চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84006 / ডাউনলোড: 7990
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

হুদায়বিয়ার সন্ধি : পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

মহানবী (সা.) ও মুশরিক নেতাদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হলো। সর্বমোট ঊনিশ দিন হুদায়বিয়ায় অবস্থানের পর মুসলমানরা মদীনার পথে রওয়ানা হলেন এবং মুশরিকরা মক্কার পথে হুদায়বিয়া ত্যাগ করল। চুক্তিপত্র লেখার সময় এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরবর্তীতে রাসূল (সা.) ও তাঁর কোন কোন সাহাবীর মধ্যে মতপার্থক্য ও বিতর্ক হয়েছিল। তাঁদের একদল এই সন্ধিচুক্তি মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল বললেন এবং কিয়দংশ একে মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রায় চৌদ্দ শ’ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা বর্তমান সময়ে বসে দূর হতে গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থেকে নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার দৃষ্টিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি পর্যালোচনার করব এবং বিতর্কের উভয় পক্ষের মত যাচাই করে দেখব। আমাদের দৃষ্টিতে নিম্নোক্ত যুক্তিতে এ সন্ধি ইসলামের পক্ষে এক শ’ ভাগ গিয়েছিল এবং তার বিজয় নিশ্চিত করেছিল :

১. কুরাইশদের অনবরত আক্রমণ এবং মদীনার ভেতর ও বাইরে থেকে তাদের পরিচালিত উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা উহুদ ও আহযাবের যুদ্ধের আলোচনায় দিয়েছি। এই অবিরত চাপের ফলে মহানবী (সা.) আরব ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী গোত্রগুলো ও তার বাইরের বিভিন্ন জাতির প্রতি ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ও তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান নি। তাঁর মূল্যবান সময়কে (অধিকাংশ সময়ই) ইসলামের প্রতিরক্ষা ও শত্রুদের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রগুলো নস্যাৎ করতে ব্যয় করতে হতো। কিন্তু এ সন্ধিচুক্তির ফলে ইসলামের মহান নেতা ও তাঁর অনুসারীরা মদীনার দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ থেকে নিরাপদ হলেন। ফলে অন্যান্য দিকে ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলো। এ প্রশান্তিকর পরিবেশের ফল দু বছর পর পাওয়া গেল যখন মক্কায় ইসলামের সূর্য উদ্ভাসিত হলো। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়ায় যাওয়ার সময় চৌদ্দ শ’ সঙ্গী নিয়ে যাত্রা করেছিলেন,কিন্তু এর ঠিক দু বছর পর মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করাকালে দশ হাজার মুসলমান ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়ে তাঁর সঙ্গে যাত্রা করেন। এই লক্ষণীয় পার্থক্য হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রত্যক্ষ ফল। কারণ একদল লোক কুরাইশদের ভয়ে মুসলমান হতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু কুরাইশরা ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার ফলে বিভিন্ন গোত্র ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেল;তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব দূর হলো। মুসলমানরাও মুক্তভাবে ইসলামের প্রচারে রত হলেন।

২. দ্বিতীয় যে সুফলটি মুসলমানরা এ চুক্তির মাধ্যমে পেয়েছিল,তা হলো ইসলাম ও আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে মুশরিকরা যে লৌহপ্রাচীর নির্মাণ করেছিল,এর ফলে তা বিলুপ্ত হয়েছিল। ফলে মদীনায় অবাধ যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলমানদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্র ইসলামের মহান ও কল্যাণময় শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারল।

মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান ঈমান,মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালনের মনোবৃত্তি,শৃঙ্খলা,নিষ্ঠা প্রভৃতি দিক মুশরিকদের বিবেক-বুদ্ধিকে আকৃষ্ট করত। নামাযের পূর্বে ওযূ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,নামাযের জামাআতে সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল দাঁড়ানো,মহানবীর উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আকর্ষণীয় ভাষণ,সর্বোচ্চ সহিত্যমানের ইলাহী বাণী শ্রবণ তাদের ইসলামের দিকে আকর্ষণ করত। অন্য দিকে এ সন্ধিচুক্তির পর মুসলমানরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মক্কা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সফর করতেন। এ সফরগুলোতে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং ইসলামের বিভিন্ন দিক,বিধি-বিধান,হালাল-হারাম,নৈতিকতার বিষয়সমূহ তাদের সামনে তুলে ধরতেন। এ প্রচারের ফলে অনেক মুশরিক নেতা,যেমন খালিদ ইবনে ওয়ালীদ,আমর ইবনুল আস প্রমুখ মুসলমান হন। ইসলামের মহাসত্যের সাথে মুশরিকদের পরিচয় মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে। আর তাই শিরকের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র কোনরূপ রক্তক্ষয় ও প্রতিরোধ ছাড়াই মুসলমানদের পদানত হয়। ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।১৯৩ এ মহাবিজয় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ,ভীতি দূরীভূত হওয়া,প্রচারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ এবং মুসলমানদের প্রচারকাজের ফলে অর্জিত হয়।

