চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79208
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79208 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পঞ্চম বাহিনীর পরিণতি

একদিন ইহুদী শাস বিন কাইস বনী কুরাইযার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে দুর্গ থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং আবেদন করে,তিনি যেন বনী কুরাইযাকে অন্যান্য ইহুদীর ন্যায় অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। মহানবী তার এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে বললেন : বনী কুরাইযার উচিত বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করা।” শাস তখন তার প্রস্তাব পরিবর্তন করে বলল : বনী কুরাইযাহ্ তাদের সমস্ত ধন-সম্পদ মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মদীনা ত্যাগ করতে প্রস্তুত রয়েছে।” কিন্তু মহানবী এবারও তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না।143

এখানে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে,মহানবী (সা.) কেন বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের প্রতিনিধির প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি? এর কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। তা এজন্য যে,বনী নাযীর গোত্রের মতো এ গোত্র যখন মুসলমানদের নাগালের বাইরে চলে যেত,তখন তারা মুশরিক আরব সামরিক শক্তিগুলোকে পুনরায় উস্কানি দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বড় বড় বিপদ ও হুমকির সম্মুখীন এবং এক বিপুল সংখ্যক লোকের রক্তপাতের কারণ হতে পারত। এ কারণেই মহানবী বনী কুরাইযার প্রেরিত প্রতিনিধির প্রস্তাব মেনে নেন নি। তাই শাস ফিরে গিয়ে বিষয়টা বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ঊর্ধ্বতন নেতাদের অবহিত করে।

বনী কুরাইযাহ্ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল,তারা বিনা শর্তে মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে বা কতিপয় ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে,বনী কুরাইযাহ্ তাদের মিত্র সা দ ইবনে মায়ায তাদের ব্যাপারে যে ফয়সালা দেবেন,তা বিনা বাক্যে মেনে নেবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গের ফটকগুলো খুলে দেয়া হলে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) একটি বিশেষ সেনাদল নিয়ে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করে তাদের সবাইকে নিরস্ত্র করলেন এবং তাদেরকে বনী নাজ্জার গোত্রের ঘর-বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখা হলো,যাতে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়।

ইসলামী সেনাবাহিনী এর আগে বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীদের বন্দী করেছিল। কিন্তু খাযরাজ গোত্র,বিশেষ করে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের হস্তক্ষেপের কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং মহানবী (সা.) তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এ কারণেই খাযরাজ গোত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে এবার আউস গোত্র বনী কুরাইযার সাথে তাদের পুরনো মিত্রতা থাকার কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার ব্যাপারে মহানবীকে তাকীদ দিতে থাকে। কিন্তু মহানবী তাদের আবেদনের বিরোধিতা করে বললেন : এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার তোমাদের গোত্রের প্রধান ও নেতা সা দ ইবনে মায়াযের ওপর অর্পণ করছি। তিনি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন,আমি তা গ্রহণ করব।” তখন উপস্থিত সবাই মহানবীর প্রস্তাব মেনে নিল।

এখানে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে,সা দ ইবনে মায়াযের ফয়সালা প্রদানের বিষয়টি বনী কুরাইযার কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। তাই ইবনে হিশাম ও শেখ মুফীদের বর্ণনানুসারে,বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা মহানবীকে এ বার্তা পাঠিয়েছিল :ننزل علي حكم سعد معاذ সা দ ইবনে মায়ায আমাদের ব্যাপারে যে রায় প্রদান করবেন,আমরা তা মেনে নেব।144

