চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84013 / ডাউনলোড: 7997
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

মক্কা বিজয়

মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসের সুপাঠ্য ও আকর্ষণীয় অধ্যায়সমূহের অন্তর্ভুক্ত, আবার একই সাথে তা শিক্ষণীয় এবং তা মহানবী (সা.)-এর পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ এবং তাঁর মহান চরিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ইতিহাসের এ অধ্যায়ে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যে সব বিষয় সম্পর্কে স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেসবের প্রতি মহানবী (সা.) এবং তাঁর অনুসারীগণের বিশ্বস্ততা স্পষ্ট হয়ে যায়, আর এর বিপরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রের ধারাসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কুরাইশ বংশীয় মুশরিকদের কপটতা ও বিশ্বাসঘাতকতাও পরিষ্কার হয়ে যায়।

ইতিহাসের এ অধ্যায় অধ্যয়ন ও মূল্যায়ন করলে শত্রুর সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি জয় করার ক্ষেত্রে মহানবীর দক্ষতা, পরিকল্পনা, কর্মকৌশল এবং বিজ্ঞজনোচিত রাজনীতি প্রমাণিত হয়ে যায়। এমন প্রতীয়মান হয় যে, এ পবিত্র ব্যক্তিত্ব তাঁর জীবনের একটি অংশ এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন এবং একজন চৌকস সমরাধিনায়কের মতো বিজয়-পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করেছেন, যাতে মুসলমানরা অনায়াসে সর্ববৃহৎ বিজয় অর্জন করেছিল।

অবশেষে এ অধ্যায়ে রক্তপিপাসু শত্রুদের জীবন ও ধন-সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে মহানবীর মানব দরদী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। এ মহামানব বিশেষ বিচক্ষতা দিয়ে এ মহান বিজয় অর্জিত হবার পর কুরাইশদের যাবতীয় অপরাধ উপেক্ষা করেন এবং সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন।

হিজরতের ষষ্ঠ বর্ষে কুরাইশ নেতৃবর্গ ও মহানবী (সা.)-এর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির তৃতীয় ধারা মোতাবেক মুসলমান ও কুরাইশরা যে কোন গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তি করতে পারবেন। এ ধারার ভিত্তিতে খুযাআহ্ গোত্র মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং মহানবী তাদের জীবন, ধন-সম্পদ এবং ভূ-খণ্ড রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর বনী কিনানাহ্ গোত্র, যারা খুযাআহ্ গোত্রের পুরানো শত্রু এবং প্রতিবেশী ছিল, কুরাইশ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এ ঘটনাপ্রবাহ একটি দশ-সালা চুক্তি- যা আরব উপদ্বীপের সমুদয় অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা ও সর্বসাধারণের শান্তি সংরক্ষণকারী ছিল,- সম্পাদিত হবার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

এ চুক্তি মোতাবেক উভয় পক্ষ (কুরাইশ ও মুসলমানরা) একে অপরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করবেন না অথবা তাদের নিজ নিজ মিত্রকে প্রতিপক্ষের মিত্রদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করবেন না এবং উস্কানী দেবেন না। এ চুক্তি সম্পাদন করার পর থেকে দু বছর গত হয় এবং উভয় পক্ষ নিরাপত্তার সাথে ও সুখ-শান্তিতে বসবাস করছিলেন। এর ফলে মুসলমানগণ হিজরতের সপ্তম বর্ষে পূর্ণ স্বাধীনতা সহ পবিত্র বাইতুল্লাহ্ শরীফ যিয়ারতের জন্য পবিত্র মক্কা নগরী গমন করেন এবং হাজার হাজার মূর্তিপূজারী মুশরিক শত্রুর চোখের সামনে নিজেদের ইসলামী দায়িত্ব ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আঞ্জাম দেন ।

অসহায় মুসলিম প্রচারকগণকে রোম সাম্রাজ্যের যে সব চর কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করেছিল, তাদেরকে দমন ও কঠোর শাস্তি প্রদান করার জন্য হিজরতের অষ্টম বর্ষের জমাদিউল আওয়াল মাসে মহানবী তিন জন ঊর্দ্ধতন মুসলিম সমরাধিনায়কের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী শামের সীমান্ত অঞ্চলসমূহে প্রেরণ করেন। মুসলিম সেনাবাহিনী এ সমরাভিযান থেকে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছিল এবং মাত্র তিন জন অধিনায়ক ও কয়েকজন সৈন্য ছাড়া এ বাহিনীর আর কোন ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে নি। তবে ইসলামের মুজাহিদগণের কাছ থেকে যে সামরিক সাফল্যের আশা করা হয়েছিল, তা অর্জন ছাড়াই এ সেনাদল মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেছিল এবং তাদের এ অভিযানের বেশিরভাগই আঘাত কর ও পালাও’ এ কৌশল সদৃশ ছিল। কুরাইশ গোত্রপতিদের মাঝে এ সংবাদ প্রচারিত হবার কারণে তাদের সাহস বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা ভাবল, ইসলামের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে গেছে এবং মুসলমানরা লড়াই করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা (বিরাজমান) শান্ত পরিবেশ নষ্ট করে দেবে। প্রথমে তারা বনী বকর গোত্রের৩২৯ মাঝে অস্ত্র বিতরণ করে এবং তাদেরকে মুসলমানদের মিত্র খুযাআহ্ গোত্রের ওপর রাতের আঁধারে আক্রমণ করে তাদের একাংশকে হত্যা ও আরেক অংশকে বন্দী করার জন্য প্ররোচিত করে। এমনকি তারা এতটুকুতেও সন্তুষ্ট থাকে নি। একদল কুরাইশ রাতের বেলা খুযাআহ্ গোত্রের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আর এভাবে তারা হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে দু বছর ধরে বিরাজমান শান্ত অবস্থাকে যুদ্ধ ও রক্তপাতে রূপান্তরিত করেছিল।

রাতের বেলা অতর্কিত এ হামলায় খুযাআহ্ গোত্রের ঘুমন্ত বা ইবাদত-বন্দেগীরত একাংশ নিহত এবং আরেক অংশ বন্দী হয়েছিলেন। খুযাআহ্ গোত্রের একদল লোক নিজেদের ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে আরবদের কাছে নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে বিবেচিত পবিত্র মক্কা নগরীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। পবিত্র মক্কায় আসা শরণার্থীরা বুদাইল ইবনে ওয়ারকা৩৩০ -এর ঘরে গিয়ে নিজ গোত্রের হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন।

