চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81801 / ডাউনলোড: 7541
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

গনীমত বণ্টন

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধলব্ধ গনীমতগুলো বণ্টন করে দেয়ার ব্যাপারে জোর দিতে লাগল। মহানবী (সা.) তাঁর অনাগ্রহ প্রমাণের জন্য একটি উটের পাশে দাঁড়িয়ে উটের কুঁজের কিছু পশম মুষ্টিবদ্ধ করে জনতার দিকে মুখ করে বলেছিলেন : তোমাদের যুদ্ধলব্ধ গনীমতগুলোর মধ্যে কেবল খুমস ব্যতীত আমার আর কোন অধিকার নেই। এমনকি, এ খুমস- যা আমার অধিকার, তাও তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেব। তাই তোমাদের কারো কাছে যে কোন ধরনের গনীমতই থাকুক, যদি তা সুঁই-সূতাও হয়, তবুও সে যেন তা ফেরত দেয়, যাতে ন্যায্যভাবে এ সব গনীমত তোমাদের মাঝে বণ্টন সম্ভব হয়।”

মহানবী (সা.) মুসলমানদের মধ্যে পুরো বাইতুল মাল বণ্টন করে দিলেন এবং বাইতুল মালের খুমস- যা কেবল তাঁর ছিল, তা তিনি কুরাইশ নেতৃবর্গের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন এবং আবু সুফিয়ান ও তার ছেলে মুআবিয়া, হাকিম বিন হিযাম, হারিস ইবনে হারিস, হারিস ইবনে হিশাম, সুহাইল ইবনে আমর, হুওয়াইতিব ইবনে আবদুল উয্যা, আলা ইবনে জারিয়াহ্ প্রমুখের মতো ব্যক্তিবর্গ, যারা সবাই বিগত দিন পর্যন্ত কুফর ও শিরকের প্রতিভূ এবং মহানবী (সা.)-এর কঠোর শত্রু ছিল, তাদের প্রত্যেককে এক শ’টি করে উট প্রদান করলেন। একইভাবে পূর্বোক্ত ব্যক্তিদের চেয়ে যাদের শত্রুতামূলক অবস্থান একটু কম ছিল, তাদের প্রত্যেককে পঞ্চাশটি করে উট দিয়েছিলেন। আর তারা এ ধরনের মূল্যবান দান ও গনীমতগুলোয় নিজেদের আরো অন্যান্য অংশসহ মহানবীর স্নেহ, ভালোবাসা ও অনুগ্রহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদের অজান্তেই ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় এ গোষ্ঠীকে মুআল্লাফাতুল কুলূব৩৮৭ (مؤلّفة القلوب ) বলা হয়েছে এবং ইসলাম ধর্মে যাকাত যে সব খাতে ব্যয় করা হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে এ গোষ্ঠী।

ইবনে সা৩৮৮ স্পষ্ট লিখেছেন : (মহানবীর) এ সব দান আসলে ঐ খুমস৩৮৯ থেকে ছিল, যা ব্যক্তিগতভাবে মহানবী (সা.)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল (অর্থাৎ মহানবী যুদ্ধলব্ধ গনীমত থেকে যে খুমস পেয়েছিলেন)। আর তিনি অন্যের অধিকার থেকে একটি দীনার নিয়ে তা কখনই এ গোষ্ঠীর হৃদয় জয় করা অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার পথে ব্যয় করেন নি।

মহানবীর এ ধরনের উদারভাবে দান একদল মুসলমান এবং বিশেষ করে কতিপয় আনসারের কাছে অত্যন্ত দুর্বিষহ বলে মনে হয়েছিল। যারা মহানবীর এ দানসমূহের সুমহান লক্ষ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিল না, তারা ভেবেছিল, বংশগত পক্ষপাতিত্ব ও গোঁড়ামি মহানবীকে গনীমতের খুমস নিজ আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বণ্টন করে দিতে প্ররোচিত করেছে! এমনকি যুল খুওয়াইসিরা নামক তামীম গোত্রের এক ব্যক্তি এতটা স্পর্ধা প্রদর্শন করেছিল যে, সে মহানবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেই ফেলল : আজ আমি আপনার কাজগুলো সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করে দেখতে পেলাম, গনীমত বণ্টন করার ক্ষেত্রে আপনি ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করেন নি।” মহানবী এ লোকটির স্পর্ধামূলক কথায় খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর মুখমণ্ডলে ক্ষোভ ও উষ্মার চিহ্ন প্রকাশ পেল। তিনি তখন বললেন : তোমার জন্য আক্ষেপ! আমার কাছে যদি ন্যায়পরায়ণতা না থাকে, তা হলে তা কার কাছে থাকবে? দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর মহানবীর কাছে তাকে হত্যা করার জন্য আবেদন করলে তিনি বলেছিলেন : তাকে ছেড়ে দাও। সে ভবিষ্যতে এমন এক দলের নেতা হবে, তীর যেভাবে ধনুক থেকে বের হয়ে যায়, তদ্রূপ তারাও ইসলাম ধর্ম থেকে বের হয়ে যাবে।”৩৯০

ঠিক যেভাবে মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তদ্রূপ এ লোকটি হযরত আলী (আ.)-এর শাসনামলে খারেজী সম্প্রদায়ের প্রধান হয়েছিল এবং ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক এ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব তার হাতে ছিল। তবে অপরাধের আগে অপরাধের শাস্তি দান ইসলাম ধর্মের নীতিমালার বিরোধী বিধায় মহানবী তাকে শাস্তি দেন নি। সা দ ইবনে উবাদাহ্ আনসারগণের পক্ষ থেকে তাদের অভিযোগবার্তা মহানবী (সা.)-এর সামনে উপস্থিত করেন। মহানবী তাঁকে বললেন : তাদের সবাইকে একটি স্থানে জড়ো কর যাতে আমি তাদেরকে আসল ঘটনা ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারি। মহানবী ভাবগাম্ভীর্যের সাথে আনসারগণের সভায় উপস্থিত হলেন এবং তাদের উদ্দেশে বললেন :

