চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84014 / ডাউনলোড: 7997
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

পবিত্র মক্কার রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ

মুসলিম সেনাবাহিনী পবিত্র মক্কার কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে পৌঁছে গেল। মহানবী (সা) প্রতিরোধ ও রক্তপাতের ঘটনা ছাড়াই মক্কা নগরী জয় করতে এবং শত্রুপক্ষকে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন।

গোপনীয়তা সংরক্ষণ ও শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার মূলনীতি ছাড়াও এ মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের ব্যাপারে যেসব কারণ সাহায্য করেছিল এবং অনুকূলে কাজ করছিল, সেসবের মধ্যে এটাও ছিল যে, মহানবীর চাচা আব্বাস একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কুরাইশদের কাছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে (কৌশলে) মুসলিম সেনাশিবিরে নিয়ে আসেন। আর আবু সুফিয়ানকে ছাড়া কুরাইশ নেতারা কোন জোরালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারত না।

আবু সুফিয়ান যখন মহানবী (সা.)-এর অভূতপূর্ব মর্যাদা ও গৌরবের সামনে মাথা নত করল এবং ঈমান আনার ঘোষণা দিল, তখন মহানবী মুশরিকদের আরো হতাশাগ্রস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করার ব্যাপারে এ অবস্থার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে চাইলেন। তাই তিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁর চাচা আব্বাস যেন আবু সুফিয়ানকে একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আটকে রাখেন যাতে করে ইসলামের নবগঠিত সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ নিজেদের বড় বড় অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি সহ তার সামনে দিয়ে প্যারেড করে যেতে পারে। এভাবে সে ইসলামের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাবে এবং পবিত্র মক্কায় ফিরে গিয়ে সেখানকার জনগণকে ইসলামের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভয় দেখাবে এবং তাদের মাথা থেকে প্রতিরোধের সকল চিন্তা দূর করে দেবে।

এখন ইসলামী সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের বর্ণনা নিম্নে দেয়া হলো :

১. খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে বনী সালীম গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার দল। তাঁদের দু টি পতাকা ছিল এবং এর একটি ছিল আব্বাস ইবনে মিরদাসের হাতে এবং অন্যটি মিকদাদের হাতে।

২. যুবাইর ইবনে আওয়ামের নেতৃত্বাধীন পাঁচ শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দু টি ব্রিগেড। তাঁর হাতে একটি কালো পতাকা ছিল। এ দু টি ব্রিগেডের অধিকাংশ যোদ্ধাই মুহাজির ছিলেন।

৩. আবু যার গিফারীর নেতৃত্বাধীন বনী গিফার গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত সেনাদল। আবু যারের হাতে এ দলটির পতাকা ছিল।

৪. ইয়াযীদ ইবনে খুসাইবের নেতৃত্বে বনী আসলাম গোত্রের চার শ’ যোদ্ধা দ্বারা গঠিত সেনাদল। এ দলের পতাকা ইয়াযীদ ইবনে খুসাইবের হাতে ছিল।

৫. বাশার বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন বনী কা ব গোত্রের পাঁচ শ’ যোদ্ধার দল। এ দলের পতাকা বাশার বিন সুফিয়ান বহন করছিলেন।

৬. মুযাইনা গোত্রের এক হাজার যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দল। এর তিনটি পতাকা ছিল। এ সব পতাকা নুমান ইবনে মাকরা, বিলাল ইবনুল হারিস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর বহন করছিলেন।

৭. জুহাইনাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দল। এর চারটি পতাকা যথাক্রমে মা’বাদ ইবনে খালিদ, নুওয়াইদ ইবনে সাখরা, রা ফে ইবনে মালীস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে বাদর বহন করছিলেন।

৮. আবু ওয়াকিদ লাইসীর নেতৃত্বে বনী কিনানাহ্, বনী লাইস ও যামরাহ্ গোত্রের আট শ’ যোদ্ধার দু টি দল এবং তাদের পতাকা আবু ওয়াকিদ লাইসীর হাতে ছিল।

৯. বনী আশজা’ গোত্রের তিন শ’ যোদ্ধার দল, যার দু টি পতাকার একটি মাকাল ইবনে সিনান ও অপরটি নাঈম ইবনে মাসউদের হাতে ছিল।৩৪৬

এ সেনা ইউনিটগুলো আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে সাথে সাথে হযরত আব্বাসকে সেনা ইউনিটগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করছিল এবং তিনিও বেশ উত্তর দিচ্ছিলেন।

যে বিষয়টি এ সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করেছিল, তা ছিল এই, যখনই আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের সামনে সেনা ইউনিটসমূহের অধিনায়কগণ প্যারেড করে উপস্থিত হচ্ছিলেন, তখনই তাঁরা তিন বার উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিচ্ছিলেন এবং ইউনিটসমূহের সৈনিকরাও অধিনায়কদের তাকবীর দেবার পরপরই সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী স্লোগান হিসেবে তিন বার উচ্চকণ্ঠে তাকবীর দিতে থাকেন। এ তাকবীর পবিত্র মক্কা নগরীর উপত্যকাসমূহে এতটা প্রতিধ্বনিত হয় যে, তা মিত্রদের ইসলাম ধর্মের প্রতি আরো অনুরাগী করে তুলে এবং শত্রুদের অন্তর বিদীর্ণ করে ও তাদেরকে ভয়-ভীতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে।

আবু সুফিয়ান একেবারে ধৈর্যহারা হয়ে এমন এক সেনা ইউনিটকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল যার মাঝে মহানবী (সা.) থাকবেন। তাই তার সামনে দিয়ে প্রতিটি ইউনিট কুচকাওয়াজ করে অতিক্রম করার সময় হযরত আব্বাসকে জিজ্ঞেস করছিল : মুহাম্মদ কি এ ইউনিটের মধ্যে আছেন? তিনি জবাবে বলছিলেন : না।” অবশেষে এক বিশাল সেনাদল যার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার, আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উল্লেখ্য, এ সেনাদলে বর্ম পরিহিত দু হাজার সৈন্য ছিল এবং এক নির্দিষ্ট দূরত্বে অসংখ্য পতাকা সেনাদলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের অধিনায়কদের হাতে ছিল। এ সেনা ইউনিটটির নাম ছিল আল কাতীবাতুল খাদরা’ অর্থাৎ সবুজ ব্রিগেড’ যা আপাদমস্তক সশস্ত্র ও যুদ্ধের উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। এ সেনাদলের সৈন্যদের পুরো দেহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। কেবল তাদের উজ্জ্বল চোখগুলো ছাড়া দেহের আর কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এ সেনাদলের মধ্যে দ্রুতগামী আরবী ঘোড়া ও লাল পশমের উট বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।