হাতে তীর বিদ্ধ হয়ে আহত হবার কারণে ঐ সময় সা দ ইবনে মায়ায অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে পারদর্শী ফীদা’ নামের মহিলার সেবা ও তত্ত্বাবধানে তাঁর তাঁবুতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আর মহানবী (সা.) তাঁকে দেখার জন্য কখনো কখনো সেখানে যেতেন। আউস গোত্রের যুবকরা উঠে চলে গেল এবং গোত্রপতিকে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা সহকারে মহানবীর কাছে নিয়ে আসল। সা দ রাসূলের দরবারে হাজির হলে মহানবী (সা.) বললেন : সবার উচিত আউস গোত্রপ্রধানকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।” তখন উপস্থিত সবাই সা দের সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করলেন। সা দের সাথে যারা এসেছিল তারা তাঁকে মহানবীর কাছে আসার সময় বারবার অনুরোধ করছিল,তিনি যেন বনী কুরাইযার ব্যাপারে দয়া প্রদর্শন করেন এবং মৃত্যুর হাত থেকে তাদের প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু তিনি তাদের এত অনুরোধ সত্বেও ঐ সভায় রায় প্রদান করলেন যে,বনী কুরাইযার যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে;তাদের ধন-সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন এবং তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করতে হবে।145

সা দ ইবনে মায়াযের দলিল অধ্যয়ন

এতে কোন বিতর্ক নেই যে,বিচারকের আবেগ-অনুভূতি যদি তার বিচার-বুদ্ধি ও বিবেকের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে,তা হলে সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের উদ্ভব হবে;আর এর পরিণতিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে;গোটা সমাজের অস্তিত্বই তখন বিপন্ন হয়ে যাবে। আবেগ-অনুভূতি হচ্ছে কৃত্রিম ক্ষুধার মতো,যা ক্ষতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত খাদ্য-সামগ্রীকে উপকারী হিসেবে দেখায়। তাই মানুষের বিবেক ও বিচার-বুদ্ধির ওপর এ ধরনের আবেগ-অনুভূতির প্রাধান্য ব্যক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য ক্ষতিকর।

সা দ ইবনে মায়ায ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র হৃদয় ও আবেগপ্রবণ মানুষ। অন্যদিকে বনী কুরাইযার নারী ও শিশুদের দিকে তাকালে স্বভাবতই যে কারো হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হতো। তেমনি বন্দী শিবিরে অবস্থানরত পুরুষদের দিকে তাকালেও হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হবার কথা। এ ছাড়া বিচারক যাতে তাদের অপরাধ উপেক্ষা করেন,এ জন্য আউস গোত্রের লোকেরা খুবই পীড়াপীড়ি করছিল। এসব বিষয়ের দাবী ছিল এটাই যে,উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নিয়োজিত বিচারক সংখ্যাগুরুদের (মুসলিম জনগণের) স্বার্থের ওপরে একটি সংখ্যাস্বল্প সম্প্রদায়ের (বনী কুরাইযার) স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করে রায় দেবেন এবং বনী কুরাইযার অপরাধীদের কোন না কোনভাবে নির্দোষ ঘোষণা করবেন অথবা অন্তত তাদেরকে শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা প্রদর্শন করবেন বা পূর্ববর্তী পরিকল্পনাগুলোর যে কোন একটি মেনে নেবেন।

কিন্তু বিচারকের যুক্তি,বিবেক-বুদ্ধি এবং মুক্ত ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হওয়া,সর্বসাধারণের (মুসলিম জনতার) কল্যাণ ও স্বার্থ বিবেচনা তাঁকে এমন এক দিকে পরিচালিত করল যে,তিনি অবশেষে সে দিকেই ধাবিত হলেন এবং বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের যোদ্ধা পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড,তাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ জব্দকরণ এবং তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করার পক্ষে রায় প্রদান করলেন। তিনি নিম্নোক্ত দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁর এ ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছিলেন। যথা :

1. বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা কিছু দিন আগে মহানবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে,যদি তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের শত্রুদের সাহায্য করে,বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদের উস্কানী দেয়,তা হলে মুসলমানরা তাদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে।146 বিচারক বললেন :

আমি যদি এ চুক্তি মোতাবেক বনী কুরাইযার ইহুদীদের শাস্তি দিই,তা হলে আমি ন্যায়বিচার পরিপন্থী কোন রায় প্রদান করি নি।”