“তোমরা পথভ্রষ্ট ও বিচ্যুত গোষ্ঠী ছিলে, যারা আমার মাধ্যমে সুপথ পেয়েছ। তোমরা দরিদ্র ছিলে; এখন তোমরা সচ্ছল ও অভাবশূন্য হয়েছ। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে; এখন তোমরা একে অপরের প্রতি দয়াবান হয়েছ।” সবাই তখন স্বীকার করে বলল : হে রাসূলাল্লাহ্! এ কথা ঠিক।” মহানবী বললেন : তোমরা আরেকভাবে আমাকে এ কথার জবাব দিতে পার এবং তোমরা আমার অবদানসমূহের বিপরীতে আমার ওপর তোমাদের যে সব অধিকার আছে, সেগুলো আমার সামনে তুলে ধরে বলতে পার : হে রাসূলাল্লাহ্! যেদিন কুরাইশরা আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, আমরা সেদিন আপনাকে গ্রহণ করেছি (আপনার নবুওয়াত সত্য বলে স্বীকার করেছি); কুরাইশরা যেদিন আপনাকে সাহায্য করে নি, সেদিন আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি; কুরাইশরা আপনাকে আশ্রয়হীন করলে আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। আপনি যেদিন কপর্দকহীন ছিলেন, সেদিন আমরা আপনাকে আর্থিক সাহায্য করেছি।”

“হে আনসাররা! আমি সামান্য সম্পদ কুরাইশদের দিয়েছি যাতে করে তারা ইসলাম ধর্মে অটল থাকে, তা থেকে তোমাদের ইসলাম ধর্মের কাছে সঁপে দিয়েছি, সেজন্য কেন তোমরা বিষণ্ণ হয়েছ? তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, অন্যেরা উট ও দুম্বা নিয়ে যাবে, আর তোমরা নিজেদের সাথে তোমাদের নবীকে নিয়ে যাবে? মহান আল্লাহর শপথ! যদি সমগ্র মানব জাতি এক পথে এবং আনসাররা আরেক পথে চলে, তা হলে আমি আনসারদের পথই বেছে নেব।” অতঃপর তিনি আনসার এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। মহানবী (সা.)-এর ভাষণ আনসারগণের অনুভূতিকে এতটা নাড়া দিয়েছিল যে, তাঁরা সবাই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন : হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা আমাদের প্রাপ্ত অংশের ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছি এবং আমাদের সামান্যতম অভিযোগও নেই।”

মহানবী (সা.)-এর উমরা পালন

গনীমত বণ্টন করার পর মহানবী (সা.) জিরানাহ্ থেকে উমরা পালন করার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা গমন করলেন। তিনি উমরার আমলসমূহ আঞ্জাম দেয়ার পর যিলক্বদ মাসের শেষে বা যিলহজ্ব মাসের প্রথম দিকে পবিত্র মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।৩৯১

বায়ান্নতম অধ্যায় : অষ্টম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

কা ব ইবনে যুহাইরের বিখ্যাত কাসীদাহ্

হিজরতের অষ্টম বর্ষের পবিত্র যিলক্বদ মাসের মাঝামাঝিতে মহানবী (সা.) জিরানায় হুনাইন যুদ্ধের গণীমত বণ্টন করার কাজ শেষ করে অবকাশ লাভ করেন। হজ্ব মৌসুমও ঘনিয়ে এল এবং হিজরতের অষ্টম বর্ষ ছিল পবিত্র মক্কার ইসলামী হুকুমতের তত্ত্বাবধান ও নেতৃত্বে মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে সমগ্র আরব জাতির হজ্ব পালন করার প্রথম বছর। মহতী এ অনুষ্ঠানে মহানবীর অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে হজ্বের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করত এবং তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের দ্বারা ঐ মহতী সমাবেশে ইসলাম ধর্মের মৌলিক ও প্রকৃত প্রচার কার্যক্রমের বাস্তবায়নও সম্ভব হতো।

অন্যদিকে ইসলামী হুকুমতের প্রাণকেন্দ্র মদীনায় মহানবী (সা.)-এর বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল এবং তিন মাস যাবত তিনি মদীনা নগরীর বাইরে ছিলেন। আর যে সব বিষয় সেখানে সরাসরি তাঁকেই আঞ্জাম দিতে হতো সেসব সম্পূর্ণরূপে তত্ত্বাবধায়কশূন্য হয়ে পড়েছিল। মহানবী সমুদয় দিক পর্যালোচনার পর এক উমরা সম্পন্ন করে পবিত্র মক্কা ত্যাগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মদীনায় ফিরে যাওয়ার মধ্যেই কল্যাণ দেখতে পেলেন।

নব্য বিজিত অঞ্চলের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি পরিচালনার জন্য এমন সব ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা প্রয়োজন ছিল যেন মহানবীর অনুপস্থিতিতে কোন সংকটের উদ্ভব না হয়। এ কারণেই একজন সহিষ্ণু ও বুদ্ধিমান যুবক উত্তাব ইবনে উমাইদ, যাঁর জীবন থেকে বিশ বসন্তের অধিক সময় গত হয় নি, তাঁকে মহানবী এক দিরহাম মাসোহারার বিনিময়ে পবিত্র মক্কার প্রশাসক ও শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করলেন। এ কাজের মাধ্যমে তিনি কতকগুলো ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন। মহানবী এ কাজের দ্বারা প্রমাণ করেছিলেন, সামাজিক পদ ও দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ও নিযুক্ত হবার বিষয়টি শুধু যোগ্যতার সাথেই সম্পর্কিত এবং অল্প বয়স্ক হওয়া কখনোই একজন যোগ্যতাসম্পন্ন যুবকের সবচেয়ে বড় সামাজিক পদমর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না। পবিত্র মক্কার শাসনকর্তা এক বিশাল জনসমাবেশে জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন : মহানবী (সা.) আমার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন এবং আমি এ কারণে আপনাদের উপঢৌকন ও সাহায্যের মোটেই মুখাপেক্ষী নই।”৩৯২

