চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84018 / ডাউনলোড: 7998
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

পারস্য-সম্রাটের দরবারে মহানবী (সা.)-এর দূত

মহানবী (সা.)-এর দূত ইরানের শাহী দরবারের উদ্দেশে রওয়ানা হবার সময়ে ইরান অর্থাৎ পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন খসরু পারভেজ। তিনি আনুশীরওয়ানের (নওশেরওয়ান) পর ইরানের দ্বিতীয় নৃপতি ছিলেন,যিনি মহানবী (সা.)-এর হিজরতেরও ৩২ বছর আগে পারস্যের রাজসিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। এ দীর্ঘ ৩২ বছরে তাঁর সরকার ও প্রশাসন অসংখ্য তিক্ত ও মধুর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। তাঁর শাসনামলে ইরানের শক্তি সম্পূর্ণরূপে দোদুল্যমান ছিল। ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি একদিন এশিয়া মাইনরের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা কন্সটান্টিনোপল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

হযরত ঈসা (আ.)-এর ক্রস,যার চেয়ে অধিকতর পবিত্র আর কিছুই খ্রিষ্টানদের কাছে ছিল না,তা তীসকূন্ অর্থাৎ মাদায়েনে আনা হলো এবং রোমের সম্রাট সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার জন্য একজন দূতকে পারস্যের রাজদরবারে প্রেরণ করলেন। ইরানের সীমান্ত,হাখামানেশী যুগে পারস্যসাম্রাজ্য যতখানি বিস্তৃতি লাভ করেছিল,সম্রাট খসরু পারভেজের রাজত্বকালে ততখানি বিস্তৃতি লাভ করেছিল। কিন্তু পরে তদানীন্তন পারস্য সম্রাটের অদক্ষতা,অব্যবস্থাপনা,মাত্রাতিরিক্ত অহংকার এবং ভোগ-বিলাসের কারণে ইরান অধঃপতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। বিজিত অঞ্চলসমূহ একের পর এক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল এবং শত্রুবাহিনী পারস্য সাম্রাজ্যের একেবারে কেন্দ্রস্থল অর্থাৎ তীসফূনের কাছে দাস্তগার্দ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে গেল যে,স্বয়ং সম্রাট খসরু পারভেজ রোমানদের ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্রাটের এ গর্হিত কাজ (পলায়ন) ইরানী জাতিকে অতিশয় ক্রুদ্ধ করেছিল এবং অবশেষে তিনি (সম্রাট) নিজ সন্তান শীরাভেইয়ের হাতেই নিহত হয়েছিলেন।

ইতিহাস বিশ্লেষণকারী জ্ঞানীগুণীগণ সম্রাট খসরু পারভেজের গর্ব-অহংকার,স্বার্থপরতা,স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিলাসিতা ও আমোদ-প্রমোদকে পারস্য সাম্রাজ্যের দক্ষতা ও শক্তিতে ভাটা পড়ার কারণ বলে গণ্য করেন। সম্রাট যদি সন্ধি প্রস্তাব আনয়নকারী দূতের বার্তা গ্রহণ করতেন,তা হলে সন্ধি ও শান্তিচুক্তির ছত্রছায়ায় ইরানের গৌরব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকত।

মহানবীর প্রেরিত পত্র খসরু পারভেজের মন-মানসিকতার উপর ভালো প্রভাব রেখে না থাকলে তা এ পত্র বা পত্রবাহকের দোষ-ত্রুটির কারণে ছিল না,বরং তাঁর বিশেষ ধরনের মানসিকতা এবং সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা তাঁকে মহানবীর আহবান সম্পর্কে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা-ভাবনা করারও সুযোগ দেয় নি। দোভাষী মহানবীর পত্র অনুবাদ করে শেষ করতে পারে নি,এমন মুহূর্তে সম্রাট খসরু পারভেজ উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে মহানবীর পত্রখানি ছিঁড়ে ফেলেন।

হিজরতের সপ্তম বর্ষের শুরুতে২০৭ মহানবী তাঁর অন্যতম সাহসী সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ্ ইবনে হাযাফাহ্ কারাশীকে ইরানের রাজদরবারে সম্রাট খসরু পারভেজের কাছে একটি পত্র হস্তান্তর করে তাঁকে ইসলাম ধর্ম ও তাওহীদী আদর্শ গ্রহণ করার আহবান জানানোর দায়িত্ব প্রদান করেন। মহানবী (সা.)-এর পত্র ছিল নিম্নরূপ :

بسم الله الرّحمان الرّحيم من محمّد رسول الله الى كسري عظيم فارس، سلام علي من اتّبع الهدي و آمن بالله و رسوله و أشهد ان لا اله الّا الله  وحده لا شريك له و أن محمّدا عبده و رسوله، أدعوك بدعاية الله، فانّى أنا رسول النّاس كافة لأنذر من كان حيّا و يحقّ القول علي الكافرين، أسلم تسلم، فان أبيت فعليك اثم المجوس

“পরম করুণাময় ও চির দয়ালু মহান আল্লাহর নামে। মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্য সম্রাট খসরুর প্রতি। যে সত্যান্বেষণ করে,মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং সাক্ষ্য দেয়,-কেবল তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই,তাঁর কোন শরীক ও সমকক্ষ নেই,আর বিশ্বাস করে,মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল,তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি মহান আল্লাহর নির্দেশে আপনাকে মহান আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। তিনি সমগ্র মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন যাতে আমি তাদেরকে তাঁর ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন এবং অবিশ্বাসীদের ওপর মহান আল্লাহর যুক্তি পরিপূর্ণ করি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুন,তা হলে আপনিও নিরাপত্তা লাভ করবেন। আর যদি আপনি ঈমান ও ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন,তা হলে মাজুস্ জাতির (সকল যারথুস্ত্র ধর্মাবলম্বীর) পাপের বোঝা আপনার কাঁধে বর্তাবে। ২০৮

ইরানের মিষ্টভাষী কবি হাকীম নিযামী এ ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা কবিতায় বর্ণনা করেছেন :

