চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 83925 / ডাউনলোড: 7971
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

যাতুস্ সালাসিলের গায্ওয়া

যেদিন মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরত করেন এবং মদীনাকে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং মুসলমানদের সমাবেশস্থল হিসেবে মনোনীত করেন, সেদিন থেকে তিনি সবসময় শত্রুদের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং তাদের গতিবিধি ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি মুশরিকদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথার্থ তথ্য লাভ করার ব্যাপারে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ কারণেই তিনি শক্তিশালী, দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণকে বিভিন্ন ছদ্মনামে পবিত্র মক্কার চারপাশে এবং বিভিন্ন গোত্রের মাঝে প্রেরণ করতেন, যাতে করে তাঁরা তাঁকে যথাসময়ে বিরোধী ও ষড়যন্ত্রকারীদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে সতর্ক ও অবহিত করতে পারেন।

এ সব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার ভিত্তিতে তিনি অনেক চক্রান্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতেন এবং শত্রুরা নিজেদের জায়গা থেকে অগ্রসর হওয়ার আগেই স্বয়ং মহানবী বা কোন ঊর্ধ্বতন মুসলিম সেনাপতির নেতৃত্বে ইসলামের মুজাহিদরা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। এর ফলে ইসলাম শত্রুর হুমকি ও বিপদ থেকে নিরাপদ হয়েছে এবং প্রচুর রক্তপাত ও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

আজ শত্রুপক্ষের শক্তি, প্রস্তুতির মাত্রা এবং গোপন নীলনক্শা ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত (গোয়েন্দা) তথ্য বিজয় ও সাফল্যের অন্যতম কার্যকর কারণ বলে গণ্য হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রেরই গুপ্তচর প্রশিক্ষণ, নিয়োগ, (গোয়েন্দা তৎপরতা আঞ্জাম দেয়ার জন্য) প্রেরণ এবং তাদেরকে কাজে লাগানোর বিশাল সংস্থা ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আছে। এ ব্যবস্থার উদ্ভাবক ছিলেন স্বয়ং মহানবী (সা.) এবং তাঁর পরে খলীফাগণ, বিশেষ করে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বিভিন্ন কাজের জন্য বহু গোয়েন্দা নিয়োগ করতেন। তিনি কোন এলাকায় কোন শাসনকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করলে কতিপয় ব্যক্তিকে এ শাসনকর্তার জীবন-যাত্রা এবং সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাঁর আচরণ এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁর কাছে গোপনে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দান করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে তিরস্কার করে ইমাম আলী (আ.) যে সব পত্র লিখেছেন৩২১ সেসব এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে।

মহানবী (সা.) হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে আশি জন মুহাজিরকে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাহ্শের নেতৃত্বে একটি স্থানে গিয়ে তাঁকে কুরাইশদের গতিবিধি ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করানোর আদেশ দিয়েছিলেন।

মহানবী (সা.) যে উহুদ যুদ্ধে অতর্কিত হামলার শিকার হন নি এবং শক্রদের আগমনের আগেই তিনি মদীনার বাইরে সেনা মোতায়েন করেছিলেন অথবা আহযাবের যুদ্ধে আরব বাহিনীর আগমনের আগে শত্রুদের আগমন পথে পরিখা খনন করিয়েছিলেন- এ সব কিছুই আসলে কতকগুলো নির্ভুল তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এ সব তথ্য মহানবীর সচেতন ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ তাঁর হাতে অর্পণ করতেন এবং এভাবে তাঁরা পতনের হুমকি থেকে তাওহীদী আদর্শ রক্ষা করার ক্ষেত্রে নিজেদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতেন। মহানবী (সা.)-এর বিজ্ঞজনোচিত এ কর্মপদ্ধতি মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। এ মূলনীতির আলোকে ইসলাম ধর্মের মহান নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই ইসলামী বিশ্বের আনাচে-কানাচে যে সব ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত হতে হবে এবং প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবার আগেই (ফিতনার) অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলো নির্বাপিত করতে হবে। যে পথ অবলম্বন করে মহানবী (সা.) উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, তাঁদেরকেও সে পথ অবলম্বন করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে হবে। আর এ কাজ এ কালে পর্যাপ্ত উপায়-উপকরণ ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না।

যাতুস্ সালাসিলের গাযওয়ায় শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথার্থ তথ্যাবলী প্রাপ্তির মাধ্যমে ব্যাপক ফিতনার আগুন নির্বাপিত হয়েছিল। মহানবী (সা.) এ পথ রুদ্ধ করে দিলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতেন।

এ যুদ্ধে মহানবীর গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ গোপনে রিপোর্ট দেন, ওয়াদী ইয়াবিস নামক এক অঞ্চলে হাজার হাজার লোক পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মকে গুঁড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নিজেদের সমুদয় শক্তি ব্যাবহার করে হয় নিজেরা সবাই এ পথে নিহত হবে অথবা মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সাহসী ও বিজয়ী সমরাধিনায়ক আলীকে ধরাশায়ী করবে।

আলী ইবনে ইবরাহীম কুম্মী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেন : ওহীর ফেরেশতা মহানবী (সা.)-কে তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করেন।৩২২ কিন্তু শিয়া বিশ্বের গবেষক আলেম মরহুম শেখ আল মুফীদ বলেন : একজন মুসলমান মহানবী (সা.)-কে এ ধরনের সংবাদ প্রদান করে এবং ওয়াদী আর রামলকে৩২৩ এ ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র বলে অভিহিত করে। আর সে আরো জানায় যে, এ গোত্রগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা রাতের বেলা অতর্কিতে মদীনা আক্রমণ করে এ কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করবে।”৩২৪

