চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79217
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79217 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মহানবী (সা.)-এর যাত্রা

অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুপক্ষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার মূলনীতি রক্ষার জন্য যাত্রার নির্দেশ জারীর মুহূর্ত পর্যন্ত যাত্রা করার সময়কাল, গতিপথ এবং লক্ষ্যস্থল কারো কাছেই স্পষ্ট ছিল না। হিজরতের অষ্টম বর্ষের 10 রমযান যাত্রার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে মদীনার সকল মুসলমানকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

মহানবী (সা.) মদীনা থেকে বের হওয়ার দিন আবু রহম গিফারী নামের এক লোককে মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে মদীনার অদূরে মুসলিম সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করতে যান। তিনি মদীনা থেকে একটু দূরে কাদীদ্’ নামক স্থানে গিয়ে সামান্য পানি আনিয়ে রোযা ভঙ্গ করলেন এবং সবাইকে রোযা ভাঙার আদেশ দিলেন। অনেকেই রোযা ভাঙলেন, কিন্তু অল্প সংখ্যক ব্যক্তি মনে করল যে, তারা রোযা রেখে জিহাদ করলে তাদের পুরস্কার বা সওয়াব আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে। সেজন্য তারা রোযা ভঙ্গ করা থেকে বিরত রইল।

এ সব সরলমনা লোক মোটেই ভাবে নি যে, যে নবী রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, সেই নবী আবার তাদেরকে রোযা ভঙ্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যদি সৌভাগ্যের নেতা ও সত্যপথ প্রদর্শক হয়ে থাকেন, তা হলে তিনি উভয় অবস্থা এবং উভয় নির্দেশ দানের ক্ষেত্রেও জনগণের সৌভাগ্যই কামনা করবেন এবং তাঁর নির্দেশসমূহের মধ্যে কোন বৈষম্যের অস্তিত্ব নেই।339

মহানবী (সা.) থেকে অগ্রগামী হওয়া অর্থাৎ তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এ ধরনের মনোবৃত্তি আসলে সত্য থেকে এক ধরনের বিচ্যূতি এবং তা আসলে মহানবী ও তাঁর শরীয়তের প্রতি এদের পূর্ণ বিশ্বাস না থাকার কথাই ব্যক্ত করে। এ কারণেই পবিত্র কুরআন এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করে বলেছে :

) يا أيّها الّذين آمنوا لا تُقدّموا بين يدى الله و رسوله(

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না।” (সূরা হুজুরাত : 1)

আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব মক্কা নগরীতে বসবাসরত মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তিনি গোপনে মহানবীকে কুরাইশদের (গৃহীত) সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে অবহিত করতেন। তিনি খাইবর যুদ্ধের পর ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন; তবে কুরাইশ নেতাদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি সর্বশেষ মুসলিম পরিবার হিসেবে পবিত্র মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। আর মহানবী (সা.) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং পথিমধ্যে জুহ্ফাহ্ অঞ্চলে মহানবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। মক্কা বিজয়কালে আব্বাসের উপস্থিতি অনেক কল্যাণকর এবং উভয় পক্ষের জন্য উপকারী হয়েছিল। আর তিনি না থাকলে হয় তো কুরাইশদের প্রতিরোধবিহীন অবস্থায় মক্কা বিজয় সম্পন্ন হতো না।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশেই তাঁর মক্কা ত্যাগ করে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করা মোটেই অসম্ভব নয় যাতে করে তিনি এর মধ্যে তাঁর শান্তিকামী ও মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

