চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79203
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79203 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চল ও দেশসমূহে রিসালতের দূতগণ

মহানবী (সা.) একটি বৃহৎ পরামর্শসভায় অন্য সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো (বিশ্বের বিভিন্ন দেশের) শাসনকর্তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের দাওয়াতের বিষয়টি উত্থাপন করেন। একদিন তিনি তাঁর সাহাবীগণকে বললেন : সকালে তোমরা সবাই উপস্থিত থাকবে যাতে আমি তোমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করতে পারি।” পরের দিন ফজরের ফরয নামায আদায় করার পর তিনি সাহাবীগণকে বললেন :

“তোমাদের উচিত মহান আল্লাহর বান্দাদেরকে উপদেশ প্রদান করা;যে ব্যক্তি জনগণের তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচালক হবে এবং তাদের সুপথ প্রদর্শন ও হেদায়েতের ব্যাপারে চেষ্টা করবে না,মহান আল্লাহ্ তার জন্য বেহেশ্ত হারাম করে দিয়েছেন। তোমরা প্রস্তুত হয়ে যাও এবং দূর-দূরান্তের অঞ্চলসমূহে রিসালতের বার্তাবাহী দূত হয়ে বিশ্ববাসীদের কানে তাওহীদের শাশ্বত আহবান পৌঁছে দাও। তবে হযরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারীদের মতো তোমরা কখনো আমার বিরোধিতা করো না।” তখন মহানবীর কাছে তাঁরা প্রশ্ন করলেন : তারা কীভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল?”   তিনি জবাবে বলেছিলেন : তিনিও আমার মতো তাঁর একদল সাহাবীকে বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর রিসালতের বার্তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। তখন তাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি,যাদের যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত ছিল (অর্থাৎ যাদের গন্তব্যস্থল নিকটবর্তী ছিল),তারা তাঁর নির্দেশ মেনে নিয়েছিল;কিন্তু যাদের যাত্রাপথ দীর্ঘ ছিল,তারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।”

অতঃপর মহানবী (সা.) সবচেয়ে দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে ছয় জনকে তাঁর বিশ্বজনীন রিসালতের কথা উল্লেখসহ পত্র সমেত বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের উদ্দেশে প্রেরণ করলেন। আর এভাবে হেদায়েতের বার্তাবাহক দূতগণ একই দিনে ইরান,রোম,হাবাশা,মিশর,ইয়ামামাহ্, বাহরাইন ও হীরার (জর্দান) উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।200

মহানবীর পত্রসমূহ লেখা শেষ হলে কতিপয় ব্যক্তি,যাঁরা তখনকার রাজদরবারগুলোর রীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন,মহানবীর কাছে আরজ করলেন,পত্রসমূহে যেন তিনি সীলমোহর দেন;কারণ,বিশ্বের সম্রাট,রাজা ও শাসকগণ স্বাক্ষরবিহীন পত্র পাঠ করেন না। তাই মহানবীর নির্দেশে তাঁর জন্য একটি রূপার আংটি তৈরি করা হয়,যার উপর তিন লাইনেمحمّد رسول الله মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্’ খোদাই করে লেখা হয়েছিল। এ আংটিতে খোদাই কাজ এমনভাবে করা হয়েছিল যে, আল্লাহ’ শব্দ সবচেয়ে উপরে,রাসূল শব্দ মাঝখানে এবং মুহাম্মদ শব্দ নিচে স্থান পেয়েছিল। আর জাল করার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই এ ধরনের সূক্ষ্ম ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং পাঠকের উচিত স্বাক্ষর বা সীলমোহরকে নিচ থেকে শুরু করে আল্লাহ্’ শব্দ পর্যন্ত পাঠ করা। মহানবী (সা.) একেও যথেষ্ট মনে করেন নি এবং পত্রের খাম বিশেষ এক ধরনের মোম দিয়ে বন্ধ করে তার উপর মোহরাংকিত করে দেন।201

