চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড5%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81886 / ডাউনলোড: 7554
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

যি কাবাদের১৫৫ যুদ্ধ

মহানবী (সা.) মদীনায় ফিরে আসার কয়েক দিন অতিবাহিত না হতেই উয়াইনা ইবনে হিসান কাজ্জারী নামে এক ব্যক্তি গাতফান গোত্রের কয়েক ব্যক্তির সহায়তায় সিরিয়ার পথের নিকটে অবস্থিত মদীনার মুসলমানদের চারণভূমি গাবা য় হামলা চালায়। তারা ঐ চারণভূমির পাহারাদারদের হত্যা করে এবং চারণভূমিতে বিচরণকারী এক পাল উটসহ এর নিকটে বসবাসকারী এক মুসলমান নারীকে বন্দী করে নিয়ে যায়। সালাফ আসলামী নামের এক যুবক মদীনার বাইরে শিকারে গেলে এ দৃশ্য দেখে। সে দ্রুত সা ল পর্বতের চূড়ায় উঠে মুসলমানদের প্রতি সাহায্যের আহবান জানায় ও চিৎকার করে বলতে থাকে : ওয়া সাবাহা’ । এ শব্দটি আরবরা সাহায্য প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করে থাকে। অতঃপর সে তার তীর-ধনুক নিয়ে লুণ্ঠনকারীদের ধাওয়া করতে থাকে। সে তাদের উদ্দেশ্যে একের পর এক তীর ছুঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দিতে থাকে। মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম তার সাহায্যের আহবান শুনতে পান। তিনি নিজেও চিৎকার করে সবাইকে আহবান জানাতে থাকেন। একদল মুসলমান অশ্ব নিয়ে দ্রুত রাসূলের নিকট পৌঁছলে তিনি সালাহ্ ইবনে যাইদকে তাদের নেতা নিযুক্ত করে লুণ্ঠনকারীদের ধাওয়া করতে বললেন এবং নিজেও প্রস্তুত হয়ে তাদের পেছনে যাত্রা করলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে তীর বিনিময়ে দু জন মুসলমান এবং শক্রপক্ষের তিনজন নিহত হলো। অবশেষে অধিকাংশ উট এবং মুসলিম নারীকেও উদ্ধার করা সম্ভব হলো। কিন্তু শত্রুরা গাতফান গোত্রের বসতিতে আশ্রয় নিল। মহানবী (সা.) শত্রুর সন্ধানে যি কাবাদে এক দিন ও এক রাত অবস্থান করলেন। তাঁর সঙ্গীরা অগ্রসর হয়ে শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করতে চাইলেও তিনি তা সঠিক মনে করলেন না এবং তাদের নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন।১৫৬

যে নযর১৫৭ বৈধ নয়

যে মুসলমান নারী লুটেরাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন,তিনি রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন : আপনার এ উটটিতে বসিয়ে যখন হামলাকারীরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল,তখন আমি নযর করেছিলাম,যদি শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পাই,তা হলে এ উটটিকে আল্লাহর জন্য কুরবানী করব।” মহানবী (সা) তার কথায় স্মিত হেসে বললেন : এ উটের জন্য কীরূপ মন্দ পুরস্কারই নির্ধারণ করেছ! প্রাণীটি তোমাকে বাঁচিয়েছে,আর তুমি কি না তাকে হত্যা করতে চাইছ!”   অতঃপর গাম্ভীর্যের সাথে বললেন : যে নযরের মধ্যে আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা করা হয় এবং এমন কোন বস্তু নযর করা-যার মালিক নযরকারী নয়,-তা বৈধ নয়। তুমি যে উটের মালিক নও,তার নযর করেছ;অথচ আমি হচ্ছি তার মালিক। তাই তোমার এ নযর পালন করার কোন প্রয়োজন নেই। ১৫৮

চল্লিশতম অধ্যায় : ষষ্ঠ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বনী মুস্তালিকের বিদ্রোহীরা

ষষ্ঠ হিজরীতে মুসলমানদের সামরিক শক্তি এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে,তাদের বিশেষ অংশও মক্কার নিকট মহড়া দিয়ে ফিরে এসেছিল,কেউ তাদের কিছু বলার সাহস পায় নি। অবশ্য মুসলমানদের এই সামরিক শক্তি অর্জনের বিষয়টি মদীনার আশে-পাশের অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও তাদের সম্পদ হস্তগত করার উদ্দেশ্যে ছিল না।

মুশরিকরা মুসলমানদের স্বাধীনতা হরণ না করলে এবং ইসলামের প্রচারকাজে বাধা প্রদান না করলে কখনোই মহানবী (সা.) অস্ত্র ক্রয় এবং সৈন্য প্রেরণ করতেন না। কিন্তু যেহেতু মুসলমানরা এবং তাদের ধর্ম প্রচারক দলের সদস্যরা সব সময়ই শত্রুদের পক্ষ থেকে হুমকির মুখে ছিলেন,সেহেতু ইসলামের মহান নবী বুদ্ধিবৃত্তিক কারণেই (আত্মরক্ষার স্বার্থে) মুসলমানদের প্রতিরক্ষা শক্তিকে সুসংহত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

ষষ্ঠ হিজরী পর্যন্তই শুধু নয়,রাসূলের শেষ জীবন পর্যন্ত সংঘটিত সকল যুদ্ধই নিম্নলিখিত যে কোন এক কারণে ঘটেছে :

১. মুশরিকদের কাপুরুষোচিত আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে। যেমন : বদর,উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ।

২. মুসলমানদের এবং ইসলামের প্রচারক দলের সদস্যদের ওপর নির্যাতন বা তাঁদের হত্যাকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী,বা মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গের মাধ্যমে ইসলামকে যারা হুমকির মুখে ফেলেছে,এমন গোত্রগুলোকে দমন করার জন্য। ইহুদীদের তিনটি গোত্র (বনী কাইনুকাহ্,বনী নাযির ও বনী কুরাইযাহ্) এরূপ চুক্তি ভঙ্গকারী বিশ্বাসঘাতক ছিল,যাদের সাথে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছিলেন।

৩. ঐ সকল গোত্র ও দলের বিরুদ্ধে,যারা অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের প্রচেষ্টায় রত ছিল এবং এ প্রস্তুতির মাধ্যমে মদীনায় হামলার পাঁয়তারা করছিল। ছোট-খাটো যুদ্ধগুলো এ লক্ষ্যেই ঘটেছিল।

বনী মুস্তালিকের যুদ্ধ

বনী মুস্তালিক খুযাআ গোত্রের একটি উপগোত্র ছিল। তারা ছিল কুরাইশদের প্রতিবেশী। মদীনায় সংবাদ পৌঁছল,বনী মুস্তালিকের নেতা হারিস ইবনে আবি জারার মদীনা অবরোধ করার লক্ষ্যে অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। মহানবী (সা.) সাথে সাথে এ ফিতনার বীজ ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাহাবী বুরাইদাকে ঐ এলাকায় পাঠালেন। বুরাইদা আগন্তুক হিসেবে ঐ গোত্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে কৌশলে তথ্য জেনে নিলেন। অতঃপর দ্রুত মদীনায় ফিরে এসে প্রতিবেদন পেশ করলেন। মহানবী (সা.) সঙ্গীদের নিয়ে বনী মুস্তালিক গোত্র অভিমুখে যাত্রা করে মুরাইসাহ্’ নামক কূপের নিকট পৌঁছলে দু দলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলিম যোদ্ধাদের আত্মত্যাগী ভূমিকা এবং তাঁদের বীরত্ব,সাহসিকতা ও দুর্ধর্ষ আক্রমণের যে ভীতি কাফেরদের মধ্যে ছিল,তাতে তারা সহজেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ক্ষণস্থায়ী এ যুদ্ধে দশজন কাফের সেনা নিহত হয় এবং ভুলবশত একজন মুসলিম সেনা নিহত হন। এ যুদ্ধের ফলে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং ঐ গোত্রের নারীরা বন্দী হিসেবে মদীনায় আনীত হয়।১৫৯

এ যুদ্ধের সবচেয়ে শিক্ষণীয় দিকটি যুদ্ধের পর গৃহীত রাসূলের রাজনৈতিক পদক্ষেপ থেকে নেয়া যেতে পারে।

মদীনায় হিজরতের পর প্রথম বারের মতো মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে বিরোধের অগ্নি জ্বলে উঠল। মহানবীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কার্যকর না হলে তাদের মধ্যেকার এত দিনের ঐক্য ও সম্প্রীতি কয়েকজন অদূরদর্শী ব্যক্তির প্রবৃত্তির শিকার হয়ে বিনষ্ট হতো।