মহানবী (সা.) মুসলমানদের এ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানানো অত্যাবশ্যক মনে করেছিলেন। ঐ সময় নামাযের জন্য জনগণের সমবেত হওয়া বা অতি প্রয়োজনীয় বিষয় শোনার সংকেত ছিলالصّلاة جامعة - এ বাক্য। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে একজন আহবানকারী একটি উঁচু স্থানে উঠে উচ্চকণ্ঠে এ বাক্য উচ্চারণ করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে জনগণ মসজিদে নববীতে সমবেত হন। মহানবী মিম্বারে আরোহণ করে ভাষণে বলেন : আল্লাহর শত্রুরা তোমাদের জন্য ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাদেরকে রাতের বেলা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। এ ফিতনা প্রতিহত করার জন্য একদল লোককে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে।” এ সময় একদল লোক এ কাজের জন্য মনোনীত হলেন এবং আবু বকরের ওপর সেনাদলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। তিনি সেনাদল নিয়ে বনী সালেম গোত্রের আবাসস্থলের দিকে রওয়ানা হলেন। মুসলিম বাহিনী যে পথ অতিক্রম করল, তা ছিল দুর্গম এবং এ গোত্র এক বিশাল উপত্যকার মাঝে বসবাস করত। মুসলিম সেনাবাহিনী যখন ঐ উপত্যকায় নেমে যেতে চাচ্ছিল, ঠিক তখন তারা বনী সালেম গোত্রের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং সেনাদলের অধিনায়ক যে পথে এসেছিলেন, সে পথে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেলেন না।৩২৫

আলী ইবনে ইবরাহীম লিখেছেন : ঐ সম্প্রদায়ের নেতারা হযরত আবু বকরকে এ সামরিক অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন : আমি মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে ইসলাম ধর্ম উপস্থাপন করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি; যদি আপনারা তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, তা হলে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।” ঐ সময় গোত্রের সর্দাররা তাঁর সামনে তাদের অগণিত লোক প্রদর্শন করে তাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে। তিনি ইসলামের মুজাহিদদের যুদ্ধ করার উদ্যম ও স্পৃহা থাকা সত্বেও ফিরে যাবার নির্দেশ দেন এবং সবাই তখন মদীনায় ফিরে যান।

ঐ অবস্থায় মুসলিম সেনাবাহিনীর (মদীনায়) প্রত্যাবর্তন মহানবী (সা.)-কে অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ করেছিল। এবার মহানবী সেনাদলটির নেতৃত্ব হযরত উমরের হাতে অর্পণ করেন। এ সময় শত্রুরা প্রথম বারের চেয়ে আরো বেশি সচেতন ছিল এবং তারা উপত্যকার প্রবেশমুখে পাথর ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। মুসলিম সেনাদল সেখানে প্রবেশ করা মাত্রই তারা তাদের গুপ্ত স্থানগুলো থেকে বের হয়ে এসে বীরত্বের সাথে লড়াই করতে লাগল। তখন সেনাদলটির অধিনায়ক তাঁর সৈন্যদের পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দিলে তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী আরবের ধূর্ত রাজনীতিজ্ঞ আমর ইবনে আস মহানবীর কাছে গিয়ে বলেছিলেন :الحرب خدعة যুদ্ধ হচ্ছে প্রতারণা”; যুদ্ধে বিজয় কেবল বীরত্ব, সাহস ও বাহুবলের মধ্যেই নিহিত নয়; বরং এর একটি অংশ পরিকল্পনা, কৌশল ও পরিচালনা করার দক্ষতার ওপরও নির্ভরশীল। আমি যদি এবার ইসলামের যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিই ও পরিচালনা করি, তা হলে আমি সমস্যার জট খুলতে পারব।” মহানবী (সা.) যদিও কতিপয় কারণে তাঁর অভিমতের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন, তবুও (তাঁকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে) পূর্ববর্তী সেনাপতিদ্বয়ের মতো তিনিও একই ভাগ্য বরণ করতেন।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) সেনা অধিনায়ক মনোনীত

একের পর এক পরাজয় ও বিফলতা মুসলমানদের নিদারুণ যন্ত্রণার সম্মুখীন করেছিল। মহানবী (সা.) শেষ বারের মতো একটি সেনাদল গঠন করে হযরত আলী (আ.)-কে এ বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করলেন এবং তাঁর হাতে পতাকা দিলেন। আলী (আ.) নিজ ঘরে প্রবেশ করে অত্যন্ত কঠিন মুহূর্তগুলোতে তিনি যে কাপড় মাথায় বাঁধতেন, তা মাথায় বাঁধলেন এবং স্ত্রী হযরত ফাতিমা (আ.)-কে তাঁর মাথায় তা বেঁধে দেয়ার অনুরোধ করলেন। মহানবী (সা.)-এর কন্যা তাঁর প্রিয় স্বামী অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ঙ্কর এক অভিযানে গমন করছেন দেখে খুব কাঁদলেন। মহানবী তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন এবং তাঁর চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিলেন। অতঃপর হযরত আলী (আ.)-এর সাথে আহযাবের মসজিদ পর্যন্ত গিয়ে বিদায় দিলেন। একটি সাদা-কালো বর্ণের ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে দু টি ইয়েমেনী বস্ত্র পরিধান করে এবং ভারতে নির্মিত বর্শা হাতে নিয়ে হযরত আলী (আ.) যাত্রা শুরু করলেন। তিনি তাঁর চলার পথ সম্পূর্ণ পরিবর্তন করলেন যাতে সৈন্যরা মনে করে যে, তিনি ইরাক অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন।أرسلته كرّارا غير فرّار আমি তাকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে যুদ্ধে প্রেরণ করলাম এ কারণে যে, সে হচ্ছে প্রচণ্ড আক্রমণকারী; সে কখনোই যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না’- এ কথা বলে মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বিদায় দিলেন। হযরত আলীর ব্যাপারে মহানবীর এ উক্তি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, পূর্ববর্তী অধিনায়কদ্বয় কেবল পরাজিত হন নি, বরং ইসলামের সামরিক নীতিমালার বিপরীতে তাঁরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন।

