চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79182
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79182 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

প্রতিমালয় ও মন্দিরের ধ্বংস সাধন

মহানবী (সা.)-এর প্রধান ও মৌলিক দায়িত্ব ছিল তাওহীদী দীনের প্রসার এবং সব ধরনের দ্বিত্ববাদ ও শিরকের মূলোৎপাটন। তিনি প্রথম পর্যায়ে পথভ্রষ্ট ও মূর্তিপূজকদের সুপথ প্রদর্শনের জন্য যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করতেন এবং সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ উত্থাপন করে শিরক ও পৌত্তলিকতা যে ভিত্তিহীন, সে ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তাঁর যুক্তি-প্রমাণ তাদের ওপর কার্যকরী প্রভাব রাখছে না এবং তারাও নিজেদের একগুঁয়েমিতে অটল থাকছে বলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলে কেবল তখনই শক্তি প্রয়োগ এবং আত্মিক রোগে আক্রান্ত, স্বেচ্ছায় ঔষধ সেবন থেকে বিরত এ সব ব্যক্তির ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে তাদের রোগ নিরাময়ের অধিকার তিনি নিজেকে প্রদান করতেন।

একালে দেশের কোন একটি অঞ্চলে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব হলে এবং একদল লোক নিজেদের পশ্চাদপদ ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ রোগের প্রতিষেধক টীকা নেয়া থেকে বিরত থাকলে এসব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী ব্যক্তি, যারা না জেনে-শুনে নিজেদের এবং অন্যদের স্বাস্থ্য ও জীবন মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করে তাদেরকে প্রতিষেধক টীকা দেয়ার অধিকার নিঃসন্দেহে দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ নিজেদের অবশ্যই প্রদান করবে।

মহানবী (সা.) ইলাহী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের আলোকে বুঝতে পেরেছিলেন, মূর্তিপূজা কলেরার জীবাণুর মতো মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী ও মর্যাদাবোধ নষ্ট করে দেয় এবং মানব জাতিকে উচ্চ স্থান থেকে নিচে ফেলে দেয়। আর এভাবে তা (শিরক ও পৌত্তলিকতা) তাকে পাথর, কাদামাটি ও হীন-নীচ বস্তুর সামনে দুর্বল ও নতজানু করে ফেলে।

সুতরাং তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শিরকের মতো আত্মিক ব্যাধির মূলোৎপাটন, সব ধরনের মূর্তিপূজার বিলোপ সাধন এবং এ ব্যাপারে কোন গোষ্ঠী প্রতিরোধ গড়ে তুললে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

ইসলামের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে মহানবী (সা.) হিজাযের চারপাশে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে সকল প্রতিমালয় ধ্বংস এবং হিজায অঞ্চলে কোন মূর্তি বা প্রতিমার অস্তিত্ব থাকতে না দেয়ার সুযোগ পান।

মহানবী (সা.) আগে থেকেই অবগত ছিলেন, তাঈ গোত্রের একটি বড় প্রতিমা আছে। একদল লোক এর পূজা করে থাকে। এ কারণেই তিনি 150 অশ্বারোহী সৈন্য সহ তাঁর একজন প্রজ্ঞাবান ও রণনিপুণ সমরাধিনায়ককে ঐ গোত্রের প্রতিমালয় ধ্বংস এবং মূর্তিটি ভাঙার দায়িত্ব দিয়ে সেখানে প্রেরণ করলেন। সেনা অধিনায়ক বুঝতে পারলেন, ঐ গোত্র ইসলামী সৈনিকদের এ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করবে এবং যুদ্ধ ছাড়া এ মিশন বাস্তবায়িত হবে না।

এ কারণে তিনি যে স্থানে ঐ প্রতিমা স্থাপিত ছিল, সে স্থানের উপর খুব ভোরে আক্রমণ চালিয়ে ঐ গোত্রের একদল প্রতিরোধকারী যোদ্ধাকে বন্দী করলেন এবং তাদেরকে যুদ্ধলব্ধ গনীমতের অংশ হিসেবে মদীনায় আনলেন।

আদী ইবনে হাতেম, যিনি পরবর্তীকালে মুজাহিদ মুসলমানদের সারিভুক্ত হয়েছিলেন এবং দানবীর পিতা হাতেমের পর ঐ অঞ্চলের নেতৃত্ব যাঁর হাতে ছিল, ঐ এলাকা থেকে কিভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন তার একটি বিবরণ তিনি দিয়েছেন :

“আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে খ্রিষ্টান ছিলাম এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে অপপ্রচারের শিকার হওয়ায় আমি আমার অন্তরে তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করতাম। হিজাযে তাঁর বড় বড় বিজয় সম্পর্কে আমি অজ্ঞ ছিলাম না এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম, একদিন এ শক্তির তরঙ্গমালা তাঈ ভূ-খণ্ড’, যার কর্তৃত্ব আমার হাতে ছিল, সেখানে এসেও পৌঁছবে। এ কারণেই যাতে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ না করি এবং ইসলামী সেনাবাহিনীর হাতেও বন্দী না হই, সেজন্য আমি আমার দাসদের নির্দেশ দিয়েছিলাম, তারা যেন আমার দ্রুতগামী উটগুলোকে যাত্রার জন্য সর্বদা প্রস্তুত রাখে। যখনই কোন বিপদ আসবে, তখনই প্রস্তুত করে রাখা উপায়-উপকরণ নিয়ে আমি শামের পথে যাত্রা করে মুসলমানদের প্রভাববলয় থেকে দূরে চলে যাব।

অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হওয়ার জন্য আমি সড়ক পথের উপর পর্যবেক্ষণকারীদের নিযুক্ত করেছিলাম যারা ইসলামী সেনাবাহিনীর পায়ের ধূলো বা তাদের পতাকা দেখামাত্রই আমাকে অবহিত করবে।

একদিন হঠাৎ আমার এক দাস এসে বিপদের ঘণ্টা বাজাল এবং আমাকে মুসলিম বাহিনীর আগমন সম্পর্কে অবহিত করল। আমি ঐ দিনই স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের সাথে নিয়ে প্রাচ্যে খ্রিষ্টানদের কেন্দ্র শামদেশ-এর দিকে প্রয়োজনীয় রসদপত্র এবং পথ চলার জন্য প্রস্তুত যাবতীয় উপকরণ সমেত যাত্রা করলাম।

আমার বোন তাঈ গোত্রের মধ্যে থেকে যায় ও বন্দী হয়। মদীনায় স্থানান্তরিত হবার পর মহানবী (সা.)-এর মসজিদের কাছে একটি বাড়ি- যা যুদ্ধবন্দীদের আবাসন কেন্দ্র ছিল, সেখানে আমার বোনকে রাখা হয়েছিল।

সে তার কাহিনী এভাবে বর্ণনা করেছে :

একদিন মহানবী (সা.) মসজিদে নামায আদায় করার জন্য যুদ্ধবন্দীদের আবাসস্থলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মহানবীর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম :

يا رسول الله هلك الوالد و غاب الوافد فامنن علىّ منّ الله عليك

হে রাসূলাল্লাহ্! আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং আমার তত্ত্বাবধানকারীও লাপাত্তা হয়ে গেছে। তাই আপনি আমার ওপর করুণা করুন; আল্লাহ্ও আপনার ওপর করুণা করবেন।

মহানবী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমার তত্ত্বাবধানকারী কে? তখন আমি বললাম : আদী ইবনে হাতেম। তিনি বললেন : সে কি ঐ ব্যক্তি যে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছ থেকে শামদেশে পালিয়ে গেছে? মহানবী এ কথা বলে মসজিদের দিকে চলে গেলেন।

পরের দিনও আমার ও মহানবীর মাঝে এ কথোপকথনেরই পুনরাবৃত্তি হলো এবং তা নিস্ফল হলো। তৃতীয় দিন আমি মহানবীর সাথে কথা বলতে মোটেই আশাবাদী ছিলাম না। কিন্তু যখন মহানবী ঐ স্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক যুবককে তাঁর পেছনে দেখলাম, যিনি আমাকে ইঙ্গিত করে বলছিলেন আমি যেন আমার গতকালের কথার পুনরাবৃত্তি করি। ঐ যুবকের ইঙ্গিতে আশার আলো আমার অন্তর আলোকিত করে দিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে মহানবীর কাছে আগের কথাগুলো তৃতীয় বারের মতো পুনরাবৃত্তি করলাম। মহানবী আমার কথার জবাবে বললেন: যাবার ব্যাপারে তুমি তাড়াহুড়ো করো না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাকে একজন বিশ্বস্ত লোকের সাথে তোমার মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাব। কিন্তু বর্তমানে তোমার যাত্রার ক্ষেত্র তৈরি হয় নি।