মহানবী (সা.)-এর আরেক সুন্দর নির্বাচন হচ্ছে এই যে, তিনি মুয়ায ইবনে জাবালকে (মক্কাবাসীদের) ধর্মীয় বিধি-বিধান ও পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য মনোনীত করেছিলেন। তিনি সাহাবীগণের মাঝে ফিক্হ্ এবং পবিত্র কুরআনের বিধি-বিধান সংক্রান্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এমনকি মহানবী (সা.) যখন তাঁকে ইয়েমেনে বিচারকাজ পরিচালনা করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে তোমার দলিল-প্রমাণ কী হবে? তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন : মহান আল্লাহর কিতাব।” মহানবী তখন বললেন : যদি পবিত্র কুরআনে ঐ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ না থাকে, তা হলে তুমি কিসের ভিত্তিতে বিচারকাজ সম্পন্ন করবে? তিনি বললেন : মহানবী (সা.) সম্পাদিত বিচারকাজসমূহের ভিত্তিতে। কারণ আমি বিভিন্ন বিষয়ে আপনার বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করেছি এবং মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছি। যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে যার বিষয়বস্তু আপনার কোন একটি বিচারের অনুরূপ হয়, তা হলে আপনার বিচার থেকে সাহায্য নিয়ে তদনুসারে ফয়সালা দেব।” রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তৃতীয় বারের মতো তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : যদি এমন কোন ঘটনা ঘটে যে ব্যাপারে মহান আল্লাহর কিতাবে কোন স্পষ্ট নির্দেশ নেই এবং আমার পক্ষ থেকেও কোন রায় প্রদান করা হয় নি, তা হলে তুমি কী করবে? তখন তিনি বলেছিলেন : আমি ইজতিহাদ করব এবং শরীয়তের মূলনীতি, ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যের (ইনসাফের) ভিত্তিতে বিচার করব।” তখন মহানবী বলেছিলেন : মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এজন্য যে, তিনি বিচারকাজ পরিচালনা করার জন্য এমন এক ব্যক্তিকে মনোনীত করার ক্ষেত্রে তাঁর নবীকে সফল করেছেন, যাঁর কর্মকাণ্ড সন্তোষজনক।”৩৯৩

কা ব ইবনে যুহাইর ইবনে আবী সালামার ঘটনা

যুহাইর ইবনে আবী সালামা জাহিলীয়াতের যুগে আরব কবি ও কথাশিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি আল মুআল্লাকাত আস্ সাবআহ্’ অর্থাৎ প্রসিদ্ধ ঝুলন্ত সাত কাব্য’-এর একটির রচয়িতা ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ সাত কাব্য পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হবার আগে পবিত্র কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল এবং সেগুলো আরব সাহিত্যের গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক বলে গণ্য হতো।৩৯৪ তিনি মহানবী (সা.)-এর রিসালাত ও নবুওয়াতের আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং বুজাইর ও কা ব নামের দু পুত্রসন্তান রেখে গিয়েছিলেন। প্রথম সন্তান (বুজাইর) মহানবীর বিশ্বস্ত অনুরাগী ও গুণগ্রাহীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং দ্বিতীয় সন্তান (কা ব) তাঁর কঠোর শত্রুদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কা ব এক শক্তিশালী বংশগত কাব্যপ্রতিভার অধিকারী থাকায় তার কবিতা ও কাসীদায় মহানবীর প্রতি কটাক্ষ করত এবং তাঁর নিন্দা ও গালমন্দ করে একদল লোককে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে উস্কানী দিত।

মহানবী (সা.) ২৪ যিলক্বদ মদীনায় প্রবেশ করেন। কা ব-এর ভাই মক্কা বিজয়, তায়েফ অবরোধ এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে মহানবীর সাথে ছিলেন। তিনি নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করলেন যে, মহানবী (সা.) কতিপয় কবি, যারা তাঁর ভাইয়ের মতো তীব্র বিদ্রূপ ও গালিগালাজকারী ছিল এবং জনগণকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করত, তাদেরকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের রক্ত মূল্যহীন বলে ঘোষণা করেছেন। অবশেষে ঐ সব কবির একজনকে হত্যাও করা হয়েছে এবং আরো দু জন কবি পালিয়ে গিয়ে জনদৃষ্টির অন্তরালে আত্মগোপন করেছে।

বুজাইর কা বের কাছে একটি চিঠিতে পুরো ঘটনা লিখে জানালেন এবং চিঠির শেষে শুভেচ্ছাস্বরূপ উল্লেখ করলেন, যদি সে মহানবীর প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ অব্যাহত রাখে, তা হলে তাকে হত্যা করা হবে। আর যদি সে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সকাশে উপস্থিত হয়ে তার অতীত কর্মের ব্যাপারে অনুশোচনা ও দুঃখ প্রকাশ করে অনুতপ্ত হয়, তা হলে মহানবী অনুতপ্ত ব্যক্তিদের তওবা গ্রহণ করেন এবং তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

কা ব তার ভাইয়ের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন এবং পবিত্র মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করার সময় মহানবী ফজরের নামায পড়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কা ব প্রথম বারের মতো মহানবী (সা.)-এর সাথে নামায আদায় করলেন। অতঃপর তিনি মহানবীর পাশে বসে তাঁর হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললেন : হে রাসূলাল্লাহ্! কা ব তার অতীত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছে এবং এখন সে একত্ববাদী দীনের প্রতি তার বিশ্বস্ততা প্রকাশ করার জন্য এসেছে। সে যদি নিজে আপনার কাছে উপস্থিত হয়, তা হলে কি আপনি তার তওবা গ্রহণ করবেন? মহানবী তখন বললেন : হ্যাঁ।” তখন কা ব বললেন : আমিই সে কা ব ইবনে যুহাইর।”