এ যুদ্ধে আমীরুল মুমিনীনের বিজয় ও সাফল্যের অন্তর্নিহিত কারণ

হযরত আলী (আ.)-এর বিজয় লাভের মূল কারণকে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে ব্যক্ত করা যায় :

১. তিনি শত্রুপক্ষকে তাঁর যাত্রার ব্যাপারে জানতে দেন নি। কারণ তিনি তাঁর যাত্রাপথ পরিবর্তন করেছিলেন যাতে মরুচারী বেদুইন এবং আশ-পাশের গোত্রগুলো শত্রুদের কাছে তাঁর অগ্রযাত্রার খবর পৌঁছাতে সক্ষম না হয়।

২. তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশল অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষার মূলনীতি পূর্ণরূপে পালন করেছিলেন। তিনি রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনের বেলা কোন স্থানে লুকিয়ে থাকতেন এবং বিশ্রাম নিতেন। উপত্যকার প্রবেশমুখে পৌঁছার আগেই তিনি তাঁর সকল সৈন্যকে বিশ্রাম নেয়ার নির্দেশ দেন। যাতে শত্রুপক্ষ উপত্যকার নিকটে তাঁদের আগমনের কথা জানতে না পারে, সেজন্য তিনি নির্দেশ দেন, সৈন্যরা যেন তাদের ঘোড়াগুলোর মুখ বেঁধে রাখে। এর ফলে শত্রুপক্ষ হ্রেষাধ্বনি শুনতে পারবে না। হযরত আলী (আ.) সাথীদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করেন এবং সৈন্যদের পাহাড়ের পেছন থেকে পাহাড়ের চূড়ায় এবং সেখান থেকে উপত্যকার ভেতরের দিকে পরিচালনা করেন। শক্তিশালী ও সাহসী মুসলিম সৈনিকগণ একজন সাহসী ও বীর সেনাধিনায়কের নেতৃত্বে বিদ্যুৎ গতিতে ঘুমন্ত ও নিদ্রালু শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একদলকে বন্দী করেন; আরেকটি দল প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে।

৩. আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর অসাধারণ ও অতুলনীয় বীরত্ব : যে সাত জন শত্রুপক্ষীয় বীর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তিনি তাদেরকে ধরাশায়ী করেছিলেন। তিনি শত্রুদের এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন যে, তারা তাদের প্রতিরোধ-ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং প্রচুর গনীমত রেখে পলায়ন করেছিল।৩২৬

ইসলামের অমিত বীর সেনাপতি অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে পবিত্র মদীনায় ফিরে এলেন। মহানবী (সা.) একদল সাহাবীকে সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মহানবীকে দেখে তৎক্ষণাৎ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। তিনি হযরত আলীর পিঠ চাপড়ে বললেন : তুমি তোমার অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ কর; মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।” এ সময় আলীর দু চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে গিয়েছিল এবং মহানবী হযরত আলীর ব্যাপারে তাঁর ঐতিহাসিক এ উক্তি করেছিলেন :

يا علىّ لولا أنّنِى أشفق أن تقول فيك طوائف من أمّتِى ما قالت النّصاري فِى المسيح لقلت فيك اليوم مقالا لا تمرّ بملاء من النّاس إلّا أخذوا التّراب من تحت قدميك

হে আলী! হযরত ঈসা মসীহের ব্যাপারে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যা বলেছে, আমি যদি আমার উম্মতের মধ্য থেকে কিছু লোক কর্তৃক তোমার ব্যাপারে সেই একই কথা বলার আশংকা না করতাম, তা হলে আমি আজ তোমার ব্যাপারে এমন কথা বলতাম যে, এর ফলে তুমি যেখান দিয়ে যেতে, লোকেরা সেখানে তোমার পায়ের তলা থেকে (বরকত লাভের জন্য) মাটি তুলে নিত।

এ ধরনের আত্মত্যাগ এতটা গুরুত্ববহ ছিল যে, এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা আল আদিয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। এ সূরার অভিনব ও আবেগময় শপথসমূহ এ ঘটনার কুরবানীকারী সৈনিকগণের সামরিক মনোবল ও বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেই উল্লিখিত হয়েছে :

) و العاديات ضبحاً فالموريات قدحاً فالمغيرات صبحاً فأثرن به نقعاً فوسطن به جمعاً(

“ঐসব ধাবমান অশ্বের শপথ! যেগুলো নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হয় এবং পাথরের উপর যেগুলোর খুরাঘাতে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বের হয় ; ভোরের বেলা যেগুলো বিদ্যুৎ চমকানির মতো শত্রুর ওপর আক্রমণ চালায়, দ্রুত গতিতে ধাবমান হওয়ার জন্য বাতাসে ধূলো-মাটি উড়িয়ে দেয় এবং শত্রুদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।”

