চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84022 / ডাউনলোড: 8002
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

ছেচল্লিশতম অধ্যায় : সপ্তম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

উমরাতুল কাযা২৯৮

হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মুসলমানগণ এ চুক্তি সম্পাদিত হবার তারিখ থেকে এক বছর অতিক্রান্ত হবার পর পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান করে উমরার আমলসমূহ আঞ্জাম দেবার পর পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করতে পারতেন (হুদায়বিয়ার শান্তি চুক্তি মোতাবেক)। তখন (এ চুক্তি মোতাবেক) সফর করার সময়, মুসাফিরের সাথে যে অস্ত্র থাকে তা অর্থাৎ তরবারি ছাড়া, অন্য কোন অস্ত্র বহন করার অনুমতি তাঁদের ছিল না।

হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হবার পর থেকে পুরো এক বছর কেটে যায়। মুসলমানদের জন্য এ চুক্তি থেকে কল্যাণ লাভ করার সময়ও তখন ঘনিয়ে এসেছিল। মুহাজির মুসলমানগণ, যাঁরা সাত বছর নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে তাওহীদী ধর্ম রক্ষা করার জন্য নিজ মাতৃভূমিতে বসবাস করার পরিবর্তে প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন, আবার মহান আল্লাহর ঘর যিয়ারত, নিকট আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং ফেলে আসা ঘর-বাড়ি পরিদর্শন করার জন্য পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করতে যাচ্ছেন। যখন মহানবী (সা.) ঘোষণা করলেন, যারা গত বছর বাইতুল্লাহ্ যিয়ারত করতে পারে নি, তারা যেন সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়’, তখন তাঁদের মধ্যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা ও সাড়া পড়ে যায় এবং তাঁদের নয়নযুগল আনন্দাশ্রুতে ভরে যায়। বিগত বছরে মহানবী (সা.) ১৩০০ সাহাবী সহকারে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করে থাকলেও পরের বছর (হিজরতের সপ্তম বর্ষে) মহানবীর সফর সঙ্গীর সংখ্যা দু হাজারে উন্নীত হয়েছিল।

তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বড় বড় মুহাজির ও আনসার ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁরা সকল ক্ষেত্রে মহানবীর পেছনে পেছনে পা ফেলেছেন। ঠিক একইভাবে ষাটটি উট, যেগুলোর গলায় কুরবানীর চিহ্ন ছিল, সেগুলোও তাঁরা নিজেদের সাথে এনেছিলেন। মহানবী (সা.) মদীনার মসজিদ থেকে ইহরাম বাঁধেন এবং অন্যরাও তাঁর অনুসরণ করে সেখান থেকে ইহরাম পরেছিলেন। দু হাজার লোক ইহরাম পরে লাব্বাইকা বলতে বলতে পবিত্র মক্কার পথে বের হয়ে যান। এ কাফেলা এতটা মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের অধিকারী ছিল যে, ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিকতা ও প্রকৃত স্বরূপের দিকে আরবের অনেক মূর্তিপূজারী মুশরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

আমরা যদি বলি, এ সফর আসলে প্রচারের (তাবলীগের) সফর ছিল এবং এ সব ব্যক্তি আসলেই প্রচার-সৈনিক ছিলেন, তা হলে তা কোন বৃথা কথা হবে না। এ সফরের আধ্যাত্মিক প্রভাব অল্প কিছু দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই উহুদ যুদ্ধের বীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এবং আরবদের মধ্যেকার ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ আমর ইবনে আসের মতো ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে কঠোর ও পাষণ্ড শত্রুরা পর্যন্ত এ বিশাল মর্যাদা প্রত্যক্ষ করার পর ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং কিছু সময় গত হওয়ার পর তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

মহানবী (সা.) কুরাইশদের হিংসা ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তিনি আশংকা করছিলেন, পবিত্র মক্কায় কুরাইশরা তাঁকে ও তাঁর সাহাবীগণকে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করতে পারে। আবার অন্য দিকে হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির একটি ধারা অনুসারে অস্ত্র সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করা অনুচিত। তাই সব ধরনের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য মহানবী (সা.) তাঁর এক সেনাপতি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তিনি বর্ম ও বর্শার মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এবং এক শ’ দ্রুতগামী ঘোড়া সমেত দু শ’ যোদ্ধা সাথে নিয়ে উমরার কাফেলা যাত্রা করার আগে রওয়ানা হয়ে পবিত্র হারাম২৯৯ শরীফের কাছে অবস্থিত মাররুয যাহরান উপত্যকায় অবস্থান নিয়ে মহানবীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

মহানবী (সা.)-এর গতিবিধির ওপর নজরদারীরত কুরাইশ গুপ্তচররা মাররুয যাহরান উপত্যকায় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত দু শ’ অশ্বারোহীর আগমনের ব্যাপারে অবগত হয় এবং কুরাইশ নেতাদের কাছে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্টও পেশ করে।

মুকরিম ইবনে হাফ্স কুরাইশদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে কুরাইশদের আপত্তির কথা জানায়। মহানবী কুরাইশ প্রতিনিধিকে এর জবাবে বলেছিলেন : আমি ও আমার সাহাবীরা কখনই চুক্তিবিরোধী কোন কাজ করবো না। আমরা সবাই অস্ত্র ছাড়াই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করব। এ সেনাপতি ও দু শ’ জন সৈন্য সকল অস্ত্র-শস্ত্র সহ এ এলাকায় (মাররুয যাহরান উপত্যকায়) অবস্থান করবে এবং তারা আর সামনে অগ্রসর হবে না।” মহানবী (সা.) তাঁর এ বাণীর দ্বারা কুরাইশদের বুঝিয়ে দেন যে, যদি তোমরা আমাদের নিরস্ত্র থাকার সুযোগে আমাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাও, তা হলে এসব সাহায্যকারী সৈন্যরা- যারা হারামের বাইরে মোতায়েন আছে- তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সাহায্যার্থে দ্রুত চলে আসবে এবং আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবে। কুরাইশরা মহানবীর দূরদর্শিতার কথা জানতে পারল। তারা মুসলমানদের সামনে পবিত্র মক্কা নগরীর দরজা খুলে দিল। কাফির-মুশরিকদের নেতারা এবং তাদের অধীনস্থরা মক্কা নগরী ত্যাগ করে এর আশে-পাশের পাহাড় ও টিলাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, যাতে মহানবী (সা.) ও তাঁর সফর- সঙ্গীগণের সাথে তারা মুখোমুখী না হয় এবং দূর থেকে তাঁদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ওপর লক্ষ্য রাখতে পারে।

পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী (সা.)-এর প্রবেশ

মহানবী (সা.) একটি বিশেষ উটের পিঠে আরোহণ করে সফরসঙ্গীগণ পরিবেষ্টিত হয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন। তখন তাঁরা তালবীয়া (লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক) পাঠ করছিলেন। সুশৃঙ্খল এ জামায়াতের মনোজ্ঞ এ লাব্বাইক ধ্বনি এতটা আকর্ষণীয় ছিল যে, তা মক্কার সকল অধিবাসীর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তাদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি এক বিশেষ টান ও নমনীয়তা সৃষ্টি করেছিল। আর সেই সাথে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি মুশরিকদের হৃদয়ে ত্রাসের সঞ্চারও করেছিল। মুসলমানদের লাব্বাইক’ ধ্বনি থেমে গেলে আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা, যিনি মহানবী (সা.)-এর উটের রজ্জু ধরে রেখেছিলেন, বলিষ্ঠ কণ্ঠে ও মধুর সুরে নিম্নোক্ত কাব্য পঙ্ক্তিমালা আবৃত্তি করছিলেন :

خلوا بنى الكفار عن سبيله

خلـوا فكلّ الـخير فِى قـبوله

يا ربّ إنّـى مـؤمن بـقيله

أعـرف حـقّ  الله فِـى قـبوله

“হে মুশরিক ও কাফিরদের সন্তানরা! মহনবী (সা.)-এর জন্য পথ খুলে দাও। তোমরা জেনে রাখ, তিনি সকল কল্যাণের উৎস (অর্থাৎ তাঁকে মেনে নেয়া ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মধ্যেই কেবল কল্যাণ নিহিত আছে)। হে প্রভু! আমি তাঁর বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করা সংক্রান্ত আপনার নির্দেশ সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত।”৩০০

যে উটের উপর মহানবী (সা.) উপবিষ্ট ছিলেন, সেই উটের উপর আরোহণ করেই তিনি পবিত্র কা বা তাওয়াফ করলেন। এবার তিনি ইবনে রাওয়াহাকে নিম্নোক্ত বিশেষ দুআ তাঁর কণ্ঠে পাঠ এবং অন্যদেরও তাঁর সাথে তা পাঠ করার নির্দেশ দেন :

لا إله إلّا الله وحده وحده، صدق وعده، و نصر عبده و أعزّ جنده و هزم الأحزاب وحده

“কেবল আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি এক-অদ্বিতীয়। তিনি তাঁর অঙ্গীকার পালন করেছেন (তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তোমরা অর্থাৎ মুসলমানরা শীঘ্রই মহান আল্লাহর ঘর কাবা যিয়ারত করবে), নিজ বান্দাকে (মহানবীকে) সাহায্য করেছেন, তাওহীদের সেনাবাহিনীকে সম্মানিত করেছেন এবং একাই তিনি কুফর ও শিরকের সকল গোষ্ঠীকে পরাজিত করেছেন।”

সেদিন যিয়ারত করার যাবতীয় স্থান এবং মসজিদ, কাবা ও সাফা-মারওয়াহ্ সহ উমরার যাবতীয় অনুষ্ঠান পালন করার স্থান মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে। যে স্থান দীর্ঘকাল ধরে শিরক ও পৌত্তলিকতার কেন্দ্র ছিল সেখানে এ ধরনের উষ্ণ তাওহীদী স্লোগান শিরকের নেতাদের ও তাদের অনুসারীদের মনোবল ও মানসিকতার ওপর এমন তীব্র আঘাত হেনেছিল যা পরবর্তীতে সমগ্র আরব উপদ্বীপে মহানবী (সা.)-এর বিজয় নিশ্চিত ও বাস্তবায়িত করেছিল।

যুহরের সময় হলে মহানবী (সা.) ও মুসলমানগণ সামষ্টিকভাবে মসজিদুল হারামে নামায আদায় করলেন এবং মুসলমানদের মুয়ায্যিন অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে সেখানে আযান দিলেন।

বিলাল হাবাশী, যিনি তাওহীদী আদর্শ গ্রহণ করার অপরাধে দীর্ঘদিন এ নগরীতে নির্যাতিত হয়েছিলেন, মহানবীর নির্দেশে পবিত্র কাবার ছাদের উপর উঠলেন এবং যেখানে মহান আল্লাহর একত্ব এবং মহানবী (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে গণ্য হতো, সেখানে তিনি কানের উপর হাত রেখে আযানের বাক্যসমূহ একের পর এক তাঁর বিশেষ কণ্ঠধ্বনি দিয়ে তেলাওয়াত করছিলেন। উল্লেখ্য, আযানের বাক্যসমূহ সকল মুসলমানের জ্ঞাত ছিল। তাঁর কণ্ঠধ্বনি এবং আযানের প্রতিটি বাক্য শোনার পর মুসলমানদের কণ্ঠে তার পুনরাবৃত্তি ও সত্যায়ন মূর্তিপূজক এবং তাওহীদের শত্রুদের কানে গিয়ে পৌঁছতে থাকে এবং তারা এতটা অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়ে যায় যে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা ও খালিদ ইবনে উসাইদ বলেই ফেলে : মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এ কারণে যে, আমাদের পিতৃপুরুষরা মৃত্যুবরণ করেছে বলে তাদেরকে এ হাবশী দাসের কণ্ঠধ্বনি শুনতে হলো না।” সুহাইল ইবনে আমর যখন বিলালের তাকবীর ধ্বনি শুনতে পেল, তখন সে তার মুখমণ্ডল একটি রুমাল দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। তারা (কুরাইশ নেতারা) বিলালের কণ্ঠে আযান শুনতে পেয়ে ততটা অসন্তুষ্ট হচ্ছিল না। তবে আযানের বাক্যসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থ, যা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আকীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, তাদেরকে পীড়া দিচ্ছিল।

মহানবী (সা.) সাফা-মারওয়াহ্ এ দু পাহাড়ের মাঝে সাঈ করতে ব্যস্ত ছিলেন। যেহেতু মুনাফিক চক্র এবং পৌত্তলিক মুশরিকরা গুজব রটিয়েছিল যে, মদীনার জ্বর বা শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী আবহাওয়া মুসলমানদের ধরাশায়ী (জরাব্যাধিগ্রস্ত) করে ফেলেছে, সেহেতু মহানবী (সা.) তাঁর সাঈ-এর কিছু অংশে হারওয়ালা৩০১ করলেন এবং মুসলমানরাও এ অংশে তাঁকে অনুসরণ করে হারওয়ালা করল।