খুযাআহ্ গোত্রের অত্যাচারিত ব্যক্তিরা তাদের অত্যাচারিত হওয়ার বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর গোচরীভূত করার জন্য নিজেদের গোত্রপতি আমর ইবনে সালিমকে মদীনায় মহানবীর কাছে প্রেরণ করেন। তিনি মদীনায় পৌঁছে সরাসরি মসজিদে নববীতে চলে যান এবং জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক স্বরে খুযাআহ্ গোত্রের অত্যাচারিত অবস্থা ও সাহায্য প্রার্থনার কথা ব্যক্ত করে এমন একটি কবিতা আবৃত্তি করেন এবং মহানবী (সা.) খুযাআহ্ গোত্রের সাথে যে মৈত্রীচুক্তি করেছিলেন তাঁকে সেই চুক্তির মর্যাদা রক্ষার দোহাই দেন এবং মযলুমদের সাহায্য ও তাদের খুনের প্রতিশোধ নেয়ার আহবান জানান।

তিনি কবিতাটির শেষে বলেছিলেন :

هم بيّتونا بالوتير هجّداً

و قتلونا ركّعاً و سجّداً

“হে নবী! তারা মধ্যরাতে যখন আমাদের একাংশ ওয়াতীর জলাশয়ের কাছে নিদ্রায় আচ্ছন্ন এবং আরেক অংশ রুকূ-সিজদাহরত ছিল, তখন এ অসহায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছে।”

এ কবি মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি এবং যুদ্ধ করার সাহস ও মনোবৃত্তি জাগ্রত করার জন্য বারবার বলছিলেন :قُتلنا و قد أسلمنا আমরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি, তখন (ঈমানের অবস্থায়) গণহত্যার শিকার হয়েছি।”

খুযাআহ্ গোত্রপতির এ ধরনের আবেগধর্মী, মর্মস্পর্শী ও উদ্দীপনা সঞ্চারী কবিতা তার প্রভাব রেখেছিল। মহানবী (সা.) বিশাল মুসলিম জনতার সামনে আমরের দিকে মুখ তুলে বলেছিলেন : হে আমর ইবনে সালিম! তোমাকে আমি সাহায্য করব।” এ অকাট্য নিশ্চয়তামূলক প্রতিশ্রুতি আমরকে অভিনব প্রশান্তি দিয়েছিল। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, মহানবী শীঘ্রই এ ঘটনার কারণ কুরাইশদের থেকে খুযাআহ্ গোত্রের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। তবে তিনি কখনোই ভাবতে পারেন নি, পবিত্র মক্কা বিজয় ও কুরাইশদের অত্যাচারী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে এ কাজের পরিসমাপ্তি হবে।

অল্প সময়ের মধ্যে সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য বুদাইল ইবনে ওযারকা খুযাআহ্ গোত্রের এক দল লোককে সাথে নিয়ে মদীনায় মহানবীর কাছে যান এবং তাঁর কাছে খুযাআহ্ গোত্রের তরুণ-যুবকদের হত্যা করার ব্যাপারে বনী বাকর গোত্রের সাথে কুরাইশদের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। অতঃপর তিনি মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যান।

মহানবী (সা.)-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বিগ্ন কুরাইশরা

কুরাইশরা তাদের এ অন্যায়ের ব্যাপারে খুব অনুতপ্ত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারে যে, তারা হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির বিপক্ষে একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে এবং এভাবে তারা এ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এ কারণে তারা মহানবী (সা.)-এর ক্রোধ প্রশমন এবং দশ-সালা চুক্তিটির অনুমোদন ও দৃঢ়ীকরণ৩৩১ এবং আরেকটি বর্ণনামতে নবায়ন করার জন্য নিজেদের নেতা আবু সুফিয়ানকে মদীনায় প্রেরণ করে, যাতে সে যে কোনভাবে তাদের অন্যায় ও আগ্রাসনের বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। সে মদীনার পথ ধরে যাত্রা করে এবং আসফান’ নামক স্থানে৩৩২ মক্কাস্থ খুযাআহ্ গোত্রের নেতা বুদাইলের সাথে তার দেখা হয়। সে তাঁর কাছে জানতে চায়, তিনি মদীনায় ছিলেন কি না এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কথা মহানবীর কাছে উত্থাপন করেছেন কি না? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তিনি নিজ গোত্রের লোকদের সান্ত্বনা দেবার জন্য তাদের কাছে গিয়েছিলেন এবং কখনোই তিনি মদীনা গমন করেন নি। তিনি এ কথা বলেই পবিত্র মক্কার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু আবু সুফিয়ান তাঁর উটের মলের মধ্যে মদীনার খেজুরের আঁটি দেখতে পায় এবং তা থেকে নিশ্চিত হয়ে যায়, বুদাইল মহানবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

আবু সুফিয়ান মদীনায় প্রবেশ করে সরাসরি নিজ কন্যা উম্মে হাবীবার কাছে যায়। উল্লেখ্য, উম্মে হাবীবাহ্ মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী ছিলেন। সেখানে সে মহানবীর তোষকের উপর বসতে চাইলে তার কন্যা তৎক্ষণাৎ তা গুটিয়ে ফেলেন। আবু সুফিয়ান তার মেয়েকে বলেছিল : তুমি কি বিছানাকে তোমার পিতার অনুপযুক্ত মনে করেছ, নাকি তোমার পিতাকে এর অনুপযুক্ত ভেবেছ? তখন পিতার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন : এ বিছানা মহানবী (সা.)-এর, আর তুমি একজন কাফির। তাই আমি চাই না, একজন অপবিত্র-কাফির ব্যক্তি মহানবীর পবিত্র বিছানার উপর বসুক।”

এ উক্তি ঐ ব্যক্তির কন্যার যে পুরো বিশটি বছর ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অনেকগুলো বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এ মহীয়সী নারী (উম্মে হাবীবাহ্) ইসলামের ক্রোড়ে এবং তাওহীদী আদর্শের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন বলে তাঁর মধ্যে ধর্মের প্রতি ভালোবাসা এতোটাই প্রবল ছিল যে, অভ্যন্তরীণ প্রবণতা সত্বেও তিনি পিতা-সন্তানের মধ্যেকার আবেগকে তাঁর ধর্মীয় আবেগের কাছে অবনত করিয়েছিলেন।

আবু সুফিয়ান মদীনায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল কন্যার আচরণে খুবই মর্মাহত হয়, আর এ কারণেই সে তার বাসগৃহ ত্যাগ করে মহানবীর কাছে উপস্থিত হয়। সে মহানবীর কাছে হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি নবায়ন ও দৃঢ়ীকরণের বিষয়টি উত্থাপন করে। কিন্তু মহানবী কোন কথাই বললেন না। তাঁর নীরবতা প্রমাণ করে, তিনি আবু সুফিয়ানের কথার কোন গুরুত্ব দেন নি।