আমার বোন বলেছে : যে যুবক মহানবী (সা.)-এর পেছনে হাঁটছিলেন এবং ইঙ্গিতে আমাকে মহানবীর কাছে আমার কথাগুলো পুনর্ব্যক্ত করতে বলেছিলেন, তিনি ছিলেন আলী ইবনে আবি তালিব।

একদিন এক কাফেলা, যার মাঝে আমার কিছু আত্মীয়ও ছিল, মদীনা থেকে শামদেশে যাচ্ছিল। আমার বোন মহানবীর কাছে তাকে ঐ কাফেলার সাথে শামদেশে তার ভাইয়ের কাছে চলে যাবার অনুমতি দানের জন্য আবেদন জানাল। মহানবী তার আবেদন মঞ্জুর করলেন এবং তার হাতে সফরের খরচ বাবদ কিছু অর্থ, পথ চলতে সক্ষম একটি সওয়ারী পশু এবং কিছু পোষাক দিলেন। আমি শামে আমার কক্ষে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, হাওদাসমেত একটি উট আমার বাড়ির সামনে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসেছে। আমি তাকালাম এবং আমার বোনকে হাওদার মধ্যে দেখতে পেলাম। আমি তাকে হাওদা থেকে নামালাম এবং বাড়িতে নিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর আমার বোন অভিযোগ করে বলল, আমি তাকে তাঈ ভূমিতে ফেলে রেখে শামদেশে চলে এসেছি এবং তাকে সাথে আনি নি।

আমি আমার বোনকে বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম। তাই একদিন আমি তার সাথে মহানবী (সা.) সম্পর্কে আলোচনা করলাম এবং তাকে বললাম : মহানবীর ব্যাপারে তোমার ধারণা কী? সে জবাবে বলল : তাঁর মধ্যে আমি সুমহান গুণাবলী প্রত্যক্ষ করেছি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর সাথে তোমার মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন কল্যাণকর বলে মনে করি। কারণ তিনি যদি প্রকৃত নবী হয়ে থাকেন, তা হলে ঐ ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবে, যে সবার আগে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। আর তিনি যদি সাধারণ শাসনকর্তা হন, তা হলেও তুমি কখনো তাঁর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; বরং তাঁর ক্ষমতার ছায়ায় তুমি উপকৃত হবে।”

মদীনার উদ্দেশে আদী ইবনে হাতেম-এর যাত্রা

আদী বলেন : আমার বোনের কথাগুলো আমার মাঝে প্রভাব ফেলেছিল। আমি মদীনার পথে অগ্রসর হলাম। মদীনায় প্রবেশ করে সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হলাম। তাঁকে মসজিদে পেলাম। আমি তাঁর মুখোমুখি বসে আমার পরিচয় পেশ করলাম। মহানবী আমাকে চিনে তাঁর জায়গা থেকে উঠে পড়লেন এবং আমার হাত ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা তাঁর পথ আটকে তাঁর সাথে কথা বললেন। আমি দেখলাম, তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সেই বৃদ্ধার কথা শুনছেন এবং তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। তাঁর মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী আমাকে আকৃষ্ট করল। আমি নিজেকে বললাম : তিনি কখনই একজন সাধারণ শাসনকর্তা হতে পারেন না। তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলে তাঁর অনাড়ম্বর জীবন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর বাড়িতে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে নির্মিত যে তোষক ছিল, তা তিনি আমাকে দিয়ে বললেন : এর উপর বসো। হিজাযের প্রধান ব্যক্তি- যাঁর হাতের মুঠোয় রয়েছে যাবতীয় ক্ষমতা,- তিনি নিজে একটি মাদুর বা খালি মাটির ওপর বসলেন। আমি তাঁর বিনয় দেখে খুবই অবাক হলাম। তাঁর মহৎ চরিত্র, সৎ গুণাবলী এবং মানব জাতির প্রতি তাঁর অসাধারণ মমত্ববোধ ও সম্মান প্রদর্শন থেকে আমি উপলব্ধি করলাম, তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তি ও শাসনকর্তা নন।