কা ব মহানবীর প্রতি তার অতীতের সকল কটূক্তি, নিন্দাবাদ, বিদ্রূপ ও অবমাননার প্রতিকার বিধান করার উদ্দেশ্যে একটি মনোরম কাসীদাহ্, যা তিনি আগেই মহানবী (সা.)-এর প্রশংসায় রচনা করে এনেছিলেন, তা মহানবী ও তাঁর সাহাবীগণের সামনে মসজিদে পাঠ করলেন।৩৯৫ চমৎকার এ কাসীদা কা বের সর্বোৎকৃষ্ট কাসীদাসমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং যেদিন এ কাসীদা মহানবীর সামনে পাঠ করা হয়েছিল, সেদিন থেকে মুসলমানরা এ কাসীদা মুখস্ত ও প্রচার করার ব্যাপারে যত্ন নিয়েছে। ঠিক একইভাবে মুসলিম জ্ঞানীগুণী ও আলেমগণের পক্ষ থেকে এ কাসীদার অনেক ব্যাখ্যাও লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ কাসীদা লামিয়াহ্’ রীতিতে৩৯৬ রচিত। এ কাব্যের মোট পঙ্ক্তির সংখ্যা হচ্ছে ৫৮। এর শুরুতে রয়েছে নিম্নোক্ত পঙ্ক্তি :

بانت سعاد فقلبِى اليوم مبتول

متيّم اثرها لم يُفد مكبول

জাহিলীয়াতের যুগের কবিরা, যারা প্রেমিকাকে সম্বোধন করে বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন উল্লেখ করার মাধ্যমে নিজেদের কাব্য বা কাসীদা শুরু করত, তাদের রীতিতে কা বও তাঁর এ কাসীদা তাঁর চাচার মেয়ে প্রেমিকা সুয়াদকে স্মরণ করে শুরু করেন এবং বলেন :

সুয়াদ আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে

এবং আমার হৃদয় আজ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

আর তার অনুপস্থিতিতে তা হীন ও অপদস্থ;

আর এখনো তার মোহ থেকে আমার হৃদয় মুক্তি পায় নি

এবং তা তার কাছে এখনো বন্দী হয়ে আছে।

কা ব তাঁর গর্হিত কার্যকলাপ সম্পর্কে ক্ষমা চেয়ে ও দুঃখ প্রকাশ করে নিম্নোক্ত পঙ্ক্তিতে বলেন :

نُـبـئـتُ أنّ الـرسـول اوعـدني

و العفو عند رسول الله مأمول

আমাকে জানানো হয়েছে,

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমাকে (প্রাণনাশের) হুমকি দিয়েছেন,

অথচ রাসূলুল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা করে দেয়াই হচ্ছে কাম্য।

এরপর তিনি বলেন :

إنّ الرسول الله لنور يُستضاء به

مهنّد من سيـوف الله مسـلول

মহানবী এমন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা

যার আলোকরশ্মির প্রভাবে

বিশ্ববাসী সৎ পথে পরিচালিত হয়

এবং তিনি মহান আল্লাহর উন্মুক্ত তলোয়ারসমূহের অন্তর্ভুক্ত

যা সর্বত্র ও সবসময় পূর্ণরূপে বিজয়ী। ৩৯৭

শোক ও আনন্দের একাত্মতা

হিজরতের অষ্টম বর্ষের শেষের দিকে মহানবী (সা.) তাঁর জ্যেষ্ঠা৩৯৮ কন্যা হযরত যায়নাবকে হারান। তিনি মহানবীর নবুওয়াত লাভের আগেই খালাত ভাই আবুল আসের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং সাথে সাথে তিনি পিতার রিসালতে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী শিরক ও পৌত্তলিকতায় বহাল থেকে যায়। সে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং (মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়)। মহানবী (সা.) তাকে মুক্তি দেন এবং এ কারণে শর্ত করেন যে, তাঁর কন্যা যায়নাবকে সে মদীনায় পাঠিয়ে দেবে। সেও তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল এবং (মক্কায় ফিরে গিয়ে) মহানবীর কন্যা যায়নাবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু কুরাইশ নেতৃবর্গ তাঁকে (যায়নাব) মাঝপথ থেকে মক্কায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়। ঐ লোকটি পথিমধ্যে হযরত যায়নাবের হাওদার কাছে গিয়ে তাঁর হাওদার মধ্যে বর্শা ঢুকিয়ে দেয়। মহানবীর আশ্রয়হীনা কন্যা অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর গর্ভপাত ঘটে। তবে তিনি মদীনায় চলে যাওয়ার ইচ্ছার ওপর অটল থাকেন এবং অত্যন্ত বেদনাক্লিষ্ট ও অসুস্থ শরীরে মদীনায় প্রবেশ করেন। আর (তখন থেকে) তিনি জীবনের অবশিষ্ট সময় অসুস্থতার মধ্যে কাটান এবং হিজরতের অষ্টম বর্ষের শেষভাগে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ শোক ও দুঃখ আরেকটি আনন্দের সাথে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ মহানবী (সা.) ঐ বছরের শেষের দিকে, মিশরের শাসনকর্তা মুকুকেস তাঁর (মহানবীর) জন্য যে পরিচারিকা উপহারস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন, তাঁর গর্ভে এক পুত্রসন্তান লাভ করেন- যাঁর নাম তিনি ইবরাহীম’ রেখেছিলেন। যখন ধাত্রী (সালমা) মহানবীকে মহান আল্লাহ্ এক পুত্রসন্তান দিয়েছেন এ সুসংবাদ দিলেন, তখন তিনি তাকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান উপহার প্রদান করেছিলেন।

সপ্তম দিবসে মহানবী (শিশুসন্তানের জন্য) একটি দুম্বা আকীকা দিলেন এবং নবজাতকের মাথার চুল ছেঁটে তার সম ওজনের রূপা মহান আল্লাহর পথে দান করলেন।৩৯৯

তেপ্পান্নতম অধ্যায় : নবম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

তাঈ গোত্রের আবাসভূমিতে হযরত আলী (আ.)

