চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83897 / ডাউনলোড: 7958
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

সেনা মনোবল শক্তিশালী করণ

মহানবী (সা.) যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী ছিলেন। এবারও যখন (মাঝপথ থেকে তিন শ লোকের মুনাফিক দলটি মুসলমানদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর) কেবল সাত শ মুসলিম যোদ্ধা তিন হাজার শত্রু-সৈন্যের মোকাবেলায় দাঁড়ালো তখন মহানবী এক ভাষণ প্রদান করে তাদের মনোবল দৃঢ় করেন। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আল ওয়াকিদী বলেন :

মহানবী (সা.) আইনাইন গিরিপথে ৫০ জন তীর নিক্ষেপকারী সৈন্য মোতায়েন করেন;উহুদ পর্বত পেছনে এবং মদীনা সামনে রেখে অবস্থান নেন। তিনি হেঁটে হেঁটে সৈন্যদের সারিগুলো বিন্যস্ত করছিলেন এবং প্রত্যেক অধিনায়কের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিলেন। একদলকে সামনে এবং একদলকে পেছনে রাখছিলেন। সৈন্যদের সারি সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে তিনি এতই সতর্কতা দেখিয়েছিলেন যে,কোন সৈনিকের কাঁধ সামনের দিকে এগিয়ে আসলে সাথে সাথে তাকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

মহানবী সৈন্যদের সারি বিন্যস্ত করার পর মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন : মহান আল্লাহ্ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন,আমি তা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : তোমরা মহান আল্লাহর আদেশের আনুগত্য কর। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকবে। এরপর তিনি বলেন : শত্রুর মুকাবেলা করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই শত্রুর মুকাবেলায় দৃঢ় পদ ও অবিচল থাকার লোকের সংখ্যা খুবই কম। কেবল তারাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সক্ষম,যাদের আল্লাহ্ হিদায়েত করেছেন এবং শক্তি যুগিয়েছেন। কেননা মহান আল্লাহর আদেশ পালনকারীদের সাথেই তিনি আছেন। শয়তান ঐ লোকদের সাথে আছে যারা মহান আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। সবকিছুর আগে জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকবে। এর মাধ্যমে তোমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।২৪ ওহী আনয়নকারী ফেরেশতা জিবরীল আমাকে বলেছেন : এ জগতে কোন ব্যক্তিই তার (জন্য বরাদ্দ) রিযকের সর্বশেষ দানাটি আহার না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে না। যতক্ষণ যুদ্ধের নির্দেশ জারি না হয়,কেউ যেন আক্রমণ পরিচালনা না করে। ২৫

যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ শত্রুবাহিনী

আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মাঝখানে বর্ম পরিহিত পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করে। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের অধিনায়কত্বে একদলকে মোতায়েন করে ডান পাশে। অপর এক দলকে ইকরামার অধিনায়কত্বে মোতায়েন করে বাম দিকে।

এছাড়া সে অগ্রবর্তী দলরূপে একটি বিশেষ দলকে সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে মোতায়েন করে যার মধ্যে পতাকাবাহীও ছিল। এরপর বনী আবদুদ্দার গোত্রভুক্ত পতাকাবাহীদের সম্বোধন করে আবু সুফিয়ান বলল : সেনাবাহিনীর বিজয় তোমাদের দৃঢ়পদ থাকার ওপর নির্ভরশীল এবং আমরা বদরের দিন এ অংশের দিক থেকেই আক্রান্ত হয়ে পরাজয় বরণ করেছি। যদি বনী আবদুদ্দার গোত্র পতাকা বহন ও রক্ষার ব্যাপারে যোগ্যতার প্রমাণ না দেয়,তা হলে পতাকা বহনের দায়িত্ব অন্য কোন গোত্রের কাঁধে চলে যাবে। কুরাইশ বাহিনীর প্রথম পতাকাবাহী বীর যোদ্ধা তালহা ইবনে আবি তালহার কাছে কথাটি মারাত্মক বলে মনে হলো। তাই সে তৎক্ষণাৎ ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিপক্ষের মল্লযোদ্ধাদের আহবান জানাল।

মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহ

যুদ্ধ শুরু হবার আগে মহানবী একখানা তরবারি হাতে নিলেন। স্বীয় সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে তাদের লক্ষ্য করে বললেন : কোন্ ব্যক্তি এ তরবারি ধারণ করে তার হক আদায় করবে? ২৬ কিছু লোক সাড়া দিলেন। কিন্তু মহানবী তাদেরকে তরবারি দিতে সম্মত হলেন না। এর মধ্যে অকুতোভয় সৈনিক আবু দুজানাহ্ সাড়া দিয়ে বললেন, এই তরবারীর হক বলতে কি বুঝায়? কিভাবে এর হক আদায় করা যাবে?”   মহানবী বললেন : এটা নিয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করবে যাতে তা বাঁকা হয়ে যায়। আবু দুজানাহ্ বললেন : আমি এর হক আদায় করতে প্রস্তুত আছি। এরপর মৃত্যুর রুমাল নামে বিখ্যাত একটি লাল রঙের রুমাল মাথায় বেঁধে মহানবীর হাত থেকে ঐ তরবারি তুলে নেন। আবু দুজানাহ্ যখনই এ রুমালটি মাথায় বাঁধতেন,তখনই বোঝা যেত,যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে,ততক্ষণ তিনি লড়াই করে যাবেন।

তিনি এক গর্বিত চিতাবাঘের মতো পথ চলছিলেন। আজ তাঁর সৌভাগ্যের জন্য তিনি অতিশয় আনন্দিত। মাথায় লাল রংয়ের পট্টি তাঁর মর্যাদা ও গৌরব আরো বৃদ্ধি করছিল।২৭

সত্যিই যে সেনাবাহিনী একমাত্র সত্য ও নৈতিকতার জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়,যাদের সামনে নিজ বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই,তাদের জন্যে এ ধরনের মহড়া হচ্ছে সর্বোত্তম উদ্দীপক। মহানবীর লক্ষ্য কেবল আবু দুজানাকে উৎসাহিত করাই ছিল না;বরং তিনি এ কাজের দ্বারা সাহাবীগণের আবেগকেও শাণিত করেন। তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে,তাঁদের সিদ্ধান্ত ও বীরত্ব এমন পর্যায়ের হতে হবে যে,এর ফলে তাঁরাও এ ধরনের সামরিক পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

