চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড5%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81732 / ডাউনলোড: 7519
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

মহানবীর ষষ্ঠ দূতের ইয়ামামায় গমন

মহানবীর ষষ্ঠ দূত বাহরাইন ও নাজদের মধ্যবর্তী ইয়ামামায় প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি সেখানে পৌঁছে ইয়ামামার শাসক হাওযাত ইবনে আলাল হানাফীর নিকট তাঁর পত্র পৌঁছালেন। পত্রের বাণী ছিল নিম্নরূপ :

“পরম করুণাময় ও দাতা আল্লাহর নামে। সৎপথ প্রাপ্তদের উপর সালাম। আপনি জেনে রাখুন,আমার আনীত দ্বীন দ্রুতগামী বাহন যে পর্যন্ত পৌঁছায় (পূর্ব-পশ্চিম সকল দিকে),সে পর্যন্ত পৌঁছবে। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন,তবেই নিরাপত্তা লাভ করবেন এবং আপনার রাজত্ব টিকে থাকবে।”

ইয়ামামার শাসক খ্রিষ্টান ছিলেন,এজন্য মহানবী (সা.) সেখানে প্রেরণের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে দূত মনোনীত করেছিলেন,যিনি দীর্ঘদিন আবিসিনিয়ায় ছিলেন এবং খ্রিষ্টীয় আচার,বিশ্বাস ও ধর্মীয় যুক্তিসমূহ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এই দূতের নাম সুলাইত ইবনে আমর,যিনি মুসলমানরা মক্কায় মুশরিকদের চরম নির্যাতনের শিকার থাকাকালে রাসূলের নির্দেশে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। ইসলামের উন্নত শিক্ষা এবং বিভিন্ন স্থানে সফরে বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফলে তাঁর বক্তব্য দানের ক্ষমতা এবং সাহস বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তিনি একজন বাগ্মী ও সাহসী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বক্তব্যের মাধ্যমে ইয়ামামার শাসককে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর উদ্দেশে বলেন : সেই ব্যক্তিই মহান,যে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে এবং খোদাভীতিকে পাথেয় বানিয়েছে। যে জাতি আপনার নেতৃত্বে সৌভাগ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে,তার পরিণতি কখনো মন্দ হতে পারে না। আমি আপনাকে সর্বোত্তম বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছি এবং নিকৃষ্ট বিষয় হতে দূরে থাকার উপদেশ দিচ্ছি। আমি আপনাকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছি এবং শয়তানের উপাসনা ও মন্দ প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করছি। আল্লাহর ইবাদতের সুফল চিরস্থায়ী বেহেশ্ত এবং শয়তান ও প্রবৃত্তির অনুসরণের পরিণতি জাহান্নাম। আমি যা বলছি,তা ছাড়া অন্য কিছু যদি গ্রহণ করেন,তবে অপেক্ষা করুন পর্দা উন্মোচিত হয়ে মহাসত্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত।”

ইয়ামামার শাসকের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল রাসূলের দূতের কথা তার মনে প্রভাব ফেলেছে। সে দূতের কাছে মহানবীর নবুওয়াতের বিষয়ে চিন্তার জন্য কয়েক দিন সময় চাইল। ঘটনাক্রমে সে সময়ে রোম থেকে একজন প্রথম সারির ধর্মযাজক ইয়ামামায় গেলেন। ইয়ামামার শাসক তাঁর কাছে ঘটনা খুলে বললে তিনি বললেন : কেন তাঁর সত্যায়ন থেকে বিরত রয়েছ?”   সে বলল : আমি আমার রাজত্ব ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত।” ধর্মযাজক বললেন : আমার মনে হয়,তাঁর অনুসরণ করাই কল্যাণকর ও শ্রেয়। কারণ তিনিই সেই আরব নবী,যাঁর সম্পর্কে হযরত ঈসা (আ.) সংবাদ দিয়েছেন এবং ইনযীলে উল্লিখিত হয়েছে,মুহাম্মদ আল্লাহর নবী।”

ধর্মযাজকের উপদেশমূলক বাণী তাকে মানসিক শক্তি দান করল এবং সে মহানবীর দূতকে ডেকে নিম্নোক্ত (বক্তব্য সম্বলিত) পত্র প্রদান করল : আপনি আমাকে সবচেয়ে সুন্দর ধর্মের প্রতি আহবান করেছেন। আমি আমার জাতির মধ্যে সবচেয়ে বাগ্মী ব্যক্তি ও শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত। আরবদের মধ্যে আমার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। আমি আপনার ধর্ম অনুসরণে রাজি আছি। তবে এ শর্তে যে,আপনি আমাকে ধর্মীয় বিশেষ মর্যাদা দেবেন এবং আপনার মর্যাদার অংশীদার (প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত) করবেন।”

সে এ পর্যন্ত বলেই ক্ষান্ত হলো না;বরং মাজাআ ইবনে মারারার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দলকে তার বক্তব্য পৌঁছে দেয়ার জন্য মদীনায় প্রেরণ করল এবং তাদেরকে বলে পাঠালো যে,যদি রাসূল তাঁর মৃত্যুর পর তাকে তাঁর স্থলবর্তী করেন,তবে সে ইসলাম গ্রহণ করবে ও তাঁকে সহযোগিতা করবে,নতুবা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তার প্রেরিত প্রতিনিধিরা মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে শর্তহীন ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে ইয়ামামার শাসকের বাণী তাঁর কাছে পৌঁছাল। মহানবী (সা.) তার কথা শুনে বললেন : যদি তার ঈমান আনা শর্তাধীন হয়ে থাকে,তবে সে খিলাফত লাভের উপযুক্ত নয়। আল্লাহ্ আমাকে তার অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন। ২৩২

মহানবীর অন্যান্য পত্র

মহানবী (সা.) বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকবর্গ ও গোত্রপতিদের নিকট যে পত্রসমূহ দিয়েছেন,তার সংখ্যা অনেক। ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ মহানবীর প্রেরিত ঊনত্রিশখানা পত্রের বিবরণ উল্লেখ করেছেন। আমরা গ্রন্থের কলেবর যাতে বৃদ্ধি না পায়,সে লক্ষ্যে অন্যসবের উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি।

চুয়াল্লিশতম অধ্যায় :সপ্তম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

খাইবরের দুর্ভেদ্য দুর্গ (আশংকার কেন্দ্র)

ইসলামের প্রদীপ-নক্ষত্র মদীনার আকাশে আলো বিকিরণ শুরু করলে মদীনার ইহুদীরা মক্কার কুরাইশদের থেকেও মহানবী ও মুসলমানদের শত্রুর চোখে দেখতে লাগল এবং সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো।

মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী ইহুদীরা তাদের অপতৎপরতা ও মন্দ কর্মের পরিণতিতেই দুর্ভাগ্যে পতিত হয়। তাদের অনেকেই মৃতুদণ্ড প্রাপ্ত হয় এবং কোন কোন গোত্র,যেমন বনী কাইনুকা এবং বনী নাযীর মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হয়। তারা খাইবর,ওয়াদিউল কুরা বা আযারআতে শামে নতুনভাবে বসতি স্থাপন করে।

মদীনার ৩২ ফারসাখ (প্রায় ২০০ কিলোমিটার) দূরবর্তী খাইবর উপত্যকায় অবস্থিত সমতল ভূমিটি অত্যন্ত উর্বর ছিল। মহানবীর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ইহুদীরা বসবাস ও আত্মরক্ষার জন্য সেখানে সাতটি দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করেছিল। ঐ অঞ্চলের ভূমি ও আবহাওয়া কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী থাকায় ওখানে বসবাসকারীরা কৃষিকাজের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়েছিল,যার দ্বারা তারা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম প্রস্তুত করত। তারা এক্ষেত্রে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। সেখানকার জনসংখ্যা বিশ হাজারের অধিক ছিল এবং তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধা ছিল।২৩৩

খাইবরের ইহুদীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল,তারা আরবের সকল গোত্রকে মদীনার ইসলামী সরকার উৎখাতে উস্কানি দিচ্ছিল এবং মুশরিকরা ইহুদীদের অর্থনৈতিক ও যুদ্ধ সরঞ্জামের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবের সকল প্রান্ত থেকে মদীনার সন্নিকটে সমবেত হয়েছিল। এর পরিণতিতে খন্দকের (আহযাব) যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল,যার বিবরণ পাঠকরা পূর্বে পাঠ করেছেন। ঐ যুদ্ধে মহানবীর রণকৌশল ও তাঁর সঙ্গীগণের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকার ফলে আক্রমণকারীরা এক মাস পরিখার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণের পর নিজেদের ঘরে,যেমন খাইবরের ইহুদীরা খাইবরে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হয় এবং ইসলামের কেন্দ্র নিরাপত্তা লাভ করে ও শান্তি ফিরে আসে।

