চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79236
ডাউনলোড: 7054


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79236 / ডাউনলোড: 7054
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ফিতনার সর্বশেষ ঘাঁটি

প্রথম যে বছর মহানবী (সা.) হিজরত করে মদীনায় আসেন সে বছর তিনি মদীনার সকল অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য একটি জীবন্ত সনদ বা ঘোষণাপত্র তৈরি করেন। আউস ও খাযরাজ গোত্র এবং বিশেষ করে দু টি ইহুদী গোত্র মদীনার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। সকল বৈশিষ্ট্য ও ধারা সমেত এ সনদ সম্মানিত পাঠকবর্গের সামনে ইতোমধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে।138

অন্যদিকে মহানবী (সা.) মদীনার ইহুদীদের সাথে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করেন। বিভিন্ন ইহুদী গোত্র চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে,তারা যদি মহানবী ও তাঁর সাহাবীগণের ক্ষতি করে বা শত্রুকে অস্ত্র ও বহনকারী পশু দিয়ে সাহায্য করে,তা হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান,তাদের ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করার ব্যাপারে মহানবীর হাত উন্মুক্ত থাকবে।

তবে তিন ইহুদী গোত্রই বিভিন্ন অজুহাতে এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। বনী কাইনুকা একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিল,আর বনী নাযীর গোত্র মহানবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তাই মহানবীও তাদেরকে মদীনা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন এবং তাদেরকে মুসলমানদের এলাকা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। বনী কুরাইযাহ্ গোত্রও ইসলাম ধর্মের মূলোৎপাটন করার জন্য সম্মিলিত আরব বাহিনীর সাথে (পরিখার যুদ্ধে) সহযোগিতা করেছিল। এখন আমরা দেখব,ইসলামের মহান নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.) বনী কুরাইযাহ্ গোত্রকে কিভাবে শায়েস্তা করেছেন।

মদীনার আকাশ তখনও ভোরের আলোয় ফর্সা হয় নি,এমন সময় সম্মিলিত আরব বাহিনীর সর্বশেষ দলটি অস্বাভাবিক ধরনের ভীতি সহকারে মদীনা ত্যাগ করে। ক্লান্তির চিহ্ন তখনও মুসলমানদের চোখে-মুখে বিদ্যমান। এ সত্বেও মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর তরফ থেকে বনী কুরাইযার ভাগ্য চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আদেশপ্রাপ্ত হন। মুয়াযযিন আযান দেন এবং মুসলমানদের সাথে মহানবী যুহরের নামায পড়েন। এরপর মহানবীর নির্দেশে মুয়াযযিন ঘোষণা করেন : বনী কুরাইযার মহল্লায় মুসলমানদের আসরের নামায পড়তে হবে। 139

এরপর মহানবী হযরত আলীর হাতে পতাকা অর্পণ করেন। সাহসী মুসলিম সৈনিকগণ হযরত আলীর পেছনে পেছনে অগ্রযাত্রা শুরু করে বনী কুরাইযার দুর্গ চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেন। দুর্গের প্রহরীরা মুসলিম সেনাবাহিনীর অগ্রসর হবার সংবাদ দুর্গের ভেতরে পৌঁছে দেয়। আর ইহুদীরা তাৎক্ষণিকভাবে দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। মুসলিম বাহিনী সেখানে উপস্থিত হবার মুহূর্ত থেকেই ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তখন বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা দুর্গের ছিদ্র ও টাওয়ার থেকে মহানবীকে অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করছিল। ইহুদীদের অশোভন উক্তিগুলো মহানবীর কর্ণগোচর না হওয়ার জন্য মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী হযরত আলী (আ.) মদীনার দিকে যাত্রা করলেন,যাতে তিনি মহানবীকে দুর্গের নিকটবর্তী হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন। কিন্তু মহানবী হযরত আলীকে বললেন : তাদের চোখ যদি আমার উপর পড়ে,তা হলে তারা গালিগালাজ ও অশোভন উক্তি থেকে বিরত হবে।” মহানবী দুর্গের কাছে গেলেন এবং তাদের লক্ষ্য করে বললেন :هل أخزاكم الله و أنزل عليكم نقمته মহান আল্লাহ্ কি তোমাদের লাঞ্ছিত করেন নি?

ইহুদীদের উদ্দেশে মহানবীর এ ধরনের কঠোর উক্তির আসলেই কোন নযীর ছিল না। তাঁর আবেগ প্রশমিত করার জন্য তারা তখন বলল : হে আবুল কাসেম! আপনি তো এতটা কঠোরভাষী ছিলেন না!