আদী ইবনে হাতেমের ইসলাম গ্রহণ

হিজরতের অষ্টম বর্ষ সকল আনন্দ, দুঃখ ও তিক্ততাসহ অতিবাহিত হলো। এ বছর শিরক, পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজার সবচেয়ে বড় ঘাঁটি মুসলমানদের পদানত হয় এবং দীন ইসলামের মহান নেতা পরিপূর্ণ বিজয় সহকারে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ইসলামের সামরিক শক্তি আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। আরবের বিদ্রোহী ও উদ্ধত গোত্রগুলো, যারা ঐ দিন পর্যন্ত ইসলাম ও তাওহীদবাদের এহেন বিজয় সম্পর্কে মোটেই চিন্তা করত না, ধীরে ধীরে এ চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিল যে, তারা মুসলমানদের নিকটবর্তী হবে এবং তাদের ধর্ম গ্রহণ করবে। এ কারণেই বিভিন্ন আরব গোত্রের প্রতিনিধিরা এবং কখনো কখনো গোত্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে আরব গোত্র মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও ঈমান আনার কথা ঘোষণা করতে থাকে। হিজরতের নবম বর্ষে গোত্রগুলোর প্রতিনিধিরা এত বেশি মদীনায় আসা-যাওয়া করেছিল যে, এ কারণে ঐ বছরের নামকরণ হয়েছিল প্রতিনিধি দলগুলোর আগমনের বর্ষ’ বা আমুল উফূদ’৪০০ (عام الوفود )।

যাইদুল খাইল-এর নেতৃত্বে তাঈ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং গোত্রপতি কথা বলা শুরু করে। মহানবী যাইদুল খাইল-এর বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তা দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন : আরবের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে তাদের সম্পর্কে যা শুনেছিলাম, তার চেয়ে তাদেরকে অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্নই পেয়েছি। কিন্তু যাইদ সম্পর্কে যা শুনেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন পেয়েছি। তাই তাকে যাইদুল খাইল’ বলার পরিবর্তে যাইদুল খাইর’ (কল্যাণের যাইদ) বলা কতই না উত্তম! ৪০১

এ প্রতিনিধি দলের বৃত্তান্ত৪০২ অধ্যয়ন এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে তাদের কথোপকথন সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলে স্পষ্ট হয়ে যায়, যুক্তিপ্রমাণ নির্ভর প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসলাম আরব উপদ্বীপে প্রসার লাভ করেছিল। অবশ্য যুগের সীমা লঙ্ঘনকারী অত্যাচারী-তাগূতী চক্র আবু সফিয়ান, আবু জেহেলরা ইসলাম ধর্মের স্বাভাবিক প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা ছাড়াও এ সব অত্যাচারী চক্রকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যও মহানবীর যুদ্ধসমূহ পরিচালিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ তাগূতী চক্র ইসলামের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং হিজায, নজদ ও অন্যান্য এলাকায় ইসলামের প্রচার-সৈনিকগণের প্রবেশের পথে বাধাদান করত। তাগূতীদের উৎখাত এবং প্রচার ও প্রসারের পথে যে সব কাঁটা বিদ্যমান, সেগুলো উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত কোন ধর্ম ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, শুধু মহানবীই নন, বরং সকল নবীই সর্বাগ্রে তাগূতী চক্রকে দমন ও প্রতিবন্ধকতাগুলো ধ্বংস করার জন্য নিজেদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছেন।

পবিত্র কুরআন সূরা নাসর-এ প্রতিনিধি দলগুলোর আগমন এবং আরব উপদ্বীপে ইসলামের ক্রমবর্ধমান বিজয় প্রসঙ্গে বলেছে :

) إذا جاء نصر الله و الفتح و رأيت النّاس يدخلون فِى دين الله أفواجا فسبح بحمد ربّك و استغفره إنّه كان توّابا(

“যখন মহান আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে; আর আপনি মানুষকে দেখবেন, দলে দলে মহান আল্লাহর দীনে প্রবেশ করছে, তখন আপনি আপনার রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও অনুশোচনা গ্রহণকারী।”৪০৩

আরব গোত্রগুলোয় এ ধরনের প্রস্তুতি এবং তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলগুলোর আগমন সত্বেও হিজরতের নবম বর্ষে সাতটি সারিয়াহ৪০৪ (سريّة ) এবং একটি গাযওয়াহ্৪০৫ (غزوة ) সংঘটিত হয়েছিল।

ষড়যন্ত্রগুলো নস্যাৎ করার জন্য এবং তখনও আরব গোত্রগুলোর মধ্যে যে সব বড় বড় মূর্তি ও প্রতিমা পূজার প্রচলন ছিল, সেগুলো ভাঙার জন্য প্রধানত এসব সারিয়াহ্ পরিচালনা করা হয়েছিল। এ সব সারিয়ার অন্যতম হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের সারিয়াহ্। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তিনি তাঈ গোত্রের আবাসভূমির দিকে গমন করেন। হিজরতের নবম বর্ষে মহানবী (সা.)-এর গাযওয়াসমূহের মধ্য থেকে তাবুকের গাযওয়াহ্ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ গাযওয়ায় মহানবী এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনা ত্যাগ করে তাবুক সীমান্ত অঞ্চলের দিকে যাত্রা করেন এবং শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হওয়া ও রক্তপাত ছাড়াই পবিত্র মদীনা নগরীতে ফিরে আসেন। তবে তিনি ভবিষ্যতের জন্য সীমান্ত শহর ও নগরীগুলো জয় করার পথ সুগম করেন।

দ্বিতীয় বদর

উহুদ যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ান মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিল : পরের বদরে ঠিক এ সময়েই বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে আমাদের দেখা হবে এবং আরো বড় প্রতিশোধ নেব।

মুসলমানরা মহানবী (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে প্রতিরক্ষামূলক এ জিহাদে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন। সেই তারিখের পর থেকে দীর্ঘ একটি বছর পার হয়ে যায়। এর মধ্যে কুরাইশদের সর্দার নানা ধরনের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছিল।

ইতোমধ্যে নুআইম ইবনে মাসউদ নামক এক ব্যক্তি মক্কায় গমন করে। মক্কার কুরাইশ ও মদীনার মুসলমানদের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আবু সুফিয়ান তাঁর কাছে একটি অনুরোধ জানায় যাতে সে মদীনায় গিয়ে রাসূলকে মদীনা থেকে বের হতে বারণ করে। আবু সুফিয়ান আরো বলে : এ বছর মক্কা ত্যাগ করে বাইরের কোথাও যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আরবদের কমন মার্কেটতুল্য বদর এলাকায় এসে যদি মুহাম্মদ শক্তির মহড়া দেখায়,তা হলে তা আমাদের জন্য পরাজয়ের গ্লানি সৃষ্টি করবে।

