চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83947 / ডাউনলোড: 7981
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক সফর

ষষ্ঠ হিজরী সাল তিক্ত-মিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে আসছিল। হঠাৎ এক রাতে মহানবী (সা.) একটি সুন্দর স্বপ্নে দেখলেন,মুসলমানরা মসজিদুল হারামে (পবিত্র কাবাঘরের চারদিকে) হজ্বের আনুষ্ঠানিকতাসমূহ পালনে রত। তিনি এ স্বপ্নের কথা তাঁর সাথীগণকে বললেন এবং একে একটি শুভ আলামত মনে করে বললেন,খুব শীঘ্রই মুসলমানরা তাদের মনের আশা পূরণে সক্ষম হবে।১৭২

কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি মুসলমানদের উমরার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মদীনার আশে-পাশের যে সকল গোত্র তখনও মূর্তিপূজক ছিল,তাদেরও আহবান জানালেন মুসলমানদের সফরসঙ্গী হওয়ার। এ খবর হিজাযের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল যে,মুসলমানরা যিলকদ মাসে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় যাচ্ছে।

এই আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সফরে আত্মিক ও নৈতিক কল্যাণের দিক ছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্যাণের দিকও বিদ্যমান ছিল এবং সমগ্র আরবোপদ্বীপে মুসলমানদের অবস্থানকে সুদৃঢ়করণ ও হিজাযের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে একত্ববাদী ধর্ম ইসলাম প্রচারের জন্য সহায়ক ছিল। কারণ হলো :

প্রথমত আরবের মূর্তিপূজক বিভিন্ন গোত্র ভাবত,মহানবী (সা.) তাদের সকল ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধী,এমনকি তাদের অন্যতম প্রাচীন আচার হজ্ব ও উমরারও তিনি বিরোধী। এ কারণে রাসূল (সা.) ও তাঁর প্রচারিত ধর্মের প্রতি ভীত ছিল। তাই এমন মুহূর্তে রাসূল (সা.) ও তাঁর সঙ্গীগণের উমরা পালনে যাত্রার ঘোষণায় তাদের ঐ ভীতি ও আশংকা খানিকটা দূর হলো। মুহাম্মদ (সা.) কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারিকভাবে দেখিয়ে দিতে চাইলেন তিনি আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও একে কেন্দ্র করে আবর্তিত ধর্মীয় আচার ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্নসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিরোধী তো ননই;বরং এরূপ কর্মকে ফরয মনে করেন এবং আরবদের আদি পিতা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর ন্যায় এর সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনে সচেষ্ট। যারা ইসলামকে তাদের সকল ধর্মীয় ও জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের এক শ’ ভাগ বিরোধী মনে করত,মুহাম্মদ (সা.) চেয়েছিলেন ঐ সকল দল ও গোষ্ঠীকে এভাবে আকর্ষণ করতে ও তাদের মন থেকে ভীতি দূর করতে।

দ্বিতীয়ত এভাবে যদি মুসলমানগণ শত-সহস্র আরব মুশরিকের সামনে সফলতার সাথে ও স্বাধীনভাবে মসজিদুল হারামে উমরা পালনে সক্ষম হন,তা হলে তা ইসলামের পক্ষে প্রচারের এক বিরাট সুযোগ এনে দেবে। কারণ এ সময়ে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুশরিকরা মুসলমানদের খবর তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে নিয়ে যাবে। ফলে যে সকল স্থানে ইসলামের আহবান পৌঁছানো মহানবী (সা.)-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না বা তাঁর পক্ষে কাউকে প্রচারক হিসেবে পাঠানো সম্ভব হয়ে ওঠে নি,সেখানেও তাঁর বাণী পৌঁছে যাবে। অন্ততপক্ষে এর প্রভাব কার্যকর হবে।

তৃতীয়ত মুহাম্মদ (সা.) যাত্রার পূর্বে মদীনায় অবস্থানকালেই হারাম মাসসমূহের১৭৩ কথা স্মরণ করে বলেন : আমরা শুধুই আল্লাহর ঘর যিয়ারতে যাব।” তাই সফরের সময় বহনের জন্য আরবদের মধ্যে প্রচলিত একটি তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সঙ্গে না নেয়ার জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশের ফলে অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো। কারণ,আরবের মুশরিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালাতো যে,তিনি কোন আরব রীতি মানেন না,তারা দেখল,রাসূলও অন্যদের মতো এ মাসগুলোতে যুদ্ধ হারাম মনে করেন ও এই প্রাচীন রীতিকে সমর্থন করেন।

