ্ধ শুরু হলো এবং তাদের দু জনের চারপাশ ধূলো-বালিতে ছেয়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারছিল না। ঢাল ও বর্মের উপর তরবারির আঘাতের শব্দ ছাড়া আর কিছুই তাদের কানে আসছিল না। বেশ কয়েকটা আঘাত ও পাল্টা আঘাতের পর আমর তার তরবারি দিয়ে হযরত আলীর মাথায় আঘাত হানলে আলী (আ.) তা তাঁর ঢাল দিয়ে প্রতিহত করলেন। এ সত্বেও তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি এ সুযোগে তরবারি দিয়ে প্রতিপক্ষের পায়ে তীব্র আঘাত হানলেন অথবা তিনি তার দু পা বা একটি পা কেটে ফেললেন। ফলে আমর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ধূলো-বালির মধ্য থেকে আলী (আ.)-এর বিজয়ী হবার নিদর্শন তাকবীর ধ্বনি উত্থিত হলো। যে সব আরব বীর আমরের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ছিল,আমরের ধরাশায়ী হবার দৃশ্য তাদের অন্তরে এতটা ভীতির সঞ্চার করল যে,তারা নিজেদের অজান্তেই লাগাম ধরে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে পরিখার দিকে চালনা করল এবং একমাত্র নওফেল ছাড়া তাদের সবাই তাদের নিজেদের সেনাশিবিরে ফিরে গেল। নওফেলের অশ্ব পরিখার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল এবং সে নিজেও মাটিতে পড়ে গিয়ে তীব্র আঘাত পেয়েছিল। পরিখায় প্রহরারত সৈন্যরা তার দিকে পাথর ছুঁড়তে থাকলে সে চিৎকার করে বলতে লাগল : এভাবে হত্যা করা মহানুভবতার পরিপন্থী। আমার সাথে মল্লযুদ্ধের জন্য একজন পরিখার ভেতরে নেমে এসো।” হযরত আলী (আ.) পরিখার ভেতরে নেমে তাকে হত্যা করলেন।

মুশরিক বাহিনীর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে প্রচণ্ড ভীতির সৃষ্টি হলো। আর আবু সুফিয়ানই সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে ভাবছিল,মুসলমানরা হামযার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নওফেলের লাশ বিকৃত করতে পারে। তাই সে নওফেলের লাশ দশ হাজার দীনারে ক্রয় করার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠালে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : লাশটা দিয়ে দাও। কারণ ইসলাম ধর্মে মৃতদেহের বিনিময়ে অর্থ নেয়া হারাম করা হয়েছে।”

হযরত আলী (আ.)-এর তরবারির এ আঘাতের মূল্য

বাহ্যত হযরত আলী (আ.) একজন বীরকে বধ করেছিলেন। তবে আসলেই তিনি ঐ সব ব্যক্তির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন,আমরের গগন বিদারী হুঙ্কারধ্বনি শুনে যাদের দেহে কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি দশ হাজার সৈন্যের যে বিশাল বাহিনী নবগঠিত ইসলামী হুকুমত ধ্বংস করার জন্য কোমর বেঁধে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল,তিনি তাদেরকেও ভীত-সন্তস্ত্র করে দিয়েছিলেন। আর যদি আমর জয়লাভ করত,তা হলে তখনই বোঝা যেত হযরত আলীর এ আত্মত্যাগের মূল্য কত অপরিসীম ছিল!

হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি এভাবে আলী (আ.)-এর এ আঘাতের মূল্যায়ন করে বলেছিলেন : আমার উম্মতের সমুদয় সৎকর্মের উপরে হচ্ছে এ আত্মত্যাগের গুরুত্ব। কারণ কুফরের সবচেয়ে বড় বীরের পরাজিত হবার কারণেই সকল মুসলমান মর্যাদাবান এবং সকল মুশরিক অপদস্থ হয়েছে। ১৩২

আলী (আ.)-এর মহানুভবতা

আমরের বর্ম অত্যন্ত দামী ও মূল্যবান হলেও হযরত আলী (আ.) মহানুভবতার কারণে তা ছুঁয়েও দেখেন নি। এমনকি দ্বিতীয় খলীফা এ জন্য আলী (আ.)-কে ভর্ৎসনা করেছিলেন যে,কেন তিনি আমরের দেহ থেকে বর্মটি খুলে আনেন নি। আমরের বোন ঘটনা জানতে পেরে বলেছিল : আমি কখনই দুঃখ করব না যে,আমার ভাই নিহত হয়েছে। কারণ সে এক মহানুভব ব্যক্তির হাতেই নিহত হয়েছে। আর এর অন্যথা হলে আমার দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত আমি অশ্রুপাত করতাম। ১৩৩

এখন আমরা দেখব,আরবের বীর আমর ইবনে আবদে উদ নিহত হবার পর মুশরিক বাহিনীর কী পরিণতি হয়েছিল।