এ কথাটি মহানবীর অনুভূতিকে এতটা নাড়া দিয়েছিল যে,তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে পেছনের দিকে চলে যান এবং তাঁর দেহ থেকে তাঁর লম্বা জামাটি মাটিতে পড়ে যায়।140

দুর্গের অভ্যন্তরে ইহুদীদের পরামর্শ সভার আয়োজন

এ সভায় হুয়াই ইবনে আখতাব নাযীরী উপস্থিত ছিল,যে ছিল পরিখা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলনকারী। সে সম্মিলিত আরব বাহিনী ও দলগুলোর ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রস্থান করার পর খাইবরের দিকে না গিয়ে বনী কুরাইযার দুর্গে প্রবেশ করে।

ইহুদী গোত্রের নেতা নিম্নোক্ত তিনটি প্রস্তাব দেয় এবং তাদেরকে যে কোন একটি গ্রহণ করার আহবান জানায় :

1. আমরা সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করব;কারণ মুহাম্মদের নবুওয়াত একটি অকাট্য বিষয় এবং আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আর তাওরাতও তা সত্যায়ন করেছে;

2. আমরা আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করে দুর্গ থেকে বের হয়ে মুসলমানদের সাথে স্বাধীনভাবে যুদ্ধ করব। যদি আমরা নিহত হই,তা হলে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আর যদি আমরা এ যুদ্ধে বিজয়ী হই,তা হলে আমরা পুনরায় স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি লাভ করতে পারব;

3. আজ শনিবারের রাত। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা জানে,ইহুদীরা শনিবার দিন ও রাতে কোন কাজে হাত দেয় না। অতএব,আমরা তাদের এ অমনোযোগিতার সদ্ব্যবহার করে রাতের বেলা তাদের ওপর আক্রমণ চালাব।141

পরামর্শসভা এ তিন প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে অভিমত ব্যক্ত করে : আমরা কখনোই আমাদের ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাত থেকে হাত গুটিয়ে নেব না। আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করার পর আমাদের কাছে আমাদের জীবন আর সুখের থাকবে না। আর তৃতীয় প্রস্তাবটিও ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কারণ এর ফলে যেভাবে আমাদের পূর্বেকার জাতিগুলো শনিবার দিবসের মর্যাদা এবং অধিকার সংরক্ষণ না করার জন্য মহান আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়েছিল,সেভাবে আমরাও খোদায়ী ক্রোধের শিকার হব।”

পরামর্শ সভার সদস্যদের মানসিকতা জানার জন্য তাদের কথোপকথনই হচ্ছে সর্বোত্তম মাধ্যম। প্রথম প্রস্তাব নাকচ করার অর্থই হচ্ছে আসলেই এই ইহুদীরা একটি একগুঁয়ে ও শত্রু মনোভাবাপন্ন সম্প্রদায় ছিল। কারণ সত্যি যদি তারা মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে অবহিত থাকে,তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একগুঁয়েমি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। দ্বিতীয় প্রস্তাব এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে তা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়,এ সম্প্রদায় ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। কারণ তা না হলে তাদের পক্ষে নিরপরাধ শিশু ও নারীদের হত্যা করা সম্ভব নয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে,পরামর্শসভা এ কারণে এ প্রস্তাব বাতিল করেছিল যে,তাদের শিশু-সন্তান ও নারীদের মৃত্যুর পর জীবন তাদের কাছে আর সুখকর থাকবে না। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে একজনও ঘূণাক্ষরেও বলে নি : এসব অসহায় শিশু ও নারী কী অপরাধ করেছে,যেজন্য তাদেরকে আমরা জবাই করব? যদি মুহাম্মদ তাদের ওপর বিজয়ী হয় এবং তাদেরকে নিজ কর্তৃত্বেও নিয়ে যায়,তবুও সে তাদেরকে কখনোই হত্যা করবে না। তাই আমরা (স্নেহময় পিতারা) কিভাবে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হতে পারি?