হে দুর্বল অক্ষম নৃপতি! তোমার নাম খসরু

এমনকি যদি তুমি হও শত পানপাত্রের অধিকারী কায়খসরু২০৯

হয়ো না অংহকারী,কারণ অহংকারী যে,নেই তার অন্তর্দৃষ্টি,

হও স্রষ্টাদ্রষ্টা;কারণ আত্মম্ভরিতায় নেই কোন গুণ ও নিপুণতা;

সাক্ষ্য দাও,এ বিশ্ব-জগতের রয়েছেন এমন স্রষ্টা

যিনি নেই কোন স্থানে আবদ্ধ,আর না যিনি কোন স্থানের মুখাপেক্ষী

এমন স্রষ্টা,যিনি মানুষকে দিয়েছেন নেতৃত্ব

আর তিনিই দিয়েছেন আমাকে মানুষের ওপর পয়গম্বরী।

মহানবীর দূত রাজদরবারে প্রবেশ করলেন। খসরু পারভেজ তাঁর হাত থেকে পত্র নেয়ার আদেশ দিলেন। দূত বললেন : আমি অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতে মহানবীর পত্র অর্পণ করব।” খসরু পারভেজ দোভাষীকে তলব করলেন। দোভাষী পত্র খুলে অনুবাদ করল :

এটা মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্যের সম্রাট খসরুর প্রতি। তখনও অনুবাদক পত্র পড়ে শেষ করতে পারে নি,অমনি ইরানের অধিপতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে অনুবাদকের হাত থেকে পত্রখানা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন এবং চিৎকার করে বললেন : এ লোকটির স্পর্ধা দেখ! সে আমার নামের আগে নিজের নাম লিখেছে!”   তৎক্ষণাৎ পারস্য সম্রাট আবদুল্লাহকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন। আবদুল্লাহ্ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এলেন এবং নিজের সওয়ারী পশুর উপর আরোহণ করে মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি মহানবীর নিকট পুরো ঘটনা বিস্তারিত বললেন এবং মহানবীও সম্রাট খসরুর অবমাননাকর আচরণে খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর মুখমণ্ডলে তীব্র ক্রোধের চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠল। মহানবী (সা.) সম্রাট খসরু সম্পর্কে বললেন :اللهمّ مزّق ملكه হে আল্লাহ্! তার রাজত্বকে টুকরো টুকরো করে দিন। ২১০

ইরানের প্রসিদ্ধ কবি ও সুবক্তা সাহিত্যিক হাকীম নিযামী এ প্রসঙ্গে কবিতা রচনা করেছেন :

যখন দূত পেশ করলেন ঐ নতুন পত্র

তখন শাস্তিদানের অভিপ্রায়ে টগবগিয়ে উঠলো খসরুর রুধির

দেখল সে ভাবগাম্ভীর্যে উদ্দীপ্ত কালো রেখা২১১

যা মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারভেজের প্রতি লেখা

কার আছে এত পিত্ত-বুকের পাটা

আমার এত মর্যাদা সত্বেও সে কি না

আমার নামের উপর লিখে নিজের নাম!

গর্দান গুঁড়িয়ে দেয়ার পত্রখানা২১২ সে ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো

আসলে পত্র নয়;বরং সে নিজেকেই ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো

ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর মত

ইয়াকুবীর প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে ওয়াজেহ একটি বর্ণনায় এমন কিছু বলেছেন যা সকল ঐতিহাসিকের মতের বিপরীত। তিনি লিখেছেন,খসরু পারভেজ (পারস্য সম্রাট) মহানবী (সা.)-এর পত্র পড়ে তাঁর সম্মানে এক খণ্ড রেশমী বস্ত্র ও সুগন্ধী উপহার হিসেবে পাঠান। মহানবী সুগন্ধিটি গ্রহণ করে সাহাবীগণের মধ্যে বিলিয়ে দেন। কিন্তু রেশমী বস্ত্র সম্পর্কে বলেন,তা পুরুষদের জন্য হারাম। অতঃপর বলেন : ইসলাম তার ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে। ২১৩

এক্ষেত্রে একমাত্র আহমদ ইবনে হাম্বল ছাড়া অন্য কোন ঐতিহাসিকের মতই ইয়াকুবীর অনুরূপ নয়। তিনি অনুরূপ মত ব্যক্ত করে বলেছেন,মহানবীর জন্য খসরু পারভেজ কিছু উপহার পাঠান।২১৪

ইয়েমেনের শাসনকর্তার প্রতি খসরু পারভেজের নির্দেশ

ইয়েমেন মক্কার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি অঞ্চল। সেখানে সবসময়ই পারস্যের সাসানী সম্রাটের নিযুক্ত প্রতিনিধি শাসনকাজ পরিচালনা করত। তখন সেখানকার শাসনকর্তা ছিল বজান। খসরু পারভেজ অহংকারবশত ইয়েমেনের শাসনকর্তাকে পত্র লিখলেন :

“আমার নিকট খবর পৌঁছেছে,মক্কার কুরাইশ বংশের এক ব্যক্তি নবুওয়াত দাবী করেছে। তোমার সেনাদলের দু জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তাকে গ্রেফতারের জন্য প্রেরণ কর,যাতে তারা তাকে গ্রেফতার করে আমার কাছে নিয়ে আসে। ২১৫

ইবনে হাজার তাঁর আল ইসাবাহ্’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,খসরু তার এই সেনাপতিকে নির্দেশ দেন রাসূলকে তাঁর পূর্বসূরিদের ধর্মে বিশ্বাস আনয়নে বাধ্য করতে এবং যদি তিনি তা করতে অস্বীকার করেন,তবে তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন করে তার নিকট প্রেরণ করতে। পারস্য সম্রাটের এ পত্র তার অজ্ঞতার পরিচায়ক। কারণ তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে এতটা অনবগত ছিলেন যে,তিনি জানতেন না এই নবুওয়াতের দাবীদার ছয় বছরের অধিক সময় হলো মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন এবং তাঁর প্রভাব সেখানে এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে,বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্রাটদের উদ্দেশে পত্র দিচ্ছেন। এমন ব্যক্তিত্বকে বন্দী করার জন্য দু জন সেনাপতি প্রেরণ সত্যিই হাস্যকর!