ছত্রভঙ্গ সম্মিলিত আরব বাহিনী

ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পেছনে আরব বাহিনী ও ইহুদীদের একক উদ্দেশ্য ছিল না। নব্য প্রতিষ্ঠিত তরুণ ইসলামী রাষ্ট্রের উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করার কারণে ইহুদীরা ভীত হয়ে পড়েছিল এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের পুরনো শত্রুতা তাদেরকে এ যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেছিল। সেখানকার ইহুদীরা গাতফান,ফিযারাহ ও অন্যান্য গোত্রকে খাইবরের শস্য প্রদান করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল,সে কারণেই তারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সুতরাং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে গোষ্ঠীগুলোকে সর্বশেষ যা প্ররোচিত করেছিল,তা ছিল একটি বস্তুগত বিষয়। আর এ লক্ষ্য যদি মুসলমানদের মাধ্যমে পূরণ করা হতো,তা হলে তারা পূর্ণ সন্তুষ্টি সহ নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরে যেত,বিশেষ করে যখন তীব্র শীত,খাদ্যাভাব এবং অবরোধকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল এবং তাদের মন দুর্বল ও তাদের পশুগুলোও মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল।

এ কারণেই মহানবী (সা.) উল্লিখিত গোত্রগুলোর নেতাদের সাথে চুক্তি করার জন্য একটি প্রতিনিধিদলকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি প্রতিনিধিদলকে এ গোত্রগুলোর কাছে এ কথা বলে দেয়ার আদেশ দেন যে,মুসলমানরা তাদেরকে মদীনার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত ফল প্রদানে সম্মত আছে। তবে এ শর্তে যে,তাদেরকে সম্মিলিত বাহিনী থেকে বের হয়ে নিজেদের এলাকায় ফিরে যেতে হবে। মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধিগণ এ গোত্রগুলোর নেতাদের সাথে বসে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি করে তা চূড়ান্ত অনুমোদন ও স্বাক্ষরের জন্য মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থাপন করেন। তবে মহানবী (সা.) সা দ ইবনে মায়ায ও সা দ ইবনে উবাদাহ্ নামক তাঁর দু জন সেনাকর্মকর্তার সাথে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা দু জনই একই অভিমত ব্যক্ত করে বললেন, এ চুক্তি যদি মহান আল্লাহর নির্দেশে হয়ে থাকে,তা হলে তা মেনে নিতে হবে। আর এটি যদি আপনার ব্যক্তিগত বিবেচনায় হয়ে থাকে এবং আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাদের অভিমত চেয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের অভিমত হচ্ছে এই যে,চুক্তিটি এখানেই স্থগিত রাখতে হবে এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে না। কারণ আমরা অতীতে কখনই এসব গোত্রকে সেলামি দিই নি এবং এসব গোত্রের মধ্য থেকে একজনেরও জোর করে আমাদের কাছ থেকে এক টুকরো খেজুর পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়ার সাহস হয় নি। আর এখন যখন মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এবং আপনার নেতৃত্বে আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি এবং আমরা এ দ্বীনের বদৌলতে মর্যাদাবান ও শক্তিশালী,তখন এ সব গোষ্ঠী ও দলকে সেলামী দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

و الله لا نعطيهم إلّا السيف حتى يحكم الله بيننا و بينكم

-“মহান আল্লাহর শপথ! মহান আল্লাহ্ কর্তৃক আমাদের ও তাদের মাঝে তরবারি দিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের সকল বৃথা ও অন্যায় আব্দারের উত্তর তরবারি দিয়েই দেব।”

মহানবী বললেন : এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করার ব্যাপারে আমার চিন্তা-ভাবনার কারণ ছিল এই যে,যেহেতু তোমরা সম্মিলিত আরব বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছ এবং চতুর্দিক থেকে তোমরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছ,সেহেতু আমি দেখতে পেলাম,শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার মধ্যেই উদ্ধার পাবার পথ বিদ্যমান। এখন যখন তোমাদের আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে,তখন আমি এ চুক্তি স্থগিত করে দিচ্ছি এবং তোমাদের বলছি মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে অপদস্থ করবেন না এবং শিরকের ওপর তাওহীদের বিজয়ের ব্যাপারে তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্যই বাস্তবায়িত করবেন। ঐ সময় সা দ ইবনে মায়ায মহানবীর অনুমতি নিয়ে চুক্তিপত্রের বিষয়বস্তু মুছে ফেলে বললেন : মূর্তিপূজারীরা আমাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা তা করুক,আমরা কোন অবস্থায়ই তাদেরকে সেলামি দেব না। ১৩৪

সম্মিলিত আরব বাহিনীর ছত্রভঙ্গ ও ব্যর্থতার কারণ

১. বিজয়ের প্রথম কারণ ছিল গাতফান ও ফাযারাহ্ গোত্রের নেতাদের সাথে মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধিগণের সংলাপ। কারণ এ চুক্তি যদিও চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়নি,তবু তা বাতিল করারও ঘোষণা দেয়া হয় নি। এ গোত্রগুলো এভাবে নিজেদের মিত্রদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে দোদুল্যমান হয়ে যায় এবং দিনের পর দিন তারা এ চুক্তি সম্পাদনের প্রতীক্ষা করতে থাকে। যখন তাদেরকে সর্বাত্মক আক্রমণ করার অনুরোধ জানানো হতো,তখনই তারা এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আশায় কতকগুলো বিশেষ অজুহাত দাঁড় করিয়ে কুরাইশদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত।