2. চুক্তি ভঙ্গকারী গোষ্ঠীটি সম্মিলিত আরব বাহিনীর ছত্রছায়ায় বেশ কিছু কাল মদীনা নগরীতে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল এবং মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত— করার জন্য তাদের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। তবে মহানবী (সা.) যদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতেন এবং নগরীর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য একদল সৈন্যকে মদীনা নগরীর দিকে প্রেরণ না করতেন,তা হলে বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতো এবং তারা এ অবস্থায় যুদ্ধ করতে সক্ষম মুসলিম পুরুষদের হত্যা করত,তাদের ধন-সম্পদ জব্দ করত এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী ও দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করত। সা দ ইবনে মায়ায ভেবে দেখলেন,তিনি যদি তাদের ব্যাপারে এ ধরনের বিচার করেন,তা হলে তা সত্য ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে না।

3. আউস গোত্রপ্রধান সা দ ইবনে মায়ায বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন এবং তাদের সাথে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ইহুদীদের দণ্ডবিধি সম্পর্কেও তাঁর জানার সম্ভাবনা ছিল। ইহুদীদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতের মূল ভাষ্য নিম্নরূপ :

তুমি যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কোন শহরের দিকে অগ্রসর হলে প্রথমে তাদেরকে শান্তি ও সন্ধির দিকে আহবান জানাবে;আর তারা যুদ্ধ বাঁধিয়েই দিলে তাদের নগরী অবরোধ করবে এবং যখনই ঐ নগরীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে,তখনই তাদের পুরুষদের হত্যা করবে। তবে নারী,শিশু,পশু এবং যা কিছু ঐ শহরের মধ্যে থাকবে,সেগুলো গনীমত হিসেবে নিজ অধিকারে আনবে।147

সম্ভবত সা দ ইবনে মায়াযের ধারণা ছিল এই যে,তিনি উভয় পক্ষের মনোনীত কাযী (বিচারক) এবং তিনি যদি আগ্রাসনকারীদের তাদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে শাস্তি প্রদান করেন,তা হলে তাঁর এ কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে না।

4. আমরা মনে করি,এ ধরনের রায় প্রদান করার প্রধান কারণ ছিল সা দ ইবনে মায়ায নিজ চোখে দেখেছিলেন,মহানবী (সা.) খাযরাজ গোত্রের অনুরোধের ভিত্তিতে বনী কাইনুকা গোত্রের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এবং তাদের মদীনা নগরী ত্যাগ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছিলেন। কিন্তু গোষ্ঠীটি তখনও ইসলামী ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে নি,এ অবস্থায় (তাদের গোত্রপতি) কা ব ইবনে আশরাফ মক্কা নগরী গিয়ে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশ ব্যক্তিদের জন্য কুম্ভিরাশ্রু ঝরিয়েছিল এবং কুরাইশরা (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে নিশ্চুপ বসে থাকে নি। ফলে উহুদের যুদ্ধের আগুন জ্বলেছিল এবং ইসলামের সত্তর জন শ্রেষ্ঠ সন্তান এ যুদ্ধে শাহাদাতের শরবত পান করেছিলেন।

ঠিক একইভাবে বনী নাযীর গোত্রকেও মহানবী (সা.) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা মহানবীর মহান এ কাজের বিপক্ষে একটি সামরিক জোট গঠন করে আহযাবের যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। যদি মহানবী দক্ষ সমর-কৌশল ও যুদ্ধ পরিচালনা এবং পরিখা খননের পরিকল্পনা প্রণয়ন না করতেন,তা হলে সেই প্রথম দিনগুলোয়ই তারা ইসলামের অস্তিত্ব মুছে ফেলত এবং পরবর্তী কালে ইসলামের আর কোন নাম-নিশানাই থাকত না এবং এভাবে হাজার হাজার লোক নিহত হতো।