মহানবী (সা.) এ সেনাদলের মাঝখানে তাঁর বিশেষ উটের উপর সওয়ার হয়ে পথ চলছিলেন এবং বড় বড় আনসার ও মুহাজির সাহাবী তাঁর চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবী তখন তাঁদের সাথে কথোপকথন করছিলেন।

এ সেনাদলের মর্যাদা ও গৌরব আবু সুফিয়ানকে এতটা ভীত করেছিল যে, সে নিজের অজান্তেই আব্বাসের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল : এ সেনাবাহিনীর সামনে কোন শক্তিই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। আব্বাস! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্রের রাজত্ব, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।”

আব্বাস এ কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিরস্কার করে বললেন : আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নবুওয়াত ও রিসালাত; আর পার্থিব শক্তিগুলোর সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই।”

মক্কার পথে আবু সুফিয়ান

এ পর্যন্ত আব্বাস তাঁর ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন এবং আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামরিক শক্তি সম্পর্কে সন্ত্রস্ত করে তোলেন। এ সময় মহানবী আবু সুফিয়ানকে মুক্ত করে দেয়ার মধ্যেই কল্যাণ দেখতে পেলেন। কারণ পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনী প্রবেশ করার আগেই সে সেখানে পৌঁছে সেখানকার অধিবাসীদের মুসলমানদের অস্বাভাবিক শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করবে এবং তাদেরকে সম্ভাব্য মুক্তির পথও দেখাবে। মুক্তির পথ দেখানো ছাড়া কেবল জনগণকে ভয় দেখানোর মাধ্যমে মহানবীর লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে না।

আবু সুফিয়ান মক্কা নগরীতে ফিরে গেল। জনগণ- যারা আগের রাত থেকেই তীব্র অস্থিরতা ও ভীতির মধ্যে ছিল এবং তার সাথে পরামর্শ না করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না- তার চারপাশে জড়ো হলো। সে ফ্যাকাসে মুখে কাঁপতে কাঁপতে মদীনার দিকে ইশারা করে জনগণের দিকে তাকিয়ে বলল :

“দুর্নিবার ইসলামী সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ পুরো শহর ঘিরে ফেলেছে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই শহরে প্রবেশ করবে। তাদের অধিনায়ক ও নেতা মুহাম্মদ আমাকে কথা দিয়েছেন, যে কেউ মসজিদ ও পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেবে বা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে অথবা আমার বা হাকীম ইবনে হিযামের ঘরে প্রবেশ করবে, তার জান-মাল সম্মানিত বলে গণ্য হবে এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।”

মহানবী (সা.) শুধু এটুকুকেও পর্যাপ্ত মনে করেন নি। পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করার পর এ তিন ধরনের আশ্রয়স্থল ছাড়াও আবদুল্লাহ্ ইবনে খাসআমীর হাতে একটি পতাকা দিয়ে নির্দেশ দিলেন, যেন তিনি উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতে থাকেন যে, যে কেউ তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবে সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।৩৪৭

আবু সুফিয়ান এ বাণী ঘোষণা করার মাধ্যমে পবিত্র মক্কার অধিবাসীদের মনোবল এতটা দুর্বল করে দেয় যে, কোন দলের মধ্যে প্রতিরোধ মনোবৃত্তি অবশিষ্ট থাকলেও সার্বিকভাবে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিগত রাত থেকে হযরত আব্বাসের মাধ্যমে যে সব পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়। আর বস্তুবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কুরাইশদের বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজয় একটা সন্দেহাতীত বিষয় হয়ে যায়। জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যে যেখানে পারল সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং পুরো শহর জুড়ে ছুটোছুটি, পলায়ন ও আশ্রয় গ্রহণ চলতে লাগল। এভাবে মহানবী (সা.)-এর প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে ইসলাম ধর্মের প্রধান শত্রু ইসলামী সেনাবাহিনীর অনুকূলে সবচেয়ে বড় সেবাটি আনজাম দিয়েছিল।

ইত্যবসরে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ মক্কাবাসীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাচ্ছিল এবং তার স্বামীর প্রতি অত্যন্ত অশোভন উক্তি করছিল। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় নি। সব ধরনের চিৎকার আসলে কামারের নেহাইয়ের ওপর মুষ্টিবদ্ধ আঘাতস্বরূপ ছিল। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা, ইকারামাহ্ ইবনে আবী জাহল এবং সুহাইল ইবনে আমরের (হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কুরাইশদের বিশেষ প্রতিনিধি) মতো কতিপয় উগ্রবাদী কুরাইশ নেতা শপথ করল, তারা পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী বাহিনীর প্রবেশে বাধা দেবে। আর একদল মক্কাবাসীও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খোলা তলোয়ার হাতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রথম ইউনিটের প্রবেশের পথে বাধা দেয়।

পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রবেশ

পবিত্র মক্কা নগরীর সড়কসমূহে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করার আগেই মহানবী (সা.) সকল সেনাপতিকে উপস্থিত করে বলেছিলেন : বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের জন্যই হচ্ছে আমার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা। তাই নিরীহ জনগণকে হত্যা থেকে তোমাদের অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। তবে ইকরামাহ্ ইবনে আবী জাহল, হাব্বার ইবনে আসওয়াদ, আবদুল্লাহ্ ইবনে সা দ ইবনে আবী সারাহ্, মিকয়াস্ হুবাবাহ্ লাইসী, হুয়াইরিস ইবনে নুকাইয, আবদুল্লাহ্ ইবনে খাতাল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ্, হযরত হামযার ঘাতক ওয়াহ্শী ইবনে হারব, আবদুল্লাহ্ ইবনুয্ যুবাইরী এবং হারিস ইবনে তালাতিলাহ্ নামের দশ জন পুরুষ এবং চার মহিলাকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের হত্যা করতে হবে। উল্লেখ্য, এ দশ ব্যক্তির প্রত্যেকেই হত্যা ও অপরাধ করেছিল বা (ইসলামের বিরুদ্ধে) অতীত যুদ্ধগুলোর আগুন জ্বালিয়েছিল।