২. সম্মিলিত আরব বাহিনীর শক্তিশালী বীর আমরের নিহত হওয়া,যার মল্লযুদ্ধে বিজয়ী হবার ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী ছিল। যুদ্ধে আমর নিহত হলে সম্মিলিত আরব বাহিনীর মাঝে তীব্র ভীতির উদ্ভব হয়। বিশেষ করে তার নিহত হবার পরপরই আরব বাহিনীর অন্যান্য বীর যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেছিল।

৩. নব বাইয়াতপ্রাপ্ত মুসলমান নুআইম ইবনে মাসউদ সম্মিলিত আরব বাহিনীর ঐক্য ভেঙে দেবার ব্যাপারে অসাধারণ প্রভাব রেখেছিলেন। তিনি মুশরিক বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন এবং এ কালের দক্ষ গুপ্তচরদের কর্মতৎপরতার চেয়ে তাঁর কর্মকাণ্ড কোন অংশে কম ছিল না;বরং ছিল আরো উন্নত এবং গুরুত্বপূর্ণ।

নুআইম ইবনে মাসউদ মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন : আমি একজন নও মুসলিম। আগে থেকেই সকল গোত্রের সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে। তারা আমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কথা জানে না। আপনার যদি কোন নির্দেশ থাকে তা হলে আমাকে তা বলুন,আমি তা বাস্তবায়ন করব।” মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন : এমন একটা কাজ কর যার ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অর্থাৎ কতকগুলো মহান কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য যদি তুমি একটি উপায় বের করার চিন্তা-ভাবনা কর এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন কর,তা হলে এতে কোন আপত্তি নেই। ১৩৫

নুআইম একটু চিন্তা করে তৎক্ষণাৎ বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের কাছে গেলেন। আর এ গোত্র আসলেই শত্রুর পঞ্চম বাহিনী ছিল এবং তাদের মাধ্যমে পেছনে থেকে মুসলমানদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকায় তারা ছিল প্রত্যক্ষ হুমকিস্বরূপ। তিনি বনী কুরাইযার দুর্গে প্রবেশ করে তাদের কাছে তাঁর বন্ধুত্ব,আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। তিনি তাদের সাথে এমনভাবে কথাবার্তা বললেন যেন তিনি তাদের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হন। এরপর তিনি বললেন : জোটবদ্ধ দলগুলো অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের সাথে তোমাদের অবস্থার পার্থক্য আছে। কারণ মদীনা হচ্ছে তোমাদের সন্তান ও নারীদের আবাসস্থল এবং তোমাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ এখানেই রয়েছে। তাই কোন অবস্থায়ই এখান থেকে অন্য কোথাও তোমাদের চলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে মিত্র ও জোটভুক্ত গোষ্ঠী,যারা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এখানে এসেছে,তাদের আবাসস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা মদীনার বাইরে ও এখান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।

তারা যদি সুযোগ পেয়ে এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়,তা হলে তো তারা তাদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উপনীত হবেই। আর যদি তারা এ যুদ্ধে পরাজিত হয়,তখন তারা তৎক্ষণাৎ এ স্থান ত্যাগ করে নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে যাবে,যা মুহাম্মদের নাগালের বাইরে।

তবে তোমাদের এ কথা ভেবে দেখা উচিত,যদি জোটভুক্ত দলগুলো এ যুদ্ধে বিজয়ী না হয় এবং তারা যদি তাদের কেন্দ্রে ফিরে যায়,তা হলে তোমরা মুসলমানদের হাতের মুঠোর মধ্যে পড়ে যাবে। আমি মনে করি,এখন যেহেতু তোমরা জোটভুক্ত দলগুলোর সাথে যোগ দিয়েই ফেলেছ,সেহেতু এ সিদ্ধান্তের ওপর তোমাদের অটল থাকা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তবে যাতে করে সম্মিলিত জোটভুক্ত দলগুলো য্দ্ধু চলাকালে তোমাদের ত্যাগ করে নিজ নিজ ভূ-খণ্ডে প্রত্যাবর্তন না করে,সেজন্য তাদের কয়েকজন নেতা ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিকে যিম্মী রাখ,যেন তারা তোমাদের দুর্দিনে তোমাদের একাকী রেখে যেতে না পারে। কারণ তখন তারা তাদের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও নেতাদের মুক্তির জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে বাধ্য হবে।

