চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84029 / ডাউনলোড: 8004
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

প্রথম অধিনায়কের ব্যাপারে মত-পার্থক্য

কতিপয় সীরাত রচয়িতা লিখেছেন, প্রথম অধিনায়ক ছিলেন মহানবী (সা.)-এর পালকপুত্র যাইদ ইবনে হারেসা। আর জাফর ও আবদুল্লাহ্ যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় সহকারী ছিলেন। তবে শিয়া গবেষক আলেমগণ এ ধারণার বিপরীতে হযরত জাফর ইবনে আবী তালিবকে এ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বলে জানেন এবং অন্য দু জন অর্থাৎ যাইদ ও আবদুল্লাহকে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় সহকারী অধিনায়ক হিসেবে গণ্য করেন। এখন আমাদের অবশ্যই দেখা উচিত যে, এ দুই অভিমতের মধ্যে কোনটি বাস্তব অবস্থার সাথে খাপ খায়? এ বাস্তবতায় উপনীত হবার জন্য দু টি পথ আছে। যথা :

১. সামাজিক মর্যাদা এবং তাকওয়া ও জ্ঞানগত পর্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে যাইদ ইবনে হারেসা জাফর আত তাইয়ারের সমকক্ষ ছিলেন না। ইবনে আসীর উসদুল গাবাহ্ গ্রন্থে জাফর তাইয়ার সম্পর্কে লিখেছেন : তিনি চরিত্র, মন-মানসিকতা, আত্মিক শক্তি, মুখাবয়ব এবং দৈহিক কাঠামোগত দিক থেকে মহানবী (সা.)-এর সদৃশ ছিলেন। তিনি আলী (আ.)-এর ঈমান আনয়নের স্বল্প সময় পরেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। যেদিন হযরত আবু তালিব (রা.) আলী (আ.)-কে রাসূলের ডান পাশে নামায আদায় করতে দেখলেন সেদিন তিনি জাফরকে বলেছিলেন : তুমিও তার (মহানবী) বাম পাশে গিয়ে নামায আদায় কর।”

জাফর ঐ দলের নেতা ছিলেন যারা নিজের ধর্ম রক্ষা করার জন্য মক্কায় নিজেদের ঘর-বাড়ী ও জীবনযাত্রা ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে হাবাশায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি সেখানে মুহাজিরদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি শক্তিশালী ও কার্যকর যুক্তি উপস্থাপন করে হাবাশার বাদশার অন্তরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছিলেন। তিনি হযরত ঈসা মসীহ্ এবং তাঁর মা হযরত মারিয়াম সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াত তেলাওয়াত করে ঐ সব কুরাইশ প্রতিনিধি, যারা হিজরতকারী মুসলমানদেরকে হিজাযে ফিরিয়ে আনার জন্য হাবাশায় গিয়েছিল, তাদের মিথ্যাবাদিতা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি আশ্রয় গ্রহণকারী মুহাজির মুসলমানদের পক্ষে হাবাশার বাদশার সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এর ফলে বাদশাহ্ নাজ্জাশী কুরাইশ প্রতিনিধিদেরকে তাঁর দরবার থেকে বের করে দিয়েছিলেন।৩১০

জাফর সেই ব্যক্তি, মহানবী (সা.) খাইবরে হাবাশাহ্ থেকে তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে ১৬ কদম এগিয়ে গিয়ে তাঁকে বরণ করেন এবং তাঁর কাঁধে হাত রেখে তাঁর কপালে চুম্বন করেন। মহানবী (সা.) আনন্দের আতিশয্যে খুব কেঁদেছিলেন এবং বলেছিলেন : আমি জানি না, হাবাশাহ্ থেকে তোমার আগমন বা তোমার ভাই আলীর হাতে খাইবর বিজয়- এ দু টি ঘটনার মধ্যে কোনটির জন্য অধিক আনন্দিত হব?

তিনি সেই মহান ব্যক্তি, যাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাহস, বীরত্ব ও পৌরুষের কথা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) স্মরণ করেছেন। যখন হযরত আলী (আ.) জানতে পারলেন, আমর ইবনে আস মুআবিয়ার হাতে বাইআত করেছেন এবং তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন যে, তাঁরা আলীর ওপর বিজয়ী হলে মুআবিয়া মিশরের শাসনকাজ আমরের হাতে অর্পণ করবেন, তখন আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এ সংবাদ শুনে অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর চাচা হামযাহ্ এবং ভাই জাফরের বীরত্বের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন : এ দুই ব্যক্তি জীবিত থাকলে আমার বিজয়ের তারকা উদিত হতো।”৩১১

এ ধরনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মুখ্য চরিত্র, যার খানিকটা এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, থাকতে কি বিবেক-বুদ্ধি অনুমতি দেবে যে, মহানবী সর্বাধিনায়কত্বের পদ যাইদকে প্রদান করবেন এবং জাফরকে তাঁর প্রথম সহকারী’ নিযুক্ত করবেন?

২. এ সব সেনাপতির শোকে যে সব শোকগাঁথা বড় বড় মুসলিম কবি রচনা করেছেন, সেসব থেকেও প্রমাণিত হয়, জাফরই ছিলেন এ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং যাইদ ও আবদুল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল সহকারীর পদ। মহানবী (সা.)-এর যুগের কবি হাসসান ইবনে সাবিত অধিনায়কদের শাহাদাতের শোক-সংবাদ পৌঁছানোর পর একটি কাসীদাহ্ পাঠ করেছিলেন, এর মূল পাঠ সীরাতে ইবনে হিশামে উল্লিখিত আছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন :

“মুতার রণাঙ্গনে যে সব অধিনায়ক একের পর এক নিহত হয়েছেন, তাঁরা সবাই মহান আল্লাহর করুণা ও দয়ার মধ্যে নিমজ্জিত। তাঁরা হলেন জাফর, যাইদ ও আবদুল্লাহ্ যাঁরা একের পর এক মৃত্যুর কারণগুলোকে করেছেন বুক পেতে আলিঙ্গন।”৩১২

এ সব শোকগাঁথা ও কবিতার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট হচ্ছে কা ব ইবনে মালেকের কাসীদাহ্ যা তিনি মুতার যুদ্ধের শহীদদের শোকে রচনা করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, প্রথম অধিনায়ক ছিলেন জাফর এবং কবি নিজেই মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ জারী করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। মহানবী (সা.) সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব সর্বপ্রথম জাফরের হাতে অর্পণ করেছিলেন। কবি তাঁর ভাষায় বলেন :