সাঈ সমাপ্ত হলে উটগুলো কুরবানী করা হলো এবং সবাই চুল ছেটে ছোট করে ইহরাম খুলে ফেললেন। মহানবী (সা.) তখন মাররুয যাহরানে অবস্থানরত দু শ’ অশ্বারোহী সৈন্যের কাছে গিয়ে অস্ত্র সংরক্ষণ করার জন্য দু শ’ ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যাতে করে এ সেনাদলও হারাম শরীফে প্রবেশ করে উমরার আমলসমূহ আঞ্জাম দিতে পারে।

উমরার আমল ও আনুষ্ঠনিকতা শেষ হলো। মুহাজিরগণ নিজেদের ঘর-বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁরা কয়েকজন আনসারকেও মেহমান হিসেবে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এভাবে আনসারগণ মুহাজিরগণকে দীর্ঘ ৮ বছর যে সেবা প্রদান করেছিলেন, মুহাজিরগণ তার খানিকটা পূরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর মক্কা নগরী ত্যাগ

ইসলাম ও মুসলমানদের চোখ ধাঁধাঁনো গৌরব এবং মর্যাদাকর অবস্থা মক্কার অধিবাসীদের মন-মানসিকতা ও আত্মিক বলের ওপর বিস্ময়কর প্রভাব ফেলেছিল। তারা মুসলমানদের আত্মিক শক্তির সাথে বেশি করে পরিচিত হলো। মুশরিক নেতারা বুঝতে পারল, পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের অবস্থান পৌত্তলিক ধর্ম ও মতাদর্শের প্রতি মক্কাবাসীদের আগ্রহ দুর্বল করে ফেলেছে এবং উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করেছে।

এ কারণেই হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়কাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর, হুওয়াইতিব নামের এক কুরাইশ প্রতিনিধি মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল : চুক্তিপত্রে যে সময় আপনাদের পবিত্র মক্কায় অবস্থান করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা বর্তমানে শেষ হয়ে গেছে। তাই যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের এলাকা ত্যাগ করুন।” কুরাইশ প্রতিনিধির এ স্পষ্ট উক্তির কারণে মহানবী (সা.)-এর কয়েকজন সাহাবী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে মহানবী এমন ধরনের ব্যক্তিত্ব ছিলেন না যে, তিনি চুক্তি মোতাবেক কাজ করার ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করবেন। মুসলমানদের মধ্যে মদীনার উদ্দেশে যাত্রা করার আহবান জানানো হলে সবাই তাৎক্ষণিকভাবে পবিত্র মক্কার হারাম শরীফ ত্যাগ করেন।

মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাসের স্ত্রী উম্মুল ফযলের বোন মায়মুনা মুসলমানগণের উদ্দীপনাপূর্ণ আবেগ ও অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভগ্নিপতি হযরত আব্বাসের কাছে পত্র পাঠিয়ে বলেছিলেন, তিনি মহানবী (সা.)-এর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রস্তুত।

মহানবী (সা.) মায়মুনার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন এবং এভাবে কুরাইশদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও বন্ধন অধিক দৃঢ় করেছিলেন। বয়সের বিস্তর ব্যবধান সত্বেও তাঁর প্রতি এক অল্পবয়স্কা তরুণীর ঝোঁক তাঁর (মহানবীর) আধ্যাত্মিক প্রভাবের এক উজ্জ্বল দলিল। এমনকি মহানবী (সা.) কুরাইশ প্রতিনিধির কাছে পবিত্র মক্কায় বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং ওয়ালীমা অর্থাৎ বিবাহোত্তর ভোজ-সভায় মক্কা নগরীর সকল নেতার অংশগ্রহণের সময় ও সুযোগের আবেদন জানালেন। কিন্তু কুরাইশ প্রতিনিধি তাঁর এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল : আপনার প্রদত্ত খাদ্যের কোন প্রয়োজন আমাদের নেই।”

মহানবী (সা.) মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন মধ্যাহ্নের আগেই মক্কা নগরী ত্যাগ করেন এবং দুপুরের পর সেখানে আর কেউ অবস্থান না করেন। তবে তিনি কেবল নিজ দাস আবু রাফেকে মক্কায় থেকে গিয়ে সন্ধ্যার সময় মহানবীর নবপরিণীতা বধূকে সাথে নিয়ে মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আদেশ দেন।৩০২

মুসলমানগণের মক্কা নগরী ত্যাগ করার পর মহানবী (সা.)-এর শত্রুরা মায়মুনাকে তিরস্কার করে। তবে তাদের তিরস্কার ও ভর্ৎসনা মায়মুনার মনের ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে নি। কারণ তিনি মহানবীর প্রতি আত্মিকভাবে ঝুঁকে পড়েছিলেন বলেই তাঁর সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

এভাবে এক বছর আগে মহানবী সত্য স্বপ্নের ভিত্তিতে মুসলমানদের পবিত্র কাবা যিয়ারত এবং তাদের সামনে পবিত্র মক্কার ফটকগুলো উন্মুক্ত হওয়ার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো।

এ প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গেই অবতীর্ণ হয়েছিল সূরা ফাত্হের ২৭তম আয়াত :

) لقد صدق اللهُ رسولَهُ الرّؤياء بالحقّ لتدخلنّ المسجدَ الحرامَ إن شاء الله آمنين محلّقين رؤوسكم و مقصّرين لا تخافون فَعَلِمَ ما لم تعلموا فجعل من دون ذلك فتحاً قريباً(

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তকমুণ্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন যা তোমরা জান না। এছাড়াও তিনি দিয়েছেন তোমাদের একটি আসন্ন বিজয়।”

সাতচল্লিশতম অধ্যায় : অষ্টম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মুতার যুদ্ধ

সপ্তম হিজরী অতিবাহিত হলো। হুদায়বিয়ার সন্ধির ছায়ায় মুসলমানরা দল বেঁধে একত্রে পবিত্র কাবা যিয়ারত করতে এবং পৌত্তলিকতার প্রাণকেন্দ্রে তাওহীদ বা একত্ববাদের অনুকূলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্লোগান দিতে সক্ষম হন। এর ফলে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ৩০৩ , আমর ইবনে আস এবং উসমান ইবনে তালহার মতো কতিপয় কুরাইশ নেতার অন্তর ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা মদীনায় আগমন করে মহানবী (সা.)-এর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং মক্কার প্রশাসনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন, যার নিস্প্রাণ কাঠামোই শুধু তখন বিদ্যমান ছিল।৩০৪

কতিপয় সীরাত রচয়িতা পঞ্চম হিজরীতে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও আমর ইবনে আসের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে নিঃসন্দেহে তাঁরা ঐ বছর ইসলাম গ্রহণ করেন নি। কারণ, খালিদ ইবনে ওয়ালীদ হিজরতের ষষ্ঠ বর্ষে সংঘটিত হুদাইবিয়ার যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর একটি অংশের সেনাপতি ছিলেন এবং এ দুই সেনাপতি একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