তৃতীয় প্রস্তাব থেকে প্রমাণিত হয় যে,তারা মহানবীর আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সামরিক কলা-কৌশল ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে নি;বরং তারা ভেবেছিল যে,ইসলাম ও মুসলমানদের মহান নেতা শনিবার দিন ও রাতে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। তাও আবার ইহুদীদের মতো শত্রুর ক্ষেত্রে,যারা ছলচাতুরী ও শঠতার জন্য দুর্নাম অর্জন করেছিল।

পরিখার যুদ্ধের ঘটনা পর্যালোচনা করলে প্রমাণিত হয়,এ গোষ্ঠীর মধ্যে সতর্ক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। তা না হলে তারা রাজনৈতিক (প্রজ্ঞার) দৃষ্টিকোণ থেকেও এ দুই গোষ্ঠীর (মুসলমান ও মুশরিক) মধ্য থেকে কোনটির সাথে যোগ না দিয়েই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারত এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও সম্মিলিত আরব বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধে দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারত। আর এভাবে যে কোন পক্ষ জয়যুক্ত হোক না কেন,সর্বাবস্থায় তাদের অস্তিত্ব ও সম্মান বজায় থাকত।

অথচ তারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে হুয়াই ইবনে আখতাবের মিষ্টি ভাষা ও চাটুকারিতায় বিভ্রান্ত হয়ে সম্মিলিত আরব বাহিনীর সাথে যোগদান করেছিল। তাদের এ দুর্ভাগ্য তীব্র হয়ে পড়ে যখন এক মাস আরব বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করার পর অবশেষে তাদেরকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকল এবং নুআইম ইবনে মাসউদ কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করে কুরাইশদের কাছে বার্তা পাঠাল : যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের বড় বড় ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে আমাদের কাছে যিম্মী স্বরূপ হস্তান্তর না করবে,ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তোমাদের সাথে কখনোই সহযোগিতা করব না।

এসব অবিবেচক ব্যক্তি এ সময় ভীষণভাবে হতাশ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। তারা ভাবতে পারছিল না,এদিকে তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে,এখন কুরাইশদের সাথে যদি তারা সম্পর্কচ্ছেদ করে,তা হলে সম্মিলিত আরব বাহিনী শক্তিহীনতা অনুভব করবে এবং তারা যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। আর এ অবস্থায় সমগ্র বনী কুরাইযাহ্ গোত্র মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে পড়বে।

তাদের যদি আসলেই সঠিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকত,তা হলে যে মুহূর্তে তারা সম্মিলিত আরব বাহিনী থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল,সেই মুহূর্তেই তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে অনুশোচনা প্রকাশ করতে পারত এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করত,যার ফলে তারা মুসলমানদের সম্ভাব্য বিজয়ের বিপদ থেকে নিরাপদ থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্য তখন তাদেরকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল যে,তারা কুরাইশদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েও মুসলমানদের সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয় নি।

মহানবী (সা.) সম্মিলিত আরব বাহিনীর প্রস্থান করার পরও বনী কুরাইযাহ্ গোত্রকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে পারেন নি। কারণ উপযুক্ত সময় ও সুযোগ পেলেই সম্মিলিত আরব বাহিনী পর্যাপ্ত অস্ত্র ও রসদপত্র সংগ্রহ করে মদীনা দখল করার পাঁয়তারা করত এবং বনী কুরাইযাহ্ গোত্র-যারা ইসলাম ধর্মের মূলোৎপাটন করার চাবিকাঠি এবং ঘরের শত্রু বলে গণ্য হতো,-তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে তারা ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বকেই পুনরায় হুমকির সম্মুখীন করত। সুতরাং বনী কুরাইযাহ্ সমস্যা’ র সমাধান এবং তাদের ব্যাপারটা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা তখন মুসলমানদের জন্য একটি অতি সংবেদনশীল ও ভাগ্যনির্ধারণী বিষয় বলে গণ্য হয়।

আবু লুবাবার বিশ্বাসঘাতকতা

দুর্গ অবরোধের পর বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা মহানবী (সা.)-এর কাছে অনুরোধ করেছিল যেন তিনি আবু লুবাবাহ্ আওমীকে তাদের কাছে প্রেরণ করেন যাতে তারা তাঁর সাথে পরামর্শ করতে পারে। আগে থেকেই বনী কুরাইযার সাথে আবু লুবাবার মৈত্রীচুক্তি ছিল। তিনি দুর্গে গেলে ইহুদী নারী ও শিশুরা তাঁকে ঘিরে ধরে কান্নাকাটি ও বিলাপ করতে লাগল এবং বলল : শর্তহীন আত্মসমর্পণ কি আমাদের জন্য কল্যাণকর?

