চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83926 / ডাউনলোড: 7972
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চল ও দেশসমূহে রিসালতের দূতগণ

মহানবী (সা.) একটি বৃহৎ পরামর্শসভায় অন্য সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো (বিশ্বের বিভিন্ন দেশের) শাসনকর্তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের দাওয়াতের বিষয়টি উত্থাপন করেন। একদিন তিনি তাঁর সাহাবীগণকে বললেন : সকালে তোমরা সবাই উপস্থিত থাকবে যাতে আমি তোমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করতে পারি।” পরের দিন ফজরের ফরয নামায আদায় করার পর তিনি সাহাবীগণকে বললেন :

“তোমাদের উচিত মহান আল্লাহর বান্দাদেরকে উপদেশ প্রদান করা;যে ব্যক্তি জনগণের তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচালক হবে এবং তাদের সুপথ প্রদর্শন ও হেদায়েতের ব্যাপারে চেষ্টা করবে না,মহান আল্লাহ্ তার জন্য বেহেশ্ত হারাম করে দিয়েছেন। তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও এবং দূর-দূরান্তের অঞ্চলসমূহে রিসালতের বার্তাবাহী দূত হয়ে বিশ্ববাসীদের কানে তাওহীদের শাশ্বত আহবান পৌঁছে দাও। তবে হযরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারীদের মতো তোমরা কখনো আমার বিরোধিতা করো না।” তখন মহানবীর কাছে তাঁরা প্রশ্ন করলেন : তারা কীভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল?”   তিনি জবাবে বলেছিলেন : তিনিও আমার মতো তাঁর একদল সাহাবীকে বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর রিসালতের বার্তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। তখন তাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি,যাদের যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত ছিল (অর্থাৎ যাদের গন্তব্যস্থল নিকটবর্তী ছিল),তারা তাঁর নির্দেশ মেনে নিয়েছিল;কিন্তু যাদের যাত্রাপথ দীর্ঘ ছিল,তারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।”

অতঃপর মহানবী (সা.) সবচেয়ে দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে ছয় জনকে তাঁর বিশ্বজনীন রিসালতের কথা উল্লেখসহ পত্র সমেত বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের উদ্দেশে প্রেরণ করলেন। আর এভাবে হেদায়েতের বার্তাবাহক দূতগণ একই দিনে ইরান,রোম,হাবাশা,মিশর,ইয়ামামাহ্, বাহরাইন ও হীরার (জর্দান) উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।২০০

মহানবীর পত্রসমূহ লেখা শেষ হলে কতিপয় ব্যক্তি,যাঁরা তখনকার রাজদরবারগুলোর রীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন,মহানবীর কাছে আরজ করলেন,পত্রসমূহে যেন তিনি সীলমোহর দেন;কারণ,বিশ্বের সম্রাট,রাজা ও শাসকগণ স্বাক্ষরবিহীন পত্র পাঠ করেন না। তাই মহানবীর নির্দেশে তাঁর জন্য একটি রূপার আংটি তৈরি করা হয়,যার উপর তিন লাইনেمحمّد رسول الله মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্’ খোদাই করে লেখা হয়েছিল। এ আংটিতে খোদাই কাজ এমনভাবে করা হয়েছিল যে, আল্লাহ’ শব্দ সবচেয়ে উপরে,রাসূল শব্দ মাঝখানে এবং মুহাম্মদ শব্দ নিচে স্থান পেয়েছিল। আর জাল করার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এ ধরনের সূক্ষ্ম ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং পাঠকের উচিত স্বাক্ষর বা সীলমোহরকে নিচ থেকে শুরু করে আল্লাহ্’ শব্দ পর্যন্ত পাঠ করা। মহানবী (সা.) একেও যথেষ্ট মনে করেন নি এবং পত্রের খাম বিশেষ এক ধরনের মোম দিয়ে বন্ধ করে তার উপর মোহরাংকিত করে দেন।২০১

রিসালত প্রচারের যুগে বিশ্ব-পরিস্থিতি

তৎকালীন বিশ্বের সমুদয় শক্তি ও কর্তৃত্ব দুই সাম্রাজ্যের হাতের মুঠোয় ছিল। আর এ কারণে এ দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধের এক দীর্ঘ অতীত ইতিহাস ছিল। ইরান ও রোমের মধ্যকার যুদ্ধ হাখামানেশী যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল এবং তা সাসানীয় যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রাচ্য পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। তখন ইরাক,ইয়েমেন এবং এশিয়া মাইনরের একাংশ পারস্যের শাহানশাহী প্রশাসনের উপনিবেশ বলে গণ্য হতো। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্য পশ্চিম ও পূর্ব-এ দু অংশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ রোমান সম্রাট থিওডর দ্য গ্রেট ৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নিজ সাম্রাজ্যকে দুই পুত্রের মধ্যে পশ্চিম রোম ও পূর্ব রোম নামের দুই দেশে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। পশ্চিম রোম ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ইউরোপের অসভ্য ও বর্বর জাতিগুলোর আক্রমণের মুখে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে পূর্ব রোম,যার রাজধানী ছিল কন্সটান্টিনোপল এবং শাম ও মিশর যার শাসনাধীন ছিল,তা দীন ইসলামের আবির্ভাবকালে তদানীন্তন বিশ্বের এক বিরাট অংশের ওপর স্বীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। অবশেষে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন কন্সটান্টিনোপল বিজয়ী বীর তুর্কী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের হাতে পদানত হয়,তখন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ও প্রশাসনের সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় এবং তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। আরব উপদ্বীপও ঐ সময় এ দুই পরাশক্তির দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। তবে যেহেতু সেখানে উর্বর ভূখণ্ড ছিল না এবং সেখানকার অধিবাসীরাও যাযাবর জীবন যাপন করত ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত,সেহেতু এ দুই সাম্রাজ্য কখনো উক্ত অঞ্চল দখল ও পদানত করার ইচ্ছা প্রকাশ করত না। তাদের (এ দুই সামাজ্য) গর্ব,অন্যায়-অবিচার এবং যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো তাদেরকে আরব উপদ্বীপে যে এক মহান বিপ্লব এবং মৌলিক পরিবর্তনের শুভ সূচনা হতে যাচ্ছে,সে ব্যাপারে অবগত হওয়া থেকে বিরত রেখেছিল। তারা কখনো ভাবতে পারে নি যে,সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে অবস্থানকারী একটি জাতি ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এ দুই সাম্রাজ্য ও পরাশক্তির পতন ঘটাবে এবং যেসব অঞ্চল তাদের অন্যায় ও শোষণের কারণে অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল,সেগুলোকে ইসলাম ধর্মের উজ্জ্বল আলোক-প্রভার দ্বারা উদ্ভাসিত করবে। তারা যদি আগে থেকেই এ আলোকবর্তিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারত,তা হলে ইসলাম ধর্মের সূচনালগ্নেই এ ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দিত।