ইয়েমেনের শাসনকর্তা কেন্দ্রীয় নির্দেশে দুই শাক্তিশালী সেনাপতি ফিরুয ও খার খাসরাহকে হিজাযের উদ্দেশে প্রেরণ করল। এ দু জন মক্কার নিকটবর্তী তায়েফে গিয়ে এক কুরাইশ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করল। সে তাদেরকে বলল,আপনাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি মদীনায় বসবাস করছে। তারা মদীনায় মহানবী (সা.)-এর সামনে উপস্থিত হয়ে বজানের পত্র তাঁর হাতে দিয়ে বললেন : আমরা ইয়েমেনের শাসকের পক্ষ থেকে আপনাকে বন্দী করে ইয়েমেনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছি। সম্ভবত আপনি ইয়েমেনে গেলে বজান আপনার পক্ষে খসরু পারভেজের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। অন্যথায় আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং সেক্ষেত্রে সাসানী শাসকদের ক্ষমতার মোকাবেলায় আপনারা পর্যুদস্ত হবেন,আপনাদের ঘরগুলো ধ্বংস হবে ও পুরুষরা নিহত হবে...।”

মহানবী (সা.) শান্তভাবে তাদের কথা শুনলেন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তাদের দীর্ঘ গোঁফ দেখে তা যে তাঁর অপছন্দ হয়েছে তা বোঝাতে মহানবী বললেন : আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন শ্মশ্রু দীর্ঘ করার এবং গোঁফ ছোট রাখার। ২১৬

মহানবী (সা.)-এর শান্ত ও আকর্ষণীয় সৌম্য চেহারা মুবারক এবং ব্যক্তিত্বময় রূপ তাদের ওপর এতটা প্রভাব ফেলেছিল যে,যখন তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন,তাদের দেহ শিহরিত হচ্ছিল।

মহানবী তাদের বললেন : আজকে আপনারা যান। আগামীকাল আপনাদের আমার মত জানাব।”   ঐ দিনই মহানবী ওহী মারফত জানতে পারলেন,খসরু পারভেজ নিহত হয়েছে। পরের দিন ওই সেনাপতি রাসূলের নিকট উপস্থিত হলে তিনি বললেন : আমার মহান পালনকর্তা আমাকে জানিয়েছেন,খসরু পারভেজকে তার পুত্র শিরাভেই হত্যা করেছে এবং সে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছে।” যে রাতে খসরু নিহত হয়েছে বলে মহানবী ঘোষণা দিয়েছিলেন,তা ছিল জমাদিউল আউয়াল মাসের দশম দিন।২১৭

বজানের প্রেরিত সেনাপতিদ্বয় এ খবর শুনে চমকে উঠে বললেন : আপনার নবুওয়াতের দাবী অপেক্ষা এ কথা সাসানী সম্রাটকে অধিকতর ক্রোধান্বিত করবে। আমরা এ খবর বজানের নিকট পৌঁছিয়ে এ ব্যাপারে খসরু পারভেজকে জানাতে বলব।

মহানবী বললেন : আমি আরো খুশী হব যদি এ কথাটিও তাকে বলেন যে,আমি বলেছি :

إنّ دينِى و سلطانِى سيبلغ إلى منتهي الخفّ و الحافر

“আমার ধর্ম ও প্রভাব ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে,যেখানে অত্যন্ত দ্রুতগামী বাহনগুলো পৌঁছায়।”

অতঃপর মহানবী (সা.) তাঁকে প্রদত্ত এক আরব গোত্রপতির উপহার স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত একটি মূল্যবান কোমরবন্ধ ঐ দুই দূতকে উপহার দিলেন। উভয়ে এতে সন্তুষ্ট হয়ে ইয়েমেনে ফিরে গেল এবং বজানকে মহানবীর বক্তব্য সম্পর্কে জানালো।

বজান বলল : যদি এ খবর সত্য হয়,তবে নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর নবী এবং আমাদের উচিত তাঁকে অনুসরণ করা।” কিছু সময় অতিক্রান্ত না হতেই শিরাভেইয়ের দূত বজানের জন্য পত্র নিয়ে গেল। তাতে লেখা ছিল :

“তোমরা জেনে রাখ,আমি খসরু পারভেজকে হত্যা করেছি। জাতির ক্ষোভের কারণে আমি তাকে হত্যা করেছি। কারণ সে পারস্যের অভিজাত ব্যক্তিদের হত্যা করেছিল,সম্মানিতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। আমার পত্র পৌঁছা মাত্র জনগণ থেকে আমার পক্ষে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ কর। নবুওয়াতের দাবীকারী ব্যক্তিকে তাঁর নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও। আমার পিতার নির্দেশের অনুবর্তী হয়ে তাঁর সঙ্গে কঠোর আচরণ করো না;বরং আমার পরবর্তী নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”

শিরাভেইয়ের পত্র বজানসহ ইয়েমেনে নিযুক্ত ইরানী বংশোদ্ভূত সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করল। ফলে বজান সহ তার কর্মচারীরা রাসূলের নিকট পত্র দিয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানাল।

মিশরে ইসলামের দূত

মিশর প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি,ফিরআউন বংশের শাসকদের রাজধানী এবং কিবতীদের বাসভূমি ছিল। হেজাযের আকাশে ইসলামের সূর্য উদয় কালে মিশর তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। কারণ মুকুকেস রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল এ শর্তে যে,বছরে ঊনিশ মিলিয়ন দিনার কর শোধ করবে।

হাতেব ইবনে আবি বালতায়াহ্ একজন দক্ষ ও সাহসী অশ্বারোহী ছিলেন। মক্কা বিজয়ের ঘটনার সাথে তাঁর নামে বিখ্যাত এক ইতিহাস জড়িত আছে,যা আমরা অষ্টম হিজরীর ঘটনা প্রবাহের আলোচনায় উল্লেখ করব।

তিনি রাসূলের প্রেরিত ছয় দূতের একজন ছিলেন,যাঁরা তাঁর ইসলামের দাওয়াত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্রাটদের নিকট পৌঁছানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে মিশর শাসনকর্তা মুকুকেসের নিকট পত্র বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিলেন। মহানবীর পত্রের বাণী ছিল নিম্নরূপ :