এ সময় মহানবী আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার জীবনের বিশেষ দিক সম্পর্কে তথ্য জানিয়ে বললেন : তুমি কি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রূকূসী406 ছিলে না? আমি বললাম : হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন : কেন তুমি তোমার গোত্রের আয়ের এক-চতুর্থাংশ নিজের জন্য বরাদ্দ করেছিলে? তোমার ধর্ম কি তোমাকে এ কাজের অনুমতি দিয়েছে? আমি বললাম : জী না। আমার গোপন বিষয়াদি সংক্রান্ত তাঁর সঠিক তথ্য প্রদান থেকে আমি নিশ্চিত হলাম, তিনি মহান আল্লাহর প্রেরিত দূত। আমি তখনও এ চিন্তার মধ্যেই নিমগ্ন ছিলাম। ঠিক তখনই আমি তাঁর তৃতীয় কথার মুখোমুখি হলাম। তিনি বলছিলেন : মুসলমানদের দারিদ্র্য ও কপর্দকহীন অবস্থা যেন তোমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধা না হয়। কারণ, এমন একদিন আসবে যখন বিশ্বের সম্পদরাজি তাদের দিকে স্রোতের মতো আসতে থাকবে; কিন্তু এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আর শত্রুদের আধিক্য ও মুসলমানদের স্বল্পতা যদি তোমার ঈমান আনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে মহান আল্লাহর শপথ, এমন একদিন আসবে যেদিন ইসলামের ব্যাপক প্রসার ও মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে একাকী পথ চলাচলকারী মহিলারা কাদেসীয়াহ্ থেকে মহান আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা যিয়ারত করার জন্য আসবে এবং কেউ তাদের ওপর চড়াও হবে না। আজ তুমি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্যদের হাতে দেখতে পেলেও আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এমন একদিন আসবে যেদিন ইসলামী সেনাবাহিনী কিসরার সকল প্রাসাদ দখল করবে এবং বাবিল (ব্যাবিলন) নগরীও তারা জয় করবে।”

আদী বলেন : আমি দীর্ঘ জীবন লাভ করার কারণে দেখতে পেয়েছি, ইসলাম প্রদত্ত (সামাজিক) নিরাপত্তার কারণে মহিলারা একাকী প্রত্যন্ত এলাকাগুলো থেকে মহান আল্লাহর ঘর কাবা যিয়ারত করতে আসতেন এবং কেউই তাদের ওপর চড়াও হতো না। আমি বাবিল শহর মুসলমানদের পদানত হতে দেখেছি। আরো দেখেছি, মুসলমানগণ কিসরার প্রাসাদ ও রাজমুকুট দখল করেছেন। আর আমি তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়ার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করার ব্যাপারেও আশাবাদী অর্থাৎ মদীনা নগরীর দিকে বিশ্বের সম্পদরাজি স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে থাকবে; অথচ সেগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার ব্যাপারে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করবে না।407

আল্লামা তাবারসী তারা তাদের পণ্ডিত ব্যক্তি ও সন্ন্যাসীদেরকে এবং ঈসা ইবনে মারিয়ামকে মহান আল্লাহর পরিবর্তে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছে’-408 এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সাথে আদীর সাক্ষাতের কাহিনীটি বর্ণনা করে বলেছেন : তিনি যখন মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হন, তখন মহানবী এ আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন। মহানবী ঐ আয়াত তেলাওয়াত শেষ করলে আদী প্রতিবাদের সুরে তাঁকে বললেন : আমরা কখনই আমাদের পুরোহিত ও সাধু-সন্ন্যাসীদের ইবাদত করি না। তাই আপনি কিভাবে আমাদের সাথে এ কথা সম্পর্কিত করে বলছেন যে, আমরা তাদেরকে আমাদের প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছি? এ সময় মহানবী বললেন : তারা যদি মহান আল্লাহর হালালকে হারাম এবং তাঁর হারামকে হালাল করে, তা হলে কি তোমরা তাদের অনুসরণ করবে? আদী বললেন : হ্যাঁ।” তিনি বললেন : এ কাজটিই হচ্ছে এ বিষয়ের সাক্ষী যে, তোমরা তাদেরকে নিজেদের প্রভু এবং কর্তৃত্বের অধিকারী বলে গ্রহণ করেছ।”409