রোমান সাম্রাজ্যে ইসলামের বার্তাবাহী দূত

রোমান সম্রাট কায়সার (সিজার) মহান আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হলে এ মহাবিজয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ তিনি তাঁর রাজধানী কন্সটান্টিনোপল থেকে পায়ে হেঁটে বাইতুল মুকাদ্দাস’ যিয়ারত করতে যাবেন। তিনি যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর তাঁর মানত পুরো করেছিলেন এবং পায়ে হেঁটে বাইতুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন।

দাহিয়াহ্ কালবী রোমান সম্রাটের কাছে পত্র পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি শামদেশে বহু বার সফর করেছিলেন বিধায় সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ জ্ঞান ছিল। তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা ও  দৈহিক গড়ন এবং তাঁর সুন্দর চারিত্রিক গুণ,সর্বোপরি তাঁর বহুমুখী যোগ্যতাই এ অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা তাঁর জন্য অত্যাবশ্যক করে দিয়েছিল। কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে শাম ত্যাগ করার আগেই বুসরা’ নামের একটি শহরে তিনি জানতে পারলেন,রোমান সম্রাট কায়সার বাইতুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন। এ কারণেই তিনি বিলম্ব না করেই বুসরার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হারিস ইবনে আবী শিমরের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মিশন সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন।

আত তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থের লেখক২০২ লিখেছেন :

“মহানবী (সা.) তাঁকে (দাহিয়াহ্ কালবী) বুসরার শাসনকর্তার কাছে পত্রখানা হস্তান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি তা রোমান সম্রাটের কাছে পৌঁছে দেন। সম্ভবত মহানবী (সা.) এ নির্দেশ এ কারণে দিয়েছিলেন,তিনি ব্যক্তিগতভাবে কায়সারের এ সফর সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলেন বা দাহিয়াহ্ কাল্বীর সফরের সুযোগ-সুবিধা সীমিত ছিল এবং কন্সটান্টিনোপল পর্যন্ত তাঁর সফর করাটাও ছিল কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।

যা হোক,মহানবীর প্রেরিত দূত বুসরার শাসনকর্তার সাথে যোগাযোগ করলেন। আর তিনিও আদী ইবনে হাতেমকে ডেকে পাঠিয়ে মহানবীর দূতের সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস পানে যাত্রা করে রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে মহানবীর পত্র পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

মহানবীর দূত হিমস শহরে কায়সারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি কায়সারের সামনে উপস্থিত হতে চাইলে দরবারের কর্মকর্তারা তাঁকে বললেন : আপনি অবশ্যই কায়সারকে সিজদাহ্ করবেন। তা না হলে সম্রাট আপনার দিকে মোটেই ফিরে তাকাবেন না এবং আপনার পত্রও গ্রহণ করবেন না।” মহানবীর প্রেরিত বুদ্ধিমান দূত দাহিয়াহ্ বললেন : আমি ভুল প্রথাসমূহ গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যই এত কষ্ট স্বীকার করে সফর করে এসেছি। আমি মুহাম্মদ’ নামক একজন রাসূলের পক্ষ থেকে রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে এ বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছি। মানবপূজা অবশ্যই রহিত ও বিলুপ্ত করতে হবে এবং এক-অদ্বিতীয় আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ইবাদত করা যাবে না। এ বিশ্বাস সহকারে কিভাবে আমি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেব এবং মহান আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তার সিজদাহ্ করব?