৩. মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সন্ধিচুক্তির আলোচনার সময় থেকেই কুরাইশদের মানসিক জটিলতার প্যাঁচ খুলতে শুরু করে। কারণ,মহানবীর উন্নত নৈতিক চরিত্র,কোমল আচরণ,প্রতিপক্ষের কঠোরতার বিপরীতে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দান,শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রভৃতি তাঁর মহামানবীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দান করে এবং সকল উন্নত নৈতিক বৈশিষ্ট্যের তিনি যে ধারক,এতে তা-ই প্রমাণিত হয়।

কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অনেক কঠিন আঘাত এলেও তাদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল মানবপ্রেমে পূর্ণ। বিশেষত যখন কুরাইশরা প্রত্যক্ষ করল চুক্তির চাপিয়ে দেয়া শর্তগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গীদের উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ আসা সত্বেও তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কা ও হারাম শরীফের পবিত্রতার বিষয়কে একদল সঙ্গীর প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাধান্য দিলেন,তখন তারা তাঁর উদ্দেশ্যের সততায় বিশ্বাস স্থাপন করল। এরূপ আচরণ মহানবীর স্বভাব ও মানসিকতা সম্পর্কে যে অপপ্রচার ছিল,তা মিথ্যা প্রমাণ করল। সে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে,তিনি মানবপ্রেমী ও শান্তিকামী ব্যক্তিত্ব-যিনি এতটা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী যে,কোন দিন সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডের শাসনক্ষমতাও হস্তগত করলেও নিজ শক্রদের সাথে বিদ্বেষমূলক আচরণ করবেন না;বরং তাদের প্রতিও সহানুভূতিশীল আচরণ করবেন। কারণ এ বিষয়টি আলোচনার অবকাশ রাখে না যে,মহানবী (সা.) যদি সেদিনও (বাইয়াতে রিদওয়ানের শপথের পরিপ্রেক্ষিতে) কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন,তাদের সবার ওপর জয়ী হতেন। যেমনটি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :

) و لو قاتلكم الّذين كفروا لولّوا الأدبار ثمّ لا يجدون وليّا و لا نصيرا(

“কাফেররা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করলে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন (পলায়ন) করত। অতঃপর তারা কোন বন্ধু ও সাহায্যকারীও পেত না।” (সূরা ফাত্হ : ২২)

এ সত্বেও তিনি এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোমলতার পরিচয় দিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছেন এবং আরব গোত্রগুলোর প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

উপরিউক্ত যুক্তিসমূহ হতে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হতে উদ্ধৃত নিম্নোক্ত বাণীর যথার্থতা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেন :و ما كان قضية أعظم بركة منها মহানবীর জীবনে হুদায়বিয়ার সন্ধি অপেক্ষা কল্যাণকর কোন ঘটনাই ঘটে নি।”

হুদায়বিয়ার সন্ধির পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহসমূহ প্রমাণ করে,মহানবীর গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীতে যে সাহাবীরা অবস্থান নিয়েছিলেন-যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন হযরত উমর,-তাঁদের যুক্তিগুলো সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন ছিল। ঐতিহাসিকরা প্রতিবাদকারীদের বক্তব্য ও মন্তব্যগুলো খুঁটিনাটিসহ উল্লেখ করেছেন।১৯৪

হুদায়বিয়ার সন্ধির মূল্য এখান থেকেই বোঝা যায় যে,মহানবী (সা.) তখনও মদীনায় গিয়ে পৌঁছেন নি,সূরা ফাত্হ মুসলমানদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে অবতীর্ণ হলো। এরশাদ হলো :

) إنّا فتحنا لك فتحا مبينا(

“নিশ্চয়ই আমি আপনাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি” । (সূরা ফাত্হ : ১)

এ আয়াতকে মক্কা বিজয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।

কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করার জন্য উপর্যুপরি আহবান জানাতে থাকে। কিছুদিন না যেতেই কুরাইশরা এমন এক তিক্ত ঘটনার মুখোমুখি হলো যে,বাধ্য হয়ে মহানবীর নিকট সন্ধির দ্বিতীয় ধারাটি বাতিলের আহবান জানাল। যে ধারাটি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবীদের ক্ষুব্ধ করেছিল,কিন্তু তিনি সুহাইলের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে তা মেনে নেন,তাতে বলা হয়েছিল,রাসূল কুরাইশদের থেকে পলায়নকারী মুসলমানদের তাদের নিকট ফিরিয়ে দেবেন;কিন্তু কোন মুসলমান পালিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিলে কুরাইশরা তাদের ফিরিয়ে দেবে না। মহানবী (সা.) এ ধারা মেনে নেয়ার সময় বলেছিলেন,মহান আল্লাহ্ কুরাইশদের হাতে বন্দী দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তির পথ করে দেবেন।