بسم الله الرّحمان الرّحيم من محمّد بن عبد الله الى المقوقس عظيم القبط، سلام علي من اتّبع الهدي. امّا بعد، فانّى أدعوك بدعاية الاسلام، أسلم تسلم و اسلم يؤتك الله اجرك مرّتين. فان توليت فانما عليك اثم القبط <و يا أهل الكتاب تعالوا الى كلمة سواء بيننا و بينكم ان لا نعبد الّا الله و لا نُشرك به شيئا و لا يتخذ بعضنا بعضاً اربابا من دون الله فان تولّوا فقولوا اشهدوا بأنا مسلمون

“পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ পত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর পক্ষ থেকে কিবতী সম্রাট মুকুকেসের প্রতি। সত্যপন্থীদের ওপর মহান আল্লাহ্ শান্তি বর্ষণ করুন। আমি আপনাকে ইসলামের প্রতি আহবান করছি। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন,যাতে (মহান আল্লাহর শাস্তি হতে) নিরাপত্তা লাভ করতে পারেন। যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন,তবে আল্লাহ্ আপনাকে দু টি পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন,তবে মিশরবাসীদের গুনাহও আপনার ওপর বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! আমরা আপনাদের এমন এক মৌলনীতির দিকে আহবান করছি,যে বিষয়ে আমরা ও আপনারা সমান। আর তা হলো : আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করব না। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না। আল্লাহকে ছেড়ে আমরা নিজেদের মধ্যকার কাউকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে,তবে বলে দিন,সাক্ষী থাকুন,আমরা তো (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণকারী। ২১৮

মহানবীর দূত মিশরে প্রবেশ করে জানতে পারলেন মিশর সম্রাট সমূদ্র তীরবর্তী আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটি সুউচ্চ প্রাসাদে বাস করেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে দ্বীপের ন্যায় ভূখণ্ডের উপর অবস্থিত সম্রাটের প্রাসাদে নৌকায় পৌঁছলেন। সম্রাট তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। অতঃপর মহানবীর পত্র পড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। চিন্তার পর মাথা উঠিয়ে মহানবীর দূতকে বললেন : যদি মুহাম্মদ আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন,কিভাবে তাঁর শক্ররা তাঁকে তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারল এবং তিনি বাধ্য হয়ে মদীনায় গিয়ে বাস করতে লাগলেন? কেন তিনি তাদেরকে অভিশাপ দিলেন না,যাতে তারা তাঁর অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যায়?

মহানবীর প্রশিক্ষিত দূত বললেন : হযরত ঈসাও আল্লাহর নবী ছিলেন এবং আপনারা তাঁকে নবী বলে মানেন। বনী ইসরাঈল জাতি তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করলে কেন তিনি তাদের অভিশাপ দিলেন না,যাতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়?

মিশর সম্রাট এমন দাঁতভাঙ্গা জবাবের প্রতীক্ষায় ছিলেন না। তাই দূতের এই যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে নীরব হলেন। অতঃপর তাঁর প্রশংসা করে বললেন :

أحسنت أنت حكيم جئت من عند حكيم

“চমৎকার! নিশ্চয়ই আপনি জ্ঞানী এবং একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বের নিকট হতে এসেছেন। ২১৯

মিশরের শাসনকর্তার অভ্যর্থনায় দূত তাঁর সামনে ইসলাম প্রচারের সাহস পেলেন। তাই বললেন : আপনার পূর্বে এ ভূখণ্ডে অন্য কেউ (ফিরআউন) শাসন করত। সে মানুষের নিকট নিজেকে খোদা বলে পরিচয় দিত। কিন্তু পরিণতিতে আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করেছেন। আল্লাহ তা করেছেন এ জন্য যে,তা আপনাদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের কারণ হবে এবং আপনারা তার পথ অনুসরণ করে যেন অন্যদের জন্য শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ না হন। আমাদের নবী মানুষকে পবিত্র এক ধর্মের প্রতি আহবান জানান। কুরাইশ মুশরিকরা তাঁর সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ করেছে,বিদ্বেষপরায়ণ ইহুদীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে,কিন্তু খ্রিষ্টানরা তাঁর সবচেয়ে নিকটবর্তী। মহান আল্লাহর শপথ! যেমনভাবে হযরত মূসা ইবনে ইমরান (আ.) হযরত ঈসা (আ.)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন,ঠিক তেমনিভাবে হযরত ঈসাও আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করেছেন।

তাই আপনাদের ইসলাম ও আল্লাহর কিতাব আল কুরআন’ -এর প্রতি আহবান করছি,যেমনভাবে আপনারা তাওরাতের অনুসারীদের ইনযীলের প্রতি আহবান জানান। যে কেউ কোন নবীর আহবান শুনবে,তার উচিত হবে তাঁর অনুসরণ করা। আমি এক নবীর আহবান আপনাদের নিকট পৌঁছালাম। আপনার উচিত হবে নিজে ইসলাম গ্রহণ করে স্বজাতিকে এ ধর্ম অনুসরণের আহবান জানানো। আমি কখনোই আপনাদের হযরত ঈসার ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে বলছি না;বরং বলছি তাঁর অনুসৃত রীতি গ্রহণ করুন। তবে জেনে রাখুন,হযরত ঈসার ধর্মের পূর্ণ রূপই হলো ইসলাম। ২২০

মিশর সম্রাটের সাথে রাসূল (সা.)-এর দূতের সংলাপ শেষ হলো। কিন্তু মুকুকেস তখনও চূড়ান্ত কোন উত্তর প্রদান করেন নি। তাই হাতিব তাঁর জবাব ও পত্র গ্রহণের জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করলেন। একদিন মুকুকেস হাতিবকে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে নিয়ে একান্ত সংলাপে বসলেন। মহানবীর ধর্মবিশ্বাস ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (সা.)-এর দূত তাঁকে বললেন : তিনি মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি আহবান করে থাকেন,তাঁর অনুসারীদের প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার,রমজান মাসে রোজা রাখার,আল্লাহর গৃহে হজ্বে যাওয়ার,নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার নির্দেশ দেন। মৃত প্রাণী ও রক্ত ভক্ষণ হতে নিষেধ করেন;অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাতে বারণ করেন...।”