আবু সুফিয়ান মহানবীর কয়েকজন সাহাবীর সাথে যোগাযোগ করে যাতে তাঁদের মাধ্যমে আবার মহানবীর সাথে যোগাযোগ করে নিজ উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়। কিন্তু এসব যোগাযোগ তার কোন উপকারেই আসে নি। অবশেষে সে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর ঘরে গিয়ে তাঁকে বলেছিল : এ নগরীতে আপনারাই আমার সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়। কারণ আমার সাথে আপনাদের ঘনিষ্ঠ রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। তাই আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি যাতে আপনি মহানবীর কাছে আমার ব্যাপারে সুপারিশ করেন।” হযরত আলী (আ.) তার এ কথার জবাবে বললেন : মহানবী যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সে ব্যাপারে আমরা কখনোই হস্তক্ষেপ করি না।” সে হযরত আলীর এ কথা শুনে হতাশ হয়ে গেল। হঠাৎ সে আলী (আ.)-এর সহধর্মিনী মহানবীর কন্যা হযরত যাহরা (আ.)-এর দিকে তাকালো। তখন তাঁর নয়নের দ্যূতি হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর সামনে খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। সে হযরত ফাতিমার আবেগকে নাড়া দেয়ার জন্য বলল : হে নবীকন্যা! আপনার সন্তানদেরকে মক্কার অধিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার আদেশ দেয়া আপনার পক্ষে কি সম্ভব? আর এর ফলে যতদিন এ পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, ততদিন তাঁরা আরবদের নেতা থাকবেন।” হযরত যাহরা আবু সুফিয়ানের অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন : এ কাজ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং বর্তমানে আমার সন্তানদের এমন অবস্থাও নেই।” সে আবার হযরত আলীর দিকে তাকিয়ে বলল : হে আলী! আমাকে এ ব্যাপারে কিছু দিক নিদের্শনা দান করুন।” হযরত আলী তাকে বললেন : আমার চোখে কেবল এ পথ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না যে, তুমি মসজিদে গিয়ে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা দানের ঘোষণা দেবে।

আবু সুফিয়ান বলল : আমি যদি এ কাজ করি, তা হলে কি কোন উপকার হবে? তিনি বললেন : খুব একটা উপকার হবে না। তবে এ কাজ করা ছাড়া আর কিছুই আমার দৃষ্টিতে আসছে না।” আবু সুফিয়ান আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর সত্যবাদিতা, সততা ও নিষ্ঠার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিল বিধায় সে তাঁর প্রস্তাব মসজিদে নববীতে গিয়ে বাস্তবায়ন করল। এরপর সে মসজিদ থেকে বের হয়ে এসে উটের পিঠে আরোহণ করে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। মক্কার কুরাইশ নেতাদের কাছে নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়ার মাঝে হযরত আলীর প্রস্তাবের ব্যাপারে কথা উঠলে সে বলল : আমি আলীর প্রস্তাব মোতাবেক মসজিদে গিয়েছি এবং মুসলমানদেরকে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছি।” উপস্থিত ব্যক্তিরা তাকে জিজ্ঞেস করল : মুহাম্মদ কি তোমার এ কাজ অনুমোদন করেছে? সে বলল : না।” তারা বলল : আলীর প্রস্তাব ঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কারণ মহানবী তোমার আশ্রয় দানের ঘোষণার প্রতি মোটেই ভ্রূক্ষেপ করে নি। আর একতরফা চুক্তির কোন কল্যাণ নেই।” অতঃপর তারা মুসলমানদের ক্রোধ প্রশমনের অন্য পথ খুঁজে বের করার জন্য অনেকগুলো পরামর্শসভার আয়োজন করেছিল।৩৩৩

এক গুপ্তচর আটক

মহানবী (সা.)-এর জীবনেতিহাস থেকে এ পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যায় যে, তিনি সব সময় চেষ্টা করতেন যাতে শত্রু সত্যের সামনে আত্মসমর্পণ করে। আর তিনি কখনোই শত্রুর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ ও তাকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় পোষণ করতেন না।

যে সব যুদ্ধে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করতেন, সেসবের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বা যখন তিনি কোন সেনাদলকে যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করতেন, তখন লক্ষ্য থাকতো শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা, শত্রুপক্ষের সৈন্য সমাবেশ ও সংহতি বিনষ্ট করা এবং তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, ইসলাম ধর্ম প্রচারের পথে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা হলে মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে ইসলাম ধর্মের শক্তিশালী যুক্তি তার প্রভাব ফেলবেই এবং এ লোকগুলো- যাদের সামরিক সমাবেশ ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল,- তাদেরকে যদি নিরস্ত্র করা হয় এবং তারা যুদ্ধরত অবস্থার অবসান ঘটায় ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করার চিন্তা মনের মধ্যে লালন না করে, তা হলে তারা নিজেদের অজান্তেই মানব প্রকৃতি বা ফিতরাতের দিকনির্দেশনার দ্বারা তাওহীদবাদী ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হবে ও ইসলামের সাহায্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

এ কারণেই অনেক পরাজিত জাতি যারা ইসলামের সামরিক শক্তির কাছে পরাজয় বরণ করেছে এবং এরপর বিশৃঙ্খল-মুক্ত পরিবেশে ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছে, তারাই দীন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং একনিষ্ঠভাবে এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টার ইবাদতের ধর্ম প্রসার ও প্রচারকাজে আত্মনিয়োগ করেছে।

আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু মক্কা বিজয়েও এ সত্য পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। মহানবী (সা.) জানতেন, যদি তিনি পবিত্র মক্কা জয় করেন এবং শত্রুদের অস্ত্রমুক্ত করে পরিবেশকে মুক্ত ও শান্ত করেন, তা হলে অল্প দিনের মধ্যেই বর্তমানে ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর শত্রু এ দলটি সাহায্যকারী ও ইসলাম ধর্মের পথে মুজাহিদ হয়ে যাবে। অতএব, শত্রুর ওপর অবশ্যই বিজয়ী হতে হবে এবং তাকে পরাভূত করতেই হবে। তবে কখনোই তাদেরকে ধ্বংস করা বাঞ্ছনীয় নয়, আর যতদূর সম্ভব রক্তপাত এড়ানো উচিত। এ পবিত্র লক্ষ্য (বিনা রক্তপাতে শত্রুকে পরাজিত করা) অর্জনের জন্য শত্রুকে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় করার মূলনীতি ব্যবহার করা উচিত। নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনী সংগ্রহ করার চিন্তা-ভাবনা করার আগেই শত্রুপক্ষকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে নিরস্ত্র করতে হবে।

শত্রুপক্ষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করার মূলনীতি তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন ইসলামের যাবতীয় সামরিক রহস্য ও গোপনীয়তা সংরক্ষিত থাকবে এবং তা শত্রুর হস্তগত হবে না। মূলনীতিগতভাবে শত্রুপক্ষ জানবে না, মহানবী তাদের ওপর আক্রমণ করবেন কি না। আর যদি আক্রমণের চিন্তা-ভাবনা করা হয়ে থাকে, তা হলে তারা ঘূণাক্ষরেও অভিযান পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর যাত্রাকাল ও গতিপথ সম্পর্কে যেন অবগত না হয়। এর অন্যথা হলে এ সামরিক মূলনীতি বাস্তবায়িত হবে না।