যুবাইর ইবনে আওয়াম ছিলেন এক বীর যোদ্ধা। মহানবী (সা.) হাতের তরবারিখানা তাঁকে না দেওয়ায় তিনি মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে বললেন : আবু দুজানার বীরত্ব ও সাহসের মাত্রা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি তাঁর পিছু নেব। তিনি বললেন : আমি যুদ্ধের ময়দানে তাঁর পেছনে পেছনে ছিলাম। দেখেছিলাম,যে বীর যোদ্ধাই তাঁর সামনে আসছিল,তিনি সাথে সাথে তাকে খতম করে দিচ্ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এক বীর ছিল,যে মুসলমানদের মধ্যেকার আহতদের মাথা দ্রুত দ্বিখণ্ডিত করছিল। এ কাজ দেখে আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে লোকটি আবু দুজানার মুখোমুখি হলো। উভয়ের মধ্যে কয়েকটি আঘাত-পাল্টা আঘাত বিনিময় হলো। শেষ পর্যন্ত কুরাইশ বীরটি আবু দুজানার হাতে নিহত হলো। আর স্বয়ং আবু দুজানাহ্ও বর্ণনা করেছেন : একজনকে দেখলাম,যে কুরাইশ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে যখন দেখল,তার মাথার উপর তরবারি,তখন ভীষণভাবে কেঁদে উঠল। হঠাৎ দেখলাম এ হচ্ছে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। আমি মনে করলাম,হিন্দ্-এর মতো মহিলাকে হত্যা করে মহানবীর তরবারি অপবিত্র করা উচিত হবে না। ২৮

যুদ্ধের সূচনা

মদীনা হতে পলাতক আউস গোত্রের লোক আবু আমেরকে দিয়ে যুদ্ধ শরু হয়ে যায়। ইসলামের বিরোধিতা করার কারণে সে মদীনা থেকে পালিয়ে গিয়ে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। আউস গোত্রের পনের ব্যক্তিও তার সাথে ছিল। আবু আমেরের ধারণা ছিল,আউস গোত্রের লোকেরা যখন তাকে দেখবে,তখন মহানবীকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যে সে যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন সে মুসলমানদের মুখোমুখি হয়,তখন সে তাদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়। কাজেই অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর সে রণাঙ্গন থেকে সরে পড়ে।২৯

উহুদের ময়দানে কয়েকজন যোদ্ধার লড়াই ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। তাদের মনে আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার। ইবনে আব্বাস বলেন : হযরত আলী সকল যুদ্ধেই মসুলমানদের পতাকাবাহী ছিলেন। সর্বদা দক্ষ,পরীক্ষিত ও অবিচল যোদ্ধাদের মধ্য থেকেই পতাকাধারী নির্বাচন করা হতো। উহুদের যুদ্ধে মুহাজিরদের পতাকা হযরত আলীর হাতে ছিল।

অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী,মুসলমানদের পতাকাবাহী মুসআব ইবনে ওমাইর নিহত হবার পর মহানবী (সা.) আলীর হাতে পতাকা তুলে দেন। মুসআব প্রথম পতাকাবাহী হবার কারণ সম্ভবত এটাই ছিল যে,তিনি আবদুদ্দার গোত্রের লোক ছিলেন। কুরাইশ বাহিনীর পতাকাধারীরাও এই গোত্রের লোক ছিল।৩০

তালহা ইবনে আবি তালহা,যাকেكبش الكتيبة কাবশুল কাতীবাহ্ বলা হতো,হুংকার দিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হলো এবং চিৎকার দিয়ে বলল : হে মুহাম্মদের সাথীরা! তোমরা বল যে,আমাদের নিহত ব্যক্তিরা দোযখে আছে,আর তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে। এই অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে যে,আমি তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিই অথবা সে আমাকে দোযখে পাঠিয়ে দিক?”   তার কণ্ঠস্বর যুদ্ধের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। আলী (আ.) সামনে এগিয়ে গেলেন। কয়েকটি ঘাত-প্রতিঘাতের পর আলীর তরবারির আঘাতে তালহা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তালহা নিহত হলে পতাকা বহনের পালা আসে পর্যাক্রমে তার দু ভাইয়ের ওপরে। উভয়ে আসেম ইবনে সাবিতের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়।

দ্বিতীয় খলীফার মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত শূরার (পরামর্শ) সভায় আমীরুল মুমিনীনের (আলী) প্রদত্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় যে,কুরাইশ বাহিনী নয় জনকে পতাকা বহনের জন্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছিল। কথা ছিল,পর্যায়ক্রমে তারা সেনাবাহিনীর পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করবে। পর্যায়ক্রমটি ছিল প্রথম ব্যক্তি নিহত হলে পরের ব্যক্তি-এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি পতাকা বহন করবে। এসব পতাকাবাহীর সবাই ছিল বনী আবদুদ্দার গোত্রের লোক। তারা সবাই উহুদ যুদ্ধের দিবসে হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে প্রাণ হারায়। এদের পর সাওআব নামক এক হাবশী ক্রীতদাস,যার দেহ-কাঠামো ছিল খুবই ভয়ানক এবং মুখমণ্ডল ছিল বীভৎস,সে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা ধারণ করেছিল। সেও ময়দানে এসে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধের আহবান করেছিল। সেই ক্রীতদাসও হযরত আলীর তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিল।

আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের বিরাট পরামর্শসভায় তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,আমি বনী আবদুদ্দার গোত্রের নয় জনের অনিষ্টতা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছিলাম,যাদের প্রত্যেকেই যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আহবান করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে পতাকা হাতে নিয়ে চিৎকার করছিল। উপস্থিত ব্যক্তিদের সবাই হযরত আলীর বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।৩১

তিনি আবারো বললেন : তোমাদের কি মনে আছে যে,ঐ নয় ব্যক্তির পরে হাবশী ক্রীতদাস সাওআব রণাঙ্গনে এসেছিল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহানবীকে হত্যা করা। সে এতখানি ক্রোধান্বিত ছিল যে,তার মুখ ফেনায় ভরে গিয়েছিল। তার চোখ দু টি লাল হয়ে গিয়েছিল। তোমরা এই ভয়ঙ্কর যোদ্ধাকে দেখে ভয়ে পিছু হটে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি সামনে এগিয়ে যাই,তার কোমরের উপর আঘাত হানি এবং তাকে ধরাশায়ী করি। এবারও উপস্থিত সবাই হযরত আলীর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন।

প্রবৃত্তির কামনা চরিতার্থ করতে লড়ছিল যে জাতি

হিন্দ এবং অন্যান্য নারীরা কুরাইশ সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যেসব কবিতা আবৃত্তি করছিল ও গান গাইছিল,তাতে দফ ও খঞ্জনা বাজিয়ে তাদেরকে রক্তপাত ঘটানো ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করার আহবান জানাচ্ছিল। তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে,এই জাতি নৈতিক চেতনা,পবিত্রতা,স্বাধীনতা ও সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটানোর জন্যে লড়ছিল না;বরং তাদের জন্য উত্তেজক ছিল বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ও যৌন সম্ভোগ। দফ ও তবলাবাদক নারীরা কুরাইশ বাহিনীর মাঝখানে এক বিশেষ সুর মূর্চ্ছনায় গান গাইছিল :