ইসলামের মহান কাণ্ডারী জানতেন,এ পদ্ধতিতে মুসলমানরা সফলতা লাভ করলে তাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত একটি লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এ দল নিজ আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু ও সুহৃদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পাবে। আর কুরাইশরা মক্কায় প্রবেশে মুসলমানদের বাধা দিলে সমগ্র আরবোপদ্বীপের গোত্রগুলোর কাছে অসম্মানিত হবে। কারণ আরবের সাধারণ নিরপেক্ষ গোত্রগুলোর আগত প্রতিনিধিরা দেখবে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশে ফরয হজ্ব করতে আসা একদল নিরস্ত্র হাজীর সঙ্গে কুরাইশরা কিরূপ আচরণ করেছে;অথচ মসজিদুল হারামের ওপর সকল আরবের অধিকার রয়েছে এবং কুরাইশরা কেবল তার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছে।

এর ফলে মুসলমানদের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটবে এবং কুরাইশদের অবৈধ শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি তারা বুঝতে পারবে। ফলে কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তাদেরকে সঙ্গী ও চুক্তিবদ্ধ করতে পারবে না। কারণ তারা সহস্র লোকের সামনে মুসলমানদের বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

মহানবী (সা.) বিষয়টির বিভিন্ন দিক চিন্তা করে উমরার জন্য যাত্রার নির্দেশ দিলেন। চৌদ্দ হাজার ১৭৪ ষোল১৭৫ হাজার অথবা আঠারো হাজার১৭৬ ,হজ্বযাত্রী যুল হুলাইফা’ নামক স্থানে ইহরাম বাঁধলেন। তাঁরা কুরবানীর জন্য সত্তরটি উট সঙ্গে নিলেন এবং উটগুলোকে কোরবানীর জন্য চিহ্নিত করে সবার কাছে নিজেদের সফরের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন।

রাসূল (সা.) কয়েকজন সংবাদবাহককে পূর্বেই সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করলেন যাতে কোন শত্রু দেখলে তাঁর কাছে দ্রুত সংবাদ পৌঁছান।

‘আসফান’ থেকে রাসূলের প্রেরিত সংবাদবাহক সংবাদ নিয়ে এলেন :

“কুরাইশরা আপনাদের আগমন সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং তাদের সৈন্যদের প্রস্তুত করে লাত ও ওজ্জার১৭৭ শপথ করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে,আপনাকে কোনক্রমেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। কুরাইশের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও ব্যক্তিরা মক্কার নিকটবর্তী যি তুয়া’ য় সমবেত হয়েছে এবং মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রোধ করতে তাদের সাহসী যোদ্ধা খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে দু শ’ সৈন্যসহ আসফানের আট মাইল দূরের কারাউল গামীম’ -এ নিয়োজিত করেছে।১৭৮ তাদের উদ্দেশ্য মুসলমানদের গতিরোধ করা,এমনকি যদি এতে তাদের নিহতও হতে হয়।”

মহানবী (সা.) এ সংবাদ শুনে বললেন : কুরাইশদের জন্য আফসোস! যুদ্ধ তাদের শেষ করে দিয়েছে। হায়! যদি কুরাইশরা আরবের মূর্তিপূজক গোত্রগুলোর সঙ্গে আমাকে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দিত! সেক্ষেত্রে ঐ গোত্রগুলো আমার ওপর বিজয়ী হলে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতো,আর আমি তাদের ওপর বিজয়ী হলে হয় তারা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিত,নতুবা তারা তাদের বিদ্যমান শক্তি নিয়ে আমার সাথে যুদ্ধ করত। আল্লাহর শপথ! একত্ববাদী এ ধর্মের প্রচারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব। হয় এতে আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ী করবেন,নতুবা তাঁর পথে প্রাণ বিসর্জন দেব।” অতঃপর একজন অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শককে ডেকে এমনভাবে কাফেলাকে নিয়ে যেতে বললেন যাতে খালিদের সেনাদলের মুখোমুখি না হতে হয়। আসলাম গোত্রের একজন দিশারী কাফেলা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। তিনি এক দুর্গম উপত্যকা দিয়ে কাফেলাকে অতিক্রম করিয়ে হুদায়বিয়া’ য় পৌঁছলে মহানবী (সা.)-এর উট মাটিতে বসে পড়ল। মহানবী (সা.) বললেন : এ উট আল্লাহর নির্দেশে এখানে বসে পড়েছে। এখানেই আমাদের করণীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” অতঃপর সবাইকে বাহন হতে নেমে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিলেন।