দরবারের কর্মকর্তাগণ মহানবীর দূতের শক্তিশালী যুক্তিতে বিস্মিত হয়েছিলেন। দরবারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষি কর্মকর্তা দাহিয়াকে বললেন : আপনি সম্রাটের বিশেষ টেবিলের উপর পত্রখানা রেখে আসতে পারেন;আর সম্রাট কায়সার ছাড়া অন্য কেউ টেবিলের উপর রাখা পত্রের উপর হাত দেবেন না এবং সম্রাট যখনই ঐ পত্র পড়বেন,তখনই তিনি আপনাকে তাঁর কাছে ডেকে পাঠাবেন।”

কায়সার পত্রখানা  খুললেন। আল্লাহর নামে’ (بسم الله )-এ বাক্য দিয়ে এ পত্র শুরু করা হয়েছিল। তা সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তিনি বললেন : আমি একমাত্র সুলাইমান (আ.) ছাড়া এ পর্যন্ত আর কারো কাছ থেকে এ ধরনের পত্র দেখি নি।” এরপর তিনি আরবী ভাষার বিশেষ অনুবাদককে পত্রখানা অনুবাদ করে তাঁকে পড়ে শোনানোর জন্য তলব করলেন। অনুবাদক মহানবীর পত্র এভাবে অনুবাদ করলেন :

-মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর কাছ থেকে রোম সাম্রাজ্যের প্রধান জনাব হিরাক্লিয়াসের প্রতি (প্রেরিত এ পত্র)। হেদায়েতের অনুসারীদের ওপর সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন,তা হলে আপনিও নিরাপত্তা লাভ করবেন এবং মহান আল্লাহ্ও আপনাকে পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন,তা হলে আরীসী২০৩ দের পাপও আপনার উপর বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! আমরা আপনাদেরকে একটি অভিন্ন মূলনীতির দিকে আহবান করছি। আর তা হলো,আমরা মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন সত্তার ইবাদত করব না,আমরা অন্য কোন সত্তাকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করব না এবং আমরা পরস্পরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করব না। আর (হে মুহাম্মদ!) তারা যদি সত্য ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়,তা হলে আপনি (তাদের) বলে দিন : তোমরা সবাই সাক্ষী থেকো,আমরা সবাই মুসলমান। ২০৪

মহানবী (সা.)-এর অবস্থা জানতে রোমান সম্রাটের অনুসন্ধান শুরু

পত্রের লেখক তাওরাত ও ইনযীলের প্রতিশ্রুত মুহাম্মদই হবেন বলে রোমের কর্ণধার এ সম্ভাবনার কথা জানালেন। এ কারণেই তিনি তাঁর জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন : সমগ্র শামদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াও;সম্ভবত মুহাম্মদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি বা যারা তাঁর অবস্থা সম্পর্কে অবগত,তাদের মধ্য থেকে কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে,যাদের কাছে থেকে আমি মুহাম্মদ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী লাভ করতে পারব।” ঘটনাক্রমে ঐ দিনগুলোতে একদল কুরাইশসহ আবু সুফিয়ান ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে শামদেশে গমন করেছিল। রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজকীয় কর্মকর্তা তাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সবাইকে বাইতুল মুকাদ্দাসে সম্রাটের কাছে নিয়ে গেলেন। রোমান সম্রাট তাদের জিজ্ঞেস

করলেন : আপনাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি আছে কি,মুহাম্মদের সাথে যার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে?”   আবু সুফিয়ান তখন নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বলল : আমরা ও তিনি একই গোত্রভুক্ত এবং আমাদের ও তাঁর ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পিতৃপুরুষ হচ্ছেন আব্দে মানাফ।” রোমান সম্রাট তখন নির্দেশ দিলেন আবু সুফিয়ান যেন তাঁর সামনে দাঁড়ায় এবং কাফেলার অন্যান্য ব্যক্তি তার পেছনে থেকে তার কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শোনে এবং লক্ষ্য রাখে। যখনই সে সম্রাটের প্রশ্নের দূরভিসন্ধিমূলক জবাব দেবে তখন তারা তৎক্ষণাৎ তার ভুল বা মিথ্যা বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করবে। এ অবস্থায় সম্রাট আবু সুফিয়ানের কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করলেন এবং সেও সেগুলোর উত্তর দিল:

–মুহাম্মদের বংশ পরিচয় কেমন?

–তাঁর পরিবার বা বংশ অত্যন্ত সম্মানিত,মর্যাদাবান ও মহান।

–তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন কি,যিনি জনগণের উপর রাজত্ব করেছেন?

–না,কখনো এমন কেউ ছিলেন না।

–নবুওয়াতের দাবী করার আগে কি তিনি মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতেন?

–হ্যাঁ,মুহাম্মদ সত্যবাদী ছিলেন।

–সমাজের কোন্ শ্রেণী তাঁর অনুসারী এবং তাঁর ধর্ম গ্রহণ করছে?

–অভিজাত শ্রেণী তাঁর বিরোধী এবং সমাজের সাধারণ ও মধ্য পর্যায়ের লোকেরা তাঁর একনিষ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থক।

–তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা কি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে?

–হ্যাঁ।

–তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকে কি কোন ব্যক্তি এ পর্যন্ত তাঁর ধর্ম ত্যাগ করেছে?

–না।

–তিনি কি শত্রু ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী অথবা পরাজিত হন?