এ নির্দেশ সেনাপতি ও সামরিক অধিনায়কগণ তাঁদের নিজ নিজ সকল সৈন্যের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর কাছে মক্কাবাসীদের আত্মিক অবস্থা স্পষ্ট হলেও পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করার সময় তিনি সামরিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সতর্কতামূলক পরিকল্পনা ছিল এরূপ :

সকল সামরিক ইউনিট এক পথে যী তূওয়ায় পৌঁছে। যী তূওয়া একটি উঁচু স্থান, যেখান থেকে পবিত্র মক্কা নগরী, বাইতুল্লাহ্ (কাবা) এবং মসজিদুল হারাম দৃষ্টিগোচর হয়। ঐ সময় মহানবী (সা.) পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি সেনা-ব্রিগেড দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। মহানবীর দৃষ্টি পবিত্র মক্কার ঘর-বাড়িগুলোর উপর পড়লে তাঁর দু চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় এবং কুরাইশদের প্রতিরোধ ছাড়াই যে মহান বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মাথা এতটা নত করেন যে, তাঁর পবিত্র শ্মশ্রূ উটের উপর স্থাপিত গদি স্পর্শ করেছিল। তিনি সতর্কতা অবলম্বন স্বরূপ তাঁর সেনাবাহিনীকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন। একটি অংশকে পবিত্র মক্কার উঁচু অংশ দিয়ে এবং আরেকটি অংশকে পবিত্র মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে পরিচালনা করেছিলেন। এতটুকু করেও তিনি ক্ষান্ত হন নি। তিনি শহরগামী সকল সড়ক থেকে বেশ কয়েকটি সেনা ইউনিট শহরের দিকে প্রেরণ করেন। সকল সেনা ইউনিট সংঘর্ষ ছাড়াই পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে এবং ঐ সময় শহরের দ্বারগুলো উন্মুক্ত ছিল। তবে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বাধীন সেনা ইউনিটের প্রবেশপথের দ্বারে ইকরামাহ্ ও সুহাইল ইবনে আমরের প্ররোচনায় এক দল লোক মুসলিম সেনা ইউনিটটির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা তীর নিক্ষেপ ও তরবারি সঞ্চালন করে মুসলিম সেনা ইউনিটটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল। তবে তাদের বারো বা তের জন নিহত হলে প্ররোচণাকারীরা পালিয়ে যায় এবং অন্যরাও পলায়নে বাধ্য হয়।৩৪৮ আবারও আবু সুফিয়ান এ ঘটনায় নিজের অজান্তেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের অনুকূলে কাজ করেছিল। তখনও ভয়-ভীতি তাকে ঘিরে রেখেছিল এবং সে ভালোভাবে জানত যে, বাধাদান কেবল ক্ষতিই বয়ে আনবে। তাই রক্তপাত এড়ানোর জন্য সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল : কুরাইশ গোত্র! তোমরা তোমাদের জীবন বিপদের সম্মুখীন করো না। কারণ, মুহাম্মদের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধে আসলেই কোন ফায়দা হবে না। তোমরা মাটিতে অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজেদের ঘর-বাড়িতে বসে থাক এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও বা মসজিদুল হারাম ও পবিত্র কাবার প্রাঙ্গণে আশ্রয় নাও। তা হলে তোমাদের জীবন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

আবু সুফিয়ানের এ বক্তব্য কুরাইশদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। তাই একদল কুরাইশ নিজেদের ঘর-বাড়িতে এবং আরেক দল মসজিদুল হারামের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছিল।

মহানবী (সা.) আযাখির নামক একটি স্থান থেকে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের সেনা ইউনিটের সৈন্যদের তরবারি পরিচালনায় সৃষ্ট ঝলকানির দ্যূতি-যা তখন উঠা-নামা করছিল,- দেখতে পেলেন এবং সংঘর্ষের কারণ জানতে পেয়ে বললেন :قضاء الله خير মহান আল্লাহর ফয়সালাই সর্বোত্তম।”

মহানবী (সা.)-কে বহনকারী উট পবিত্র মক্কা নগরীর সবচেয়ে উঁচু এলাকা দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে এবং হুজূন এলাকায় মহানবীর চাচা হযরত আবু তালিবের কবরের পাশে এসে থামে। বিশ্রাম করার জন্য এখানে একটি বিশেষ তাঁবু স্থাপন করা হয়। কারো বাড়িতে থাকার জন্য জোর অনুরোধ করা হলেও মহানবী তা গ্রহণ করেন নি।

মূর্তি ভাঙ্গা ও পবিত্র কাবা ধোয়া

যে মক্কা নগরী বহু বছর যাবত শিরক ও মূর্তিপূজার ঘাঁটি ছিল, তা তাওহীদী আদর্শের (ইসলাম) সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এ নগরীর সকল অঞ্চল ইসলামের সৈনিকদের অধিকারে আসে। হুজূন’ নামক স্থানে মহানবী (সা.) তাঁর জন্য খাটানো তাঁবুতে কিছু সময় বিশ্রাম করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে মহান আল্লাহর ঘর (কাবা) যিয়ারত ও তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামের দিকে রওয়ানা হন। তিনি যুদ্ধের পোশাক ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত ছিলেন এবং আনসার ও মুহাজিরগণ খুব মর্যাদার সাথে তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন। মহানবীর উটের লাগাম মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে ছিল এবং তাঁর চলার পথের দু ধারে মুসলিম ও মুশরিকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। একদল ক্রোধে ও ভীতিজনিত কারণে হতবাক হয়ে গিয়েছিল এবং আরেক দল আনন্দ প্রকাশ করছিল। মহানবী কতিপয় কারণে উটের পিঠ থেকে নামলেন না এবং উটের পিঠে আরোহণ করেই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন। হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) সামনে স্থিত হয়ে হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ ছোঁয়ার পরিবর্তে তাঁর হাতে যে বিশেষ ছড়ি ছিল, তা দিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে তাকবীর দিলেন।