সময় না গড়াতেই কুরাইশ অশ্বারোহী সেনারা রাসূল (সা.)-এর নতুন পথ সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁর অবস্থান গ্রহণের স্থানের কাছে চলে আসে। মহানবী (সা.) যাত্রা স্থগিত না করে অগ্রযাত্রার সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই কুরাইশ সৈন্যদের রক্ষণব্যূহ ভেদ করে যেতে হতো। সেক্ষেত্রে তাদের হত্যা করে রক্তের ওপর দিয়ে পথ অতিক্রম করতে হতো। অথচ সবাই জানত রাসূল (সা.) উমরা ও কাবা ঘর যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে আসেন নি। তাই এ রকম কিছু ঘটলে মহানবীর ব্যক্তিত্ব ও শান্তিকামী চরিত্রের ভাবমর্যাদার ওপর আঘাত আসত। উপরন্তু আগত ঐ সৈন্যদের হত্যার মাধ্যমেই ঘটনার যবনিকাপাত ঘটতো না। কারণ সাথে সাথেই একের পর এক নতুন সেনাবাহিনী তাঁদের প্রতিরোধের জন্য আসত এবং তা অব্যাহত থাকত। অন্যদিকে মুসলমানরা তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র সঙ্গে নেন নি। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা কখনোই কল্যাণকর হতো না। তাই আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান বাঞ্ছনীয় ছিল।

এ কারণেই বাহন হতে নামার পর মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেন : যদি আজ কুরাইশরা আমার কাছে এমন কিছু চায় যা তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় করে,তবে আমি অবশ্যই তা দেব এবং সমঝোতার পথকেই বেছে নেব। ১৭৯

সবাই রাসূল (সা.)-এর কথা শুনলেন এবং শত্রুদের কানেও তা পৌঁছল। তারা রাসূলের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে জানার সিদ্ধান্ত নিল। তাই কয়েকজনকে তাঁর নিকট প্রেরণ করল তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার জন্য।

রাসূল (সা.) সকাশে কুরাইশ প্রতিনিধিদল

কুরাইশরা কয়েক দফায় রাসূলের নিকট বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রেরণ করে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইল।

সর্বপ্রথম বুদাইল খাযায়ী তার গোত্রের কয়েকজনকে নিয়ে রাসূলের কাছে এল। মহানবী (সা.) তাদের বললেন : আমি যুদ্ধের জন্য আসি নি;বরং আল্লাহর ঘর যিয়ারতে এসেছি।” প্রতিনিধিদল কুরাইশ নেতাদের নিকট ফিরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু কুরাইশরা তাদের কথা সহজে বিশ্বাস করতে পারল না। তাই তারা বলল : আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে কোন অবস্থায়ই মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না,এমনকি যদি সে উমরাও করতে আসে।”

দ্বিতীয় বার কুরাইশদের পক্ষ থেকে মুকরিজ’ নামের এক ব্যক্তি রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করল। সেও কুরাইশদের নিকট ফিরে গিয়ে বুদাইলের অনুরূপ প্রতিবেদন দিল। কিন্তু কুরাইশরা তাদের দু জনের কথাই বিশ্বাস করল না। তৃতীয় বার আরবের তীরন্দাজ বাহিনীর নেতা হুলাইস ইবনে আলকামাকে দ্বন্দ্ব-সংশয় অবসানের লক্ষ্যে রাসূলের নিকট পাঠালো।১৮০ তাকে দূর থেকে দেখেই রাসূল (সা.) মন্তব্য করলেন :

“এই ব্যক্তি আল্লাহর পরিচয় লাভকারী পবিত্র এক গোত্রের মানুষ। তার সামনে কুরবানীর জন্য আনীত উটগুলো ছেড়ে দাও যাতে সে বুঝতে পারে আমরা যুদ্ধ করতে আসি নি। উমরা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই।” এই শীর্ণ সত্তরটি উটের উপর হুলাইসের দৃষ্টি পড়লে সে দেখল সেগুলো খাদ্যাভাবে শুকিয়ে গেছে এবং একে অপরের লোম ছিঁড়ে খাচ্ছে। সে মহানবীর সঙ্গে দেখা না করেই যত দ্রুত সম্ভব কুরাইশদের নিকট ফিরে গিয়ে বলল : আমরা তোমাদের সাথে এ শর্তে কখনোই চুক্তিবদ্ধ হই নি যে,আল্লাহর ঘরের যিয়ারতকারীদের বাধা দেবে। মুহাম্মদ যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন নি। যে খোদার হাতে আমার জীবন,তাঁর শপথ! যদি মুহাম্মদকে প্রবেশে বাধা দাও,তা হলে আমি আমার গোত্রের সকল লোক (যাদের অধিকাংশই তীরন্দাজ) নিয়ে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব।”

হুলাইসের কথায় কুরাইশরা ভীত হলো এবং চিন্তা করে তাকে বলল : শান্ত হও। আমরা এমন পথ অবলম্বন করব,যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও।”