نحـن بنات طـارق

نـمشى على النّـمارق

إن تـقبلـوا نعـانق

أو تــدبـروا نـفـارق

আমরা বালিকা পথের

গালিচার উপর দিয়ে করি পদচারণ।

যদি মুখোমুখি হও শত্রুর,করবো আলিঙ্গন

(আর) যদি শত্রু থেকে কর পৃষ্ঠ প্রদর্শন,

তা হলে ছেড়ে যাবো তোমাদের।

নিঃসন্দেহে,যে জাতির যুদ্ধ যৌন বিষয়াদির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বস্তুগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য না থাকে;অন্যদিকে যে জাতি স্বাধীনতার প্রসার,চিন্তার উৎকর্ষতা,কাঠ ও মাটির মূর্তির উপাসনা ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে,-উভয়ের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য ও অতুলনীয় ব্যবধান রয়েছে। এ দু দলের মধ্যে ভিন্ন-ধর্মী দু ধরনের মনোবলের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ইসলামের বীর সমরনায়কগণ,যেমন আলী,হামযাহ্,আবু দুজানাহ্,যুবাইর ও অন্যান্যের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগী লড়াইয়ের ফলে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রশস্ত্র ও গনীমতের সম্পদ ফেলে রেখে অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পালাতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামের সৈনিকদের গৌরব একের পর এক বৃদ্ধি পেতে থাকে।৩২

বিজয়ের পর পরাজয়

ইসলামের সৈনিকরা এ কারণে বিজয়ী হয়েছিল যে,বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর পথে জিহাদ,তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন,তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের প্রচার এবং এ পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান ছিল,সেগুলো অপসারণ ছাড়া তাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না।

বিজয় লাভের পরে পরাজয় এজন্য হয়েছিল যে,অধিকাংশ মুসলমানের নিয়্যত ও লক্ষ্যে পরিবর্তন এসে যায়। কুরাইশ বাহিনী যেসব গনীমতের মাল ফেলে পালিয়েছিল,সেসবের প্রতি মনোযোগ তাদের ইখলাস (নিষ্ঠা) কলুষিত করেছিল এবং তারা মহানবীর নির্দেশ ভুলে গিয়েছিল।

ঘটনার বিবরণ

আমরা উহুদ প্রান্তরের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনায় এ বিষয় উল্লেখ করেছি যে,উহুদ পর্বতের মাঝখানে একটি বিশেষ ধরনের ফাটল ছিল। মহানবী (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইরের অধিনায়কত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের ওপর রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগের এ গিরি প্রহরার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাদের অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন,তীর নিক্ষেপ করে পাহাড়ের ফাটলের ভেতর দিয়ে শত্রু সৈন্যদের আগমন ও চলাচল প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন,তারা কোন অবস্থায়ই তাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না।

যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতার মধ্যে শত্রু সৈন্যরা যখনই এই গিরিপথ অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে,তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র ও মালপত্র মাটিতে ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পলায়ন শুরু করে,তখন প্রাণপণ লড়াই করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইসলামের মুষ্টিমেয় বীর সেনানী যুদ্ধের ময়দানের বাইরে গিয়ে শত্রুবাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানই শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন থেকে বিরত থাকে। তারা (শত্রুবাহিনীর) ফেলে যাওয়া অস্ত্র-শস্ত্র ও সম্পদ সংগ্রহে তৎপর হয়ে যায়। তারা ধরে নিয়েছিল,যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। রণাঙ্গনের পশ্চাদ্ভাগে গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত সৈনিকরা সুবর্ণ সুযোগ ভেবে মনে মনে বলে : আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনর্থক। আমাদেরও গনীমত সংগ্রহে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাদের অধিনায়ক বললেন : মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী বাহিনী জয়ী হোক বা পরাজিত হোক,আমরা যেন এ স্থান ত্যাগ না করি। অধিকাংশ তীর নিক্ষেপকারী রক্ষী সেনা তাদের অধিনায়কের নির্দেশের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়ে বলে : এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল,যুদ্ধ চলাকালে আমরা যেন এ গিরিপথটি পাহারা দিই। এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । এর ভিত্তিতে চল্লিশ জন সৈন্য প্রহরার স্থান থেকে নিচে নেমে আসে। সেখানে কেবল দশ ব্যক্তি ব্যতীত আর কেউ রইল না।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ছিল দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। শুরু থেকেই সে জানত,গিরিপথের মুখটি হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি এবং সে বেশ কয়েক বার ঐ পথ দিয়ে রণাঙ্গনের পেছন দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বারবার প্রহরীদের তীর নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছিল। এবার সে তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতার সুযোগ গ্রহণ করে। সে কুরাইশ সৈন্যদের মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করতে নেতৃত্ব দেয়। সে এক দফায় অতর্কিতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে মুসলমানদের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হয়। টিলার উপর মোতায়েন মুষ্টিমেয় তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যের প্রতিরোধে কোন লাভ হলো না। ঐ দশ ব্যক্তি প্রাণপণ লড়াই করে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও ইকরামাহ্ ইবনে আবি জাহলের সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসতর্ক ও নিরস্ত্র মুসলমানরা পেছন দিক থেকে সশস্ত্র শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ স্পর্শকাতর স্থানটি দখল করে নেয়ার পর পরাজিত কুরাইশ বাহিনীর পলায়নপর সৈন্যদের পুনরায় সংঘবদ্ধ হবার আহবান জানায়। সে চিৎকার করে ও শ্লোগান দিয়ে কুরাইশ বাহিনীর প্রতিরোধ স্পৃহা এবং অবিচল থাকার মনোবৃত্তি চাঙ্গা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের যুদ্ধের সারি ছত্রভঙ্গ থাকার সুযোগে কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। তারা পেছন ও সামনের দিক থেকে ইসলামী বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এ পরাজয়ের কারণ ছিল,ঐ দলটির ত্রুটি-বিচ্যুতি,যারা বস্তুগত লক্ষ্যের জন্য বাঙ্কার বা অবস্থানস্থল ছেড়ে এসেছিল এবং নিজেদের অজান্তেই শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এর ফলে কুরাইশ বাহিনীর অশ্বারোহী দল খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে পেছন দিক থেকে রণাঙ্গনে ঢুকে পড়ে।