মহানবী (সা.)-এর চারপাশ ঘিরে প্রদীপের চারপাশে ঘূর্ণনরত পতঙ্গের মতো আবর্তিত সাহাবীগণ মহানবীকে অনুসরণ করে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দিলেন। তাঁদের তাকবীর-ধ্বনি মক্কার মুশরিকদের কানে পৌঁছলে তারা নিজেদের বাড়ি এবং উঁচু এলাকাগুলোয় গিয়ে আশ্রয় নিল। মসজিদুল হারামে এক অভিনব শোরগোল প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জনগণের তুমুল হর্ষধ্বনির কারণে মহানবী প্রশান্ত মনে ও চিন্তামুক্তভাবে তাওয়াফ করতে পারছিলেন না। জনগণকে শান্ত করার জন্য মহানবী তাদের দিকে এক ইশারা করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মসজিদুল হারাম জুড়ে সুমসাম নীরবতা নেমে এলো। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন বুকের মধ্যে বন্দী হয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না)। মসজিদুল হারামের ভেতরে ও বাইরে অবস্থানরত জনতার দৃষ্টি তখন তাঁর দিকে নিবদ্ধ ছিল। তিনি তাওয়াফ শুরু করলেন। তাওয়াফের প্রথম পর্যায়েই পবিত্র কাবার দরজার উপর স্থাপিত হুবাল, ইসাফ ও নায়েলা নামের কতিপয় বড় বড় প্রতিমার উপর মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি হাতের বর্শা দিয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত করে ঐ প্রতিমাগুলো মাটিতে ফেলে দিলেন এবং নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন :

) قل جاء الحق و زهق الباطل إنّ الباطل كان زهوقا(

“আপনি বলে দিন : সত্য (গৌরবের সাথে ও বিজয়ী বেশে) প্রকাশিত হয়েছে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা (প্রথম থেকেই) ভিত্তিহীন ছিল।” (সূরা বনী ইসরাঈল)

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে মুশরিকদের চোখের সামনেই হুবালের প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো। এ বড় মূর্তিটি- যা বছরের পর বছর ধরে আরব উপদ্বীপের জনগণের চিন্তা-চেতনার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল,- তাদের চোখের সামনে ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। ঠাট্টা করে যুবাইর আবু সুফিয়ানের দিকে মুখ তুলে বললেন : হুবাল- এ বড় প্রতিমা ভেঙে ফেলা হলো।”

আবু সুফিয়ান অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যুবাইরকে বলেছিল : আমাদের থেকে হাত উঠিয়ে নাও তো (অর্থাৎ এ ধরনের কথা আর বলো না)। হুবালের দ্বারা যদি কোন কাজ হতো, তা হলে পরিণামে আমাদের ভাগ্য এমন হতো না।” আর সে বুঝতে পেরেছিল, তাদের ভাগ্য আসলে কখনোই তার হাতে ছিল না।

তাওয়াফ শেষ হলে মহানবী মসজিদুল হারামের এক কোণে একটু বসলেন। তখন পবিত্র কাবার চাবিরক্ষক ছিল উসমান ইবনে তালহা এবং এ পদটি তার বংশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহাল ছিল। মহানবী (সা.) হযরত বিলালকে উসমানের ঘরে গিয়ে পবিত্র কাবার চাবি নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন। বিলাল চাবিরক্ষকের কাছে মহানবীর নির্দেশবার্তা পৌঁছে দিলেন। কিন্তু তার মা তাকে মহানবীর কাছে চাবি হস্তান্তরে বাধা দিল এবং বলল : পবিত্র কাবার চাবি রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের বংশীয় গৌরব এবং আমরা কখনই এ গৌরব হাতছাড়া হতে দেব না।” উসমান মায়ের হাত ধরে নিজের বিশেষ কক্ষে নিয়ে গিয়ে বলল : আমরা যদি নিজ ইচ্ছায় চাবি না দিই, তা হলে তুমি নিশ্চিত থেকো, বলপ্রয়োগ করে আমাদের থেকে তা নিয়ে নেয়া হবে।”৩৪৯ চাবিরক্ষক এসে পবিত্র কাবার তালা খুলে দিল। মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পেছনে উসামাহ্ ইবনে যায়েদ ও বিলাল প্রবেশ করলেন এবং স্বয়ং চাবিরক্ষকও প্রবেশ করলো। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে পবিত্র কাবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়ে জনতাকে দরজার সামনে ভীড় করা থেকে বিরত রাখছিলেন। পবিত্র কাবার অভ্যন্তরীণ প্রাচীর নবীগণের চিত্রকলা দিয়ে পূর্ণ ছিল। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে কাবার প্রাচীরগুলো যমযম কূপের পানি দিয়ে ধোয়া হলো এবং কাবার দেয়ালে যে সব চিত্র ছিল, সেগুলো উঠিয়ে এনে ধ্বংস করা হলো।

মুনাফিক দলের ভূমিকা

মুনাফিক দলের ভূমিকা ছিল ইহুদীদের চেয়েও মারাত্মক। কেননা মুনাফিকরা বন্ধুর বেশে পেছন থেকে পিঠে ছুরি মারছিল। এদের নেতা ছিল আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও মালেক ইবনে উবাই। এরা মুসলমানদের সামনে বন্ধুত্বের মুখোশ পরেছিল। এরা দ্রুত বনী নাযীর গোত্রের নেতাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায় যে,আমরা দু হাজার সৈন্য দিয়ে তোমাদের সাহায্য করব। আর তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রসমূহ অর্থাৎ বনী কুরাইযাহ্ ও বনী গাতফান তোমাদের একাকী ছেড়ে দেবে না। এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দানের কারণে ইহুদীদের সাহস বেড়ে যায়। শুরুতে তারা আত্মসমর্পণ করে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। তারা দুর্গের প্রবেশদ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয় এবং যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন মূল্যেই হোক,প্রতিরক্ষার লড়াই করবে এবং বিনামূল্যে তাদের ক্ষেত-খামার মুসলমানদের হাতে তুলে দেবে না।