‘আবু বাসির’ নামের এক মুসলমান দীর্ঘ দিন মুশরিকদের হাতে বন্দী ছিলেন। তিনি একবার সুযোগ বুঝে কৌশলে মক্কা থেকে পালিয়ে গিয়ে মদীনায় পৌঁছলেন। কুরাইশদের দু জন বিশিষ্ট ব্যক্তি আযহার এবং আখনাস মহানবীকে সন্ধির দ্বিতীয় ধারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবু বাসিরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পত্র লিখে পাঠাল। বনী আমের গোত্রের এক ব্যক্তিসহ স্বীয় এক দাসকে এ পত্র দিয়ে মদীনায় রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বলল।

মহানবী (সা.) সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী আবু বাসিরকে বললেন : অবশ্যই তোমাকে নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যেতে হবে। আমি কখনোই তাদের সাথে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করব না। আমি নিশ্চিত,মহান আল্লাহ্ তোমার ও অন্যদের মুক্তির পথ করে দেবেন।” আবু বাসির বললেন: হে নবী! আপনি কি আমাকে মুশরিকদের হাতে অর্পণ করতে চান যাতে তারা আমাকে আমার ধর্ম হতে ফিরিয়ে নিতে পারে?”   মহানবী (সা.) তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে কুরাইশ প্রতিনিধিদের হাতে তাঁকে অর্পণ করলেন। তারা মক্কার দিকে যাত্রা করে যখন যুল হুলাইফা ১৯৫ নামক স্থানে পৌঁছল,তখন আবু বাসির ক্লান্ত হয়ে একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। অতঃপর বনী আমেরের ঐ ব্যক্তিকে নিজের কাছে ডেকে গল্প জমালেন। এক ফাঁকে তার তরবারিটি দেখার নাম করে হাতে নিয়ে তা খাপ থেকে বের করলেন এবং আকস্মিকভাবে ঐ ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এ ঘটনা দেখে দাসটি ভয়ে পলায়ন করল।

দাসটি মদীনায় পৌছে মহানবীকে ঘটনা খুলে বলল। কিছুক্ষণ পর আবু বাসিরও সেখানে এসে মহানবীকে বললেন : হে আল্লাহর নবী! আপনি আপনার শর্ত অনুযায়ী কাজ করেছেন। কিন্তু আমি কখনোই আমার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কাফেরদের ছিনিমিনি খেলার সুযোগ দেব না” । এই বলে তিনি লোহিত সাগরের তীরে কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার চলার পথের ঈস’ নামক একটি স্থানের দিকে যাত্রা করলেন এবং সেখানে একাকী বসবাস শুরু করলেন। মক্কার মুসলমানগণ আবু বাসিরের ঘটনা জানতে পারলেন এবং তাঁর অবস্থান সম্পর্কেও অবহিত হলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে সত্তর জন মক্কা থেকে পালিয়ে আবু বাসিরের প্রতিবেশী হলেন। এই সত্তর জন সক্ষম যুবক কুরাইশদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন-তাঁদের কোন স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছিল না;ঈস-এ পৌঁছেও তাঁদের কোন জীবিকার উপায় ছিল না। তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ চালাবেন এবং তাদের যাকেই পাবেন,হত্যা করবেন। তাঁরা দক্ষতার সাথে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলোর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকলেন এবং তাঁদের অনবরত হামলার ফলে কুরাইশরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ফলে তারা বাধ্য হয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট এ মর্মে পত্র দিল যে,হুদায়বিয়ার সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অকার্যকর ঘোষণা করা হোক এবং ঈস হতে মুসলমানদের মদীনায় নিয়ে যাওয়া হোক। মহানবী (সা.) উভয় পক্ষের সম্মতিতে তা অকার্যকর ঘোষণা করলেন এবং ঈস-এ সমবেত মুসলমানদের মদীনায় চলে আসতে নির্দেশ দিলেন।১৯৬

এ ঘটনার ফলে কুরাইশরা বুঝতে পারল ঈমানদার ব্যক্তিদের সব সময় বন্দী করে রাখা যায় না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের বন্দী করে রাখা স্বাধীনতা দান অপেক্ষা বিপজ্জনক। কারণ,একদিন তাদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠবে এবং তারা শত্রুদের নিকট থেকে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।

কুরাইশদের নিকট মুসলিম নারীদের ফিরিয়ে না দেয়া

হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উকবা ইবনে আবি মুঈতের কন্যা উম্মে কুলসুম মক্কা থেকে মদীনায় গেলেন। তাঁর দুই ভাই আম্মারাহ্ এবং ওয়ালীদ মহানবীর নিকট সন্ধির দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে দেয়ার আহবান জানান। মহানবী জানালেন,নারীরা এ ধারার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং ধারাটি কেবল পুরুষদের জন্যই প্রযোজ্য।১৯৭