إذ يهتدونِى بجعفر ولوائه

قدام أوّلهم فنعم الأوّل

ঐ সময়ের কথা তোমরা কর স্মরণ

ইসলামের সৈনিকরা প্রথম অধিনায়ক জাফরের পতাকাতলে যখন

জিহাদের ময়দানের দিকে করেছিল গমন।

ঐ দিনগুলোর রচনা এ কবিতাগুলো কালের বিবর্তনে আজও টিকে আছে এবং সংরক্ষিত আছে। এগুলো হচ্ছে এ বিষয়ের সবচেয়ে জীবন্ত ও শক্তিশালী প্রমাণ যে, আহলে সুন্নাতের সীরাত রচয়িতারা এ প্রসঙ্গে যা লিখেছেন, তা আসলে বাস্তবতাবিরোধী। রাবিগণ বিশেষ কতকগুলো রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের জন্য তা জাল করেছেন এবং সীরাত রচয়িতাগণও যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেগুলো তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ঐসব রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ গ্রন্থে এখন আলোচনা সম্ভব নয়। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ইবনে হিশাম যদিও কাসীদাসমূহ উল্লেখ করেছেন, তবুও তিনি জাফর তাইয়ারকে প্রথম সহকারী বলে গণ্য করেছেন।৩১৩

মুসলিম ও রোমান সেনাবাহিনীর রণাঙ্গনে অবস্থান গ্রহণ

রোম তখন ইরানের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করার কারণে অদ্ভুত ধরনের গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হয়েছিল। পারস্যের ওপর তাদের বিজয়গুলোর কারণে উৎফুল্ল থাকা সত্বেও তারা ইসলামের মুজাহিদগণের সাহসিকতা ও বীরত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। উল্লেখ্য, তাঁরা (ইসলামের মুজাহিদগণ) তাঁদের সত্তাগত বীরত্ব ও ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়েই এতসব গৌরব অর্জন করেছিলেন। এ কারণেই, ইসলামের সৈনিকদের যাত্রা করার সময় এবং তাদের প্রস্তুতির কথা রোম-সরকারকে জানানো হয়েছিল। রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস শামদেশে তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তার সাহায্য নিয়ে তিন হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য বিশাল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। শামদেশের শাসনকর্তা শুরাহবীল একাই শামের বিভিন্ন গোত্র থেকে এক লাখ যোদ্ধা সংগ্রহ করে নিজ পতাকাতলে সমবেত করেছিল। মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য সে ঐ বিশাল সেনাবাহিনীকে শামের সীমান্তগুলোর দিকে প্রেরণ করে। এমনকি রোমান সম্রাটও পূর্বের তথ্যের ভিত্তিতে এক লাখ সৈন্য নিয়ে রোম থেকে যাত্রা করেন এবং বাল্কা অঞ্চলের মায়াব নামের একটি নগরীতে প্রবেশ করে যাত্রাবিরতি করেন এবং সাহায্যকারী রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে সেখানে অবস্থান নেন।৩১৪

মুসলমানদের বিজয় সংক্রান্ত যে সব তথ্য রোমের সমরাধিনায়কদের কাছে পৌঁছতো সেগুলোর ভিত্তিতেই ক্ষুদ্র একটি সেনাদলকে মোকাবেলার জন্য এত সৈন্য সমাবেশ ও বিশাল সেনাবাহিনীর আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। অথচ তিন হাজার সৈন্য, যত সাহসীই হোক না কেন, তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এ বিশাল সেনাবাহিনীর এক-দশমাংশই যথেষ্ট ছিল।

ঠিক একইভাবে এ দুই সেনাবাহিনীর সামর্থ্য ও যোগ্যতার তুলনামূলক মূল্যায়ন করলে, মুসলিম বাহিনী- কী লোকবল, কী সামরিক কলা-কৌশল- উভয় দিক থেকে রোমান সেনাবাহিনীর চেয়ে বহু গুণ দুর্বল ছিল। কারণ, রোমান সেনা কর্মকর্তারা ইরান ও রোমের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধগুলোয় অংশগ্রহণ করার ফলে কতকগুলো গোপন সামরিক কৌশল ও সাফল্যের গোপন রহস্য আয়ত্ব করেছিল; অথচ এসব ক্ষেত্রে নবগঠিত মুসলিম সেনাদলের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ প্রাথমিক পর্যায়ের ছিল। অধিকন্তু মুসলিম সেনাবাহিনীর সামরিক অস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম এবং যানবাহন রোমান সেনাবাহিনীর সমকক্ষ ছিল না। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ইসলামী শক্তি ভিন দেশের মাটিতে আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, আর রোমানরা তাদের নিজ ভূ-খণ্ডের সমুদয় সামরিক সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ছিল এবং তাদের অবস্থান ছিল আত্মরক্ষামূলক। এ অবস্থায় হামলাকারী বাহিনীকে অবশ্যই এতটা শক্তিশালী হতে হবে যে, তারা সব প্রতিকূল পরিস্থিতি উৎরাতে সক্ষম হয়।

এতসব বিবেচনা করেই মুসলিম সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণ কয়েক কদম দূরত্বের মধ্যে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা সত্বেও পলায়নের চেয়ে প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও দৃঢ়পদ থাকাকেই প্রাধান্য দেন এবং এভাবে তাঁদের ঐতিহাসিক সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধি করেন।

শাম সীমান্তে আক্রমণ করার পর মুসলিম সেনাবাহিনী শত্রুবাহিনীর প্রস্তুতি ও সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে। যুদ্ধ করার পদ্ধতি ও কৌশল ঠিক করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একটি সামরিক পরামর্শসভার আয়োজন করা হয়। একদল বলেন, মহানবী (সা.)-এর কাছে পুরো ঘটনা পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য জেনে নেবেন। এ অভিমত প্রায় গৃহীত হয়েই গিয়েছিল, ঠিক তেমনি মুহূর্তে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সহকারী অধিনায়ক আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা (যিনি মদীনা থেকে যাত্রা করার সময় মহান আল্লাহর কাছে শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করেছিলেন) দাঁড়িয়ে অগ্নি ঝরানো ও তেজোদ্দীপ্ত এক ভাষণ দেন এবং বলেন :

“মহান আল্লাহর শপথ! আমরা কখনোই অধিক জনবল ও অস্ত্র নিয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করি নি। মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে যে ঈমান দান করে সম্মানিত করেছেন, সেই ঈমানের আলোকে আমরা শত্রুর মুকাবিলা করতাম ও মুখোমুখী হতাম।