বনী নাযীর গোত্রের অন্যতম সর্দার সালাম ইবনে মুশকাম,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের অঙ্গীকারকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করে এবং বলে,কল্যাণজনক হচ্ছে সবার চলে যাওয়া। কিন্তু হুয়াই ইবনে আখতাব জনসাধারণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানায়।

রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের বার্তা সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনায় স্থলবর্তী হিসেবে রেখে যান এবং তাকবীর ধ্বনি দিয়ে বনী নাযীর গোত্রের দুর্গ অবরোধের জন্য অগ্রসর হন। বনী নাযীর ও বনী কুরাইযার মধ্যবর্তী স্থানে তিনি শিবির স্থাপন করেন এবং উভয় গোত্রের মধ্যেকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী87 ছয় দিন ছয় রাত এবং অন্য কয়েকজনের বর্ণনা মোতাবেক 15 দিন তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু ইহুদীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং দৃঢ়তা প্রদর্শন করে। মহানবী (সা.) দুর্গের আশ-পাশের খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দেন,যাতে ইহুদীরা এ ভূখণ্ডের প্রতি লোভের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়।

এ সময় দুর্গের ভেতর থেকে ইহুদীদের চিৎকার শুরু হয় এবং তারা বলে : হে আবুল কাসেম (মুহাম্মদ)! আপনি সব সময় আপনার সৈন্যদের গাছ-পালা কাটতে নিষেধ করেছেন। এখন কেন সে কাজ করার নির্দেশ দিলেন?”   তবে এর কারণ যেটি ছিল তা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইহুদীরা আগের ফয়সালা মেনে নিতে রাযী হয়ে যায়। তারা একমত হয়ে বলল : আমরা দেশত্যাগ করে চলে যেতে রাযী আছি;তবে শর্ত হলো আমাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি আমাদের সাথে নিয়ে যাব। মহানবী (সা.) এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং বললেন,তারা অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে যেতে পারবে,তবে অস্ত্রগুলো নিতে পারবে না;সেগুলো মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করতে হবে।

লোভাতুর ইহুদীরা তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে যাবার ব্যাপারে যারপর নাই চেষ্টা চালায়। এমনকি ঘরের দরজাগুলোও চৌকাঠসহ নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়। বাকী ঘরগুলো নিজেদের হাতে ভেঙে ফেলে। তাদের একদল খাইবর ও আরেক দল সিরিয়ায় চলে যায়। তবে তাদের কেবল দু ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। পরাজিত ও অপদস্থ এ জাতিটি এ পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার জন্য দফ বাজিয়ে,গান গেয়ে মদীনা ত্যাগ করে এবং এ আচরণের মধ্য দিয়ে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে,এ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তারা ততটা চিন্তিত বা মনঃক্ষুণ্ণ হয় নি।

মুহাজিরগণের মধ্যে বনী নাযীরের ক্ষেত-খামার বণ্টন

ইসলামের সৈনিকগণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া শত্রুপক্ষের কাছ থেকে যে সম্পদ গনীমত হিসেবে লাভ করেন,পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী88 তা সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর মালিকানাধীন। তিনি যেভাবে ভালো মনে করেন,ইসলামের কল্যাণে তা ব্যয় করবেন। মহানবী এটাই কল্যাণকর মনে করলেন যে,এই ক্ষেত-খামার,পানির উৎস ও বাগানগুলো মুহাজিরগণের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কেননা মক্কা থেকে হিজরত করে আসার কারণে তাঁদের হাতে জাগতিক সহায়-সম্পদ ছিল না বললেই চলে। তাঁরা আনসারগণের উপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের মেহমান হিসেবেই ছিলেন। এ মতটিকে সা দ ইবনে উবাদা ও সা দ ইবনে মায়ায সমর্থন করেন। এ কারণে সকল জমি মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণের মধ্যে বণ্টন করা হয় এবং আনসারগণের মধ্যে অত্যন্ত দরিদ্র হবার কারণে সাহল ইবনে হাদীদ এবং আবু দুজানাহ্ ছাড়া অন্য কেউ তার ভাগ পান নি। এভাবে সকল মুসলমানের সার্বিক অবস্থার উন্নতির একটি ব্যবস্থা হয়। বনী নাযীর গোত্রের জনৈক নেতার মূল্যবান তরবারিটি সা দ ইবনে মায়াযকে প্রদান করা হয়।

হিজরী চতুর্থ শতকের রবিউল আউয়াল মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। সূরা হাশরও এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। আমরা দীর্ঘতা এড়ানোর জন্য এ সূরার আয়াতসমূহের অনুবাদ ও তাফসীর হতে বিরত থাকছি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন,এ ঘটনায় কোনরূপ রক্তপাত ঘটে নি। কিন্তু মরহুম শেখ মুফীদ বলেন,বিজয়ের রাতে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে বনী নাযীর গোত্রের দশজন ইহুদী নিহত হয় এবং তারা নিহত হবার ফলে ইহুদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।89

পঁয়ত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মদ ও নেশাকর পানীয় নিষিদ্ধকরণ

মদ এবং সামগ্রিকভাবে মাদকদ্রব্য মানব সমাজের অন্যতম জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক আপদ ছিল এবং এখনো রয়েছে। এ ধ্বংসকারী বিষাক্ত দ্রব্যাদির নিন্দায় এটুকুই যথেষ্ট যে,অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্যের সর্বপ্রধান সম্বল জ্ঞান-বু্দ্ধির সাথে এ মাদকদ্রব্য সাংঘর্ষিক। মানুষের সৌভাগ্য ও কলাণের নিয়ামক হচ্ছে তার জ্ঞান ও বিবেক। অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের যে ব্যবধান,তা মানুষের এ অভ্যন্তরীণ শক্তির উপরই নির্ভরশীল। এলকোহল (মদ) বা মাদকদ্রব্য এর চরম শত্রু। এ কারণে মদ ও নেশাকর পানীয় অর্থাৎ মাদকদ্রব্য সেবন প্রতিরোধ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূলগণের অন্যতম কর্মসূচী ছিল। একই কারণে সকল শরীয়তে মদ সম্পূর্ণ হারাম ঘোষিত হয়েছে।90