বনী কুরাইযার দুর্গে কুরাইশ প্রতিনিধিদের গমন

আবু সুফিয়ান যুদ্ধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য শনিবার রাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ কারণেই কুরাইশ ও গাতফান গোত্রপতি ও নেতারা কয়েকজন প্রতিনিধিকে বনী কুরাইযার দুর্গে প্রেরণ করে এবং তারা তাদেরকে জানায় : এ স্থান আমাদের আবাসভূমি নয়;আমাদের পশুগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা আগামীকাল পেছন থেকে আক্রমণ চালাবে যাতে আমরা এ যুদ্ধের একটা চূড়ান্ত রফা করতে পারি।” সম্মিলিত আরব গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদেরকে বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের সেনাপতি বলেছিল : আগামীকাল শনিবার। আর আমরা ইহুদী জাতি এ দিন কোন কাজ করি না। কারণ আমাদের একদল পূর্বপুরুষ এ দিনে কাজে হাত দিয়েছিল বলে আল্লাহর শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল। অধিকন্তু আমরা ঐ অবস্থায় যুদ্ধ করব যখন আরব দল ও গোষ্ঠীগুলোর কতিপয় নেতা যিম্মী হিসেবে আমাদের দুর্গে অবস্থান করবে যাতে করে তোমরা তাদের মুক্তির জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে যেতে থাকবে এবং যুদ্ধ চলাকালে তোমরা আমাদের একাকী ফেলে পলায়ন করবে না।”

কুরাইশ প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে গোত্রপতি ও নেতাদের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করে। তখন সবাই বলেছিল : নুআইম সহানুভূতি প্রকাশ করে যা বলেছে,তা ঠিকই (সত্যই) ছিল। আসলে বনী কুরাইযা আমাদের সাথে চালাকী করতে চাচ্ছে।” আবারো কুরাইশ প্রতিনিধিরা বনী কুরাইযার নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে বলল : আমাদের কতিপয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে দেব,তা আসলে বাস্তব নয়। এমনকি আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজন লোককেও তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নই। যদি তোমরা চাও,কাল মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে পার। তা হলে আমরাও তোমাদের সাহায্য করব।”

‘আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজনকেও তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে তুলে দেব না’ -কুরাইশ প্রতিনিধিদলের এ ধরনের উক্তি নুআইমের কথা সত্য হবার ব্যাপারে বনী কুরাইযার সকল সংশয় দূর করে দিল এবং সবাই অভিমত ব্যক্ত করল : নুআইম যা বলেছে,তা-ই সত্য। কুরাইশরা আসলে নিজেদের স্বার্থ ও পরিণতি নিয়েই কেবল ভাবে। যদি তারা এ যুদ্ধে জয়ী হবার সম্ভাবনা না দেখে,তা হলে তারা নিজেদের পথ ধরবে এবং এভাবে তারা মুসলমানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। ১৩৬

সর্বশেষ কারণ

উপরিউক্ত কারণগুলো,আরেকটি কারণ-যা আসলে গায়েবী সাহায্য’ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে-এর সাথে যুক্ত হয়ে জোটভুক্ত দল ও গোষ্ঠীগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। অন্য কারণটি ছিল হঠাৎ করে আবহাওয়া তীব্রভাবে ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং ঝড় বইতে থাকে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তন এতটা তীব্র ছিল যে,তাঁবুগুলোকে উল্টে ফেলে দেয়;ফানুস ও প্রদীপগুলো নিভে যায় এবং প্রজ্বলিত অগ্নিরাশি মরুর বুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় মহানবী (সা.) হুযাইফাকে পরিখা অতিক্রম করে শত্রুদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আনার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেন : আমি আবু সুফিয়ানের কাছে গেলাম। তাকে সম্মিলিত আরব বাহিনীর সেনাপতিদের মাঝে বক্তৃতা করতে দেখলাম এবং তখন সে বলছিল : আমরা যে অঞ্চলে এসেছি তা আমাদের বসবাসের কেন্দ্র নয়। আমাদের পশুগুলো ধ্বংস হয়েছে এবং ঝড়ো হাওয়া আমাদের তাঁবু,আস্তাবল ও প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডগুলো অবশিষ্ট রাখে নি। আর বনী কুরাইযাও আমাদের সাহায্য করে নি। আমাদের এ স্থান ত্যাগ করাই হচ্ছে কল্যাণকর। এরপর সে তার হাঁটুবাঁধা উটের উপর আরোহণ করে সেটাকে চাবুক দিয়ে কষে আঘাত করতে লাগল। বেচারা আবু সুফিয়ান এতটা ভীত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল যে,তার উটের পাগুলো যে বাঁধা রয়েছে,সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না।”

তখনও ভোরের আলো ফুটে বের হয় নি;সম্মিলিত আরব বাহিনী এ সময় ঐ স্থান ত্যাগ করে এবং তাদের একটি লোকও সেখানে অবশিষ্ট থাকে নি।১৩৭

আটত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

সেনা মনোবল শক্তিশালী করণ

মহানবী (সা.) যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। এবারও যখন (মাঝপথ থেকে তিন শ লোকের মুনাফিক দলটি মুসলমানদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর) কেবল সাত শ মুসলিম যোদ্ধা তিন হাজার শত্রু-সৈন্যের মোকাবেলায় দাঁড়ালো তখন মহানবী এক ভাষণ প্রদান করে তাদের মনোবল দৃঢ় করেন। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদী বলেন :

মহানবী (সা.) আইনাইন গিরিপথে 50 জন তীর নিক্ষেপকারী সৈন্য মোতায়েন করেন;উহুদ পর্বত পেছনে এবং মদীনা সামনে রেখে অবস্থান নেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সৈন্যদের সারিগুলো বিন্যস্ত করছিলেন এবং প্রত্যেক অধিনায়কের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিলেন। একদলকে সামনে এবং একদলকে পেছনে রাখছিলেন। সৈন্যদের সারি সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্কতা দেখিয়েছিলেন যে,কোন সৈনিকের কাঁধ সামনের দিকে এগিয়ে আসলে সাথে সাথে তাকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