রিসালত প্রচারের যুগে বিশ্ব-পরিস্থিতি

তৎকালীন বিশ্বের সমুদয় শক্তি ও কর্তৃত্ব দুই সাম্রাজ্যের হাতের মুঠোয় ছিল। আর এ কারণে এ দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধের এক দীর্ঘ অতীত ইতিহাস ছিল। ইরান ও রোমের মধ্যকার যুদ্ধ হাখামানেশী যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল এবং তা সাসানীয় যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রাচ্য পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। তখন ইরাক,ইয়েমেন এবং এশিয়া মাইনরের একাংশ পারস্যের শাহানশাহী প্রশাসনের উপনিবেশ বলে গণ্য হতো। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্য পশ্চিম ও পূর্ব-এ দু অংশে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ রোমান সম্রাট থিওডর দ্য গ্রেট 359 খ্রিষ্টাব্দে নিজ সাম্রাজ্যকে দুই পুত্রের মধ্যে পশ্চিম রোম ও পূর্ব রোম নামের দুই দেশে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। পশ্চিম রোম 476 খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ইউরোপের অসভ্য ও বর্বর জাতিগুলোর আক্রমণের মুখে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে পূর্ব রোম,যার রাজধানী ছিল কন্সটান্টিনোপল এবং শাম ও মিশর যার শাসনাধীন ছিল,তা দীন ইসলামের আবির্ভাবকালে তদানীন্তন বিশ্বের এক বিরাট অংশের ওপর স্বীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। অবশেষে 1453 খ্রিষ্টাব্দে যখন কন্সটান্টিনোপল বিজয়ী বীর তুর্কী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের হাতে পদানত হয়,তখন পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ও প্রশাসনের সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় এবং তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। আরব উপদ্বীপও ঐ সময় এ দুই পরাশক্তির দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। তবে যেহেতু সেখানে উর্বর ভূখণ্ড ছিল না এবং সেখানকার অধিবাসীরাও যাযাবর জীবন যাপন করত ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত,সেহেতু এ দুই সাম্রাজ্য কখনো উক্ত অঞ্চল দখল ও পদানত করার ইচ্ছা প্রকাশ করত না। তাদের (এ দুই সামাজ্য) গর্ব,অন্যায়-অবিচার এবং যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো তাদেরকে আরব উপদ্বীপে যে এক মহান বিপ্লব এবং মৌলিক পরিবর্তনের শুভ সূচনা হতে যাচ্ছে,সে ব্যাপারে অবগত হওয়া থেকে বিরত রেখেছিল। তারা কখনো ভাবতে পারে নি যে,সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে অবস্থানকারী একটি জাতি ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এ দুই সাম্রাজ্য ও পরাশক্তির পতন ঘটাবে এবং যেসব অঞ্চল তাদের অন্যায় ও শোষণের কারণে অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল,সেগুলোকে ইসলাম ধর্মের উজ্জ্বল আলোক-প্রভার দ্বারা উদ্ভাসিত করবে। তারা যদি আগে থেকেই এ আলোকবর্তিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হতে পারত,তা হলে ইসলাম ধর্মের সূচনালগ্নেই এ ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দিত।

রোমান সাম্রাজ্যে ইসলামের বার্তাবাহী দূত

রোমান সম্রাট কায়সার (সিজার) মহান আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হলে এ মহাবিজয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ তিনি তাঁর রাজধানী কন্সটান্টিনোপল থেকে পায়ে হেঁটে বাইতুল মুকাদ্দাস’ যিয়ারত করতে যাবেন। তিনি যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর তাঁর মানত পুরো করেছিলেন এবং পায়ে হেঁটে বাইতুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন।

দাহিয়াহ্ কালবী রোমান সম্রাটের কাছে পত্র পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি শামদেশে বহু বার সফর করেছিলেন বিধায় সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর পূর্ণ জ্ঞান ছিল। তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা ও  দৈহিক গড়ন এবং তাঁর সুন্দর চারিত্রিক গুণ,সর্বোপরি তাঁর বহুমুখী যোগ্যতাই এ অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা তাঁর জন্য অত্যাবশ্যক করে দিয়েছিল। কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশে শাম ত্যাগ করার আগেই বুসরা’ নামের একটি শহরে তিনি জানতে পারলেন,রোমান সম্রাট কায়সার বাইতুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন। এ কারণেই তিনি বিলম্ব না করেই বুসরার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হারিস ইবনে আবী শিমরের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মিশন সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন।