আরব উপদ্বীপে মদপান একটি গণ-মুসিবত ও মহামারী আকারে বিদ্যমান ছিল। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার মূলোৎপাটনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। পরিবেশের চাহিদা এবং সাধারণভাবে সব আরবের অবস্থা ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দিচ্ছিল না যে,মহানবী (সা.) কোন পটভূমি ছাড়াই তা হারাম ঘোষণা করবেন। বরং একজন দক্ষ চিকিৎসকের ন্যায় সমাজের মন-মানসিকতাকে আগে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ছিল যাতে চূড়ান্ত ও নিশ্চিত সংস্কার সম্ভবপর হয়। এ কারণে মদপানের নিন্দায় নাযিলকৃত চারখানা আয়াতের ভাষা এক রকম নয়। বরং প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এ আয়াতসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা মহানবীর দ্বীন প্রচারের কর্মকৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। আমাদের মতে বড় বড় বক্তা ও লেখকরা এ পদ্ধতির অনুসরণ করতে পারেন এবং এ পদ্ধতিতেই তাঁরা সমাজের কলুষ ও অনাচারগুলো দূর করার চেষ্টা করতে পারেন।

কোন একটি অন্যায় ও অনাচার প্রতিরোধ করার জন্য মৌলিক শর্ত হলো,প্রথমে সমাজের লোকদের চিন্তা-চেতনা ও বৃহত্তর জনমতকে ঐ অনাচারের ক্ষয়-ক্ষতি ও অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ করা। যতদিন পর্যন্ত সমাজে মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ চেতনার সৃষ্টি না হবে,ততদিন পর্যন্ত কোন অনাচার মৌলিকভাবে মোকাবেলা করা যাবে না। কেননা স্বয়ং মানুষই তো এ সংস্কার-সংশোধনের যিম্মাদার।

যে সমাজে মদপান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল,পবিত্র কুরআন এ দৃষ্টিকোণ থেকে সেখানে প্রথম বারের মতো খেজুর ও আঙুর দ্বারা মদ তৈরিকে উত্তম জীবিকা বা রিয্কে হাসান -এর পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছে। এভাবে সমাজের ঘুমন্ত অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে তা জাগ্রত ও সচেতন করা হয়। এরশাদ হয়েছে :

) و من ثمرات النّخيل و الأعناب تتخذون منه سكرا و رزقا حسنا(

তোমরা খেজুর গাছের ফল ও আঙুর থেকে মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। (সূরা নাহল : 67)

পবিত্র কুরআন প্রথম বারের মতো এ তথ্য কর্ণগোচর করে যে,খেজুর ও আঙুর থেকে মদ তৈরি করা উত্তম খাদ্য নয়;বরং উত্তম খাদ্য হচ্ছে উভয় ফলকে খেজুর ও আঙুর রূপে আহার করা।

এ আয়াত মানুষের চিন্তায় নাড়া দেয় এবং তাদের মানসিকতা এমনভাবে প্রস্তুত করে যাতে পরবর্তীতে আল্লাহ্ তাঁর ভাষাকে আরো কঠোরতর করেন এবং আরেকখানা আয়াতের মাধ্যমে এ কথা ঘোষণা করেন যে,মদ ও জুয়ার দ্বারা যে  আংশিক (পার্থিব) মুনাফা হয়,তা সমুদয় ক্ষয়-ক্ষতির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তুচ্ছ। নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে এ বক্তব্য সমাজের সামনে পেশ করা হয় :

) يسألونك عن الخمر و الميسر قل فيهما اثم كبير و منافع للنّاس و إثمهما أكبر من نفعهما(

তারা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জানতে চায়। বলুন,উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও;কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। 91

নিঃসন্দেহে লাভ ও ক্ষতির মাঝে তুলনা করা এবং লাভের চাইতে ক্ষতির পাল্লা ভারী দেখানো চিন্তাশীল লোকদের মনে ঐ কাজটির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য যথার্থ। কিন্তু সাধারণ লোকদের যতক্ষণ পরিষ্কার ভাষায় নিষেধ করা না হবে,ততক্ষণ নিছক এ ধরনের বাচনভঙ্গি ও বর্ণনা পদ্ধতির দ্বারা তারা অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হয় না।

এমনকি এ আয়াত নাযিল হওয়া সত্বেও আবদুর রহমান ইবনে আউফ এক ভোজসভার আয়োজন করে তাতে খাবার দস্তরখানে মদ পরিবেশন করেন। মেহমানরা মদ পান করার পর নামাযে দাঁড়ান। তাঁদের একজন নামাযে (মদের নেশায়) পবিত্র কুরআনের আয়াত ভুলভাবে তেলাওয়াত করেন,যার ফলে ঐ আয়াতের অর্থই পাল্টে যায়!

অর্থাৎ সূরা কাফিরুন-এلا أعبد ما تعبدون (হে কাফেররা!) তোমরা যার (মূর্তির) উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি না -এর পরিবর্তে এভাবে তেলাওয়াত করেন :أعبد ما تعبدون তোমরা যার উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি -যার অর্থ আয়াতের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়।

এসব ঘটনা মানুষের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করতে থাকে যাতে পরিবেশ ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দেয় যে,অন্তত বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে শরাব (মদ) হারাম ঘোষিত হোক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোষণা করা হয় যে,মাতাল অবস্থায় নামায পড়ার অধিকার কোন মুসলমানের নেই।

আর এ বিধান বা নির্দেশ নিম্নোক্ত আয়াতে ঘোষণা করা হয় :

) لا تقربوا الصّلاة و أنتم سكاري حتّي تعلموا ما تقولوا(

অর্থাৎ মাতাল অবস্থায় নামায পড়ো না। কারণ তোমরা (মাতাল অবস্থায় নামাযে) কী বলছ,তা জান না।