মহানবী সৈন্যদের সারি বিন্যস্ত করার পর মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন,আমি তা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : তোমরা মহান আল্লাহর আদেশের আনুগত্য কর। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকবে। এরপর তিনি বলেন : শত্রুর মুকাবেলা করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই শত্রুর মুকাবেলায় দৃঢ় পদ ও অবিচল থাকার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কেবল তারাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম,যাদের আল্লাহ্ হিদায়েত করেছেন এবং শক্তি যুগিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহর আদেশ পালনকারীদের সাথেই তিনি আছেন। শয়তান ঐ লোকদের সাথে আছে যারা মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। সবকিছুর আগে জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।24 ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা জিবরীল আমাকে বলেছেন : এ জগতে কোন ব্যক্তিই তার (জন্য বরাদ্দ) রিযকের সর্বশেষ দানাটি আহার না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না। যতক্ষণ যুদ্ধের নির্দেশ জারি না হয়,কেউ যেন আক্রমণ পরিচালনা না করে। 25

যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ শত্রুবাহিনী

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে বর্ম পরিহিত পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অধিনায়কত্বে একদলকে মোতায়েন করে ডান পাশে। অপর এক দলকে ইকরামার অধিনায়কত্বে মোতায়েন করে বাম দিকে।

এছাড়া সে অগ্রবর্তী দলরূপে একটি বিশেষ দলকে সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে মোতায়েন করে যার মধ্যে পতাকাবাহীও ছিল। এরপর বনী আবদুদ্দার গোত্রভুক্ত পতাকাবাহীদের সম্বোধন করে আবু সুফিয়ান বলল : সেনাবাহিনীর বিজয় তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা বদরের দিন এ অংশের দিক থেকেই আক্রান্ত হয়ে পরাজয় বরণ করেছি। যদি বনী আবদুদ্দার গোত্র পতাকা বহন ও রক্ষার ব্যাপারে যোগ্যতার প্রমাণ না দেয়,তা হলে পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রের কাঁধে চলে যাবে। কুরাইশ বাহিনীর প্রথম পতাকাবাহী বীর যোদ্ধা তালহা ইবনে আবি তালহার কাছে কথাটি মারাত্মক বলে মনে হলো। তাই সে তৎক্ষণাৎ ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিপক্ষের মল্লযোদ্ধাদের আহবান জানাল।

মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহ

যুদ্ধ শুরু হবার আগে মহানবী একখানা তরবারি হাতে নিলেন। স্বীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে তাদের লক্ষ্য করে বললেন : কোন্ ব্যক্তি এ তরবারি ধারণ করে তার হক আদায় করবে? 26 কিছু লোক সাড়া দিলেন। কিন্তু মহানবী তাদেরকে তরবারি দিতে সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অকুতোভয় সৈনিক আবু দুজানাহ্ সাড়া দিয়ে বললেন, এই তরবারীর হক বলতে কি বুঝায়? কিভাবে এর হক আদায় করা যাবে?”   মহানবী বললেন : এটা নিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবে যাতে তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানাহ্ বললেন : আমি এর হক আদায় করতে প্রস্তুত আছি। এরপর মৃত্যুর রুমাল নামে বিখ্যাত একটি লাল রঙের রুমাল মাথায় বেঁধে মহানবীর হাত থেকে ঐ তরবারি তুলে নেন। আবু দুজানাহ্ যখনই এ রুমালটি মাথায় বাঁধতেন,তখনই বোঝা যেত,যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে,ততক্ষণ তিনি লড়াই করে যাবেন।

তিনি এক গর্বিত চিতাবাঘের মতো পথ চলছিলেন। আজ তাঁর সৌভাগ্যের জন্য তিনি অতিশয় আনন্দিত। মাথায় লাল রংয়ের পট্টি তাঁর মর্যাদা ও গৌরব আরো বৃদ্ধি করছিল।27

সত্যিই যে সেনাবাহিনী একমাত্র সত্য ও নৈতিকতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়,যাদের সামনে নিজ বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই,তাদের জন্যে এ ধরনের মহড়া হচ্ছে সর্বোত্তম উদ্দীপক। মহানবীর লক্ষ্য কেবল আবু দুজানাকে উৎসাহিত করাই ছিল না;বরং তিনি এ কাজের দ্বারা সাহাবীগণের আবেগকেও শাণিত করেন। তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে,তাঁদের সিদ্ধান্ত ও বীরত্ব এমন পর্যায়ের হতে হবে যে,এর ফলে তাঁরাও এ ধরনের সামরিক পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

