চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79197
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79197 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

বাইয়াতে রিদওয়ান

মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত প্রতিনিধির ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হলো এবং তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। হঠাৎ হযরত উসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এবং তাঁরা প্রতিশোধের জন্য গর্জে উঠলেন। মহানবী (সা.) তাদের এই পবিত্র ও উজ্জীবিত চেতনাকে ধারণ ও দৃঢ় করার জন্য তাঁদের উদ্দেশে বললেন: চূড়ান্ত কিছু না করা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না।” যেহেতু সে মুহূর্তে মুসলমানরা সমূহ বিপদের আশংকা করছিলেন এবং এজন্য তাঁরা যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন,সেহেতু মহানবী (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন মুসলমানদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুত শপথ নবায়ন করবেন। তাই নতুনভাবে তাঁদেরকে তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করার লক্ষ্যে একটি গাছের নিচে বসলেন এবং সকল সঙ্গীকে বাইয়াত (প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার জন্য শপথ) নেয়ার জন্য তাঁর হাতে হাত রাখতে আহবান জানালেন। তাঁরা রাসূলের হাতে হাত রেখে শপথ করলেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ইসলামের প্রতিরক্ষায় নিবেদিত থাকবেন। এটিই সেই ঐতিহাসিক বাইয়াতে রিদওয়ান’ ,যা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে :

) لقد رضى الله عن المؤمنين إذ يُبايعونك تحت الشّجرة فعلم ما فِى قلوبِهم فأنزل السّكينة عليهم و أثابَهم فتحا قريبا(

“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন,যখন তারা বৃক্ষের নিচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ্ অবগত ছিলেন,যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।” (সূরা ফাত্হ : 18)

বাইয়াত সম্পন্ন হওয়ার পর মুসলমানরা তাঁদের করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন। হয় কুরাইশরা তাঁদের আল্লাহর ঘরে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেবে,নতুবা তাঁরা মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করবেন। মহানবী (সা.) হযরত উসমানের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ হযরত উসমান ফিরে এলেন। এটি সন্ধির সবুজ সংকেত দিল। তিনি কুরাইশদের অবস্থান সম্পর্কে রাসূল (সা.)-কে বললেন : কুরাইশদের সমস্যা হলো তারা আল্লাহর নামে শপথ করেছে। তাই এ সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের প্রতিনিধি আপনার নিকট আসবে।”

রাসূল (সা.)-এর সাথে কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর-এর সাক্ষাৎ

কুরাইশদের পঞ্চম প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে সুহাইল ইবনে আমর রাসূলের নিকট এল যাতে বিশেষ এক চুক্তির মাধ্যমে এ অচলাবস্থার অবসান হয়। সুহাইলকে দেখামাত্রই রাসূল (সা.) বললেন : সুহাইল কুরাইশদের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে সন্ধিচুক্তি করতে এসেছে।” সুহাইল এসে মহানবীর সামনে বসল। সে যে বিষয়েই কথা বলছিল,তার মাধ্যমে একজন ঝানু কূটনীতিকের ন্যায় মহানবীর ভাবাবেগকে উদ্বেলিত করার চেষ্টা করছিল। সে বলল : হে আবুল কাসেম! মক্কা আমাদের হারাম (পবিত্র স্থান) এবং আমাদের জন্য সম্মানের বস্তু। আরবের সকল গোত্র জানে,তুমি আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছ। তুমি যদি এ অবস্থায় জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ কর,তবে সকল আরব গোত্রই জানবে,আমরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে পড়েছি। তখন সকল আরব সম্প্রদায় আমাদের এ ভূমি দখল করার জন্য প্ররোচিত হবে। তোমার সঙ্গে আমাদের যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে,তার কসম দিয়ে বলছি,তোমার এ জন্মভূমি মক্কার যে মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে...

সুহাইল এটুকু বলতেই মহানবী (সা.) তার কথায় ছেদ ঘটিয়ে বললেন : তুমি কী বলতে চাও? সে বলল : কুরাইশ নেতাদের প্রস্তাব হলো : তুমি এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করে এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাও এবং পরের বছর উমরা করার জন্য এসো। মুসলমানরা আগামী বছর আরবের অন্যান্য গোত্রের ন্যায় হজ্ব করার জন্য কাবা ঘরে আসতে পারবে। তাদের হজ্বের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের শর্ত হলো তারা তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না এবং সঙ্গে একটি তরবারি ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবে না।”

মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সুহাইলের আলোচনার ফলে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে একটি ব্যাপক ও সার্বিক চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। কিন্তু চুক্তির শর্ত নির্ধারণ ও ধারা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সে বেশ কঠোরতা অবলম্বন করছিল। কখনো কখনো তার প্রস্তাব এতটা অগ্রহণীয় ছিল যে,তা সন্ধির সম্ভাবনাই নাকচ করছিল। কিন্তু উভয় পক্ষই সন্ধির পক্ষে থাকায় তা যাতে ছিন্ন না হয়,সে চেষ্টাও ছিল।

অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনামতে মহানবী (সা.) হযরত আলীকে চুক্তিপত্র লেখার নির্দেশ দেন। প্রথমে তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে বলেন : লিখ : বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম এবং আলী তা লিখলেন। কিন্তু সুহাইল বলল : আমি এ বাক্যের সাথে পরিচিত নই। রাহমান’ ও রাহীম’ -কে আমি চিনি না;লিখ : বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! তোমার নামে’ ।”

মহানবী (সা.) সুহাইলের কথা মেনে নিয়ে অনুরূপ লিখতে বললেন। অতঃপর মহানবী বললেন : লিখ : এ সন্ধিচুক্তি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ এবং কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইলের মধ্যে সম্পাদিত হচ্ছে।” সুহাইল বলল : আমরা তোমার রাসূল ও নবী হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করি না। যদি তা স্বীকারই করতাম,তবে তোমার সাথে যুদ্ধ করতাম না। অবশ্যই এ বিশেষণ চুক্তিপত্র থেকে মুছে দিয়ে নিজের নাম ও পিতার নাম লেখ।” রাসূল এ বিষয়টিও মেনে নেবেন ও তাকে ছাড় দেবেন,এ সময় কোন কোন মুসলমান তা চান নি। কিন্তু মহানবী একটি উচ্চতর লক্ষ্য সামনে রেখে-যা আমরা পরে উল্লেখ করব-সুহাইলের দাবী মেনে নিয়ে হযরত আলীকে আল্লাহর রাসূল শব্দটি মুছে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। হযরত আলী অত্যন্ত সম্মান ও বিনয়ের সাথে বললেন : হে আল্লাহর নবী! আপনার পবিত্র নামের পাশে নবুওয়াতের স্বীকৃতিকে মুছে ফেলার মতো অসম্মানের কাজ থেকে আমাকে ক্ষমা করুন।” মহানবী হযরত আলীকে বললেন : ঐ শব্দের ওপর আমার আঙ্গুল রাখ। আমি নিজেই তা মুছে দিই।” আলী তা-ই করলেন এবং রাসূল স্বহস্তে তা মুছে দিলেন।184

মহানবী (সা.) এ সন্ধিচুক্তি লিখতে যে ব্যাপক ছাড় দেন,বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। কারণ তিনি প্রবৃত্তির তাড়না ও বৈষয়িক চিন্তার অনুবর্তী ছিলেন না এবং তিনি জানতেন,মহাসত্য কখনো লেখা বা মোছার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় না। তাই সন্ধির ভিত্তি অটল রাখতে সুহাইলের সকল কঠোর শর্ত সমঝোতামূলক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে মেনে নিয়েছেন।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

মহানবীর শিক্ষালয়ের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ছাত্র আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিবও অনুরূপ ইতিহাসের শিকার হন। এ দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর মানস-প্রতিবিম্বকেও জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই রাসূলের অনুরূপ পর্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হযরত আলী রাসূলের নাম মুছে ফেলতে অপারগতা প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলে তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর ক্ষেত্রেও যে অনুরূপ ঘটনা ঘটবে,তার ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন : হে আলী! এদের উত্তরসূরিরাও তোমাকে এরূপ করতে বলবে এবং তুমি তাদের দ্বারা মযলুম হয়ে তা করতে বাধ্য হবে। 185 এ স্মৃতি আলী (আ.)-এর মনে সিফ্ফীনের যুদ্ধের পর জাগ্রত হলো যখন আলী (আ.)-এর সরল ও অদূরদর্শী সৈন্যরা ধোঁকায় পড়ে প্রতারিত হয়ে আলীকে সন্ধি করতে বাধ্য করল। যখন আলীর পক্ষে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে সন্ধিপত্রে লিখলেন,هذا ما تقاضى عليه أمير المؤمنين على আমিরুল মুমিনীন আলী যে বিষয়ে আহবান জানাচ্ছেন’ ,তখন মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে নিয়োজিত প্রতিনিধি আমর ইবনে আস ও সিরীয় সৈন্যরা আপত্তি জানিয়ে বলল : আলী ও আলীর পিতার নাম লিখ। কারণ আমরা যদি তাকে মুমিনদের নেতা মনে করতাম,তবে তার সঙ্গে কখনো যুদ্ধে লিপ্ত হতাম না।”