এ আয়াতের প্রভাব এতটা তীব্র ছিল যে,একদল লোক চিরতরে মদ পান ত্যাগ করে এবং তাদের যুক্তি ছিল এই যে,যে জিনিস তোমাদের নামাযের ক্ষতি করে,তা অবশ্যই তোমাদের জীবনের কর্মসূচী থেকেই নিরঙ্কুশভাবে বাদ দিতে হবে।

তবে আরেকটি দল এরপরও মদ পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে নি;এমনকি আনসারগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উল্লিখিত আয়াত অবতীর্ণ হওয়া সত্বেও এমন ভোজসভার আয়োজন করে যাতে মদ পরিবেশন করার পর অতিথিবৃন্দ (নেশাগ্রস্ত হয়ে) পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হয় এবং পরস্পরের হাত ভেঙে দেয় ও মাথা ফাটিয়ে দেয়। এরপর মহানবী (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করা হয়।

দ্বিতীয় খলীফা ঐ দিন পর্যন্ত মদ পান করতেন। তিনি পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ মদ পান সুনিশ্চিতভাবে হারাম করার জন্য যথেষ্ট নয় -এ ধারণার বশবর্তী হয়ে দু হাত তুলে প্রার্থনা

করেন :

اللهم بيّن لنا بيانا شافيا فِى الخمر

হে আল্লাহ্! মদ সম্পর্কে আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সন্তোষজনক বিধান সম্বলিত ব্যাখ্যা অবতীর্ণ করুন।

বলার অপেক্ষা রাখে না,এ ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা মদ পান নিশ্চিতভাবে হারাম হবার বিধান মেনে নেয়ার জন্য (তদানীন্তন) মুসলিম সমাজকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। এ কারণেই মদ পান নিষিদ্ধ করার স্পষ্ট ও চূড়ান্ত বিধান অবতীর্ণ হয়। এ আয়াত হলো :

) يا أيّها الّذين آمنوا إنّما الخمر و الميسر و الأنصاب و الأزلام رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই শরাব (মদ),জুয়া,মূর্তিপূজার বেদী এবং আযলাম (এক ধরনের ভাগ্য পরীক্ষা) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। কাজেই সবাই তা থেকে বেঁচে থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 92

এ স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ঘোষণার ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে,যারা তখনো শরীয়তের স্পষ্ট ও পরিষ্কার বিধান না আসার যুক্তিতে মদ পান করত,তারাও মদ পান ত্যাগ করল। সুন্নী ও শিয়া সূত্রের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে,এ আয়াত শোনার পর দ্বিতীয় খলীফা বলেন :انتهينا يا ربّ

হে প্রভু! এখন থেকে আমরা বিরত হলাম। 93

বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিষয়ক সংযুক্তি

দ্বিতীয় খলীফা উল্লিখিত তিনখানা আয়াত শোনার পর ক্ষান্ত হন নি। তিনি মদ হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাদকদ্রব্য হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত আয়াত নাযিল হলে তিনি সন্তষ্টি লাভ করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর হুকুম ছিল :

) رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

(শরাব) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। অতএব,তোমরা তা থেকে বিরত থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 94

কিন্তু আমাদের যুগের পাশ্চাত্যপন্থীরা এসব আয়াতকে যথেষ্ট মনে করে না;বরং তারা বলতে চায়,মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারেحرام (হারাম) বাحُرّم হুররিমা (হারাম করা হলো) পরিভাষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় মদ যে নিষিদ্ধ,তা বোঝা যায় না।

এ দলটি কুপ্রবৃত্তির কামনা-বাসনার পূজারী এবং অজুহাত খুঁজে বেড়াতে অভ্যস্ত। এরা শয়তানী বোতলটার মধ্যে ডুবে থাকতে ও বুকে জড়িয়ে রাখতে এবং এ জাতীয় অনর্থক কথা বলতে চায়;অথচ পবিত্র কুরআন এ ধরনের শয়তানী চিন্তাধারা দমন করার উদ্দেশ্যে শরাব হারাম হওয়ার বিষয়ে অন্যভাবে হারাম পরিভাষা ব্যবহার করেছে। পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতে বলা হয়েছে :و إثمهما أكبر من نفعهما এতদুভয়ের (মদ ও জুয়া) গুনাহ,উভয়ের উপকারের চেয়ে বড় (জঘন্য)। 95

অর্থাৎ মদপানকে বড় গুনাহ ও পাপ বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর এক আয়াতে সকল পাপকর্মকে (إثم ) হারাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে :

) قل إنّما حرّم ربّى الفواحش ما ظهر منها و ما بطن و الأثم(

বলুন,আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও গোপন সকল অশ্লীলতা এবং পাপকর্ম হারাম ঘোষণা করেছেন। 96

এত স্পষ্ট বিবরণের পরও কি পাশ্চাত্যপূজারী নোংরা মানসিকতার লোকেরা মদ হারাম হওয়া সংক্রান্ত আরো পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট ব্যাখ্যার অপেক্ষায় বসে থাকবে?

আমাদের মতে এ বিষয়ে যুক্তিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কেননা মদ সম্পর্কিত চার আয়াতে মদকে নোংরা,অপবিত্র এবং মূর্তি,জুয়া ও শয়তানের কাজের সমপর্যায়ের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে,মদ হারাম। আর স্বার্থ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়-এমন সহজ সরল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ সব আয়াত সবচেয়ে কার্যকরী বর্ণনা ও ব্যাখ্যা।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন,তা হচ্ছে মহানবী (সা.) এ চার আয়াতের সাহায্যে তাঁর চারপাশের পরিবেশকে এই অপবিত্র বস্তু থেকে পবিত্র করেন এবং স্বয়ং ঈমানদারদের ঈমানই আল্লাহর হুকুম কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য জগৎ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েও এ ব্যাপারে তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। এই প্রাণ হরণকারী বস্তুটি বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রে তাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিস্ফল প্রমাণিত হয়েছে। 1933-1935 সালে এলকোহল জাতীয় পানীয় নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। এটি বিরাট ট্র্যাজেডি এবং পাঠকগণ এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ইতিহাসের শরণাপন্ন হতে পারেন।