পবিত্র মক্কা নগরী বিজয় শিরক ও মূর্তিপূজার সবচেয়ে সুরক্ষিত ও মজবুত দুর্গের পতন এবং কুরাইশদের যালিম প্রশাসন, যা ছিল তাওহীদবাদী ধর্মের প্রচার ও প্রসারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, তা উচ্ছেদ করার জন্য মহানবী (সা.) রণপ্রস্ততির কথা ঘোষণা করেন। তিনি মহান আল্লাহর কাছে দুআ করেন, কুরাইশদের গুপ্তচররা যেন মুসলিম সেনাবাহিনীর যাত্রা ও গতিবিধি সম্পর্কে অবগত না হয়। মুহররম মাসের শুরুতেই মদীনা নগরীর আশে-পাশের অঞ্চলগুলো থেকে মদীনায় এক বিশাল সেনাসমাবেশ করা হয় যার বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা লিখেছেন :

তিন শ’ অশ্ব ও তিন পতাকা সমেত সাত শ’ মুহাজির যোদ্ধা, সাত শ’ অশ্ব ও অনেক পতাকা সমেত চার হাজার আনসার যোদ্ধা, এক শ’ অশ্ব, এক শ’ বর্ম ও তিন পতাকা সহ বনী মাযীনাহ্ গোত্র থেকে এক হাজার যোদ্ধা, বনী আসলাম গোত্র থেকে ত্রিশটি অশ্ব ও দু টি পতাকা সহ চার শ’ যোদ্ধা; জুহাইনা গোত্র থেকে পঞ্চাশটি অশ্ব ও চারটি পতাকা সহ আট শ’ যোদ্ধা, বনী কা ব থেকে তিনটি পতাকা সহ পাঁচ শ’ যোদ্ধা; সেনাদলের অবশিষ্টাংশ গিফার, আমাজা ও বনী সালীম গোত্রের যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত।৩৩৪

ইবনে হিশাম বলেন : মুসলিম বাহিনীর সেনাসংখ্যা দশ হাজারে উপনীত হয়।” এরপর তিনি আরো বলেন : বনি সালীম গোত্র থেকে সাত শ’ এবং আরেকটি বর্ণনানুসারে এক হাজার যোদ্ধা, বনী গিফার গোত্র থেকে চার শ’ যোদ্ধা, আসলাম গোত্র থেকে চার শ’ যোদ্ধা, মাযীনাহ্ গোত্র থেকে এক হাজার তিন শ’ যোদ্ধা এবং বাকী অংশ মুহাজির, আনসার ও তাঁদের মিত্রগণ এবং বনী তামীম, কাইস ও আসাদ গোত্র থেকে কতিপয় লোকের সমন্বয়ে গঠিত।”

এ অভিযান বাস্তবায়িত করার জন্য পবিত্র মক্কা অভিমুখী সকল সড়কপথ ইসলামী হুকুমতের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণের (সার্বক্ষণিক) নযরে রাখা হয়েছিল এবং শক্তভাবে সকল যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। ইসলামী সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করার প্রাক মুহূর্তে হযরত জিবরীল (আ.) এসে মহানবী (সা.)-কে জানালেন, মুসলমানদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত এক সরলমনা লোক কুরাইশদের কাছে চিঠি লিখেছে এবং সারাহ্’ নামের এক মহিলার সাথে চুক্তি করেছে যে, কিছু অর্থ নিয়ে সে তার চিঠিটা কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেবে। আর সে ঐ চিঠিতে মক্কা নগরীর ওপর মুসলমানদের অত্যাসন্ন আক্রমণ চালানোর কথাও ফাঁস করে দিয়েছিল। সারাহ্ মক্কার গায়িকা ছিল এবং সে কখনো কখনো কুরাইশদের শোকানুষ্ঠানগুলোতে শোকগাঁথাও গাইত। বদর যুদ্ধের পরে মক্কায় তার কাজের প্রসার ও চাকচিক্য কমে গিয়েছিল। কারণ বদর যুদ্ধে কতিপয় কুরাইশ নেতা নিহত হয়েছিল এবং মক্কা নগরী জুড়ে তখন শোক ও দুঃখের মাতম চলছিল। এ কারণেই মক্কায় তখন গান-বাজনা ও আমোদ-প্রমোদের আসর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশদের ক্রোধ ও শত্রুতার আগুন প্রজ্বলিত রাখতে এবং বদর যুদ্ধে নিহতদের প্রতিশোধ গ্রহণের অনুভূতি জনগণের মধ্য থেকে বিদূরিত না হওয়ার লক্ষ্যে শোকগাঁথা গাওয়া সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ কারণেই বদর যুদ্ধের দু বছর পর সে মদীনায় আসে। মহানবী (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : তুমি কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছ? সে বলেছিল : না।” মহানবী তখন বলেছিলেন : তা হলে তুমি এখানে কেন এসেছ? সে উত্তরে বলেছিল : কুরাইশ আমার গোত্র ও বংশ। তাদের একদল নিহত হয়েছে এবং আরেকদল মদীনায় হিজরত করেছে। বদর যুদ্ধের পরে আমার পেশার পসার ও চাকচিক্য হারিয়ে গেছে। তাই আমি অভাবগ্রস্ত হয়ে ও প্রয়োজনের তাকীদেই এখানে এসেছি।” মহানবী তাকে পর্যাপ্ত পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্য-দ্রব্য দেয়ার জন্য তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন।৩৩৫

সারাহ্ মহানবীর কাছ থেকে আনুকূল্য পাওয়া সত্বেও হাতিব ইবনে আবী বালতাআর কাছ থেকে মাত্র দশ দীনার নিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ভার গ্রহণ করে এবং মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের প্রস্ততি গ্রহণের কথা ফাঁস করা তার পত্র কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।৩৩৬

মহানবী (সা.) তাঁর তিন বীরকে ডেকে নিয়ে তাঁদের দায়িত্ব দিলেন, তাঁরা মক্কার পথে অগ্রসর হয়ে এ গুপ্তচর নারীকে যেখানে পাবেন, সেখানে গ্রেফতার করে তার থেকে ঐ চিঠিটা উদ্ধার করবেন। মহানবী (সা.) এ অভিযানের দায়িত্ব হযরত আলী, যুবাইর ও মিকদাদকে প্রদান করেন। তাঁরা রাওযাতু খাখ্’৩৩৭ নামক স্থানে ঐ নারী গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে তাকে তল্লাশী চালান। কিন্তু তাঁরা তার কাছে কিছুই পেলেন না। অন্যদিকে ঐ নারী গুপ্তচরটি হাতিবের কাছ থেকে চিঠি নেয়ার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করে।

তখন হযরত আলী বললেন : মহান আল্লাহর শপথ! মহানবী কখনোই মিথ্যা বলেন না। তুমি চিঠিটা দিয়ে দাও। নইলে আমরা যে কোনভাবেই হোক, তোমার কাছ থেকে চিঠিটা উদ্ধার করব।”