চুয়ান্নতম অধ্যায় : নবম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

তাবুক যুদ্ধ

যে উঁচু ও মজবুত দুর্গ একটি পানির ঝরনার পাশে তৈরি করা হয়েছিল এবং হিজর ও শামের মাঝখানে সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল, সেই দুর্গকে তাবুক’ বলা হতো। তখনকার সিরিয়া প্রাচ্য রোমান’ সাম্রাজ্যের একটি উপনিবেশ ছিল। তখন প্রাচ্য রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কন্সট্যান্টিনোপল নগরী (অধুনা তুরস্কের ইস্তাম্বুল)। শামদেশের সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা সবাই হযরত ঈসা মসীহ (আ.)-এর অনুসারী ছিল এবং শামের জেলাগুলোর প্রধানরাও শামদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হতো। আর শামের প্রাদেশিক শাসনকর্তাও সরাসরি রোমান সম্রাটের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করত।

সমগ্র আরব উপদ্বীপে দীন ইসলামের দ্রুত প্রসার ও প্রভাব এবং তখনকার মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে হিজায অঞ্চলে মুসলমানদের আলোকদীপ্ত ব্যাপক বিজয়ের খবর বাইরের জগতে প্রচারিত হতো এবং তা শত্রুদের পৃষ্ঠদেশে কম্পন সৃষ্টি করে তাদেরকে এ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে বের করার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করত।

মক্কার পৌত্তলিক প্রশাসনের পতন এবং হিজাযের বড় বড় নেতা ও গোত্রপতির ইসলামের শিক্ষা ও নীতিমালার অনুসরণ, ইসলামী যোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ রোমান সম্রাটকে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের দমন এবং অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদেরকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়ার জন্য প্ররোচিত করে। কারণ ইসলামের অসাধারণ অলৌকিক প্রসার ও প্রভাবের কারণে রোমান সম্রাট নিজ সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে ও ধ্বংসের সম্মুখীন দেখতে পেয়েছিল এবং মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে অতি মাত্রায় ভীত হয়ে পড়েছিল।

তদানীন্তন রোম কেবল ইরানের (পারস্য) একমাত্র শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বলে গণ্য হতো এবং সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তির অধিকারী ছিল। পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধগুলোয় বিজয় লাভ করার কারণে রোম তখন ভীষণ শক্তিমদমত্ত হয়ে পড়েছিল।

চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য নিয়ে গঠিত রোমান বাহিনী সে যুগের সর্বশেষ মডেলের অস্ত্র ও হাতিয়ার সহ সুসজ্জিত হয়ে শামের সীমান্ত অঞ্চলগুলোয় অবস্থান গ্রহণ করে এবং সীমান্তে বসবাসকারী গোত্রগুলো, যেমন লাখ্ম, আমিলা, গাসসান ও জাযাম গোত্র রোমানদের সাথে যোগ দিয়ে রোমান বাহিনীর অগ্রবর্তী যোদ্ধাদল হিসাবে বালকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়।410

যে সব কাফেলা হিজায ও শামের বাণিজ্যিক রুটে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকত, তারাই শামের সীমান্ত এলাকায় রোমান বাহিনীর অবস্থান গ্রহণ করার সংবাদ মহানবী (সা.)-কে প্রদান করেছিল। মহানবী (সা.) এক বিশাল সেনাবাহিনী সহ আগ্রাসীদের উপযুক্ত জবাব দান এবং যে ধর্ম তিনি তাঁর প্রিয় অনুসারীদের রক্তের বিনিময়ে ও তাঁর ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার দ্বারা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং বিশ্বব্যাপী যা প্রসার লাভ করতে যাচ্ছে, তা শত্রুবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ থেকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেলেন না।

এ অপ্রীতিকর সংবাদ এমন এক সময় পৌঁছায়, যখন মদীনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা তখনও তাদের ফসল গোলায় তুলেন নি। সবেমাত্র খেজুর পাকতে শুরু করেছে এবং মদীনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোয় এক ধরনের দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল। তবে দীনদার ব্যক্তিদের কাছে আধ্যাত্মিক জীবন, সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সংরক্ষণ এবং মহান আল্লাহর পথে জিহাদ সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সৈন্য সংগ্রহ এবং যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটানোর ব্যবস্থা