ক্ষমতা থাকা সত্বেও ক্ষমা প্রদর্শন

মহানবী (সা)-এর উজ্জ্বল জীবনেতিহাস, তাঁর সুমহান নৈতিক চরিত্র ও উন্নত মানসিকতা এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা তাঁর জ্ঞাতি-গোত্র ও নিকটাত্মীয়দের কাছে স্পষ্ট ছিল এবং মহানবীর সকল আত্মীয় জানতেন যে, তিনি সমগ্র গৌরবময় জীবনে কখনোই পাপ ও অন্যায়ের পেছনে যান নি, কারো ওপর সামান্যতম যুলুম করার ইচ্ছা করেন নি এবং সত্যের পরিপন্থী কোন কথা তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় নি। এ কারণেই তাঁর সাধারণ জনতার প্রতি আহবান বা দীনের দাওয়াত দেয়ার প্রথম দিনেই বনী হাশিমের প্রায় সকল লোক তাঁর আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং তাঁরা তাঁর চারপাশে প্রদীপের কাছে পতঙ্গ যেমন জড়ো হয়, তেমনি সমবেত হয়েছিলেন।

একজন সুবিবেচক প্রাচ্যবিদ340 এ ব্যাপারকে মহানবীর পবিত্রতা, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার প্রতীক বলে বিবেচনা করেছেন এবং বলেছেন : কোন ব্যক্তি, তা তিনি যতই সতর্ক এবং রক্ষণশীল হোন না কেন, বংশ ও নিকটাত্মীয়-স্বজনদের কাছে ব্যক্তিগত জীবনের সমুদয় দিক গোপন রাখতে সক্ষম নন। মুহাম্মদ মন্দ মন-মানসিকতা ও চরিত্রের অধিকারী হলে তা কখনোই তাঁর নিকটাত্মীয় ও গোত্রের কাছে গোপন থাকত না এবং তারা এত তাড়াতাড়ি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন না ও ঝুঁকে পড়তেন না।”

বনী হাশিমের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েক ব্যক্তি তাঁর প্রতি ঈমান আনে নি এবং আবু লাহাবের পরে আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আবী উমাইয়্যা নাম্নী মহানবী (সা.)-এর মাত্র দু জন আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যারা তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন তো করেই নি; বরং সত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং মহানবীকে মত্রাতিরিক্ত কষ্ট দিত।

আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস মহানবীর পিতৃব্যপুত্র এবং তাঁর দুধ-ভাই ছিল এবং মহানবীর নবুওয়াত লাভের আগে তাঁর প্রতি অত্যন্ত মমতা ও ভালোবাসা পোষণ করত। কিন্তু নবুওয়াত লাভের পর মহানবীর কাছ থেকে সে তার পথকে পৃথক করে ফেলে। উম্মে সালামার ভাই আবদুল্লাহ্ মহানবীর ফুফু ও আবদুল মুত্তালিবের কন্যা আতিকার পুত্র ছিল।

সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার এ দু ব্যক্তিকে মক্কা ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। মহানবী (সা.) যখন মক্কা বিজয়ের জন্য যাত্রা করছেন, তখন পথিমধ্যে সানীয়াতুল উকাব’ বা নাবকুল উকাব’-এ মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। মহানবীর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দানের ব্যাপারে তাদের শত পীড়াপীড়ি সত্বেও মহানবী তাদের কথা মেনে নেন নি। এমনকি উম্মে সালামাহ্ অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কণ্ঠে সুপারিশ করলেন। কিন্তু মহানবী তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন : এটা ঠিক যে, আবু সুফিয়ান আমার পিতৃব্যপুত্র; কিন্তু সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তিটি আমার কাছে অনেক অযৌক্তিক আবদার করেছিল341 এবং সে নিজেও অন্যদের ঈমান আনার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মহানবীর মন-মানসিকতা এবং তাঁর আবেগ-অনুভূতি উদ্দীপ্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাদের দু জনকে বললেন : আপনারা মহানবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং ইউসুফের ভাইয়েরা নিজেদের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য যে কথা তাঁকে বলেছিল, আপনারাও তাঁকে তা বলুন।”

ইউসুফের ভাইয়েরা ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছিল :

) لقد آثرك الله علينا و إن كنّا لخاطئين(

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাকে আমাদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন এবং (নিশ্চয়ই) আমরা পাপী।” (সূরা ইউসুফ : 91)

হযরত ইউসূফ (আ.) এ বাক্য শোনার পর তাদেরকে নিম্নোক্ত কথা বলে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন :

) لا تثريب عليكم اليوم يغفر الله لكم و هو أرحم الرّاحمين(

“আজ তোমাদের থেকে জবাবদিহি আদায় করা হবে না। মহান আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করে দিন এবং তিনিই সবচেয়ে দয়ালু।” (সূরা ইউসূফ : 92)

এরপর হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) আরো বললেন : যদি আপনারা প্রথম বাক্য উচ্চারণ করেন, তা হলে তিনি অবশ্যই দ্বিতীয় বাক্যের দ্বারা এর জবাব দেবেন; কারণ তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনোই মানতে প্রস্তুত নন যে, অন্য কোন ব্যক্তি তাঁর চেয়ে অধিকতর মিষ্টভাষী হোক।” যে পথ হযরত আলী (আ.) তাদেরকে দেখিয়েছিলেন, সে পথই তারা অবলম্বন করলেন। মহানবীও হযরত ইউসূফ (আ.)-এর মতো তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তারা দু জনই তখন থেকেই জিহাদের পোশাক পরিধান করেন। তারা তাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওহীদী আদর্শ ও দ্বীন ইসলামের ওপর অটল থেকেছেন। অতীত জীবনের ক্ষতিপূরণ করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান একটি কাসীদাহ্ রচনা করেন যা নিম্নরূপ :

لـعمـرك إنّى يوم أحـمل راية

لتغلب خـيل اللّات خـيل مـحمّد

فكالـمدلج الحيران أظـلم  ليله

فهذا أوانِى حـين أهدي  فـاهتدى

-তোমার জীবনের শপথ, যেদিন আমি পতাকা কাঁধে বহন করছিলাম, যাতে করে লাতের (মক্কাস্থ জাহিলী যুগের একটি মূর্তির নাম) বাহিনী মুহাম্মদের বাহিনীর ওপর হয় জয়যুক্ত, সেদিন আমি ছিলাম রাতের উদ্ভ্রান্ত পথিকের মতো, যে আঁধারে পথ চলে। তবে এখন হচ্ছে ঐ সময় যখন আমাকে পথ প্রদর্শন করানো হবে; অতএব, আমি সুপথ প্রাপ্ত হব।342

ইবনে হিশাম লিখেছেন : মহানবী (সা)-এর পিতৃব্যপুত্র আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব তাঁর কাছে নিম্নোক্ত বার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন : যদি আপনি আমার ঈমান আনার ব্যাপারে স্বীকৃতি না দেন, তা হলে আমি আমার শিশুপুত্রের হাত ধরে মরু-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াব (এবং সেখানে বাকী জীবন কাটিয়ে দেব)।343

উম্মে সালামাহ্ মহানবী (সা.)-এর আবেগকে উদ্দীপ্ত করার জন্য তখন বললেন : আমরা আপনার কাছ থেকে বারবার শুনেছি :إنّ الإسلام يَجُبُّ ما كان قبله নিশ্চয়ই ইসলাম মানুষকে তার অতীত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় (অর্থাৎ তার অতীত জীবনের পাপকে মুছে দেয়)।” আর এ কারণেই মহানবীও তাঁদের দু জনকে গ্রহণ করে নিলেন।344

ইসলামী সেনাবাহিনীর আকর্ষণীয় রণকৌশল

মাররুয যাহরান মক্কা নগরী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মহানবী (সা.) পূর্ণ দক্ষতার সাথে পবিত্র মক্কার প্রান্তসীমা পর্যন্ত দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পরিচালনা করেন। ঐ সময় কুরাইশ ও তাদের গুপ্তরচরা এবং ঐ সব ব্যক্তি, যারা তাদের স্বার্থে কাজ করত, কষ্মিনকালেও ইসলামী সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা সম্পর্কে অবগত ছিল না। মহানবী মক্কাবাসীদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার, মক্কা নগরীর বাসিন্দাদের প্রতিরোধ করা ছাড়াই আত্মসমর্পণ এবং এ বিশাল ঘাঁটি ও পবিত্র কেন্দ্র বিনা রক্তপাতে জয় করা সম্ভব করে তোলার জন্য নির্দেশ দেন, মুসলিম সৈন্যরা উঁচু উঁচু এলাকায় গিয়ে আগুন জ্বালাবে। তিনি অধিক ভীতি সৃষ্টির জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে পৃথক পৃথকভাবে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেন, যাতে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার একটি (উজ্জ্বল) রেখা সবগুলো পাহাড় ও উঁচু এলাকা ছেয়ে ফেলে।