সূরা মুমতাহিনার দশম আয়াত এক্ষেত্রে করণীয় বিষয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে :

) يا أيّها الّذين آمنوا إذا جائكم المؤمنات مهاجرات فامتحنوهنّ الله أعلم بإيمانهنّ فإن علمتموهنّ مؤمنات فلا ترجعوهنّ إلى الكفّار لا هنّ حلّ لهم و لا هم يحلّون لهنّ و آتوهم ما أنفقوا(

“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদের কাছে ঈমানদার নারীরা হিজরত করে আসে,তখন তাদেরকে পরীক্ষা কর। আল্লাহ্ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জান,তারা ঈমানদার,তবে আর তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ো না। এরা কাফেরদের জন্য হালাল নয় এবং কাফেররা এদের জন্য হালাল নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে,তা তাদের ফিরিয়ে দাও।”

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মহানবী (সা.) শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট পত্র দেয়ার এবং ইসলাম ও তাঁর নবুওয়াতের আহবানকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।

তেতাল্লিশতম অধ্যায় : সপ্তম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মহানবী (সা.) ও তাঁর বিশ্ব-রিসালতের ঘোষণা

হুদায়বিয়ার সন্ধি আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ ভাগ অর্থাৎ পবিত্র মক্কা নগরীর দিক থেকে মহানবীকে চিন্তামুক্ত করেছিল এবং এ সন্ধির কারণে শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার দরুন একদল আরব গোত্র পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এ সময় মহানবী এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তদানীন্তন বিশ্বের শাসকশ্রেণী,গোত্রপতি ও খ্রিষ্ট ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পত্র বিনিময়ের দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন এবং সেদিন তিনি যে ইসলাম ধর্মকে সরল আকীদা-বিশ্বাস ছাড়াও বৃহত্তর পরিসরে সমগ্র মানব জাতিকে তাওহীদ এবং এ ধর্মের সুমহান সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষামালার পতাকাতলে সমবেত ও একত্র করতে সক্ষম ছিলেন,তা তিনি তৎকালীন বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন।

এটা ছিল তাঁর উদ্ধত কুরাইশ গোত্রের সাথে দীর্ঘ ঊনিশ বছর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর প্রথম পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণ শত্রুরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘর্ষ বাঁধিয়ে তাঁকে ব্যস্ত না রাখলে তিনি এর বহু পূর্বেই বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিতেন। তবে আরবদের কাপুরুষোচিত আক্রমণ-আগ্রাসনগুলোর কারণে তিনি তাঁর সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) আমীর-অমাত্য,রাজা-বাদশাহ্,গোত্রপতি এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক (ধর্মীয়) ব্যক্তিত্বদের কাছে যেসব পত্র প্রদান করেছিলেন,সেসবই তাঁর দাওয়াহ্ বা প্রচার পদ্ধতির কথাই ব্যক্ত করে।১৯৮

বর্তমানে আমাদের হাতে ইসলাম ধর্মের তাবলীগ ও এ ধর্ম গ্রহণের প্রতি আহবান (দাওয়াত) বা চুক্তি ও প্রতিজ্ঞা হিসেবে মহানবী লিখিত পত্রসমূহের মধ্যে এক শ’ পঁচাশিখানা পত্র বিদ্যমান,যেসব মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ সংরক্ষণ করেছেন। এসব চিঠি-পত্র থেকে প্রতীয়মান হয়,ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলামের পদ্ধতি ছিল যুক্তি ও প্রামাণ্য দলিল নির্ভর,আর তা যুদ্ধ ও তরবারি ছিল না। মহানবী কুরাইশদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ হওয়ার পরপরই তিনি পত্র ও মুবাল্লিগগণকে (ধর্মপ্রচারকারী) প্রেরণ করার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য ও আহবান জগৎবাসীর কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

এসব পত্রের মূল পাঠ এবং এসবের পরতে পরতে যে সব ইশারা বিদ্যমান সেসব;বিদেশী জাতিসমূহের সাথে চুক্তি সম্পাদন করার সময় মহানবী যেসব উপদেশ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং নমনীয়তা প্রদর্শন করেছেন,সে সবকিছুই আসলে ঐসব প্রাচ্যবিদের তত্ত্ব পরিপন্থী,যারা অযৌক্তিক ও অবৈধ অপবাদ আরোপের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের প্রকৃত চেহারা ঢেকে ফেলতে এবং এ ধর্মের প্রসারকে তরবারি ও বর্শার ফল বলে গণ্য করতে চেয়েছেন। আমরা আশাবাদী,একদিন আমরা এসব চিঠি-পত্রের মূল পাঠ এবং যেসব ঘটনা এসবের ব্যাপারে সংঘটিত হয়েছে বা এগুলো লেখার কারণ হয়েছে,সেসব এমনভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারব যে,এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের পদ্ধতি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