আবু জাহলের ছেলে ইকরামার হামলায় খালিদের আক্রমণ অভিযান শক্তিশালী হয়। এ সময় ইসলামী বাহিনীতে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরোধ করা ছাড়া উপায়ন্তর দেখলেন না। কিন্তু চেইন অব কমান্ড যেহেতু ভেঙে পড়েছিল,সেহেতু ইসলামের সৈনিকরা সাফল্যজনক প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেন না। বরং তাঁরা বড় ধরনের প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। কয়েকজন মুসলমান সৈনিকও অসর্তকতার কারণে অন্য মুসলিম সৈনিকদের হাতে নিহত হলেন। খালিদ ও ইকরামার আক্রমণ অভিযান কুরাইশ বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি চাঙ্গা করে। পলাতক কুরাইশ সৈন্যরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় এবং তাদের শক্তি ও সমর্থন যোগাতে থাকে। এ অবস্থায় তারা মুসলমানদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের একদলকে হত্যা করে।

মহানবী (সা.)-এর নিহত হবার সংবাদ

কুরাইশ বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা লাইসী ইসলামী বাহিনীর বীর পতাকাবাহী মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর হামলা করে। তাদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ইসলামী বাহিনীর পতাকাধারী শাহাদাত লাভ করেন। ইসলামী যোদ্ধাদের চেহারা ঢাকা ছিল। সে ভাবল,নিহত ব্যক্তি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হবেন। তখনই সে চিৎকার দিল এবং সেনা অধিনায়কদের উদ্দেশে বলল : ভাইসব! মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদটি কুরাইশ বাহিনীর মুখে মুখে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

কুরাইশ নেতারা এমন আনন্দিত হলো যে,তাদের আওয়াজ সমগ্র রণাঙ্গনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তারা সবাই বলছিল :ألا قد قُتل محمّد، ألا قد قُتل محمّد মুহাম্মদ নিহত হয়েছে,মুহাম্মদ নিহত হয়েছে। এ মিথ্যা সংবাদ রটে যাওয়ায় দুশমনদের সাহস বেড়ে যায়। কুরাইশ বাহিনী তখন তরঙ্গমালার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রত্যেকের চেষ্টা ছিল,মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটায় অংশ নেবে এবং এর মাধ্যমে শিরক ও পৌত্তলিকতার জগতে খ্যাতি অর্জন করবে।

এ গুজব দুশমন সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে যতখানি প্রভাব বিস্তার করে,ইসলামের মুজাহিদদের মনোবল ভেঙে দেয়াতেও ততখানি প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলমানদের বহু লোক যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং মাত্র কয়েক মুজাহিদ যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকেন।

কিছুসংখ্যক লোকের পলায়ন কি অস্বীকার্য?

(উহুদের রণাঙ্গন থেকে) সাহাবীদের পলায়ন এবং তাঁদের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। অথবা যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুসলমানদের মাঝে সুখ্যাতি এবং উচ্চ মর্যাদা ও পদের অধিকারী হয়েছিলেন,সেহেতু তা আমাদের এ তিক্ত সত্য মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েও দাঁড়াবে না।

বিখ্যাত মুসলিম সীরাত রচয়িতা ইবনে হিশাম লিখেছেন,মুসলিম বাহিনী যখন চাপের মুখে পড়ে এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে,তখন অধিকাংশ মুসলমান নিজেদের জীবন রক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে যায় এবং সবাই যে যার মতো একেক দিকে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আনাস ইবনে মালিকের চাচা আনাস আনাস ইবনে নযর একদল মুজাহির ও আনসার,যাঁদের মধ্যে উমর ইবনে খাত্তাব ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও ছিলেন,তাঁদেরকে দেখতে পেলেন যে,তাঁরা এক কোণায় বসে আছেন এবং নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছেন। তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠে তাঁদেরকে বললেন : আপনারা কেন এখানে বসে আছেন? তাঁরা জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন;তাই এখন য্দ্ধু করে কোন লাভ নেই। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেন : যদি মহানবী নিহত হয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের এ জীবনের কোন লাভ নেই। আপনারাও সবাই উঠে যে পথে তিনি শহীদ হয়েছেন,সে পথে শহীদ হোন। ৩৩ অনেক ঐতিহাসিকই বলেছেন,আনাস ইবনে নযর ঐ সময় বললেন : মুহাম্মদ যদি নিহত হয়েও থাকেন,মুহাম্মদের আল্লাহ্ তো জীবিত আছেন। এরপর তিনি দেখতে পেলেন যে,তাঁর কথা তাঁদের উপর কোন প্রভাব রাখছে না। তখন তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। ইবনে হিশাম বলেন,এ যুদ্ধে আনাসের দেহে ৭০টি ক্ষত বা আঘাত ছিল এবং তাঁর বোন ব্যতীত আর কেউই তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি।

একদল মুসলমান এতটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে,তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর দ্বারস্থ হতে চেয়েছিল যাতে সে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারে।৩৪

উহুদ প্রান্তর

যে দীর্ঘ ও বিশাল উপত্যকা শামের বাণিজ্য-পথকে ইয়েমেনের সাথে যুক্ত করেছিল,সেই উপত্যকাকে ওয়াদিউল কুরা নামে অভিহিত করা হতো। এখানকার যেখানেই বসতি স্থাপন করা সম্ভবপর ছিল,সেখানেই বিভিন্ন আরব ও ইহুদী গোত্র বসতি স্থাপন করেছিল। এদিক থেকে উপত্যকা জুড়ে বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম গড়ে উঠেছিল,যেগুলোর চতুর্দিক পাথর দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। এসব জনপদের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত হতো ইয়াসরিব যা মদীনাতুর রাসূল বা সংক্ষেপে মদীনা নামে অভিহিত হয়। মক্কা থেকে মদীনায় কেউ এলে তাকে অবশ্যই দক্ষিণ দিক থেকে এই কেন্দ্রীয় জনপদে প্রবেশ করতে হতো। কিন্তু এলাকাটি পাথুরে ও কংকরময় ছিল বলে সেখানে সৈন্য পরিচালনার কাজটি কষ্টকর ছিল। কুরাইশ বাহিনী যখন মদীনার কাছাকাছি পৌঁছে,তখন যাত্রাপথ থেকে সরে এসে মদীনার উত্তর দিকে আকীক উপত্যকায় উহুদ পর্বতের পাদদেশে সেনা মোতায়েন করে। খেজুর বাগান এবং সমতলভূমি না থাকায় জায়গাটি সব ধরনের সামরিক তৎপরতার জন্য উপযোগী ছিল। এদিক থেকেই মদীনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। কেননা এই এলাকায় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অপেক্ষাকৃত কমই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।