হিজরতের অষ্টম বর্ষের প্রথম দিকে হিজাজের বেশিরভাগ অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত শান্ত অবস্থা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাওহীদের আহবানধ্বনি অনেক এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করেছিল। উত্তরে ইহুদীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং দক্ষিণে কুরাইশদের আক্রমণ যখন আর ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য হুমকি নয়, তখনই মহানবী (সা.) শামের সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতি তাঁর আহবান ও প্রচার কার্যক্রম নিয়োজিত করা এবং ঐ দিনগুলোতে রোম সম্রাটের শাসনাধীন জনসমষ্টিকে ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এ কারণেই তিনি হারিস ইবনে উমাইর আয্দীকে একটি পত্র সহ শামের শাসনকর্তার দরবারে প্রেরণ করেন। সে সময় শামের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে নিযুক্ত হারিস ইবনে আবী শিমর গাসসানী। মহানবীর দূত শামের সীমান্তবর্তী নগরসমূহে প্রবেশ করলে সীমান্ত অঞ্চলগুলোর শাসনকর্তা শুরাহবীল তাঁর আগমনের কথা অবগত হয়ে তাঁকে মুতা’ গ্রামে গ্রেফতার করেন। পূর্ণাঙ্গ জিজ্ঞাসাবাদে মহানবীর দূত স্বীকার করেন, তিনি শামের শাসনকর্তা হারিস আল গাসসানীর কাছে মহানবীর পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্রবাহক। সীমান্ত এলাকার শাসনকর্তার আদেশে সব ধরনের মানবীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে এই দূতকে হাত-পা বেঁধে হত্যা করা হয়। অথচ সকল আন্তর্জাতিক ও মানবীয় নিয়ম অনুসারে পৃথিবীর সকল অঞ্চল ও রাষ্ট্রে দূতের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

মহানবী (সা.) শুরাহবীলের জঘন্য অপরাধ সম্পর্কে অবগত হন এবং দূত নিহত হওয়ায় অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ হন। এ ধরনের কাপুরুষোচিত কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি মুসলমানদের অবহিত করেন। আর এ কারণেই তিনি ইসলামের দূতকে হত্যাকারী এই উদ্ধত ও দাম্ভিক শাসনকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিজ সৈন্যদের আহবান জানান।

আরো বেদনাদায়ক ঘটনা

এ ঘটনার পাশাপাশি সে সময়ে আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যায়। এ ঘটনা শামের সীমান্ত অঞ্চলের ইসলাম প্রচারকদের ধর্ম প্রচার করার স্বাধীনতা হরণকারী অধিবাসী এবং কাপুরুষোচিতভাবে মহানবীর দূতকে হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্য মহানবীর সিদ্ধান্তকে দৃঢ়তর করেছিল।

হিজরতের অষ্টম বর্ষের রবী মাসে কা ব ইবনে উমাইর আল গিফারী মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে তাবলীগ (প্রচার কার্য) সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় দক্ষতার অধিকারী পনের ব্যক্তিকে নিয়ে ওয়াদীউল কুরার পশ্চাতে অবস্থিত যাত্ ইত্লাহ্ অঞ্চলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে তাওহীদী দীন ও মহানবী (সা.)-এর রিসালত প্রচারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ইসলামের প্রচার সৈনিকরা ঐ অঞ্চলে আগমন করে ইসলামের শক্তিশালী যু্ক্তি ও দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে জনগণকে তাওহীদের দিকে আহবান জানাতে থাকেন। হঠাৎ ঐ এলাকার জনগণ তাঁদের সাথে তীব্র বিরোধিতা শুরু করে এবং তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়।

মুবাল্লিগগণ নিজেদের এক বিশাল জনতার বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ দেখতে পান এবং তাঁরা প্রাণপণে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। অবশেষে তাঁরা অপদস্থতা ও বশ্যতা বরণ করার চেয়ে শাহাদাত লাভকেই প্রাধান্য দেন। তাঁদের মধ্যে নিহত ব্যক্তিদের লাশসমূহের মাঝে পড়ে থাকা আহত একজন মধ্যরাতে সে স্থান ত্যাগ করে মদীনার পথে অগ্রসর হন এবং মহানবীকে পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন।

প্রচারকর্মীদের হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনার কারণে মহানবী (সা.) জমাদি মাসে জিহাদের ফরমান জারী করেন এবং তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনী সীমা লঙ্ঘনকারী এবং ইসলামের প্রচারকার্যক্রমে বাধাদানকারীদের দমন করার জন্য (এ অঞ্চলের দিকে) প্রেরিত হয়।৩০৫

জিহাদের ফরমান জারী করা হলো। মদীনার সেনাছাউনীতে (জুরফ) তিন হাজার সাহসী যোদ্ধা সমবেত হলেন। মহানবী (সা.) নিজেই সেনাছাউনীতে এলেন এবং বক্তব্য প্রদান করলেন :

“তোমরা যে জায়গায় যাচ্ছ সেখানে ইসলামের দূতকে হত্যা করা হয়েছে। তাদেরকে তোমরা পুনরায় ইসলামের দাওয়াত দেবে। যদি তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তা হলে তোমরা ইসলামের দূতের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। আর তা না হলে, তোমরা মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। হে ইসলামের সৈনিকরা! তোমরা মহান আল্লাহর নামে জিহাদ করবে; মহান আল্লাহর শত্রুরা এবং তোমাদের শত্রুরা, যারা শামদেশে বসবাস করছে, তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেবে। যে সব সন্যাসী সমাজের কোলাহল থেকে বিমুখ হয়ে আশ্রম ও উপাসনালয়সমূহে বসবাস করছে, তাদের ওপর চড়াও হবে না। একদল লোকের মন-মগজে স্থাপিত শয়তানের আস্তানাগুলো তরবারির আঘাতে ধ্বংস করবে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের তোমরা হত্যা করবে না। কখনো তোমরা কোন খেজুর গাছ ও বৃক্ষ কাটবে না এবং কোন ঘর-বাড়িও ধ্বংস করবে না।৩০৬

হে মুজাহিদরা! সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আমার পিতৃব্যপুত্র জাফর ইবনে আবী তালিব। তিনি নিহত হলে যাইদ ইবনে হারেসা পতাকা তুলে নেবে এবং সেনাবাহিনী পরিচালনা করবে, আর সেও নিহত হলে সেনাদলের অধিনায়ক হবে আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা। আর সেও যদি নিহত হয়, তা হলে তোমরা কোন একজনকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নির্বাচিত করবে।”