একটি জিজ্ঞাসার জবাব

তেল শিল্প জাতীয়করণের বছরগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের চরেরা মার্ক্সবাদ ও নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণা প্রচারের জন্য ময়দান যে কোন ধরনের প্রতিন্ধকতা থেকে মুক্ত দেখতে পেয়ে কখনো কখনো ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে আপত্তি করার জন্য মুখ খুলত এবং সমালোচনা করত। একদিন তাদের এক সদস্য আমাকে (লেখক) সূরা আল আদিয়াতের আয়াতসমূহে যে সব শপথ (কসম) রয়েছে, সেসবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। তার প্রশ্ন করার বাচনভঙ্গি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, তার দৃষ্টিতে এসব শপথ গুরুত্বহীন। এ কারণেই সে এ প্রশ্ন করার সময় ঠোঁট বাঁকা করে মাথা নাড়িয়ে বলছিল : যে সব অশ্ব হাঁপাচ্ছে, টানা টানা শ্বাস নিচ্ছে এবং পাথরের ওপর যেগুলোর খুরাঘাতে বিদ্যুৎ¯ফুলিঙ্গ ঠিকরে বের হচ্ছে, সেগুলোর নামে শপথ করার কী অর্থ থাকতে পারে? আমি তার এ প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম :“‘ যুদ্ধরত যোদ্ধাদের অশ্বসমূহের শপথ’ অথবা অশ্বসমূহের খুর ও পাথরের মাঝখান থেকে ঠিকরে বের হওয়া বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের শপথ’ আসলে যালেমদের বিরুদ্ধে জিহাদের গুরুত্বকে চিত্রায়িত করে। এই সংগ্রামরত সেনাবাহিনী কেবল কল্যাণপ্রসূ ও মূল্যবানই নয়, বরং তাদের অশ্বগুলো এবং সেগুলোর খুরের তল থেকে ঠিকরে বের হওয়া বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গও পবিত্র; এসব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে মুজাহিদগণ কর্তৃক যালেমদের কোমর ভেঙে দেয়া এবং মানব জাতিকে আগ্রাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার চেয়ে আর কোন্ মূল্যবোধ অধিকতর মহান হবে?

পবিত্র কুরআন এভাবে অর্থাৎ মুজাহিদগণের ঘোড়াগুলো, এগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এবং এগুলোর খুর থেকে নির্গত অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহকে পবিত্র গণ্য করার মাধ্যমে মুমিনদেরকে যে সব লৌহপ্রাচীরের ভেতর জাতিসমূহ বন্দী হয়ে আছে, সেগুলো গুঁড়িয়ে ফেলার জন্য শক্তি সঞ্চয় করার আহবান জানিয়েছে।

মুক্তিদানকারী গোষ্ঠী কেবল নিজেরাই পবিত্র নয়; বরং তাদের অশ্বগুলো, সেগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এবং সেগুলোর খুর থেকে নির্গত অগ্নিস্ফুলিঙ্গও মর্যাদার অধিকারী এবং আজ ঐ অশ্বগুলো দ্রুতগামী মোটরযান এবং অশ্বগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যুদ্ধবিমানের গর্জনকারী শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে এবং মহানবী (সা.)-এর রিসালাতের যুগের হাতিয়ার ও উপায়-উপকরণসমূহের ন্যায় সেগুলোকে পবিত্র ও মর্যাদার আলোকবর্তিকা আচ্ছাদিত করে রেখেছে।৩২৭

এটি ছিল সংক্ষেপে যাতুস্ সালাসিলের গাযওয়ার ঘটনা যা শিয়া মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ সহীহ সনদ ও সূত্রে সংরক্ষণ করেছেন। তবে আহলে সুন্নাতের ঐতিহাসিকগণ, যেমন তাবারী৩২৮ যাতুস্ সালাসিলের ঘটনা ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন এবং আমরা যা এখানে বর্ণনা করেছি, তার সাথে এ ঘটনার বেশ পার্থক্য আছে। যাতুস্ সালাসিল দু টি যুদ্ধেরও নাম হতে পারে, যেগুলোর প্রতিটি শিয়া-সুন্নী মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ কর্তৃক স্বতন্ত্রভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে উভয় পক্ষ একটি ঘটনাই বর্ণনা করেছেন এবং অপর ঘটনা বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছেন।

ঊনপঞ্চাশতম অধ্যায় : অষ্টম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

ইসলামের মুবাল্লিগগণের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড

আদাল (عضل ) ও কারা (قاره ) গোত্রের একদল প্রতিনিধি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলে : হে রাসূলাল্লাহ্! আমাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে এবং আমাদের সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আপনি দয়া করে আপনার একদল সাহাবীকে প্রেরণ করুন তাঁরা আমাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবেন,আমাদেরকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবেন এবং মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত হালাল ও হারাম সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবেন। 75

মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব ছিল এই যে,কতিপয় বড় গোত্রের প্রতিনিধি এ দলটির আহবানে সাড়া দেবেন। আর মুসলমানদেরও দায়িত্ব ছিল যে কোন কিছুর বিনিময়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। এ কারণে মহানবী (সা.) মুরসেদ নামক এক সাহাবীর অধিনায়কত্বে একটি দলকে গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে উল্লিখিত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তাঁরা গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে মদীনা এবং মুসলমানদের শক্তি ও কর্তৃত্বের আওতার বাইরে চলে যান এবং রাযী নামক এক পানির উৎসের স্থানে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে গোত্রীয় প্রতিনিধিরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তারা হুজাইল গোত্রের সাহায্য নিয়ে মদীনা থেকে প্রেরিত লোকদের বন্দী ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঐ অঞ্চলে মুসলমানরা (মদীনা থেকে প্রেরিত মুবাল্লিগ) যখন শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন,তখন তরবারি ছাড়া তাঁদের আর কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। এ কারণে তরবারির বাঁট শক্ত করে হাতে ধরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য তাঁরা তৈরি হয়ে যান। কিন্তু শত্রুপক্ষ শপথ করে বলে : তোমাদের বন্দী করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো তোমাদের জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে কুরাইশ নেতাদের হাতে তুলে দেয়া এবং তার বিনিময়ে কিছু অর্থ লাভ করা।