ঘটনাটি এরূপ : যুদ্ধ শেষের পর মুহাজিরগণের মধ্য থেকে জাহ্জাহ্ ইবনে সাঈদ ১৬০ এবং আনসারগণের মধ্য থেকে সানান জুহনী’ নামক দু জন মুসলমানের মধ্যে পানিকে কেন্দ্র করে বিরোধ দেখা দিলে তারা উভয়েই নিজ নিজ গোত্রকে সাহায্যের জন্য আহবান জানায়। এ গোত্রভিত্তিক সাহায্যের আহবানের পরিণতি এতটা ক্ষতিকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যে,তারা মদীনা থেকে দূরে এই স্থানে পরস্পরের রক্তপাত করতে উদ্যত হয়েছিল,যা তাদের উভয়কেই নিশ্চিহ্ন করে দিত। মহানবী (সা.) ঘটনাটি জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বললেন : এই দু ব্যক্তিকে তাদের অবস্থার ওপর (মন্দ পরিণতির) ছেড়ে দাও। এরূপ সাহায্য কামনা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও দুর্গন্ধযুক্ত। এটি জাহিলী যুগের আহবান। তাদের অন্তর হতে জাহিলী যুগের মন্দ প্রভাব এখনো দূরীভূত হয় নি। এ দুই ব্যক্তি ইসলামের শিক্ষা ও কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত নয়। ইসলাম সকল মুসলমানকে পরস্পরের ভাই বলেছে এবং যে আহবানই পরস্পরকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে,তা মূল্যহীন একত্ববাদে’ পর্যবসিত হবে। ১৬১

দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী মুনাফিক

মহানবী (সা.) এ দ্বন্দ্বের পরম প্রাজ্ঞজনোচিত মোকাবেলা করলেন এবং উভয় দলকে শান্ত ও নিরস্ত করলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই মদীনার মুনাফিকদের নেতা ছিল। সে ইসলাম ও রাসূলের প্রতি খুবই বিদ্বেষী ছিল এবং গনীমতের লোভে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সে এ বিরোধের সুযোগে নিজের বিদ্বেষ প্রকাশ করল। তার কিছু সঙ্গী ও সমর্থকদের সামনে বলল : আমাদের কারণেই তারা আমাদের ওপর চেপে বসেছে। আমরা মদীনার অধিবাসীরা মক্কার মুহাজিরদের নিজ ভূমিতে আশ্রয় দিয়ে তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছি। আমরা ঐ প্রবাদের মতো হয়েছি,যাতে বলা হয়েছে : তোমার কুকুরকে খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট কর,পরে সে তোমাকেই খাবে’ । আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি,মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানিত ও শক্তিশালীরা (মদীনার অধিবাসীরা) দুর্বল ও অসম্মানিতদের (মক্কার মুহাজিরদের) বের করে দেব।”

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের এ কথা ঐ সব লোকের উপর মন্দ প্রভাব ফেলল যাদের মনে তখনও জাহিলী যুগের গোঁড়ামী ও গোত্রপ্রীতি বিরাজ করছিল। ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের স্থায়ী বীজ বপন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

সৌভাগ্যক্রমে সেখানে ইসলামের চেতনায় উজ্জীবিত যুবক যাইদ ইবনে আরকাম বসেছিলেন। এই যুবক ঐ শয়তানী প্ররোচনামূলক কথার কঠোর জবাব দিয়ে বলেন : তুমিই সেই দুর্বল ও লাঞ্ছিত,যার নিজ সম্প্রদায়ের নিকটেও কোন সম্মান নেই। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) মুসলমানদের নিকট সম্মানিত এবং তাদের হৃদয় তাঁর ভালোবাসায় পূর্ণ।”

অতঃপর তিনি ঐ সভা হতে উঠে মুসলিম সেনাপতির তাঁবুর দিকে যাত্রা করলেন। তাঁবুতে প্রবেশ করে মহানবীকে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করলেন। রাসূল (সা.) বাহ্যিকতা (সৌজন্য) বজায় রাখার জন্য তিন বার যাইদের কথা প্রত্যাখ্যান করে ইতিবাচক সম্ভাবনার দিকটি বললেন : তুমি হয় তো ভুল শুনেছ। হয় তো তুমি তার প্রতি ক্ষোভ ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এরূপ বলছ। সে হয় তো তোমাকে ক্ষুদ্র ও বুদ্ধিহীন বলে তিরস্কার করে,এজন্য। সে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু বলে নি।” যাইদ সবগুলো সম্ভাবনাই বাদ দিয়ে বললেন : তার উদ্দেশ্য বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি এবং নিফাকের (কপটতার) বিস্তৃতি ঘটানো।”

হযরত উমর মহানবীকে বললেন : আপনি আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইকে হত্যার নির্দেশ দিন।” কিন্তু মহানবী (সা.) বললেন : এ সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। কারণ এতে সবাই বলবে,মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের হত্যা করে। ১৬২

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই তার কথা যাইদ ইবনে আরকামের মাধ্যমে রাসূলের কানে পৌঁছেছে জানতে পেরে দ্রুত তাঁর কাছে গিয়ে আল্লাহর শপথ করে বলল : আমি কখনোই এরূপ কথা বলি নি।” কেউ কেউ কল্যাণ চিন্তা করে আবদুল্লাহর পক্ষ নিয়ে বললেন : যাইদ আবদুল্লাহর কথা ভুল শুনেছেন।”

কিন্তু ঘটনাটির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটল না। কারণ তা ঝড়ের পূর্বে ক্ষণিক নিস্তব্ধতার মতো,যার ওপর নির্ভর করা যায় না। তাই ইসলামের মহান কাণ্ডারী সবার মন থেকে বিদ্বেষের ঝড় প্রশমিত করতে ও মুসলমানদের মন থেকে তা সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে পদক্ষেপ নিলেন। এ লক্ষ্যেই দুপুরের তীব্র রোদে বিশ্রাম নেয়ার সময়ে যাত্রার নির্দেশ শুনে আনসারগণের অন্যতম নেতা উসাইদ ইবনে হুযাইর রাসূলের নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন : এই অসময়ে কেন যাত্রার নির্দেশ দিচ্ছেন?”   মহানবী (সা.) বললেন : তুমি আবদুল্লাহর কথা শোন নি? যে আগুন সে জ্বালিয়েছে,তার খবর পাও নি?” উসাইদ আল্লাহর শপথ করে বললেন : হে আমাদের প্রিয় ও সম্মানিত! শাসন ক্ষমতা আপনার হাতে ন্যস্ত। আপনি চাইলেই তাকে বের করে দিতে পারেন। আপনি সবচেয়ে মান্য ও সম্মানের পাত্র। সে-ই লাঞ্ছিত ও অসম্মানিত। আপনি তাকে ক্ষমা করুন। কারণ,সে এক পরাজিত ব্যক্তি। আপনি মদীনায় হিজরতের পূর্বে আউস ও খাযরাজ গোত্র মতৈক্যে পৌঁছেছিল,তাকে মদীনার শাসক নিযুক্ত করবে। তার জন্য মুকট তৈরি করতে সে সোনা ও হীরা সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ইসলামের তারকার উদয়ের ফলে তার অবস্থা অসহায় হয়ে পড়ে। সবাই তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই সে আপনাকে বিভেদের কারণ মনে করে।”

রাসূল (সা.) যাত্রার নির্দেশ দিলেন। নামায ও খাদ্য গ্রহণের স্বল্প সময় ব্যতীত চব্বিশ ঘণ্টা সবাই একনাগাড়ে পথ চললেন। দ্বিতীয় দিন আবহাওয়া বেশ গরম ছিল। অবিরত পথ চলার ফলে সবাই শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন রাসূল (সা.) থামার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানরা এতটা ক্লান্ত ছিলেন যে,যে যেখানে ছিলেন,বাহন থেকে নেমে সেখানেই বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লেন। সবাই গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন। এভাবে তাঁদের মন থেকে সব তিক্ততা দূর হয়ে গেল এবং এ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে রাসূল (সা.) তাঁদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব প্রশমিত করলেন।১৬৩

ঈমান ও ভাবাবেগের দোলাচলে এক সৈনিক

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের পুত্র পবিত্র মনের ইসলামের একজন সৈনিক ছিলেন। ইসলামের মহান শিক্ষায় শিক্ষিত এ যুবক নিজ মুনাফিক পিতার প্রতি সবার থেকে সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে ভাবলেন মহানবী (সা.) হয় তো তাঁর পিতাকে হত্যার নির্দেশ দেবেন। তাই তিনি মহানবীর সকাশে উপস্থিত হয়ে বললেন : যদি সিদ্ধান্ত হয়,আমার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে,তা হলে সে দায়িত্ব পালনে আমি রাজী আছি। আমি অনুরোধ করব,এ দায়িত্ব আপনি অন্য কারো ওপর অর্পণ করবেন না। কারণ আমি ভয় পাচ্ছি,যদি আপনি অন্য কাউকে এ দায়িত্ব দেন,আর সে আমার পিতাকে হত্যা করে,তবে হয় তো আমি তা সহ্য করতে পারব না এবং পিতার প্রতি ভালবাসা ও আরবীয় বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে হত্যাকারীকে হত্যা করে ফেলব। এর ফলে আমার হাত একজন মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হবে এবং নিজের জন্য জাহান্নামের মন্দ পরিণতি ডেকে আনব।”