সারাহ্ বুঝতে পারল, আলী এমন সৈনিক যিনি মহানবীর আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না। এ কারণেই সে হযরত আলীকে বলল :  একটু দূরে যান।” এরপর সে তার চুলের দীর্ঘ বেনীর ভাঁজের ভেতর থেকে চিঠি বের করে হযরত আলীর কাছে হস্তান্তর করে।

দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মুসলমান, যে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের ক্রান্তিকালে তাদের সাহায্যার্থে দ্রুত ছুটে যেত, সে এ ধরনের দুষ্কর্মে হাত দিয়েছে বিধায় মহানবী ভীষণ অসন্তষ্ট ও দুঃখিত হয়েছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি হাতিবকে ডেকে কুরাইশদের এ ধরনের তথ্য প্রদানের ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইলেন। সে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নামে শপথ করে বলল : আমার ঈমানে সামান্য পরিমাণ দ্বিধা-সংশয় প্রবেশ করে নি। তবে মহানবী অবগত আছেন, আমি মদীনায় একাকী বসবাস করছি এবং আমার সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনরা কুরাইশদের চাপ ও নির্যাতনের মধ্যে মক্কায় জীবন-যাপন করছে। আমার এ সংবাদ দেয়ার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কুরাইশরা কিছুটা হলেও যেন তাদের থেকে চাপ ও নির্যাতনের মাত্রা লাঘব করে।”

হাতিবের দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বোঝা যায়, মুসলমানদের গোপন বিষয়াদি সংক্রান্ত তথ্য অর্জন করার জন্য কুরাইশ নেতারা মক্কায় তাদের (মুসলমানদের) আত্মীয়-স্বজনদের চাপের মুখে রাখত এবং তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা লাঘব করার ব্যাপারে শর্তারোপ করে বলত যে, তাদেরকে মদীনার মুসলমানদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত গোপন তথ্যাবলী সংগ্রহ করে তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তার দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা ও কারণ দর্শানো যথার্থ ও যুক্তিসংগত না হওয়া সত্বেও মহানবী তার অতীত কর্মকাণ্ড ও অবদানসমূহের মতো কতকগুলো কল্যাণের কথা বিবেচনা করে তার অজুহাত গ্রহণ করেন এবং তাকে মুক্ত করে দেন। এমনকি হযরত উমর মহানবী (সা.)-এর কাছে তার শিরচ্ছেদের আবেদন জানালে মহানবী বলেছিলেন : সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং একদিন সে মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র ছিল। এ কারণেই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি না ঘটার জন্য এ প্রসঙ্গে কয়েক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল :

) يا أيّها الّذين آمنوا لا تتّخذوا عدوّى و عدوّكم أولياء.(

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না... ৩৩৮

মুনাফিক দলের ভূমিকা

মুনাফিক দলের ভূমিকা ছিল ইহুদীদের চেয়েও মারাত্মক। কেননা মুনাফিকরা বন্ধুর বেশে পেছন থেকে পিঠে ছুরি মারছিল। এদের নেতা ছিল আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও মালেক ইবনে উবাই। এরা মুসলমানদের সামনে বন্ধুত্বের মুখোশ পরেছিল। এরা দ্রুত বনী নাযীর গোত্রের নেতাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায় যে,আমরা দু হাজার সৈন্য দিয়ে তোমাদের সাহায্য করব। আর তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রসমূহ অর্থাৎ বনী কুরাইযাহ্ ও বনী গাতফান তোমাদের একাকী ছেড়ে দেবে না। এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দানের কারণে ইহুদীদের সাহস বেড়ে যায়। শুরুতে তারা আত্মসমর্পণ করে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। তারা দুর্গের প্রবেশদ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয় এবং যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন মূল্যেই হোক,প্রতিরক্ষার লড়াই করবে এবং বিনামূল্যে তাদের ক্ষেত-খামার মুসলমানদের হাতে তুলে দেবে না।

বনী নাযীর গোত্রের অন্যতম সর্দার সালাম ইবনে মুশকাম,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের অঙ্গীকারকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করে এবং বলে,কল্যাণজনক হচ্ছে সবার চলে যাওয়া। কিন্তু হুয়াই ইবনে আখতাব জনসাধারণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানায়।

রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের বার্তা সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনায় স্থলবর্তী হিসেবে রেখে যান এবং তাকবীর ধ্বনি দিয়ে বনী নাযীর গোত্রের দুর্গ অবরোধের জন্য অগ্রসর হন। বনী নাযীর ও বনী কুরাইযার মধ্যবর্তী স্থানে তিনি শিবির স্থাপন করেন এবং উভয় গোত্রের মধ্যেকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী87 ছয় দিন ছয় রাত এবং অন্য কয়েকজনের বর্ণনা মোতাবেক 15 দিন তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু ইহুদীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং দৃঢ়তা প্রদর্শন করে। মহানবী (সা.) দুর্গের আশ-পাশের খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দেন,যাতে ইহুদীরা এ ভূখণ্ডের প্রতি লোভের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়।

এ সময় দুর্গের ভেতর থেকে ইহুদীদের চিৎকার শুরু হয় এবং তারা বলে : হে আবুল কাসেম (মুহাম্মদ)! আপনি সব সময় আপনার সৈন্যদের গাছ-পালা কাটতে নিষেধ করেছেন। এখন কেন সে কাজ করার নির্দেশ দিলেন?”   তবে এর কারণ যেটি ছিল তা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইহুদীরা আগের ফয়সালা মেনে নিতে রাযী হয়ে যায়। তারা একমত হয়ে বলল : আমরা দেশত্যাগ করে চলে যেতে রাযী আছি;তবে শর্ত হলো আমাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি আমাদের সাথে নিয়ে যাব। মহানবী (সা.) এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং বললেন,তারা অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে যেতে পারবে,তবে অস্ত্রগুলো নিতে পারবে না;সেগুলো মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করতে হবে।

লোভাতুর ইহুদীরা তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে যাবার ব্যাপারে যারপর নাই চেষ্টা চালায়। এমনকি ঘরের দরজাগুলোও চৌকাঠসহ নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়। বাকী ঘরগুলো নিজেদের হাতে ভেঙে ফেলে। তাদের একদল খাইবর ও আরেক দল সিরিয়ায় চলে যায়। তবে তাদের কেবল দু ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। পরাজিত ও অপদস্থ এ জাতিটি এ পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার জন্য দফ বাজিয়ে,গান গেয়ে মদীনা ত্যাগ করে এবং এ আচরণের মধ্য দিয়ে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে,এ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তারা ততটা চিন্তিত বা মনঃক্ষুণ্ণ হয় নি।