আবু লুবাবাহ্ বললেন, হ্যাঁ।” তবে তিনি হাত দিয়ে গলার দিকে ইঙ্গিত করলেন অর্থাৎ তারা আত্মসমর্পণ করলে নিহত হবে। তিনি জানতেন,মহানবী (সা.) এ গোষ্ঠীটির অস্তিত্ব আর বরদাশ্ত করবেন না। কারণ তারা তাওহীদী আদর্শ ও দীনের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি। যেহেতু আবু লুবাবাহ্ ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অর্থাৎ তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছেন,সেহেতু তিনি অত্যন্ত অনুতপ্ত হলেন। তিনি কাঁপতে কাঁপতে অত্যন্ত ফ্যাকাসে চেহারায় ইহুদীদের দুর্গ থেকে বের হয়ে সরাসরি মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং সেখানে নিজেকে মসজিদের একটি স্তম্ভের সাথে বাঁধলেন। আর তিনি মহান আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন,মহান আল্লাহ্ যদি তাঁর পাপ ক্ষমা না করেন,তা হলে তিনি মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত এ অবস্থার মধ্যেই থাকবেন।

মুফাসসিরগণ বলেছেন,এ আয়াত আবু লুবাবার বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল :

) يا أيّها الّذين آمنوا لا تخونوا الله و الرّسول و تخونوا أماناتكم و أنتم تعلمون(

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সজ্ঞানে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের সাথে এবং যে সব আমানত তোমাদের কাছে আছে,সেসবের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।” (সূরা আনফাল : 27)

মহানবী (সা.) আবু লুবাবার অবস্থার কথা জানতে পেরে বললেন : এ কাজ করার আগে সে আমার কাছে এলে আমি তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম এবং মহান আল্লাহ্ও তাকে ক্ষমা করে দিতেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে না দেবেন,ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে এ অবস্থায় থাকতে হবে।”

যে রশি দিয়ে তিনি নিজেকে স্তম্ভের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন,আবু লুবাবার স্ত্রী নামায পড়ার সময় গিয়ে তা খুলে দিতেন এবং নামায পড়ার পর আবার তাঁকে মসজিদের স্তম্ভের সাথে বেঁধে রাখতেন।

এভাবে ছয় দিন গত হয়ে গেল। ভোরের বেলা যখন মহানবী (সা.) উম্মে সালামার হুজরায় অবস্থান করছিলেন,তখন ওহীর ফেরেশতা আবু লুবাবাকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা ঘোষণাসম্বলিত নিম্নোক্ত আয়াতসহ আগমন করেন :

) و آخرون اعترفوا بذنوبِهم خلطوا عملا صالحا و آخر سيئاً عسي الله أن يتوب عليهم إنّ الله غفور رّحيم(

“তাদের মধ্যকার আরেকটি দল নিজেদের পাপ স্বীকার করেছে,তারা সৎ কর্ম ও অসৎ কর্ম পরস্পর মিশ্রিত করেছে;সম্ভবত আশা করা যায়,মহান আল্লাহ্ তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও চিরদয়ালু।” (সূরা তওবা : 102)

উম্মে সালামার দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের উপর পড়লো। ঐ সময় মহানবীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছিল। মহানবী (সা.) উম্মে সালামাকে বললেন : মহান আল্লাহ্ আবু লুবাবার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন;উঠে গিয়ে সুসংবাদ দাও।” উম্মে সালামা মহান আল্লাহ্ যে আবু লুবাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন,জনগণকে সে সম্পর্কে সুসংবাদ প্রদান করলে জনতা এ কথা শুনে তাঁর বন্ধনগুলো খুলে দেয়ার জন্য মসজিদের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু তিনি বললেন : মহানবী (সা.) এসে আমার বন্ধন খুলে দেবেন।” মহানবী (সা.) ফজরের নামায পড়ার জন্য মসজিদে গমন করলেন এবং তিনি তাঁর বন্ধনগুলো খুলে দিলেন।142

অবশ্য আবু লুবাবার এ স্খলন তাঁর অনুচিত অনুভূতির কারণেই হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতক নারী-পুরুষের ক্রন্দন তাঁর থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল এবং তিনি মুসলমানদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। তবে তাঁর ঈমানী শক্তি এবং মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর ভয়-ভীতি এর চেয়েও উন্নত ছিল যা তাঁকে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য এতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল যে,দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বাঘাতকতা করার চিন্তা তাঁর মনে কখনোই উঁকি দেয় নি।