কুরাইশ ও তাদের মিত্ররা সবাই তখন গভীর নিদ্রামগ্ন। অন্যদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় উঁচু এলাকাগুলো বিশাল অগ্নিকুণ্ডের রূপ দান করেছিল এবং মক্কাবাসীদের বাড়িগুলোকে আলোকিত করে ফেলেছিল। এর ফলে মক্কাবাসীদের অন্তরে ভীতির সৃষ্টি হয় এবং উঁচু এলাকাগুলোর দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।

তখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং হাকীম ইবনে হিশামের ন্যায় মক্কার কুরাইশ নেতারা প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য মক্কার বাইরে এসে অনুসন্ধান কাজে মনোনিবেশ করে।

জুহ্ফাহ্ থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে সর্বক্ষণ পথ চলার সাথী আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব চিন্তা করলেন, ইসলামী সেনাবাহিনী কুরাইশদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে কুরাইশ বংশীয় বহু লোক নিহত হবে। তাই শ্রেয়তর হবে যদি তিনি উভয় পক্ষের কল্যাণার্থে কোন ভূমিকা পালন করেন এবং কুরাইশদের আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করেন।

তিনি মহানবীর সাদা খচ্চরের উপর আরোহণ করে রাতের বেলা পবিত্র মক্কার পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকেন, যাতে তিনি মক্কা নগরী অবরোধের কথা কুরাইশ নেতাদের গোচরীভূত করেন এবং তাদেরকে ইসলামী সেনাবাহিনীর সংখ্যাধিক্য ও তাঁদের বীরত্বব্যঞ্জক মনোবল ও সাহসিকতা সম্পর্কে জ্ঞাত করেন এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে, আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।

তিনি দূর থেকে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকার কথোপকথন শুনতে পেলেন। তারা বলছিল :

আবু সুফিয়ান : আমি এ পর্যন্ত এত প্রকাণ্ড আগুন এবং এত বিশাল সেনাবাহিনী দেখি নি!

বুদাইল ইবনে ওয়ারকা : তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত খুযাআহ্ গোত্র হবে।

আবু সুফিয়ান : যারা এত প্রকাণ্ড আগুন প্রজ্বলিত করছে এবং এত বড় সেনাছাউনী স্থাপন করেছে, তাদের চেয়ে খুযাআহ্ গোত্র সংখ্যায় অতি অল্প।

এরই মধ্যে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব সেখানে এসে তাদের কথা থামিয়ে দিয়ে আবু সুফিয়ানকে সম্বোধন করে বললেন : আবু হানযালাহ্ (আবু সুফিয়ানের উপনাম)! আবু সুফিয়ান আব্বাসের কণ্ঠধ্বনি চিনতে পেরে বলল : আবুল ফযল (আব্বাসের উপনাম)! আপনি কী বলেন? আব্বাস তখন বললেন : মহান আল্লাহর শপথ! এ অগ্নিকুণ্ড ও শিখাগুলোর সবই মুহাম্মদের সৈন্যদের। তিনি এক শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে কুরাইশদের কাছে এসেছেন এবং কখনোই এ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কুরাইশদের হবে না।”

আব্বাসের এ কথাগুলো আবু সুফিয়ানের গায়ে তীব্র কম্পন সৃষ্টি করে। তখন তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল এবং তার দাঁতে খিল লাগার উপক্রম হয়েছিল। সে হযরত আব্বাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল : আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য উৎসর্গীকৃত হোক! এখন উপায় কী?