খাইবরের ইহুদীদের কাপুরুষোচিত ভূমিকা মহানবীকে বিশৃঙ্খলা ও আশংকার এ কেন্দ্রে আক্রমণ করে তাদের উচ্ছেদ ও নিরস্ত্র করার এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। কারণ,এ আশংকা ছিল,একগুঁয়ে ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এ জাতি আরবের গোত্রগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করে মুসলমাদের বিরুদ্ধে নতুন করে উস্কানী দেবে এবং আহযাবের যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। বিশেষত কুরাইশদের মূর্তিপূজা ও স্বধর্মের প্রতি যতটা গোঁড়ামি ছিল,ইহুদীদের স্বধর্মের প্রতি গোঁড়ামি তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এ কারণেই এক হাজার মূর্তিপূজকের বিপরীতে একজন ইহুদীও ইসলাম গ্রহণ করে নি। তারা এতটা গোঁড়া ছিল যে,নিজ ধর্ম ত্যাগ করে সত্য ধর্ম গ্রহণে তাদের কোন আগ্রহই ছিল না।

অন্য যে বিষয়টি মহানবীকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছিল,তা হলো,তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকদের প্রতি মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় পত্র দিয়ে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে বিশেষত পারস্য ও রোম সম্রাট ইহুদীদের ব্যবহার করে মুসলমানদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ এবং দীন ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার প্রচেষ্টা নিতে পারে এ আশংকায় ইহুদীদের কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নজর রাখা এবং তাদেরকে নিরস্ত্র করা প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে এ সম্ভাবনাও ছিল,ইহুদীরা রোম ও পারস্য সম্রাটদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে,যেভাবে ইতোপূর্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সংগঠিত করেছিল। বিশেষত ঐ সময়ে ইরান ও রোমের মধ্যেকার যুদ্ধে তারা এক পক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করত। এসব দিক চিন্তা করে মহানবী (সা.) দেখলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিপজ্জনক অগ্নি নির্বাপণ দরকার। এ কাজের জন্য তখনই ছিল উপযুক্ত সময়। কারণ হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের কোন সম্ভবনা ছিল না;বরং সেদিক থেকে মদীনা নিরাপদ ছিল। আর সে মুহূর্তে ইহুদীদের সংগঠিত শক্তির উপর আক্রমণ ঘটলে কুরাইশরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। অন্যদিকে আহযাবের যুদ্ধে ইহুদীদের সহযোগী মদীনার উত্তরের গাতফান গোত্রসহ অন্যান্য গোত্র,যারা তাদের সাহায্য করতে পারে,তাদের বিষয়েও মহানবী বিশেষ পরিকল্পনা নিলেন।

উপরিউক্ত উদ্দেশ্যসমূহ সামনে রেখে আরব ভূখণ্ডে ইহুদীদের সর্বশেষ কেন্দ্র দখলের লক্ষ্যে মহানবী (সা.) মুসলমাদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বললেন,এ যুদ্ধে শুধু তারাই সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে যারা হুদায়বিয়ার সন্ধিতে উপস্থিত ছিল। অন্যরা ইচ্ছা করলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারে,কিন্তু গনীমত থেকে কিছুই পাবে না। রাসূল (সা.) গাইলা লাইসীকে মদীনায় তাঁর স্থলবর্তী করে হযরত আলীর হাতে সাদা পতাকা দিয়ে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সেনাদল দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য উট চালানোর সময় বিশেষ সঙ্গীত (হিদা) গাওয়ার অনুমতি দিলেন। উটচালক দলের অগ্রগামী ব্যক্তি আমের ইবনে আকওয়া নিম্নোক্ত কবিতা পড়ছিলেন :

والله لولا الله ما اهـتدينـا

و لا تـصدقنا و لا صليـنـا

انا إذا قوم  بـغـوا علينـا

و ان أرادوا فـتـنـة  ابيـنـا

فانـزلـن سـكينة علينـا

و ثبت الأقـدام ان لاقيـنـا

অর্থাৎ আল্লাহর শপথ,যদি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ না থাকত,তবে আমরা বিপথগামী হতাম। কোন যাকাতও দিতাম না,নামাযও পড়তাম না। আমরা এমন এক জাতি,যদি কেউ আমাদের উপর জুলুম করে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে,আমরা তাদের অধীনতাকে মানি না। আল্লাহ্ আমাদের তাঁর পথে অবিচল রাখুন এবং আমাদের উপর প্রশান্তি বর্ষণ করুন।

এই কবিতা ও সঙ্গীতের বিষয়বস্তু এ যুদ্ধের উদ্দেশ্যকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করছে। এ থেকে বোঝা যায়,ইহুদীরা আমাদের উপর জুলুম করেছে এবং আমাদের ঘরে আগুন জ্বালিয়েছে বলে আমরা এ ফিতনার কেন্দ্র ধ্বংস করে আগুন নির্বাপিত করতে সফরের কষ্ট সহ্য করছি। তাঁর সঙ্গীতের বিষয়বস্তু মহানবীকে এতটা খুশী করেছিল যে,তিনি আমেরের জন্য দুআ করেন। এ যুদ্ধেই আমের শাহাদাতের শরবত পান করেন।

মহানবী (সা.) সেনাবহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেয়ার সময় সামরিক কৌশল গোপন রাখার বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন কেউ তাঁদের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে যেন জানতে না পারে এবং শত্রুরা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালাবেন ও দুর্গ অবরুদ্ধ করবেন। অন্যদিকে শত্রুপক্ষের মিত্ররা যাতে মনে করে,মহানবী (সা.) তাদের উদ্দেশে হয় তো যাত্রা করে থাকবেন। তাই তারা নিজ ঘর থেকে বের হবার সাহস করবে না।

কেউ কেউ যেন এটা মনে করে,মহানবীর উত্তর দিকে পরিচালিত এ অভিযানের উদ্দেশ্য আহযাবের যুদ্ধে ইহুদীদের দুই সহযোগী গোত্র গাতফান ও ফাযারাহ্। তাই রাসূল (সা.) যখন রাজিই’ নামক স্থানে পৌঁছেন,তখন সেনাদলকে খাইবরের দিকে পরিচালিত করে তাদের ও বনী গাতফান গোত্রের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নেন যাতে এ দুই গোত্রের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয় এবং তারা খাইবরের ইহুদীদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে। খাইবরের অবরোধ এক মাস স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এ এক মাসে ঐ গোত্র তাদেরকে সাহায্য করতে পারে নি।২৩৪

ইসলামের মহান নেতা দু শ’ অশ্বারোহীসহ এক হাজার ছয় শ’ সৈন্য নিয়ে খাইবর অভিযানে যাত্রা করেন।২৩৫

মহানবী (সা.) খাইবরের নিকটবর্তী হলে নিম্নোক্ত দুআ পড়েন,যা তাঁর পবিত্র নিয়্যতের পরিচয় বহন করে :

اللهم ربّ السّموات و ما اظللن و ربّ الأرضين و ما اقللن... نسألك خير هذه القرية و خير أهلها و خير ما فيها، و نعوذ بك من شرها و شر أهلها و شر ما فيها

“হে আল্লাহ,আপনি আকাশ ও যা কিছু তার নিচে রয়েছে,তার পালনকর্তা এবং পৃথিবীসমূহ ও যা কিছু ভারী বস্তু তার উপর রয়েছে,তারও প্রভু। আমি আপনার নিকট এ ভূমি,এর অধিবাসী এবং যা কিছু তাতে রয়েছে,সবকিছুর কল্যাণ কামনা করছি এবং এ ভূমি,এর অধিবাসী এবং এর মধ্যে বিদ্যমান অকল্যাণ হতে আপনার আশ্রয় চাইছি। ২৩৬

এক হাজার ছয় শ’ সাহসী সৈনিক,যারা প্রত্যেকেই যুদ্ধের তীব্র আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে এখানে এসেছে,তাঁদের সামনে এভাবে ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রার্থনা প্রমাণ করে মহানবী (সা.) প্রতিশোধ গ্রহণ এবং দেশ ও ভূমি দখলের মনোবৃত্তি নিয়ে সেখানে যান নি,বরং তিনি গিয়েছেন এ বিপজ্জনক কেন্দ্র,যে কোন মুহূর্তে যা কাফের ও মুশরিকদের ঘাঁটিতে পরিণত হওয়ার আশংকা রয়েছে,তাকে নিরস্ত্র ও শক্তিহীন করতে,যাতে এদিক থেকে ইসলামের অগ্রযাত্রা নিরাপদ থাকে।

রাতে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পথ অবরুদ্ধ

খাইবরের সাতটি দুর্গের প্রতিটির বিশেষ নাম ছিল;যথাক্রমে নায়েম,কামুস,কুতাইবা,নাসতাত,শাক্ক,তীহ্ এবং মালালিম। কোন কোন দুর্গ কখনো যে সেনাপতির অধীন ছিল,তার নামে অভিহিত হতো,যেমন মারহাবের দুর্গ। অন্যদিকে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি দুর্গের পাশে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ছিল,যাতে কেল্লাগুলোর প্রহরীরা দুর্গের বাইরের খবরাখবর দুর্গের অভ্যন্তরে সরবরাহ করতে পারে। দুর্গগুলো এমনভাবে নির্মিত হয়েছিল,যেন দুর্গের অধিবাসীরা বাইরের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে এবং শত্রুর অবস্থানের ওপর মিনজানিক (পাথর ছোড়ার জন্য বিশেষ কামান) দ্বারা আক্রমণ চালাতে পারে।২৩৭