আপনারা সবাই উঠে পড়ুন এবং পথ চলা অব্যাহত রাখুন। আপনারা স্মরণ করুন, বদরের যুদ্ধে মাত্র দু টি ঘোড়া এবং উহুদের যুদ্ধে মাত্র একটি ঘোড়ার চেয়ে বেশি কিছু আমাদের ছিল না। কিন্তু এ যুদ্ধে আমরা দু টি পরিণতির মধ্যে যে কোন একটির অপেক্ষায় আছি : হয় তাদের ওপর আমরা বিজয়ী হব- আর এটা হচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতি, যা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছেন এবং মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কখনো অন্যথা হয় না;- অথবা আমরা শাহাদাত বরণ করব। আর এ অবস্থায় আমরা আমাদের ভাইদের সাথে মিলিত হব।”

এ ভাষণ ইসলামী সেনাবাহিনীর মধ্যে জিহাদের প্রেরণা শক্তিশালী করে এবং তাঁরা তাঁদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। উভয় সেনাবাহিনী শারীফ’ নামক স্থানে পরস্পর মুখোমুখি হয়। কিন্তু কৌশলগত কারণে ইসলামী বাহিনী খানিকটা পশ্চাদপসরণ করে মুতা অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে।

সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জাফর ইবনে আবী তালিব সৈন্যদের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশের জন্য একজন অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ এবং হাতাহাতি সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। তাঁকে অবশ্যই পতাকা হাতে নিয়ে নিজ সৈনিকদের আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, অথচ ঐ একই সময় তাঁকে যুদ্ধ ও আত্মরক্ষাও করে যেতে হবে।

শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালানোর সময় বীরগাঁথা আবৃত্তি থেকে আত্মিক সাহস এবং লক্ষ্য অর্জনের পথে তাঁর দৃঢ় ইচ্ছা-শক্তি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়। তিনি আক্রমণ করার সময় বলছিলেন:

يا حبّذا الـجنة و أقـترابها

طيّـبة و بـاردا شـرابُـها

و الروم روم قد دنا عذابها

كافرة بعـيـدة أنسـابـها

علىّ إذ لاقيتها ضرابها

“আমি আনন্দিত যে, প্রতিশ্রুত বেহেশত- ঐ পবিত্র বেহেশত, যেখানে আছে শীতল সুপেয় পানীয়সমূহ- নিকটবর্তী হয়েছে। আর এর বিপরীতে রোমের পতন ও ধ্বংসও নিকটবর্তী হয়ে গেছে- ঐ রোমান জাতি, যারা তাওহীদী ধর্মকে অস্বীকার করেছে এবং আমাদের থেকে যাদের সকল সম্পর্ক ও বন্ধন দূর হয়ে গেছে। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যখনই তাদের মুখোমুখী হব, তখনই তাদের ওপর আঘাত হানব।৩১৫

ইসলামী সেনাদলের প্রথম প্রধান অধিনায়ক (জাফর ইবনে আবী তালিব) প্রাণপণ আক্রমণ চালান এবং প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। যখন তিনি নিজেকে শত্রুদের দ্বারা আবেষ্টিত দেখতে পান এবং শাহাদাত বরণের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান, তখন যাতে করে শত্রুরা তাঁর অশ্ব ব্যবহার করতে না পারে এবং শত্রুদের যাতে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, এ জড়জগতের সাথে তিনি তাঁর সর্বশেষ বন্ধনও ছিন্ন করে ফেলেছেন, সেজন্য তিনি ঘোড়া থেকে নিচে নেমে পড়েন এবং এক আঘাতে সেটাকে নিশ্চল করে দেন। এরপর তিনি আত্মরক্ষা ও আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। ঠিক তখনই তাঁর ডান হাত কর্তিত হয়ে গেলে পতাকা যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয়, সেজন্য তিনি তাঁর বাম হাত দিয়ে তা ধরে রাখেন। কিন্তু তাঁর বাম হাতও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি তাঁর দু বাহু দিয়ে পতাকা ধরে রাখেন। অবশেষে আশিটিরও অধিক আঘাত নিয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং প্রাণত্যাগ করেন।

তখন প্রথম সহকারী অধিনায়ক যাইদ ইবনে হারেসার পালা আসে। তিনি পতাকা কাঁধে নিয়ে অতুলনীয় বীরত্বের সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেন এবং বর্শার অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সহকারী অধিনায়ক আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা তখন পতাকা হাতে তুলে নেন এবং অশ্বের উপর আরোহণ করে বীবত্বব্যঞ্জক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। যুদ্ধ চলাকালে তাঁর তীব্র ক্ষুধা পেলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক লোকমা খাদ্য তাঁর হাতে দেয়া হয়। তখনও তিনি কিছুই খান নি; হঠাৎ শক্রবাহিনীর প্লাবনের মতো প্রচণ্ড ক্ষিপ্র আক্রমণের শব্দ তাঁর কানে আসে! তিনি খাদ্যের টুকরাটি সাথে সাথে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শত্রুবাহিনীর কাছে চলে যান এবং শাহাদাত বরণ পর্যন্ত প্রাণপণ যুদ্ধ করতে থাকেন।

দিশাহারা মুসলিম বাহিনী

আর ঠিক সে সময় মুসলিম বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং তাঁর দু জন সহকারী একের পর এক পর্যায়ক্রমে শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু মহানবী (সা.) এ অবস্থা যে ঘটতে পারে, তা আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সৈন্যদের ওপর অধিনায়ক নির্বাচন করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এ সময় সাবিত ইবনে আকরাস পতাকা তুলে নিয়ে সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন : আপনারা একজন অধিনায়ক নির্বাচিত করুন।” তখন সবাই বলেছিল : আপনি আমাদের অধিনায়ক হন।” তিনি বললেন : আমি কখনোই এ দায়িত্ব গ্রহণ করব না। আপনারা অন্য কাউকে নির্বাচিত করুন। অতপর সাবিত নিজে এবং সৈন্যরা মিলে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে, যিনি সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং এ সেনাদলে উপস্থিত ছিলেন, সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করলেন।

তিনি যখন সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নির্বাচিত হলেন, সেটি ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল মুহূর্ত। তখন মুসলিম বাহিনীর ওপর ভয়-ভীতি প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক তখন এমন এক সামরিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যার কোন পূর্ব নযীর ছিল না। তিনি মাঝরাতে যখন সবদিক ঘন কালো আঁধারে নিমজ্জিত, তখন প্রচণ্ড শোরগোল করে সৈন্যদের স্থান পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ (পরিকল্পনা ছিল) সেনাদলের ডান বাহু বাম বাহুর জন্য স্থান ছেড়ে দেবে এবং একইভাবে বাম বাহু ডান বাহুর জন্য নিজ স্থান ত্যাগ করবে। একইভাবে সেনাবাহিনীর অগ্রভাগ মধ্যভাগের জায়গায় এবং মধ্যভাগ অগ্রভাগের জায়গায় চলে যাবে। আর এ প্রক্রিয়া প্রভাত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তিনি আরো নির্দেশ প্রদান করেন, সেনাবাহিনীর একটি অংশ মাঝরাতে দূরবর্তী এলাকায় চলে যাবে এবং ভোর হলে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ স্লোগান দিতে দিতে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হবে। পুরো এ পরিকল্পনা এজন্য করা হয়েছিল যে, রোমান বাহিনী যেন ভাবে যে, মুসলমানদের জন্য সাহায্যকারী বাহিনী চলে এসেছে। ঘটনাচক্রে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে শক্রবাহিনী পরের দিন মুসলমানদের ওপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। তারা নিজেরা বলাবলি করছিল যে, সাহায্যকারী বাহিনী ছাড়াই এ সেনাদল অতুলনীয় সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। আর যখন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন তাদের দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও অবিচলতা বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। এ যুদ্ধে রোমান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক একজন মুসলিম সৈন্যের হাতে নিহত হয়েছিল।৩১৬