সা দ ইবনে মায়ায এ সব দিক খুব ভালোভাবে বিবেচনা করেছিলেন। অতীত অভিজ্ঞতাসমূহও তাঁকে আবেগ-অনুভূতির কাছে বশ্যতা স্বীকার এবং একটি অপরাধী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বন্ধুত্ব ও স্বার্থের অনুকূলে হাজার হাজার লোকের স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার অনুমতি দেয় নি। কারণ সন্দেহাতীতভাবে এ গোষ্ঠীটি ভবিষ্যতে আরো বৃহত্তর জোট গঠন করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিক আরব বাহিনী ও সামরিক শক্তিগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলত এবং যুদ্ধ করার জন্য উস্কানি দিত। এভাবে তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রকেই হুমকি ও বিপদের সম্মুখীন করত। এ কারণেই তিনি এ গোষ্ঠীটির অস্তিত্বকে মুসলিম সমাজের জন্য পুরোপুরি বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন,যদি এ গোষ্ঠীটি মুসলমানদের নাগালের বাইরে চলে যায়,তা হলে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকবে না এবং মুসলমানদের ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন করবে।

যদি এসব কারণ বিদ্যমান না থাকত,তা হলে সা দ ইবনে মায়াযের জন্য সাধারণ জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবী পূরণ করে তাদেরকে সন্তুষ্ট করা গুরুত্ব পেত ও প্রাধান্য লাভ করত। আর একটি জাতি বা গোত্রের প্রধান সবকিছুর চেয়ে তাঁর নিজ গোষ্ঠী বা জনগণের প্রতি সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। তাই তাদেরকে অসন্তুষ্ট করা বা তাদের প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যান করা যে কোন গোত্রপ্রধানের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। তবে তিনি এসব আবেদন ও অনুরোধকে হাজার হাজার মুসলমানের কল্যাণ ও স্বার্থের পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তাই তিনি নিজ গোত্রের লোকদের অসন্তুষ্ট করে হলেও বিবেক ও যুক্তির বিধানকে উপেক্ষা করতে পারেন নি।

সা দ ইবনে মায়াযের সূক্ষ্মদর্শিতা এবং সঠিক নীতি অবলম্বন করে ইনসাফপূর্ণ রায় প্রদানের সাক্ষ্য এটাই যে,(সা দের এ রায় প্রদানের পর) যখন বনী কুরাইযার অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল,তখন তারা তাদের মনের গোপন কথাগুলো ফাঁস করে দিচ্ছিল।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় পরিখা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলনকারী হুইয়াই ইবনে আখতাবের দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর উপর পড়লে সে বলেছিল :

أما و الله ما لُمت فِى عداوتك و لكن من يخذل الله يُخذل

“আমি আপনার সাথে শত্রুতা পোষণ করার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নই;তবে মহান আল্লাহ্ যাকে অপদস্থ করেন কেবল সে-ই অপদস্থ হয়। 148

এরপর সে বনী কুরাইযার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল : মহান আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বনী ইসরাইলের লাঞ্ছনা অবশ্যম্ভাবী।”

বনী কুরাইযার নারীদের মধ্য থেকে একজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। কারণ সে যাঁতাকলের পাথর নিক্ষেপ করে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিল। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে যুবাইর বাতা’ নামের এক ব্যক্তি সাবিত ইবনে কাইস’ নামের এক মুসলমানের সুপারিশে মৃত্যু দণ্ডাদেশ থেকে অব্যহতি পেয়েছিল। তার স্ত্রী ও সন্তানরাও বন্দিত্বদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল এবং তার জব্দকৃত ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তার কাছে ফেরত দেয়া হয়েছিল। বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের মধ্য থেকে প্রাপ্ত গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ (খুমস)-যা ইসলাম ধর্মের আর্থিক বিষয়াদি পরিচালনা কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট-বের করার পর মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছিল। অশ্বারোহী সৈন্যরা তিন ভাগ ও পদাতিক সৈন্যরা এক ভাগ করে গনীমত লাভ করেছিল। মহানবী (সা.) গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ যাইদের হাতে অর্পণ করলেন,যাতে তিনি নাজদে গিয়ে তা বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে ঘোড়া,অস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। আর এভাবে হিজরতের পঞ্চম বর্ষের 19 যিলহজ্ব বনী কুরাইযা সৃষ্ট ফিতনার অবসান হলো। সূরা আহযাবের 26-27 তম আয়াত বনী কুরাইযার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সা দ ইবনে মায়ায,যিনি পরিখার যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন,বনী কুরাইযার ঘটনার পর এ ক্ষতজনিত কারণেই শাহাদাত লাভ করেন।149