এরপর সেনাবাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেয়া হলো এবং মহানবী (সা.) একদল মুসলমানকে সাথে নিয়ে সানীয়াতুল বিদা পর্যন্ত গিয়ে তাদেরকে বিদায় দেন। সেখানে বিদায় দানকারীরা সৈন্যদের বিদায় দিল এবং তারা পূর্ব প্রথা অনুযায়ী বলল : دفع الله عنكم و ردّكم سالمين غانمين মহান আল্লাহ্ তোমাদের থেকে শত্রুদেরকে দূরে ঠেলে দিন এবং নিরাপদে ও যুদ্ধের গনীমতসহ তিনি তোমাদের ফিরিয়ে আনুন।”

কিন্তু সেনাদলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অধিনায়ক ইবনে রাওয়াহা তাদের জবাবে এ কাব্যপঙ্ক্তি আবৃত্তি করলেন :

لكنّنِى أسأل الرّحمان مغفرة

و ضربة ذات قرع تقذف الزبدا

 “কিন্তু আমি পরম দয়ালু মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং কামনা করছি (তরবারির) প্রচণ্ড এক আঘাত যার ফলে হাতের তালু থেকে রক্ত ঝরবে।”৩০৭

এ বাক্য আসলে এ অধিনায়কের ঈমানী শক্তির মাত্রা এবং মহান আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণের প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহের প্রমাণ। এ অবস্থায় সবাই দেখতে পায় যে, এ সাহসী অধিনায়ক কাঁদছেন। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন : দুনিয়ার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র টান নেই। তবে আমি মহানবী (সা.)-কে এ আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনেছি :

) و إن منكم إلّا واردها كان علي ربّك حتما مقضيّا(

-মহান আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী ফয়সালা এটাই যে, তোমাদের সবাইকে দোযখের উপর আসতেই হবে এবং সেখান থেকে পুণ্যবানরা বেহেশতের দিকে রওয়ানা হবে।৩০৮

তখন আমার দোযখের উপর আগমন অবশ্যম্ভাবী। তবে আমার কাছে স্পষ্ট নয়, দোযখের উপর আমার আগমনের পরিণতি কেমন হবে (অর্থাৎ আমি কি দোযখের উপর আগমন করার পর সেখান থেকে পুণ্যবানদের সাথে বেহেশতের দিকে রওয়ানা হতে পারব, নাকি দোযখের মধ্যে পতিত হব)? ৩০৯

ইসলামের মুবাল্লিগগণের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড

আদাল (عضل ) ও কারা (قاره ) গোত্রের একদল প্রতিনিধি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলে : হে রাসূলাল্লাহ্! আমাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে এবং আমাদের সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আপনি দয়া করে আপনার একদল সাহাবীকে প্রেরণ করুন তাঁরা আমাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবেন,আমাদেরকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবেন এবং মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত হালাল ও হারাম সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবেন। 75

মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব ছিল এই যে,কতিপয় বড় গোত্রের প্রতিনিধি এ দলটির আহবানে সাড়া দেবেন। আর মুসলমানদেরও দায়িত্ব ছিল যে কোন কিছুর বিনিময়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। এ কারণে মহানবী (সা.) মুরসেদ নামক এক সাহাবীর অধিনায়কত্বে একটি দলকে গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে উল্লিখিত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তাঁরা গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে মদীনা এবং মুসলমানদের শক্তি ও কর্তৃত্বের আওতার বাইরে চলে যান এবং রাযী নামক এক পানির উৎসের স্থানে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে গোত্রীয় প্রতিনিধিরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তারা হুজাইল গোত্রের সাহায্য নিয়ে মদীনা থেকে প্রেরিত লোকদের বন্দী ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঐ অঞ্চলে মুসলমানরা (মদীনা থেকে প্রেরিত মুবাল্লিগ) যখন শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন,তখন তরবারি ছাড়া তাঁদের আর কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। এ কারণে তরবারির বাঁট শক্ত করে হাতে ধরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য তাঁরা তৈরি হয়ে যান। কিন্তু শত্রুপক্ষ শপথ করে বলে : তোমাদের বন্দী করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো তোমাদের জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে কুরাইশ নেতাদের হাতে তুলে দেয়া এবং তার বিনিময়ে কিছু অর্থ লাভ করা।

মুসলিম মুবাল্লিগগণ একে অপরের দিকে তাকালেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সিদ্ধান্ত নিলেন,তাঁরা লড়াই করবেন। তাঁরা বললেন : আমরা মূর্তিপূজারী ও মুশরিকদের কোন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করব না। অতঃপর তাঁরা তরবারি কোষমুক্ত করেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় ও মহানবী (সা.)-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত লাভ করেন। কিন্তু যাইদ ইবনে দাসিনাহ্,খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ্ তরবারি কোষবদ্ধ করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অর্ধেক পথে এসে আবদুল্লাহ্ আত্মসমর্পণ করার কারণে অনুতপ্ত হন। তিনি হাতের বাঁধন খুলে ফেলেন এবং তরবারি কোষমুক্ত করে শত্রুর ওপর আক্রমণ করেন। শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করে এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে ধরাশায়ী করে। তারা তাঁর দিকে এত বেশি পাথর নিক্ষেপ করে যে,তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই প্রাণ হারান। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু অপর দুই বন্দীকে মক্কার কাফেরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বিনিময়ে মুসলমানদের যারা বন্দী করেছিল তাদের দুই বন্দীকে কুরাইশরা মুক্তি দেয়।

সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা,যার পিতা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল,বন্দী যাইদকে ক্রয় করে যাতে একজন ইসলাম প্রচারককে হত্যার মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে,এক বিশাল জনতার সামনে যাইদকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। তানঈমে76 ফাঁসিকাষ্ঠ টানানো হয়।

কুরাইশরা ও তাদের মিত্ররা নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে সমবেত হয়। তার মৃত্যুর জন্য কয়েক মুহূর্তের বেশি বাকী ছিল না।

মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ান সকল ঘটনায় নিজে দূরে থেকে নেপথ্যে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। আবু সুফিয়ান এবার যাইদকে লক্ষ্য করে বলে : তুমি যে আল্লাহকে বিশ্বাস করো,তার শপথ দিয়ে বলছি-আমাকে বলো,তুমি কি চাও যে,মুহাম্মদ তোমার পরিবর্তে নিহত হোক? তা হলে তুমি মুক্তি পাবে এবং নিজ ঘরে ফিরে যাবে।

যাইদ পূর্ণ সাহসিকতার সাথে বললেন :  আমি কখনো রাজি হব না যে,মহানবী (সা.)-এর পায়ে কোন কাঁটা বিদ্ধ হোক,যদিও তার বিনিময়ে আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

যাইদের বলিষ্ঠ জবাব আবু সুফিয়ানকে বিব্রত করে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীগণের ভালোবাসার আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে সে মন্তব্য করে : আমার দীর্ঘ জীবনে মুহাম্মদের সাথীদের মতো আর কারো সাথী দেখি নি,যারা এত বেশি ত্যাগী হতে পারে,এত অধিক ভালোবাসা পোষণ করতে পারে!