মুসলমানরা যে পথ ধরে এসেছিলেন, সে পথে তাদের ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ এনে দেয় রোমান বাহিনীর নীরবতা। সবচেয়ে বড় যে সাফল্য মুসলমানরা এ যুদ্ধে অর্জন করেছিলেন, তা ছিল এই, একটি ক্ষুদ্র বাহিনী একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সামনে এক বা তিন দিন প্রতিরোধ করেছে এবং অবশেষে প্রাণ নিয়ে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করেছে। নতুন সেনাপতির সামরিক কৌশল যেহেতু একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ ছিল, তা মুসলমানদের মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে এবং এর ফলে তাঁরা নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন, সেহেতু তা প্রশংসাযোগ্য।৩১৭

ইসলামের সৈনিকদের মদীনায় প্রত্যাবর্তন

মদীনা প্রবেশের আগেই যুদ্ধের অবস্থা এবং মুসলিম সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ সংক্রান্ত তথ্যসমূহ মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাই মুসলিম জনতা ইসলামের সৈনিকদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য দ্রুত ছুটে আসে এবং মদীনার সেনাছাউনী অর্থাৎ জুরফ এলাকায় তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে।

নতুন সেনাপতির এ কাজ একটি বিচক্ষণধর্মী রণকৌশল হলেও তা যেহেতু মুসলমানদের গৌরবাত্মক অনুভূতি এবং তাদের চেতনাগত খাঁটি বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে মানানসই হয় নি, সেহেতু মুসলমানদের দৃষ্টিতে তাদের পশ্চাদপসরণ সুন্দর কাজ বলে গণ্য হয় নি। এ কারণেই হে পলাতকরা! কেন তোমরা জিহাদ থেকে পলায়ন করেছ’- এ ধরনের ভর্ৎসনামূলক ধ্বনি তুলে এবং তাদের মাথা ও মুখমণ্ডলের উপর ধূলো-মাটি নিক্ষেপ করে তাদেরকে বরণ করা হয়েছিল। সাধারণ মুসলিম জনতার আচরণ এদের সাথে এতটা রূঢ় ছিল যে, এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক ব্যক্তিই দীর্ঘকাল ঘরে বসে থাকতে এবং প্রকাশ্যে বের না হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরা কখনো ঘরের বাইরে আসলে জনতা তাঁদের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলত : তিনি ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত, যারা জিহাদ থেকে পলায়ন করেছে’।৩১৮

ইতিহাসের বদলে কল্পকাহিনী

মুসলমানদের মধ্যে হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবী তালিবের উপাধি আসাদুল্লাহ্’ (আল্লাহর সিংহ) হওয়ায় কতিপয় লোক তাঁর বরাবরে এক কাল্পনিক নেতা বা বীরকে দাঁড় করিয়ে তাঁর উপাধি সাইফুল্লাহ্’ (মহান আল্লাহর তরবারি) দিতে চেয়েছে, আর এ ব্যক্তি খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ব্যতীত আর কেউ নন। এ কারণেই তারা বলে, মুতার যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর মহানবী (সা.) তাঁকে সাইফুল্লাহ্’ উপাধি প্রদান করেন।

মহানবী যদি তাঁকে অন্য কোন ঘটনা উপলক্ষে এ উপাধি প্রদান করতেন, তা হলে তো কোন কথাই ছিল না। কিন্তু মুতার য্দ্ধু থেকে প্রত্যাবর্তন করার পরের সার্বিক পরিস্থিতি তাঁকে মহানবী (সা.)-এর এ ধরনের উপাধিতে ভূষিত করা মোটেই অপরিহার্য করে না। যে ব্যক্তি এমন এক দলের নেতৃত্বে ছিলেন যাদেরকে জনগণ পলায়নকারী’ বলে অভিহিত করেছে এবং যাদের মাথা ও মুখমণ্ডলের উপর ধূলা-মাটি নিক্ষেপ করে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, সেই ব্যক্তিকে মহানবী সাইফুল্লাহ্’-এর মতো কোন উপাধিতে ভূষিত করবেন, তা কি যথার্থ ও সঙ্গত হবে? তিনি যদি অন্যান্য যুদ্ধে আল্লাহর তবরারির পূর্ণাঙ্গ রূপ ও বহিঃপ্রকাশ হয়ে থাকেন, তা হলেও তিনি মোটেই এ যুদ্ধে এ ধরনের উপাধির বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ছিলেন না এবং কেবল এক ধরনের প্রশংসনীয় সামরিক কৌশল ব্যতীত এ যুদ্ধে তাঁর থেকে আর কিছুই প্রকাশ পায় নি। আর তা না হলে, তাঁকে এবং তাঁর অধীন সৈন্যদেরকে মুসলিম জনতা পলায়নকারী’ উপাধিতে ভূষিত করত না। ইবনে সা দ লিখেছেন : পশ্চাদপসরণ করার সময় রোমের একদল সৈন্য মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের কয়েকজনকে হত্যা করেছিল।”৩১৯

‘সাইফুল্লাহ্’ উপাধির উপাখ্যান যারা রচনা করেছে, তারা তাদের বক্তব্য দৃঢ় করার জন্য এ বাক্যটিও ছুঁড়ে দিয়েছে : খালিদ যখন অধিনায়কত্ব লাভ করেন, তখন তিনি আক্রমণ করার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজেও বীরবিক্রমে আক্রমণ চালান। তাঁর হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে যায়। আর কেবল একটি ঢাল তাঁর হাতে অবশিষ্ট (অক্ষত) ছিল।

এ মিথ্যা গল্প-কাহিনীর রচয়িতারা অবারও উদাসীন থেকেছে যে, খালিদ ও তাঁর অধীন সৈন্যরা যদি যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের রণনৈপুণ্য ও দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকতেন, তা হলে মদীনার জনগণ কেন তাঁদেরকে পলায়নকারী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল এবং কেন তারা ধূলা-মাটি নিক্ষেপ করে তাঁদেরকে বরণ করেছিল? এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল দুম্বা জবাই করে এবং গোলাপ জল ও সুগন্ধি ছিটিয়ে তাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো।