মহানবী (সা.)-এর বিশ্বজনীন রিসালত

একদল অজ্ঞ লোক মহানবী (সা.)-এর বিশ্বজনীন রিসালতকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন এবং এ ব্যাপারে তারা কতিপয় দালাল লেখকের রচিত গীতই গেয়ে থাকেন। এ গোষ্ঠীর নেতা হচ্ছেন স্যার উইলিয়াম মুরের মতো প্রাচ্যবিদ,যিনি বলেছেন :

“হযরত মুহাম্মদের রিসালত বিশ্বজনীন হওয়ার১৯৯ বিষয়টি পরবর্তীকালে উত্থাপিত হয়েছে এবং মুহাম্মদ তাঁর নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কেবল আরব জাতিকেই ইসলাম ধর্মের দিকে আহবান জানাতেন। আর তিনি আরব উপদ্বীপ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের সাথে পরিচিতও ছিলেন না।”

এই লেখক (স্যার উইলিয়াম মুর) তাঁর ইংরেজ পূর্বসূরিদের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন এবং পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত যেসব সাক্ষ্য দেয়,মহানবী (সা.) সর্বসাধারণ বিশ্ববাসীকে তাওহীদ ও তাঁর নিজ রিসালতের প্রতি আহবান জানাতেন,সেসবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি বাস্তবতাসমূহ ঢেকে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। তাই তিনি বলেন : তিনি (মুহাম্মদ) কেবল আরব জাতিকে দাওয়াত দিতেন (ধর্মের আহবান জানাতেন)।” আমরা এখানে পবিত্র কুরআনের কয়েকখানা আয়াত উল্লেখ করব যেসব থেকে প্রমাণিত হয়,মহানবী (সা.)-এর রিসালত ছিল বিশ্বজনীন দাওয়াত বা প্রচার কার্যক্রম।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :

) قل يا أيّها النّاس إنّى رسول الله إليكم جميعا(

“বলুন,হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত (রাসূল)।” (সূরা আরাফ : ১৫৮)

এ আয়াতে যে পক্ষকে সম্বোধন করা হয়েছে,তারা শুধু আরব জাতিই নয়;বরং তারা হচ্ছে সমগ্র মানব জাতি।

) و ما أرسلناك إلّا كافّة للنّاس بشيرا و نذيرا(

“(হে মুহাম্মদ!) আমরা কেবল আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।” (সূরা সাবা : ২৮)

এ গ্রন্থকে (আল কুরআন) সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য স্মরণ করার মাধ্যম করা হয়েছে :

) و ما هو إلّا ذكر للعالمين(

“আর তা (কুরআন) জগৎসমূহের (সমগ্র বিশ্ববাসীর) জন্য উপদেশ বৈ কিছু নয়। (সূরা

কলম : ৫২)

) لينذر من كان حيّا(

“যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতকে।” (সূরা ইয়াসীন : ৭০)

) هو الّذى أرسل رسوله بالهدي و دين الحقّ ليظهره علي الدّين كلّه و لو كره المشركون(

“তিনিই স্বীয় রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্ম সহ প্রেরণ করেছেন অন্য সকল ধর্মের ওপর বিজয়ী করার জন্য,যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা তওবা : ৩৩)

এখন আমরা এই ইংরেজ লেখককে প্রশ্ন করব : এসব আয়াতে এসব বিশ্বজনীন আহবান থাকা সত্বেও আপনি কিভাবে বলছেন যে,মহানবী (সা.)-এর রিসালত ও নবুওয়াত বিশ্বজনীন হওয়ার বিষয়টি পরবর্তীকালে (অর্থাৎ তাঁর ওফাতের পরে) উত্থাপন করা হয়েছে? এসব আয়াত ও আরো অন্যান্য আয়াত থাকা সত্বেও এবং দূরদেশ ও অঞ্চলগুলোয় মহানবীর প্রেরিত দূতগণের উপস্থিতি ও মহানবীর যেসব পত্র ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়েছে,সেসব থাকা সত্বেও (এমনকি বিদেশী জাতিগুলোর কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য দূরবর্তী অঞ্চল ও দেশগুলোয় তিনি যেসব পত্র প্রেরণ করেছিলেন,সেসবের কয়েকখানা আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এবং সেগুলোর শোভা বর্ধন করছে) কি কোন বিবেকবান ব্যক্তির পক্ষে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালতের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা সম্ভব?