কিছুক্ষণের মধ্যেই যাইদকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। তাঁর প্রাণপাখি উড়ে যায় ঊর্ধ্বলোকের পানে। সত্য ও ন্যায়ের সীমান্ত রক্ষায়,ইসলামের সত্য বাণী প্রচারের লক্ষ্যে এঁরা শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি খুবাইব দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থায় কাটান। মক্কার পরামর্শসভা সিদ্ধান্ত নেয়,তাঁকেও তানঈম-এ ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হবে।77

খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের পাশে মক্কার নেতা ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দু রাকাত নামায আদায়ের অনুমতি গ্রহণ করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে দু রাকাত নামায আদায় করেন এবং কুরাইশ নেতাদের লক্ষ্য করে বলেন : আমি মৃত্যুকে ভয় করি বলে তোমাদের ধারণা হতে পারে-এ সন্দেহ যদি না হতো,তা হলে এর চেয়ে বেশি নামায পড়তাম।78 নামাযের রূকূ ও সিজদা দীর্ঘ করতাম। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আপনার নবীর পক্ষ হতে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা আমরা পালন করেছি। ঐ মুহূর্তে হত্যার আদেশ জারি করা হয়। খুবাইবকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়। খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের ওপর বলতে লাগলেন : হে আল্লাহ্! আপনি জানেন,আমার একজন বন্ধুও আশেপাশে নেই,যে আমার সালাম মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেবে। হে আল্লাহ্! আপনিই আমার সালাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিন।

হয় তো এই আধ্যাত্মিক পুরুষের ধর্মীয় আবেগ আবু উকবার সহ্য হচ্ছিল না। সে দাঁড়িয়ে খুবাইবের ওপর এক শক্ত আঘাত হানে এবং তাঁকে শহীদ করে।

ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী79 খুবাইব প্রাণত্যাগের পূর্বক্ষণে শূলির উপর এ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

فوالله ما أرجو اذا مت مسلما

علي اى جنب كان فى الله مصرعى

وذلك فِى ذات االله و ان يشأ

يبـارك علي اوصـال شلـومـمزع

মহান আল্লাহর শপথ! যদি মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করি,

তা হলে কোন্ এলাকায় আমাকে দাফন করা হবে,তা নিয়ে চিন্তা করি না।

আমার এই হৃদয়বিদারক মৃত্যু আল্লাহর পথে,তিনি যদি চান,

এ শাহাদাত আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মুবারক করে দেবেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহানবী (সা.)-কে দারুণভাবে মর্মাহত করে এবং মুসলমানদের গভীর শোকে নিমজ্জিত করে। মুসলমানদের মহান কবি হাস্সান ইবনে সাবিত এ উপলক্ষে মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেন যা ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

রাসূল (সা.) এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন,এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এর ফলে বহু কষ্টে প্রশিক্ষিত ইসলাম প্রচারের বীর সেনানীর উপর অপূরণীয় আঘাত আসতে পারে। কুৎসিত অন্তরের ইতর লোকেরা পূত চরিত্রের ধর্মপ্রচারকগণের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যেতে পারে।

এই বীর মুজাহিদের লাশ বহু দিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলন্ত ছিল। একদল লোক লাশ পাহারা দিত। অবশেষে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে দু জন দুঃসাহসী মুসলমান রাতের বেলা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাঁর লাশ নামিয়ে আনেন এবং দাফন করেন।80

বীরে মাউনার ঘটনা

হিজরী চতুর্থ সালের সফর মাসে রাযী নামক স্থানে ইসলামের কৃতি সন্তানদের শাহাদাতের খবর মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছার আগে আবু বাররা আমেরী মদীনায় আগমন করে। মহানবী (সা.) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত কবুল করল না। তবে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে আরয করল,যদি তিনি শক্তিশালী কোন ধর্ম প্রচারকারী দলকে নাজদ এলাকায় প্রেরণ করেন,তা হলে তাদের ঈমান আনার আশা করা যায়। কেননা তাওহীদের প্রতি তাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। মহানবী (সা.) বললেন : নাজদবাসীদের প্রতারণা ও শত্রুতাকে আমি ভয় পাই। আবু বাররা বলল : আপনার প্রেরিত ব্যক্তিবর্গ আমার আশ্রয়ে থাকবেন। আমিই নিশ্চয়তা দিচ্ছি,আমি তাদেরকে যে কোন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করব।

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে চল্লিশ জন ইসলাম ধর্ম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব,মুনযির-এর নেতৃত্বে নাজদের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁদের সবাই ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেয ও ধর্মীয় বিধানে পারদর্শী। তাঁরা বীরে মাউনার (মাউনার কূপ) কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি করেন। মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একখানা পত্র নাজদ গোত্রীয় নেতা আমর ইবনে তুফাইলের উদ্দেশে লিখেছিলেন। তাঁর পত্র আমেরের কাছে পৌঁছানোর জন্য একজন মুসলমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমের শুধু যে মহানবী (সা.)-এর চিঠিখানা পড়ে নি,তা নয়;বরং পত্রবাহককেও হত্যা করে। এরপর সে তার গোত্রের লোকদের ইসলাম প্রচারকগণকে হত্যা করার আহবান জানায়। গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে এবং বলে,গোত্রের মুরব্বী আবু বাররা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজ গোত্রের লোকদের সাহায্যের ব্যাপারে সে নিরাশ হয় এবং আশেপাশের গোত্র ও সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চায়। এভাবে ইসলামের মুবাল্লিগগণের অবস্থানস্থলটি আমেরের লোকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়।

ইসলামের প্রচারকারীরা শুধু যে বড় জ্ঞানী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন,তা-ই নয়;বরং বীর যোদ্ধাও ছিলেন। তাঁরা আত্মসমর্পণকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করেন এবং তরবারি হাতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু কা ব ইবনে যাইদ আহত শরীর নিয়ে কোনমতে মদীনা পৌঁছেন এবং ঘটনাটি মহানবীকে অবহিত করেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা গোটা ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের দারুণভাবে মর্মাহত করে। মহানবী (সা.) বহু দিন ধরে বীরে মাউনার স্মরণ করতেন।81

এ দু টি ঘটনাই ছিল উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কেননা এর ফলে মুসলমানদের হত্যার জন্য আশেপাশের গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল।

প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান

প্রাচ্যবিদরা যেখানে কোন মুশরিকের মুখে সামান্য আঁচড় লাগলেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর মারমুখী হয়ে যান,আর জোর করে এ কথা বলার চেষ্টা করেন যে,ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে,তাঁরা এই বেদনাদায়ক দু টি ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেন নি।

বিশ্বের কোথায় আছে যে,জ্ঞানের ঝাণ্ডাবাহীদের হত্যা করা হয়? ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়ে থাকলে এই মিশনারী দলগুলো কেন প্রাণকে হাতের তালুতে রেখে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন এবং শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেছেন?