জাফরের ইন্তেকালে মহানবী (সা.)-এর আকুল কান্না

মহানবী (সা.) তাঁর পিতৃব্যপুত্র জাফরের শাহাদাতে খুব বেশি কেঁদেছিলেন। তিনি জাফরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইসকে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ সম্পর্কে অবগত করান এবং তাঁকে সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানানোর জন্য মহানবী (সা.) জাফরের বাড়ীতে যান এবং আসমার দিকে তাকিয়ে বলেন : আমার সন্তানরা কোথায়? তখন জাফরের স্ত্রী জাফরের তিন সন্তান আবদুল্লাহ্, আউন ও মুহাম্মদকে মহানবীর কাছে ডেকে আনেন। তাঁর সন্তানদের প্রতি মহানবীকে অত্যন্ত স্নেহ ও মমতা প্রদর্শন করতে দেখেই আসমা বুঝে নেন, তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন। এজন্যই তিনি জিজ্ঞেস করেন : মনে হচ্ছে আমার সন্তানরা এতীম হয়ে গেছে? কারণ, আপনি তাদের সাথে এতীমদের প্রতি সম্ভাব্য আচরণ করছেন! এ সময় মহানবী (সা.) এত বেশি কান্নাকাটি করেন যে, তাঁর পবিত্র দাঁড়ি বেয়ে অশ্রুর ফোঁটা ঝরে পড়ছিল। অতঃপর মহানবী নিজ কন্যা ফাতিমাকে খাবার তৈরি করার নির্দেশ দেন। মহানবী (সা.) জাফরের পরিবারকে তিন দিন আপ্যায়ন করেছিলেন। এ ঘটনার পর মহানবীর হৃদয়ে জাফর ইবনে আবী তালিব ও যাইদ ইবনে হারিসার শোক চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল এবং যখনই তিনি নিজ ঘরে প্রবেশ করতেন, তখনই তিনি তাঁদের জন্য ক্রন্দন করতেন।৩২০

আটচল্লিশতম অধ্যায় : অষ্টম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

ইসলামের মুবাল্লিগগণের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড

আদাল (عضل ) ও কারা (قاره ) গোত্রের একদল প্রতিনিধি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলে : হে রাসূলাল্লাহ্! আমাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে এবং আমাদের সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আপনি দয়া করে আপনার একদল সাহাবীকে প্রেরণ করুন তাঁরা আমাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবেন,আমাদেরকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবেন এবং মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত হালাল ও হারাম সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবেন। 75

মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব ছিল এই যে,কতিপয় বড় গোত্রের প্রতিনিধি এ দলটির আহবানে সাড়া দেবেন। আর মুসলমানদেরও দায়িত্ব ছিল যে কোন কিছুর বিনিময়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। এ কারণে মহানবী (সা.) মুরসেদ নামক এক সাহাবীর অধিনায়কত্বে একটি দলকে গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে উল্লিখিত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তাঁরা গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে মদীনা এবং মুসলমানদের শক্তি ও কর্তৃত্বের আওতার বাইরে চলে যান এবং রাযী নামক এক পানির উৎসের স্থানে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে গোত্রীয় প্রতিনিধিরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তারা হুজাইল গোত্রের সাহায্য নিয়ে মদীনা থেকে প্রেরিত লোকদের বন্দী ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঐ অঞ্চলে মুসলমানরা (মদীনা থেকে প্রেরিত মুবাল্লিগ) যখন শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন,তখন তরবারি ছাড়া তাঁদের আর কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। এ কারণে তরবারির বাঁট শক্ত করে হাতে ধরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য তাঁরা তৈরি হয়ে যান। কিন্তু শত্রুপক্ষ শপথ করে বলে : তোমাদের বন্দী করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো তোমাদের জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে কুরাইশ নেতাদের হাতে তুলে দেয়া এবং তার বিনিময়ে কিছু অর্থ লাভ করা।

মুসলিম মুবাল্লিগগণ একে অপরের দিকে তাকালেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সিদ্ধান্ত নিলেন,তাঁরা লড়াই করবেন। তাঁরা বললেন : আমরা মূর্তিপূজারী ও মুশরিকদের কোন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করব না। অতঃপর তাঁরা তরবারি কোষমুক্ত করেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় ও মহানবী (সা.)-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত লাভ করেন। কিন্তু যাইদ ইবনে দাসিনাহ্,খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ্ তরবারি কোষবদ্ধ করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অর্ধেক পথে এসে আবদুল্লাহ্ আত্মসমর্পণ করার কারণে অনুতপ্ত হন। তিনি হাতের বাঁধন খুলে ফেলেন এবং তরবারি কোষমুক্ত করে শত্রুর ওপর আক্রমণ করেন। শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করে এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে ধরাশায়ী করে। তারা তাঁর দিকে এত বেশি পাথর নিক্ষেপ করে যে,তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই প্রাণ হারান। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু অপর দুই বন্দীকে মক্কার কাফেরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বিনিময়ে মুসলমানদের যারা বন্দী করেছিল তাদের দুই বন্দীকে কুরাইশরা মুক্তি দেয়।

সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা,যার পিতা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল,বন্দী যাইদকে ক্রয় করে যাতে একজন ইসলাম প্রচারককে হত্যার মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে,এক বিশাল জনতার সামনে যাইদকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। তানঈমে76 ফাঁসিকাষ্ঠ টানানো হয়।

কুরাইশরা ও তাদের মিত্ররা নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে সমবেত হয়। তার মৃত্যুর জন্য কয়েক মুহূর্তের বেশি বাকী ছিল না।

মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ান সকল ঘটনায় নিজে দূরে থেকে নেপথ্যে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। আবু সুফিয়ান এবার যাইদকে লক্ষ্য করে বলে : তুমি যে আল্লাহকে বিশ্বাস করো,তার শপথ দিয়ে বলছি-আমাকে বলো,তুমি কি চাও যে,মুহাম্মদ তোমার পরিবর্তে নিহত হোক? তা হলে তুমি মুক্তি পাবে এবং নিজ ঘরে ফিরে যাবে।

যাইদ পূর্ণ সাহসিকতার সাথে বললেন :  আমি কখনো রাজি হব না যে,মহানবী (সা.)-এর পায়ে কোন কাঁটা বিদ্ধ হোক,যদিও তার বিনিময়ে আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

যাইদের বলিষ্ঠ জবাব আবু সুফিয়ানকে বিব্রত করে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীগণের ভালোবাসার আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে সে মন্তব্য করে : আমার দীর্ঘ জীবনে মুহাম্মদের সাথীদের মতো আর কারো সাথী দেখি নি,যারা এত বেশি ত্যাগী হতে পারে,এত অধিক ভালোবাসা পোষণ করতে পারে!