অবশেষে তারা বুদ্ধিমান,সমঝদার ও তাদের কল্যাণকামী উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে মহানবী (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করল। সে প্রথমে কুরাইশদের প্রতিনিধি হিসেবে যেতে রাজী হয় নি। কারণ সে লক্ষ্য করেছে,পূর্ববর্তী প্রতিনিধিদের তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে ও তাদের বিশ্বাস না করে মানহানি ঘটিয়েছে। কিন্তু কুরাইশরা তাকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে,তাদের নিকট তার বিশেষ সম্মান রয়েছে এবং তাকে তারা বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ দেবে না।

উরওয়া ইবনে মাসউদ রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল : বিভিন্ন দলকে নিজের চারদিকে সমবেত করেছ এ উদ্দেশ্যে যে,নিজ জন্মভূমি (মক্কা) আক্রমণ করবে? কিন্তু জেনে রাখ,কুরাইশরা তাদের সমগ্র শক্তি নিয়ে তোমার মোকাবেলা করবে এবং কোন অবস্থায়ই তোমাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি,তোমার চারপাশে সমবেত এরা তোমাকে একা ফেলে পালিয়ে না যায়!

তার এ কথা বলর সময় হযরত আবু বকর মহানবীর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি উরওয়ার উদ্দেশে বললেন : তুমি ভুল করছ। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গীরা কখনোই তাঁকে ছেড়ে যাবে না।” উরওয়া মুসলমানদের মানসিক শক্তি দুর্বল করার জন্য কূটনৈতিক চাল চালছিল। সে কথা বলার সময় মহানবীকে অসম্মান করার লক্ষ্যে বারবার তাঁর শ্মশ্রুতে হাত দিচ্ছিল। অন্যদিকে মুগীরা ইবনে শু বা প্রতিবারই তার হাতে আঘাত করে সরিয়ে দিচ্ছিলেন ও বলছিলেন : সম্মান ও আদব রক্ষা করে আচরণ কর। মহানবীর সাথে বেয়াদবী করো না।” উরওয়া ইবনে মাসউদ রাসূলকে প্রশ্ন করল : এই ব্যক্তিটি কে? (সম্ভবত রাসূলের চারদিকে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন,তাঁরা মুখ ঢেকে রেখেছিলেন)। মহানবী (সা.) বললেন : সে তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র শু বার পুত্র মুগীরা।” উরওয়া রাগান্বিত হয়ে মুগীরাকে বলল : হে চালবাজ প্রতারক! আমি গতকাল তোর সম্মান কিনেছি (রক্ষা করেছি)। তুই ইসলাম গ্রহণের পর সাকীফ গোত্রের তের জনকে হত্যা করেছিস। আমি সাকীফ গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করা থেকে রক্ষা পেতে সবার রক্তপণ শোধ করেছি।” মহানবী তার কথায় ছেদ টেনে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন যেমনটি পূর্ববর্তী প্রতিনিধিদের নিকট দিয়েছিলেন। অতঃপর উরওয়ার এতক্ষণের কথার দাঁতভাঙা জবাব দিতে উঠে ওযূ করতে গেলেন। উরওয়া লক্ষ্য করল মহানবীর ওযূর পানি মাটিতে পড়ার পূর্বেই কাড়াকাড়ি করে মুসলমানরা তা নিয়ে নিচ্ছেন। উরওয়া সেখান থেকে উঠে কুরাইশদের সমাবেশস্থল যি তুয়া’ র দিকে যাত্রা করল। কুরাইশদের বৈঠকে প্রবেশ করে রাসূলের আসার উদ্দেশ্য ও সাক্ষাতের বিবরণ পেশ করল। অতঃপর বলল : আমি বড় বড় রাজা-বাদশা দেখেছি। ক্ষমতাবান সম্রাট,যেমন পারস্য ও রোম সম্রাট,আবিসিনিয়ার বাদশাহ,সবাইকে দেখেছি। কিন্তু নিজ অনুসারী ও ভক্তদের মাঝে মুহাম্মদের মতো সম্মানের অধিকারী কাউকে দেখি নি। আমি দেখেছি তাঁর অনুসারীরা তাঁর ওযূর পানি মাটিতে পরার পূর্বেই বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তা ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। যদি তাঁর কোন চুল বা লোমও মাটিতে পড়ে,তারা তা ত্বরিৎগতিতে তুলে নিচ্ছে। সুতরাং তার বিপজ্জনক মর্যাদাকর অবস্থান সম্পর্কে কুরাইশদের চিন্তা করা উচিত। ১৮১

মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধি প্রেরণ

বিশ্ব মুসলিমের নেতা মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে কুরাইশ প্রতিনিধি দলগুলোর বৈঠক সফলতা লাভ করে নি। তাই স্বাভাবিকভাবে মহানবীর ভাববার সম্ভাবনা ছিল,কুরাইশদের প্রেরিত প্রতিনিধি সঠিকভাবে তথ্য পৌঁছাতে সক্ষম হয় নি বা কেউ কেউ সঠিক তথ্য সেখানে পৌঁছাক,তা চায় নি কিংবা মিথ্যুক বলে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে স্পষ্টভাবে বক্তব্য উপস্থাপন থেকে বিরত থেকেছে। এদিক চিন্তা করে মহানবী সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পৌত্তলিক দলের নেতাদের কাছে প্রেরণ করে তাঁর উদ্দেশ্য যে উমরা করা ছাড়া অন্য কিছু নয়,তা জানিয়ে দেবেন।

তিনি খাযায়া গোত্রের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে এ কাজের জন্য মনোনীত করলেন। তাঁর নাম খিরাশ ইবনে উমাইয়্যা। মহানবী (সা.) তাঁকে একটি উট দিয়ে কুরাইশদের নিকট যেতে বললেন। তিনি কুরাইশদের নিকট গিয়ে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন। কিন্তু কুরাইশরা কোন দূতের প্রতি সম্মানজনক আচরণের বিশ্বজনীন নীতি অনুসরণের বিপরীতে তাঁর উটটিকে হত্যা করল ও তাঁকেও হত্যা করতে উদ্যত হলো। কিন্তু তীরন্দাজ আরবরা কুরাইশদের এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করল। এ কাজের মাধ্যমে কুরাইশরা প্রমাণ করল,তারা শান্তি,সন্ধি ও সমঝোতার পথ অবলম্বন করতে রাজী নয়;বরং যুদ্ধ বাঁধানোর চিন্তায় রয়েছে।

এ ঘটনার পরপরই কুরাইশদের প্রশিক্ষিত ৫০ যুবক মুসলমানদের অবস্থানের নিকট মহড়া দেয়ার দায়িত্ব পেল। সে সাথে সুযোগ পেলে মুসলমানদের সম্পদ লুট করে তাঁদের কয়েকজনকে বন্দী করে কুরাইশদের নিকট নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ তো হলোই;বরং তারা সবাই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে রাসূলের নিকট আনীত হলো। বন্দী হওয়ার পূর্বে তারা মুসলমানদের উদ্দেশে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা সত্বেও মহানবী (সা.) তাঁর শান্তিকামী মনোভাব প্রমাণ করতে তাদের সবাইকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন,তিনি যুদ্ধ করতে আসেন নি।১৮২

মহানবী (সা.) দ্বিতীয় বারের মতো প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। এতকিছু সত্বেও তিনি সন্ধি ও সমঝোতার বিষয়ে নিরাশ হলেন না এবং সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে এবং কুরাইশ নেতাদের মতের পরিবর্তন ঘটাতে চাইলেন। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন কুরাইশদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত হয় নি। সুতরাং হযরত আলী,যুবাইরসহ ইসলামের যে সব মহাসৈনিক আরব ও কুরাইশদের মহাবীরদের মুখোমুখি হয়ে তাদের অনেককে হত্যা করেছেন,তাঁদেরকে মনোনীত করা সমীচীন মনে করলেন না। এজন্য তিনি সর্বপ্রথম হযরত উমর ইবনে খাত্তাবের কথা চিন্তা করলেন। কারণ তিনি সেদিন পর্যন্ত কোন কুরাইশের এক ফোঁটা রক্তও ঝরান নি। কিন্তু হযরত উমর এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অজুহাত দেখিয়ে বললেন : আমি আমার জীবনের বিষয়ে কুরাইশদের হতে শঙ্কিত এবং মক্কায় আমার কোন নিকটাত্মীয়ও নেই যে আমার পক্ষাবলম্বন করে আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচাবে। তাই আমি এমন এক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করছি,যিনি এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম। তিনি হলেন উসমান ইবনে আফ্ফান। যেহেতু তিনি উমাইয়্যা বংশোদ্ভূত এবং আবু সুফিয়ানের নিকটাত্মীয়,সেহেতু তিনি আপনার বাণী কুরাইশদের নিকট পৌঁছানোর অধিক উপযুক্ত।” হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান এ কাজের দায়িত্ব পেলেন এবং মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি পথিমধ্যে আবান ইবনে সাঈদ ইবনে আসের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তার আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। আবান প্রতিশ্রুতি দিল,কেউ তাঁর ক্ষতি করবে না এবং সে তাঁকে নিরাপদে কুরাইশদের নিকট নিয়ে যাবে যাতে তিনি রাসূলের বাণী পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু কুরাইশরা রাসূলের বাণী শুনে বলল : আমরা শপথ করেছি মুহাম্মদকে জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না। এ শপথের ফলে সংলাপের মাধ্যমে তাকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়ার পথ রুদ্ধ হয়েছে।” অতঃপর তারা হযরত উসমানকে কাবা ঘর তাওয়াফের অনুমতি দিল। কিন্তু তিনি রাসূলের সম্মানে তা থেকে বিরত থাকলেন। কুরাইশরা আরো যা করল,তা হলো হযরত উসমানকে ফিরে যেতে দিল না। সম্ভবত তারা চাইল তাঁর যাত্রা বিলম্বিত করে কোন উপায় বের করতে।১৮৩