এই যুবকের কথায় পরিপূর্ণ ও উজ্জীবিত ঈমানের প্রকাশ ঘটেছে। কারণ তিনি মহানবীর কাছে আবেদন জানান নি,তাঁর পিতাকে ক্ষমা করা হোক। কারণ তিনি জানতেন,রাসূল (সা.) যে কাজই করুন না কেন,তা আল্লাহর নির্দেশে করেন। কিন্তু তিনি তাঁর মনে এক আশ্চর্য দ্বিধা অনুভব করলেন। একদিকে আরবীয় চেতনা ও পিতার প্রতি ভালবাসা তাঁকে পিতার হত্যাকারী মুসলমানকে হত্যায় প্ররোচিত করছে,অন্যদিকে হৃদয়ের গভীরে ইসলামী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছে পিতার হত্যা মেনে নিতে। এ দুই চিন্তার টানাপোড়েনে তিনি এমন পথ বেছে নিলেন যাতে একদিকে ইসলামের কল্যাণও সংরক্ষিত হয়,অন্যদিকে আরেক মুসলমানের পক্ষ থেকে তাঁর পিতার প্রতি ভালোবাসাও আঘাত প্রাপ্ত না হয়। তাই নিজেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এ কাজটি তাঁর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণের ঈমানী দাবীতে সাড়া দেয়ার মানসিক শান্তি তিনি লাভ করতেন। কিন্তু করুণার আধার মহানবী (সা.) তাঁকে জানালেন,এসব কোন সিদ্ধান্তই তিনি গ্রহণ করেন নি এবং তার প্রতি তিনি স্বাভাবিক আচরণই করবেন।

এরূপ কথা মহানবীর বিশাল হৃদয়ের পরিচয় বহন করে যা সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঢেউ উঠল। সবাই তাকে এতটা নিন্দা করল যে,মানুষের সামনে সে অসম্মানিত ও লাঞ্ছিত হলো। এরপর হতে কেউই তাকে আর পাত্তা দিত না।

মহানবী (সা.) এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের বেশ কিছু শিক্ষণীয় নির্দেশনা দান করলেন যা তাঁর প্রাজ্ঞ ইসলামী রাজনীতিকে প্রকাশিত করেছে। এ ঘটনার পর থেকে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই আর মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় নি। সকল ক্ষেত্রেই সে প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় ও নিন্দার পাত্র হয়ে পড়ে। একদিন মহানবী (সা.) হযরত উমরকে ডেকে বলেন : যেদিন তুমি তাকে হত্যার পরামর্শ আমাকে দিয়েছিলে,সেদিন তাকে হত্যার নির্দেশ দিলে অনেকেই তার হত্যায় প্রভাবিত হয়ে তার পক্ষ নিত। কিন্তু আজ তারা তার প্রতি এতটা বীতশ্রদ্ধ যে,যদি আমি তাকে হত্যার নির্দেশ দিই,তা হলে তারা কোন আপত্তি ছাড়াই তা কার্যকর করবে।

এক বরকতময় বিয়ে

বিদ্রোহী বনী মুস্তালিক গোত্রপতি হারিস ইবনে জারারের কন্যা মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তাঁর পিতা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এক পাল উট নিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করল। মদীনার পথে আকীক প্রান্তরে পৌঁছে মুক্তিপণ হিসেবে আনা উটগুলোর মধ্য হতে দু টি ভালো উট বেছে নিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ের উপত্যকায় লুকিয়ে রাখল। যখন মদীনায় রাসূলের সামনে উপস্থিত হয়ে বলল : আমার কন্যার মুক্তিপণ হিসেবে এই উটগুলো এনেছি” ,তখন রাসূল (সা.) বললেন : যে দু টি উট উপত্যকায় লুকিয়ে রেখে এসেছ,সেগুলো কোথায়?

হারিস এই গায়েবী খবরে আশ্চর্যান্বিত ও কম্পিত হলো। তার সঙ্গে আসা দু পুত্রকে দ্রুত গিয়ে উট দু টি আনার নির্দেশ দিল। সবগুলো উট রাসূলকে দিয়ে কন্যাকে মুক্ত করল। তার কন্যাও এ ঘটনায় মুসলমান হলেন। রাসূল (সা.) তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তাঁর পিতা সন্তুষ্ট চিত্তে বারো শ দিরহাম মোহরানার বিনিময়ে তাঁকে রাসূলের বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করল। বনী মুস্তালিকের গোত্রপতি হারিসের সঙ্গে রাসূলের আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের ফলে বনী মুস্তালিকের এক শ’ পরিবার মুক্তি পেল। তাদের সকল বন্দী নারী-পুরুষ মুক্ত হয়ে নিজ গোত্রের নিকট ফিরে গেল। এভাবে এই মহীয়সী নারী নিজ গোত্রের জন্য কল্যাণের কারণ হলেন। সবাই বলতে লাগলো : এ নারীর ন্যায় কেউই তাঁর গোত্রের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করেন নি।১৬৪

পাপাচারীর মুখোশ উন্মোচিত

বনী মুস্তালিকের ইসলাম গ্রহণ প্রকৃতপক্ষেই আন্তরিক ছিল। কারণ তারা মুসলমানদের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় কোন খারাপ আচরণের সম্মুখীন হয় নি;বরং মুসলমানদের পক্ষ হতে সদাচরণ ও সম্মানই পেয়েছে। অবশেষে বিভিন্ন উসিলায় তারা সমবেতভাবে মুক্তি পেয়ে নিজ গোত্রের নিকট ফিরে যায়। মহানবী (সা.) ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে তাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণের জন্য প্রেরণ করেন। তারা রাসূলের প্রতিনিধির আগমনের সংবাদ শুনে ঘোড়ায় আরোহণ করে তাঁকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসল। ওয়ালিদ তাদেরকে সমবেতভাবে আসতে দেখে (ঐ গোত্রের সঙ্গে পূর্বশত্রুতার কারণে) ভীত হয়ে দ্রুত মদীনায় ফিরে আসে এবং রাসূলকে মিথ্যা প্রতিবেদন দেয় যে,তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল ও যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে।

ওয়ালীদের দেয়া খবর মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। তারা বনী মুস্তালিকের কাছে এরূপ আচরণ কখনোই আশা করেন নি। এ সময় বনী মুস্তালিকের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল রাসূলের নিকট এসে বলল : আমরা তাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসেছিলাম;সে আমাদের দেখে হঠাৎ করে দ্রুত প্রস্থান করে। আমরা শুনেছি,সে মদীনায় এসে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে।” এ সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা হুজুরাতের ষষ্ঠ আয়াত অবতীর্ণ হয় যা বনী মুস্তালিকের দাবীকে সত্যায়ন করে এবং ওয়ালীদ ইবনে উকবাকে ফাসেক ও মিথ্যুক বলে অভিহিত করে।

আয়াতে বলা হয় : হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের জন্য কোন খবর আনে,তোমরা তা যাচাই কর,যাতে তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে এমন কাজ করে না বসো,যার ফলে পরবর্তীতে অনুশোচনাগ্রস্ত হতে হয়।”

একচল্লিশতম অধ্যায় : ষষ্ঠ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

গুরুতর পাপের অভিযোগ

মুনাফিকদের সর্দার ইসলামের যুগেও তার জাহিলী যুগের অন্যায় কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সে দাসী ও অন্যান্য নারী ক্রয় করে তাদের দ্বারা অবৈধ দেহ ব্যবসা করাত এবং এভাবে অর্থ উপার্জন করত। ব্যভিচার হারাম ঘোষিত হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরও সে তার এ কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের দাসীরা চরম মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে রাসূলের নিকট এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে : আমরা নিজেরা পবিত্র থাকতে চাই,কিন্তু সে আমাদের অন্যায় ও অশ্লীল কাজে বাধ্য করে থাকে।” এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঐ পাপাচারী ব্যক্তি সম্পর্কে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় :

) و لا تُكرهوا فتياتكم علي البغاء إن أردن تحصّنا لتبتغوا عرض الحياة الدّنيا(

“তোমাদের ক্রীতদাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনে সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না।” (সূরা নূর : ৩৩)

নারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পবিত্রতার বিষয় নিয়ে ব্যবসাকারী (এ ব্যক্তি) চেয়েছিল তৎকালীন ইসলামী সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশেষ নারীর১৬৫ প্রতি এরূপ অশালীন অপবাদ আরোপ করতে।