–কখনো তিনি বিজয়ী,আবার কখনো তিনি পরাজয়ের সম্মুখীন হন।

সম্রাট তখন দোভাষীকে বললেন : আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীদের বল,তোমাদের তথ্য যদি সঠিক হয়,তা হলে তিনি অবশ্যই শেষ যামানার প্রতিশ্রুত নবী।” তিনি সবশেষে বললেন : আমি আগে থেকে অবগত ছিলাম,এ ধরনের এক নবীর আবির্ভাব হবে। তবে আমি জানতাম না তিনি কুরাইশ বংশীয় হবেন। আমি তাঁর সামনে বিনয়াবনত হতে এবং সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর পদযুগল ধৌত করতে প্রস্তুত। আর অতি শীঘ্রই তাঁর শক্তি,মর্যাদা ও মহত্ত্ব সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যকে ঘিরে ফেলবে।”

রোমান সম্রাটের ভ্রাতুষ্পুত্র বলল : মুহাম্মদ তাঁর পত্রে আপনার নামের আগে তাঁর নিজের নাম উল্লেখ করেছেন।” এ সময় সম্রাট তাকে ধমক দিয়ে বললেন : তাঁর প্রতি নামূসে আকবার’ অর্থাৎ ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। আমার নামের উপর তাঁর নাম অগ্রগণ্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”

আবু সুফিয়ান বলে : মুহাম্মদের প্রতি রোমান সম্রাট অকুণ্ঠ দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করায় রাজদরবারে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল এবং আমি এ ঘটনা ঘটায় খুবই অসন্তুষ্ট হলাম এ কারণে যে,মুহাম্মদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি এতটা বেড়ে যাবে যে,এর ফলে রোমান জাতিও তাকে ভয় পেতে থাকবে। যদিও প্রশ্ন ও উত্তরের শুরুতে আমি রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে মুহাম্মদকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম এবং আমি বলছিলাম,আপনি মুহাম্মদ সম্পর্কে যা শুনেছেন আসলে সে তার চেয়ে অনেক তুচ্ছ;তবে কায়সার আমার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রতি মোটেই কর্ণপাত করলেন না এবং বললেন : আমি আপনাকে যা জিজ্ঞেস করব,আপনি কেবল সে প্রশ্নেরই উত্তর দেবেন। ২০৫

কায়সারের উপর মহানবী (সা.)-এর পত্রের প্রভাব

আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট ও তথ্যাবলীকে রোমান সম্রাট যথেষ্ট মনে করলেন না;বরং তিনি পত্রসমেত বিষয়টি রোমের একজন পণ্ডিতের কাছে উত্থাপন করলেন। আর সেই পণ্ডিতও জবাবে লিখলেন : ইনি সেই নবী যাঁর জন্য সমগ্র বিশ্ব অপেক্ষমান।” রোমান সম্রাট রোমের সর্দার ও নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটি ধর্মীয় আশ্রমে এক বিরাট সমাবেশের আয়োজন করে সেখানে মহানবীর পত্র তাদেরকে পড়ে শুনালেন এবং বললেন : তোমরা কি তাঁর কর্মসূচী ও ধর্মের সাথে একমত (অর্থাৎ তা গ্রহণ করার ব্যাপারে সম্মত আছ কি?)।” সাথে সাথেই এ সভায় এক বড় ধরনের গোলযোগ বেঁধে গেল। তাদের মতপার্থক্য ও বিরোধিতার কারণে স্বয়ং রোমান সম্রাট নিজের প্রাণনাশের আশংকা করলেন। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ উক্ত সভাস্থলের উঁচু জায়গায় স্থাপিত তাঁর আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে লক্ষ্য করে বললেন : আমার এ প্রস্তাবটা ছিল তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। তাই হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর ধর্মের প্রতি তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি সত্যি আমাকে বিস্মিত করেছে এবং তা আমার কাছে প্রশংসনীয়।”

কায়সার দাহিয়াহকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে সম্মান করলেন এবং মহানবীর পত্রের জবাব লিখে কিছু উপহারও তাঁর সাথে প্রেরণ করলেন। সম্রাট এ পত্রে মহানবীর প্রতি স্বীয় বিশ্বাস,ভক্তি ও নিষ্ঠা ব্যক্ত করেছিলেন।২০৬

সাফল্যজনক প্রতিরক্ষা লড়াই ও পুনঃ বিজয়

ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যায়কে যদি পুনঃবিজয় বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে অতিরঞ্জিত কিছু বলা হবে না। এ বিজয় বলতে আমরা এ কথাই বুঝাতে চাই যে,মুসলমানরা শত্রুর প্রত্যাশার বিপরীতে মহানবীর জীবনকে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। মুসলিম বাহিনীর ভাগ্যে জুটে যাওয়া এটিই ছিল পুনঃবিজয়।

যদি এ বিজয়ে মুসলিম বাহিনীর সবাই অংশীদার বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে মুসলিম বাহিনীর প্রতি সম্মান প্রদশর্ন হিসেবে তা যথার্থই হবে। কিন্তু এ বিজয়ের আসল দায়িত্ব বহন করেছেন গুটিকতক মুসলমান,যাঁরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মহাসম্পদ অক্ষত থাকা এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকা নির্বাপিত না হওয়া এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির ত্যাগের ফল ছিল।

এখন এই আত্মত্যাগী মহান ব্যক্তিগণের সম্পর্কে কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করছি :

1. (উহুদের রণাঙ্গনে) প্রথম ব্যক্তি যিনি অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন তিনি ছিলেন সেই তরুণ,যাঁর জীবনের মাত্র 24টি বসন্ত অতিক্রম হয়েছিল এবং জীবনের শুরু থেকে মহানবীর ওফাতের দিন পর্যন্ত তাঁর পাশেই ছিলেন এবং এক মুহূর্তও তাঁর সাহচর্য ও তাঁর জন্য আত্মত্যাগ থেকে বিরত হন নি।