সাতটি দুর্গে অবস্থানরত বিশ হাজার অধিবাসীর মধ্যে দুই হাজার যোদ্ধা ছিল। খাদ্য ও পানীয় এতটা সঞ্চিত ছিল যে,তারা সবাই এ দিক থেকে নিশ্চিত ছিল। তাদের গুদামগুলো খাদ্যে পূর্ণ ছিল। এ দুর্গগুলো এতটা সুরক্ষিত ছিল যে,ছিদ্র করারও কোন সুযোগ ছিল না। যে কেউ দুর্গের দিকে অগ্রসর হলে পাথরের বা তীরের আঘাতে নিহত বা আহত হতো। তাই এ দুর্গগুলো ইহুদী যোদ্ধাদের জন্য শক্তিশালী ঘাঁটি বলে পরিগণিত হতো।

এরূপ শক্তিশালী ও সুসজ্জিত শত্রুর ঘাঁটি দখলের উদ্দেশ্যে আগত মুসলমানদের তা দখল করতে সর্বোচ্চ যুদ্ধকলা ও সূক্ষ্মতম সমরশৈলী অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। তাই মুসলিম যোদ্ধারা সর্বপ্রথম যে কাজ করলো,তা হলো,রাতে দুর্গের দিকের সকল গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পথ অবরোধ করল। এ কাজ এত দ্রুত ও গোপনে সম্পাদিত হলো যে,দুর্গগুলোর প্রহরীরাও তা টের পেল না। সকালে খাইবরের কৃষকরা দুর্গ হতে কৃষিক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বের হলে লক্ষ্য করল,ইসলামের সাহসী ও সংগ্রামী যোদ্ধারা সকল পথ অবরোধ করে রেখেছে,তাদের চেহারা ঈমান ও প্রত্যয়ের চিহ্ন বহন করছে,তাদের শক্তিশালী হাতে রয়েছে ধারালো অস্ত্র। এ অবস্থায় অগ্রসর হলেই বন্দী হতে হবে। তাই এ দৃশ্য দেখামাত্রই তারা এতটা ভীত হলো যে,দ্রুত দুর্গের মধ্যে পালিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করে সমবেতভাবে সৈন্যদের জানালো,মুহাম্মদ তার সৈন্যদের নিয়ে দুর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাথে সাথে দুর্গের কপাট বন্ধ করা হলো। দুর্গের ভেতরে যুদ্ধ উপলক্ষে জরুরী সভা বসলো। অপরদিকে মহানবী (সা.)-এর চোখ কোদাল,বেলচা,গাঁইতি ইত্যাদির মতো ধ্বংসকারী সরঞ্জামের উপর পড়লে তিনি একে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করলেন। তাই মুসলিম সেনাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য বললেন :

الله أكبر خربت خيبر انا إذا نزلنا بساحة قوم فساء صباح المنذرين

“সর্বশ্রেষ্ঠ তিনিই আল্লাহ্,খাইবর ধ্বংস হোক;আমরা যখন এমন জাতির ভূমিতে এসেছি,যাদের সতর্ক করা হয়েছে,তাদের পরিণতি কত মন্দ!

যুদ্ধাবস্থার জরুরী বৈঠকে ইহুদীরা সিদ্ধান্ত নিল,নারী ও শিশুদের একটি দুর্গে এবং খাদ্যদ্রব্য এক দুর্গে রেখে অন্যান্য দুর্গ থেকে প্রতিরোধ করবে। দুর্গের অভ্যন্তর থেকে যোদ্ধারা পাথর ও তীর দিয়ে আক্রমণ করবে এবং সুযোগ বুঝে দুর্গ থেকে বের হয়ে মুসলমানদের সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধকৌশল তারা যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিল এবং এ কৌশলে তারা এক মাস ইসলামের দুর্বার যোদ্ধাদের প্রতিরোধ করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি কখনো কখনো একটি দুর্গ দখলের জন্য মুসলমানরা দশ দিন যুদ্ধ করেছে,কিন্তু কোন ফল হয় নি।

পর পর ইহুদী ঘাঁটির পতন

মুসলমানরা যেখানে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সে স্থান সামরিক দৃষ্টিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ,ইহুদী সৈন্যদের আক্রমণের আওতায় ছিলেন তাঁরা। খুব সহজেই ইহুদীরা ঐ স্থানে তাঁদের উপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে পারত। এ কারণে মুসলমানদের সাহসী ও অভিজ্ঞ সৈন্য হুবাব ইবনে মুনযার মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন : আপনি যদি আল্লাহর নির্দেশে এ স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকেন,তবে আমার কোন আপত্তি নেই। কারণ আল্লাহর নির্দেশ সকল পরামর্শ ও পূর্ব অনুমানের ঊর্ধ্বে। কিন্তু যদি কোন পরিকল্পনা ছাড়া এমনিই এখানে অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন,সেক্ষেত্রে সেনাদলের সদস্যদের পরামর্শ দানের সুযোগ দিলে আমার পরামর্শ হলো,এ স্থান শত্রুর নাগালের মধ্যে। কারণ,তাদের দুর্গ নামতাত’ -এর তীরন্দাজদের সামনে কোন ঘর ও খেজুর গাছ না থাকায় সহজেই তারা আমাদের অবস্থানের প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হানতে পারবে।” মহানবী (সা.) ইসলামের মহান মৌলনীতি (পরামর্শের নীতি) অনুসারে অন্যদের মতামতের গুরুত্ব দেয়ার জন্য বললেন : যদি তোমরা এর থেকে উত্তম স্থান নির্বাচন কর,আমরা ক্যাম্প সরিয়ে সেখানে নিয়ে যাব।” হুবাব ইবনে মুনযার খাইবরের অবস্থানগুলোর সুবিধা-অসুবিধা পর্যালোচনা করে এমন স্থান নির্বাচন করলেন যা খেজুর বাগানের পশ্চাতে ছিল। ফলে যুদ্ধ ক্যাম্পটি সেখানে সরিয়ে নেয়া হলো। খাইবরের যুদ্ধ চলাকালীন দিনের বেলা মহানবী ও সৈন্যগণ ক্যাম্প থেকে দুর্গের দিকে আসতেন ও রাতে সেখানে ফিরে যেতেন।২৩৮

খাইবারের যুদ্ধের বিস্তারিত ও যথাযথ বিবরণ দেয়া অসম্ভব। কিন্তু ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থসমূহ থেকে মোটামুটিভাবে জানা যায়,মুসলিম সৈন্যরা একটি একটি করে দুর্গ দখলে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁরা চেষ্টা করতেন,যে দুর্গে আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে,তা থেকে অন্য দুর্গগুলোকে বিচ্ছিন্ন করতে। এভাবে একটি দুর্গের পতন ঘটানোর পর অপর দুর্গে আক্রমণ করতেন। কিন্তু যে দুর্গগুলো মাটির নিচ দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত ছিল এবং যে দুর্গগুলোর অভ্যন্তরে সৈন্যরা কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলত,সেগুলোর দখল প্রক্রিয়া বেশ ধীর গতিতে সম্পন্ন হতো। কিন্তু যে দুর্গগুলোর সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হতো বা অন্য দুর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত,সহজেই তার পতন হতো। সেক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনাও কম ঘটত।

একদল ঐতিহাসিকের মতে,খাইবরের দুর্গগুলোর মধ্যে প্রথম পতন ঘটে নায়েম দুর্গের। মুসলমানদের তা দখলে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছিল। এ দুর্গ দখল করতে ইসলামের এক মহান সৈনিক মাহমুদ ইবনে মাসলামা নিহত হন এবং আরো কয়েক সৈন্য আহত হন। মাহমুদ ইহুদীদের নিক্ষিপ্ত একটি বড় পাথরের আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য ইবনে আসীরের২৩৯ বর্ণনামতে তিনি আহত হওয়ার তিন দিন পর শাহাদাত বরণ করেন। পঞ্চাশ জন আহত সৈনিক ব্যান্ডেজ ও শুশ্রূষার জন্য নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তরিত হন।২৪০

বনী গিফার গোত্রের একদল নারী রাসূলের অনুমতিক্রমে খাইবরে এসেছিলেন। তাঁরা আহতদের শুশ্রূষা ও তাঁদের জন্য বৈধ অন্যান্য দায়িত্ব পালনে আত্মত্যাগী ভূমিকা রাখেন এবং এ জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।২৪১

সামরিক পরামর্শসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নায়েম দুর্গের পর কামুস দুর্গকে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলো। এ দুর্গে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবিল হুকাইক। এ দুর্গও মুসলিম সেনাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে হস্তগত হলো। ইহুদী নেতা হুইয়াই ইবনে আখতাবের২৪২ কন্যা সাফিয়া এ সময় বন্দী হন,যিনি পরবর্তীতে রাসূলের স্ত্রী হয়েছিলেন।