এই লেখক সম্পূর্ণ নির্লজ্জভাবে লিখেছেন : মুহাম্মদ আরব উপদ্বীপ (হিজায) ব্যতীত অন্য কোন অঞ্চলের সাথে পরিচিত ছিলেন না।” অথচ তিনি ষোল বছর বয়সে পিতৃব্য আবু তালিবের সাথে শামদেশে গিয়েছিলেন এবং যৌবনে তিনি পবিত্র মক্কা থেকে শামদেশ পর্যন্ত হযরত খাদীজার বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং কুরাইশদের বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে তিনি শামদেশে গমন করেছিলেন।

সত্যি-সত্যি যখনই আমরা ইতিহাসে পাঠ করি,এক গ্রীক যুবক (ইস্কান্দার মাকদূনী অর্থাৎ ম্যাসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার) সমগ্র বিশ্বের শাসনকর্তা হতে চাইতেন অথবা আমরা যখন শুনতে পাই,নেপোলিয়ান বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার খায়েশ পোষণ করতেন,তখন তো আমরা মোটেই বিস্মিত হই না। কিন্তু যখনই একদল প্রাচ্যবিদ এ কথা শোনেন যে,মুসলিম উম্মাহর মহান নেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে তদানীন্তন বিশ্বের দুই মহা পরাক্রমশালী সম্রাট (রোমান ও পারস্য সম্রাট),যাদের জাতিসমূহের সাথে তাঁর জাতি ও গোত্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল,তাদেরকে তাওহীদী ধর্মের দিকে আহবান করেছিলেন,তখনই তারা ঔদ্ধত্য সহকারে এ ঘটনাকে অসম্ভব বলে অভিহিত করেন।

কুরআনের আয়াতে সত্যের উন্মোচন

কুরআনের আয়াতসমূহ অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির এ পর্দা উন্মোচন করে দেয় যে,একদল সাহাবী মনে করেছিলেন,সাহায্য ও বিজয়ের ব্যাপারে মহানবীর দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহ ভিত্তিহীন। মহান আল্লাহ্ এ দল সম্পর্কে বলেন :

) و طائفة قد أهمّتهم أنفسهم يظنّون بالله غير الحق ظن الجاهلية يقولون هل لنا من الأمر من شىء(

সাহাবীদের মধ্যে একদল নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এতখানি চিন্তায় মগ্ন ছিল যে,তারা আল্লাহর সম্পর্কে জাহিলীয়াতের সময়কার ধারণা ও অনুমানের মতো বাতিল ধারণা পোষণ করছিল। তারা বলছিল,আমাদের কি মুক্তির কোন উপায় আছে। 35

আপনারা সূরা আলে ইমরানের কিছু আয়াত36 পর্যালোচনা করে এ যুদ্ধের কিছু গোপন বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এসব আয়াত সাহাবীদের সম্পর্কে শিয়াদের আকীদাকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে দেয়। শিয়ারা আকীদা পোষণ করে যে,মহানবী (সা.)-এর সকল সাহাবী তাওহীদী ধর্মের জন্য সত্যিকারভাবে ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না। তাদের মধ্যে দুর্বল আকীদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফিকও ছিল। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তরের মুমিন-মুক্তাকী লোকও অনেক ছিলেন। আজ আহলে সুন্নাতের একদল লেখক এ জাতীয় অনেক অন্যায় কাজ ধামাচাপা দিতে চান,যার নমুনা উহুদ যুদ্ধের বর্ণনায় আপনারা শুনলেন। তারা বাস্তবতা বহির্ভূত ব্যাখ্যা দিয়ে সকল সাহাবীর মর্যাদা রক্ষা করতে চান অথচ এসব ব্যাখ্যা অপরিপক্ব ও অপর্যাপ্ত এবং গোঁড়ামি ও পক্ষপাতদুষ্টতার পর্দা সত্যের প্রকৃত চেহারা দর্শনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কোন্ লেখক নিচের আয়াতের প্রতিপাদ্য অস্বীকার করতে পারবে? সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে : তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলে এবং কারো দিকে তাকাচ্ছিলে না;অথচ নবী পেছন থেকে তোমাদের ডাকছিলেন;তোমরা তাঁর কথায় কর্ণপাত কর নি;বরং তোমাদের পলায়ন অব্যাহত রেখেছিলে। 37

এ আয়াত সে সব লোক এবং তাদের মতো লোকদের সম্পর্কে,যাদেরকে আনাস ইবনে নযর নিজের চোখে দেখেছেন,তারা এক কোণায় বসে আছে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন রয়েছে। এর চেয়েও স্পষ্ট হচ্ছে নিচের এ আয়াত : যারা দু দলের মুখোমুখি হবার দিন পালিয়ে গিয়েছিল,শয়তান তাদেরকে তাদের কতিপয় কাজের ফলে পদস্খলিত করে দিল। তবে মহান আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্ও ক্ষমাকারী ও সহনশীল। 38

যারা নবীর নিহত হবার গুজবকে নিজেদের বাহানা হিসেবে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল এবং এ ফন্দি আঁটছিল যে,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের সহায়তায় আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে,তাদেরকে তিরস্কার করে পবিত্র কুরআন বলেছে :

) و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرّسل أفائن مات أو قتل انقلبتم علي أعقابكم و من ينقلب علي عقبيه فلن يضرّ الله شيئا و سيجزى الله الشّاكرين(

মুহাম্মদ (আল্লাহর পক্ষ হতে) একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন-তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনোই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না;বরং আল্লাহ্ কৃতজ্ঞদের শীঘ্রই পুরস্কার দান করবেন। 39