এই বীর সেনাপতি,এই প্রকৃত আত্মত্যাগী ছিলেন মুত্তাকীদের মওলা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মূলত এই পুনর্বার বিজয় সেই প্রথম বিজয়ের মতোই এই জান-নিসার বীর যোদ্ধার ত্যাগ ও বীরত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। কেননা যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের পলায়নের কারণ ছিল এই যে,তাদের পতাকাবাহীরা একের পর এক আলীর তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল। ফলে কুরাইশ বাহিনীর অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়েছিল এবং তাদের অটল থাকার শক্তি লোপ পেয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণকারী সমসাময়িক মিশরীয় লেখকগণ,হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা যতখানি প্রাপ্য বা অন্ততপক্ষে ইতিহাসে যতখানি লিপিবদ্ধ হয়েছে,ততখানি হক আদায় করেন নি। তাঁরা আমীরুল মুমিনীনের আত্মত্যাগকে অন্যদের ত্যাগের পর্যায়ভুক্ত করেছেন। এ কারণে হযরত আলীর আত্মত্যাগের বিবরণ এখানে দেয়া সমীচীন মনে করছি।

1. ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাসে46 লিখেছেন : মহানবী (সা.) সবদিক থেকে কুরাইশ বাহিনীর বিভিন্ন দলের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। যে দলই হযরতের ওপর আক্রমণ চালাতো,হযরত আলী মহানবীর নির্দেশে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতেন এবং তাদের কতিপয় লোককে হত্যা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। উহুদ যুদ্ধে এ ঘটনার কয়েকবার পুনরাবৃত্তি হয়। এ আত্মত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে ওহীর ফেরেশতা আগমন করেন এবং মহানবীর কাছে হযরত আলীর আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন এবং বলেন : এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ যা এ বীর সেনানায়ক তাঁর নিজ থেকে প্রদর্শন করেছেন। মহানবীও ওহীর বাহক ফেরেশতার উক্তি সত্যায়ন করে বলেন : আমি আলী হতে এবং সে আমা হতে। এরপর রণাঙ্গনে একটি আহবান-ধ্বনি শোনা গেল,যার বিষয়বস্তু হচ্ছে এ দু টি বাক্য :

لا سيف إلّا ذو الفقار لا فتى إلّا علىّ

অর্থাৎ একমাত্র যে তরবারী যুদ্ধে অবদান রাখতে পারে,তা হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিবের তরবারী,আর আলীই হচ্ছে একমাত্র বীর জোয়ান।

ইবনে আবীল হাদীদ ঘটনাপ্রবাহের আরো বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং বলেছেন : যারা মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করছিল,তাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ। আলী বাহন পশুর উপর সওয়ার না হয়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়েই তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করছিলেন। এরপর হযরত জিবরীলের অবতরণের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন : এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রচিত গায্ওয়া (য্দ্ধু) সম্পর্কিত গ্রন্থের কয়েকটি হস্তলিখিত অনুলিপিতে জিবরীলের অবতরণের বিষয়টি দেখতে পেয়েছি। এমনকি একদিন আমার শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব সাকীনার কাছে এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা সঠিক। আমি তাঁকে বললাম : এ সত্য ঘটনা সিহাহ্ সিত্তার47 গ্রন্থকারগণ কেন লিখেন নি?”   তিনি উত্তরে বলেছিলেন : অনেক সহীহ্ রেওয়ায়েত আছে যেসব উল্লেখ করার ব্যাপারে সিহাহ্-এর গ্রন্থকারগণ অবহেলা করেছেন। 48

2. আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) তাঁর একদল অনুসারীর উপস্থিতিতে রা স-উল ইয়াহুদে যে দীর্ঘ ভাষণ পেশ করেন,তাতে নিজের আত্মত্যাগের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেছিলেন : কুরাইশ বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আনসার ও মুহাজিররা তাদের বাড়ির পথ ধরে ছুটে পালিয়েছিল। আর তখন আমি সত্তরটি জখম নিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর তিনি আমার জামা উঠিয়ে ক্ষতস্থানগুলোর উপর হাত বুলিয়ে দেন যেগুলোর চিহ্ন (তখনও) বিদ্যমান ছিল।49

এমনকি এলালুশ শারায়ে গ্রন্থে শেখ সাদুক-এর বর্ণনা অনুযায়ী আলী (আ.) মহানবীর (সা.) জীবন রক্ষা করার সময় এতটা ত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন যে,তাঁর তরবারী ভেঙে যায় এবং মহানবী (সা.)তাঁর তরবারি যুলফিকার তাঁকে দান করেন। সেই তরবারি নিয়েই তিনি মহান আল্লাহর পথে জিহাদ চালিয়ে যান।

ইবনে হিশাম তাঁর স্বনামধন্য সীরাত গ্রন্থে50 মুশরিক বাহিনীর নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বাইশ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের নাম ও গোত্র-পরিচয় ইত্যাদি লিখেছেন। এদের মধ্যে বারো জন আলীর হাতে নিহত হয়েছিল। বাকীরা অন্যান্য মুসমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। উল্লিখিত সীরাত লেখক নিহতদের নাম ও পরিচয় বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা সংক্ষিপ্ততার জন্য আর বেশি লিখছি না।

আমরা স্বীকার করছি,আহলে সুন্নাহ্ ও শিয়াদের গ্রন্থসমূহে,বিশেষ করে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে51 হযরত আলী ( আ.)-এর অবদান সংক্রান্ত যে বর্ণনা রয়েছে,এখানে তা উল্লেখ করতে পারি নি। এ ব্যাপারে যে সব বিক্ষিপ্ত রেওয়ায়েত ও বর্ণনা রয়েছে,সেসব পর্যালোচনা করার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে,উহুদ যুদ্ধে তাঁর মতো কেউ দৃঢ়পদ থাকেন নি।