এ দুই দুর্গের পতন মুসলমানদের মানসিক শক্তি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল এবং ইহুদীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হলো। কিন্তু মুসলমানদের খাদ্য-দ্রব্যের রসদ ফুরিয়ে এসেছিল বলে তাঁরা খাদ্যসংকটে পড়েছিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে এমন প্রাণীর মাংস খেতে বাধ্য হলেন যা মাকরূহ। যে দুর্গে ইহুদীরা খাদ্য-দ্রব্য মজুদ রেখেছিল,তখনও তা মুসলমানদের দখলে আসে নি।

সংকটের মুহূর্তেও চরম আত্মসংযম

মুসলমানদের উপর ক্ষুধার চাপ তীব্রতর হলে তাঁরা মাকরূহ প্রাণীর মাংস খেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তখন একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাখাল,যে ইহুদীদের দুম্বাগুলোকে দেখাশুনা করত,রাসূলের নিকট এসে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইল। মহানবী (সা.) আকর্ষণীয় বক্তব্যের মাধ্যমে তার কাছে ইসলাম ধর্মকে তুলে ধরলেন। সেও এতে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করল। সে মহানবীকে বলল : এ দুম্বাগুলো আমার তত্ত্বাবধানে আমানত হিসেবে রয়েছে। এখন তো আমার সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। তাই এ দুম্বাগুলোকে আপনি নিতে পারেন।”

মহানবী (সা.) সহস্রাধিক ক্ষুধার্ত সৈনিকের সামনে সুস্পষ্টভাবে বললেন : আমাদের ধর্মে আমানতের খেয়ানত অন্যতম বড় অপরাধ ও গুনাহ। তোমার দায়িত্ব হলো,দুর্গে গিয়ে দুম্বাগুলোর মালিকের কাছে সেগুলো ফিরিয়ে দেয়া।” সে রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মতো কাজ করল। সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে সে রাসূলের সৈন্যদলে যোগ দিল। অবশেষে মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হলো।২৪৩

মহানবী (সা.) তাঁর যৌবনে আল আমীন’ বা বিশ্বস্ত’ উপাধি লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা শুধু সে সময়েই ছিল না;বরং সারা জীবন তিনি এমনই ছিলেন। সকালে দুর্গগুলো থেকে রাখালরা মেষ পাল নিয়ে সবুজ মাঠে যেত এবং সন্ধ্যায় ফিরত,কিন্তু কোন মুসলমানই তা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন নি। কারণ তাঁরা তাঁদের নেতার প্রশিক্ষণে ইসলামের মহান শিক্ষার ছায়ায় তাঁর মতো বিশ্বস্ত ও আমানতদার হিসেবে তৈরি হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) শুধু একদিন চরম খাদ্য সংকটে পড়ায় মাত্র দু টি মেষ গ্রহণের অনুমতি তিনি দিয়েছিলেন,যাতে সৈন্যরা তাঁদের জীবন বাঁচাতে পারেন। যদি সংকট এতটা তীব্র না হতো,তবে কখনোই তা করার অনুমতি দিতেন না। অধিকাংশ সময়ই সৈন্যরা ক্ষুধার কষ্টের কথা বললে তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে বলতেন : যে দুর্গে খাদ্য-দ্রব্য রয়েছে,তা হস্তগত কর।” যুদ্ধের মাধ্যমে হস্তগত করা ছাড়া তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপে নিষেধ করতেন।২৪৪

এ সত্বেও সমসাময়িক কোন কোন মধ্যপ্রাচ্যবিদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলামের মহান উদ্দেশ্যকে খাটো করে দেখাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এ বিষয়টি প্রমাণের মাধ্যমে যে,মুসলমানরা যুদ্ধের সময় ন্যায়পরায়ণ আচরণ করতেন না এবং ইসলামের যুদ্ধগুলো গনীমত লাভ ও লুটপাটের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতো। কিন্তু এ ঘটনাসহ এরূপ অসংখ্য ঘটনা,যা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে,তাদের এ মিথ্যা দাবী অসার প্রমাণ করে। কারণ নিজ ত্যাগী সৈন্যদের জীবন-মরণ সমস্যার সময়ও মহানবী ঐ রাখালকে তার ইহুদী মনিবের সম্পদে বিশ্বাসঘাতকতায় নিষেধ করেছেন;অথচ তিনি ইচ্ছা করলেই তা আটক করতে পারতেন।

মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করব?

মৃত্যুকে গ্রহণ করা সন্দেহাতীতভাবে মানুষের পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। যেহেতু মৃত্যুভয় মানুষের জন্য একটি বড় দুর্বলতা সেহেতু মানুষের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে এটি। যেমন অপমানকে গ্রহণ,অসম্মানজনক অধীনতা গ্রহণ করা এরূপ হাজারো দুর্গতি। যদি কেউ মৃত্যুকে ভয় না পায় তাহলে তার পুরো জীবনই পাল্টে যাবে। মহৎ ব্যক্তিরা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে সাহসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। (অবশ্য আত্মহত্যার ফল আমরা বলছি না। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দায়িত্ব মনে করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কথা বলছি। যারা আত্মহত্যা করে তারা তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এ কাজ করে।)

যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তবে মানুষের জন্য তা সাফল্য। ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন,

إنّی لا أری الموت إلا سعادة و لا الحیاة مع الظالمین إلا برما

আমি মৃত্যুকে সাফল্য ছাড়া কিছু মনে করি না আর জালেমদের সঙ্গে বেঁচে থাকাকে অপমান ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। (লুহুফ,পৃ. ৬৯)

মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণকে আল্লাহ প্রেমিক ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না। যাদের কাছে মৃত্যু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থান পরিবর্তনের মতো। ইমাম হুসাইনের ভাষায় একটি সাঁকো অতিক্রম করার মতো,এ ছাড়া কিছু নয়। ইমাম হুসাইন আশুরার দিন সকালে তার সাথীদের বলেন,

ما الموت إلا قنطرة تعبر بکم عن البؤس و الضّرّاء إلی الجنان

মৃত্যু একটি পুলের মত যার উপর দিয়ে তোমরা অতিক্রম করবে ও জান্নাতকে আলিঙ্গন করবে (কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। (মায়ানী আল আখবার সাদুক,পৃ. ২৮৯)৮৬

হে আমার সাথীরা! আমাদের সম্মুখে শুধু একটি সাঁকো রয়েছে যার নাম মৃত্যু- এটা অতিক্রম করলেই আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যু নিকটবর্তী হচ্ছিল ইমাম হুসাইনের চেহারা তত সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল হচ্ছিল।

যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন ইমাম হুসাইন ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উমর ইবনে সা দের একজন সহযোগী যে এ দৃশ্য লক্ষ্য করছিল সে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে উমর ইবনে সা দকে বলল, অনুমতি দাও,ওর জন্য কিছু পানি নিয়ে আসি। এখন তো ও মারাই যাচ্ছে,পানি খেলেও কিছু করতে পারবে না। উমর ইবনে সা দ অনুমতি দিলে সে যখন পানি নিয়ে ফিরছিল তখন দেখল পাষণ্ড ও অভিশপ্ত শিমার ইমামের মাথা নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে দেখার অভিব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছে-

و لقد شغلتی نور وجهه عن الفکرة فی قتله

  তার চেহারার নূরে এতটা মোহিত হয়েছিলাম যে,তার নিহত হওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

পূর্ণ মানব সে-ই যার উপর কোন পরিস্থিতিই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না (ক্ষমতা,প্রভাব,দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ কোন অবস্থাতেই সে তার ভারসাম্য ও ব্যক্তিত্বকে হারায় না)। যেমন আলী (আ.) এরূপ এক নমুনা যিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ ও মর্যাদার সকল স্তরেই অবস্থান করেছেন; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ খেলাফত থেকে সর্বনিম্ম পদ শ্রমিকের কাজও তিনি করেছেন। আলী আলওয়ারদী বলেছেন, আলী (আ.) কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আলীর কুড়ে ঘরেরঁ জীবনের সঙ্গে (শ্রমিক অবস্থায়) প্রাসাদের জীবনের (খেলাফতের সময়কাল,যদিও প্রকৃতপক্ষে আলী প্রাসাদে বাস করতেন না,তবে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে) কোন পার্থক্য ছিল না। শ্রমিক আলীর চিন্তার সঙ্গে খলিফা আলীর চিন্তার কোন পার্থক্য ছিল না। এজন্যই আলী (আ.) পূর্ণ মানব।

আলী (আ.)-এর গোপনে দাফন

আমরা কেন আজকে এখানে সমবেত হয়েছি? সমবেত হয়েছি এক পূর্ণ মানব-এর শোক পালন করতে। যেহেতু এ পূর্ণ মানবকে গোপনে দাফন করতে হয়েছে। কেন? কারণ তার যেরূপ পরম বন্ধু রয়েছে সেরূপ পরম শত্রুও রয়েছে। আলী (আ.)-এর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গ্রন্থে (বাংলায় অনূদিত হয়েছে) আমরা উল্লেখ করেছি এ ধরনের ব্যক্তিরা যেমন প্রচণ্ড আকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি বিকর্ষণ ক্ষমতারও। তাদের বন্ধুও যেমনি থাকে চরম অন্তরঙ্গ ও উচ্চ পর্যায়ের যারা যে কোন সময়ে তার জন্য প্রাণ দিতে অকুণ্ঠিত তেমনি শত্রুও থাকে যারা তার রক্তের জন্য পিপাসার্ত বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও নিকটতম শত্রু। যেমন খারেজীরা দীনের বাহ্যিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ও ঈমানের অধিকারী,কিন্তু দীনের মূল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আলী (আ.) নিজেই বলেছেন,এরা ঈমানদার,কিন্তু অজ্ঞ। তার ভাষায়-