ঈমানের সঙ্গে নিফাকের চরম শত্রুতা ও বৈপরীত্য রয়েছে। মুশরিক সকল অবস্থায় শত্রুতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের ক্রোধ ব্যক্ত ও প্রশমিত করে। কিন্তু মুনাফিক যেহেতু ঈমানকে নিজেকে রক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে,তাই নিজের শত্রুতা প্রকাশ করতে পারে না। এ কারণেই তার ভেতরে পুষে রাখা ক্ষোভ হঠাৎ করে বিস্ফোরণের ন্যায় প্রকাশিত হয়। ফলে সে উন্মাদের ন্যায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই কথা বলে ও অপবাদ আরোপ করে।

বনী মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার মুহূর্তে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে মুনাফিকদের নেতা অপমানিত হয় এবং তার পুত্র তার মদীনায় প্রবেশে বাধাদান করে। পরে মহানবী (সা.)-এর অনুমতিক্রমে সে মদীনায় প্রবেশ করে। তার কপটতামূলক কাজের ফলে তার অবস্থান মদীনার সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন থেকে এতটা অপমানজনক অবস্থায় নেমে যায় যে,মাতৃভূমিতে প্রবেশের সময় তাকে নিজ পুত্রের বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

এরূপ লাঞ্ছিত ব্যক্তি উন্মাদের মতো যে কোন কাজ করতে পারে। সে অপমান ও লাঞ্ছনাকর গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে চাইবে ইসলামী সমাজের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে।

কোন শত্রু সরাসরি আক্রমণ করতে সক্ষম না হলে সাধারণত এরূপ গুজব ছড়িয়ে সমাজকে উদ্বিগ্ন করতে চায়,যাতে তারা তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চিন্তার অবকাশ না পায়।

মিথ্যা গুজব রটানো সৎকর্মশীল,পবিত্র ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বহানি করার একটি মোক্ষম অস্ত্র। স্বনামধন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকারক অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁদের আশ-পাশের লোকদের তাদের থেকে সরিয়ে দিতে ও বিচ্ছিন্ন করতে মুনাফিকরা প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।

সেনা মনোবল শক্তিশালী করণ

মহানবী (সা.) যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। এবারও যখন (মাঝপথ থেকে তিন শ লোকের মুনাফিক দলটি মুসলমানদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর) কেবল সাত শ মুসলিম যোদ্ধা তিন হাজার শত্রু-সৈন্যের মোকাবেলায় দাঁড়ালো তখন মহানবী এক ভাষণ প্রদান করে তাদের মনোবল দৃঢ় করেন। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদী বলেন :

মহানবী (সা.) আইনাইন গিরিপথে 50 জন তীর নিক্ষেপকারী সৈন্য মোতায়েন করেন;উহুদ পর্বত পেছনে এবং মদীনা সামনে রেখে অবস্থান নেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সৈন্যদের সারিগুলো বিন্যস্ত করছিলেন এবং প্রত্যেক অধিনায়কের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিলেন। একদলকে সামনে এবং একদলকে পেছনে রাখছিলেন। সৈন্যদের সারি সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্কতা দেখিয়েছিলেন যে,কোন সৈনিকের কাঁধ সামনের দিকে এগিয়ে আসলে সাথে সাথে তাকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

মহানবী সৈন্যদের সারি বিন্যস্ত করার পর মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন,আমি তা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : তোমরা মহান আল্লাহর আদেশের আনুগত্য কর। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকবে। এরপর তিনি বলেন : শত্রুর মুকাবেলা করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই শত্রুর মুকাবেলায় দৃঢ় পদ ও অবিচল থাকার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কেবল তারাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম,যাদের আল্লাহ্ হিদায়েত করেছেন এবং শক্তি যুগিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহর আদেশ পালনকারীদের সাথেই তিনি আছেন। শয়তান ঐ লোকদের সাথে আছে যারা মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। সবকিছুর আগে জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।24 ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা জিবরীল আমাকে বলেছেন : এ জগতে কোন ব্যক্তিই তার (জন্য বরাদ্দ) রিযকের সর্বশেষ দানাটি আহার না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না। যতক্ষণ যুদ্ধের নির্দেশ জারি না হয়,কেউ যেন আক্রমণ পরিচালনা না করে। 25

যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ শত্রুবাহিনী

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে বর্ম পরিহিত পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অধিনায়কত্বে একদলকে মোতায়েন করে ডান পাশে। অপর এক দলকে ইকরামার অধিনায়কত্বে মোতায়েন করে বাম দিকে।

এছাড়া সে অগ্রবর্তী দলরূপে একটি বিশেষ দলকে সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে মোতায়েন করে যার মধ্যে পতাকাবাহীও ছিল। এরপর বনী আবদুদ্দার গোত্রভুক্ত পতাকাবাহীদের সম্বোধন করে আবু সুফিয়ান বলল : সেনাবাহিনীর বিজয় তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা বদরের দিন এ অংশের দিক থেকেই আক্রান্ত হয়ে পরাজয় বরণ করেছি। যদি বনী আবদুদ্দার গোত্র পতাকা বহন ও রক্ষার ব্যাপারে যোগ্যতার প্রমাণ না দেয়,তা হলে পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রের কাঁধে চলে যাবে। কুরাইশ বাহিনীর প্রথম পতাকাবাহী বীর যোদ্ধা তালহা ইবনে আবি তালহার কাছে কথাটি মারাত্মক বলে মনে হলো। তাই সে তৎক্ষণাৎ ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিপক্ষের মল্লযোদ্ধাদের আহবান জানাল।

মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহ

যুদ্ধ শুরু হবার আগে মহানবী একখানা তরবারি হাতে নিলেন। স্বীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে তাদের লক্ষ্য করে বললেন : কোন্ ব্যক্তি এ তরবারি ধারণ করে তার হক আদায় করবে? 26 কিছু লোক সাড়া দিলেন। কিন্তু মহানবী তাদেরকে তরবারি দিতে সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অকুতোভয় সৈনিক আবু দুজানাহ্ সাড়া দিয়ে বললেন, এই তরবারীর হক বলতে কি বুঝায়? কিভাবে এর হক আদায় করা যাবে?”   মহানবী বললেন : এটা নিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবে যাতে তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানাহ্ বললেন : আমি এর হক আদায় করতে প্রস্তুত আছি। এরপর মৃত্যুর রুমাল নামে বিখ্যাত একটি লাল রঙের রুমাল মাথায় বেঁধে মহানবীর হাত থেকে ঐ তরবারি তুলে নেন। আবু দুজানাহ্ যখনই এ রুমালটি মাথায় বাঁধতেন,তখনই বোঝা যেত,যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে,ততক্ষণ তিনি লড়াই করে যাবেন।

তিনি এক গর্বিত চিতাবাঘের মতো পথ চলছিলেন। আজ তাঁর সৌভাগ্যের জন্য তিনি অতিশয় আনন্দিত। মাথায় লাল রংয়ের পট্টি তাঁর মর্যাদা ও গৌরব আরো বৃদ্ধি করছিল।27

সত্যিই যে সেনাবাহিনী একমাত্র সত্য ও নৈতিকতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়,যাদের সামনে নিজ বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই,তাদের জন্যে এ ধরনের মহড়া হচ্ছে সর্বোত্তম উদ্দীপক। মহানবীর লক্ষ্য কেবল আবু দুজানাকে উৎসাহিত করাই ছিল না;বরং তিনি এ কাজের দ্বারা সাহাবীগণের আবেগকেও শাণিত করেন। তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে,তাঁদের সিদ্ধান্ত ও বীরত্ব এমন পর্যায়ের হতে হবে যে,এর ফলে তাঁরাও এ ধরনের সামরিক পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

যুবাইর ইবনে আওয়াম ছিলেন এক বীর যোদ্ধা। মহানবী (সা.) হাতের তরবারিখানা তাঁকে না দেওয়ায় তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বললেন : আবু দুজানার বীরত্ব ও সাহসের মাত্রা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি তাঁর পিছু নেব। তিনি বললেন : আমি যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পেছনে পেছনে ছিলাম। দেখেছিলাম,যে বীর যোদ্ধাই তাঁর সামনে আসছিল,তিনি সাথে সাথে তাকে খতম করে দিচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এক বীর ছিল,যে মুসলমানদের মধ্যেকার আহতদের মাথা দ্রুত দ্বিখণ্ডিত করছিল। এ কাজ দেখে আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে লোকটি আবু দুজানার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বীরটি আবু দুজানার হাতে নিহত হলো। আর স্বয়ং আবু দুজানাহ্ও বর্ণনা করেছেন : একজনকে দেখলাম,যে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে যখন দেখল,তার মাথার উপর তরবারি,তখন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল। হঠাৎ দেখলাম এ হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। আমি মনে করলাম,হিন্দ্-এর মতো মহিলাকে হত্যা করে মহানবীর তরবারি অপবিত্র করা উচিত হবে না। 28