এ ক্ষেত্রে বাক-বিতণ্ডা চলতে লাগল। হযরত আলী (আ.) চাচ্ছিলেন না এর মাধ্যমে নিজের অদূরদর্শী সৈনিকরা নতুন বাহানা শুরু করুক। উভয় পক্ষ দীর্ঘক্ষণ বিতর্ক করছিল। অবশেষে তাঁর একজন সেনাপতির উপর্যুপরি অনুরোধে আমিরুল মুমিনীন’ শব্দটি মুছে ফেলার অনুমতি দিলেন। অতঃপর বললেন :الله أكبر سنّة بسنّة আল্লাহ্ মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ। একই ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।” অতঃপর বললেন : এটি রাসূল (সা.)-এর অনুসৃত রীতি এবং তাঁরই উদ্ধৃতি।” এরপর হুদায়বিয়ার স্মৃতিচারণ করলেন।186

হুদায়বিয়ার সন্ধি-শর্ত

এখন আমরা মহানবী (সা.) ও কুরাইশদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বিভিন্ন শর্ত উল্লেখ করব :

1. কুরাইশ ও মুসলমানরা সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডে সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে যে,দশ বছর একে অপরের সাথে যুদ্ধ করবে না ও পরস্পরের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ হতে বিরত থাকবে।

2. যদি কুরাইশদের কেউ তাদের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া মক্কা থেকে পলায়ন করে ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়,মুহাম্মদ অবশ্যই তাকে কুরাইশদের নিকট ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু যদি কোন মুসলমান মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে আসে,কুরাইশরা তাকে মুসলমানদের নিকট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নয়।

3. মুসলমান ও কুরাইশরা স্বাধীনভাবে যে কোন গোত্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন।

4. মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীগণ এ বছর এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোয় স্বাধীনভাবে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা উমরা পালন করতে পারবেন। তবে শর্ত হলো এই যে,তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবেন না ও সঙ্গে সাধারণত একজন মুসাফির যাত্রী যে ধরনের তরবারি বহন করে,তা ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবেন না।187

5. মক্কার মুসলমানরা এ চুক্তির অধীনে মক্কায় স্বাধীনভাবে ইসলামী বিধান পালন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে কুরাইশরা তাদের বাধা দিতে পারবে না। তাঁদের ধর্মান্তরিত করা ও মুসলমান হওয়ার কারণে তিরস্কার করতে পারবে না।188

6. চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষদ্বয় একে অপরের ধন-সম্পদ সম্মানিত মনে করবেন এবং বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিতে পরস্পরকে দেখতে ও প্রতারণা করতে পারবেন না।189

7. যে সকল মুসলমান মদীনা থেকে মক্কায় আসবেন,তাঁদের জীবন ও ধন-সম্পদের প্রতি সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হবে।190

হুদায়বিয়ার এ শর্তগুলো আমরা বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছি যার সূচী আমরা নিম্নে প্রদান করছি। চুক্তিপত্র দু টি ভিন্ন পত্রে লিখিত হয়। অতঃপর কয়েকজন কুরাইশ ও মুসলিম প্রতিনিধি সাক্ষী হিসেবে তাতে স্বাক্ষর করেন। পরে তার একটি অনুলিপি মহানবী (সা.)-কে এবং অন্যটি সুহাইলকে দেয়া হয়।

স্বাধীনতার বাণী

এ চুক্তিপত্রের পর্বে পর্বে স্বাধীনতা ও মুক্তির বাণী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,যার অনুরণন প্রতিটি নিরপেক্ষ বিবেকবান ব্যক্তির কানেই পশবে। কিন্তু সবচেয়ে স্পর্শকাতর হলো দ্বিতীয় শর্ত যা অনেককেই ক্রোধান্বিত করেছিল। রাসূল (সা.)-এর কোন কোন সঙ্গী এ বৈষম্যমূলক শর্তে চরম অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এমন কিছু কথা বলেছিলেন,যা ইসলামের নবী ও মহান নেতার প্রতি দৃষ্টিকটু ও সমালোচনামূলক। অথচ চুক্তিপত্রের এ ধারাটি উজ্জ্বল এক শিখার ন্যায় আজো প্রজ্বলিত রয়েছে। এতে ইসলামের প্রসার ও বিস্তারের পদ্ধতিতে মহানবী (সা.)-এর উন্নত চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির মৌলনীতির প্রতি ইসলামের মহান নেতার অনির্বচনীয় সম্মানের প্রকাশ পেয়েছে।