لا تقولوا الخوارج بعدی فلیس من طلب الحق فأخطاه کمن طلب الباطل فأدرکه

খারেজীদের আমার মৃত্যুর পর আর হত্যা করো না,যেহেতু যারা সত্যের সন্ধানী,কিন্তু ভুল করছে তারা যারা অসত্যকে জানার পরও তার অনুসরণ করছে এক সমান নয়। খারেজীদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের তুলনা করে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর এদের হত্যা করো না। এদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য রয়েছে,এরা সত্যকে চায়,কিন্তু বোকা (তাই অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়) ও ভুল করে। কিন্তু মুয়াবিয়াপন্থীরা সত্যকে জেনেই তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।

তাই কেন আলীকে এত বন্ধু ও সুহৃদ থাকা সত্ত্বেও রাত্রিতে গোপনে দাফন করা হয়েছে? এই খারেজীদের ভয়ে। যেহেতু তারা বলত আলী মুসলমান নয়,তাই ভয় ছিল তারা জানতে পারলে কবর থেকে তার লাশ বের করে অপমান করত।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ের শেষ দিকে প্রায় শত বছর পর্যন্ত নবী পরিবারের ইমামরা ব্যতীত কেউই জানত না যে,ইমাম আলী (আ.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে।

একুশে রমযানের ভোরে ইমাম হাসান (আ.) জানাযার আকৃতিতে সাজিয়ে একটি খাটিয়া কিছু ব্যক্তির হাতে দেন মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যাতে লোকজন মনে করে আলী (আ.)-কে মদীনায় দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু ইমাম আলীর সন্তানগণ ও কিছু সংখ্যক অনুসারী যারা তার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানতেন তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। বর্তমানে কুফার নিকটে নাজাফে যে স্থানে আলীর সমাধি রয়েছে সেখানে তারা গোপনে যিয়ারতে আসতেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় যখন খারেজীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং আলীর প্রতি অসম্মানের সম্ভাবনা রহিত হয় তখন ইমাম সাদিক তার এক সাহাবী সাফওয়ান (রহ.)-কে সে স্থান চিহ্নিত করে গাছ লাগিয়ে দিতে বলেন। এরপর থেকে সবাই জানতে পারে ইমাম আলীর কবর সেখানে এবং তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার কবর যিয়ারত করতে শুরু করে।

যে রাতে আলীকে দাফন করা হয় খুব কম সংখ্যক লোক তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন,সে সাথে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী। তাদের মধ্যে সামায়া ইবনে সাওহান যিনি আলী (আ.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুসারী ছিলেন তিনি একজন তুখোর বক্তাও ছিলেন। আলীকে দাফনের সময় তাদের অন্তর যেরূপ বিরাগ বেদনায় স্তব্ধ ও কণ্ঠ বায়ুরূদ্ধ হচ্ছিল,সে সাথে মনে অনুভূত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। এরূপ অবস্থায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই কাঁদছিলেন সামায়া যার হৃদয় প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল তিনি কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মাথা ও সারা শরীরে মাখতে শুরু করলেন। কবরের মাটিকে বুকে চেপে ধরে বললেন,

السلام علیک یا أمیر المؤمنین لقد عشت سعیدا و متّ سعیدا

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম। আপনি সৌভাগ্যের সাথে জীবন যাপন করেছেন,সৌভাগ্যের সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল সাফল্যমণ্ডিত,আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করেছেন,আল্লাহর ঘর মসজিদেই শাহাদাত বরণ করেছেন। জীবনের শুরুও আল্লাহর ঘরে,জীবনের পরিসমাপ্তিও আল্লাহর ঘরে। হে আলী! আপনি কতটা মহৎ ছিলেন আর এ মানুষরা কতটা হীন!

যদি এ সম্প্রদায় আপনার কথা মতো চলতلاکلوا فوقهم و من تحت أرجلیهم তবে আসমান ও তাদের পায়ের নীচে থেকে নেয়ামত বর্ষিত হতো। তারা আখেরাতে ও দুনিয়ার সাফল্য লাভ করত। কিন্তু আফসোস! এ জনগণ আপনার মর্যাদা বোঝেনি। আপনার অনুসরণ না করে বরং আপনাকে কষ্ট দিয়েছে,আপনার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আপনাকে এ অবস্থায় কবরে পাঠিয়েছে।

لا حول و لا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের পর্যালোচনা

পূর্ণ মানব (বর্তমানের ভাষায় আদর্শ মানব) কে,তা জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি মতাদর্শেই আদর্শ মানবের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। যেহেতু আমরা ইসলামের পূর্ণ ও আদর্শ মানবের প্রতিকৃতি ও স্বরূপ জানতে চাই সেহেতু প্রচলিত অন্য সব মতবাদের আদর্শ মানবের প্রকৃতির পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব। গত দিনের আলোচনায় বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি। আজকে আমাদের আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ দিয়ে শুরু করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ

প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় মানুষের অস্তিত্বের মূল বিষয় ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তি। তাদের মতে মানুষের আমিত্ব হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল। যেমনভাবে মানবদেহ তার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় তেমনিভাবে তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত সত্তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল হলো তার চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা। মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো যা দ্বারা সে চিন্তা করে।

মানুষ যা দ্বারা চোখে দেখে তা চিন্তার হাতের একটি উপকরণ মাত্র,তেমনি যা দ্বারা কল্পনা করে,যা দ্বারা চায়,যা দ্বারা ভালোবাসে বা মানুষ যে সত্তার কারণে জৈবিক চাহিদার অধিকারী এ সবই চিন্তার সত্তার হাতের একেকটি উপকরণ। মানব সত্তার মৌল উপাদান তার চিন্তাশক্তি। তাই পূর্ণ মানব তিনিই যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছেছেন। চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছার অর্থ বিশ্ব ও অস্তিত্বজগতকে ঠিক যে রূপে আছে সে রূপেই উদ্ঘাটন ও জানা।

এ মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলকে মানব সত্তার মৌল উপাদান বলে জানে। এ ছাড়াও বিশ্বাস করে যে,বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তা-শক্তির দ্বারা বিশ্বকে তার প্রকৃত রূপে উদ্ঘাটন করা সম্ভব। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি অস্তিত্বজগতকে তার আসল রূপে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করার ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক আয়নার¡মত বিশ্বজগৎ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এতে প্রতিফলিত হয়।

ইসলামী দার্শনিক সমাজ যারা এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তারা বিশ্বাস করেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ও কোরআনের আলোকে ঈমান বলতে বিশ্বকে ঠিক যেমনভাবে আছে তেমনভাবে জানাই বোঝানো হয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিশ্বে বিরাজমান শৃঙ্খলা,প্রচলিত বিধান,বিশ্বের গতি ও লক্ষ্য এগুলোকে জানা। তারা বলেন,কোরআনে যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস,বিশ্বজগৎ আল্লাহর সৃষ্টি এ বিষয়ে বিশ্বাস,আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে লক্ষ্যহীন ছেড়ে দেননি,বরং একে হেদায়েত ও পরিচালনা করছেন,যেমন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করছেন তা জানা,সব কিছু আল্লাহ্ থেকে এসেছে এবং তার প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী প্রভৃতি- এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো বিশ্বজগতকে তার প্রকৃতরূপে জানা। তারা ঈমানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,ঈমান পরিচিতি-জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতীত কিছু নয়। অবশ্য তাদের এ প্রজ্ঞা বা পরিচিতি জ্ঞানেরঅর্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা আংশিক জ্ঞান নয়,বরং এ জ্ঞান ও পরিচয় দার্শনিক ও প্রজ্ঞাগত। দার্শনিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিসমাপ্তি,অস্তিত্বের ধারা ও পর্যায়কে সামগ্রিকভাবে জানাও উদ্ঘাটন করা।

এ মতাদর্শের বিপরীত মতবাদ

এ মতাদর্শ যা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ বলে আমরা উল্লেখ করেছি এর বিপরীতে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে যে মতবাদগুলো এ মতবাদের বিরোধী ও সমালোচক। মুসলিম বিশ্বে প্রথম যে মতবাদটি এ মতবাদের বিরেুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো এশরাকী,সূফী ও খোদাপ্রেম মতবাদ। এরপর রয়েছে আহলে হাদীসের অনুসারীরা। শিয়াদের মধ্যে আখবারী এবং সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী ও আহলে হাদীস দার্শনিকদের বিপরীতে আকলকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন,দার্শনিকরা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপারে যত বেশি গুরুত্ব দেয় আকলের গুরুত্ব এত অধিক নয়।