ঊনচল্লিশতম অধ্যায় : ষষ্ঠ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

ইসলামের শক্রদের ওপর কড়া নজর

পঞ্চম হিজরী শেষ হওয়ার পূর্বেই খন্দক যুদ্ধের সম্মিলিত শত্রুবাহিনী ও বিদ্রোহী বনী কুরাইযাহ্ গোত্র ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হলো। ফলে মদীনাসহ মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ মুসলমানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসলো। ইসলামের নবীন প্রশাসন দৃঢ়তর হলো এবং ইসলামী ভূ-খণ্ডে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কিন্তু এই শান্ত পরিবেশ স্থায়ীভাবে বজায় রাখার পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তাই মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা শত্রুদের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে মনে করলেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী শক্তিগুলোকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য তাঁর অধীন শক্তিকে নিয়োজিত করলেন।

শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি খন্দকের যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষের বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া বিভিন্ন দলগুলোর মধ্যে যেগুলো মুসলমানদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল,তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ পদক্ষেপ নিলেন। আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধের আগুন জ্বালানোর পেছনে যে ব্যক্তিটির সরাসরি হাত ছিল,সে হলো হুয়াই ইবনে আখতাব এবং সে ইহুদী গোত্র বনী কুরাইযার সাথে যুদ্ধে নিহত হয়। কিন্তু তার অন্যতম সহযোগী সাল্লাম ইবনে হুকাইক150 খাইবরে পালিয়ে গিয়েছিল। সে ইসলামের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর শত্রু বলে গণ্য হতো এবং সবসময় ইসলামের শত্রু দলগুলোকে নতুন ভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় ছিল। বিশেষত খন্দকের যুদ্ধের জন্য আগত আরবের পৌত্তলিক গোত্রগুলো যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও সরঞ্জাম হাতে পেলে নতুন করে সম্মিলিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতো।

এ সব বিভিন্ন দিক চিন্তা করে মহানবী (সা.) ইসলাম বিদ্বেষী ক্ষতিকর এ শত্রু নিধনের জন্য খাযরাজ গোত্রের151 কয়েকজন সাহসী যুবককে প্রেরণ করলেন। তবে তাদের নির্দেশ দিলেন যেন কোন প্রকারেই তার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্ষতি না হয়। খাযরাজ গোত্রের যুবকরা খাইবরে পৌঁছে তার ঘরের নিকটবর্তী সকল ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন যাতে তার চিৎকারের শব্দে তারা সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে। অতঃপর তার ঘরের দোতলার দরজায় কড়া নাড়লেন। তার স্ত্রী দরজা খুললে তাঁরা বললেন,খাদ্যশস্য কিনতে এসেছেন,এজন্য সাল্লামকে দরকার। তার স্ত্রী সত্য মনে করে তাদেরকে তার শয়ন কক্ষ দেখিয়ে দিল। সাল্লাম তখন সবে মাত্র শয্যায় গিয়েছিল। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা তার শয়নকক্ষে দ্রুত প্রবেশ করলেন এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তাকে সেখানে হত্যার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর ও তাদের শান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ফিতনার অপসারণ করলেন। অতঃপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গের বাইরে কূপের নিকট আত্মগোপন করলেন।