কোন কোন সাহাবীর এ আপত্তির ( কেন আমরা মুসলমানদের ফিরিয়ে দেব,অথচ তারা আমাদের থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য নয়’ ) জবাবে বলেন : যে মুসলমান ইসলামের পতাকার নিচ থেকে শিরকের দিকে পালিয়ে যায় এবং তাওহীদবাদী ইসলামের পবিত্র পরিবেশের ওপর মানবতার পরিপন্থী শিরকমিশ্রিত পরিবেশকে অগ্রাধিকার দেয়,সুস্পষ্ট যে,তার ঈমান সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং সে মন থেকে ইসলামকে গ্রহণ করে নি। এরূপ কোন মুসলমান আমাদের কোন কল্যাণে আসবে না। অন্যদিকে আমরা যদি আমাদের নিকট আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিকে কাফেরদের নিকট ফিরিয়ে দিই,তা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ্ তার মুক্তির পথ করে দেবেন। 191

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিসম্মত ছিল। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর গৃহীত ভূমিকার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। কারণ সময় না গড়াতেই কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধারাটির মন্দ প্রভাব কুরাইশদের ওপর পড়ল। ফলে তারা নিজেরাই এ ধারা বাতিলের আহবান জানালো। আমরা পরবর্তীতে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

হুদায়বিয়ার সন্ধির এই ধারা কোন কোন উদ্দেশ্যপ্রবণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রাচ্যবিদের জন্য দাঁতভাঙ্গা জবাব। কারণ তাঁরা ইসলামের বিস্তার ও অগ্রযাত্রার মূল কারণ অস্ত্র’ বলে মনে করেন এবং বলে থাকেন,ইসলাম অস্ত্রের মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। ইসলাম তার বিষয়বস্তুর গভীরতা ও আকর্ষণ ক্ষমতার কারণে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার যে গৌরব লাভ করেছিল,তা সহ্য করতে না পেরে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অন্যদের দ্বিধান্বিত করতে ইসলামের অগ্রযাত্রার কারণ মুসলমানদের পেশীশক্তি বলে উল্লেখ করে থাকেন। অথচ যে সন্ধিচুক্তিটি ইসলামের মহান নেতা আরব উপদ্বীপের শত-সহস্র (রূপক অর্থে) ব্যক্তির সামনে স্বাক্ষর করেছিলেন,তাতে ইসলামের মহান শিক্ষা ও আকর্ষণীয় রূপ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তদুপরি যদি কেউ বলে,ইসলাম মুসলমানদের তরবারির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে,তবে সে বাস্তবদর্শী ও সত্যনিষ্ঠ নয়।

খাযাআ গোত্র হুদায়বিয়া সন্ধির তৃতীয় ধারার অধীনে মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলো। তাদের চিরশত্রু বনী কিনানাহ্ কুরাইশদের সাথে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করলো।

সন্ধিচুক্তি বলবৎ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা

সন্ধির পটভূমি ও এর শর্তসমূহ হতে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়,অনেক ক্ষেত্রেই উল্লিখিত শর্ত চাপিয়ে দেয়ার শামিল ছিল ও তা অনেকটা আরোপিত বলে গণ্য। মহানবী (সা.) যে চুক্তিপত্র থেকে আল্লাহর রাসূল’ বিশেষণ বাদ দিয়েছিলেন এবং জাহিলী যুগের ন্যায় পত্রের প্রথমে বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখতে রাজী হয়েছিলেন-এ সবই আরব ভূ-খণ্ডে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে করেছেন। তিনি কুরাইশ কোন মুসলমান মদীনায় আশ্রয় নিলে তাকে মুশরিকদের কাছে ফেরত দেয়ার শর্তটিও সুহাইলের একগুঁয়ে মনোভাবের ফলে মেনে নেন। যদি তিনি মদীনায় আশ্রয়প্রার্থী কুরাইশ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার চিন্তা করতেন এবং সন্ধির বৈষম্যমূলক শর্তটি না মানার জন্য তাঁর সঙ্গীদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে সুহাইলের প্রস্তাব না মানতেন,তবে সংলাপের পথ বন্ধ হয়ে যেত এবং সন্ধিচুক্তিও সম্পাদিত হতো না। ফলে আল্লাহর এক বড় নিয়ামতস্বরূপ এ সন্ধির চোখ ধাঁধানো সাফল্য হতে মুসলমানরা বঞ্চিত হতো। মহান এক লক্ষ্যের চিন্তা করে মহানবী (সা.) সব ধরনের চাপ সহ্য করেছেন। কারণ ঐ মহান লক্ষ্যের তুলনায় এ প্রতিকূলতা কিছুই নয়। যদি রাসূল মুসলমানদের ঐ অংশের স্বার্থ রক্ষার চিন্তা করতেন ও সাধারণ মুসলমানদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করতেন,তবে সুহাইল তার একগুঁয়ে চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে যুদ্ধ বাঁধানোর পরিবেশ সৃষ্টি করত। নিম্নোক্ত ঘটনাটি এর সপক্ষে একটি সুস্পষ্ট দলিল :