কিছুক্ষণের মধ্যেই যাইদকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। তাঁর প্রাণপাখি উড়ে যায় ঊর্ধ্বলোকের পানে। সত্য ও ন্যায়ের সীমান্ত রক্ষায়,ইসলামের সত্য বাণী প্রচারের লক্ষ্যে এঁরা শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি খুবাইব দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থায় কাটান। মক্কার পরামর্শসভা সিদ্ধান্ত নেয়,তাঁকেও তানঈম-এ ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হবে।77

খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের পাশে মক্কার নেতা ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দু রাকাত নামায আদায়ের অনুমতি গ্রহণ করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে দু রাকাত নামায আদায় করেন এবং কুরাইশ নেতাদের লক্ষ্য করে বলেন : আমি মৃত্যুকে ভয় করি বলে তোমাদের ধারণা হতে পারে-এ সন্দেহ যদি না হতো,তা হলে এর চেয়ে বেশি নামায পড়তাম।78 নামাযের রূকূ ও সিজদা দীর্ঘ করতাম। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আপনার নবীর পক্ষ হতে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা আমরা পালন করেছি। ঐ মুহূর্তে হত্যার আদেশ জারি করা হয়। খুবাইবকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়। খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের ওপর বলতে লাগলেন : হে আল্লাহ্! আপনি জানেন,আমার একজন বন্ধুও আশেপাশে নেই,যে আমার সালাম মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেবে। হে আল্লাহ্! আপনিই আমার সালাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিন।

হয় তো এই আধ্যাত্মিক পুরুষের ধর্মীয় আবেগ আবু উকবার সহ্য হচ্ছিল না। সে দাঁড়িয়ে খুবাইবের ওপর এক শক্ত আঘাত হানে এবং তাঁকে শহীদ করে।

ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী79 খুবাইব প্রাণত্যাগের পূর্বক্ষণে শূলির উপর এ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

فوالله ما أرجو اذا مت مسلما

علي اى جنب كان فى الله مصرعى

وذلك فِى ذات االله و ان يشأ

يبـارك علي اوصـال شلـومـمزع

মহান আল্লাহর শপথ! যদি মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করি,

তা হলে কোন্ এলাকায় আমাকে দাফন করা হবে,তা নিয়ে চিন্তা করি না।

আমার এই হৃদয়বিদারক মৃত্যু আল্লাহর পথে,তিনি যদি চান,

এ শাহাদাত আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মুবারক করে দেবেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহানবী (সা.)-কে দারুণভাবে মর্মাহত করে এবং মুসলমানদের গভীর শোকে নিমজ্জিত করে। মুসলমানদের মহান কবি হাস্সান ইবনে সাবিত এ উপলক্ষে মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেন যা ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

রাসূল (সা.) এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন,এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এর ফলে বহু কষ্টে প্রশিক্ষিত ইসলাম প্রচারের বীর সেনানীর উপর অপূরণীয় আঘাত আসতে পারে। কুৎসিত অন্তরের ইতর লোকেরা পূত চরিত্রের ধর্মপ্রচারকগণের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যেতে পারে।

এই বীর মুজাহিদের লাশ বহু দিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলন্ত ছিল। একদল লোক লাশ পাহারা দিত। অবশেষে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে দু জন দুঃসাহসী মুসলমান রাতের বেলা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাঁর লাশ নামিয়ে আনেন এবং দাফন করেন।80

বীরে মাউনার ঘটনা

হিজরী চতুর্থ সালের সফর মাসে রাযী নামক স্থানে ইসলামের কৃতি সন্তানদের শাহাদাতের খবর মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছার আগে আবু বাররা আমেরী মদীনায় আগমন করে। মহানবী (সা.) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত কবুল করল না। তবে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে আরয করল,যদি তিনি শক্তিশালী কোন ধর্ম প্রচারকারী দলকে নাজদ এলাকায় প্রেরণ করেন,তা হলে তাদের ঈমান আনার আশা করা যায়। কেননা তাওহীদের প্রতি তাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। মহানবী (সা.) বললেন : নাজদবাসীদের প্রতারণা ও শত্রুতাকে আমি ভয় পাই। আবু বাররা বলল : আপনার প্রেরিত ব্যক্তিবর্গ আমার আশ্রয়ে থাকবেন। আমিই নিশ্চয়তা দিচ্ছি,আমি তাদেরকে যে কোন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করব।

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে চল্লিশ জন ইসলাম ধর্ম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব,মুনযির-এর নেতৃত্বে নাজদের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁদের সবাই ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেয ও ধর্মীয় বিধানে পারদর্শী। তাঁরা বীরে মাউনার (মাউনার কূপ) কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি করেন। মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একখানা পত্র নাজদ গোত্রীয় নেতা আমর ইবনে তুফাইলের উদ্দেশে লিখেছিলেন। তাঁর পত্র আমেরের কাছে পৌঁছানোর জন্য একজন মুসলমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমের শুধু যে মহানবী (সা.)-এর চিঠিখানা পড়ে নি,তা নয়;বরং পত্রবাহককেও হত্যা করে। এরপর সে তার গোত্রের লোকদের ইসলাম প্রচারকগণকে হত্যা করার আহবান জানায়। গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে এবং বলে,গোত্রের মুরব্বী আবু বাররা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজ গোত্রের লোকদের সাহায্যের ব্যাপারে সে নিরাশ হয় এবং আশেপাশের গোত্র ও সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চায়। এভাবে ইসলামের মুবাল্লিগগণের অবস্থানস্থলটি আমেরের লোকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়।

ইসলামের প্রচারকারীরা শুধু যে বড় জ্ঞানী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন,তা-ই নয়;বরং বীর যোদ্ধাও ছিলেন। তাঁরা আত্মসমর্পণকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করেন এবং তরবারি হাতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু কা ব ইবনে যাইদ আহত শরীর নিয়ে কোনমতে মদীনা পৌঁছেন এবং ঘটনাটি মহানবীকে অবহিত করেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা গোটা ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের দারুণভাবে মর্মাহত করে। মহানবী (সা.) বহু দিন ধরে বীরে মাউনার স্মরণ করতেন।81

এ দু টি ঘটনাই ছিল উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কেননা এর ফলে মুসলমানদের হত্যার জন্য আশেপাশের গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল।

প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান

প্রাচ্যবিদরা যেখানে কোন মুশরিকের মুখে সামান্য আঁচড় লাগলেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর মারমুখী হয়ে যান,আর জোর করে এ কথা বলার চেষ্টা করেন যে,ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে,তাঁরা এই বেদনাদায়ক দু টি ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেন নি।

বিশ্বের কোথায় আছে যে,জ্ঞানের ঝাণ্ডাবাহীদের হত্যা করা হয়? ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়ে থাকলে এই মিশনারী দলগুলো কেন প্রাণকে হাতের তালুতে রেখে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন এবং শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেছেন?