যুদ্ধের সূচনা

মদীনা হতে পলাতক আউস গোত্রের লোক আবু আমেরকে দিয়ে যুদ্ধ শরু হয়ে যায়। ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে সে মদীনা থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। আউস গোত্রের পনের ব্যক্তিও তার সাথে ছিল। আবু আমেরের ধারণা ছিল,আউস গোত্রের লোকেরা যখন তাকে দেখবে,তখন মহানবীকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যে সে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন সে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়,তখন সে তাদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কাজেই অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর সে রণাঙ্গন থেকে সরে পড়ে।29

উহুদের ময়দানে কয়েকজন যোদ্ধার লড়াই ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের মনে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার। ইবনে আব্বাস বলেন : হযরত আলী সকল যুদ্ধেই মসুলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন। সর্বদা দক্ষ,পরীক্ষিত ও অবিচল যোদ্ধাদের মধ্য থেকেই পতাকাধারী নির্বাচন করা হতো। উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর হাতে ছিল।

অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,মুসলমানদের পতাকাবাহী মুসআব ইবনে ওমাইর নিহত হবার পর মহানবী (সা.) আলীর হাতে পতাকা তুলে দেন। মুসআব প্রথম পতাকাবাহী হবার কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে,তিনি আবদুদ্দার গোত্রের লোক ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাধারীরাও এই গোত্রের লোক ছিল।30

তালহা ইবনে আবি তালহা,যাকেكبش الكتيبة কাবশুল কাতীবাহ্ বলা হতো,হুংকার দিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলো এবং চিৎকার দিয়ে বলল : হে মুহাম্মদের সাথীরা! তোমরা বল যে,আমাদের নিহত ব্যক্তিরা দোযখে আছে,আর তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে। এই অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে,আমি তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিই অথবা সে আমাকে দোযখে পাঠিয়ে দিক?”   তার কণ্ঠস্বর যুদ্ধের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলী (আ.) সামনে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি ঘাত-প্রতিঘাতের পর আলীর তরবারির আঘাতে তালহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তালহা নিহত হলে পতাকা বহনের পালা আসে পর্যাক্রমে তার দু ভাইয়ের ওপরে। উভয়ে আসেম ইবনে সাবিতের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।

দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত শূরার (পরামর্শ) সভায় আমীরুল মুমিনীনের (আলী) প্রদত্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় যে,কুরাইশ বাহিনী নয় জনকে পতাকা বহনের জন্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছিল। কথা ছিল,পর্যায়ক্রমে তারা সেনাবাহিনীর পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করবে। পর্যায়ক্রমটি ছিল প্রথম ব্যক্তি নিহত হলে পরের ব্যক্তি-এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পতাকা বহন করবে। এসব পতাকাবাহীর সবাই ছিল বনী আবদুদ্দার গোত্রের লোক। তারা সবাই উহুদ যুদ্ধের দিবসে হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে প্রাণ হারায়। এদের পর সাওআব নামক এক হাবশী ক্রীতদাস,যার দেহ-কাঠামো ছিল খুবই ভয়ানক এবং মুখমণ্ডল ছিল বীভৎস,সে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা ধারণ করেছিল। সেও ময়দানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আহবান করেছিল। সেই ক্রীতদাসও হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল।

আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের বিরাট পরামর্শসভায় তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,আমি বনী আবদুদ্দার গোত্রের নয় জনের অনিষ্টতা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছিলাম,যাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আহবান করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে পতাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিল। উপস্থিত ব্যক্তিদের সবাই হযরত আলীর বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।31

তিনি আবারো বললেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,ঐ নয় ব্যক্তির পরে হাবশী ক্রীতদাস সাওআব রণাঙ্গনে এসেছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহানবীকে হত্যা করা। সে এতখানি ক্রোধান্বিত ছিল যে,তার মুখ ফেনায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দু টি লাল হয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই ভয়ঙ্কর যোদ্ধাকে দেখে ভয়ে পিছু হটে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সামনে এগিয়ে যাই,তার কোমরের উপর আঘাত হানি এবং তাকে ধরাশায়ী করি। এবারও উপস্থিত সবাই হযরত আলীর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন।

প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করতে লড়ছিল যে জাতি

হিন্দ এবং অন্যান্য নারীরা কুরাইশ সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যেসব কবিতা আবৃত্তি করছিল ও গান গাইছিল,তাতে দফ ও খঞ্জনা বাজিয়ে তাদেরকে রক্তপাত ঘটানো ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করার আহবান জানাচ্ছিল। তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে,এই জাতি নৈতিক চেতনা,পবিত্রতা,স্বাধীনতা ও সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে লড়ছিল না;বরং তাদের জন্য উত্তেজক ছিল বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ও যৌন সম্ভোগ। দফ ও তবলাবাদক নারীরা কুরাইশ বাহিনীর মাঝখানে এক বিশেষ সুর মূর্চ্ছনায় গান গাইছিল :

نحـن بنات طـارق

نـمشى على النّـمارق

إن تـقبلـوا نعـانق

أو تــدبـروا نـفـارق

আমরা বালিকা পথের

গালিচার উপর দিয়ে করি পদচারণ।

যদি মুখোমুখি হও শত্রুর,করবো আলিঙ্গন

(আর) যদি শত্রু থেকে কর পৃষ্ঠ প্রদর্শন,

তা হলে ছেড়ে যাবো তোমাদের।

নিঃসন্দেহে,যে জাতির যুদ্ধ যৌন বিষয়াদির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য না থাকে;অন্যদিকে যে জাতি স্বাধীনতার প্রসার,চিন্তার উৎকর্ষতা,কাঠ ও মাটির মূর্তির উপাসনা ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে,-উভয়ের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য ও অতুলনীয় ব্যবধান রয়েছে। এ দু দলের মধ্যে ভিন্ন-ধর্মী দু ধরনের মনোবলের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইসলামের বীর সমরনায়কগণ,যেমন আলী,হামযাহ্,আবু দুজানাহ্,যুবাইর ও অন্যান্যের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগী লড়াইয়ের ফলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্র ও গনীমতের সম্পদ ফেলে রেখে অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পালাতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামের সৈনিকদের গৌরব একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে।32

বিজয়ের পর পরাজয়

ইসলামের সৈনিকরা এ কারণে বিজয়ী হয়েছিল যে,বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথে জিহাদ,তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের প্রচার এবং এ পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল,সেগুলো অপসারণ ছাড়া তাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না।

বিজয় লাভের পরে পরাজয় এজন্য হয়েছিল যে,অধিকাংশ মুসলমানের নিয়্যত ও লক্ষ্যে পরিবর্তন এসে যায়। কুরাইশ বাহিনী যেসব গনীমতের মাল ফেলে পালিয়েছিল,সেসবের প্রতি মনোযোগ তাদের ইখলাস (নিষ্ঠা) কলুষিত করেছিল এবং তারা মহানবীর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল।

ঘটনার বিবরণ

আমরা উহুদ প্রান্তরের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনায় এ বিষয় উল্লেখ করেছি যে,উহুদ পর্বতের মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের ফাটল ছিল। মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইরের অধিনায়কত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের ওপর রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগের এ গিরি প্রহরার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন,তীর নিক্ষেপ করে পাহাড়ের ফাটলের ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যদের আগমন ও চলাচল প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন,তারা কোন অবস্থায়ই তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না।

যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতার মধ্যে শত্রু সৈন্যরা যখনই এই গিরিপথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে,তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ও মালপত্র মাটিতে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলায়ন শুরু করে,তখন প্রাণপণ লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইসলামের মুষ্টিমেয় বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গিয়ে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত থাকে। তারা (শত্রুবাহিনীর) ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ও সম্পদ সংগ্রহে তৎপর হয়ে যায়। তারা ধরে নিয়েছিল,যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত সৈনিকরা সুবর্ণ সুযোগ ভেবে মনে মনে বলে : আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থক। আমাদেরও গনীমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের অধিনায়ক বললেন : মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী বাহিনী জয়ী হোক বা পরাজিত হোক,আমরা যেন এ স্থান ত্যাগ না করি। অধিকাংশ তীর নিক্ষেপকারী রক্ষী সেনা তাদের অধিনায়কের নির্দেশের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়ে বলে : এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল,যুদ্ধ চলাকালে আমরা যেন এ গিরিপথটি পাহারা দিই। এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । এর ভিত্তিতে চল্লিশ জন সৈন্য প্রহরার স্থান থেকে নিচে নেমে আসে। সেখানে কেবল দশ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ রইল না।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। শুরু থেকেই সে জানত,গিরিপথের মুখটি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি এবং সে বেশ কয়েক বার ঐ পথ দিয়ে রণাঙ্গনের পেছন দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবার প্রহরীদের তীর নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার সে তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগ গ্রহণ করে। সে কুরাইশ সৈন্যদের মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করতে নেতৃত্ব দেয়। সে এক দফায় অতর্কিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হয়। টিলার উপর মোতায়েন মুষ্টিমেয় তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যের প্রতিরোধে কোন লাভ হলো না। ঐ দশ ব্যক্তি প্রাণপণ লড়াই করে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসতর্ক ও নিরস্ত্র মুসলমানরা পেছন দিক থেকে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্পর্শকাতর স্থানটি দখল করে নেয়ার পর পরাজিত কুরাইশ বাহিনীর পলায়নপর সৈন্যদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার আহবান জানায়। সে চিৎকার করে ও শ্লোগান দিয়ে কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধ স্পৃহা এবং অবিচল থাকার মনোবৃত্তি চাঙ্গা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের যুদ্ধের সারি ছত্রভঙ্গ থাকার সুযোগে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। তারা পেছন ও সামনের দিক থেকে ইসলামী বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এ পরাজয়ের কারণ ছিল,ঐ দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি,যারা বস্তুগত লক্ষ্যের জন্য বাঙ্কার বা অবস্থানস্থল ছেড়ে এসেছিল এবং নিজেদের অজান্তেই শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর ফলে কুরাইশ বাহিনীর অশ্বারোহী দল খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে পেছন দিক থেকে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়ে।