এ দু টি ঘটনার অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে। তাঁদের ঈমানের শক্তি,আত্মত্যাগ,জান বাজি রেখে যুদ্ধ ও সাহসিকতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়,বিস্ময়কর এবং মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস।

মুমিন কখনো একবারের বেশি প্রতারিত হয় না

রাযী ও বীরে মাউনার হৃদয়বিদারক ঘটনায় ইসলামের বহু মুবাল্লিগ শহীদ হওয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে দারুণ মর্মবেদনার সৃষ্টি হয়। এক অস্বাভাবিক ধরনের বিষাদ মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখানে এসে পাঠকদের মনে হয় তো প্রশ্ন জাগবে,মহানবী (সা.) কেন এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? প্রথম ঘটনায় অর্থাৎ রাযীর নিকটে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে,তারপরও অপর চল্লিশ ব্যক্তিকে তিনি কেন বীরে মাউনায় পাঠালেন? মহানবী (সা.) কি নিজেই বলেন নি : لا يلدغ المؤمن من جُحر مرّتين মুমিন (সর্পের) এক গর্ত হতে দু বার দংশিত হয় না।

এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেননা ইসলাম প্রচারকারী দলটি আবু বাররার গোত্রের হাতে শহীদ হন নি। যদিও তার ভাতিজা আমের ইবনে তুফাইল আবু বাররার গোত্র-যা তার নিজেরও গোত্র-ইসলাম প্রচারকদের হত্যার জন্য প্ররোচিত করছিল,কিন্তু ঐ গোত্রের একজনও তার কথায় সায় দেয় নি। সবাই বলেছিল : তোমার চাচা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমের ইবনে তুফাইল পার্শ্ববর্তী ভিন্ন গোত্র সালীম যাকওয়ান -এর কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং ইসলাম প্রচারকগণকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইসলামের প্রচার সৈনিকরা আবু বাররার এলাকার উদ্দেশে গমনকালে নিজেদের মধ্য থেকে আমর ইবনে উমাইয়্যা ও হারিস ইবনে সিম্মাহকে82 তাঁদের উটগুলো চরানো ও দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁরা তাঁদের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় হঠাৎ আমের ইবনে তুফাইল তাঁদের ওপর চড়াও হয়। ফলে হারিস ইবনে সিম্মাহ্ নিহত হন এবং আমর ইবনে উমাইয়্যাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমর ইবনে উমাইয়্যা মদীনায় ফিরে আসার সময় দু জন লোকের সাক্ষাৎ পান। তিনি নিশ্চিত হন,তারা সেই গোত্রের লোক যারা দীনের মুবাল্লিগগণকে হত্যা করেছে। এ কারণে তিনি উভয়কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন।

তাঁর এ কাজটি ভুল ধারণার কারণে হয়েছিল। কেননা তারা আবু বাররার (বনী আমের) গোত্রের লোক ছিল,যারা আপন গোত্রপতির প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের দলের ওপর হামলা চালাতে রাযী হয় নি।

এ ঘটনার ফলেও মহানবী (সা.)-এর মর্মবেদনা বৃদ্ধি পায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন,ঐ দু জনের রক্তমূল্য তিনি পরিশোধ করবেন।

তবে এ ব্যাপারে তাবাকাতে ইবনে সা দ-এর83 প্রণেতা স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন,উভয় দলের পরিণতির খবর একই রাতে মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছায়। দ্বিতীয় দলটি পাঠানোর সময় মহানবী (সা.) রাযীর শহীদদের ভাগ্যে কী ঘটেছে,তা জানতেন না।

চৌত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বনী নাযীরের যুদ্ধ

মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীরা উহুদে মুসলমানদের পরাজয় এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণের নিহত হবার ঘটনায় দারুণ খুশী হয়েছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল,মদীনায় কোন বিদ্রোহ ঘটাবে। এর মাধ্যমে মদীনার বাইরের গোত্রগুলোকে বোঝাবে যে,মদীনায় ন্যূনতম ঐক্য ও সংহতি বিদ্যমান নেই। কাজেই বহিঃশক্তি এসে ইসলামের নব্য প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করতে পারবে।

মহানবী (সা.) বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদের উদ্দেশ্য ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য একদল সৈনিকসহ তাদের দুর্গের দিকে গমন করেন। কিন্তু বনী নাযীরের সাথে যোগাযোগের পেছনে মহানবীর দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছিল আমর ইবনে উমাইয়্যার হাতে নিহত বনী আমের গোত্রের দুই আরবের রক্তমূল্য পরিশোধে তাদের সহায়তা নেয়া। কেননা বনী নাযীর গোত্র মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ওদিকে বনী আমেরের সাথেও তাদের মৈত্রীচুক্তি ছিল। চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলো সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

মহানবী (সা.) দুর্গের প্রবেশদ্বারে অবতরণ করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যের কথা গোত্রীয় প্রধানদের কাছে তুলে ধরেন। তারা দৃশ্যত খোলা মনে মহানবীকে অভ্যর্থনা জানায় এবং কথা দেয়,রক্তমূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারা তাঁকে সাহায্য করবে। তারা মহানবীকে তাঁর ডাকনাম আবুল কাসেম -এ সম্বোধন করে অনুরোধ করতে থাকে : আপনি আমাদের দুর্গে প্রবেশ করুন এবং একটি দিন এখানে অবস্থান করুন। রাসূল তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন না;বরং দুর্গের দেয়ালের ছায়ায় সাথী ও সৈনিকগণ সহ বসেন এবং বনী নাযীর গোত্রের সর্দারদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন।84

মহানবী (সা.) উপলব্ধি করেন,তাদের মিষ্টি মিষ্টি কথার সাথে এক ধরনের সংশয়পূর্ণ রহস্যজনক তৎপরতা মিশে আছে। অন্যদিকে তিনি যেখানে বসে ছিলেন,সেখানে লোকজনের আনাগোনা বেশি করে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কানে কানে কথাবার্তা বেশি হচ্ছিল,যা থেকে সহজেই সন্দেহ জাগে। মূলত বনী নাযীরের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,মহানবীকে অতর্কিত আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। তাদের একজন আমর হাজ্জাশ প্রস্তুতি নিয়েছিল,সে ছাদের উপর যাবে এবং মহানবী (সা.)-এর উপর একটি পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করবে।