আব্বাস বললেন : একমাত্র উপায় হচ্ছে এটাই যে, তুমি আমার সাথে মহানবীর সকাশে সাক্ষাৎ করতে যাবে এবং তাঁর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করবে; আর তা না হলে কুরাইশদের জীবন হুমকির সম্মুখীন।”

অতঃপর তিনি তাকে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে ইসলামী সেনাশিবিরের দিকে গমন করেন এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের জন্য আবু সুফিয়ানের সাথে আসা ঐ দু ব্যক্তি পবিত্র মক্কায় ফিরে গেল।

আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের উদ্যোগ ইসলামের স্বার্থে এসেছিল এবং তা কুরাইশদের চিন্তাশীল ব্যক্তিটি অর্থাৎ আবু সুফিয়ানকে ইসলামের ক্ষমতা ও মুসলিম সেনাবাহিনী সম্পর্কে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত করেছিল যে, একমাত্র আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় আসছিল না। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি আবু সুফিয়ানকে পবিত্র মক্কায় ফিরে যেতে বাধা দেন, রাতের বেলা তাকে মুসলিম সেনাশিবিরে নিয়ে আসেন, সব দিক থেকে তার পথ আটকে দেন এবং তাকে আর মক্কায় ফিরে যেতে দেন নি। কারণ, মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার পর চরমপন্থী কুরাইশদের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কয়েক ঘণ্টা প্রতিরোধ করার জন্য নির্বোধের ন্যায় তার হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করার সম্ভাবনা ছিল।

মুসলিম সেনাশিবিরের মাঝখান দিয়ে আবু সুফিয়ানসহ আব্বাসের গমন

মহানবী (সা.)-এর পিতৃব্য আব্বাস মহানবীর বিশেষ খচ্চরটির পিঠে বসা ছিলেন এবং আবু সুফিয়ানকে নিজের সাথে রেখেছিলেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রজ্বলিত প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ডগুলোর মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যেসব সেনারক্ষী হযরত আব্বাস ও মহানবীর বিশেষ খচ্চর চিনত তারা তাঁর পথ অতিক্রম করার ব্যাপারে বাধা দেয় নি; বরং তারা তাঁর জন্য পথ খুলে দিচ্ছিল।

পথিমধ্যে খচ্চরের পিঠে হযরত আব্বাসের পেছনে বসা আবু সুফিয়ানের উপর দৃষ্টি পড়লে হযরত উমর তাকে সেখানেই হত্যা করতে চাইলেন। কিন্তু মহানবীর চাচা তাকে নিরাপত্তা দান করায় তিনি এ চিন্তা ত্যাগ করেন। অবশেষে মহানবীর তাঁবুর অদূরে আব্বাস ও আবু সুফিয়ান খচ্চরের পিঠ থেকে নামেন। মহানবীর চাচা অনুমতি নিয়ে তাঁর তাঁবুতে প্রবেশ করেন এবং তাঁর উপস্থিতিতে হযরত আব্বাস ও হযরত উমরের মধ্যে ভীষণ বিতর্ক হয়। উমর পীড়াপীড়ি করছিলেন যে, আবু সুফিয়ান মহান আল্লাহর শত্রু এবং এখনই তাকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু আব্বাস বলছিলেন : আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি এবং আমার নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং তা সম্মানিত বলে বিবেচনা করতে হবে।” মহানবী (সা.) এক কথায় এ বিতর্কের অবসান ঘটান এবং হযরত আব্বাসকে নির্দেশ দেন, তিনি আবু সুফিয়ানকে সারা রাত একটি তাঁবুতে আটকে রাখবেন এবং সকালে তাকে তাঁর কাছে উপস্থিত করবেন।