আবু জাহলের ছেলে ইকরামার হামলায় খালিদের আক্রমণ অভিযান শক্তিশালী হয়। এ সময় ইসলামী বাহিনীতে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায়ন্তর দেখলেন না। কিন্তু চেইন অব কমান্ড যেহেতু ভেঙে পড়েছিল,সেহেতু ইসলামের সৈনিকরা সাফল্যজনক প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেন না। বরং তাঁরা বড় ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। কয়েকজন মুসলমান সৈনিকও অসর্তকতার কারণে অন্য মুসলিম সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। খালিদ ও ইকরামার আক্রমণ অভিযান কুরাইশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা করে। পলাতক কুরাইশ সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং তাদের শক্তি ও সমর্থন যোগাতে থাকে। এ অবস্থায় তারা মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের একদলকে হত্যা করে।

মহানবী (সা.)-এর নিহত হবার সংবাদ

কুরাইশ বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা লাইসী ইসলামী বাহিনীর বীর পতাকাবাহী মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর হামলা করে। তাদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ইসলামী বাহিনীর পতাকাধারী শাহাদাত লাভ করেন। ইসলামী যোদ্ধাদের চেহারা ঢাকা ছিল। সে ভাবল,নিহত ব্যক্তি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হবেন। তখনই সে চিৎকার দিল এবং সেনা অধিনায়কদের উদ্দেশে বলল : ভাইসব! মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদটি কুরাইশ বাহিনীর মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

কুরাইশ নেতারা এমন আনন্দিত হলো যে,তাদের আওয়াজ সমগ্র রণাঙ্গনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তারা সবাই বলছিল :ألا قد قُتل محمّد، ألا قد قُتل محمّد মুহাম্মদ নিহত হয়েছে,মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদ রটে যাওয়ায় দুশমনদের সাহস বেড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী তখন তরঙ্গমালার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল,মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটায় অংশ নেবে এবং এর মাধ্যমে শিরক ও পৌত্তলিকতার জগতে খ্যাতি অর্জন করবে।

এ গুজব দুশমন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে,ইসলামের মুজাহিদদের মনোবল ভেঙে দেয়াতেও ততখানি প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলমানদের বহু লোক যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মাত্র কয়েক মুজাহিদ যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকেন।

কিছুসংখ্যক লোকের পলায়ন কি অস্বীকার্য?

(উহুদের রণাঙ্গন থেকে) সাহাবীদের পলায়ন এবং তাঁদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। অথবা যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে সুখ্যাতি এবং উচ্চ মর্যাদা ও পদের অধিকারী হয়েছিলেন,সেহেতু তা আমাদের এ তিক্ত সত্য মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েও দাঁড়াবে না।

বিখ্যাত মুসলিম সীরাত রচয়িতা ইবনে হিশাম লিখেছেন,মুসলিম বাহিনী যখন চাপের মুখে পড়ে এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে,তখন অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবন রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং সবাই যে যার মতো একেক দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আনাস ইবনে মালিকের চাচা আনাস আনাস ইবনে নযর একদল মুজাহির ও আনসার,যাঁদের মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও ছিলেন,তাঁদেরকে দেখতে পেলেন যে,তাঁরা এক কোণায় বসে আছেন এবং নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছেন। তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠে তাঁদেরকে বললেন : আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন;তাই এখন য্দ্ধু করে কোন লাভ নেই। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন : যদি মহানবী নিহত হয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের এ জীবনের কোন লাভ নেই। আপনারাও সবাই উঠে যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন,সে পথে শহীদ হোন। 33 অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন,আনাস ইবনে নযর ঐ সময় বললেন : মুহাম্মদ যদি নিহত হয়েও থাকেন,মুহাম্মদের আল্লাহ্ তো জীবিত আছেন। এরপর তিনি দেখতে পেলেন যে,তাঁর কথা তাঁদের উপর কোন প্রভাব রাখছে না। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইবনে হিশাম বলেন,এ যুদ্ধে আনাসের দেহে 70টি ক্ষত বা আঘাত ছিল এবং তাঁর বোন ব্যতীত আর কেউই তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি।

একদল মুসলমান এতটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে,তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর দ্বারস্থ হতে চেয়েছিল যাতে সে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে।34

সেনা মনোবল শক্তিশালী করণ

মহানবী (সা.) যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। এবারও যখন (মাঝপথ থেকে তিন শ লোকের মুনাফিক দলটি মুসলমানদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর) কেবল সাত শ মুসলিম যোদ্ধা তিন হাজার শত্রু-সৈন্যের মোকাবেলায় দাঁড়ালো তখন মহানবী এক ভাষণ প্রদান করে তাদের মনোবল দৃঢ় করেন। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদী বলেন :

মহানবী (সা.) আইনাইন গিরিপথে 50 জন তীর নিক্ষেপকারী সৈন্য মোতায়েন করেন;উহুদ পর্বত পেছনে এবং মদীনা সামনে রেখে অবস্থান নেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সৈন্যদের সারিগুলো বিন্যস্ত করছিলেন এবং প্রত্যেক অধিনায়কের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিলেন। একদলকে সামনে এবং একদলকে পেছনে রাখছিলেন। সৈন্যদের সারি সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্কতা দেখিয়েছিলেন যে,কোন সৈনিকের কাঁধ সামনের দিকে এগিয়ে আসলে সাথে সাথে তাকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

মহানবী সৈন্যদের সারি বিন্যস্ত করার পর মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন,আমি তা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : তোমরা মহান আল্লাহর আদেশের আনুগত্য কর। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকবে। এরপর তিনি বলেন : শত্রুর মুকাবেলা করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই শত্রুর মুকাবেলায় দৃঢ় পদ ও অবিচল থাকার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কেবল তারাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম,যাদের আল্লাহ্ হিদায়েত করেছেন এবং শক্তি যুগিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহর আদেশ পালনকারীদের সাথেই তিনি আছেন। শয়তান ঐ লোকদের সাথে আছে যারা মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। সবকিছুর আগে জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।24 ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা জিবরীল আমাকে বলেছেন : এ জগতে কোন ব্যক্তিই তার (জন্য বরাদ্দ) রিযকের সর্বশেষ দানাটি আহার না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না। যতক্ষণ যুদ্ধের নির্দেশ জারি না হয়,কেউ যেন আক্রমণ পরিচালনা না করে। 25

যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ শত্রুবাহিনী

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে বর্ম পরিহিত পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অধিনায়কত্বে একদলকে মোতায়েন করে ডান পাশে। অপর এক দলকে ইকরামার অধিনায়কত্বে মোতায়েন করে বাম দিকে।

এছাড়া সে অগ্রবর্তী দলরূপে একটি বিশেষ দলকে সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে মোতায়েন করে যার মধ্যে পতাকাবাহীও ছিল। এরপর বনী আবদুদ্দার গোত্রভুক্ত পতাকাবাহীদের সম্বোধন করে আবু সুফিয়ান বলল : সেনাবাহিনীর বিজয় তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা বদরের দিন এ অংশের দিক থেকেই আক্রান্ত হয়ে পরাজয় বরণ করেছি। যদি বনী আবদুদ্দার গোত্র পতাকা বহন ও রক্ষার ব্যাপারে যোগ্যতার প্রমাণ না দেয়,তা হলে পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রের কাঁধে চলে যাবে। কুরাইশ বাহিনীর প্রথম পতাকাবাহী বীর যোদ্ধা তালহা ইবনে আবি তালহার কাছে কথাটি মারাত্মক বলে মনে হলো। তাই সে তৎক্ষণাৎ ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিপক্ষের মল্লযোদ্ধাদের আহবান জানাল।

মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহ

যুদ্ধ শুরু হবার আগে মহানবী একখানা তরবারি হাতে নিলেন। স্বীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে তাদের লক্ষ্য করে বললেন : কোন্ ব্যক্তি এ তরবারি ধারণ করে তার হক আদায় করবে? 26 কিছু লোক সাড়া দিলেন। কিন্তু মহানবী তাদেরকে তরবারি দিতে সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অকুতোভয় সৈনিক আবু দুজানাহ্ সাড়া দিয়ে বললেন, এই তরবারীর হক বলতে কি বুঝায়? কিভাবে এর হক আদায় করা যাবে?”   মহানবী বললেন : এটা নিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবে যাতে তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানাহ্ বললেন : আমি এর হক আদায় করতে প্রস্তুত আছি। এরপর মৃত্যুর রুমাল নামে বিখ্যাত একটি লাল রঙের রুমাল মাথায় বেঁধে মহানবীর হাত থেকে ঐ তরবারি তুলে নেন। আবু দুজানাহ্ যখনই এ রুমালটি মাথায় বাঁধতেন,তখনই বোঝা যেত,যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে,ততক্ষণ তিনি লড়াই করে যাবেন।

তিনি এক গর্বিত চিতাবাঘের মতো পথ চলছিলেন। আজ তাঁর সৌভাগ্যের জন্য তিনি অতিশয় আনন্দিত। মাথায় লাল রংয়ের পট্টি তাঁর মর্যাদা ও গৌরব আরো বৃদ্ধি করছিল।27

সত্যিই যে সেনাবাহিনী একমাত্র সত্য ও নৈতিকতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়,যাদের সামনে নিজ বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই,তাদের জন্যে এ ধরনের মহড়া হচ্ছে সর্বোত্তম উদ্দীপক। মহানবীর লক্ষ্য কেবল আবু দুজানাকে উৎসাহিত করাই ছিল না;বরং তিনি এ কাজের দ্বারা সাহাবীগণের আবেগকেও শাণিত করেন। তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে,তাঁদের সিদ্ধান্ত ও বীরত্ব এমন পর্যায়ের হতে হবে যে,এর ফলে তাঁরাও এ ধরনের সামরিক পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

যুবাইর ইবনে আওয়াম ছিলেন এক বীর যোদ্ধা। মহানবী (সা.) হাতের তরবারিখানা তাঁকে না দেওয়ায় তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বললেন : আবু দুজানার বীরত্ব ও সাহসের মাত্রা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি তাঁর পিছু নেব। তিনি বললেন : আমি যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পেছনে পেছনে ছিলাম। দেখেছিলাম,যে বীর যোদ্ধাই তাঁর সামনে আসছিল,তিনি সাথে সাথে তাকে খতম করে দিচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এক বীর ছিল,যে মুসলমানদের মধ্যেকার আহতদের মাথা দ্রুত দ্বিখণ্ডিত করছিল। এ কাজ দেখে আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে লোকটি আবু দুজানার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বীরটি আবু দুজানার হাতে নিহত হলো। আর স্বয়ং আবু দুজানাহ্ও বর্ণনা করেছেন : একজনকে দেখলাম,যে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে যখন দেখল,তার মাথার উপর তরবারি,তখন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল। হঠাৎ দেখলাম এ হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। আমি মনে করলাম,হিন্দ্-এর মতো মহিলাকে হত্যা করে মহানবীর তরবারি অপবিত্র করা উচিত হবে না। 28

যুদ্ধের সূচনা

মদীনা হতে পলাতক আউস গোত্রের লোক আবু আমেরকে দিয়ে যুদ্ধ শরু হয়ে যায়। ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে সে মদীনা থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। আউস গোত্রের পনের ব্যক্তিও তার সাথে ছিল। আবু আমেরের ধারণা ছিল,আউস গোত্রের লোকেরা যখন তাকে দেখবে,তখন মহানবীকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যে সে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন সে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়,তখন সে তাদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কাজেই অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর সে রণাঙ্গন থেকে সরে পড়ে।29

উহুদের ময়দানে কয়েকজন যোদ্ধার লড়াই ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের মনে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার। ইবনে আব্বাস বলেন : হযরত আলী সকল যুদ্ধেই মসুলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন। সর্বদা দক্ষ,পরীক্ষিত ও অবিচল যোদ্ধাদের মধ্য থেকেই পতাকাধারী নির্বাচন করা হতো। উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর হাতে ছিল।

অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,মুসলমানদের পতাকাবাহী মুসআব ইবনে ওমাইর নিহত হবার পর মহানবী (সা.) আলীর হাতে পতাকা তুলে দেন। মুসআব প্রথম পতাকাবাহী হবার কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে,তিনি আবদুদ্দার গোত্রের লোক ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাধারীরাও এই গোত্রের লোক ছিল।30

তালহা ইবনে আবি তালহা,যাকেكبش الكتيبة কাবশুল কাতীবাহ্ বলা হতো,হুংকার দিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলো এবং চিৎকার দিয়ে বলল : হে মুহাম্মদের সাথীরা! তোমরা বল যে,আমাদের নিহত ব্যক্তিরা দোযখে আছে,আর তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে। এই অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে,আমি তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিই অথবা সে আমাকে দোযখে পাঠিয়ে দিক?”   তার কণ্ঠস্বর যুদ্ধের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলী (আ.) সামনে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি ঘাত-প্রতিঘাতের পর আলীর তরবারির আঘাতে তালহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তালহা নিহত হলে পতাকা বহনের পালা আসে পর্যাক্রমে তার দু ভাইয়ের ওপরে। উভয়ে আসেম ইবনে সাবিতের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।

দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত শূরার (পরামর্শ) সভায় আমীরুল মুমিনীনের (আলী) প্রদত্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় যে,কুরাইশ বাহিনী নয় জনকে পতাকা বহনের জন্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছিল। কথা ছিল,পর্যায়ক্রমে তারা সেনাবাহিনীর পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করবে। পর্যায়ক্রমটি ছিল প্রথম ব্যক্তি নিহত হলে পরের ব্যক্তি-এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পতাকা বহন করবে। এসব পতাকাবাহীর সবাই ছিল বনী আবদুদ্দার গোত্রের লোক। তারা সবাই উহুদ যুদ্ধের দিবসে হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে প্রাণ হারায়। এদের পর সাওআব নামক এক হাবশী ক্রীতদাস,যার দেহ-কাঠামো ছিল খুবই ভয়ানক এবং মুখমণ্ডল ছিল বীভৎস,সে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা ধারণ করেছিল। সেও ময়দানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আহবান করেছিল। সেই ক্রীতদাসও হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল।

আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের বিরাট পরামর্শসভায় তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,আমি বনী আবদুদ্দার গোত্রের নয় জনের অনিষ্টতা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছিলাম,যাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আহবান করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে পতাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিল। উপস্থিত ব্যক্তিদের সবাই হযরত আলীর বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।31

তিনি আবারো বললেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,ঐ নয় ব্যক্তির পরে হাবশী ক্রীতদাস সাওআব রণাঙ্গনে এসেছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহানবীকে হত্যা করা। সে এতখানি ক্রোধান্বিত ছিল যে,তার মুখ ফেনায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দু টি লাল হয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই ভয়ঙ্কর যোদ্ধাকে দেখে ভয়ে পিছু হটে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সামনে এগিয়ে যাই,তার কোমরের উপর আঘাত হানি এবং তাকে ধরাশায়ী করি। এবারও উপস্থিত সবাই হযরত আলীর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন।

প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করতে লড়ছিল যে জাতি

হিন্দ এবং অন্যান্য নারীরা কুরাইশ সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যেসব কবিতা আবৃত্তি করছিল ও গান গাইছিল,তাতে দফ ও খঞ্জনা বাজিয়ে তাদেরকে রক্তপাত ঘটানো ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করার আহবান জানাচ্ছিল। তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে,এই জাতি নৈতিক চেতনা,পবিত্রতা,স্বাধীনতা ও সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে লড়ছিল না;বরং তাদের জন্য উত্তেজক ছিল বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ও যৌন সম্ভোগ। দফ ও তবলাবাদক নারীরা কুরাইশ বাহিনীর মাঝখানে এক বিশেষ সুর মূর্চ্ছনায় গান গাইছিল :