নুআইম যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন,মদীনায় যায়,কিন্তু তার কথাবার্তা মহানবীর মনোবলে সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারে নি। মহানবী (সা.) দেড় হাজার সৈন্য,কয়েকটি ঘোড়া ও কিছু বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে চতুর্থ হিজরীর যিলকদ মাসে (যা হারাম বা নিষিদ্ধ মাস) বদর ভূখণ্ডে উপনীত হন। তিনি সেখানে দীর্ঘ আট দিন অবস্থান করেন এবং সে সময়টা ছিল বদরে আরবদের সাধারণ বাণিজ্যমেলার মৌসুম। মুসলমানরা তাদের পণ্য-সামগ্রী বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এরপর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে আসা লোকেরা চলে গেলেও ইসলামী বাহিনী সেখানে কুরাইশ বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে।

বদর প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর আগমনের খবর মক্কায় পৌঁছলে কেবল নিজেদের মান-সম্মান রক্ষার খাতিরে হলেও বদরের উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করা ছাড়া কুরাইশ নেতৃবর্গের আর কোন উপায় ছিল না। তাই আবু সুফিয়ান প্রচুর সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে মররুয যাহরান পর্যন্ত যায়। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ও রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার বাহানা দেখিয়ে মাঝপথ থেকে সে ফিরে যায়।

মুশরিক বাহিনীর পশ্চাদপসরণ এতই লজ্জাজনক ছিল যে,সাফওয়ান আবু সুফিয়ানকে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে : আমরা এ পশ্চাদপসরণের কারণে এ পর্যন্ত অর্জিত সকল গৌরব হাতছাড়া করে ফেলেছি। তুমি যদি গত বছর এ যুদ্ধ হবার কথা না দিতে,তা হলে আমরা এতখানি লজ্জিত হতাম না। 99

হিজরী চতুর্থ সালের 3 শাবান মহানবী (সা.)-এর দ্বিতীয় দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।100 আর একই বছর হযরত আলী (আ.)-এর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ ইন্তেকাল করেন।101 এ বছরই মহানবী (সা.) যাইদ ইবনে সাবিতকে ইহুদীদের কাছে সুরিয়ানী ভাষা শেখার নির্দেশ দেন।102

ছত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ103

ভ্রান্ত কুসংস্কার মূলোচ্ছেদের প্রয়োজনে

হিজরী পঞ্চম সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে পরিখার যুদ্ধ (আহযাবের যুদ্ধ),বনী কুরাইযার পরিণতি ও যায়নাব বিনতে জাহাশের সাথে মহানবী (সা.)-এর বিয়ে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী এসব ঘটনার সূচনায় রয়েছে উল্লিখিত মহিয়সী মহিলার সাথে মহানবীর বিয়ে।

পবিত্র কুরআন সূরা আহযাবের 4,6 এবং 36 থেকে 40 তম আয়াতের মাধ্যমে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে। তাতে প্রাচ্যবিদদের মিথ্যার বেসাতি এবং কল্পনাবিলাসের কোন অবকাশ রাখে নি।

আমরা ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ সূত্র অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবলম্বনে ঘটনাটির বিবরণ পেশ করব। এরপর প্রাচ্যবিদদের উক্তিগুলোও পর্যালোচনা করব।

যাইদ ইবনে হারিসা কে?

যাইদ এক যুবকের নাম। শৈশবে আরব বেদুইন ডাকাতদল তাঁকে একটি কাফেলা থেকে অপহরণ করে উকায মেলায় ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করেছিল। হাকীম ইবনে হিযাম তাঁকে আপন ফুফু খাদীজাহর জন্য কিনে নিয়েছিলেন। বিয়ের পর হযরত খাদীজাহ্ ক্রীতদাসটিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে অর্পণ করেছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর মনের পবিত্রতা,স্বচ্ছতা এবং তাঁর উত্তম চরিত্রের কারণে ছেলেটি তাঁর প্রতি অনুরাগী ও ভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি যাইদের পিতা যখন ছেলের খোঁজে মক্কায় আসেন এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে তাঁকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য আবেদন জানান,যাতে করে তাঁকে মায়ের কাছে ও পরিবারের মাঝে নিয়ে যেতে পারেন,তখন তিনি পিতার সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানান। বরং মহানবীর কাছে থাকাকে নিজের মাতৃভূমি এবং আত্মীয়-স্বজনের মাঝে থাকার ওপর অগ্রাধিকার দেন। রাসূল (সা.) তাঁর নিকটে থাকা বা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি যাইদের ওপর ছেড়ে দেন। এটি ছিল উভয় পক্ষের আত্মিক আকর্ষণ ও মমতার নিদর্শন। যাইদ যেমন অন্তস্তল থেকে মহানবী (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন,মহানবীও তেমনি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসা এতটা প্রগাঢ় ছিল যে,তাঁকে তিনি আপন সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে সাহাবীগণ তাঁকে যাইদ ইবনে মুহাম্মদ’ বলতেন। মহানবী (সা.) ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিক হবার জন্য একদিন যাইদের হাত ধরে কুরাইশদের উদ্দেশে বলেছিলেন : এ হচ্ছে আমার সন্তান। আমরা একে অপরের উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করব।”

এই আত্মিক টান ও মমত্ববোধ ততদিন বলবৎ ছিল যতদিন না মুতার যুদ্ধে যাইদ শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর ইন্তেকালে মহানবী ঔরসজাত সন্তান মারা যাবার মতোই শোকাহত হন।104