মুসলিম মুবাল্লিগগণ একে অপরের দিকে তাকালেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সিদ্ধান্ত নিলেন,তাঁরা লড়াই করবেন। তাঁরা বললেন : আমরা মূর্তিপূজারী ও মুশরিকদের কোন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করব না। অতঃপর তাঁরা তরবারি কোষমুক্ত করেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় ও মহানবী (সা.)-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত লাভ করেন। কিন্তু যাইদ ইবনে দাসিনাহ্,খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ্ তরবারি কোষবদ্ধ করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অর্ধেক পথে এসে আবদুল্লাহ্ আত্মসমর্পণ করার কারণে অনুতপ্ত হন। তিনি হাতের বাঁধন খুলে ফেলেন এবং তরবারি কোষমুক্ত করে শত্রুর ওপর আক্রমণ করেন। শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করে এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে ধরাশায়ী করে। তারা তাঁর দিকে এত বেশি পাথর নিক্ষেপ করে যে,তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই প্রাণ হারান। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু অপর দুই বন্দীকে মক্কার কাফেরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বিনিময়ে মুসলমানদের যারা বন্দী করেছিল তাদের দুই বন্দীকে কুরাইশরা মুক্তি দেয়।

সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা,যার পিতা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল,বন্দী যাইদকে ক্রয় করে যাতে একজন ইসলাম প্রচারককে হত্যার মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে,এক বিশাল জনতার সামনে যাইদকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। তানঈমে76 ফাঁসিকাষ্ঠ টানানো হয়।

কুরাইশরা ও তাদের মিত্ররা নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে সমবেত হয়। তার মৃত্যুর জন্য কয়েক মুহূর্তের বেশি বাকী ছিল না।

মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ান সকল ঘটনায় নিজে দূরে থেকে নেপথ্যে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। আবু সুফিয়ান এবার যাইদকে লক্ষ্য করে বলে : তুমি যে আল্লাহকে বিশ্বাস করো,তার শপথ দিয়ে বলছি-আমাকে বলো,তুমি কি চাও যে,মুহাম্মদ তোমার পরিবর্তে নিহত হোক? তা হলে তুমি মুক্তি পাবে এবং নিজ ঘরে ফিরে যাবে।

যাইদ পূর্ণ সাহসিকতার সাথে বললেন :  আমি কখনো রাজি হব না যে,মহানবী (সা.)-এর পায়ে কোন কাঁটা বিদ্ধ হোক,যদিও তার বিনিময়ে আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

যাইদের বলিষ্ঠ জবাব আবু সুফিয়ানকে বিব্রত করে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীগণের ভালোবাসার আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে সে মন্তব্য করে : আমার দীর্ঘ জীবনে মুহাম্মদের সাথীদের মতো আর কারো সাথী দেখি নি,যারা এত বেশি ত্যাগী হতে পারে,এত অধিক ভালোবাসা পোষণ করতে পারে!

কিছুক্ষণের মধ্যেই যাইদকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। তাঁর প্রাণপাখি উড়ে যায় ঊর্ধ্বলোকের পানে। সত্য ও ন্যায়ের সীমান্ত রক্ষায়,ইসলামের সত্য বাণী প্রচারের লক্ষ্যে এঁরা শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি খুবাইব দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থায় কাটান। মক্কার পরামর্শসভা সিদ্ধান্ত নেয়,তাঁকেও তানঈম-এ ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হবে।77

খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের পাশে মক্কার নেতা ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দু রাকাত নামায আদায়ের অনুমতি গ্রহণ করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে দু রাকাত নামায আদায় করেন এবং কুরাইশ নেতাদের লক্ষ্য করে বলেন : আমি মৃত্যুকে ভয় করি বলে তোমাদের ধারণা হতে পারে-এ সন্দেহ যদি না হতো,তা হলে এর চেয়ে বেশি নামায পড়তাম।78 নামাযের রূকূ ও সিজদা দীর্ঘ করতাম। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আপনার নবীর পক্ষ হতে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা আমরা পালন করেছি। ঐ মুহূর্তে হত্যার আদেশ জারি করা হয়। খুবাইবকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়। খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের ওপর বলতে লাগলেন : হে আল্লাহ্! আপনি জানেন,আমার একজন বন্ধুও আশেপাশে নেই,যে আমার সালাম মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেবে। হে আল্লাহ্! আপনিই আমার সালাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিন।

হয় তো এই আধ্যাত্মিক পুরুষের ধর্মীয় আবেগ আবু উকবার সহ্য হচ্ছিল না। সে দাঁড়িয়ে খুবাইবের ওপর এক শক্ত আঘাত হানে এবং তাঁকে শহীদ করে।

ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী79 খুবাইব প্রাণত্যাগের পূর্বক্ষণে শূলির উপর এ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

فوالله ما أرجو اذا مت مسلما

علي اى جنب كان فى الله مصرعى

وذلك فِى ذات االله و ان يشأ

يبـارك علي اوصـال شلـومـمزع

মহান আল্লাহর শপথ! যদি মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করি,

তা হলে কোন্ এলাকায় আমাকে দাফন করা হবে,তা নিয়ে চিন্তা করি না।

আমার এই হৃদয়বিদারক মৃত্যু আল্লাহর পথে,তিনি যদি চান,

এ শাহাদাত আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মুবারক করে দেবেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহানবী (সা.)-কে দারুণভাবে মর্মাহত করে এবং মুসলমানদের গভীর শোকে নিমজ্জিত করে। মুসলমানদের মহান কবি হাস্সান ইবনে সাবিত এ উপলক্ষে মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেন যা ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