তিক্ত অভিজ্ঞতা

উহুদের ঘটনাবলী পর্যালোচনার দ্বারা তিক্ত ও মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। একদলের দৃঢ় ও অবিচল থাকার শক্তি ও ক্ষমতা এবং আরেক দলের দৃঢ়পদ ও অবিচল না থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে এ তথ্য হস্তগত হয় যে,মহানবী (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মুসলমানকে ন্যায়পরায়ণ ও মুত্তাকী সাব্যস্ত করা যায় না বা সম্ভবপর নয়। কেননা যে টিলা তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের অবস্থানস্থল ছিল,যারা তা ত্যাগ করেছে অথবা স্পর্শকাতর মুহূর্তে (রণাঙ্গন ত্যাগ করে ) পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে এবং মহানবীর আহবানের প্রতি তোয়াক্কা করে নি,তারাও মহানবীর সাহাবী ছিল।

বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক ওয়াকিদী লিখেছেন,উহুদের দিন আট ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মহানবী (সা.)-এর সাথে থাকার বাইয়াত করেন। তাঁরা ছিলেন মুজাহিরগণের মধ্য থেকে তিনজন-আলী,তালহা,যুবাইর এবং আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন। এই আটজন ছাড়া সবাই বিপজ্জনক মুহূর্তে পলায়ন করে।

ইবনে আবিল হাদীদ40 লিখেছেন,608 সালে বাগদাদে এক অনুষ্ঠানে মজলিসে ওয়াকিদীর মাগাযী গ্রন্থটি একজন বড় মুসলিম মনীষী মুহাম্মদ ইবনে মাআদ আলাভীর কাছে পাঠ করছিলাম। বিষয়টি যখন এ পর্যন্ত পৌঁছল যে,মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন : আমি উহুদের দিন নিজের চোখে দেখেছি,মুসলমানরা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল,আর মহানবী (সা.) তাদেরকে নাম ধরে ধরে ডাকছিলেন এবং বলছিলেন : হে অমুক! আমার কাছে এসো;হে অমুক! আমার কাছে এসো (إلَىّ يا فلان! إلَىّ يا فلان !),কেউই রাসূলের ডাকে অনুকূল সাড়া দিচ্ছিল না। উস্তাদ (মুহাম্মদ ইবনে মাআদ) আমাকে বললেন যে, অমুক, অমুক বলতে ঐ লোকদেরই বুঝানো হয়েছে,যাঁরা মহানবী (সা.)-এর পরে (রাষ্ট্রীয়) পদমর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের নাম স্পষ্টভাবে বললে বর্ণনাকারীর আশংকা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য থাকার কারণে স্পষ্টভাবে তাঁদের নাম উল্লেখ করতে চান নি।

অনুরূপভাবে তিনি (ইবনে আবিল হাদীদ) তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,প্রায় সকল বর্ণনাকারীই এ কথায় ঐকমত্য পোষণ করেন যে,তৃতীয় খলীফা ঐসব লোকদের মধ্যে ছিলেন,যারা সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে রণাঙ্গনে অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন না। আপনারা সামনে ইসলামের একজন মহীয়সী নারী নাসীবা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর এক উক্তি পড়বেন। উল্লেখ্য,এ মহীয়সী নারী উহুদের ময়দানে মহানবীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঐ বাণীতে পরোক্ষভাবে পলাতক দলটির মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে খাটো করা হয়েছে। আমরা মহানবীর সঙ্গীগণের কারো ব্যাপারেই কখনো মন্দ ধারণা রাখি না। উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন এবং বাস্তবতা প্রকাশ করা। তাদের পলায়নকে যে পরিমাণ নিন্দা করি,ঠিক তেমনি যুদ্ধের ময়দানে আরেক দল,যাঁদের কাহিনী আপনারা পরে পাঠ করবেন,তাঁদের (রণাঙ্গনে) দৃঢ়পদ থাকারও প্রশংসা করি এবং তাঁদের কাজের মর্যাদা দিই।

মহানবী (সা.)-কে হত্যার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পাঁচ ব্যক্তি

যে মুহূর্তে ইসলামী বাহিনী বিক্ষিপ্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল,তখন চতুর্দিক থেকে মহানবীকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছিল। এ সত্বেও কুরাইশ বাহিনীর নামকরা পাঁচজন যোদ্ধা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন কিছুর বিনিময়েই হোক,মহানবীর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে ফেলবে। এই লোকেরা ছিল :

1. আবদুল্লাহ্ ইবনে শিহাব,যে মহানবীর কপালে আঘাত করে।

2. আবু ওয়াক্কাসের পুত্র উতবা;সে চারটি পাথর নিক্ষেপ করে হযরতের ডান পাশের রুবাঈ দাঁত মুবারক41 ভেঙে দেয়।