2. আবু দুজানাহ্ : তিনি হচ্ছেন আমীরুল মুমিনীনের পর দ্বিতীয় সৈনিক,যিনি মহানবীর প্রতিরক্ষায় এমন ভূমিকা পালন করেন যে,তিনি নিজেকে মহানবীর ঢালে পরিণত করেন। তাঁর পিঠের উপর তীর বিদ্ধ হচ্ছিল। এভাবে তিনি মহানবীকে তীরের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রক্ষা করেন। মরহুম সেপেহের প্রণীত নাসিখুত্ তারিখ গ্রন্থে আবু দুজানাহ্ সম্পর্কে একটি বাক্য আছে। এ কথার সূত্র ও প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় নি। তিনি লিখেছেন52 :

মহানবী (সা.) ও আলী যখন মুশরিকদের অবরোধের মধ্যে পড়েছিলেন,তখন আবু দুজানার প্রতি মহানবীর দৃষ্টি পড়ে এবং তিনি তাঁকে বলেন : আবু দুজানাহ্! আমি তোমার কাছ থেকে আমার বাইয়াত ফেরৎ নিলাম;তবে আলী আমা হতে আর আমি আলী হতে। আবু দুজানাহ্ তীব্রভাবে কাঁদলেন এবং বললেন : আমি কোথায় যাব,আমার স্ত্রীর কাছে যাব,সে তো মৃত্যুবরণ করবে;আমি কি আমার বাড়িতে ফিরে যাব;তা তো বিরান হয়ে যাবে;আমার ধন-সম্পদের দিকে যাব,তা তো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মৃত্যুর দিকেই ছুটে যাব,যা আমার দিকে এসে পৌঁছবে।

আবু দুজানার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। তাঁর প্রতি মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেন আর তিনি ও আলী কুরাইশদের একের পর এক আক্রমণ থেকে মহানবীকে হেফাযত করেন।

ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে আসিম ইবনে সাবিত,সাহাল ইবনে হুনাইফ,তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ প্রমুখের নামের উল্লেখ দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ,যে সব ব্যক্তিত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়পদ ছিলেন,তাঁদের সংখ্যা ছত্রিশ জন বলে উল্লেখ করেছেন। যা হোক,ইতিহাসের আলোকে যা নিশ্চিত,তা হচ্ছে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.),আবু দুজানাহ,হামযাহ্ এবং উম্মে আমের নামক একজন মহিলার দৃঢ়তা। এ চারজন ছাড়া বাকীদের দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি অনুমাননির্ভর। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তা মূল থেকেই সন্দেহযুক্ত।

3. হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব : মহানবী (সা.)-এর চাচা হামযাহ্ ছিলেন আরবের বীরকেশরী এবং ইসলামের একজন বিখ্যাত সেনানায়ক। তিনি সেই ব্যক্তিগণের অন্যতম,যাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মক্কায় অত্যন্ত নাযুক পরিস্থিতিতে মহানবীকে মূর্তিপূজারীদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন। কুরাইশদের সভায় আবু জাহল মহানবীর অবমাননা করেছিল এবং তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিল,তার প্রতিশোধস্বরূপ তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঐ সময় তাঁকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না।

তিনি ছিলেন সেই বীরকেশরী,বদরের যুদ্ধে যিনি কুরাইশ বাহিনীর বীর অধিনায়ক শাইবাকে হত্যা করেন। এছাড়া অপর একদলকে হত্যা ও আরো কতককে আহত করেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল সত্যকে রক্ষা এবং মানব জীবনে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী,ওতবার মেয়ে হিন্দ মনে মনে হামযার প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,যে কোন মূল্যেই হোক,মুসলমানদের কাছ থেকে তার পিতার প্রতিশোধ নেবে।

ওয়াহ্শী ছিল এক হাবশী বীর যোদ্ধা। সে যুবাইর ইবনে মুতয়েমের ক্রীতদাস ছিল। যুবাইরের চাচাও বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। হিন্দের পক্ষ থেকে সে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল যে,সে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার মনের আশা পূরণ করবে। হিন্দ্ ওয়াহ্শিকে প্রস্তাব দিয়েছিল,আমার পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তোমাকে তিনজনের (মুহাম্মদ,আলী ও হামযাহ্) মধ্যে যে কোন একজনকে হত্যা করতে হবে। বীর ওয়াহ্শী জবাবে বলেছিল : আমি কখনোই মুহাম্মদের নাগাল পাব না। কেন না তার সাহাবীরা যে কারো চাইতে তার নিকটবর্তী। আলীও যুদ্ধের ময়দানে অসম্ভব রকমের সজাগ। কিন্তু যুদ্ধের সময় হামযার ক্রোধ ও উত্তেজনা এত প্রবল থাকে যে,লড়াই চলাকালীন তার আশপাশে কি হচ্ছে,সে তা বুঝতে পারে না। হয় তো আমি তাকেই ধোঁকায় ফেলে হত্যা করতে পারব। হিন্দ্ ঐটুকুতেই রাজি হয়ে যায়। তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়,এক্ষেত্রে যদি সে সফল হয়,তা হলে তাকে মুক্তি দান করবে।