نحـن بنات طـارق

نـمشى على النّـمارق

إن تـقبلـوا نعـانق

أو تــدبـروا نـفـارق

আমরা বালিকা পথের

গালিচার উপর দিয়ে করি পদচারণ।

যদি মুখোমুখি হও শত্রুর,করবো আলিঙ্গন

(আর) যদি শত্রু থেকে কর পৃষ্ঠ প্রদর্শন,

তা হলে ছেড়ে যাবো তোমাদের।

নিঃসন্দেহে,যে জাতির যুদ্ধ যৌন বিষয়াদির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য না থাকে;অন্যদিকে যে জাতি স্বাধীনতার প্রসার,চিন্তার উৎকর্ষতা,কাঠ ও মাটির মূর্তির উপাসনা ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে,-উভয়ের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য ও অতুলনীয় ব্যবধান রয়েছে। এ দু দলের মধ্যে ভিন্ন-ধর্মী দু ধরনের মনোবলের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইসলামের বীর সমরনায়কগণ,যেমন আলী,হামযাহ্,আবু দুজানাহ্,যুবাইর ও অন্যান্যের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগী লড়াইয়ের ফলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্র ও গনীমতের সম্পদ ফেলে রেখে অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পালাতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামের সৈনিকদের গৌরব একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে।32

বিজয়ের পর পরাজয়

ইসলামের সৈনিকরা এ কারণে বিজয়ী হয়েছিল যে,বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথে জিহাদ,তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের প্রচার এবং এ পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল,সেগুলো অপসারণ ছাড়া তাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না।

বিজয় লাভের পরে পরাজয় এজন্য হয়েছিল যে,অধিকাংশ মুসলমানের নিয়্যত ও লক্ষ্যে পরিবর্তন এসে যায়। কুরাইশ বাহিনী যেসব গনীমতের মাল ফেলে পালিয়েছিল,সেসবের প্রতি মনোযোগ তাদের ইখলাস (নিষ্ঠা) কলুষিত করেছিল এবং তারা মহানবীর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল।

ঘটনার বিবরণ

আমরা উহুদ প্রান্তরের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনায় এ বিষয় উল্লেখ করেছি যে,উহুদ পর্বতের মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের ফাটল ছিল। মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইরের অধিনায়কত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের ওপর রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগের এ গিরি প্রহরার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন,তীর নিক্ষেপ করে পাহাড়ের ফাটলের ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যদের আগমন ও চলাচল প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন,তারা কোন অবস্থায়ই তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না।

যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতার মধ্যে শত্রু সৈন্যরা যখনই এই গিরিপথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে,তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ও মালপত্র মাটিতে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলায়ন শুরু করে,তখন প্রাণপণ লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইসলামের মুষ্টিমেয় বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গিয়ে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত থাকে। তারা (শত্রুবাহিনীর) ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ও সম্পদ সংগ্রহে তৎপর হয়ে যায়। তারা ধরে নিয়েছিল,যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত সৈনিকরা সুবর্ণ সুযোগ ভেবে মনে মনে বলে : আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থক। আমাদেরও গনীমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের অধিনায়ক বললেন : মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী বাহিনী জয়ী হোক বা পরাজিত হোক,আমরা যেন এ স্থান ত্যাগ না করি। অধিকাংশ তীর নিক্ষেপকারী রক্ষী সেনা তাদের অধিনায়কের নির্দেশের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়ে বলে : এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল,যুদ্ধ চলাকালে আমরা যেন এ গিরিপথটি পাহারা দিই। এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । এর ভিত্তিতে চল্লিশ জন সৈন্য প্রহরার স্থান থেকে নিচে নেমে আসে। সেখানে কেবল দশ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ রইল না।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। শুরু থেকেই সে জানত,গিরিপথের মুখটি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি এবং সে বেশ কয়েক বার ঐ পথ দিয়ে রণাঙ্গনের পেছন দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবার প্রহরীদের তীর নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার সে তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগ গ্রহণ করে। সে কুরাইশ সৈন্যদের মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করতে নেতৃত্ব দেয়। সে এক দফায় অতর্কিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হয়। টিলার উপর মোতায়েন মুষ্টিমেয় তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যের প্রতিরোধে কোন লাভ হলো না। ঐ দশ ব্যক্তি প্রাণপণ লড়াই করে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসতর্ক ও নিরস্ত্র মুসলমানরা পেছন দিক থেকে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্পর্শকাতর স্থানটি দখল করে নেয়ার পর পরাজিত কুরাইশ বাহিনীর পলায়নপর সৈন্যদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার আহবান জানায়। সে চিৎকার করে ও শ্লোগান দিয়ে কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধ স্পৃহা এবং অবিচল থাকার মনোবৃত্তি চাঙ্গা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের যুদ্ধের সারি ছত্রভঙ্গ থাকার সুযোগে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। তারা পেছন ও সামনের দিক থেকে ইসলামী বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এ পরাজয়ের কারণ ছিল,ঐ দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি,যারা বস্তুগত লক্ষ্যের জন্য বাঙ্কার বা অবস্থানস্থল ছেড়ে এসেছিল এবং নিজেদের অজান্তেই শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর ফলে কুরাইশ বাহিনীর অশ্বারোহী দল খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে পেছন দিক থেকে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়ে।

আবু জাহলের ছেলে ইকরামার হামলায় খালিদের আক্রমণ অভিযান শক্তিশালী হয়। এ সময় ইসলামী বাহিনীতে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায়ন্তর দেখলেন না। কিন্তু চেইন অব কমান্ড যেহেতু ভেঙে পড়েছিল,সেহেতু ইসলামের সৈনিকরা সাফল্যজনক প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেন না। বরং তাঁরা বড় ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। কয়েকজন মুসলমান সৈনিকও অসর্তকতার কারণে অন্য মুসলিম সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। খালিদ ও ইকরামার আক্রমণ অভিযান কুরাইশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা করে। পলাতক কুরাইশ সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং তাদের শক্তি ও সমর্থন যোগাতে থাকে। এ অবস্থায় তারা মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের একদলকে হত্যা করে।

মহানবী (সা.)-এর নিহত হবার সংবাদ

কুরাইশ বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা লাইসী ইসলামী বাহিনীর বীর পতাকাবাহী মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর হামলা করে। তাদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ইসলামী বাহিনীর পতাকাধারী শাহাদাত লাভ করেন। ইসলামী যোদ্ধাদের চেহারা ঢাকা ছিল। সে ভাবল,নিহত ব্যক্তি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হবেন। তখনই সে চিৎকার দিল এবং সেনা অধিনায়কদের উদ্দেশে বলল : ভাইসব! মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদটি কুরাইশ বাহিনীর মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

কুরাইশ নেতারা এমন আনন্দিত হলো যে,তাদের আওয়াজ সমগ্র রণাঙ্গনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তারা সবাই বলছিল :ألا قد قُتل محمّد، ألا قد قُتل محمّد মুহাম্মদ নিহত হয়েছে,মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদ রটে যাওয়ায় দুশমনদের সাহস বেড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী তখন তরঙ্গমালার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল,মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটায় অংশ নেবে এবং এর মাধ্যমে শিরক ও পৌত্তলিকতার জগতে খ্যাতি অর্জন করবে।

এ গুজব দুশমন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে,ইসলামের মুজাহিদদের মনোবল ভেঙে দেয়াতেও ততখানি প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলমানদের বহু লোক যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মাত্র কয়েক মুজাহিদ যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকেন।

কিছুসংখ্যক লোকের পলায়ন কি অস্বীকার্য?

(উহুদের রণাঙ্গন থেকে) সাহাবীদের পলায়ন এবং তাঁদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। অথবা যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে সুখ্যাতি এবং উচ্চ মর্যাদা ও পদের অধিকারী হয়েছিলেন,সেহেতু তা আমাদের এ তিক্ত সত্য মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েও দাঁড়াবে না।

বিখ্যাত মুসলিম সীরাত রচয়িতা ইবনে হিশাম লিখেছেন,মুসলিম বাহিনী যখন চাপের মুখে পড়ে এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে,তখন অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবন রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং সবাই যে যার মতো একেক দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আনাস ইবনে মালিকের চাচা আনাস আনাস ইবনে নযর একদল মুজাহির ও আনসার,যাঁদের মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও ছিলেন,তাঁদেরকে দেখতে পেলেন যে,তাঁরা এক কোণায় বসে আছেন এবং নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছেন। তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠে তাঁদেরকে বললেন : আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন;তাই এখন য্দ্ধু করে কোন লাভ নেই। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন : যদি মহানবী নিহত হয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের এ জীবনের কোন লাভ নেই। আপনারাও সবাই উঠে যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন,সে পথে শহীদ হোন। 33 অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন,আনাস ইবনে নযর ঐ সময় বললেন : মুহাম্মদ যদি নিহত হয়েও থাকেন,মুহাম্মদের আল্লাহ্ তো জীবিত আছেন। এরপর তিনি দেখতে পেলেন যে,তাঁর কথা তাঁদের উপর কোন প্রভাব রাখছে না। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইবনে হিশাম বলেন,এ যুদ্ধে আনাসের দেহে 70টি ক্ষত বা আঘাত ছিল এবং তাঁর বোন ব্যতীত আর কেউই তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি।

একদল মুসলমান এতটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে,তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর দ্বারস্থ হতে চেয়েছিল যাতে সে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে।34


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53