রাসূল (সা.) এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন,এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এর ফলে বহু কষ্টে প্রশিক্ষিত ইসলাম প্রচারের বীর সেনানীর উপর অপূরণীয় আঘাত আসতে পারে। কুৎসিত অন্তরের ইতর লোকেরা পূত চরিত্রের ধর্মপ্রচারকগণের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যেতে পারে।

এই বীর মুজাহিদের লাশ বহু দিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলন্ত ছিল। একদল লোক লাশ পাহারা দিত। অবশেষে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে দু জন দুঃসাহসী মুসলমান রাতের বেলা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাঁর লাশ নামিয়ে আনেন এবং দাফন করেন।80

বীরে মাউনার ঘটনা

হিজরী চতুর্থ সালের সফর মাসে রাযী নামক স্থানে ইসলামের কৃতি সন্তানদের শাহাদাতের খবর মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছার আগে আবু বাররা আমেরী মদীনায় আগমন করে। মহানবী (সা.) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত কবুল করল না। তবে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে আরয করল,যদি তিনি শক্তিশালী কোন ধর্ম প্রচারকারী দলকে নাজদ এলাকায় প্রেরণ করেন,তা হলে তাদের ঈমান আনার আশা করা যায়। কেননা তাওহীদের প্রতি তাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। মহানবী (সা.) বললেন : নাজদবাসীদের প্রতারণা ও শত্রুতাকে আমি ভয় পাই। আবু বাররা বলল : আপনার প্রেরিত ব্যক্তিবর্গ আমার আশ্রয়ে থাকবেন। আমিই নিশ্চয়তা দিচ্ছি,আমি তাদেরকে যে কোন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করব।

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে চল্লিশ জন ইসলাম ধর্ম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব,মুনযির-এর নেতৃত্বে নাজদের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁদের সবাই ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেয ও ধর্মীয় বিধানে পারদর্শী। তাঁরা বীরে মাউনার (মাউনার কূপ) কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি করেন। মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একখানা পত্র নাজদ গোত্রীয় নেতা আমর ইবনে তুফাইলের উদ্দেশে লিখেছিলেন। তাঁর পত্র আমেরের কাছে পৌঁছানোর জন্য একজন মুসলমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমের শুধু যে মহানবী (সা.)-এর চিঠিখানা পড়ে নি,তা নয়;বরং পত্রবাহককেও হত্যা করে। এরপর সে তার গোত্রের লোকদের ইসলাম প্রচারকগণকে হত্যা করার আহবান জানায়। গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে এবং বলে,গোত্রের মুরব্বী আবু বাররা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজ গোত্রের লোকদের সাহায্যের ব্যাপারে সে নিরাশ হয় এবং আশেপাশের গোত্র ও সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চায়। এভাবে ইসলামের মুবাল্লিগগণের অবস্থানস্থলটি আমেরের লোকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়।

ইসলামের প্রচারকারীরা শুধু যে বড় জ্ঞানী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন,তা-ই নয়;বরং বীর যোদ্ধাও ছিলেন। তাঁরা আত্মসমর্পণকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করেন এবং তরবারি হাতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু কা ব ইবনে যাইদ আহত শরীর নিয়ে কোনমতে মদীনা পৌঁছেন এবং ঘটনাটি মহানবীকে অবহিত করেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা গোটা ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের দারুণভাবে মর্মাহত করে। মহানবী (সা.) বহু দিন ধরে বীরে মাউনার স্মরণ করতেন।81

এ দু টি ঘটনাই ছিল উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কেননা এর ফলে মুসলমানদের হত্যার জন্য আশেপাশের গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল।

প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান

প্রাচ্যবিদরা যেখানে কোন মুশরিকের মুখে সামান্য আঁচড় লাগলেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর মারমুখী হয়ে যান,আর জোর করে এ কথা বলার চেষ্টা করেন যে,ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে,তাঁরা এই বেদনাদায়ক দু টি ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেন নি।

বিশ্বের কোথায় আছে যে,জ্ঞানের ঝাণ্ডাবাহীদের হত্যা করা হয়? ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়ে থাকলে এই মিশনারী দলগুলো কেন প্রাণকে হাতের তালুতে রেখে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন এবং শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেছেন?

এ দু টি ঘটনার অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে। তাঁদের ঈমানের শক্তি,আত্মত্যাগ,জান বাজি রেখে যুদ্ধ ও সাহসিকতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়,বিস্ময়কর এবং মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস।

মুমিন কখনো একবারের বেশি প্রতারিত হয় না

রাযী ও বীরে মাউনার হৃদয়বিদারক ঘটনায় ইসলামের বহু মুবাল্লিগ শহীদ হওয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে দারুণ মর্মবেদনার সৃষ্টি হয়। এক অস্বাভাবিক ধরনের বিষাদ মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখানে এসে পাঠকদের মনে হয় তো প্রশ্ন জাগবে,মহানবী (সা.) কেন এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? প্রথম ঘটনায় অর্থাৎ রাযীর নিকটে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে,তারপরও অপর চল্লিশ ব্যক্তিকে তিনি কেন বীরে মাউনায় পাঠালেন? মহানবী (সা.) কি নিজেই বলেন নি : لا يلدغ المؤمن من جُحر مرّتين মুমিন (সর্পের) এক গর্ত হতে দু বার দংশিত হয় না।

এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেননা ইসলাম প্রচারকারী দলটি আবু বাররার গোত্রের হাতে শহীদ হন নি। যদিও তার ভাতিজা আমের ইবনে তুফাইল আবু বাররার গোত্র-যা তার নিজেরও গোত্র-ইসলাম প্রচারকদের হত্যার জন্য প্ররোচিত করছিল,কিন্তু ঐ গোত্রের একজনও তার কথায় সায় দেয় নি। সবাই বলেছিল : তোমার চাচা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমের ইবনে তুফাইল পার্শ্ববর্তী ভিন্ন গোত্র সালীম যাকওয়ান -এর কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং ইসলাম প্রচারকগণকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইসলামের প্রচার সৈনিকরা আবু বাররার এলাকার উদ্দেশে গমনকালে নিজেদের মধ্য থেকে আমর ইবনে উমাইয়্যা ও হারিস ইবনে সিম্মাহকে82 তাঁদের উটগুলো চরানো ও দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁরা তাঁদের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় হঠাৎ আমের ইবনে তুফাইল তাঁদের ওপর চড়াও হয়। ফলে হারিস ইবনে সিম্মাহ্ নিহত হন এবং আমর ইবনে উমাইয়্যাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমর ইবনে উমাইয়্যা মদীনায় ফিরে আসার সময় দু জন লোকের সাক্ষাৎ পান। তিনি নিশ্চিত হন,তারা সেই গোত্রের লোক যারা দীনের মুবাল্লিগগণকে হত্যা করেছে। এ কারণে তিনি উভয়কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন।

তাঁর এ কাজটি ভুল ধারণার কারণে হয়েছিল। কেননা তারা আবু বাররার (বনী আমের) গোত্রের লোক ছিল,যারা আপন গোত্রপতির প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের দলের ওপর হামলা চালাতে রাযী হয় নি।

এ ঘটনার ফলেও মহানবী (সা.)-এর মর্মবেদনা বৃদ্ধি পায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন,ঐ দু জনের রক্তমূল্য তিনি পরিশোধ করবেন।

তবে এ ব্যাপারে তাবাকাতে ইবনে সা দ-এর83 প্রণেতা স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন,উভয় দলের পরিণতির খবর একই রাতে মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছায়। দ্বিতীয় দলটি পাঠানোর সময় মহানবী (সা.) রাযীর শহীদদের ভাগ্যে কী ঘটেছে,তা জানতেন না।

চৌত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বনী নাযীরের যুদ্ধ

মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীরা উহুদে মুসলমানদের পরাজয় এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণের নিহত হবার ঘটনায় দারুণ খুশী হয়েছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল,মদীনায় কোন বিদ্রোহ ঘটাবে। এর মাধ্যমে মদীনার বাইরের গোত্রগুলোকে বোঝাবে যে,মদীনায় ন্যূনতম ঐক্য ও সংহতি বিদ্যমান নেই। কাজেই বহিঃশক্তি এসে ইসলামের নব্য প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করতে পারবে।

মহানবী (সা.) বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদের উদ্দেশ্য ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য একদল সৈনিকসহ তাদের দুর্গের দিকে গমন করেন। কিন্তু বনী নাযীরের সাথে যোগাযোগের পেছনে মহানবীর দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছিল আমর ইবনে উমাইয়্যার হাতে নিহত বনী আমের গোত্রের দুই আরবের রক্তমূল্য পরিশোধে তাদের সহায়তা নেয়া। কেননা বনী নাযীর গোত্র মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ওদিকে বনী আমেরের সাথেও তাদের মৈত্রীচুক্তি ছিল। চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলো সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

মহানবী (সা.) দুর্গের প্রবেশদ্বারে অবতরণ করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যের কথা গোত্রীয় প্রধানদের কাছে তুলে ধরেন। তারা দৃশ্যত খোলা মনে মহানবীকে অভ্যর্থনা জানায় এবং কথা দেয়,রক্তমূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারা তাঁকে সাহায্য করবে। তারা মহানবীকে তাঁর ডাকনাম আবুল কাসেম -এ সম্বোধন করে অনুরোধ করতে থাকে : আপনি আমাদের দুর্গে প্রবেশ করুন এবং একটি দিন এখানে অবস্থান করুন। রাসূল তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন না;বরং দুর্গের দেয়ালের ছায়ায় সাথী ও সৈনিকগণ সহ বসেন এবং বনী নাযীর গোত্রের সর্দারদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন।84

মহানবী (সা.) উপলব্ধি করেন,তাদের মিষ্টি মিষ্টি কথার সাথে এক ধরনের সংশয়পূর্ণ রহস্যজনক তৎপরতা মিশে আছে। অন্যদিকে তিনি যেখানে বসে ছিলেন,সেখানে লোকজনের আনাগোনা বেশি করে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কানে কানে কথাবার্তা বেশি হচ্ছিল,যা থেকে সহজেই সন্দেহ জাগে। মূলত বনী নাযীরের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,মহানবীকে অতর্কিত আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। তাদের একজন আমর হাজ্জাশ প্রস্তুতি নিয়েছিল,সে ছাদের উপর যাবে এবং মহানবী (সা.)-এর উপর একটি পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করবে।

সৌভাগ্যজনকভাবে তাদের নীল-নকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের সন্দেহপূর্ণ ও অসংলগ্ন আচরণ থেকে তাদের চক্রান্ত আঁচ করা যাচ্ছিল। আল ওয়াকিদীর বর্ণনা অনুযায়ী ওহীর ফেরেশতা মহানবীকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে সরে বসেন এবং এমনভাবে মজলিস ছেড়ে উঠে যান যে,ইহুদীরা মনে করল,কোন কাজে তিনি বাইরে যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু রাসূল (সা.) মদীনার পথ ধরে অগ্রসর হন। তাঁর সাহাবীগণকেও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানালেন না। তাঁরা তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু তাঁরা যতই অপেক্ষা করুন,তাতে কোন ফল হলো না।