হাতিব রাসূল (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করলেন এবং তাঁর চরিত্র-বৈশিষ্ট বর্ণনা করে বক্তব্য শেষ করলেন। মিশরের শাসনকর্তা তাঁকে বললেন : নিশ্চয়ই এসব তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ। আমার ধারণা ছিল,শেষ নবী এখনো আসেন নি। আমি মনে করতাম,তিনি নবিগণের আবির্ভাবের কেন্দ্র সিরিয়ায় আবির্ভূত হবেন,হিজাযে নয়। হে মুহাম্মদের দূত! আপনি জেনে রাখুন,আমি যদি তাঁর ধর্ম মেনেও নিই,কিবতীরা (মিশরের অধিবাসীরা) তা গ্রহণ করবে না। আশা করি,আপনাদের নবীর ক্ষমতার বলয় মিশর পর্যন্ত প্রসারিত হোক এবং তাঁর সঙ্গীগণ এ দেশে অবস্থান গ্রহণ করুন। এভাবে স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের পরাস্ত করে তাদের বাতিল বিশ্বাসের ওপর জয়ী হোন। আমি আপনার নিকট চাই এ কথোপকথনের বিষয় গোপন রাখুন,যাতে কিবতীরা কেউ এ সম্পর্কে জানতে না পারে। ২২১

সাফল্যজনক প্রতিরক্ষা লড়াই ও পুনঃ বিজয়

ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যায়কে যদি পুনঃবিজয় বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে অতিরঞ্জিত কিছু বলা হবে না। এ বিজয় বলতে আমরা এ কথাই বুঝাতে চাই যে,মুসলমানরা শত্রুর প্রত্যাশার বিপরীতে মহানবীর জীবনকে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। মুসলিম বাহিনীর ভাগ্যে জুটে যাওয়া এটিই ছিল পুনঃবিজয়।

যদি এ বিজয়ে মুসলিম বাহিনীর সবাই অংশীদার বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে মুসলিম বাহিনীর প্রতি সম্মান প্রদশর্ন হিসেবে তা যথার্থই হবে। কিন্তু এ বিজয়ের আসল দায়িত্ব বহন করেছেন গুটিকতক মুসলমান,যাঁরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মহাসম্পদ অক্ষত থাকা এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকা নির্বাপিত না হওয়া এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির ত্যাগের ফল ছিল।

এখন এই আত্মত্যাগী মহান ব্যক্তিগণের সম্পর্কে কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করছি :

1. (উহুদের রণাঙ্গনে) প্রথম ব্যক্তি যিনি অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন তিনি ছিলেন সেই তরুণ,যাঁর জীবনের মাত্র 24টি বসন্ত অতিক্রম হয়েছিল এবং জীবনের শুরু থেকে মহানবীর ওফাতের দিন পর্যন্ত তাঁর পাশেই ছিলেন এবং এক মুহূর্তও তাঁর সাহচর্য ও তাঁর জন্য আত্মত্যাগ থেকে বিরত হন নি।

এই বীর সেনাপতি,এই প্রকৃত আত্মত্যাগী ছিলেন মুত্তাকীদের মওলা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মূলত এই পুনর্বার বিজয় সেই প্রথম বিজয়ের মতোই এই জান-নিসার বীর যোদ্ধার ত্যাগ ও বীরত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। কেননা যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের পলায়নের কারণ ছিল এই যে,তাদের পতাকাবাহীরা একের পর এক আলীর তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল। ফলে কুরাইশ বাহিনীর অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়েছিল এবং তাদের অটল থাকার শক্তি লোপ পেয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণকারী সমসাময়িক মিশরীয় লেখকগণ,হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা যতখানি প্রাপ্য বা অন্ততপক্ষে ইতিহাসে যতখানি লিপিবদ্ধ হয়েছে,ততখানি হক আদায় করেন নি। তাঁরা আমীরুল মুমিনীনের আত্মত্যাগকে অন্যদের ত্যাগের পর্যায়ভুক্ত করেছেন। এ কারণে হযরত আলীর আত্মত্যাগের বিবরণ এখানে দেয়া সমীচীন মনে করছি।

1. ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাসে46 লিখেছেন : মহানবী (সা.) সবদিক থেকে কুরাইশ বাহিনীর বিভিন্ন দলের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। যে দলই হযরতের ওপর আক্রমণ চালাতো,হযরত আলী মহানবীর নির্দেশে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতেন এবং তাদের কতিপয় লোককে হত্যা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। উহুদ যুদ্ধে এ ঘটনার কয়েকবার পুনরাবৃত্তি হয়। এ আত্মত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে ওহীর ফেরেশতা আগমন করেন এবং মহানবীর কাছে হযরত আলীর আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন এবং বলেন : এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ যা এ বীর সেনানায়ক তাঁর নিজ থেকে প্রদর্শন করেছেন। মহানবীও ওহীর বাহক ফেরেশতার উক্তি সত্যায়ন করে বলেন : আমি আলী হতে এবং সে আমা হতে। এরপর রণাঙ্গনে একটি আহবান-ধ্বনি শোনা গেল,যার বিষয়বস্তু হচ্ছে এ দু টি বাক্য :

لا سيف إلّا ذو الفقار لا فتى إلّا علىّ

অর্থাৎ একমাত্র যে তরবারী যুদ্ধে অবদান রাখতে পারে,তা হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিবের তরবারী,আর আলীই হচ্ছে একমাত্র বীর জোয়ান।

ইবনে আবীল হাদীদ ঘটনাপ্রবাহের আরো বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং বলেছেন : যারা মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করছিল,তাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ। আলী বাহন পশুর উপর সওয়ার না হয়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়েই তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করছিলেন। এরপর হযরত জিবরীলের অবতরণের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন : এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রচিত গায্ওয়া (য্দ্ধু) সম্পর্কিত গ্রন্থের কয়েকটি হস্তলিখিত অনুলিপিতে জিবরীলের অবতরণের বিষয়টি দেখতে পেয়েছি। এমনকি একদিন আমার শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব সাকীনার কাছে এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা সঠিক। আমি তাঁকে বললাম : এ সত্য ঘটনা সিহাহ্ সিত্তার47 গ্রন্থকারগণ কেন লিখেন নি?”   তিনি উত্তরে বলেছিলেন : অনেক সহীহ্ রেওয়ায়েত আছে যেসব উল্লেখ করার ব্যাপারে সিহাহ্-এর গ্রন্থকারগণ অবহেলা করেছেন। 48

2. আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) তাঁর একদল অনুসারীর উপস্থিতিতে রা স-উল ইয়াহুদে যে দীর্ঘ ভাষণ পেশ করেন,তাতে নিজের আত্মত্যাগের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেছিলেন : কুরাইশ বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আনসার ও মুহাজিররা তাদের বাড়ির পথ ধরে ছুটে পালিয়েছিল। আর তখন আমি সত্তরটি জখম নিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর তিনি আমার জামা উঠিয়ে ক্ষতস্থানগুলোর উপর হাত বুলিয়ে দেন যেগুলোর চিহ্ন (তখনও) বিদ্যমান ছিল।49

এমনকি এলালুশ শারায়ে গ্রন্থে শেখ সাদুক-এর বর্ণনা অনুযায়ী আলী (আ.) মহানবীর (সা.) জীবন রক্ষা করার সময় এতটা ত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন যে,তাঁর তরবারী ভেঙে যায় এবং মহানবী (সা.)তাঁর তরবারি যুলফিকার তাঁকে দান করেন। সেই তরবারি নিয়েই তিনি মহান আল্লাহর পথে জিহাদ চালিয়ে যান।

ইবনে হিশাম তাঁর স্বনামধন্য সীরাত গ্রন্থে50 মুশরিক বাহিনীর নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বাইশ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের নাম ও গোত্র-পরিচয় ইত্যাদি লিখেছেন। এদের মধ্যে বারো জন আলীর হাতে নিহত হয়েছিল। বাকীরা অন্যান্য মুসমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। উল্লিখিত সীরাত লেখক নিহতদের নাম ও পরিচয় বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা সংক্ষিপ্ততার জন্য আর বেশি লিখছি না।

আমরা স্বীকার করছি,আহলে সুন্নাহ্ ও শিয়াদের গ্রন্থসমূহে,বিশেষ করে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে51 হযরত আলী ( আ.)-এর অবদান সংক্রান্ত যে বর্ণনা রয়েছে,এখানে তা উল্লেখ করতে পারি নি। এ ব্যাপারে যে সব বিক্ষিপ্ত রেওয়ায়েত ও বর্ণনা রয়েছে,সেসব পর্যালোচনা করার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে,উহুদ যুদ্ধে তাঁর মতো কেউ দৃঢ়পদ থাকেন নি।

2. আবু দুজানাহ্ : তিনি হচ্ছেন আমীরুল মুমিনীনের পর দ্বিতীয় সৈনিক,যিনি মহানবীর প্রতিরক্ষায় এমন ভূমিকা পালন করেন যে,তিনি নিজেকে মহানবীর ঢালে পরিণত করেন। তাঁর পিঠের উপর তীর বিদ্ধ হচ্ছিল। এভাবে তিনি মহানবীকে তীরের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রক্ষা করেন। মরহুম সেপেহের প্রণীত নাসিখুত্ তারিখ গ্রন্থে আবু দুজানাহ্ সম্পর্কে একটি বাক্য আছে। এ কথার সূত্র ও প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় নি। তিনি লিখেছেন52 :

মহানবী (সা.) ও আলী যখন মুশরিকদের অবরোধের মধ্যে পড়েছিলেন,তখন আবু দুজানার প্রতি মহানবীর দৃষ্টি পড়ে এবং তিনি তাঁকে বলেন : আবু দুজানাহ্! আমি তোমার কাছ থেকে আমার বাইয়াত ফেরৎ নিলাম;তবে আলী আমা হতে আর আমি আলী হতে। আবু দুজানাহ্ তীব্রভাবে কাঁদলেন এবং বললেন : আমি কোথায় যাব,আমার স্ত্রীর কাছে যাব,সে তো মৃত্যুবরণ করবে;আমি কি আমার বাড়িতে ফিরে যাব;তা তো বিরান হয়ে যাবে;আমার ধন-সম্পদের দিকে যাব,তা তো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মৃত্যুর দিকেই ছুটে যাব,যা আমার দিকে এসে পৌঁছবে।

আবু দুজানার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। তাঁর প্রতি মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেন আর তিনি ও আলী কুরাইশদের একের পর এক আক্রমণ থেকে মহানবীকে হেফাযত করেন।

ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে আসিম ইবনে সাবিত,সাহাল ইবনে হুনাইফ,তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ প্রমুখের নামের উল্লেখ দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ,যে সব ব্যক্তিত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়পদ ছিলেন,তাঁদের সংখ্যা ছত্রিশ জন বলে উল্লেখ করেছেন। যা হোক,ইতিহাসের আলোকে যা নিশ্চিত,তা হচ্ছে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.),আবু দুজানাহ,হামযাহ্ এবং উম্মে আমের নামক একজন মহিলার দৃঢ়তা। এ চারজন ছাড়া বাকীদের দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি অনুমাননির্ভর। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তা মূল থেকেই সন্দেহযুক্ত।

3. হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব : মহানবী (সা.)-এর চাচা হামযাহ্ ছিলেন আরবের বীরকেশরী এবং ইসলামের একজন বিখ্যাত সেনানায়ক। তিনি সেই ব্যক্তিগণের অন্যতম,যাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মক্কায় অত্যন্ত নাযুক পরিস্থিতিতে মহানবীকে মূর্তিপূজারীদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন। কুরাইশদের সভায় আবু জাহল মহানবীর অবমাননা করেছিল এবং তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিল,তার প্রতিশোধস্বরূপ তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঐ সময় তাঁকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না।

তিনি ছিলেন সেই বীরকেশরী,বদরের যুদ্ধে যিনি কুরাইশ বাহিনীর বীর অধিনায়ক শাইবাকে হত্যা করেন। এছাড়া অপর একদলকে হত্যা ও আরো কতককে আহত করেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল সত্যকে রক্ষা এবং মানব জীবনে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী,ওতবার মেয়ে হিন্দ মনে মনে হামযার প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,যে কোন মূল্যেই হোক,মুসলমানদের কাছ থেকে তার পিতার প্রতিশোধ নেবে।