মুহাজিরগণের মধ্যে বনী নাযীরের ক্ষেত-খামার বণ্টন

ইসলামের সৈনিকগণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া শত্রুপক্ষের কাছ থেকে যে সম্পদ গনীমত হিসেবে লাভ করেন,পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী88 তা সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর মালিকানাধীন। তিনি যেভাবে ভালো মনে করেন,ইসলামের কল্যাণে তা ব্যয় করবেন। মহানবী এটাই কল্যাণকর মনে করলেন যে,এই ক্ষেত-খামার,পানির উৎস ও বাগানগুলো মুহাজিরগণের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কেননা মক্কা থেকে হিজরত করে আসার কারণে তাঁদের হাতে জাগতিক সহায়-সম্পদ ছিল না বললেই চলে। তাঁরা আনসারগণের উপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের মেহমান হিসেবেই ছিলেন। এ মতটিকে সা দ ইবনে উবাদা ও সা দ ইবনে মায়ায সমর্থন করেন। এ কারণে সকল জমি মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণের মধ্যে বণ্টন করা হয় এবং আনসারগণের মধ্যে অত্যন্ত দরিদ্র হবার কারণে সাহল ইবনে হাদীদ এবং আবু দুজানাহ্ ছাড়া অন্য কেউ তার ভাগ পান নি। এভাবে সকল মুসলমানের সার্বিক অবস্থার উন্নতির একটি ব্যবস্থা হয়। বনী নাযীর গোত্রের জনৈক নেতার মূল্যবান তরবারিটি সা দ ইবনে মায়াযকে প্রদান করা হয়।

হিজরী চতুর্থ শতকের রবিউল আউয়াল মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। সূরা হাশরও এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। আমরা দীর্ঘতা এড়ানোর জন্য এ সূরার আয়াতসমূহের অনুবাদ ও তাফসীর হতে বিরত থাকছি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন,এ ঘটনায় কোনরূপ রক্তপাত ঘটে নি। কিন্তু মরহুম শেখ মুফীদ বলেন,বিজয়ের রাতে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে বনী নাযীর গোত্রের দশজন ইহুদী নিহত হয় এবং তারা নিহত হবার ফলে ইহুদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।89

পঁয়ত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মদ ও নেশাকর পানীয় নিষিদ্ধকরণ

মদ এবং সামগ্রিকভাবে মাদকদ্রব্য মানব সমাজের অন্যতম জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক আপদ ছিল এবং এখনো রয়েছে। এ ধ্বংসকারী বিষাক্ত দ্রব্যাদির নিন্দায় এটুকুই যথেষ্ট যে,অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্যের সর্বপ্রধান সম্বল জ্ঞান-বু্দ্ধির সাথে এ মাদকদ্রব্য সাংঘর্ষিক। মানুষের সৌভাগ্য ও কলাণের নিয়ামক হচ্ছে তার জ্ঞান ও বিবেক। অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের যে ব্যবধান,তা মানুষের এ অভ্যন্তরীণ শক্তির উপরই নির্ভরশীল। এলকোহল (মদ) বা মাদকদ্রব্য এর চরম শত্রু। এ কারণে মদ ও নেশাকর পানীয় অর্থাৎ মাদকদ্রব্য সেবন প্রতিরোধ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূলগণের অন্যতম কর্মসূচী ছিল। একই কারণে সকল শরীয়তে মদ সম্পূর্ণ হারাম ঘোষিত হয়েছে।90

আরব উপদ্বীপে মদপান একটি গণ-মুসিবত ও মহামারী আকারে বিদ্যমান ছিল। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার মূলোৎপাটনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। পরিবেশের চাহিদা এবং সাধারণভাবে সব আরবের অবস্থা ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দিচ্ছিল না যে,মহানবী (সা.) কোন পটভূমি ছাড়াই তা হারাম ঘোষণা করবেন। বরং একজন দক্ষ চিকিৎসকের ন্যায় সমাজের মন-মানসিকতাকে আগে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ছিল যাতে চূড়ান্ত ও নিশ্চিত সংস্কার সম্ভবপর হয়। এ কারণে মদপানের নিন্দায় নাযিলকৃত চারখানা আয়াতের ভাষা এক রকম নয়। বরং প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এ আয়াতসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা মহানবীর দ্বীন প্রচারের কর্মকৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। আমাদের মতে বড় বড় বক্তা ও লেখকরা এ পদ্ধতির অনুসরণ করতে পারেন এবং এ পদ্ধতিতেই তাঁরা সমাজের কলুষ ও অনাচারগুলো দূর করার চেষ্টা করতে পারেন।

কোন একটি অন্যায় ও অনাচার প্রতিরোধ করার জন্য মৌলিক শর্ত হলো,প্রথমে সমাজের লোকদের চিন্তা-চেতনা ও বৃহত্তর জনমতকে ঐ অনাচারের ক্ষয়-ক্ষতি ও অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ করা। যতদিন পর্যন্ত সমাজে মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ চেতনার সৃষ্টি না হবে,ততদিন পর্যন্ত কোন অনাচার মৌলিকভাবে মোকাবেলা করা যাবে না। কেননা স্বয়ং মানুষই তো এ সংস্কার-সংশোধনের যিম্মাদার।

যে সমাজে মদপান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল,পবিত্র কুরআন এ দৃষ্টিকোণ থেকে সেখানে প্রথম বারের মতো খেজুর ও আঙুর দ্বারা মদ তৈরিকে উত্তম জীবিকা বা রিয্কে হাসান -এর পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছে। এভাবে সমাজের ঘুমন্ত অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে তা জাগ্রত ও সচেতন করা হয়। এরশাদ হয়েছে :

) و من ثمرات النّخيل و الأعناب تتخذون منه سكرا و رزقا حسنا(

তোমরা খেজুর গাছের ফল ও আঙুর থেকে মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। (সূরা নাহল : 67)

পবিত্র কুরআন প্রথম বারের মতো এ তথ্য কর্ণগোচর করে যে,খেজুর ও আঙুর থেকে মদ তৈরি করা উত্তম খাদ্য নয়;বরং উত্তম খাদ্য হচ্ছে উভয় ফলকে খেজুর ও আঙুর রূপে আহার করা।

এ আয়াত মানুষের চিন্তায় নাড়া দেয় এবং তাদের মানসিকতা এমনভাবে প্রস্তুত করে যাতে পরবর্তীতে আল্লাহ্ তাঁর ভাষাকে আরো কঠোরতর করেন এবং আরেকখানা আয়াতের মাধ্যমে এ কথা ঘোষণা করেন যে,মদ ও জুয়ার দ্বারা যে  আংশিক (পার্থিব) মুনাফা হয়,তা সমুদয় ক্ষয়-ক্ষতির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তুচ্ছ। নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে এ বক্তব্য সমাজের সামনে পেশ করা হয় :

) يسألونك عن الخمر و الميسر قل فيهما اثم كبير و منافع للنّاس و إثمهما أكبر من نفعهما(

তারা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জানতে চায়। বলুন,উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও;কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। 91

নিঃসন্দেহে লাভ ও ক্ষতির মাঝে তুলনা করা এবং লাভের চাইতে ক্ষতির পাল্লা ভারী দেখানো চিন্তাশীল লোকদের মনে ঐ কাজটির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য যথার্থ। কিন্তু সাধারণ লোকদের যতক্ষণ পরিষ্কার ভাষায় নিষেধ করা না হবে,ততক্ষণ নিছক এ ধরনের বাচনভঙ্গি ও বর্ণনা পদ্ধতির দ্বারা তারা অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হয় না।

এমনকি এ আয়াত নাযিল হওয়া সত্বেও আবদুর রহমান ইবনে আউফ এক ভোজসভার আয়োজন করে তাতে খাবার দস্তরখানে মদ পরিবেশন করেন। মেহমানরা মদ পান করার পর নামাযে দাঁড়ান। তাঁদের একজন নামাযে (মদের নেশায়) পবিত্র কুরআনের আয়াত ভুলভাবে তেলাওয়াত করেন,যার ফলে ঐ আয়াতের অর্থই পাল্টে যায়!