বনী নাযীরের ইহুদীরা দারুণ দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেল। তারা একদিকে ধারণা করছিল যে,মহানবী (সা.) তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছেন। তা-ই যদি হয়,তবে তাদের বড় ধরনের শাস্তি পেতে হবে। অপরদিকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল : মহানবী যেহেতু এখন আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছেন,তার প্রতিশোধ আমরা তার সাথীদের কাছ থেকেই নিই। তবে সাথে সাথে বলছিল যে,এ অবস্থায় পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে যাবে এবং মহানবী (সা.) নিঃসন্দেহে আমাদের কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেবেন।

এহেন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর সাথে যাঁরা এসেছিলেন,তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন,মহানবীর খোঁজে তাঁরা যাবেন এবং তিনি কোথায় আছেন,তা সন্ধান করবেন। দুর্গের প্রাচীর থেকে বেশি দূরে যেতে না যেতেই তাঁরা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান,যিনি মদীনা থেকে আসছিলেন। তিনি মহানবীর মদীনা প্রবেশের সংবাদ নিয়ে আসেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ মহানবীর নিকট উপস্থিত হন। সেখানেই তাঁরা ইহুদীদের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন,যা ওহীর ফেরেশতা জিবরীল (আ.) তাঁকে জানিয়েছিলেন।85

এ জঘন্য অপরাধ মোকাবেলায় করণীয়

এখন এ বিশ্বাসঘাতকদের ব্যাপারে মহানবীর করণীয় কি? এরাই সেই সম্প্রদায় যারা ইসলামী হুকুমতের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল। ইসলামের সৈনিকরা তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করছিলেন। জীবনভর তারা মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বচক্ষে দেখছিল। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে শেষ নবীর সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য ও প্রমাণ দেখতে পেয়েছে;অথচ তাঁকে আতিথেয়তার পরিবর্তে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছে। অত্যন্ত কাপুরুষোচিত পন্থায় তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে।

এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের দাবী কী? এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরূপ বিশ্বাসঘাতকতার মূলোৎপাটন করা হয়,তার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) গৃহীত পদ্ধতি ছিল যুক্তিসঙ্গত। গোটা সেনাবাহিনীতে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমা আউসীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দেন,অতি সত্বর তাঁর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত হুকুম যেন বনী নাযীরের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি বনী নাযীরের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বললেন : ইসলামের মহান নবী আমার মাধ্যমে তোমাদের কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছেন যে,দশ দিনের মধ্যে অবশ্যই তোমরা এই ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাবে। কেননা তোমরা চুক্তিভঙ্গ করেছ,প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ। যদি দশ দিনের মধ্যে এ এলাকা ত্যাগ না কর,তা হলে তোমাদের রক্ত প্রবাহিত করা হবে।

এ বার্তা ইহুদীদের মধ্যে মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যেকে এ ষড়যন্ত্রের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে। তাদের জনৈক নেতা সবাইকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব করে। কিন্তু অধিকাংশের গোয়ার্তুমী এ প্রস্তাব গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চরম অসহায়ত্ব তাদের ঘিরে ধরে। নিরুপায় হয়ে মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমার উদ্দেশে বলে : হে মুহাম্মদ! আপনি আউস গোত্রের লোক। মহানবীর আগমনের পূর্বে আউস গোত্রের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল। এখন কেন আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন?”   তিনি পূর্ণ সৎ সাহস ও বলিষ্ঠতা সহকারে বললেন : সেদিন পার হয়ে গেছে। এখন মানুষের মন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এ সিদ্ধান্ত সেই চুক্তির আওতায় নেয়া হয়,যে চুক্তি মহানবীর মদীনা আগমনের প্রথম দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে সম্পাদন করেছিলেন। ঐ চুক্তিতে বনী নাযীর গোত্রের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির বিষয়বস্তু আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে : মহানবী তিন গোত্রের সাথেই (বনী নাযীর,বনী কাইনুকা ও বনী কুরাইযাহ্) চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন,তারা কখনো রাসূলুল্লাহ্ ও তাঁর সাহাবীগণের ক্ষতি করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেবে না;মুখে বা হাতে তাঁদের কোন ক্ষতি করবে না।... যদি ঐ তিন গোত্রের কোন একটি চুক্তির বিষয়বস্তুর বিরোধী আচরণ করে,তা হলে তাদের রক্তপাত ঘটানো,সম্পদ বাজেয়াফ্ত করা এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী করার অধিকার মহানবীর থাকবে।86

কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন

প্রাচ্যবিদদের দেখা যায়,এখানে এসে তাঁরা পুনরায় কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন শুরু করে দেন। তাঁরা মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের মতো বনী নাযীর গোত্রের বিশ্বাসঘাতক,চুক্তিভঙ্গকারী ইহুদীদের জন্য যারপর নাই অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা মহানবীর কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তাদের এ মায়াকান্না ও সমালোচনা সত্য উদ্ঘাটন বা প্রকৃত বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে নয়। কেননা সম্মানিত পাঠকবর্গ ইহুদীদের সাথে মহানবীর চুক্তির যে বিবরণ পাঠ করেছেন,তাতে এ মতটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে,মহানবী তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তা চুক্তিপত্রে উল্লিখিত শাস্তির চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক লঘু। আজকের দিনে এসব প্রাচ্যবিদের প্রভুদের পক্ষ থেকে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে কত জঘন্য অপরাধ করা হচ্ছে,অথচ এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্য হতে একজনও সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) যখন মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতককে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লিখিত শাস্তির চেয়েও কম শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তখন কতিপয় লেখক সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন। অথচ এসব লেখক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ জাতীয় ঘটনাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন।


9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53