সৌভাগ্যজনকভাবে তাদের নীল-নকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের সন্দেহপূর্ণ ও অসংলগ্ন আচরণ থেকে তাদের চক্রান্ত আঁচ করা যাচ্ছিল। আল ওয়াকিদীর বর্ণনা অনুযায়ী ওহীর ফেরেশতা মহানবীকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে সরে বসেন এবং এমনভাবে মজলিস ছেড়ে উঠে যান যে,ইহুদীরা মনে করল,কোন কাজে তিনি বাইরে যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু রাসূল (সা.) মদীনার পথ ধরে অগ্রসর হন। তাঁর সাহাবীগণকেও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানালেন না। তাঁরা তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু তাঁরা যতই অপেক্ষা করুন,তাতে কোন ফল হলো না।

বনী নাযীরের ইহুদীরা দারুণ দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেল। তারা একদিকে ধারণা করছিল যে,মহানবী (সা.) তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছেন। তা-ই যদি হয়,তবে তাদের বড় ধরনের শাস্তি পেতে হবে। অপরদিকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল : মহানবী যেহেতু এখন আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছেন,তার প্রতিশোধ আমরা তার সাথীদের কাছ থেকেই নিই। তবে সাথে সাথে বলছিল যে,এ অবস্থায় পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে যাবে এবং মহানবী (সা.) নিঃসন্দেহে আমাদের কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেবেন।

এহেন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর সাথে যাঁরা এসেছিলেন,তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন,মহানবীর খোঁজে তাঁরা যাবেন এবং তিনি কোথায় আছেন,তা সন্ধান করবেন। দুর্গের প্রাচীর থেকে বেশি দূরে যেতে না যেতেই তাঁরা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান,যিনি মদীনা থেকে আসছিলেন। তিনি মহানবীর মদীনা প্রবেশের সংবাদ নিয়ে আসেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ মহানবীর নিকট উপস্থিত হন। সেখানেই তাঁরা ইহুদীদের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন,যা ওহীর ফেরেশতা জিবরীল (আ.) তাঁকে জানিয়েছিলেন।85

এ জঘন্য অপরাধ মোকাবেলায় করণীয়

এখন এ বিশ্বাসঘাতকদের ব্যাপারে মহানবীর করণীয় কি? এরাই সেই সম্প্রদায় যারা ইসলামী হুকুমতের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল। ইসলামের সৈনিকরা তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করছিলেন। জীবনভর তারা মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বচক্ষে দেখছিল। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে শেষ নবীর সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য ও প্রমাণ দেখতে পেয়েছে;অথচ তাঁকে আতিথেয়তার পরিবর্তে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছে। অত্যন্ত কাপুরুষোচিত পন্থায় তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে।

এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের দাবী কী? এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরূপ বিশ্বাসঘাতকতার মূলোৎপাটন করা হয়,তার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) গৃহীত পদ্ধতি ছিল যুক্তিসঙ্গত। গোটা সেনাবাহিনীতে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমা আউসীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দেন,অতি সত্বর তাঁর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত হুকুম যেন বনী নাযীরের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি বনী নাযীরের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বললেন : ইসলামের মহান নবী আমার মাধ্যমে তোমাদের কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছেন যে,দশ দিনের মধ্যে অবশ্যই তোমরা এই ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাবে। কেননা তোমরা চুক্তিভঙ্গ করেছ,প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ। যদি দশ দিনের মধ্যে এ এলাকা ত্যাগ না কর,তা হলে তোমাদের রক্ত প্রবাহিত করা হবে।

এ বার্তা ইহুদীদের মধ্যে মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যেকে এ ষড়যন্ত্রের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে। তাদের জনৈক নেতা সবাইকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব করে। কিন্তু অধিকাংশের গোয়ার্তুমী এ প্রস্তাব গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চরম অসহায়ত্ব তাদের ঘিরে ধরে। নিরুপায় হয়ে মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমার উদ্দেশে বলে : হে মুহাম্মদ! আপনি আউস গোত্রের লোক। মহানবীর আগমনের পূর্বে আউস গোত্রের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল। এখন কেন আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন?”   তিনি পূর্ণ সৎ সাহস ও বলিষ্ঠতা সহকারে বললেন : সেদিন পার হয়ে গেছে। এখন মানুষের মন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এ সিদ্ধান্ত সেই চুক্তির আওতায় নেয়া হয়,যে চুক্তি মহানবীর মদীনা আগমনের প্রথম দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে সম্পাদন করেছিলেন। ঐ চুক্তিতে বনী নাযীর গোত্রের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির বিষয়বস্তু আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে : মহানবী তিন গোত্রের সাথেই (বনী নাযীর,বনী কাইনুকা ও বনী কুরাইযাহ্) চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন,তারা কখনো রাসূলুল্লাহ্ ও তাঁর সাহাবীগণের ক্ষতি করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেবে না;মুখে বা হাতে তাঁদের কোন ক্ষতি করবে না।... যদি ঐ তিন গোত্রের কোন একটি চুক্তির বিষয়বস্তুর বিরোধী আচরণ করে,তা হলে তাদের রক্তপাত ঘটানো,সম্পদ বাজেয়াফ্ত করা এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী করার অধিকার মহানবীর থাকবে।86

কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন

প্রাচ্যবিদদের দেখা যায়,এখানে এসে তাঁরা পুনরায় কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন শুরু করে দেন। তাঁরা মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের মতো বনী নাযীর গোত্রের বিশ্বাসঘাতক,চুক্তিভঙ্গকারী ইহুদীদের জন্য যারপর নাই অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা মহানবীর কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তাদের এ মায়াকান্না ও সমালোচনা সত্য উদ্ঘাটন বা প্রকৃত বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে নয়। কেননা সম্মানিত পাঠকবর্গ ইহুদীদের সাথে মহানবীর চুক্তির যে বিবরণ পাঠ করেছেন,তাতে এ মতটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে,মহানবী তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তা চুক্তিপত্রে উল্লিখিত শাস্তির চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক লঘু। আজকের দিনে এসব প্রাচ্যবিদের প্রভুদের পক্ষ থেকে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে কত জঘন্য অপরাধ করা হচ্ছে,অথচ এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্য হতে একজনও সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) যখন মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতককে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লিখিত শাস্তির চেয়েও কম শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তখন কতিপয় লেখক সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন। অথচ এসব লেখক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ জাতীয় ঘটনাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53