কুরআনের আয়াতে সত্যের উন্মোচন

কুরআনের আয়াতসমূহ অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির এ পর্দা উন্মোচন করে দেয় যে,একদল সাহাবী মনে করেছিলেন,সাহায্য ও বিজয়ের ব্যাপারে মহানবীর দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহ ভিত্তিহীন। মহান আল্লাহ্ এ দল সম্পর্কে বলেন :

) و طائفة قد أهمّتهم أنفسهم يظنّون بالله غير الحق ظن الجاهلية يقولون هل لنا من الأمر من شىء(

সাহাবীদের মধ্যে একদল নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এতখানি চিন্তায় মগ্ন ছিল যে,তারা আল্লাহর সম্পর্কে জাহিলীয়াতের সময়কার ধারণা ও অনুমানের মতো বাতিল ধারণা পোষণ করছিল। তারা বলছিল,আমাদের কি মুক্তির কোন উপায় আছে। 35

আপনারা সূরা আলে ইমরানের কিছু আয়াত36 পর্যালোচনা করে এ যুদ্ধের কিছু গোপন বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এসব আয়াত সাহাবীদের সম্পর্কে শিয়াদের আকীদাকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে দেয়। শিয়ারা আকীদা পোষণ করে যে,মহানবী (সা.)-এর সকল সাহাবী তাওহীদী ধর্মের জন্য সত্যিকারভাবে ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না। তাদের মধ্যে দুর্বল আকীদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফিকও ছিল। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তরের মুমিন-মুক্তাকী লোকও অনেক ছিলেন। আজ আহলে সুন্নাতের একদল লেখক এ জাতীয় অনেক অন্যায় কাজ ধামাচাপা দিতে চান,যার নমুনা উহুদ যুদ্ধের বর্ণনায় আপনারা শুনলেন। তারা বাস্তবতা বহির্ভূত ব্যাখ্যা দিয়ে সকল সাহাবীর মর্যাদা রক্ষা করতে চান অথচ এসব ব্যাখ্যা অপরিপক্ব ও অপর্যাপ্ত এবং গোঁড়ামি ও পক্ষপাতদুষ্টতার পর্দা সত্যের প্রকৃত চেহারা দর্শনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কোন্ লেখক নিচের আয়াতের প্রতিপাদ্য অস্বীকার করতে পারবে? সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে : তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলে এবং কারো দিকে তাকাচ্ছিলে না;অথচ নবী পেছন থেকে তোমাদের ডাকছিলেন;তোমরা তাঁর কথায় কর্ণপাত কর নি;বরং তোমাদের পলায়ন অব্যাহত রেখেছিলে। 37

এ আয়াত সে সব লোক এবং তাদের মতো লোকদের সম্পর্কে,যাদেরকে আনাস ইবনে নযর নিজের চোখে দেখেছেন,তারা এক কোণায় বসে আছে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন রয়েছে। এর চেয়েও স্পষ্ট হচ্ছে নিচের এ আয়াত : যারা দু দলের মুখোমুখি হবার দিন পালিয়ে গিয়েছিল,শয়তান তাদেরকে তাদের কতিপয় কাজের ফলে পদস্খলিত করে দিল। তবে মহান আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্ও ক্ষমাকারী ও সহনশীল। 38

যারা নবীর নিহত হবার গুজবকে নিজেদের বাহানা হিসেবে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল এবং এ ফন্দি আঁটছিল যে,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের সহায়তায় আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে,তাদেরকে তিরস্কার করে পবিত্র কুরআন বলেছে :

) و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرّسل أفائن مات أو قتل انقلبتم علي أعقابكم و من ينقلب علي عقبيه فلن يضرّ الله شيئا و سيجزى الله الشّاكرين(

মুহাম্মদ (আল্লাহর পক্ষ হতে) একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন-তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনোই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না;বরং আল্লাহ্ কৃতজ্ঞদের শীঘ্রই পুরস্কার দান করবেন। 39