যুবাইর ইবনে আওয়াম ছিলেন এক বীর যোদ্ধা। মহানবী (সা.) হাতের তরবারিখানা তাঁকে না দেওয়ায় তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বললেন : আবু দুজানার বীরত্ব ও সাহসের মাত্রা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি তাঁর পিছু নেব। তিনি বললেন : আমি যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পেছনে পেছনে ছিলাম। দেখেছিলাম,যে বীর যোদ্ধাই তাঁর সামনে আসছিল,তিনি সাথে সাথে তাকে খতম করে দিচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এক বীর ছিল,যে মুসলমানদের মধ্যেকার আহতদের মাথা দ্রুত দ্বিখণ্ডিত করছিল। এ কাজ দেখে আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে লোকটি আবু দুজানার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বীরটি আবু দুজানার হাতে নিহত হলো। আর স্বয়ং আবু দুজানাহ্ও বর্ণনা করেছেন : একজনকে দেখলাম,যে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে যখন দেখল,তার মাথার উপর তরবারি,তখন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল। হঠাৎ দেখলাম এ হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। আমি মনে করলাম,হিন্দ্-এর মতো মহিলাকে হত্যা করে মহানবীর তরবারি অপবিত্র করা উচিত হবে না। 28

যুদ্ধের সূচনা

মদীনা হতে পলাতক আউস গোত্রের লোক আবু আমেরকে দিয়ে যুদ্ধ শরু হয়ে যায়। ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে সে মদীনা থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। আউস গোত্রের পনের ব্যক্তিও তার সাথে ছিল। আবু আমেরের ধারণা ছিল,আউস গোত্রের লোকেরা যখন তাকে দেখবে,তখন মহানবীকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যে সে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন সে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়,তখন সে তাদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কাজেই অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর সে রণাঙ্গন থেকে সরে পড়ে।29

উহুদের ময়দানে কয়েকজন যোদ্ধার লড়াই ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের মনে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার। ইবনে আব্বাস বলেন : হযরত আলী সকল যুদ্ধেই মসুলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন। সর্বদা দক্ষ,পরীক্ষিত ও অবিচল যোদ্ধাদের মধ্য থেকেই পতাকাধারী নির্বাচন করা হতো। উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর হাতে ছিল।

অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,মুসলমানদের পতাকাবাহী মুসআব ইবনে ওমাইর নিহত হবার পর মহানবী (সা.) আলীর হাতে পতাকা তুলে দেন। মুসআব প্রথম পতাকাবাহী হবার কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে,তিনি আবদুদ্দার গোত্রের লোক ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাধারীরাও এই গোত্রের লোক ছিল।30

তালহা ইবনে আবি তালহা,যাকেكبش الكتيبة কাবশুল কাতীবাহ্ বলা হতো,হুংকার দিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলো এবং চিৎকার দিয়ে বলল : হে মুহাম্মদের সাথীরা! তোমরা বল যে,আমাদের নিহত ব্যক্তিরা দোযখে আছে,আর তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে। এই অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে,আমি তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিই অথবা সে আমাকে দোযখে পাঠিয়ে দিক?”   তার কণ্ঠস্বর যুদ্ধের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলী (আ.) সামনে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি ঘাত-প্রতিঘাতের পর আলীর তরবারির আঘাতে তালহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তালহা নিহত হলে পতাকা বহনের পালা আসে পর্যাক্রমে তার দু ভাইয়ের ওপরে। উভয়ে আসেম ইবনে সাবিতের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।

দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত শূরার (পরামর্শ) সভায় আমীরুল মুমিনীনের (আলী) প্রদত্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় যে,কুরাইশ বাহিনী নয় জনকে পতাকা বহনের জন্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছিল। কথা ছিল,পর্যায়ক্রমে তারা সেনাবাহিনীর পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করবে। পর্যায়ক্রমটি ছিল প্রথম ব্যক্তি নিহত হলে পরের ব্যক্তি-এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পতাকা বহন করবে। এসব পতাকাবাহীর সবাই ছিল বনী আবদুদ্দার গোত্রের লোক। তারা সবাই উহুদ যুদ্ধের দিবসে হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে প্রাণ হারায়। এদের পর সাওআব নামক এক হাবশী ক্রীতদাস,যার দেহ-কাঠামো ছিল খুবই ভয়ানক এবং মুখমণ্ডল ছিল বীভৎস,সে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা ধারণ করেছিল। সেও ময়দানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আহবান করেছিল। সেই ক্রীতদাসও হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল।

আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের বিরাট পরামর্শসভায় তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,আমি বনী আবদুদ্দার গোত্রের নয় জনের অনিষ্টতা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছিলাম,যাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আহবান করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে পতাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিল। উপস্থিত ব্যক্তিদের সবাই হযরত আলীর বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।31

তিনি আবারো বললেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,ঐ নয় ব্যক্তির পরে হাবশী ক্রীতদাস সাওআব রণাঙ্গনে এসেছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহানবীকে হত্যা করা। সে এতখানি ক্রোধান্বিত ছিল যে,তার মুখ ফেনায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দু টি লাল হয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই ভয়ঙ্কর যোদ্ধাকে দেখে ভয়ে পিছু হটে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সামনে এগিয়ে যাই,তার কোমরের উপর আঘাত হানি এবং তাকে ধরাশায়ী করি। এবারও উপস্থিত সবাই হযরত আলীর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন।