কুরাইশ বাহিনী তৃতীয় হিজরীর 5 শাওয়াল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উহুদ পর্বতের পাদদেশে শিবির স্থাপন করে। মহানবী (সা.) সেই দিন এবং শুক্রবার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) মদীনায় অবস্থান করেন এবং শুক্রবার সামরিক পরামর্শ সভা ডাকেন। তিনি প্রতিরক্ষার কৌশল ও ধরন সম্পর্কে দূরদর্শী ব্যক্তি ও সমরবিশেষজ্ঞগণের সাথে পরামর্শ করেন।

প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ

মহানবী (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ-সামরিক ও এ জাতীয় অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গিগণের সাথে পরামর্শ করতে হবে এবং নিজের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে,যাতে করে তিনি এ কাজের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের জন্য একটি মহান আদর্শ ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন এবং সাহাবিগণের মাঝে গণমতসহ সত্যান্বেষণ এবং বাস্তবদর্শিতার মনোবৃত্তির উন্মেষ ঘটান। তবে এ ধরনের পরামর্শের দ্বারা কি মহানবী লাভবান হতেন? তাঁদের (সঙ্গী-সাথীদের) পরামর্শে তাঁর কি কোন উপকার হতো? ইলমে কালাম-এর মহীরূহ হিসেবে স্বীকৃত মনীষীগণ এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিশদভাবে জানতে হলে সম্মানিত পাঠকদের ধর্মতত্ত্ববিদগণের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের শরণাপন্ন হতে হবে।13

এসব পরামর্শ একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া যা মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত হিসেবে আজও বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর এ পদ্ধতি এতটা শিক্ষণীয় ও প্রভাবশালী ছিল যে,তাঁর ইন্তিকালের পর ইসলামের খলীফাগণ এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তাঁরা সামরিক বিষয় ও সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে আমীরুল মুমিনীনের সমুন্নত চিন্তা ও মতামতকে পুরোপুরি স্বাগত জানিয়েছেন।14

সামরিক পরিষদ

সেখানে সমবেত ইসলামী বাহিনীর বীর সৈনিক ও সেনাপতিগণের এক বিরাট সমাবেশে মহানবী (সা.) বলিষ্ঠ কণ্ঠে আহবান জানালেন : সেনাপতি ও সৈনিকরা! তাওহীদের চৌহদ্দির মধ্যে কুরাইশ বাহিনীর পক্ষ থেকে যে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে,তা প্রতিরোধ পদ্ধতি কী হতে পারে,সে সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত কর।

মদীনার মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই দুর্গ রক্ষার প্রস্তাব উত্থাপন করল। দুর্গ রক্ষার প্রস্তাব দানের উদ্দেশ্য ছিল এই যে,মুসলমানরা যেন মদীনার বাইরে না যায়;দালান-কোঠা ও বাড়ির ছাদ ব্যবহার করে যেন তারা যুদ্ধ করে। মহিলারা ঘরের ছাদ ও উঁচু দালান থেকে দুশমনের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবে,আর পুরুষরা রাস্তায় রাস্তায় হাতাহাতি যুদ্ধ করবে।

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই তার কথা এভাবে শুরু করে : আমরা অতীতে দুর্গ রক্ষার কৌশল ব্যবহার করতাম। মহিলারা ঘরের ছাদ থেকে আমাদের সাহায্য করত। এ কারণেই ইয়াসরিব নগরী এখনো অক্ষত রয়েছে। শত্রুরা এ পর্যন্ত এ নগরী দখল করতে পারে নি। যখনই প্রতিরক্ষার জন্য আমরা এ পন্থা গ্রহণ করেছি,বিজয়ী হয়েছি। আর যখনই শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করেছি,ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।

মুজাহিদ ও আনসারগণের মধ্যকার বয়ষ্ক ব্যক্তিরা এ প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তরুণরা,বিশেষ করে যারা বদরের যুদ্ধে অংশ নেয় নি এবং যাদের মাথায় যুদ্ধের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল,তারা এ প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করছিল এবং বলছিল : প্রতিরক্ষার এ কৌশল শত্রুদের সাহস বাড়িয়ে দেবে। বদর যুদ্ধে মুসলমানরা যে গৌরবের অধিকারী হয়েছিল,তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এটা কি দূষণীয় নয় যে,আমাদের বীর সেনানী এবং আত্মোৎসর্গকারী যোদ্ধারা ঘরে বসে থেকে শত্রুকে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে? আমরা বহুদিন থেকে এমন দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন সে সুযোগ আমাদের সামনে উপস্থিত। ইসলামের সাহসী বীর সেনাধ্যক্ষ হামযাহ্ বললেন : সেই মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি,যিনি পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। শহরের বাইরে গিয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত আজ খাদ্য গ্রহণ করব না। শেষ কথা হলো ইসলামী সেনাবাহিনীকে নগরীর বাইরে যেতে এবং নগরীর বাইরে গিয়েই শত্রুর সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।15

শাহাদাতের জন্য লটারী

জাগ্রত ও প্রাণবন্ত হৃদয়ের অধিকারী বৃদ্ধ খুসাইমাহ্ দাঁড়িয়ে বললেন : হে রাসূলাল্লাহ্! কুরাইশরা পুরো একটি বছর চেষ্টা করে আরব গোত্রগুলোকে নিজেদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে। যদি আমরা এ নগরী রক্ষার জন্য বাইরে না যাই,তা হলে তারা মদীনা অবরোধ করবে। তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে মক্কায় ফিরে যেতেও পারে। কিন্তু এ কাজই তাদের স্পর্ধার কারণ হবে। আমরা ভবিষ্যতে তাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারব না। আমি এজন্য আফসোস করছি,বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয় নি,যদিও আমি এবং আমার সন্তান আন্তরিকভাবেই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছিলাম। আমরা উভয়ে এ সৌভাগ্যের ব্যাপারে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছিলাম।

শেষ পর্যন্ত সে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে এবং আমি সফল হই নি। আমি বদর যুদ্ধে আমার ছেলেকে বলেছিলাম,তুমি তরুণ,তোমার বহু চাওয়া-পাওয়া আছে। তুমি তোমার যৌবনকালকে এমন পথে ব্যয় করতে পার যে পথে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু আমার জীবন তো ফুরিয়ে এসেছে। আমার ভবিষ্যত পরিষ্কার নয়। আমার এই পবিত্র জিহাদে (বদর যুদ্ধে) অংশগ্রহণ করতে হবে। তুমি আমার স্থানে থেকে আমার পরিবার-পরিজনের দেখাশুনার দয়িত্ব পালন কর। কিন্তু এ ব্যাপারে তার প্রচণ্ড আগ্রহ ও প্রচেষ্টা এত অধিক ছিল যে,দু পক্ষ লটারী করতে বাধ্য হলাম। লটারীতে তার নাম ওঠে। সে বদর যুদ্ধে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে। গত রাতে এ দুর্গের সর্বত্র কুরাইশদের অবরোধ নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সে চিন্তা নিয়েই আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার প্রিয় সন্তানকে স্বপ্নে দেখতে পেলাম। সে বেহেশতের বাগানসমূহে পায়চারী করছে। সে সেখানকার ফলমূল খাচ্ছে। সে ভালোবাসায় ভরা ব্যাকুল কণ্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল : আব্বাজান! আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। হে রাসূলাল্লাহ্! আমার দাঁড়ি সাদা এবং আমার হাঁড়গুলো দুর্বল হয়ে গেছে। আমার একান্ত অনুরোধ,আমার জন্য আপনি আল্লাহর দরবারে শাহাদাত লাভের দুআ করুন। 16

ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের আত্মত্যাগী ও শাহাদাত পিপাসু বহু ব্যক্তিত্বকেই দেখতে পাওয়া যায়। যে আদর্শ অস্তিত্বশীল জগতের উৎসমূল ও পরকালের আদর্শে বিশ্বাসী নয়,সে আদর্শের পক্ষে খাইসামার মতো আত্মত্যাগী বীর যোদ্ধা সৃষ্টি করা সহজ কাজ নয়।

এ বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের মনোবল,এ ত্যাগ ও প্রাণপণ সংগ্রাম-যা একজন যোদ্ধা মহান আল্লাহর বাণী ও তাওহীদী ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং শাহাদাত লাভের পথে ক্রন্দন করার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা করে,তা মহান নবিগণের আদর্শ ছাড়া দ্বিতীয় কোন আদর্শে পাওয়া সম্ভব নয়।

আজকের বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা ও অধিনায়কদের জীবন-মানের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এ সত্বেও যুদ্ধগুলোয় যেহেতু তাদের লক্ষ্য থাকে বিদ্যমান অবস্থা বহাল রাখা বা আরো উন্নত জীবনের অধিকারী হওয়া,সেহেতু তাদের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু মহান নবিগণের আদর্শে লড়াই করতে হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শাহাদাতই একমাত্র পথ। তাই আল্লাহর সৈনিকরা কোন ভয়-ভীতি ছাড়াই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজেদের সব ধরনের বিপদের মুখে সঁপে দেয়।

শূরা বা পরামর্শ সভার ফলাফল

মহানবী (সা.) অধিকাংশের মতামতকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেন। তিনি নগরীর বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করাকে দুর্গ রক্ষা এবং হাতাহাতি লড়াই বা মল্লযুদ্ধের ওপর স্থান দেন। আসলে হামযাহ্ ও সা দ ইবনে উবাদার মতো সেনাধ্যক্ষগণের পক্ষ হতে জোর দাবি ওঠার পর মদীনার চিহ্নিত মুনাফিক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের মতামত গ্রহণ ও অগ্রাধিকার প্রদান করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

এসব ছাড়াও মদীনার সরু অলি-গলিতে বিশৃঙ্খল হাতাহাতি লড়াই,নারীদের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োগ,নিজেরা ঘরে বসে থেকে শত্রুর জন্য প্রবেশপথ খুলে দেয়া মুসলমানদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের পরিচায়ক ছিল।

বদর যুদ্ধে যেভাবে শক্তির মহড়া দেয়া হয়েছে,তার সাথে কোনভাবেই এগুলো তুলনীয় ও সংগতিশীল ছিল না। মদীনা অবরোধ,শহরের প্রবেশপথে শত্রুসেনা মোতায়েন হওয়া ও তাদের মুকাবিলায় ইসলামের সৈনিকদের নির্বিকার থাকা ইসলামের মুজাহিদগণের শৌর্য-বীর্যের চেতনা ও মনোবল ধ্বংস করে দিত।

আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি দুরভিসন্ধি এঁটেছিল। হয় তো তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবীর ওপর একটি মারাত্মক আঘাত হানা। মহানবী যুদ্ধের পোশাক পরিধান করলেন এবং প্রতিরক্ষার কৌশল নির্ধারণের পর বাড়ির ভেতর গেলেন। তিনি বর্ম পরলেন এবং তরবারী ঝুলিয়ে নিলেন। পিঠের উপর একখানা ঢাল,কাঁধে একটি ধনুক ঝুলিয়ে এবং হাতে বল্লম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

এ দৃশ্য দেখে মুসলমানরা প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হলেন। কেউ কেউ ধারণা করলেন,নগরীর বাইরে যাবার জন্য তারা যে পীড়াপীড়ি করেছেন,তাতে তাঁর সম্মতি ছিল না। তাঁরা অনর্থক তাঁকে মদীনার বাইরে যেতে বাধ্য করেছেন। এ কারণে তাঁরা দোষ স্বীকারের উদ্দেশ্যে আরজ করলেন : আমরা প্রতিরক্ষার কৌশলের ক্ষেত্রে আপনার মতামতের অধীন। বাইরে যাওয়া যদি কল্যাণকর না হয়,তা হলে আমরা এখানেই অবস্থান করব। মহানবী বললেন :

ما ينبغى لنبِى إذا لبس لامته أن يضعها حتّي يُقاتل

কোন নবী যখন বর্ম পরিধান করেন,তখন শত্রুর সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত তা খুলে ফেলা উচিত নয়। 17

মহানবী (সা.)-এর মদীনার বাইরে গমন

মহানবী (সা.) জুমআর নামায আদায় করেন এবং এক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী সাথে নিয়ে উহুদের উদ্দেশে মদীনা ত্যাগ করেন। তিনি উসামাহ্,যাইদ ইবনে হারিসাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের মতো যারা অল্পবয়স্ক ছিল,তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুমতি দিলেন না;কিন্তু সুমরা রাফে নামের অনূর্ধ 15 বছরের দুই কিশোরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন। কেননা তারা ছোট হলেও তীর নিক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিল।

ইতোমধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ একদল ইহুদী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু মহানবী বিশেষ বিবেচনার কারণে তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন নি। মাঝপথে ইসলামী বাহিনী যখন মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শওত নামক স্থানে পৌঁছল,তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই-মহানবী (সা.) যুবকদের মতামত গ্রহণ করেছেন,তার মতামতকে গুরুত্ব দেন নি-এ অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। শুধু তা-ই নয়,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের স্বগোত্রীয় আউস গোত্রের তিন শ ব্যক্তি মাঝপথ থেকে ফিরে যায়। কাজেই এ যুদ্ধে না ইহুদীরা অংশগ্রহণ করেছে,না মুনাফিক গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছে।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ চেয়েছিলেন,নিকটতম পথ অতিক্রম করে নিজস্ব সেনাশিবিরে গিয়ে পৌঁছবেন। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তিনি মুরাব্বা নামক এক মুনাফিকের বাগান অতিক্রম করে যেতে বাধ্য হন। তার ভূ-সম্পত্তিতে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করায় একগুঁয়েমিবশত সে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়। এমনকি সে মহানবীর প্রতি বেয়াদবীপূর্ণ উক্তিও করে। মহানবীর সাহাবীগণ তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বললেন : এই অন্ধ হৃদয়ের অধিকারী গোঁয়ার লোকটিকে বাদ দাও। 18