তিক্ত অভিজ্ঞতা

উহুদের ঘটনাবলী পর্যালোচনার দ্বারা তিক্ত ও মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। একদলের দৃঢ় ও অবিচল থাকার শক্তি ও ক্ষমতা এবং আরেক দলের দৃঢ়পদ ও অবিচল না থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে এ তথ্য হস্তগত হয় যে,মহানবী (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মুসলমানকে ন্যায়পরায়ণ ও মুত্তাকী সাব্যস্ত করা যায় না বা সম্ভবপর নয়। কেননা যে টিলা তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের অবস্থানস্থল ছিল,যারা তা ত্যাগ করেছে অথবা স্পর্শকাতর মুহূর্তে (রণাঙ্গন ত্যাগ করে ) পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে এবং মহানবীর আহবানের প্রতি তোয়াক্কা করে নি,তারাও মহানবীর সাহাবী ছিল।

বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক ওয়াকিদী লিখেছেন,উহুদের দিন আট ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মহানবী (সা.)-এর সাথে থাকার বাইয়াত করেন। তাঁরা ছিলেন মুজাহিরগণের মধ্য থেকে তিনজন-আলী,তালহা,যুবাইর এবং আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন। এই আটজন ছাড়া সবাই বিপজ্জনক মুহূর্তে পলায়ন করে।

ইবনে আবিল হাদীদ40 লিখেছেন,608 সালে বাগদাদে এক অনুষ্ঠানে মজলিসে ওয়াকিদীর মাগাযী গ্রন্থটি একজন বড় মুসলিম মনীষী মুহাম্মদ ইবনে মাআদ আলাভীর কাছে পাঠ করছিলাম। বিষয়টি যখন এ পর্যন্ত পৌঁছল যে,মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন : আমি উহুদের দিন নিজের চোখে দেখেছি,মুসলমানরা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল,আর মহানবী (সা.) তাদেরকে নাম ধরে ধরে ডাকছিলেন এবং বলছিলেন : হে অমুক! আমার কাছে এসো;হে অমুক! আমার কাছে এসো (إلَىّ يا فلان! إلَىّ يا فلان !),কেউই রাসূলের ডাকে অনুকূল সাড়া দিচ্ছিল না। উস্তাদ (মুহাম্মদ ইবনে মাআদ) আমাকে বললেন যে, অমুক, অমুক বলতে ঐ লোকদেরই বুঝানো হয়েছে,যাঁরা মহানবী (সা.)-এর পরে (রাষ্ট্রীয়) পদমর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের নাম স্পষ্টভাবে বললে বর্ণনাকারীর আশংকা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য থাকার কারণে স্পষ্টভাবে তাঁদের নাম উল্লেখ করতে চান নি।

অনুরূপভাবে তিনি (ইবনে আবিল হাদীদ) তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,প্রায় সকল বর্ণনাকারীই এ কথায় ঐকমত্য পোষণ করেন যে,তৃতীয় খলীফা ঐসব লোকদের মধ্যে ছিলেন,যারা সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে রণাঙ্গনে অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন না। আপনারা সামনে ইসলামের একজন মহীয়সী নারী নাসীবা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর এক উক্তি পড়বেন। উল্লেখ্য,এ মহীয়সী নারী উহুদের ময়দানে মহানবীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঐ বাণীতে পরোক্ষভাবে পলাতক দলটির মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে খাটো করা হয়েছে। আমরা মহানবীর সঙ্গীগণের কারো ব্যাপারেই কখনো মন্দ ধারণা রাখি না। উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন এবং বাস্তবতা প্রকাশ করা। তাদের পলায়নকে যে পরিমাণ নিন্দা করি,ঠিক তেমনি যুদ্ধের ময়দানে আরেক দল,যাঁদের কাহিনী আপনারা পরে পাঠ করবেন,তাঁদের (রণাঙ্গনে) দৃঢ়পদ থাকারও প্রশংসা করি এবং তাঁদের কাজের মর্যাদা দিই।

মহানবী (সা.)-কে হত্যার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পাঁচ ব্যক্তি

যে মুহূর্তে ইসলামী বাহিনী বিক্ষিপ্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল,তখন চতুর্দিক থেকে মহানবীকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছিল। এ সত্বেও কুরাইশ বাহিনীর নামকরা পাঁচজন যোদ্ধা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন কিছুর বিনিময়েই হোক,মহানবীর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে ফেলবে। এই লোকেরা ছিল :

1. আবদুল্লাহ্ ইবনে শিহাব,যে মহানবীর কপালে আঘাত করে।

2. আবু ওয়াক্কাসের পুত্র উতবা;সে চারটি পাথর নিক্ষেপ করে হযরতের ডান পাশের রুবাঈ দাঁত মুবারক41 ভেঙে দেয়।

3. ইবনে কুমিআহ্ লাইসী,যে মহানবীর মুখমণ্ডলে আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ আঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে,শিরস্ত্রাণের আংটাগুলো তাঁর মুখমণ্ডলের উপরিভাগ ছিদ্র হয়ে ঢুকে গিয়েছিল। আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বের করে আনেন। এর ফলে তাঁর নিজের চারটি দাঁত ভেঙে যায়।