প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করতে লড়ছিল যে জাতি

হিন্দ এবং অন্যান্য নারীরা কুরাইশ সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যেসব কবিতা আবৃত্তি করছিল ও গান গাইছিল,তাতে দফ ও খঞ্জনা বাজিয়ে তাদেরকে রক্তপাত ঘটানো ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করার আহবান জানাচ্ছিল। তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে,এই জাতি নৈতিক চেতনা,পবিত্রতা,স্বাধীনতা ও সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে লড়ছিল না;বরং তাদের জন্য উত্তেজক ছিল বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ও যৌন সম্ভোগ। দফ ও তবলাবাদক নারীরা কুরাইশ বাহিনীর মাঝখানে এক বিশেষ সুর মূর্চ্ছনায় গান গাইছিল :

نحـن بنات طـارق

نـمشى على النّـمارق

إن تـقبلـوا نعـانق

أو تــدبـروا نـفـارق

আমরা বালিকা পথের

গালিচার উপর দিয়ে করি পদচারণ।

যদি মুখোমুখি হও শত্রুর,করবো আলিঙ্গন

(আর) যদি শত্রু থেকে কর পৃষ্ঠ প্রদর্শন,

তা হলে ছেড়ে যাবো তোমাদের।

নিঃসন্দেহে,যে জাতির যুদ্ধ যৌন বিষয়াদির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য না থাকে;অন্যদিকে যে জাতি স্বাধীনতার প্রসার,চিন্তার উৎকর্ষতা,কাঠ ও মাটির মূর্তির উপাসনা ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে,-উভয়ের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য ও অতুলনীয় ব্যবধান রয়েছে। এ দু দলের মধ্যে ভিন্ন-ধর্মী দু ধরনের মনোবলের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইসলামের বীর সমরনায়কগণ,যেমন আলী,হামযাহ্,আবু দুজানাহ্,যুবাইর ও অন্যান্যের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগী লড়াইয়ের ফলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্র ও গনীমতের সম্পদ ফেলে রেখে অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পালাতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামের সৈনিকদের গৌরব একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে।32

বিজয়ের পর পরাজয়

ইসলামের সৈনিকরা এ কারণে বিজয়ী হয়েছিল যে,বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথে জিহাদ,তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের প্রচার এবং এ পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল,সেগুলো অপসারণ ছাড়া তাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না।

বিজয় লাভের পরে পরাজয় এজন্য হয়েছিল যে,অধিকাংশ মুসলমানের নিয়্যত ও লক্ষ্যে পরিবর্তন এসে যায়। কুরাইশ বাহিনী যেসব গনীমতের মাল ফেলে পালিয়েছিল,সেসবের প্রতি মনোযোগ তাদের ইখলাস (নিষ্ঠা) কলুষিত করেছিল এবং তারা মহানবীর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল।

ঘটনার বিবরণ

আমরা উহুদ প্রান্তরের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনায় এ বিষয় উল্লেখ করেছি যে,উহুদ পর্বতের মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের ফাটল ছিল। মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইরের অধিনায়কত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের ওপর রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগের এ গিরি প্রহরার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন,তীর নিক্ষেপ করে পাহাড়ের ফাটলের ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যদের আগমন ও চলাচল প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন,তারা কোন অবস্থায়ই তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না।

যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতার মধ্যে শত্রু সৈন্যরা যখনই এই গিরিপথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে,তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ও মালপত্র মাটিতে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলায়ন শুরু করে,তখন প্রাণপণ লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইসলামের মুষ্টিমেয় বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গিয়ে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত থাকে। তারা (শত্রুবাহিনীর) ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ও সম্পদ সংগ্রহে তৎপর হয়ে যায়। তারা ধরে নিয়েছিল,যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত সৈনিকরা সুবর্ণ সুযোগ ভেবে মনে মনে বলে : আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থক। আমাদেরও গনীমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের অধিনায়ক বললেন : মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী বাহিনী জয়ী হোক বা পরাজিত হোক,আমরা যেন এ স্থান ত্যাগ না করি। অধিকাংশ তীর নিক্ষেপকারী রক্ষী সেনা তাদের অধিনায়কের নির্দেশের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়ে বলে : এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল,যুদ্ধ চলাকালে আমরা যেন এ গিরিপথটি পাহারা দিই। এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । এর ভিত্তিতে চল্লিশ জন সৈন্য প্রহরার স্থান থেকে নিচে নেমে আসে। সেখানে কেবল দশ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ রইল না।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। শুরু থেকেই সে জানত,গিরিপথের মুখটি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি এবং সে বেশ কয়েক বার ঐ পথ দিয়ে রণাঙ্গনের পেছন দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবার প্রহরীদের তীর নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার সে তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগ গ্রহণ করে। সে কুরাইশ সৈন্যদের মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করতে নেতৃত্ব দেয়। সে এক দফায় অতর্কিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হয়। টিলার উপর মোতায়েন মুষ্টিমেয় তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যের প্রতিরোধে কোন লাভ হলো না। ঐ দশ ব্যক্তি প্রাণপণ লড়াই করে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসতর্ক ও নিরস্ত্র মুসলমানরা পেছন দিক থেকে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্পর্শকাতর স্থানটি দখল করে নেয়ার পর পরাজিত কুরাইশ বাহিনীর পলায়নপর সৈন্যদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার আহবান জানায়। সে চিৎকার করে ও শ্লোগান দিয়ে কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধ স্পৃহা এবং অবিচল থাকার মনোবৃত্তি চাঙ্গা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের যুদ্ধের সারি ছত্রভঙ্গ থাকার সুযোগে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। তারা পেছন ও সামনের দিক থেকে ইসলামী বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এ পরাজয়ের কারণ ছিল,ঐ দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি,যারা বস্তুগত লক্ষ্যের জন্য বাঙ্কার বা অবস্থানস্থল ছেড়ে এসেছিল এবং নিজেদের অজান্তেই শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর ফলে কুরাইশ বাহিনীর অশ্বারোহী দল খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে পেছন দিক থেকে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়ে।