মহানবী (সা.)-এর ফুপাতো বোনকে যাইদ-এর বিয়ে

(শ্রেণীগত) ব্যবধান ও দূরত্ব কমিয়ে আনা,সমগ্র মানব জাতিকে মানবতার ও খোদাভীরুতার পতাকাতলে একত্রিত করা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি হিসেবে চারিত্রিক গুণাবলী ও মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতিকে পরিচিত করানোই ছিল মহানবী (সা.)-এর অন্যতম পবিত্র লক্ষ্য। অতএব,যত শীঘ্র সম্ভব আরবদের প্রাচীন ঘৃণ্য প্রথা (অভিজাত শ্রেণীর মেয়ের দরিদ্র শ্রেণীর পাত্রকে বিয়ে করা অনুচিত-এরূপ ধ্যান-ধারণা) বিলুপ্ত করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। আর এ কর্মসূচী তাঁর নিজ বংশ থেকে শুরু করা এবং হযরত আবদুল মুত্তালিবের পৌত্রী তাঁর নিজ ফুপাতো বোন যায়নাবকে নিজের পূর্বেকার দাস এবং দাসত্ব বন্ধন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত যাইদ ইবনে হারেসার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করাটা ছিল কতই না উত্তম,যাতে করে সবাই উপলব্ধি করে যে,এসব কল্পিত ব্যবধান যত দ্রুত সম্ভব বিলুপ্ত করতে হবে এবং যখনই মহানবী (সা.) তাদেরকে বলবেন, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া-পরহেযগারী (খোদাভীরুতা) এবং মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষের সমমর্যাদাসম্পন্ন’ ,তখন স্বয়ং তিনিই হবেন এ আদর্শ ও আইনের প্রথম বাস্তবায়নকারী এবং তাঁকেই তা সর্বপ্রথম কার্যকর করতে হবে।

এ ধরনের ভুল ও অন্যায় প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য মহানবী (সা.) যায়নাবের ঘরে গমন করে যাইদের সাথে তাঁর বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। যায়নাব এবং তাঁর ভাই প্রথমে এ প্রস্তাবে ততটা আগ্রহ দেখান নি। কারণ,তখনও তাঁদের অন্তর থেকে জাহিলী যুগের ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। অন্যদিকে,যেহেতু মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করা তাঁদের জন্য অপ্রীতিকর ছিল,তাই তাঁরা যাইদের দাস হওয়ার বিষয়টি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে মহানবীর প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

অবিলম্বে ওহীর ফেরেশতা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসহ অবতরণ করে যায়নাব ও তাঁর ভাইয়ের এহেন আচরণের নিন্দা করেন। এ আয়াত হলো :

) و ما كان لمؤمن و لا مؤمنة إذا قضي الله و رسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم و من يعص الله و رسوله فقد ضلّ ضلالا مبينا(

“যখন মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন,তখন মুমিন নর-নারীদের সেই বিষয়ে (ফয়সালার বিপরীতে) কোন এখতিয়ার থাকবে না;আর যে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সিদ্ধান্তের) বিরুদ্ধাচরণ করবে,সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে।” (সূরা আহযাব : 36)

মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ তাঁদের কাছে এ আয়াত পাঠ করে শুনান। মহানবীর প্রতি এবং তাঁর মহান লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি যায়নাব ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহর ঈমান এ বিয়ের ব্যাপারে যায়নাবের সম্মতি প্রদানের কারণ হয়েছিল। পরিণামে,অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত রমণী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বেকার দাস যাইদের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। আর এভাবে ইসলাম ধর্ম ও শরীয়তের প্রাণ সঞ্জীবনী কর্মসূচীর একাংশ বাস্তবায়িত হলো এবং সে সাথে (জাহিলী যুগের) একটি ভুল প্রথা কার্যত বিলুপ্ত হলো।

স্ত্রীর সাথে যাইদ-এর বিয়ে-বিচ্ছেদ

অবশেষে এ বিয়ে বিশেষ কিছু কারণে স্থায়ী হয় নি এবং শেষ পর্যন্ত তালাক (বিচ্ছেদ) পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কেউ কেউ বলেছেন,বিয়ে-বিচ্ছেদের কারণ ছিল যায়নাবের মন-মানসিকতা। তিনি স্বামীর বংশ-মর্যাদা ও পরিচয় নীচু হওয়ার বিষয়টি তাঁর সামনে প্রায়ই উত্থাপন করতেন। এভাবে তিনি স্বামী যাইদের জীবনকে তিক্ত করে ফেলেছিলেন।

তবে যাইদের কারণেও বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়ে থাকতে পারে। কারণ তাঁর জীবনী থেকে প্রমাণিত হয় যে,তাঁর মধ্যে সমাজের সাথে সংশ্রবহীনতা ও খাপ না খাওয়ার মনোবৃত্তি বিরাজ করত। তিনি জীবনে বহু বিয়ে করেছিলেন এবং সর্বশেষ স্ত্রী ছাড়া সবাইকে তিনি তালাক দিয়েছিলেন (উল্লেখ্য,মুতার যুদ্ধে তাঁর শাহাদাত লাভ পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ স্ত্রী তাঁর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন)। একের পর এক তালাক দান থেকে যাইদের মধ্যে খাপ না খাওয়ানোর প্রবণতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যাইদও যে এ ঘটনায় সমান অংশীদার ছিলেন,তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর প্রতি মহানবীর কড়া উক্তি। কারণ তিনি যখন জানতে পারলেন,তাঁর পালিত পুত্র সহধর্মিনীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে (যাইদকে) বলেছিলেন :

) أمسك عليك زوجك و اتّق الله(

“তুমি তোমার স্ত্রীকে ধরে রেখ (তালাক দিও না) এবং মহান আল্লাহকে ভয় করো।” (সূরা আহযাব : 37)

যদি যাইদের স্ত্রী যায়নাবই বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী হতেন,তা হলে স্ত্রীর সাথে যাইদের সম্পর্কচ্ছেদ তাকওয়া তথা পরহেযগারীর পরিপন্থী বলে গণ্য হতো না। তবে,অবশেষে যাইদ তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন এবং যায়নাবের সাথে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটান।

আরেক ভুল প্রথা বিলুপ্ত করার জন্য বিয়ে

এ বিয়ের মূল কারণ অধ্যয়ন করার আগে বংশ পরিচিতি-যা একটি সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ উপাদান বলে বিবেচিত,অগত্যা তা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আরেকভাবে বলতে হয় যে,প্রকৃত (ঔরসজাত) পুত্র ও পালিত পুত্রের মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্যও আমাদের জানতে হবে। পিতার সাথে ঔরসজাত সন্তানের অস্তিত্বগত সম্পর্ক রয়েছে। আসলে পিতা হচ্ছেন সন্তানের জন্মগ্রহণ ও অস্তিত্ব লাভের বস্তুগত কারণ। আর সন্তান হচ্ছে পিতা-মাতার শারীরিক এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্যাবলীর উত্তরাধিকারী। এ ধরনের একত্ব ও রক্তসম্পর্কের কারণেই পিতা ও সন্তান একে অপরের ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন এবং বিয়ে ও তালাক সংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় (অর্থাৎ পিতা তার ঔরসজাত সন্তানের বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবেন না এবং পুত্রও পিতার বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে না)।