সন্ধির শর্তসমূহ সম্পর্কে আলোচনা শেষে উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে হযরত আলী (আ.) চুক্তিপত্র লিখছিলেন,এমন সময় সুহাইলের পুত্র আবু জান্দাল শিকলবদ্ধ অবস্থায় সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। সবাই তাঁর আগমনে হতভম্ব হলেন। কারণ তিনি তাঁর পিতার কারাগারে শিকলবদ্ধ অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিলেন,তা কারো জানা ছিল না। তিনি একজন নিরপরাধ বন্দী ছিলেন-যাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি তাওহীদবাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নিয়েছিলেন ও মহানবী (সা.)-এর অন্যতম ভক্তে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি কোনভাবে খবর পেয়েছিলেন যে,মুসলমানরা হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছে। তাই কৌশলে কারাগার থেকে পালিয়ে ভিন্নপথে বন্ধুর পথ পেরিয়ে মুসলমানদের নিকট পৌঁছান।

সুহাইল তার পুত্রকে দেখামাত্র এতটা ক্রোধান্বিত হলো যে,তাঁর মুখে জোরে চপেটাঘাত করল। অতঃপর রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে বলল : সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী এরূপ প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একে মক্কায় ফিরিয়ে দাও অর্থাৎ আমাদের থেকে পলাতক ব্যক্তিকে আমাদের হাতে সোপর্দ কর। নিঃসন্দেহে সুহাইলের দাবী সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক ছিল। কারণ তখনও চুক্তি কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ হয় নি এবং উভয় পক্ষ তাতে স্বাক্ষরও করেন নি। যে চুক্তিনামা তখনও চূড়ান্ত হয় নি,কিভাবে তা এক পক্ষের দাবীর সপক্ষে দলিল হতে পারে? এ কারণে মহানবী (সা.) বললেন : এখনও চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয় নি।” সুহাইল বলল : সেক্ষেত্রে আমি পুরো চুক্তিটিই অস্বীকার ও বাতিল ঘোষণা করব।” সুহাইল এতটা বাড়াবাড়ি করছিল যে,কুরাইশদের অন্য দুই প্রতিনিধি মুকরেজ ও হুয়াইতাব ক্রোধান্বিত হয়ে দ্রুত উঠে আবু জান্দালকে তার পিতার হাত থেকে নিয়ে রাসূল (সা.)-এর হাতে দিয়ে বলল : আবু জান্দাল তোমার আশ্রয়ে থাকুক।” তারা এভাবে বিতর্কের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সুহাইল তার একগুঁয়েমী অব্যাহত রেখে বলল : চুক্তির সংলাপ শেষ হয়ে গেছে।” অবশেষে মহানবী (সা.) বাধ্য হয়ে ইসলামের প্রসারের জন্য সুবর্ণ সুযোগদানকারী এ সন্ধিচুক্তিটি রক্ষার শেষ প্রচেষ্টা হাতে নিলেন। তিনি আবু জান্দালকে তাঁর পিতার হাতে সমর্পণের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নির্যাতিত বন্দীকে সান্ত্বনা দানের জন্য বললেন : আবু জান্দাল! তুমি ধৈর্য অবলম্বন কর। আমরা চেয়েছিলাম তোমার পিতা স্নেহ-ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে তোমাকে আমাদের নিকট সমর্পণ করবে। কিন্তু সে তা করল না। তুমি সহনশীল হও এবং জেনে রাখ! আল্লাহ্ তুমি ও তোমার মত অন্যান্য নির্যাতিতের মুক্তির পথ বের করে দেবেন।”

বৈঠকের সমাপ্তি ঘটল এবং উভয় পক্ষ চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করল। সুহাইল ও তার সঙ্গীরা মক্কার পথ ধরল। আবু জান্দাল মুকরেজ ও হুয়াইতাবের নিরাপত্তায় মক্কায় ফিরে গেল। মহানবী (সা.) ইহরাম অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে সেখানে নিজ উট কুরবানী করলেন এবং মাথার চুল কামিয়ে ফেললেন। অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করলেন।192