আবু জাহলের ছেলে ইকরামার হামলায় খালিদের আক্রমণ অভিযান শক্তিশালী হয়। এ সময় ইসলামী বাহিনীতে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায়ন্তর দেখলেন না। কিন্তু চেইন অব কমান্ড যেহেতু ভেঙে পড়েছিল,সেহেতু ইসলামের সৈনিকরা সাফল্যজনক প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেন না। বরং তাঁরা বড় ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। কয়েকজন মুসলমান সৈনিকও অসর্তকতার কারণে অন্য মুসলিম সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। খালিদ ও ইকরামার আক্রমণ অভিযান কুরাইশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা করে। পলাতক কুরাইশ সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং তাদের শক্তি ও সমর্থন যোগাতে থাকে। এ অবস্থায় তারা মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের একদলকে হত্যা করে।

মহানবী (সা.)-এর নিহত হবার সংবাদ

কুরাইশ বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা লাইসী ইসলামী বাহিনীর বীর পতাকাবাহী মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর হামলা করে। তাদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ইসলামী বাহিনীর পতাকাধারী শাহাদাত লাভ করেন। ইসলামী যোদ্ধাদের চেহারা ঢাকা ছিল। সে ভাবল,নিহত ব্যক্তি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হবেন। তখনই সে চিৎকার দিল এবং সেনা অধিনায়কদের উদ্দেশে বলল : ভাইসব! মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদটি কুরাইশ বাহিনীর মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

কুরাইশ নেতারা এমন আনন্দিত হলো যে,তাদের আওয়াজ সমগ্র রণাঙ্গনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তারা সবাই বলছিল :ألا قد قُتل محمّد، ألا قد قُتل محمّد মুহাম্মদ নিহত হয়েছে,মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদ রটে যাওয়ায় দুশমনদের সাহস বেড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী তখন তরঙ্গমালার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল,মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটায় অংশ নেবে এবং এর মাধ্যমে শিরক ও পৌত্তলিকতার জগতে খ্যাতি অর্জন করবে।

এ গুজব দুশমন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে,ইসলামের মুজাহিদদের মনোবল ভেঙে দেয়াতেও ততখানি প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলমানদের বহু লোক যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মাত্র কয়েক মুজাহিদ যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকেন।

কিছুসংখ্যক লোকের পলায়ন কি অস্বীকার্য?

(উহুদের রণাঙ্গন থেকে) সাহাবীদের পলায়ন এবং তাঁদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। অথবা যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে সুখ্যাতি এবং উচ্চ মর্যাদা ও পদের অধিকারী হয়েছিলেন,সেহেতু তা আমাদের এ তিক্ত সত্য মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েও দাঁড়াবে না।

বিখ্যাত মুসলিম সীরাত রচয়িতা ইবনে হিশাম লিখেছেন,মুসলিম বাহিনী যখন চাপের মুখে পড়ে এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে,তখন অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবন রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং সবাই যে যার মতো একেক দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আনাস ইবনে মালিকের চাচা আনাস আনাস ইবনে নযর একদল মুজাহির ও আনসার,যাঁদের মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও ছিলেন,তাঁদেরকে দেখতে পেলেন যে,তাঁরা এক কোণায় বসে আছেন এবং নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছেন। তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠে তাঁদেরকে বললেন : আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন;তাই এখন য্দ্ধু করে কোন লাভ নেই। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন : যদি মহানবী নিহত হয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের এ জীবনের কোন লাভ নেই। আপনারাও সবাই উঠে যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন,সে পথে শহীদ হোন। 33 অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন,আনাস ইবনে নযর ঐ সময় বললেন : মুহাম্মদ যদি নিহত হয়েও থাকেন,মুহাম্মদের আল্লাহ্ তো জীবিত আছেন। এরপর তিনি দেখতে পেলেন যে,তাঁর কথা তাঁদের উপর কোন প্রভাব রাখছে না। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইবনে হিশাম বলেন,এ যুদ্ধে আনাসের দেহে 70টি ক্ষত বা আঘাত ছিল এবং তাঁর বোন ব্যতীত আর কেউই তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি।

একদল মুসলমান এতটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে,তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর দ্বারস্থ হতে চেয়েছিল যাতে সে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে।34


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53