সুতরাং এ ধরনের বিষয়বস্তু,যার অস্তিত্বগত ভিত্তি রয়েছে,তা কেবল ভাষার মাধ্যমে বা কথা দিয়ে কখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। (সূরা আহযাবের 4 ও 5 নং আয়াতসমূহের সারাংশ) উত্তরাধিকার,বিয়ে এবং তালাকের মতো কতকগুলো বিধানের ক্ষেত্রে প্রকৃত সন্তানের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা,পালিত পুত্র (দত্তক সন্তান) কখনোই মানুষের প্রকৃত সন্তান হয় না। যেমন প্রকৃত সন্তান যদি পিতার উত্তরাধিকারী বা পিতা তার ঔরসজাত সন্তানের উত্তরাধিকারী হন বা ঔরসজাত সন্তানের পত্নী,সন্তান কর্তৃক তালাক প্রদানের পর সন্তানের পিতার জন্য হারাম হয়,তা হলে কখনোই এ কথা বলা সম্ভব নয় যে,পালিত পুত্রও এসব বিধানের ক্ষেত্রে প্রকৃত সন্তানের সাথে সমান অংশীদার হবে।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের অংশীদারিত্ব সঠিক উৎসমূলবিশিষ্ট নয়। এছাড়াও এটি বংশ পরিচিতি নিয়ে এক ধরনের হাস্য-কৌতুক ও ছিনিমিনি খেলা মাত্র।

সুতরাং দত্তক সন্তান গ্রহণ যদি আবেগ-অনুভূতি,মমত্ববোধ ও ভালবাসা প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে,তা হলে তা খুবই পছন্দনীয় ও যথাযথ হবে। তবে তা যদি কতকগুলো সামাজিক বিধানের ক্ষেত্রে অংশীদার করানোর নিমিত্ত হয়ে থাকে,তা হলে তা হবে বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত হিসাব-নিকাশ থেকে বহু দূরে। এখানে উল্লেখ্য,এসব সামাজিক বিধান একান্তভাবেই প্রকৃত সন্তানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত।

জাহিলী আরব সমাজ দত্তক (পালিত) পুত্রকে প্রকৃত সন্তানের মতো মনে করত। মহানবী (সা.) পূর্বে তাঁর পালিত পুত্র যাইদের স্ত্রী যায়নাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করার মাধ্যমে এ ভুল প্রথা কার্যত অর্থাৎ বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে আরব জাতির মধ্য থেকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মুখে বলা এবং আইন প্রবর্তন করার চেয়েও দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে দেখানোর প্রভাব অনেক বেশি। যেহেতু তদানীন্তন আরব সমাজে পালিত পুত্রের তালাক প্রাপ্তা বা বিধবা পত্নীকে বিয়ে করা-যা আরবদের কাছে অস্বাভাবিক ধরনের জঘন্য বিষয় বলে বিবেচিত হতো-বাস্তবে কার্যকর করার সৎ সাহস কারো ছিল না,সেহেতু মহান আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে এ কাজের জন্য সরাসরি আহবান করেছিলেন। তাই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেছেন :

) فلمّا قضي زيد منها وطرا زوّجناكها لكى لا يكون علي المؤمنين حرج فِى أزواج أدعيائهم إذا قضوا منهنّ وطرا و كان أمر الله مفعولا(

“অতঃপর যখন যাইদ যায়নাবকে তালাক দিল,তখন আমরা তাকে আপনার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলাম,যাতে ঈমানদারদের দত্তক পুত্ররা যখন তাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে,তখন সেসব রমণীকে বিয়ে করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়;আর মহান আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।” (সূরা আহযাব : 37-38)

এ বিয়ে একটি ভুল প্রথা বিলোপ করা ছাড়াও সাম্যের সর্ববৃহৎ নিদর্শন হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ,ইসলাম ধর্মের মহান নেতা এমন এক নারীকে বিয়ে করেন,যিনি এর আগে তাঁর আযাদকৃত দাসের সহধর্মিনী ছিলেন। আর ঐ সময় এ ধরনের বিয়ে সমাজে মর্যাদার পরিপন্থী বলে গণ্য হতো।

এ সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ মুনাফিকচক্র ও সংকীর্ণ চিন্তাধারার অধিকারী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এটাকে এক ঘৃণ্য ব্যাপার হিসেবে তারা সর্বত্র বলে বেড়াতে লাগল যে,মুহাম্মদ তাঁর পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন।

মহান আল্লাহ্ এ ধরনের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা মূলোৎপাটন করার জন্য নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

) ما كان محمّد أبا أحد من رجالكم و لكن رسول الله و خاتم النّبيّين و كان الله بكلّ شىء عليما(

“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নন,বরং তিনি মহান আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী;আর মহান আল্লাহ্ সব ব্যাপারে অবগত আছেন।” (সূরা আহযাব : 40)

পবিত্র কুরআন এ বিষয় বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট বলে মনে করে নি;বরং মহানবী (সা.),যিনি মহান আল্লাহর বিধি-নির্দেশ কার্যকর করার ব্যাপারে নির্ভীক ছিলেন,সূরা আহযাবের 38 ও 39তম আয়াতে তাঁর ভূয়সী প্রশংসাও করেছে। এ দুই আয়াতের সারাংশ হচ্ছে : মুহাম্মদ (সা.) অন্য সকল নবীর মতো,যাঁরা মহান আল্লাহর বাণীসমূহ মানব জাতির কাছে পৌঁছে দেন এবং মহান আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে কাউকেই ভয় করেন না।105

এটাই হচ্ছে যায়নাবের সাথে মহানবী (সা.)-এর শুভ পরিণয়ের মূল দর্শন বা হিকমত। এখন আমরা প্রাচ্যবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করব।


11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53