আত তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থের লেখক202 লিখেছেন :

“মহানবী (সা.) তাঁকে (দাহিয়াহ্ কালবী) বুসরার শাসনকর্তার কাছে পত্রখানা হস্তান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি তা রোমান সম্রাটের কাছে পৌঁছে দেন। সম্ভবত মহানবী (সা.) এ নির্দেশ এ কারণে দিয়েছিলেন,তিনি ব্যক্তিগতভাবে কায়সারের এ সফর সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলেন বা দাহিয়াহ্ কাল্বীর সফরের সুযোগ-সুবিধা সীমিত ছিল এবং কন্সটান্টিনোপল পর্যন্ত তাঁর সফর করাটাও ছিল কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।

যা হোক,মহানবীর প্রেরিত দূত বুসরার শাসনকর্তার সাথে যোগাযোগ করলেন। আর তিনিও আদী ইবনে হাতেমকে ডেকে পাঠিয়ে মহানবীর দূতের সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস পানে যাত্রা করে রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে মহানবীর পত্র পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

মহানবীর দূত হিমস শহরে কায়সারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি কায়সারের সামনে উপস্থিত হতে চাইলে দরবারের কর্মকর্তারা তাঁকে বললেন : আপনি অবশ্যই কায়সারকে সিজদাহ্ করবেন। তা না হলে সম্রাট আপনার দিকে মোটেই ফিরে তাকাবেন না এবং আপনার পত্রও গ্রহণ করবেন না।” মহানবীর প্রেরিত বুদ্ধিমান দূত দাহিয়াহ্ বললেন : আমি ভুল প্রথাসমূহ গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যই এত কষ্ট স্বীকার করে সফর করে এসেছি। আমি মুহাম্মদ’ নামক একজন রাসূলের পক্ষ থেকে রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে এ বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছি। মানবপূজা অবশ্যই রহিত ও বিলুপ্ত করতে হবে এবং এক-অদ্বিতীয় আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ইবাদত করা যাবে না। এ বিশ্বাস সহকারে কিভাবে আমি আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেব এবং মহান আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তার সিজদাহ্ করব?

দরবারের কর্মকর্তাগণ মহানবীর দূতের শক্তিশালী যুক্তিতে বিস্মিত হয়েছিলেন। দরবারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষি কর্মকর্তা দাহিয়াকে বললেন : আপনি সম্রাটের বিশেষ টেবিলের উপর পত্রখানা রেখে আসতে পারেন;আর সম্রাট কায়সার ছাড়া অন্য কেউ টেবিলের উপর রাখা পত্রের উপর হাত দেবেন না এবং সম্রাট যখনই ঐ পত্র পড়বেন,তখনই তিনি আপনাকে তাঁর কাছে ডেকে পাঠাবেন।”

কায়সার পত্রখানা  খুললেন। আল্লাহর নামে’ (بسم الله )-এ বাক্য দিয়ে এ পত্র শুরু করা হয়েছিল। তা সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তিনি বললেন : আমি একমাত্র সুলাইমান (আ.) ছাড়া এ পর্যন্ত আর কারো কাছ থেকে এ ধরনের পত্র দেখি নি।” এরপর তিনি আরবী ভাষার বিশেষ অনুবাদককে পত্রখানা অনুবাদ করে তাঁকে পড়ে শোনানোর জন্য তলব করলেন। অনুবাদক মহানবীর পত্র এভাবে অনুবাদ করলেন :

-মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর কাছ থেকে রোম সাম্রাজ্যের প্রধান জনাব হিরাক্লিয়াসের প্রতি (প্রেরিত এ পত্র)। হেদায়েতের অনুসারীদের ওপর সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন,তা হলে আপনিও নিরাপত্তা লাভ করবেন এবং মহান আল্লাহ্ও আপনাকে পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন,তা হলে আরীসী203 দের পাপও আপনার উপর বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! আমরা আপনাদেরকে একটি অভিন্ন মূলনীতির দিকে আহবান করছি। আর তা হলো,আমরা মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন সত্তার ইবাদত করব না,আমরা অন্য কোন সত্তাকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করব না এবং আমরা পরস্পরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করব না। আর (হে মুহাম্মদ!) তারা যদি সত্য ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়,তা হলে আপনি (তাদের) বলে দিন : তোমরা সবাই সাক্ষী থেকো,আমরা সবাই মুসলমান। 204

মহানবী (সা.)-এর অবস্থা জানতে রোমান সম্রাটের অনুসন্ধান শুরু

পত্রের লেখক তাওরাত ও ইনযীলের প্রতিশ্রুত মুহাম্মদই হবেন বলে রোমের কর্ণধার এ সম্ভাবনার কথা জানালেন। এ কারণেই তিনি তাঁর জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন : সমগ্র শামদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াও;সম্ভবত মুহাম্মদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি বা যারা তাঁর অবস্থা সম্পর্কে অবগত,তাদের মধ্য থেকে কাউকে খুঁজে বের করতে পারবে,যাদের কাছে থেকে আমি মুহাম্মদ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী লাভ করতে পারব।” ঘটনাক্রমে ঐ দিনগুলোতে একদল কুরাইশসহ আবু সুফিয়ান ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে শামদেশে গমন করেছিল। রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজকীয় কর্মকর্তা তাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সবাইকে বাইতুল মুকাদ্দাসে সম্রাটের কাছে নিয়ে গেলেন। রোমান সম্রাট তাদের জিজ্ঞেস

করলেন : আপনাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি আছে কি,মুহাম্মদের সাথে যার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে?”   আবু সুফিয়ান তখন নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বলল : আমরা ও তিনি একই গোত্রভুক্ত এবং আমাদের ও তাঁর ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পিতৃপুরুষ হচ্ছেন আব্দে মানাফ।” রোমান সম্রাট তখন নির্দেশ দিলেন আবু সুফিয়ান যেন তাঁর সামনে দাঁড়ায় এবং কাফেলার অন্যান্য ব্যক্তি তার পেছনে থেকে তার কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শোনে এবং লক্ষ্য রাখে। যখনই সে সম্রাটের প্রশ্নের দূরভিসন্ধিমূলক জবাব দেবে তখন তারা তৎক্ষণাৎ তার ভুল বা মিথ্যা বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করবে। এ অবস্থায় সম্রাট আবু সুফিয়ানের কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো করলেন এবং সেও সেগুলোর উত্তর দিল:

–মুহাম্মদের বংশ পরিচয় কেমন?

–তাঁর পরিবার বা বংশ অত্যন্ত সম্মানিত,মর্যাদাবান ও মহান।

–তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন কি,যিনি জনগণের উপর রাজত্ব করেছেন?

–না,কখনো এমন কেউ ছিলেন না।

–নবুওয়াতের দাবী করার আগে কি তিনি মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতেন?

–হ্যাঁ,মুহাম্মদ সত্যবাদী ছিলেন।

–সমাজের কোন্ শ্রেণী তাঁর অনুসারী এবং তাঁর ধর্ম গ্রহণ করছে?

–অভিজাত শ্রেণী তাঁর বিরোধী এবং সমাজের সাধারণ ও মধ্য পর্যায়ের লোকেরা তাঁর একনিষ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থক।

–তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা কি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে?

–হ্যাঁ।

–তাঁর অনুসারীদের মধ্য থেকে কি কোন ব্যক্তি এ পর্যন্ত তাঁর ধর্ম ত্যাগ করেছে?

–না।

–তিনি কি শত্রু ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী অথবা পরাজিত হন?