এদের থেকেও ইন্দ্রিয়বাদীরা বর্তমান সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির চরম সমালোচক। বিগত তিন-চার শতকধরে ইন্দ্রিয়বাদীদের জয়-জয়কার। তাদের মতে বুদ্ধিবৃত্তিকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তা ততটা মূল্যের অধিকারী নয়। আকলের তেমন কোন গুরুত্ব নেই,বরং আকল ইন্দ্রিয়ের অনুগত। মানবের মূল তার ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিসমূহ। আকল খুব বেশি হলে যা করতে পারে তা হলো ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উপর কাজ করা। যেমন কোন কারখানাকে যদি আমাদের বিবেচনায় আনি,সেখানে যেরূপ কাঁচামাল প্রবেশ করে তৎপর কারখানার মেশিনের মধ্যে তা মিশ্রিত বা বিভাজিত হয়,উদাহরণস্বরূপ কাপড় বুনন কারখানায় প্রথমে তুলা থেকে সুতা বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বুননের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাপড়ের আকৃতি দেয়া হয়। তেমনি আকল মেশিনের মতো শুধু ইনিদ্রয়লব্ধ কাঁচামালকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ তার নিজের স্থানে এখনও অটল। এখানে আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোচনা করব না,বরং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার চেষ্টা করব।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের (মারেফাত) মৌলিকত্ব

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদে কয়েকটি বিষয় আছে যার প্রতিটিকে যাচাই করে দেখব যে,সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল কিনা। প্রথম বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের মৌলিকত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্বের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে এবং এ জ্ঞান ও পরিচিতি মৌলিক,নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ।

অনেক মতবাদই বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতায় বিশ্বাসী নয়। এখন আমরা দেখব ইসলামী উৎসগুলো থেকে আমাদের নিকট এ ধরনের দলিল-প্রমাণ রয়েছে কিনা যে,বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী হতে পারি। ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে যাতে আমরা বলতে পারি ইসলামের মতো কোন মতাদর্শেই আকলকে এত অধিক পৃষ্ঠপোষকতা করা হযনি বা প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে আকলকে অন্য কোন ধর্মেই ইসলামের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আপনি খ্রিষ্টধর্মকে ইসলামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন খ্রিষ্টধর্ম ঈমানের গণ্ডীতে আকলের প্রবেশের বিরোধী। তাদের মতে মানুষ যখন কোন কিছুর উপর ঈমান আনবে তখন এর উপর চিন্তা করার অধিকার তার নেই। চিন্তা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ তাই বিশ্বাসগত বিষয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আকলকে কি কেন এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া যাবে না। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি,বিশেষত ঈমানের রক্ষক চার্চের অধিপতির দায়িত্ব হলো ঈমানের গণ্ডিতে যুক্তি,চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রবেশকে প্রতিহত করা। মূলত খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে (উসূল) বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেমন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার ধর্মের একটি মৌলিক বিষয় বলুন। আপনি হয়তো বললেন,তাওহীদ (একত্ববাদ)। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করাহয়,কেন আপনি এক আল্লাহ্য় ঈমান এনেছেন? আপনাকে অবশ্যই এজন্য যুক্তি পেশ করতে হবে যেহেতু ইসলাম আকল ব্যতীত আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে না। যদি বলেন, আমি এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করি,কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি পেশ করতে পারব না। আমার দাদীমার থেকে শুনে আমি বিশ্বাস করেছি। অবশেষে এক সত্যে পৌছেছি যেভাবেই হোক দাদীমার কাছে শুনে অথবা স্বপ্নদেখে। ইসলাম বলে, না,যদিও এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী হও,কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্বপ্ন বা পিতা-মাতার অন্ধ অনুকরণ অথবা পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে,তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর যুক্তির ভিত্তিতে যদি আপনি ঈমান আনয়ন করেন তবেই তা গ্রহণ করা হবে নতুবা নয়।

খ্রিষ্টবাদে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটাই খ্রিষ্টবাদের ভিত্তি। একজন খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব হলো এই গণ্ডিতে আকল ও চিন্তার প্রবেশকে রোধ করা। ইসলামে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের স্থান সংরক্ষিত। আকল ব্যতীত অন্য কোন কিছুর এ গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার নেই।

ইসলামের উৎসসমূহে অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহয় আকলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখা যায়। প্রথমত কোরআন সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা করেছে। তদুপরি আমাদের হাদীস গ্রন্থসমূহেও বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব ও মৌলিকত্ব এতটা প্রকট যে,এ গ্রন্থসমূহ খুললেই দেখা যায়,তাতে প্রথম অধ্যায় হিসেবে কিতাবুল আকল এসেছে এবং এ অধ্যায়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) আকল সম্পর্কিত একটা আশ্চর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ্পাকের দু টি হুজ্জাত (দলিল) রয়েছে। এ দু টি হুজ্জাত দু টি নবী। একটি অভ্যন্তরীণ নবী বা আকল,দ্বিতীয়টি বাহ্যিক নবী অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ যারা নিজেরা মানুষ এবং অন্য মানুষদের দীনের দিকে দাওয়াত করেন। আল্লাহ্পাকের এ দু টি হুজ্জাত একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ যদি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি থাকে,কিন্তু পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরিত না হয়,তবে মানুষের পক্ষে সফলতার পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। তেমনি যদি নবী থাকেন,কিন্তু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী না হয় তাহলেও সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। আকল ও নবী একসঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করে। এর চেয়ে উত্তমরূপে আকলকে সম্মানিত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান আর কোনভাবে সম্ভব কি?

এ ধরনের বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্ভবত আরো শুনে থাকবেন। যেমন জ্ঞানীর নিদ্রা অজ্ঞের ইবাদত হতে উত্তম , জ্ঞানীর খাদ্যগ্রহণ মূর্খের রোযা অপেক্ষা উত্তম , জ্ঞানীর নিরবতা অজ্ঞের কথা বলা হতে শ্রেয় , আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি এ অবস্থার পূর্বে যে,তার আকল পূর্ণতায় পৌছায় ও সমগ্র উম্মত থেকে তার বুদ্ধিবৃত্তি উচ্চতর হয় ইত্যাদি। আমরা রাসূল (সা.)-কে বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্র রূপ বলে জানি। আমাদের এ ধারণা খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যশীল। যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দীনকে পৃথক বলে জানে। কিন্তু আমরা আমাদের নবীকে আকলের পরিপূর্ণ রূপ মনে করি।

সুতরাং পরিচিতিজ্ঞান ও প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে আমরা আকলকে দলিল বলে জানি এ অর্থে যে,বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান ও পরিচয় লাভ সম্ভব। দার্শনিকদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম সমর্থন করে।

মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করব?

মৃত্যুকে গ্রহণ করা সন্দেহাতীতভাবে মানুষের পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। যেহেতু মৃত্যুভয় মানুষের জন্য একটি বড় দুর্বলতা সেহেতু মানুষের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে এটি। যেমন অপমানকে গ্রহণ,অসম্মানজনক অধীনতা গ্রহণ করা এরূপ হাজারো দুর্গতি। যদি কেউ মৃত্যুকে ভয় না পায় তাহলে তার পুরো জীবনই পাল্টে যাবে। মহৎ ব্যক্তিরা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে সাহসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। (অবশ্য আত্মহত্যার ফল আমরা বলছি না। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দায়িত্ব মনে করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কথা বলছি। যারা আত্মহত্যা করে তারা তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এ কাজ করে।)

যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তবে মানুষের জন্য তা সাফল্য। ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন,

إنّی لا أری الموت إلا سعادة و لا الحیاة مع الظالمین إلا برما

আমি মৃত্যুকে সাফল্য ছাড়া কিছু মনে করি না আর জালেমদের সঙ্গে বেঁচে থাকাকে অপমান ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। (লুহুফ,পৃ. ৬৯)

মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণকে আল্লাহ প্রেমিক ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না। যাদের কাছে মৃত্যু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থান পরিবর্তনের মতো। ইমাম হুসাইনের ভাষায় একটি সাঁকো অতিক্রম করার মতো,এ ছাড়া কিছু নয়। ইমাম হুসাইন আশুরার দিন সকালে তার সাথীদের বলেন,

ما الموت إلا قنطرة تعبر بکم عن البؤس و الضّرّاء إلی الجنان

মৃত্যু একটি পুলের মত যার উপর দিয়ে তোমরা অতিক্রম করবে ও জান্নাতকে আলিঙ্গন করবে (কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। (মায়ানী আল আখবার সাদুক,পৃ. ২৮৯)৮৬

হে আমার সাথীরা! আমাদের সম্মুখে শুধু একটি সাঁকো রয়েছে যার নাম মৃত্যু- এটা অতিক্রম করলেই আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যু নিকটবর্তী হচ্ছিল ইমাম হুসাইনের চেহারা তত সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল হচ্ছিল।

যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন ইমাম হুসাইন ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উমর ইবনে সা দের একজন সহযোগী যে এ দৃশ্য লক্ষ্য করছিল সে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে উমর ইবনে সা দকে বলল, অনুমতি দাও,ওর জন্য কিছু পানি নিয়ে আসি। এখন তো ও মারাই যাচ্ছে,পানি খেলেও কিছু করতে পারবে না। উমর ইবনে সা দ অনুমতি দিলে সে যখন পানি নিয়ে ফিরছিল তখন দেখল পাষণ্ড ও অভিশপ্ত শিমার ইমামের মাথা নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে দেখার অভিব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছে-

و لقد شغلتی نور وجهه عن الفکرة فی قتله

  তার চেহারার নূরে এতটা মোহিত হয়েছিলাম যে,তার নিহত হওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

পূর্ণ মানব সে-ই যার উপর কোন পরিস্থিতিই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না (ক্ষমতা,প্রভাব,দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ কোন অবস্থাতেই সে তার ভারসাম্য ও ব্যক্তিত্বকে হারায় না)। যেমন আলী (আ.) এরূপ এক নমুনা যিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ ও মর্যাদার সকল স্তরেই অবস্থান করেছেন; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ খেলাফত থেকে সর্বনিম্ম পদ শ্রমিকের কাজও তিনি করেছেন। আলী আলওয়ারদী বলেছেন, আলী (আ.) কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আলীর কুড়ে ঘরেরঁ জীবনের সঙ্গে (শ্রমিক অবস্থায়) প্রাসাদের জীবনের (খেলাফতের সময়কাল,যদিও প্রকৃতপক্ষে আলী প্রাসাদে বাস করতেন না,তবে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে) কোন পার্থক্য ছিল না। শ্রমিক আলীর চিন্তার সঙ্গে খলিফা আলীর চিন্তার কোন পার্থক্য ছিল না। এজন্যই আলী (আ.) পূর্ণ মানব।

আলী (আ.)-এর গোপনে দাফন

আমরা কেন আজকে এখানে সমবেত হয়েছি? সমবেত হয়েছি এক পূর্ণ মানব-এর শোক পালন করতে। যেহেতু এ পূর্ণ মানবকে গোপনে দাফন করতে হয়েছে। কেন? কারণ তার যেরূপ পরম বন্ধু রয়েছে সেরূপ পরম শত্রুও রয়েছে। আলী (আ.)-এর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গ্রন্থে (বাংলায় অনূদিত হয়েছে) আমরা উল্লেখ করেছি এ ধরনের ব্যক্তিরা যেমন প্রচণ্ড আকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি বিকর্ষণ ক্ষমতারও। তাদের বন্ধুও যেমনি থাকে চরম অন্তরঙ্গ ও উচ্চ পর্যায়ের যারা যে কোন সময়ে তার জন্য প্রাণ দিতে অকুণ্ঠিত তেমনি শত্রুও থাকে যারা তার রক্তের জন্য পিপাসার্ত বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও নিকটতম শত্রু। যেমন খারেজীরা দীনের বাহ্যিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ও ঈমানের অধিকারী,কিন্তু দীনের মূল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আলী (আ.) নিজেই বলেছেন,এরা ঈমানদার,কিন্তু অজ্ঞ। তার ভাষায়-

لا تقولوا الخوارج بعدی فلیس من طلب الحق فأخطاه کمن طلب الباطل فأدرکه

খারেজীদের আমার মৃত্যুর পর আর হত্যা করো না,যেহেতু যারা সত্যের সন্ধানী,কিন্তু ভুল করছে তারা যারা অসত্যকে জানার পরও তার অনুসরণ করছে এক সমান নয়। খারেজীদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের তুলনা করে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর এদের হত্যা করো না। এদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য রয়েছে,এরা সত্যকে চায়,কিন্তু বোকা (তাই অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়) ও ভুল করে। কিন্তু মুয়াবিয়াপন্থীরা সত্যকে জেনেই তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।

তাই কেন আলীকে এত বন্ধু ও সুহৃদ থাকা সত্ত্বেও রাত্রিতে গোপনে দাফন করা হয়েছে? এই খারেজীদের ভয়ে। যেহেতু তারা বলত আলী মুসলমান নয়,তাই ভয় ছিল তারা জানতে পারলে কবর থেকে তার লাশ বের করে অপমান করত।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ের শেষ দিকে প্রায় শত বছর পর্যন্ত নবী পরিবারের ইমামরা ব্যতীত কেউই জানত না যে,ইমাম আলী (আ.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে।

একুশে রমযানের ভোরে ইমাম হাসান (আ.) জানাযার আকৃতিতে সাজিয়ে একটি খাটিয়া কিছু ব্যক্তির হাতে দেন মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যাতে লোকজন মনে করে আলী (আ.)-কে মদীনায় দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু ইমাম আলীর সন্তানগণ ও কিছু সংখ্যক অনুসারী যারা তার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানতেন তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। বর্তমানে কুফার নিকটে নাজাফে যে স্থানে আলীর সমাধি রয়েছে সেখানে তারা গোপনে যিয়ারতে আসতেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় যখন খারেজীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং আলীর প্রতি অসম্মানের সম্ভাবনা রহিত হয় তখন ইমাম সাদিক তার এক সাহাবী সাফওয়ান (রহ.)-কে সে স্থান চিহ্নিত করে গাছ লাগিয়ে দিতে বলেন। এরপর থেকে সবাই জানতে পারে ইমাম আলীর কবর সেখানে এবং তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার কবর যিয়ারত করতে শুরু করে।

যে রাতে আলীকে দাফন করা হয় খুব কম সংখ্যক লোক তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন,সে সাথে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী। তাদের মধ্যে সামায়া ইবনে সাওহান যিনি আলী (আ.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুসারী ছিলেন তিনি একজন তুখোর বক্তাও ছিলেন। আলীকে দাফনের সময় তাদের অন্তর যেরূপ বিরাগ বেদনায় স্তব্ধ ও কণ্ঠ বায়ুরূদ্ধ হচ্ছিল,সে সাথে মনে অনুভূত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। এরূপ অবস্থায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই কাঁদছিলেন সামায়া যার হৃদয় প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল তিনি কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মাথা ও সারা শরীরে মাখতে শুরু করলেন। কবরের মাটিকে বুকে চেপে ধরে বললেন,

السلام علیک یا أمیر المؤمنین لقد عشت سعیدا و متّ سعیدا

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম। আপনি সৌভাগ্যের সাথে জীবন যাপন করেছেন,সৌভাগ্যের সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল সাফল্যমণ্ডিত,আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করেছেন,আল্লাহর ঘর মসজিদেই শাহাদাত বরণ করেছেন। জীবনের শুরুও আল্লাহর ঘরে,জীবনের পরিসমাপ্তিও আল্লাহর ঘরে। হে আলী! আপনি কতটা মহৎ ছিলেন আর এ মানুষরা কতটা হীন!

যদি এ সম্প্রদায় আপনার কথা মতো চলতلاکلوا فوقهم و من تحت أرجلیهم তবে আসমান ও তাদের পায়ের নীচে থেকে নেয়ামত বর্ষিত হতো। তারা আখেরাতে ও দুনিয়ার সাফল্য লাভ করত। কিন্তু আফসোস! এ জনগণ আপনার মর্যাদা বোঝেনি। আপনার অনুসরণ না করে বরং আপনাকে কষ্ট দিয়েছে,আপনার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আপনাকে এ অবস্থায় কবরে পাঠিয়েছে।

لا حول و لا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের পর্যালোচনা

পূর্ণ মানব (বর্তমানের ভাষায় আদর্শ মানব) কে,তা জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি মতাদর্শেই আদর্শ মানবের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। যেহেতু আমরা ইসলামের পূর্ণ ও আদর্শ মানবের প্রতিকৃতি ও স্বরূপ জানতে চাই সেহেতু প্রচলিত অন্য সব মতবাদের আদর্শ মানবের প্রকৃতির পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব। গত দিনের আলোচনায় বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি। আজকে আমাদের আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ দিয়ে শুরু করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ

প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় মানুষের অস্তিত্বের মূল বিষয় ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তি। তাদের মতে মানুষের আমিত্ব হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল। যেমনভাবে মানবদেহ তার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় তেমনিভাবে তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত সত্তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল হলো তার চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা। মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো যা দ্বারা সে চিন্তা করে।

মানুষ যা দ্বারা চোখে দেখে তা চিন্তার হাতের একটি উপকরণ মাত্র,তেমনি যা দ্বারা কল্পনা করে,যা দ্বারা চায়,যা দ্বারা ভালোবাসে বা মানুষ যে সত্তার কারণে জৈবিক চাহিদার অধিকারী এ সবই চিন্তার সত্তার হাতের একেকটি উপকরণ। মানব সত্তার মৌল উপাদান তার চিন্তাশক্তি। তাই পূর্ণ মানব তিনিই যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছেছেন। চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছার অর্থ বিশ্ব ও অস্তিত্বজগতকে ঠিক যে রূপে আছে সে রূপেই উদ্ঘাটন ও জানা।

এ মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলকে মানব সত্তার মৌল উপাদান বলে জানে। এ ছাড়াও বিশ্বাস করে যে,বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তা-শক্তির দ্বারা বিশ্বকে তার প্রকৃত রূপে উদ্ঘাটন করা সম্ভব। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি অস্তিত্বজগতকে তার আসল রূপে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করার ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক আয়নার¡মত বিশ্বজগৎ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এতে প্রতিফলিত হয়।