সাল্লামের স্ত্রীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা জেগে উঠলো। তারা ঘর থেকে বের হয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে যুবকদের খুঁজতে লাগল। কিন্তু অনেকক্ষণ খোঁজার পরও তাদের না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গেল। তখন তার মৃত্যু নিশ্চিত কি না তা জানার জন্য ঐ যুবকদের একজন মুখ ঢেকে তার ঘরে সমবেত ইহুদীদের মধ্যে গিয়ে লক্ষ্য করলেন তার স্ত্রী তাদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলছে। অতঃপর মৃত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল : ইহুদীদের খোদার শপথ! সে মৃত্যুবরণ করেছে।” এ কথা শুনে সেই যুবক নিজ সঙ্গীদের নিকট ফিরে এসে অভিযান সফল হয়েছে বলে জানালেন। তখন তাঁরা রাতের অন্ধকারেই মদীনার দিকে যাত্রা করলেন এবং মদীনায় পৌঁছে সকল ঘটনা বিস্তারিতভাবে রাসূলকে জানালেন।152

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কুরাইশগণের হাবাশার (আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া) দিকে যাত্রা

কুরাইশের কিছুসংখ্যক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোক দিন দিন ইসলামের অগ্রযাত্রা লক্ষ্য করে ভীত হয়ে পড়ল। তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য হাবাশার দিকে যাত্রা করল। তারা ভাবল,যদি মুহাম্মদ (সা.) আরব উপদ্বীপের সকল স্থানে তাঁর দখল প্রতিষ্ঠিত করেন,তবে তা তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ ঘটনা ঘটার পূর্বেই উপায় বের করতে হবে ও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যেতে হবে। এ জন্য উপযুক্ত স্থান হলো হাবাশা। কুরাইশরা কখনো মুসলমানদের ওপর জয়ী হলে তারা নিজ দেশে ও ঘরে ফিরে যাবে।

এই সুদূরপ্রসারী চিন্তার অন্যতম অংশীদার হলো আমর ইবনুল আস। সেও এ দলের সাথে প্রচুর পরিমাণ উপঢৌকন নিয়ে হাবাশার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করল। যেদিন আমর ইবনুল আস ও কুরাইশগণের কাফেলা আবিসিনিয়ায় পৌঁছে,একই দিন রাসূল (সা.)-এর পত্রবাহক আমর ইবনে উমাইয়্যা দ্বামারীও নাজ্জাশীর নিকট উপস্থিত হন। তিনি হযরত জাফর ইবনে আবী তালিবসহ অন্যান্য মুসলমানের সম্পর্কে করণীয় বিষয়ে রাসূলের পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। আমর ইবনুল আস নাজ্জাশীর দরবারে তার যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে তা বোঝানোর জন্য নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল: আমি বিশেষ উপঢৌকন নিয়ে আবিসিনিয়ার সম্রাটের নিকট যাচ্ছি এবং তাঁকে আহবান জানাবো,তিনি যেন আমাকে মুহাম্মদের এ বিশেষ দূতের শিরচ্ছেদ করার অনুমতি দেন।” অতঃপর সে মনের ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে সম্রাটের দরবারে প্রবেশ করল। সম্রাটকে সম্মান প্রদর্শনের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী দরবারের মাটিতে চুম্বন করে সম্রাটকে সিজদা করল। সম্রাট তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন : নিজ দেশ হতে আমার জন্য কি কোন উপঢৌকন নিয়ে এসেছ?

সে বলল : জী,হে সম্রাট!”   তারপর তার সঙ্গে আনীত উপঢৌকন সম্রাটের নিকট পেশ করে বলল : কিছুক্ষণ পূর্বে যে ব্যক্তিটি আপনার দরবার থেকে বের হয়ে গেল,সে এমন এক ব্যক্তির প্রতিনিধি যে আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। তাই আজ অনুমতি দিন আমি তার শিরচ্ছেদের মাধ্যমে ঐ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করি এবং এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হবে। আমর ইবনুল আসের কথায় নাজ্জাশী এতটা রাগান্বিত হলেন যে,নিজের মুখে এত জোরে আঘাত করলেন যে,তাঁর নাক ফেটে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হলো। অতঃপর তিনি ক্রোধান্বিত অবস্থায় বললেন : তুমি আমার নিকটে চাও এমন ব্যক্তির প্রতিনিধিকে তোমার হতে সোপর্দ ও হত্যা করি,যার ওপর হযরত মূসার ন্যায় ইলাহী গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহর শপথ! তিনি সত্য নবী এবং অচিরেই তাঁর শত্রুদের ওপর বিজয়ী হবেন।” আমর ইবনুল আস তার জবানবন্দীতে বলেছে : আমি এই কথা শুনে মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম;কিন্তু নিজ সঙ্গীদের থেকে তা গোপন রাখলাম। 153