দু জন আত্মোৎসর্গী সৈনিক

মহানবী (সা.) এক জায়গায় তাঁর সৈনিকদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। তাদের আত্মোৎসর্গী অবয়ব ও উজ্জ্বল চেহারা তরবারির ঝলকানির মাঝে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে চমকাচ্ছিল। মহানবী ইসলাম ধর্মের প্রতিরক্ষার জন্য যে সেনাবাহিনী উহুদ প্রান্তরে নিয়ে এসেছেন,বয়সের দিক থেকে তাদের মধ্যে অনেক তারতম্য ছিল। অনেকেই ছিলেন বয়ষ্ক,আবার একদল ছিলেন আত্মোৎসর্গী যুবক,যাদের বয়স 15 বছর অতিক্রম করে নি।

তাদের প্রেরণার একমাত্র উৎস পূর্ণতা অর্জনের প্রেম ও আগ্রহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না,যা তাওহীদী আদর্শ রক্ষা করার আলোকে তাদের মধ্যে অস্তিত্ব লাভ করেছিল ও বিদ্যমান ছিল। বিষয়টি প্রমাণের জন্য আমরা এক বৃদ্ধ ও এক তরুণের কাহিনী তুলে ধরব,যার সদ্য বিয়ের পর একটি মাত্র রাত অতিক্রান্ত হয়েছিল।

1. আমর ইবনে জমূহ : বয়সের ভারে ন্যূজ বৃদ্ধ;দৈহিক শক্তি বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। একটি ঘটনায় তাঁর এক পায়ে আঘাত লেগেছিল। তিনি তাঁর সাহসী চার পুত্রসন্তানকে ইসলাম ধর্ম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করেন। তাঁর হৃদয় শুধু এ কারণে আলোকিত হয়েছিল যে,তাঁর সন্তানরা সত্যের পথে তরবারি চালনা করছে।

তিনি চিন্তা করে দেখলেন,যুদ্ধ থেকে তাঁর দূরে থাকা অন্যায় হবে। কেন তিনি এমন সৌভাগ্য হাতছাড়া করবেন? তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছিল। তারা জোরালো ভাষায় বলছিল : ইসলামের বিধি-বিধান আপনার কাঁধ থেকে সব ধরনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে অর্থাৎ আপনাকে অব্যাহতি দিয়েছে। তাদের কথা এ বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তিনি নিজেই মহানবীর নিকট উপস্থিত হন এবং বলেন : আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে জিহাদের ময়দানে যেতে বাধা দিচ্ছে। আপনার মত কী? আমার মনে শাহাদাত লাভ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। আমি বেহেশতের দিকে উড়ে যেতে চাই। মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন :

اما انت فقد عذرك الله و لا جهاد عليك

মহান আল্লাহ্ আপনাকে অপারগ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার কোন দায়িত্ব নেই। 19

তিনি অনুরোধের পর অনুরোধ করেন;কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন। আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে বেষ্টন করে রেখেছিল। মহানবী তাঁর আত্মীয়-স্বজনের উদ্দেশে বললেন : যে ইসলামের রাস্তায় শাহাদাতের শরবত পান করতে চায়,তাকে তোমরা বাধা দিও না। অতঃপর তিনি বাড়ি ত্যাগ করে রওয়ানা হন এবং রওয়ানা হওয়ার সময়ে বলেন :

اللهم ارزقنِى الشهادة و لا تردّنِى إلى أهلى

  হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার রাস্তায় শহীদ হবার তওফীক দাও। আমাকে আর ঘরে ফিরিয়ে এনো না।

উহুদ যুদ্ধের উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোর অন্যতম ছিল এই বৃদ্ধ খোঁড়া লোকটির বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ। তিনি খোঁড়া পায়ে আক্রমণ করছিলেন এবং বলছিলেন : আমার প্রত্যাশা বেহেশত। তাঁর এক ছেলেও পিতার পেছনে পেছনে চলছিল। দু জনই এত প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করেন যে,উভয়ে শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর অপর ভাই আবদুল্লাহ্ও এ যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করেন।20

2. হানযালা : তিনি ছিলেন এমন এক যুবক যাঁর জীবন-বসন্ত থেকে 24 বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয় নি। তিনিيُخرج الحىّ من الميّت তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন অর্থাৎ অপবিত্র পিতাদের থেকে পবিত্র সন্তানদের সৃষ্টি করেন-এ আয়াতের বাস্তব নমুনা ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর শত্রু আবু আমীরের সন্তান ছিলেন। সে ছিল ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত,যারা ইসলাম ধর্মের অনিষ্ট কামনা করত। সে মহানবীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধের উস্কানিদাতাদের মধ্যে গণ্য ছিল। সে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করার ব্যাপারে অবহেলা করে নি। সে মসজিদে যেরার ঘটনার অন্যতম নায়ক ছিল। (আমরা নবম হিজরীর ঘটনাবলীর বিবরণে সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পেশ করব।)

সন্তানের পিতার প্রতি যে আবেগ,তা কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে উহুদের ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হানযালাকে বাধা দেয় নি। উহুদ যুদ্ধের আগের রাতটি ছিল তাঁর বিয়ের রাত। আউস গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বাধ্য হয়ে ঐ রাতেই তাঁকে বাসর রাতের অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন করতে হয়েছিল।

যুদ্ধের ডাক তাঁর কানে এসে বাজলে তিনি অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের সামনে উপস্থিত হয়ে একটি রাত মদীনায় অবস্থান করা এবং পরের দিনই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাওয়া ছাড়া তিনি আর কোন উপায় দেখতে পেলেন না। মরহুম মাজলিসীর বর্ণনা অনুযায়ী নিম্নের আয়াত তাঁর শানেই নাযিল হয়েছে21 :

) إنّما المؤمنون الّذين آمنوا بالله و رسوله و إذا كانوا معه علي أمر جامع لم يذهبوا حتّي يستأذنوه إنّ الّذين يستأذنونك أولئك الّذين يُؤمنون بالله و رسوله فإذا استأذنوك لبعض شأنهم فأذن لمن شئت منهم(