অর্থাৎ সূরা কাফিরুন-এلا أعبد ما تعبدون (হে কাফেররা!) তোমরা যার (মূর্তির) উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি না -এর পরিবর্তে এভাবে তেলাওয়াত করেন :أعبد ما تعبدون তোমরা যার উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি -যার অর্থ আয়াতের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়।

এসব ঘটনা মানুষের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করতে থাকে যাতে পরিবেশ ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দেয় যে,অন্তত বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে শরাব (মদ) হারাম ঘোষিত হোক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোষণা করা হয় যে,মাতাল অবস্থায় নামায পড়ার অধিকার কোন মুসলমানের নেই।

আর এ বিধান বা নির্দেশ নিম্নোক্ত আয়াতে ঘোষণা করা হয় :

) لا تقربوا الصّلاة و أنتم سكاري حتّي تعلموا ما تقولوا(

অর্থাৎ মাতাল অবস্থায় নামায পড়ো না। কারণ তোমরা (মাতাল অবস্থায় নামাযে) কী বলছ,তা জান না।

এ আয়াতের প্রভাব এতটা তীব্র ছিল যে,একদল লোক চিরতরে মদ পান ত্যাগ করে এবং তাদের যুক্তি ছিল এই যে,যে জিনিস তোমাদের নামাযের ক্ষতি করে,তা অবশ্যই তোমাদের জীবনের কর্মসূচী থেকেই নিরঙ্কুশভাবে বাদ দিতে হবে।

তবে আরেকটি দল এরপরও মদ পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে নি;এমনকি আনসারগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উল্লিখিত আয়াত অবতীর্ণ হওয়া সত্বেও এমন ভোজসভার আয়োজন করে যাতে মদ পরিবেশন করার পর অতিথিবৃন্দ (নেশাগ্রস্ত হয়ে) পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হয় এবং পরস্পরের হাত ভেঙে দেয় ও মাথা ফাটিয়ে দেয়। এরপর মহানবী (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করা হয়।

দ্বিতীয় খলীফা ঐ দিন পর্যন্ত মদ পান করতেন। তিনি পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ মদ পান সুনিশ্চিতভাবে হারাম করার জন্য যথেষ্ট নয় -এ ধারণার বশবর্তী হয়ে দু হাত তুলে প্রার্থনা

করেন :

اللهم بيّن لنا بيانا شافيا فِى الخمر

হে আল্লাহ্! মদ সম্পর্কে আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সন্তোষজনক বিধান সম্বলিত ব্যাখ্যা অবতীর্ণ করুন।

বলার অপেক্ষা রাখে না,এ ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা মদ পান নিশ্চিতভাবে হারাম হবার বিধান মেনে নেয়ার জন্য (তদানীন্তন) মুসলিম সমাজকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। এ কারণেই মদ পান নিষিদ্ধ করার স্পষ্ট ও চূড়ান্ত বিধান অবতীর্ণ হয়। এ আয়াত হলো :

) يا أيّها الّذين آمنوا إنّما الخمر و الميسر و الأنصاب و الأزلام رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই শরাব (মদ),জুয়া,মূর্তিপূজার বেদী এবং আযলাম (এক ধরনের ভাগ্য পরীক্ষা) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। কাজেই সবাই তা থেকে বেঁচে থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 92

এ স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ঘোষণার ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে,যারা তখনো শরীয়তের স্পষ্ট ও পরিষ্কার বিধান না আসার যুক্তিতে মদ পান করত,তারাও মদ পান ত্যাগ করল। সুন্নী ও শিয়া সূত্রের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে,এ আয়াত শোনার পর দ্বিতীয় খলীফা বলেন :انتهينا يا ربّ

হে প্রভু! এখন থেকে আমরা বিরত হলাম। 93

বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিষয়ক সংযুক্তি

দ্বিতীয় খলীফা উল্লিখিত তিনখানা আয়াত শোনার পর ক্ষান্ত হন নি। তিনি মদ হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাদকদ্রব্য হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত আয়াত নাযিল হলে তিনি সন্তষ্টি লাভ করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর হুকুম ছিল :

) رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

(শরাব) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। অতএব,তোমরা তা থেকে বিরত থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 94

কিন্তু আমাদের যুগের পাশ্চাত্যপন্থীরা এসব আয়াতকে যথেষ্ট মনে করে না;বরং তারা বলতে চায়,মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারেحرام (হারাম) বাحُرّم হুররিমা (হারাম করা হলো) পরিভাষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় মদ যে নিষিদ্ধ,তা বোঝা যায় না।

এ দলটি কুপ্রবৃত্তির কামনা-বাসনার পূজারী এবং অজুহাত খুঁজে বেড়াতে অভ্যস্ত। এরা শয়তানী বোতলটার মধ্যে ডুবে থাকতে ও বুকে জড়িয়ে রাখতে এবং এ জাতীয় অনর্থক কথা বলতে চায়;অথচ পবিত্র কুরআন এ ধরনের শয়তানী চিন্তাধারা দমন করার উদ্দেশ্যে শরাব হারাম হওয়ার বিষয়ে অন্যভাবে হারাম পরিভাষা ব্যবহার করেছে। পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতে বলা হয়েছে :و إثمهما أكبر من نفعهما এতদুভয়ের (মদ ও জুয়া) গুনাহ,উভয়ের উপকারের চেয়ে বড় (জঘন্য)। 95

অর্থাৎ মদপানকে বড় গুনাহ ও পাপ বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর এক আয়াতে সকল পাপকর্মকে (إثم ) হারাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে :

) قل إنّما حرّم ربّى الفواحش ما ظهر منها و ما بطن و الأثم(

বলুন,আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও গোপন সকল অশ্লীলতা এবং পাপকর্ম হারাম ঘোষণা করেছেন। 96

এত স্পষ্ট বিবরণের পরও কি পাশ্চাত্যপূজারী নোংরা মানসিকতার লোকেরা মদ হারাম হওয়া সংক্রান্ত আরো পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট ব্যাখ্যার অপেক্ষায় বসে থাকবে?