ওয়াহ্শী ছিল এক হাবশী বীর যোদ্ধা। সে যুবাইর ইবনে মুতয়েমের ক্রীতদাস ছিল। যুবাইরের চাচাও বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। হিন্দের পক্ষ থেকে সে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল যে,সে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার মনের আশা পূরণ করবে। হিন্দ্ ওয়াহ্শিকে প্রস্তাব দিয়েছিল,আমার পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তোমাকে তিনজনের (মুহাম্মদ,আলী ও হামযাহ্) মধ্যে যে কোন একজনকে হত্যা করতে হবে। বীর ওয়াহ্শী জবাবে বলেছিল : আমি কখনোই মুহাম্মদের নাগাল পাব না। কেন না তার সাহাবীরা যে কারো চাইতে তার নিকটবর্তী। আলীও যুদ্ধের ময়দানে অসম্ভব রকমের সজাগ। কিন্তু যুদ্ধের সময় হামযার ক্রোধ ও উত্তেজনা এত প্রবল থাকে যে,লড়াই চলাকালীন তার আশপাশে কি হচ্ছে,সে তা বুঝতে পারে না। হয় তো আমি তাকেই ধোঁকায় ফেলে হত্যা করতে পারব। হিন্দ্ ঐটুকুতেই রাজি হয়ে যায়। তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়,এক্ষেত্রে যদি সে সফল হয়,তা হলে তাকে মুক্তি দান করবে।

একদল মনে করেন,যুবাইর নিজেই তার গোলামের সাথে এ চুক্তি সম্পাদন করে। কেননা,বদর যুদ্ধে তার চাচা নিহত হয়েছিল। হাবশী গোলাম ওয়াহ্শী নিজেই বলেছে : উহুদের দিন আমি কুরাইশের বিজয় লাভের সময়টিতে হামযার খোঁজে ছিলাম। তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের মতো প্রতিপক্ষের ব্যূহের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর সামনে যে-ই আসছিল,তাকেই তিনি ধরাশায়ী করছিলেন। আমি এমনভাবে গাছ ও পাথরের পেছনে লুকিয়ে রইলাম যে,এর ফলে তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি তুমুল লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। আমি আমার গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি হাবশী ছিলাম বিধায় হাবশীদের মতোই বর্শা নিক্ষেপ করতাম। এজন্য তা খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। এ কারণে আমি একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বিশেষ এক ভঙ্গিতে দুলিয়ে তাঁর দিকে আমার দুই ফলা বিশিষ্ট বর্শা নিক্ষেপ করলাম। বর্শা তাঁর পাঁজর ও জঙ্ঘার মধ্যবর্তী পার্শ্বদেশে আঘাত করল এবং তাঁর দু পায়ের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি আমার ওপর আক্রমণ করতে চাইলেন;কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা তাঁকে এই সুযোগ দেয় নি। ঐ অবস্থায় তিনি পড়ে রইলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর আমি খুব সতর্কতার সাথে তাঁর দিকে গেলাম। আমার বর্শাটি বের করে এনে কুরাইশ বাহিনীর শিবিরে ফিরে গেলাম;আর নিজের মুক্তির জন্য দিন গুণতে লাগলাম।

উহুদ যুদ্ধের পর বহু দিন আমি মক্কায় ছিলাম। অতঃপর মুসলমানরা মক্কা জয় করলে আমি তায়েফে পালিয়ে গেলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামের কর্তৃত্ব সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আমি শুনতে পেয়েছিলাম,যে যত মারাত্মক অপরাধীই হোক না কেন,যদি ইসলাম গ্রহণ করে,মহানবী (সা.) তার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আমি মুখে কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে মহানবী সকাশে উপস্থিত হলাম। মহানবীর দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। তিনি বললেন : তুমি কি সেই হাবশী ওয়াহ্শী? আমি বললাম : জ্বি হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কিভাবে হামযাহকে হত্যা করেছ? আমি হুবহু ঘটনাটি বললাম। মহানবী খুবই মর্মাহত হলেন এবং বললেন : যতদিন জীবিত আছ,ততদিন আমি যেন তোমার চেহারা না দেখি। কেননা আমার চাচাকে হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা তোমার দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে। 53

এ হচ্ছে নবুওয়াতের সেই মহান আত্মা এবং অন্তরের সীমাহীন প্রশস্ততা,যা স্বয়ং মহান আল্লাহ্ ইসলামের সুমহান নেতাকে দান করেছেন। তিনি বহু অজুহাত দাঁড় করিয়ে আপন চাচার হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু এরপরও তাকে মুক্ত করে দেন। ওয়াহ্শী বলেছে : মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন,আমি তাঁর সামনে থেকে আমার চেহারা লুকিয়ে রাখতাম। মহানবীর ইন্তেকালের পর নবুওয়াতের দাবীদার ভণ্ড মুসাইলিমা কায্যাব-এর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমি ইসলামী সেনাবাহিনীতে যোগদান করলাম। আমি মুসাইলিমাকে হত্যার জন্য সেই যুদ্ধাস্ত্রটি ব্যবহার করলাম। একজন আনসারের সহায়তায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হলাম। আমি যদি এ অস্ত্র দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি হামযাহ্ কে হত্যা করে থাকি,নিকৃষ্টতম ব্যক্তি মুসাইলিমাও তো এ অস্ত্রের বিপদ থেকে রক্ষা পায় নি।

মুসাইলিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াহ্শীর অংশগ্রহণের বিষয়টি তার নিজের দাবীমাত্র। তবে ইবনে হিশাম বলেন,ওয়াহ্শী জীবনের শেষপ্রান্তে একটি কালো কাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। মদ পানের কারণে সে মুসলমানদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল এবং তাকে প্রায় সময়ে মদ পানের দায়ে বেত্রাঘাত করা হতো। বারবার মন্দ কাজের জন্য সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে তার নাম কেটে দেয়া হয়। উমর ইবনে খাত্তাব বলতেন,হামযার হত্যাকারী আখেরাতে অবশ্যই সফলকাম হবে না।54

4. উম্মে আমের : এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অবকাশ নেই যে,ইসলামে মহিলাদের জন্য জিহাদ নিষিদ্ধ। এ কারণে যখন মদীনার মহিলাদের প্রতিনিধি মহানবীর নিকট উপস্থিত হন,তখন তাঁরা এই বঞ্চনার ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলেন এবং অভিযোগ করেন : আমরা সাংসারিক জীবনে স্বামীদের জন্য সকল কাজ সম্পাদন করি। আর তারা নিশ্চিন্তে জিহাদে অংশগ্রহণ করে;অথচ আমরা নারী সমাজ এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