–কখনো তিনি বিজয়ী,আবার কখনো তিনি পরাজয়ের সম্মুখীন হন।

সম্রাট তখন দোভাষীকে বললেন : আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীদের বল,তোমাদের তথ্য যদি সঠিক হয়,তা হলে তিনি অবশ্যই শেষ যামানার প্রতিশ্রুত নবী।” তিনি সবশেষে বললেন : আমি আগে থেকে অবগত ছিলাম,এ ধরনের এক নবীর আবির্ভাব হবে। তবে আমি জানতাম না তিনি কুরাইশ বংশীয় হবেন। আমি তাঁর সামনে বিনয়াবনত হতে এবং সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর পদযুগল ধৌত করতে প্রস্তুত। আর অতি শীঘ্রই তাঁর শক্তি,মর্যাদা ও মহত্ত্ব সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যকে ঘিরে ফেলবে।”

রোমান সম্রাটের ভ্রাতুষ্পুত্র বলল : মুহাম্মদ তাঁর পত্রে আপনার নামের আগে তাঁর নিজের নাম উল্লেখ করেছেন।” এ সময় সম্রাট তাকে ধমক দিয়ে বললেন : তাঁর প্রতি নামূসে আকবার’ অর্থাৎ ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। আমার নামের উপর তাঁর নাম অগ্রগণ্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”

আবু সুফিয়ান বলে : মুহাম্মদের প্রতি রোমান সম্রাট অকুণ্ঠ দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করায় রাজদরবারে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল এবং আমি এ ঘটনা ঘটায় খুবই অসন্তুষ্ট হলাম এ কারণে যে,মুহাম্মদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি এতটা বেড়ে যাবে যে,এর ফলে রোমান জাতিও তাকে ভয় পেতে থাকবে। যদিও প্রশ্ন ও উত্তরের শুরুতে আমি রোমান সম্রাট কায়সারের কাছে মুহাম্মদকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম এবং আমি বলছিলাম,আপনি মুহাম্মদ সম্পর্কে যা শুনেছেন আসলে সে তার চেয়ে অনেক তুচ্ছ;তবে কায়সার আমার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রতি মোটেই কর্ণপাত করলেন না এবং বললেন : আমি আপনাকে যা জিজ্ঞেস করব,আপনি কেবল সে প্রশ্নেরই উত্তর দেবেন। 205

কায়সারের উপর মহানবী (সা.)-এর পত্রের প্রভাব

আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট ও তথ্যাবলীকে রোমান সম্রাট যথেষ্ট মনে করলেন না;বরং তিনি পত্রসমেত বিষয়টি রোমের একজন পণ্ডিতের কাছে উত্থাপন করলেন। আর সেই পণ্ডিতও জবাবে লিখলেন : ইনি সেই নবী যাঁর জন্য সমগ্র বিশ্ব অপেক্ষমান।” রোমান সম্রাট রোমের সর্দার ও নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য একটি ধর্মীয় আশ্রমে এক বিরাট সমাবেশের আয়োজন করে সেখানে মহানবীর পত্র তাদেরকে পড়ে শুনালেন এবং বললেন : তোমরা কি তাঁর কর্মসূচী ও ধর্মের সাথে একমত (অর্থাৎ তা গ্রহণ করার ব্যাপারে সম্মত আছ কি?)।” সাথে সাথেই এ সভায় এক বড় ধরনের গোলযোগ বেঁধে গেল। তাদের মতপার্থক্য ও বিরোধিতার কারণে স্বয়ং রোমান সম্রাট নিজের প্রাণনাশের আশংকা করলেন। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ উক্ত সভাস্থলের উঁচু জায়গায় স্থাপিত তাঁর আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে লক্ষ্য করে বললেন : আমার এ প্রস্তাবটা ছিল তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। তাই হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর ধর্মের প্রতি তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি সত্যি আমাকে বিস্মিত করেছে এবং তা আমার কাছে প্রশংসনীয়।”

কায়সার দাহিয়াহকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে সম্মান করলেন এবং মহানবীর পত্রের জবাব লিখে কিছু উপহারও তাঁর সাথে প্রেরণ করলেন। সম্রাট এ পত্রে মহানবীর প্রতি স্বীয় বিশ্বাস,ভক্তি ও নিষ্ঠা ব্যক্ত করেছিলেন।206