ঐ লোকেরাই মুমিন যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর যখন কোন সাধারণ জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কাজের জন্য তাঁর কাছে সবাই উপস্থিত হয়,তখন তাঁর অনুমতি গ্রহণ ব্যতীত তারা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। যারা আপনার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করে,তারাই আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি ঈমান রাখে। যদি তারা তাদের কোন বিশেষ বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আপনার কাছ থেকে অনুমতি নেয়,তা হলে তাদের মধ্যে যাকে আপনার ইচ্ছা তাকে অনুমতি দিন। 22

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য রাসূল তাঁকে এক রাতের অনুমতি দান করেন। পরদিন সকালে হানযালা জানাবতের (যৌন কারণে অপবিত্রতার) গোসল না করইে ময়দানে ছুটে যান। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে নববধূ-যার সাথে দাম্পত্য জীবনের মাত্র একটি রাত অতিবাহিত হয়েছিল-তাঁর দু চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। স্বামীর কাঁধে হাত রেখে অনুরোধ করলেন- আর কিছুক্ষণ থাক । তিনি যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত চার জন পুরুষকে সাক্ষী করলেন যে,বিগত রাতে তাঁর ও তাঁর স্বামীর মধ্যে মিলন হয়েছে।

হানযালা বাড়ী থেকে রওনা হন। নববধূ ঐ চার ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বললেন : গতকাল আমি স্বপ্ন দেখেছি যে,আকাশ ফেটে গেছে এবং আমার স্বামী তাতে প্রবেশ করছেন। এরপর ফাটলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ স্বপ্ন দেখে আমি মনে করছি যে,আমার স্বামীর রূহ্ ঊর্ধ্ব আকাশ পানে পাড়ি জমাবে এবং তিনি শাহাদাতের শরবত পান করবেন।

হানযালা সেনাদলে শামিল হন। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আবু সুফিয়ানের প্রতি,যে দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানে টহল দিচ্ছিল। তিনি বীরত্বপূর্ণ হামলা চালিয়ে আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে তরবারির আঘাত হনলেন। কিন্তু তরবারি আঘাত করল আবু সুফিয়ানের ঘোড়ার পিঠে। আর আবু সুফিয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হৈ চৈ শুনে কুরাইশ বাহিনীর একদল সৈন্য তাকে ঘিরে ধরল। শাদ্দাদ লাইসী হানযালার ওপর হামলা করল। এ হামলার ফলে হানযালার হাত থেকে আবু সুফিয়ান রেহাই পেল। কুরাইশ বাহিনীর মধ্য থেকে বর্শাধারী এক সৈনিক হানযালার ওপর হামলা করল এবং তাঁর দেহে বর্শা ঢুকিয়ে দিল। হানযালা সেই যখম নিয়েই বর্শাধারীকে ধাওয়া করলেন এবং হাতের তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করলেন। তিনি নিজেও আঘাতের কারণে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

মহানবী (সা.) বলেছেন : আমি দেখতে পেলাম,ফেরেশতারা হানযালাকে গোসল দিচ্ছে। এ কারণে তাঁকেغسيل الملائكة গাসীলুল মালাইকাহ্ (ফেরেশতারা যাঁর লাশের গোসল দিয়েছে এমন ব্যক্তি) নামে আখ্যায়িত করা হয়। আউস গোত্র তাদের গৌরব কীর্তির কথা স্মরণ করলে এভাবে বলত :و منّا حنظلة غسيل الملائكة আমাদের মাঝে আছেন হানযালা,যাঁকে ফেরেশতারা গোসল দিয়েছিলেন।

আবু সুফিয়ান বলত : তারা যেহেতু বদর যুদ্ধে আমার ছেলে হানযালাকে হত্যা করেছে,সেহেতু আমিও উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের হানযালাকে হত্যা করেছি।

এই বর ও নববধূর ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক। কেননা তাঁরা ছিলেন সত্যের পথে কুরবান;অথচ নববধূ ও বর উভয়ের পিতারা ছিল ইসলামের চরম শত্রু। নববধূর পিতা ছিল মদীনার মুনাফিকদের সরদার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ইবনে আবী সালল। আর হানযালা ছিলেন জাহিলী যুগের পুরোহিত আবু আমীরের সন্তান। ইসলামের (চূড়ান্তভাবে) আবির্ভাবের পরে আবু আমীর মক্কার মুশরিকদের দলে যোগ দেয় এবং হিরাক্লিয়াসকে তরুণ ইসলামী হুকুমতকে ধ্বংস করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

দুই বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি

তৃতীয় হিজরীর 7 শাওয়াল ভোরে ইসলামী সেনাবাহিনী কুরাইশদের আগ্রাসী বাহিনীর মুকাবিলায় নিজেদের সারিবদ্ধ করে। ইসলামী সেনাবাহিনী এমন স্থানে মোতায়েন করা হয়,যার পশ্চাতে একটি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরক্ষা ব্যূহ অর্থাৎ উহুদ পর্বত ছিল। কিন্তু পাহাড়ের মাঝখানে একটি বিশেষ ফাটল ছিল। তাতে আশংকা ছিল,শত্রুবাহিনী উহুদ পর্বতের পেছন দিক থেকে এসে পাহাড়ের ঐ ফাটল বা গিরিপথ দিয়ে পেছন থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর হামলা করে বসতে পারে।

মহানবী (সা.) এ আশংকা দূর করার জন্য টিলার উপরে দুই দল তীর নিক্ষেপকারী সেনা মোতায়েন করেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরকে তাদের অধিনায়ক নিযুক্ত করে নির্দেশ দেন : তোমরা তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদের তাড়িয়ে দেবে। পেছন থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার সুযোগ দেবে না। আমাদের ওপর যেন তারা অতর্কিতে আক্রমণ করতে না পারে। আমরা যুদ্ধে জয়ী হই বা পরাজিত হই,তোমরা এ স্থান ছেড়ে চলে আসবে না। 23

উহুদ যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে,এই গিরিপথটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ছিল। জয় লাভের পর মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটেছিল এ কারণে যে,(গিরিপথে মোতায়েন) তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিল এবং স্পর্শকাতর বাঙ্কারটি তারা ছেড়ে দিয়েছিল। এর ফলে পরাজিত পলাতক শত্রুবাহিনী সেই গিরিপথের পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে।

মহানবী (সা.) যে তীর নিক্ষেপকারী মুসলিম সেনাদের কোন অবস্থায়ই গিরিপথের মুখের অবস্থান ত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন,তা প্রমাণ করে যে,তিনি সামরিক কৌশল সম্পর্কে পূর্ণরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এ থেকে আরো প্রমাণিত হয়েছে যে,সেনাধিনায়কের সামরিক মেধা,দক্ষতা ও বিচক্ষণতাই বিজয়ের একমাত্র গ্যারান্টি নয়,যদি অধীন সৈনিকরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53