3. ইবনে কুমিআহ্ লাইসী,যে মহানবীর মুখমণ্ডলে আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ আঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে,শিরস্ত্রাণের আংটাগুলো তাঁর মুখমণ্ডলের উপরিভাগ ছিদ্র হয়ে ঢুকে গিয়েছিল। আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বের করে আনেন। এর ফলে তাঁর নিজের চারটি দাঁত ভেঙে যায়।

4. আবদুল্লাহ্ ইবনে হামীদ,যে হামলা চালানো অবস্থায়ই মুসলিম বাহিনীর বীর যোদ্ধা আবু দুজানার আক্রমণে নিহত হয়।

5. উবাই ইবনে খালফ,সে ঐ ব্যক্তি যে মহানবীর হাতে নিহত হয়। সে এমন সময় মহানবীর মুখোমুখি হয়,যখন তিনি কোনমতে গিরি উপত্যকায় পৌঁছেছিলেন এবং কয়েকজন সাহাবী তাঁকে চিনতে পেরে চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে রয়েছিলেন। সে মহানবীর দিকে এলে তিনি হারেস ইবনে সিম্মার কাছ থেকে একটি বর্শা নেন এবং তা তার ঘাড়ে বসিয়ে দেন। তাতে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। উবাই ইবনে খালফের জখম যদিও খুব সামান্য ছিল,কিন্তু ভয় তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে,তার বন্ধুরা যতই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল,সে শান্ত হচ্ছিল না। সে বারবার বলছিল : মুহাম্মদকে মক্কায় আমি বলেছিলাম,আমি তোমাকে হত্যা করব। তার উত্তরে সে আমাকে বলেছিল;বরং আমিই তোমাকে হত্যা করব। সে কখনো মিথ্যা বলে না। এ ভয় ও ক্ষতই তার দফা রফা করে। কয়েক দিন পরে (মক্কায়) ফেরার পথে সে মারা যায়।42

সত্যই এ বিষয়টি প্রমাণ করে,কুরাইশরা কতখানি হীনমন্য ও ঘৃণ্য মানসিকতার অধিকারী ছিল। তারা এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত এবং স্বীকার করত যে,মহানবী (সা.) সত্যবাদী;তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না। এ সত্বেও তারা চরম শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তাঁর রক্ত ঝরানোর জন্য এতসব চেষ্টা করেছে।

মহানবী পর্বতের মতো দৃঢ়তা ও অবিচলতা সহকারে নিজের ও ইসলামের প্রতিরক্ষা বিধান করেন। যদিও মৃত্যুর সাথে তাঁর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না এবং তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে শত্রুবাহিনী ঢেউয়ের মতো তাঁর ওপর হামলে পড়ছে,এ সত্বেও তাঁর এমন কোন কথা ও আচরণ পরিলক্ষিত হয় নি যার মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের সামান্যতম আভাস থাকতে পারে। কেবল কপালের রক্ত পরিষ্কার করার সময় এটুক কথা তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়েছিল, যে জনগোষ্ঠী নিজেদের নবীর মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত করেছে,এমন অবস্থায় যে,তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছিলেন,তারা কিভাবে সফলকাম হবে? 43

এ উক্তি মানুষের প্রতি,এমনকি নিজের শত্রুদের প্রতি তাঁর অতিশয় দয়া ও সহৃদয়তার প্রমাণ বহন করে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন : মহানবী (সা.) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যুদ্ধ ঘোরতর রূপ নিলেই তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কাজেই মহানবী যে নিরাপদ ছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল,তাঁর সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক সংগ্রাম,যা তিনি নিজের ও ইসলামের চৌহদ্দির প্রতিরক্ষার জন্য করেছিলেন।

অবশ্য নবীর জীবন রক্ষার পেছনে অন্য কারণও সক্রিয় ছিল। আর তা ছিল স্বল্পসংখ্যক জান কুরবান সাহাবীর আত্মত্যাগ,যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে তাঁকে রক্ষা করার এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকাকে নির্বাপিত হবার হাত থেকে সমুজ্জ্বল রাখার ব্যবস্থা করেন। উহুদ যুদ্ধের দিন মহানবী প্রচণ্ড যুদ্ধ করেন। তাঁর তূণে যত তীর ছিল সবই তিনি নিক্ষেপ করেন। তাঁর ধনুক ভেঙে গিয়েছিল এবং ধনুকের রশি ছিঁড়ে গিয়েছিল।44

মহানবীর প্রতিরক্ষায় যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন,তাঁরা মাত্র কয়েকজন ছিলেন45 যাঁদের সবার অবিচলতার বিষয়টি ঐতিহাসিক বিচারে নিশ্চিত নয়। ঐতিহাসিকদের মাঝে যে সত্যটি নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত,তা হচ্ছে,স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্বের দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা,যাঁদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষামূলক্ষ প্রচেষ্টার বিবরণ আমরা এখন পেশ করব।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53