আমাদের মতে এ বিষয়ে যুক্তিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কেননা মদ সম্পর্কিত চার আয়াতে মদকে নোংরা,অপবিত্র এবং মূর্তি,জুয়া ও শয়তানের কাজের সমপর্যায়ের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে,মদ হারাম। আর স্বার্থ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়-এমন সহজ সরল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ সব আয়াত সবচেয়ে কার্যকরী বর্ণনা ও ব্যাখ্যা।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন,তা হচ্ছে মহানবী (সা.) এ চার আয়াতের সাহায্যে তাঁর চারপাশের পরিবেশকে এই অপবিত্র বস্তু থেকে পবিত্র করেন এবং স্বয়ং ঈমানদারদের ঈমানই আল্লাহর হুকুম কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য জগৎ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েও এ ব্যাপারে তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। এই প্রাণ হরণকারী বস্তুটি বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রে তাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিস্ফল প্রমাণিত হয়েছে। 1933-1935 সালে এলকোহল জাতীয় পানীয় নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। এটি বিরাট ট্র্যাজেডি এবং পাঠকগণ এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ইতিহাসের শরণাপন্ন হতে পারেন।

যাতুর রিকা অভিযান

রিকা (رقاع ) আরবদের পরিভাষায় তালি নামে পরিচিত। কাজেই এই পবিত্র জিহাদকে যাতুর রিকা অভিযান নামকরণের কারণ হচ্ছে এ অভিযানে মুসলমানরা বহু চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হন,যা তালিযুক্ত জামার সাথে তুলনীয়। কখনো কখনো বলা হয়,এ অভিযানকে যাতুর রিকা বলার কারণ মুসলিম সৈনিকগণ পায়ে হেঁটে পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য তাঁদের পায়ে পট্টি জড়িয়েছিলেন।

যা হোক,অন্যান্য অভিযানের মতো এ অভিযান প্রথম পর্যায়ের কোন লড়াই ছিল না;বরং প্রজ্বলিত হবার উপক্রম যুদ্ধের স্ফূলিঙ্গ নির্বাপিত করার জন্যই এ অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ গাতফান -এর দু টি শাখা-গোত্র বনী মাহারির বনী সালাবাহ্ -এর পক্ষ হতে যে অশুভ তৎপরতা চালানো হচ্ছিল,তা দমিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান পরিচালিত হয়।

মহানবী (সা.)-এর নিয়ম ছিল তিনি বিচক্ষণ ও সচেতন ব্যক্তিদের আশে-পাশের এলাকায় পাঠাতেন যাতে তাঁরা সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর কাছে প্রতিবেদন প্রদান করেন। হঠাৎ তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে,এ গোত্র দু টি মদীনা নগরী দখল করার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের চিন্তা-ভাবনা করছে। মহানবী একটি বিশেষ বাহিনী নিয়ে নজ্দের উদ্দেশে গমন করেন এবং শত্রু-ভূখণ্ডের খুব কাছে অবতরণ করেন। ইসলামী বাহিনীর অতীত শৌর্য-বীর্য,ত্যাগ-তিতিক্ষার ঐতিহ্য গোটা আরব উপদ্বীপকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। তাদের আগমনের খবর পেয়ে শত্রুবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে এবং কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়াই পাহাড়ী অঞ্চল ও উচ্চভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

তবে মহানবী যেহেতু এ অভিযানে ফরয নামাযসমূহ সালাতে খাওফ অর্থাৎ ভীতিকর পরিস্থিতিতে নামায আদায়ের নিয়মে পড়েন এবং এ ধরনের নামায কীভাবে পড়তে হবে,তা সূরা নিসার 102তম আয়াতে বলা হয়,সেহেতু অনুমান করা যায়,শত্রু বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও রণপ্রস্তুতি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং যুদ্ধ বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন।

বীরত্বের স্বাক্ষর

ইবনে হিশাম97 ও আমীনুল ইসলাম তাবারসী-এর মতো সীরাত রচয়িতা ও মুফাসসিরগণ এ অভিযানের বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কতক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন,যা শত্রুবাহিনীর মোকাবেলায় মহানবী (সা.)-এর বীরত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এর সাদৃশ্যপূর্ণ বর্ণনা আমরা যি আমর অভিযান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। বর্ণনা সংক্ষেপ করার প্রয়োজনে আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না।

ইসলামের ধৈর্যশীল রক্ষীগণ

ইসলামের সৈনিকগণ যদিও এ অভিযানে সম্মুখ লড়াই ছাড়াই মদীনায় ফিরে আসেন,তবুও সামান্য কিছু মালে গনীমত তাঁদের হস্তগত হয়। ফেরার পথে একটি বিশাল উপত্যকায় তাঁরা রাতটা বিশ্রামে কাটান। মহানবী (সা.) দু জন বীর যোদ্ধাকে উপত্যকার প্রবেশপথ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁদের নাম ছিল আব্বাদ আম্মার । তাঁরা দু জন রাতের ঘণ্টাগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। সে হিসেবে রাতের প্রথম ভাগের পাহারার দায়িত্ব পড়ে আব্বাদের উপর।

গাতফান গোত্রের এক লোক মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করার মানসিকতা পোষণ করছিল। সে যে কোন ভাবে মুসলমানদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছিল। লোকটি রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নামাযরত প্রহরীর দিকে তীর নিক্ষেপ করে। কিন্তু প্রহরী নামাযে এতখানি বিভোর ছিলেন যে,তিনি তীরের আঘাত খুব সামান্যই অনুভব করেন এবং তীরটি নিজের পা থেকে বের করে পুনরায় নামাযে মশগুল হয়ে যান। কিন্তু শত্রুর আক্রমণের তিন বার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তৃতীয় বারে তীরটি খুব শক্তভাবে তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়। ফলে মনের মাধুরি মিশিয়ে আর নামাযে তন্ময় হয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। কাজেই খুব সংক্ষিপ্ত রূকূ ও সিজদা সহকারে নামায শেষ করে আম্মারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন।

আব্বাদের হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখে আম্মার দারুণভাবে মর্মাহত হন এবং অনেকটা প্রতিবাদী সুরে বলেন : কেন তুমি আমাকে শুরুতে জানালে না?”   আহত প্রহরী তাঁকে বললেন : আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাতে মশগুল ছিলাম এবং পবিত্র কুরআনের একখানা সূরা তেলাওয়াত করছিলাম। হঠাৎ প্রথম তীরটি আমাকে আঘাত করে। মহান আল্লাহর কাছে নিভৃতে দুআ এবং তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করার স্বাদ আমাকে নামায ভঙ্গ করতে বারণ করে। যদি মহানবী (সা.) আমাকে এ উপত্যকার পাহারার দায়িত্ব প্রদান না করতেন,তা হলে কিছুতেই আমার নামায এবং যে সূরা পাঠ করছিলাম,তাতে বিরতি টানতাম না;বরং মহান আল্লাহর কাছে মুনাজাতরত অবস্থায় আমার প্রাণটি দিয়ে দিতাম। কখনো নামায মাঝখানে শেষ করার চিন্তাও করতাম না 98


10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53