4. আবদুল্লাহ্ ইবনে হামীদ,যে হামলা চালানো অবস্থায়ই মুসলিম বাহিনীর বীর যোদ্ধা আবু দুজানার আক্রমণে নিহত হয়।

5. উবাই ইবনে খালফ,সে ঐ ব্যক্তি যে মহানবীর হাতে নিহত হয়। সে এমন সময় মহানবীর মুখোমুখি হয়,যখন তিনি কোনমতে গিরি উপত্যকায় পৌঁছেছিলেন এবং কয়েকজন সাহাবী তাঁকে চিনতে পেরে চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে রয়েছিলেন। সে মহানবীর দিকে এলে তিনি হারেস ইবনে সিম্মার কাছ থেকে একটি বর্শা নেন এবং তা তার ঘাড়ে বসিয়ে দেন। তাতে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। উবাই ইবনে খালফের জখম যদিও খুব সামান্য ছিল,কিন্তু ভয় তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে,তার বন্ধুরা যতই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল,সে শান্ত হচ্ছিল না। সে বারবার বলছিল : মুহাম্মদকে মক্কায় আমি বলেছিলাম,আমি তোমাকে হত্যা করব। তার উত্তরে সে আমাকে বলেছিল;বরং আমিই তোমাকে হত্যা করব। সে কখনো মিথ্যা বলে না। এ ভয় ও ক্ষতই তার দফা রফা করে। কয়েক দিন পরে (মক্কায়) ফেরার পথে সে মারা যায়।42

সত্যই এ বিষয়টি প্রমাণ করে,কুরাইশরা কতখানি হীনমন্য ও ঘৃণ্য মানসিকতার অধিকারী ছিল। তারা এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত এবং স্বীকার করত যে,মহানবী (সা.) সত্যবাদী;তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না। এ সত্বেও তারা চরম শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তাঁর রক্ত ঝরানোর জন্য এতসব চেষ্টা করেছে।

মহানবী পর্বতের মতো দৃঢ়তা ও অবিচলতা সহকারে নিজের ও ইসলামের প্রতিরক্ষা বিধান করেন। যদিও মৃত্যুর সাথে তাঁর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না এবং তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে শত্রুবাহিনী ঢেউয়ের মতো তাঁর ওপর হামলে পড়ছে,এ সত্বেও তাঁর এমন কোন কথা ও আচরণ পরিলক্ষিত হয় নি যার মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের সামান্যতম আভাস থাকতে পারে। কেবল কপালের রক্ত পরিষ্কার করার সময় এটুক কথা তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়েছিল, যে জনগোষ্ঠী নিজেদের নবীর মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত করেছে,এমন অবস্থায় যে,তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছিলেন,তারা কিভাবে সফলকাম হবে? 43

এ উক্তি মানুষের প্রতি,এমনকি নিজের শত্রুদের প্রতি তাঁর অতিশয় দয়া ও সহৃদয়তার প্রমাণ বহন করে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন : মহানবী (সা.) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যুদ্ধ ঘোরতর রূপ নিলেই তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কাজেই মহানবী যে নিরাপদ ছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল,তাঁর সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক সংগ্রাম,যা তিনি নিজের ও ইসলামের চৌহদ্দির প্রতিরক্ষার জন্য করেছিলেন।

অবশ্য নবীর জীবন রক্ষার পেছনে অন্য কারণও সক্রিয় ছিল। আর তা ছিল স্বল্পসংখ্যক জান কুরবান সাহাবীর আত্মত্যাগ,যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে তাঁকে রক্ষা করার এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকাকে নির্বাপিত হবার হাত থেকে সমুজ্জ্বল রাখার ব্যবস্থা করেন। উহুদ যুদ্ধের দিন মহানবী প্রচণ্ড যুদ্ধ করেন। তাঁর তূণে যত তীর ছিল সবই তিনি নিক্ষেপ করেন। তাঁর ধনুক ভেঙে গিয়েছিল এবং ধনুকের রশি ছিঁড়ে গিয়েছিল।44

মহানবীর প্রতিরক্ষায় যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন,তাঁরা মাত্র কয়েকজন ছিলেন45 যাঁদের সবার অবিচলতার বিষয়টি ঐতিহাসিক বিচারে নিশ্চিত নয়। ঐতিহাসিকদের মাঝে যে সত্যটি নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত,তা হচ্ছে,স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্বের দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা,যাঁদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষামূলক্ষ প্রচেষ্টার বিবরণ আমরা এখন পেশ করব।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53