এ দু টি ঘটনার অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে। তাঁদের ঈমানের শক্তি,আত্মত্যাগ,জান বাজি রেখে যুদ্ধ ও সাহসিকতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়,বিস্ময়কর এবং মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস।

মুমিন কখনো একবারের বেশি প্রতারিত হয় না

রাযী ও বীরে মাউনার হৃদয়বিদারক ঘটনায় ইসলামের বহু মুবাল্লিগ শহীদ হওয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে দারুণ মর্মবেদনার সৃষ্টি হয়। এক অস্বাভাবিক ধরনের বিষাদ মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখানে এসে পাঠকদের মনে হয় তো প্রশ্ন জাগবে,মহানবী (সা.) কেন এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? প্রথম ঘটনায় অর্থাৎ রাযীর নিকটে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে,তারপরও অপর চল্লিশ ব্যক্তিকে তিনি কেন বীরে মাউনায় পাঠালেন? মহানবী (সা.) কি নিজেই বলেন নি : لا يلدغ المؤمن من جُحر مرّتين মুমিন (সর্পের) এক গর্ত হতে দু বার দংশিত হয় না।

এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেননা ইসলাম প্রচারকারী দলটি আবু বাররার গোত্রের হাতে শহীদ হন নি। যদিও তার ভাতিজা আমের ইবনে তুফাইল আবু বাররার গোত্র-যা তার নিজেরও গোত্র-ইসলাম প্রচারকদের হত্যার জন্য প্ররোচিত করছিল,কিন্তু ঐ গোত্রের একজনও তার কথায় সায় দেয় নি। সবাই বলেছিল : তোমার চাচা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমের ইবনে তুফাইল পার্শ্ববর্তী ভিন্ন গোত্র সালীম যাকওয়ান -এর কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং ইসলাম প্রচারকগণকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইসলামের প্রচার সৈনিকরা আবু বাররার এলাকার উদ্দেশে গমনকালে নিজেদের মধ্য থেকে আমর ইবনে উমাইয়্যা ও হারিস ইবনে সিম্মাহকে82 তাঁদের উটগুলো চরানো ও দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁরা তাঁদের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় হঠাৎ আমের ইবনে তুফাইল তাঁদের ওপর চড়াও হয়। ফলে হারিস ইবনে সিম্মাহ্ নিহত হন এবং আমর ইবনে উমাইয়্যাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমর ইবনে উমাইয়্যা মদীনায় ফিরে আসার সময় দু জন লোকের সাক্ষাৎ পান। তিনি নিশ্চিত হন,তারা সেই গোত্রের লোক যারা দীনের মুবাল্লিগগণকে হত্যা করেছে। এ কারণে তিনি উভয়কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন।

তাঁর এ কাজটি ভুল ধারণার কারণে হয়েছিল। কেননা তারা আবু বাররার (বনী আমের) গোত্রের লোক ছিল,যারা আপন গোত্রপতির প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের দলের ওপর হামলা চালাতে রাযী হয় নি।

এ ঘটনার ফলেও মহানবী (সা.)-এর মর্মবেদনা বৃদ্ধি পায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন,ঐ দু জনের রক্তমূল্য তিনি পরিশোধ করবেন।

তবে এ ব্যাপারে তাবাকাতে ইবনে সা দ-এর83 প্রণেতা স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন,উভয় দলের পরিণতির খবর একই রাতে মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছায়। দ্বিতীয় দলটি পাঠানোর সময় মহানবী (সা.) রাযীর শহীদদের ভাগ্যে কী ঘটেছে,তা জানতেন না।

চৌত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বনী নাযীরের যুদ্ধ

মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীরা উহুদে মুসলমানদের পরাজয় এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণের নিহত হবার ঘটনায় দারুণ খুশী হয়েছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল,মদীনায় কোন বিদ্রোহ ঘটাবে। এর মাধ্যমে মদীনার বাইরের গোত্রগুলোকে বোঝাবে যে,মদীনায় ন্যূনতম ঐক্য ও সংহতি বিদ্যমান নেই। কাজেই বহিঃশক্তি এসে ইসলামের নব্য প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করতে পারবে।

মহানবী (সা.) বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদের উদ্দেশ্য ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য একদল সৈনিকসহ তাদের দুর্গের দিকে গমন করেন। কিন্তু বনী নাযীরের সাথে যোগাযোগের পেছনে মহানবীর দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছিল আমর ইবনে উমাইয়্যার হাতে নিহত বনী আমের গোত্রের দুই আরবের রক্তমূল্য পরিশোধে তাদের সহায়তা নেয়া। কেননা বনী নাযীর গোত্র মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ওদিকে বনী আমেরের সাথেও তাদের মৈত্রীচুক্তি ছিল। চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলো সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

মহানবী (সা.) দুর্গের প্রবেশদ্বারে অবতরণ করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যের কথা গোত্রীয় প্রধানদের কাছে তুলে ধরেন। তারা দৃশ্যত খোলা মনে মহানবীকে অভ্যর্থনা জানায় এবং কথা দেয়,রক্তমূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারা তাঁকে সাহায্য করবে। তারা মহানবীকে তাঁর ডাকনাম আবুল কাসেম -এ সম্বোধন করে অনুরোধ করতে থাকে : আপনি আমাদের দুর্গে প্রবেশ করুন এবং একটি দিন এখানে অবস্থান করুন। রাসূল তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন না;বরং দুর্গের দেয়ালের ছায়ায় সাথী ও সৈনিকগণ সহ বসেন এবং বনী নাযীর গোত্রের সর্দারদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন।84

মহানবী (সা.) উপলব্ধি করেন,তাদের মিষ্টি মিষ্টি কথার সাথে এক ধরনের সংশয়পূর্ণ রহস্যজনক তৎপরতা মিশে আছে। অন্যদিকে তিনি যেখানে বসে ছিলেন,সেখানে লোকজনের আনাগোনা বেশি করে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কানে কানে কথাবার্তা বেশি হচ্ছিল,যা থেকে সহজেই সন্দেহ জাগে। মূলত বনী নাযীরের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,মহানবীকে অতর্কিত আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। তাদের একজন আমর হাজ্জাশ প্রস্তুতি নিয়েছিল,সে ছাদের উপর যাবে এবং মহানবী (সা.)-এর উপর একটি পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করবে।