একদল মনে করেন,যুবাইর নিজেই তার গোলামের সাথে এ চুক্তি সম্পাদন করে। কেননা,বদর যুদ্ধে তার চাচা নিহত হয়েছিল। হাবশী গোলাম ওয়াহ্শী নিজেই বলেছে : উহুদের দিন আমি কুরাইশের বিজয় লাভের সময়টিতে হামযার খোঁজে ছিলাম। তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের মতো প্রতিপক্ষের ব্যূহের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর সামনে যে-ই আসছিল,তাকেই তিনি ধরাশায়ী করছিলেন। আমি এমনভাবে গাছ ও পাথরের পেছনে লুকিয়ে রইলাম যে,এর ফলে তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি তুমুল লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। আমি আমার গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি হাবশী ছিলাম বিধায় হাবশীদের মতোই বর্শা নিক্ষেপ করতাম। এজন্য তা খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। এ কারণে আমি একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বিশেষ এক ভঙ্গিতে দুলিয়ে তাঁর দিকে আমার দুই ফলা বিশিষ্ট বর্শা নিক্ষেপ করলাম। বর্শা তাঁর পাঁজর ও জঙ্ঘার মধ্যবর্তী পার্শ্বদেশে আঘাত করল এবং তাঁর দু পায়ের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি আমার ওপর আক্রমণ করতে চাইলেন;কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা তাঁকে এই সুযোগ দেয় নি। ঐ অবস্থায় তিনি পড়ে রইলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর আমি খুব সতর্কতার সাথে তাঁর দিকে গেলাম। আমার বর্শাটি বের করে এনে কুরাইশ বাহিনীর শিবিরে ফিরে গেলাম;আর নিজের মুক্তির জন্য দিন গুণতে লাগলাম।

উহুদ যুদ্ধের পর বহু দিন আমি মক্কায় ছিলাম। অতঃপর মুসলমানরা মক্কা জয় করলে আমি তায়েফে পালিয়ে গেলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামের কর্তৃত্ব সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আমি শুনতে পেয়েছিলাম,যে যত মারাত্মক অপরাধীই হোক না কেন,যদি ইসলাম গ্রহণ করে,মহানবী (সা.) তার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আমি মুখে কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে মহানবী সকাশে উপস্থিত হলাম। মহানবীর দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। তিনি বললেন : তুমি কি সেই হাবশী ওয়াহ্শী? আমি বললাম : জ্বি হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কিভাবে হামযাহকে হত্যা করেছ? আমি হুবহু ঘটনাটি বললাম। মহানবী খুবই মর্মাহত হলেন এবং বললেন : যতদিন জীবিত আছ,ততদিন আমি যেন তোমার চেহারা না দেখি। কেননা আমার চাচাকে হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা তোমার দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে। 53

এ হচ্ছে নবুওয়াতের সেই মহান আত্মা এবং অন্তরের সীমাহীন প্রশস্ততা,যা স্বয়ং মহান আল্লাহ্ ইসলামের সুমহান নেতাকে দান করেছেন। তিনি বহু অজুহাত দাঁড় করিয়ে আপন চাচার হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু এরপরও তাকে মুক্ত করে দেন। ওয়াহ্শী বলেছে : মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন,আমি তাঁর সামনে থেকে আমার চেহারা লুকিয়ে রাখতাম। মহানবীর ইন্তেকালের পর নবুওয়াতের দাবীদার ভণ্ড মুসাইলিমা কায্যাব-এর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমি ইসলামী সেনাবাহিনীতে যোগদান করলাম। আমি মুসাইলিমাকে হত্যার জন্য সেই যুদ্ধাস্ত্রটি ব্যবহার করলাম। একজন আনসারের সহায়তায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হলাম। আমি যদি এ অস্ত্র দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি হামযাহ্ কে হত্যা করে থাকি,নিকৃষ্টতম ব্যক্তি মুসাইলিমাও তো এ অস্ত্রের বিপদ থেকে রক্ষা পায় নি।

মুসাইলিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াহ্শীর অংশগ্রহণের বিষয়টি তার নিজের দাবীমাত্র। তবে ইবনে হিশাম বলেন,ওয়াহ্শী জীবনের শেষপ্রান্তে একটি কালো কাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। মদ পানের কারণে সে মুসলমানদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল এবং তাকে প্রায় সময়ে মদ পানের দায়ে বেত্রাঘাত করা হতো। বারবার মন্দ কাজের জন্য সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে তার নাম কেটে দেয়া হয়। উমর ইবনে খাত্তাব বলতেন,হামযার হত্যাকারী আখেরাতে অবশ্যই সফলকাম হবে না।54

4. উম্মে আমের : এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অবকাশ নেই যে,ইসলামে মহিলাদের জন্য জিহাদ নিষিদ্ধ। এ কারণে যখন মদীনার মহিলাদের প্রতিনিধি মহানবীর নিকট উপস্থিত হন,তখন তাঁরা এই বঞ্চনার ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলেন এবং অভিযোগ করেন : আমরা সাংসারিক জীবনে স্বামীদের জন্য সকল কাজ সম্পাদন করি। আর তারা নিশ্চিন্তে জিহাদে অংশগ্রহণ করে;অথচ আমরা নারী সমাজ এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

মহানবী (সা.) তাঁর মাধ্যমে মদীনার নারী সমাজের প্রতি বার্তা পাঠান : তোমরা যদিও কতক সৃষ্টিগত ও সামাজিক কারণে এই মহা সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়েছ;কিন্তু তোমরা সাংসারিক ও বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জিহাদের সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম। অতঃপর তিনি এই ঐতিহাসিক উক্তি করেন :و إنّ حُسن التّبعّل يعدل ذلك كلّه সুচারুরূপে ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনই জিহাদের সমকক্ষ। তবে কখনো কখনো কিছু অভিজ্ঞ নারী ইসলামের যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য তাঁদের সাথে মদীনার বাইরে আসতেন। তাঁরা পিপাসার্তদের পানি পান করানো,সৈনিকদের কাপড় ধোয়া ও আহতদের সেবা করার মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় লাভে সাহায্য করতেন।

উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। তিনি বলেন : আমি ইসলামের মুজাহিদগণের পানি সরবরাহের জন্য উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আমি দেখতে পেলাম,বিজয়ের হাওয়া মুসলমানদের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ মোড় ঘুরে গেল। মুসলমানরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। মহানবী (সা.)-এর প্রাণ নিয়ে আশংকা দেখা দিল। আমি নিজ দায়িত্ব মনে করলাম যে,জীবন যতক্ষণ আছে,মহানবীর প্রাণ রক্ষা করব। পানির মশক মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। একটি তরবারি সংগ্রহ করে নিয়ে শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করলাম। কখনো কখনো তীর নিক্ষেপ করছিলাম। এ ঘটনা ঘটার সময় তাঁর কাঁধে যে ক্ষত হয়েছিল,তা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : লোকেরা যখন শত্রুবাহিনীর বিপরীত দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল,তখন পলায়নরত এক ব্যক্তির উপর মহানবীর দৃষ্টি পড়ে। তিনি বললেন : এখন যে পালিয়ে যাচ্ছ,অন্তত তোমার ঢালটি ফেলে যাও। সে ঢালটি মাটিতে ফেলে দিল। আমি সেই ঢালটি নিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ইবনে কুমিআ নামক এক ব্যক্তি সজোরে চিৎকার দিয়ে বলছে,মুহাম্মদ কোথায় আছে? সে মহানবীকে চিনতে পেরে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ করতে আসে। আমি ও মুসআব তাকে তার লক্ষ্যের দিকে যেতে বাধা দিলাম। সে আমাকে পেছনে তাড়ানোর জন্য আমার কাঁধের উপর একটি আঘাত করে। আমি যদিও তাকে কয়েক বার আঘাত করেছি;কিন্তু তার আঘাত আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিল,যা এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তার শরীরে দু টি বর্ম ছিল। এজন্য আমার আঘাত তার ওপর কার্যকর প্রভাব রাখে নি।

আমার কাঁধের ওপর যে আঘাত লাগে,তা খুবই মারাত্মক ছিল। মহানবী (সা.) আমার আঘাতের কথা বুঝতে পারেন। তিনি দেখতে পেলেন,তা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার এক ছেলেকে ডেকে বললেন : তোমার মায়ের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দাও। সে আমার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। আমি আবার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত হলাম।

এর মধ্যে আমি দেখতে পেলাম,আমার এক ছেলে আহত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ আহতদের পট্টি বাঁধার জন্য যে কাপড় সাথে এনেছিলাম,তা দিয়ে আমার ছেলের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলাম। এ সময় মহানবীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির দিকে আমার ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করে

বললাম :قم فضارب القوم হে বৎস! ওঠ,যুদ্ধে অবতীর্ণ হও।

মহানবী (সা.) এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য বিস্ময়বোধ করলেন। যখনই তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন,তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক। প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী,যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল,এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে,তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল। এবার মহিলার বীরত্বের ব্যাপারে মহানবীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি বিস্ময়ে হেসে ফেললেন এমনভাবে যে,তাঁর পেছনের সারির দাঁতগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তিনি বললেন : তোমার সন্তানের যথার্থ প্রতিশোধ নিয়েছ। 55

পরের দিন যখন মহানবী (সা.) তাঁর সেনাদলকে হামরাউল আসাদ -এর দিকে পরিচালিত করলেন,নাসীবাও সেনাবাহিনীর সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হবার কারণে তাঁকে যাবার অনুমতি দেয়া হয় নি। মহানবী হামরাউল আসাদ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে এক ব্যক্তিকে নাসীবার ঘরে পাঠান যাতে তিনি নাসীবার অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবগত করেন। মহানবী তাঁর সুস্থতার সংবাদ পেয়ে খুশী হন।

এই নারী এত ত্যাগের বিনিময়ে মহানবীর কাছে আবেদন করেন,যাতে তিনি তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন,মহান আল্লাহ্ যেন তাঁকে বেহেশতে মহানবীর নিত্য সহচর করেন। মহানবীও তাঁর জন্য দুআ করেন এবং বলেন : হে আল্লাহ্! এদেরকে বেহেশতে আমার সাথী করে দিন। 56

এই মহিয়সী নারীর বীরত্বের দৃশ্য মহানবীকে এতখানি আনন্দিত করে যে,তিনি এই মহিলা সম্পর্কে বলেছিলেন :لمقام نسيبة بنت كعب اليوم خير من فلان و فلان আজ নাসীবা বিনতে কা ব-এর মর্যাদা অমুক অমুকের চাইতে শ্রেষ্ঠ।

ইবনে আবীল হাদীদ লিখেছেন,হাদীস বর্ণনাকারী মহানবীর প্রতি খেয়ানত করেছেন। কেননা এ দু ব্যক্তির নাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন নি।57 তবে আমি মনে করি,অমুক অমুক বলতে ঐ লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,যাঁরা রাসূলের পরে মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন;বর্ণনাকারী তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাজনিত ভীতির কারণেই কথাটি অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন।


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53