মহানবী (সা.) শত্রুপক্ষের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সম্পর্কে সার্বিকভাবে অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি নিশ্চিত ছিলেন, আধ্যাত্মিক পুঁজি (মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জিহাদের মানসিকতা) ছাড়াও এ যুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী ও সামরিক শক্তিরও প্রয়োজন আছে। এ উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছুসংখ্যক লোককে পবিত্র মক্কা ও মদীনার আশে-পাশের এলাকাগুলোয় প্রেরণ করেন যাতে তাঁরা মুসলমানদের মহান আল্লাহর পথে জিহাদের আহবান জানান এবং বিত্তশালী মুসলমানরাও যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটানোর ব্যবস্থা করে দেন।

অবশেষে ত্রিশ হাজার যোদ্ধা যুদ্ধে যোগদান করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন। মদীনার সেনা সমাবেশকেন্দ্র সানীয়াতুল বিদা য় এসে তাঁরা সমবেত হন। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে যুদ্ধের ব্যয়ভার অনেকটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। এ ত্রিশ হাজার যোদ্ধার মধ্যে দশ হাজার আরোহী এবং বিশ হাজার পদাতিক ছিলেন। মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন প্রতিটি গোত্র যেন অবশ্যই নিজেদের জন্য একটি করে পতাকা নির্বাচন করে।411

যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরতরা বা বিরোধীরা

তাবুক যুদ্ধ ছিল মুনাফিক ও ঈমানের মিথ্যা দাবীদারদের থেকে প্রকৃত আত্মোৎসর্গকারীদের শনাক্ত করার সর্বোৎকৃষ্ট মানদণ্ড। কারণ সাধারণ জনতাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের ঘোষণা তখনই দেয়া হয়েছিল, যখন আবহাওয়া ছিল খুব উষ্ণ। মদীনার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তখন নিজেদেরকে ফসল মাড়াই ও খেজুর তোলার জন্য প্রস্তুত করেছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে তাদের মধ্য থেকে কতিপয় ব্যক্তির বিরত থাকার বিষয়টি তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত করেছে এবং তাদের নিন্দায় বেশ কিছু আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছিল যার সবই সূরা তাওবায় রয়েছে। একদল লোক নিম্নোক্ত কারণগুলোর জন্য এ পবিত্র জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছিল :

1. প্রবৃত্তির পূজারী রিপূর দাসেরা : মহানবী (সা.) একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জাদ বিন কাইসকে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন। সে মহানবীকে বলে : আমি এমন এক লোক যার মাঝে নারীর প্রতি তীব্র আসক্তি আছে। তাই আমি ভয় পাচ্ছি, রোমীয় নারীদের ওপর আমার দৃষ্টি পড়লে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারব না।” এ ধরনের শিশুসুলভ অজুহাত শোনার পর মহানবী তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের শরণাপন্ন হলেন। তার (জাদ বিন কাইস) নিন্দা করে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল :

) و منهم من يقول ائذن لِى و لا تفتنِى ألا فِى الفتنة سقطوا و إنّ جهنّم لمحيطة بالكافرين(

“এবং তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে বলে : আমাকে অব্যাহতি দিন এবং আমাকে ফিতনায় ফেলেন না। সাবধান! তারাই ফিতনায় পড়ে আছে। আর নিশ্চয়ই জাহান্নাম কাফিরদের পরিবেষ্টন করে রয়েছে।” (সূরা তাওবা : 49)

2. মুনাফিকরা : যে গোষ্ঠীটি বাহ্যত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং ইসলাম দ্বারা বিন্দুমাত্র উপকৃত হতে পারে নি, তারা বিভিন্নভাবে জনগণকে এ জিহাদে যোগদান থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল। কাখনো কখনো তারা তীব্র গরম আবহাওয়া’কে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করাত। আর এ কারণে ওহীর মাধ্যমে তাদের এ সব অজুহাতের সমুচিত জবাবও দেয়া হয়েছে :

) قل نار جهنّم أشدّ حرّا لو كانوا يفقهون(

“আপনি বলে দিন : জাহান্নাম এ গরম আবহাওয়ার চেয়েও অত্যধিক উষ্ণ, যদি তারা অনুধাবন করত।” (সূরা তাওবা : 81)

একদল মুনাফিক মুসলমানদের এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভয় দেখিয়ে বলত : রোমানদের সাথে আরব জাতির যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই এবং অল্প সময়ের মধ্যে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুজাহিদকে বন্দিত্বের শিকলে আবদ্ধ করে উন্মুক্ত বাজারগুলোয় বিক্রি করা হবে।”412