সৌভাগ্যজনকভাবে তাদের নীল-নকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের সন্দেহপূর্ণ ও অসংলগ্ন আচরণ থেকে তাদের চক্রান্ত আঁচ করা যাচ্ছিল। আল ওয়াকিদীর বর্ণনা অনুযায়ী ওহীর ফেরেশতা মহানবীকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে সরে বসেন এবং এমনভাবে মজলিস ছেড়ে উঠে যান যে,ইহুদীরা মনে করল,কোন কাজে তিনি বাইরে যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু রাসূল (সা.) মদীনার পথ ধরে অগ্রসর হন। তাঁর সাহাবীগণকেও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানালেন না। তাঁরা তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু তাঁরা যতই অপেক্ষা করুন,তাতে কোন ফল হলো না।

বনী নাযীরের ইহুদীরা দারুণ দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেল। তারা একদিকে ধারণা করছিল যে,মহানবী (সা.) তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছেন। তা-ই যদি হয়,তবে তাদের বড় ধরনের শাস্তি পেতে হবে। অপরদিকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল : মহানবী যেহেতু এখন আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছেন,তার প্রতিশোধ আমরা তার সাথীদের কাছ থেকেই নিই। তবে সাথে সাথে বলছিল যে,এ অবস্থায় পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে যাবে এবং মহানবী (সা.) নিঃসন্দেহে আমাদের কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেবেন।

এহেন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর সাথে যাঁরা এসেছিলেন,তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন,মহানবীর খোঁজে তাঁরা যাবেন এবং তিনি কোথায় আছেন,তা সন্ধান করবেন। দুর্গের প্রাচীর থেকে বেশি দূরে যেতে না যেতেই তাঁরা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান,যিনি মদীনা থেকে আসছিলেন। তিনি মহানবীর মদীনা প্রবেশের সংবাদ নিয়ে আসেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ মহানবীর নিকট উপস্থিত হন। সেখানেই তাঁরা ইহুদীদের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন,যা ওহীর ফেরেশতা জিবরীল (আ.) তাঁকে জানিয়েছিলেন।85

এ জঘন্য অপরাধ মোকাবেলায় করণীয়

এখন এ বিশ্বাসঘাতকদের ব্যাপারে মহানবীর করণীয় কি? এরাই সেই সম্প্রদায় যারা ইসলামী হুকুমতের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল। ইসলামের সৈনিকরা তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করছিলেন। জীবনভর তারা মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বচক্ষে দেখছিল। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে শেষ নবীর সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য ও প্রমাণ দেখতে পেয়েছে;অথচ তাঁকে আতিথেয়তার পরিবর্তে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছে। অত্যন্ত কাপুরুষোচিত পন্থায় তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে।

এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের দাবী কী? এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরূপ বিশ্বাসঘাতকতার মূলোৎপাটন করা হয়,তার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) গৃহীত পদ্ধতি ছিল যুক্তিসঙ্গত। গোটা সেনাবাহিনীতে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমা আউসীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দেন,অতি সত্বর তাঁর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত হুকুম যেন বনী নাযীরের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি বনী নাযীরের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বললেন : ইসলামের মহান নবী আমার মাধ্যমে তোমাদের কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছেন যে,দশ দিনের মধ্যে অবশ্যই তোমরা এই ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাবে। কেননা তোমরা চুক্তিভঙ্গ করেছ,প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ। যদি দশ দিনের মধ্যে এ এলাকা ত্যাগ না কর,তা হলে তোমাদের রক্ত প্রবাহিত করা হবে।

এ বার্তা ইহুদীদের মধ্যে মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যেকে এ ষড়যন্ত্রের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে। তাদের জনৈক নেতা সবাইকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব করে। কিন্তু অধিকাংশের গোয়ার্তুমী এ প্রস্তাব গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চরম অসহায়ত্ব তাদের ঘিরে ধরে। নিরুপায় হয়ে মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমার উদ্দেশে বলে : হে মুহাম্মদ! আপনি আউস গোত্রের লোক। মহানবীর আগমনের পূর্বে আউস গোত্রের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল। এখন কেন আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন?”   তিনি পূর্ণ সৎ সাহস ও বলিষ্ঠতা সহকারে বললেন : সেদিন পার হয়ে গেছে। এখন মানুষের মন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এ সিদ্ধান্ত সেই চুক্তির আওতায় নেয়া হয়,যে চুক্তি মহানবীর মদীনা আগমনের প্রথম দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে সম্পাদন করেছিলেন। ঐ চুক্তিতে বনী নাযীর গোত্রের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির বিষয়বস্তু আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে : মহানবী তিন গোত্রের সাথেই (বনী নাযীর,বনী কাইনুকা ও বনী কুরাইযাহ্) চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন,তারা কখনো রাসূলুল্লাহ্ ও তাঁর সাহাবীগণের ক্ষতি করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেবে না;মুখে বা হাতে তাঁদের কোন ক্ষতি করবে না।... যদি ঐ তিন গোত্রের কোন একটি চুক্তির বিষয়বস্তুর বিরোধী আচরণ করে,তা হলে তাদের রক্তপাত ঘটানো,সম্পদ বাজেয়াফ্ত করা এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী করার অধিকার মহানবীর থাকবে।86

কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন

প্রাচ্যবিদদের দেখা যায়,এখানে এসে তাঁরা পুনরায় কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন শুরু করে দেন। তাঁরা মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের মতো বনী নাযীর গোত্রের বিশ্বাসঘাতক,চুক্তিভঙ্গকারী ইহুদীদের জন্য যারপর নাই অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা মহানবীর কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তাদের এ মায়াকান্না ও সমালোচনা সত্য উদ্ঘাটন বা প্রকৃত বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে নয়। কেননা সম্মানিত পাঠকবর্গ ইহুদীদের সাথে মহানবীর চুক্তির যে বিবরণ পাঠ করেছেন,তাতে এ মতটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে,মহানবী তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তা চুক্তিপত্রে উল্লিখিত শাস্তির চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক লঘু। আজকের দিনে এসব প্রাচ্যবিদের প্রভুদের পক্ষ থেকে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে কত জঘন্য অপরাধ করা হচ্ছে,অথচ এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্য হতে একজনও সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) যখন মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতককে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লিখিত শাস্তির চেয়েও কম শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তখন কতিপয় লেখক সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন। অথচ এসব লেখক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ জাতীয় ঘটনাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53