ইসলামী দার্শনিক সমাজ যারা এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তারা বিশ্বাস করেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ও কোরআনের আলোকে ঈমান বলতে বিশ্বকে ঠিক যেমনভাবে আছে তেমনভাবে জানাই বোঝানো হয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিশ্বে বিরাজমান শৃঙ্খলা,প্রচলিত বিধান,বিশ্বের গতি ও লক্ষ্য এগুলোকে জানা। তারা বলেন,কোরআনে যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস,বিশ্বজগৎ আল্লাহর সৃষ্টি এ বিষয়ে বিশ্বাস,আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে লক্ষ্যহীন ছেড়ে দেননি,বরং একে হেদায়েত ও পরিচালনা করছেন,যেমন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করছেন তা জানা,সব কিছু আল্লাহ্ থেকে এসেছে এবং তার প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী প্রভৃতি- এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো বিশ্বজগতকে তার প্রকৃতরূপে জানা। তারা ঈমানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,ঈমান পরিচিতি-জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতীত কিছু নয়। অবশ্য তাদের এ প্রজ্ঞা বা পরিচিতি জ্ঞানেরঅর্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা আংশিক জ্ঞান নয়,বরং এ জ্ঞান ও পরিচয় দার্শনিক ও প্রজ্ঞাগত। দার্শনিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিসমাপ্তি,অস্তিত্বের ধারা ও পর্যায়কে সামগ্রিকভাবে জানাও উদ্ঘাটন করা।

এ মতাদর্শের বিপরীত মতবাদ

এ মতাদর্শ যা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ বলে আমরা উল্লেখ করেছি এর বিপরীতে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে যে মতবাদগুলো এ মতবাদের বিরোধী ও সমালোচক। মুসলিম বিশ্বে প্রথম যে মতবাদটি এ মতবাদের বিরেুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো এশরাকী,সূফী ও খোদাপ্রেম মতবাদ। এরপর রয়েছে আহলে হাদীসের অনুসারীরা। শিয়াদের মধ্যে আখবারী এবং সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী ও আহলে হাদীস দার্শনিকদের বিপরীতে আকলকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন,দার্শনিকরা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপারে যত বেশি গুরুত্ব দেয় আকলের গুরুত্ব এত অধিক নয়।

এদের থেকেও ইন্দ্রিয়বাদীরা বর্তমান সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির চরম সমালোচক। বিগত তিন-চার শতকধরে ইন্দ্রিয়বাদীদের জয়-জয়কার। তাদের মতে বুদ্ধিবৃত্তিকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তা ততটা মূল্যের অধিকারী নয়। আকলের তেমন কোন গুরুত্ব নেই,বরং আকল ইন্দ্রিয়ের অনুগত। মানবের মূল তার ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিসমূহ। আকল খুব বেশি হলে যা করতে পারে তা হলো ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উপর কাজ করা। যেমন কোন কারখানাকে যদি আমাদের বিবেচনায় আনি,সেখানে যেরূপ কাঁচামাল প্রবেশ করে তৎপর কারখানার মেশিনের মধ্যে তা মিশ্রিত বা বিভাজিত হয়,উদাহরণস্বরূপ কাপড় বুনন কারখানায় প্রথমে তুলা থেকে সুতা বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বুননের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাপড়ের আকৃতি দেয়া হয়। তেমনি আকল মেশিনের মতো শুধু ইনিদ্রয়লব্ধ কাঁচামালকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ তার নিজের স্থানে এখনও অটল। এখানে আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোচনা করব না,বরং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার চেষ্টা করব।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের (মারেফাত) মৌলিকত্ব

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদে কয়েকটি বিষয় আছে যার প্রতিটিকে যাচাই করে দেখব যে,সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল কিনা। প্রথম বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের মৌলিকত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্বের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে এবং এ জ্ঞান ও পরিচিতি মৌলিক,নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ।

অনেক মতবাদই বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতায় বিশ্বাসী নয়। এখন আমরা দেখব ইসলামী উৎসগুলো থেকে আমাদের নিকট এ ধরনের দলিল-প্রমাণ রয়েছে কিনা যে,বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী হতে পারি। ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে যাতে আমরা বলতে পারি ইসলামের মতো কোন মতাদর্শেই আকলকে এত অধিক পৃষ্ঠপোষকতা করা হযনি বা প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে আকলকে অন্য কোন ধর্মেই ইসলামের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আপনি খ্রিষ্টধর্মকে ইসলামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন খ্রিষ্টধর্ম ঈমানের গণ্ডীতে আকলের প্রবেশের বিরোধী। তাদের মতে মানুষ যখন কোন কিছুর উপর ঈমান আনবে তখন এর উপর চিন্তা করার অধিকার তার নেই। চিন্তা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ তাই বিশ্বাসগত বিষয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আকলকে কি কেন এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া যাবে না। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি,বিশেষত ঈমানের রক্ষক চার্চের অধিপতির দায়িত্ব হলো ঈমানের গণ্ডিতে যুক্তি,চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রবেশকে প্রতিহত করা। মূলত খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে (উসূল) বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেমন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার ধর্মের একটি মৌলিক বিষয় বলুন। আপনি হয়তো বললেন,তাওহীদ (একত্ববাদ)। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করাহয়,কেন আপনি এক আল্লাহ্য় ঈমান এনেছেন? আপনাকে অবশ্যই এজন্য যুক্তি পেশ করতে হবে যেহেতু ইসলাম আকল ব্যতীত আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে না। যদি বলেন, আমি এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করি,কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি পেশ করতে পারব না। আমার দাদীমার থেকে শুনে আমি বিশ্বাস করেছি। অবশেষে এক সত্যে পৌছেছি যেভাবেই হোক দাদীমার কাছে শুনে অথবা স্বপ্নদেখে। ইসলাম বলে, না,যদিও এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী হও,কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্বপ্ন বা পিতা-মাতার অন্ধ অনুকরণ অথবা পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে,তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর যুক্তির ভিত্তিতে যদি আপনি ঈমান আনয়ন করেন তবেই তা গ্রহণ করা হবে নতুবা নয়।

খ্রিষ্টবাদে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটাই খ্রিষ্টবাদের ভিত্তি। একজন খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব হলো এই গণ্ডিতে আকল ও চিন্তার প্রবেশকে রোধ করা। ইসলামে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের স্থান সংরক্ষিত। আকল ব্যতীত অন্য কোন কিছুর এ গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার নেই।

ইসলামের উৎসসমূহে অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহয় আকলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখা যায়। প্রথমত কোরআন সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা করেছে। তদুপরি আমাদের হাদীস গ্রন্থসমূহেও বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব ও মৌলিকত্ব এতটা প্রকট যে,এ গ্রন্থসমূহ খুললেই দেখা যায়,তাতে প্রথম অধ্যায় হিসেবে কিতাবুল আকল এসেছে এবং এ অধ্যায়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) আকল সম্পর্কিত একটা আশ্চর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ্পাকের দু টি হুজ্জাত (দলিল) রয়েছে। এ দু টি হুজ্জাত দু টি নবী। একটি অভ্যন্তরীণ নবী বা আকল,দ্বিতীয়টি বাহ্যিক নবী অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ যারা নিজেরা মানুষ এবং অন্য মানুষদের দীনের দিকে দাওয়াত করেন। আল্লাহ্পাকের এ দু টি হুজ্জাত একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ যদি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি থাকে,কিন্তু পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরিত না হয়,তবে মানুষের পক্ষে সফলতার পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। তেমনি যদি নবী থাকেন,কিন্তু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী না হয় তাহলেও সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। আকল ও নবী একসঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করে। এর চেয়ে উত্তমরূপে আকলকে সম্মানিত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান আর কোনভাবে সম্ভব কি?

এ ধরনের বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্ভবত আরো শুনে থাকবেন। যেমন জ্ঞানীর নিদ্রা অজ্ঞের ইবাদত হতে উত্তম , জ্ঞানীর খাদ্যগ্রহণ মূর্খের রোযা অপেক্ষা উত্তম , জ্ঞানীর নিরবতা অজ্ঞের কথা বলা হতে শ্রেয় , আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি এ অবস্থার পূর্বে যে,তার আকল পূর্ণতায় পৌছায় ও সমগ্র উম্মত থেকে তার বুদ্ধিবৃত্তি উচ্চতর হয় ইত্যাদি। আমরা রাসূল (সা.)-কে বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্র রূপ বলে জানি। আমাদের এ ধারণা খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যশীল। যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দীনকে পৃথক বলে জানে। কিন্তু আমরা আমাদের নবীকে আকলের পরিপূর্ণ রূপ মনে করি।

সুতরাং পরিচিতিজ্ঞান ও প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে আমরা আকলকে দলিল বলে জানি এ অর্থে যে,বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান ও পরিচয় লাভ সম্ভব। দার্শনিকদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম সমর্থন করে।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53