মহানবী (সা.) তাঁর মাধ্যমে মদীনার নারী সমাজের প্রতি বার্তা পাঠান : তোমরা যদিও কতক সৃষ্টিগত ও সামাজিক কারণে এই মহা সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়েছ;কিন্তু তোমরা সাংসারিক ও বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জিহাদের সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম। অতঃপর তিনি এই ঐতিহাসিক উক্তি করেন :و إنّ حُسن التّبعّل يعدل ذلك كلّه সুচারুরূপে ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনই জিহাদের সমকক্ষ। তবে কখনো কখনো কিছু অভিজ্ঞ নারী ইসলামের যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য তাঁদের সাথে মদীনার বাইরে আসতেন। তাঁরা পিপাসার্তদের পানি পান করানো,সৈনিকদের কাপড় ধোয়া ও আহতদের সেবা করার মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় লাভে সাহায্য করতেন।

উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। তিনি বলেন : আমি ইসলামের মুজাহিদগণের পানি সরবরাহের জন্য উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আমি দেখতে পেলাম,বিজয়ের হাওয়া মুসলমানদের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ মোড় ঘুরে গেল। মুসলমানরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। মহানবী (সা.)-এর প্রাণ নিয়ে আশংকা দেখা দিল। আমি নিজ দায়িত্ব মনে করলাম যে,জীবন যতক্ষণ আছে,মহানবীর প্রাণ রক্ষা করব। পানির মশক মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। একটি তরবারি সংগ্রহ করে নিয়ে শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করলাম। কখনো কখনো তীর নিক্ষেপ করছিলাম। এ ঘটনা ঘটার সময় তাঁর কাঁধে যে ক্ষত হয়েছিল,তা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : লোকেরা যখন শত্রুবাহিনীর বিপরীত দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল,তখন পলায়নরত এক ব্যক্তির উপর মহানবীর দৃষ্টি পড়ে। তিনি বললেন : এখন যে পালিয়ে যাচ্ছ,অন্তত তোমার ঢালটি ফেলে যাও। সে ঢালটি মাটিতে ফেলে দিল। আমি সেই ঢালটি নিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ইবনে কুমিআ নামক এক ব্যক্তি সজোরে চিৎকার দিয়ে বলছে,মুহাম্মদ কোথায় আছে? সে মহানবীকে চিনতে পেরে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ করতে আসে। আমি ও মুসআব তাকে তার লক্ষ্যের দিকে যেতে বাধা দিলাম। সে আমাকে পেছনে তাড়ানোর জন্য আমার কাঁধের উপর একটি আঘাত করে। আমি যদিও তাকে কয়েক বার আঘাত করেছি;কিন্তু তার আঘাত আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিল,যা এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তার শরীরে দু টি বর্ম ছিল। এজন্য আমার আঘাত তার ওপর কার্যকর প্রভাব রাখে নি।

আমার কাঁধের ওপর যে আঘাত লাগে,তা খুবই মারাত্মক ছিল। মহানবী (সা.) আমার আঘাতের কথা বুঝতে পারেন। তিনি দেখতে পেলেন,তা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার এক ছেলেকে ডেকে বললেন : তোমার মায়ের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দাও। সে আমার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। আমি আবার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত হলাম।

এর মধ্যে আমি দেখতে পেলাম,আমার এক ছেলে আহত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ আহতদের পট্টি বাঁধার জন্য যে কাপড় সাথে এনেছিলাম,তা দিয়ে আমার ছেলের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলাম। এ সময় মহানবীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির দিকে আমার ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করে

বললাম :قم فضارب القوم হে বৎস! ওঠ,যুদ্ধে অবতীর্ণ হও।

মহানবী (সা.) এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য বিস্ময়বোধ করলেন। যখনই তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন,তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক। প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী,যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল,এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে,তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল। এবার মহিলার বীরত্বের ব্যাপারে মহানবীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি বিস্ময়ে হেসে ফেললেন এমনভাবে যে,তাঁর পেছনের সারির দাঁতগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তিনি বললেন : তোমার সন্তানের যথার্থ প্রতিশোধ নিয়েছ। 55

পরের দিন যখন মহানবী (সা.) তাঁর সেনাদলকে হামরাউল আসাদ -এর দিকে পরিচালিত করলেন,নাসীবাও সেনাবাহিনীর সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হবার কারণে তাঁকে যাবার অনুমতি দেয়া হয় নি। মহানবী হামরাউল আসাদ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে এক ব্যক্তিকে নাসীবার ঘরে পাঠান যাতে তিনি নাসীবার অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবগত করেন। মহানবী তাঁর সুস্থতার সংবাদ পেয়ে খুশী হন।

এই নারী এত ত্যাগের বিনিময়ে মহানবীর কাছে আবেদন করেন,যাতে তিনি তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন,মহান আল্লাহ্ যেন তাঁকে বেহেশতে মহানবীর নিত্য সহচর করেন। মহানবীও তাঁর জন্য দুআ করেন এবং বলেন : হে আল্লাহ্! এদেরকে বেহেশতে আমার সাথী করে দিন। 56

এই মহিয়সী নারীর বীরত্বের দৃশ্য মহানবীকে এতখানি আনন্দিত করে যে,তিনি এই মহিলা সম্পর্কে বলেছিলেন :لمقام نسيبة بنت كعب اليوم خير من فلان و فلان আজ নাসীবা বিনতে কা ব-এর মর্যাদা অমুক অমুকের চাইতে শ্রেষ্ঠ।

ইবনে আবীল হাদীদ লিখেছেন,হাদীস বর্ণনাকারী মহানবীর প্রতি খেয়ানত করেছেন। কেননা এ দু ব্যক্তির নাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন নি।57 তবে আমি মনে করি,অমুক অমুক বলতে ঐ লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,যাঁরা রাসূলের পরে মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন;বর্ণনাকারী তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাজনিত ভীতির কারণেই কথাটি অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন।


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53