যাতুর রিকা অভিযান

রিকা (رقاع ) আরবদের পরিভাষায় তালি নামে পরিচিত। কাজেই এই পবিত্র জিহাদকে যাতুর রিকা অভিযান নামকরণের কারণ হচ্ছে এ অভিযানে মুসলমানরা বহু চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হন,যা তালিযুক্ত জামার সাথে তুলনীয়। কখনো কখনো বলা হয়,এ অভিযানকে যাতুর রিকা বলার কারণ মুসলিম সৈনিকগণ পায়ে হেঁটে পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য তাঁদের পায়ে পট্টি জড়িয়েছিলেন।

যা হোক,অন্যান্য অভিযানের মতো এ অভিযান প্রথম পর্যায়ের কোন লড়াই ছিল না;বরং প্রজ্বলিত হবার উপক্রম যুদ্ধের স্ফূলিঙ্গ নির্বাপিত করার জন্যই এ অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ গাতফান -এর দু টি শাখা-গোত্র বনী মাহারির বনী সালাবাহ্ -এর পক্ষ হতে যে অশুভ তৎপরতা চালানো হচ্ছিল,তা দমিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান পরিচালিত হয়।

মহানবী (সা.)-এর নিয়ম ছিল তিনি বিচক্ষণ ও সচেতন ব্যক্তিদের আশে-পাশের এলাকায় পাঠাতেন যাতে তাঁরা সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর কাছে প্রতিবেদন প্রদান করেন। হঠাৎ তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে,এ গোত্র দু টি মদীনা নগরী দখল করার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের চিন্তা-ভাবনা করছে। মহানবী একটি বিশেষ বাহিনী নিয়ে নজ্দের উদ্দেশে গমন করেন এবং শত্রু-ভূখণ্ডের খুব কাছে অবতরণ করেন। ইসলামী বাহিনীর অতীত শৌর্য-বীর্য,ত্যাগ-তিতিক্ষার ঐতিহ্য গোটা আরব উপদ্বীপকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। তাদের আগমনের খবর পেয়ে শত্রুবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে এবং কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়াই পাহাড়ী অঞ্চল ও উচ্চভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

তবে মহানবী যেহেতু এ অভিযানে ফরয নামাযসমূহ সালাতে খাওফ অর্থাৎ ভীতিকর পরিস্থিতিতে নামায আদায়ের নিয়মে পড়েন এবং এ ধরনের নামায কীভাবে পড়তে হবে,তা সূরা নিসার 102তম আয়াতে বলা হয়,সেহেতু অনুমান করা যায়,শত্রু বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও রণপ্রস্তুতি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং যুদ্ধ বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন।

বীরত্বের স্বাক্ষর

ইবনে হিশাম97 ও আমীনুল ইসলাম তাবারসী-এর মতো সীরাত রচয়িতা ও মুফাসসিরগণ এ অভিযানের বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কতক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন,যা শত্রুবাহিনীর মোকাবেলায় মহানবী (সা.)-এর বীরত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এর সাদৃশ্যপূর্ণ বর্ণনা আমরা যি আমর অভিযান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। বর্ণনা সংক্ষেপ করার প্রয়োজনে আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না।

ইসলামের ধৈর্যশীল রক্ষীগণ

ইসলামের সৈনিকগণ যদিও এ অভিযানে সম্মুখ লড়াই ছাড়াই মদীনায় ফিরে আসেন,তবুও সামান্য কিছু মালে গনীমত তাঁদের হস্তগত হয়। ফেরার পথে একটি বিশাল উপত্যকায় তাঁরা রাতটা বিশ্রামে কাটান। মহানবী (সা.) দু জন বীর যোদ্ধাকে উপত্যকার প্রবেশপথ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁদের নাম ছিল আব্বাদ আম্মার । তাঁরা দু জন রাতের ঘণ্টাগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। সে হিসেবে রাতের প্রথম ভাগের পাহারার দায়িত্ব পড়ে আব্বাদের উপর।

গাতফান গোত্রের এক লোক মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করার মানসিকতা পোষণ করছিল। সে যে কোন ভাবে মুসলমানদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছিল। লোকটি রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নামাযরত প্রহরীর দিকে তীর নিক্ষেপ করে। কিন্তু প্রহরী নামাযে এতখানি বিভোর ছিলেন যে,তিনি তীরের আঘাত খুব সামান্যই অনুভব করেন এবং তীরটি নিজের পা থেকে বের করে পুনরায় নামাযে মশগুল হয়ে যান। কিন্তু শত্রুর আক্রমণের তিন বার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তৃতীয় বারে তীরটি খুব শক্তভাবে তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়। ফলে মনের মাধুরি মিশিয়ে আর নামাযে তন্ময় হয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। কাজেই খুব সংক্ষিপ্ত রূকূ ও সিজদা সহকারে নামায শেষ করে আম্মারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন।

আব্বাদের হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখে আম্মার দারুণভাবে মর্মাহত হন এবং অনেকটা প্রতিবাদী সুরে বলেন : কেন তুমি আমাকে শুরুতে জানালে না?”   আহত প্রহরী তাঁকে বললেন : আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাতে মশগুল ছিলাম এবং পবিত্র কুরআনের একখানা সূরা তেলাওয়াত করছিলাম। হঠাৎ প্রথম তীরটি আমাকে আঘাত করে। মহান আল্লাহর কাছে নিভৃতে দুআ এবং তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করার স্বাদ আমাকে নামায ভঙ্গ করতে বারণ করে। যদি মহানবী (সা.) আমাকে এ উপত্যকার পাহারার দায়িত্ব প্রদান না করতেন,তা হলে কিছুতেই আমার নামায এবং যে সূরা পাঠ করছিলাম,তাতে বিরতি টানতাম না;বরং মহান আল্লাহর কাছে মুনাজাতরত অবস্থায় আমার প্রাণটি দিয়ে দিতাম। কখনো নামায মাঝখানে শেষ করার চিন্তাও করতাম না 98


10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53