মহানবী (সা.) সকাশে আবু সুফিয়ান

হযরত আব্বাস সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আবু সুফিয়ানকে মহানবীর কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর চারপাশ মুহাজির ও আনসারগণ ঘিরে রেখেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি আবু সুফিয়ানের উপর পড়লে তিনি বললেন : মহান আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই- এ সত্য তোমার উপলব্ধির কি এখনো সময় হয় নি? আবু সুফিয়ান তাঁর উত্তরে বলেছিল : আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি আপনার নিজ আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে কতখানি ধৈর্যশীল, উদার এবং দয়াবান! আমি এখন বুঝেছি, যদি মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মাবুদ থাকত, তা হলে সে আমাদের স্বার্থে একটা কিছু অবশ্যই করত।” মহান আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে আবু সুফিয়ানের স্বীকারোক্তির পর মহানবী বললেন : আমি যে মহান আল্লাহর নবী, তা তোমার জানার সময় কি এখনো হয় নি? আবু সুফিয়ান তখন পূর্বের উক্তির পুনারাবৃত্তি করে বলল : আপনি আপনার নিজ জ্ঞাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে কতখানি ধৈর্যশীল, উদার ও দয়াবান! আমি এখন আপনার রিসালাতের ব্যাপারেই চিন্তা করছি।” আব্বাস আবু সুফিয়ানের দ্বিধাগ্রস্ততা দেখে মর্মাহত হলেন এবং বললেন : যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ না কর, তা হলে তোমার প্রাণ হুমকির সম্মুখীন হবে। তোমার উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহান আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাতের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া।” আবু সুফিয়ান তখন মহান আল্লাহর একত্ব ও রাসূলুল্লাহর রিসালাতের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি প্রদান করে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

আবু সুফিয়ান ভয়-ভীতির মাঝে ঈমান আনয়ন করেছিল এবং এ ধরনের ঈমান আনা কখনোই মহানবী (সা.) এবং তাঁর দীনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না। তবে কতিপয় কল্যাণের ভিত্তিতে আবু সুফিয়ানের মুসলমানের কাতারভুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল, যাতে করে মক্কার অধিবাসীদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পথে বিদ্যমান সবচেয়ে বড় বাধা এভাবে অপসারিত হয়ে যায়। কারণ আবু সুফিয়ান, আবু জাহল, ইকরামাহ্, সাফওয়া ইবনে উমাইয়্যা সহ কয়েকজনের মতো কতিপয় (প্রভাবশালী) ব্যক্তি বহু বছর ধরে (21 বছর) এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিল এবং কোন ব্যক্তি ইসলামের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা বা এ ধর্মের প্রতি নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করার সাহস পর্যন্ত পেত না। আবু সুফিয়ানের বাহ্যিক ইসলাম গ্রহণ তার নিজের জন্য সুফল বয়ে না আনলেও মহানবী (সা.) এবং যেসব ব্যক্তি তার কর্তৃত্বাধীন ছিলেন এবং তার সাথে যাঁদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল, তাঁদের জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর হয়েছিল।

এ সত্বেও মহানবী (সা.) আবু সুফিয়ানকে ছেড়ে দেবার নির্দেশে প্রদান করলেন না। কারণ মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আবু সুফিয়ানের উস্কানীমূলক তৎপরতায় হাত দেয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এ কারণে তিনি কতিপয় প্রমাণবশত একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় তাকে আটকে রাখার জন্য হযরত আব্বাসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত আব্বাস তখন মহানবীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন : যে আবু সুফিয়ান নেতৃত্ব, মর্যাদা ও গৌরব খুব পছন্দ করে, এখন তার অবস্থা যখন এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তখন এ মহা ঘটনা প্রবাহে তাকে (অন্তত) একটা মর্যাদা দান করুন।”

দীর্ঘ বিশ বছর যাবত আবু সুফিয়ান ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর বড় বড় আঘাত হানা সত্বেও মহানবী (সা.) কিছু কল্যাণের ভিত্তিতে তাকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তাঁর মহৎ আত্মারই পরিচায়ক ঐতিহাসিক বাক্য তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন :

আবু সুফিয়ান জনগণকে নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারবে যে, যে কেউ মসজিদুল হারামের সীমারেখার মধ্যে আশ্রয় নেবে বা মাটির উপর অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের নিরপেক্ষ থাকার কথা ঘোষণা দেবে বা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে (ভিন্ন বর্ণনা মতে হাকিম ইবনে হিযামের ঘরে), সে মুসলিম সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবে।345