তিক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য পদক্ষেপ

রাজীর মর্মান্তিক ও তিক্ত ঘটনায় ইসলামের একদল নিবেদিত প্রাণ ধর্মপ্রচারক বনী লাহিয়ান গোত্রের দুই শাখাগোত্র আজাল’ ও কারেহ’ -এর নিষ্ঠুর ও কপট ব্যক্তিদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন এবং তাঁদের দুই ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় কুরাইশদের কাছে প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্ত বিক্রী করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে কুরাইশরা তাঁদেরকে নির্যাতন করে হত্যা করে। এ ঘটনাটি মুসলমানদের হৃদয়ে শোকের কালো ছায়া ফেলেছিল। এর পর হতে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে মুসলমানদের সামনের সব প্রতিবন্ধক একে একে দূর করা সম্ভব হয়েছিল। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদের সম্মিলিত বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ ও ইহুদীদের পর্যুদস্ত করার পর ইসলামের মহান নেতা বনী লাহিয়ানকে শাস্তি দানের চিন্তা করলেন যাতে অন্য কোন গোত্র এরূপ অন্যায় কাজে সাহসী না হয় এবং ইসলামের প্রচারকগণের প্রতি অত্যাচার চালাতে না পারে।

তিনি ষষ্ঠ হিজরীর পঞ্চম মাসে মদীনার দায়িত্ব ইবনে উম্মে মাকতুমের হাতে অর্পণ করে নিজ বাহিনী নিয়ে মদীনা হতে বের হলেন। কিন্তু কাউকেই নিজ গন্তব্য সম্পর্কে জানালেন না। কারণ,এতে কুরাইশ বা বনী লাহিয়ান তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। কেউ যাতে বুঝতে না পারে,তাই তিনি উত্তর দিকে সিরিয়ার পথ ধরলেন। দীর্ঘ পথ ঐ দিকে যাত্রার পর তার মোড় ঘুরিয়ে বনী লাহিয়ানের আবাসস্থলের নিকটে পৌঁছলেন। কিন্তু বনী লাহিয়ানের বসতি গারানে পৌঁছার পূর্বেই তারা তাঁর আগমন টের পেয়ে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা মুসলমানদের নাগালের বাইরে আশ্রয় গ্রহণ করলেও এ সামরিক অভিযান তাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করল এবং এ ভীতি সৃষ্টিই তাদের ও অন্যান্যের ওপর কার্যকর প্রভাব ফেলল।

মহানবী (সা.) তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ সফলতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে একটি সামরিক মহড়া দিলেন। তিনি দুই শ’ সৈন্য নিয়ে গারান থেকে যাত্রা করে মক্কার নিকটবর্তী আসফানে পৌঁছলেন এবং দশ ব্যক্তির একটি টহল দল মক্কার পার্শ্ববর্তী কারাউল গামিমে পাঠালেন। তাঁর এ শক্তি প্রদর্শনের মহড়া কুরাইশদের অবগতির মধ্যেই ছিল। অতঃপর তিনি তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেছেন,মহানবী (সা.) এ সামরিক মহড়া থেকে ফিরে এসে মদীনায় পৌঁছে এই দুআ পড়লেন :

أعوذ بالله من وعثاء السّفر و كآبة المنقلب و سوء المنظر فِى المال و الأهل

“হে আল্লাহ্! ভ্রমণের ক্লান্তি,স্থানান্তরের কষ্ট এবং পরিবার ও সম্পদের অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষয়ক্ষতি হতে আপনার আশ্রয় চাই। 154