চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড5%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81868 / ডাউনলোড: 7552
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

কুরআনের আয়াতে সত্যের উন্মোচন

কুরআনের আয়াতসমূহ অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির এ পর্দা উন্মোচন করে দেয় যে,একদল সাহাবী মনে করেছিলেন,সাহায্য ও বিজয়ের ব্যাপারে মহানবীর দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহ ভিত্তিহীন। মহান আল্লাহ্ এ দল সম্পর্কে বলেন :

) و طائفة قد أهمّتهم أنفسهم يظنّون بالله غير الحق ظن الجاهلية يقولون هل لنا من الأمر من شىء(

সাহাবীদের মধ্যে একদল নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এতখানি চিন্তায় মগ্ন ছিল যে,তারা আল্লাহর সম্পর্কে জাহিলীয়াতের সময়কার ধারণা ও অনুমানের মতো বাতিল ধারণা পোষণ করছিল। তারা বলছিল,আমাদের কি মুক্তির কোন উপায় আছে। ৩৫

আপনারা সূরা আলে ইমরানের কিছু আয়াত৩৬ পর্যালোচনা করে এ যুদ্ধের কিছু গোপন বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এসব আয়াত সাহাবীদের সম্পর্কে শিয়াদের আকীদাকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে দেয়। শিয়ারা আকীদা পোষণ করে যে,মহানবী (সা.)-এর সকল সাহাবী তাওহীদী ধর্মের জন্য সত্যিকারভাবে ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না। তাদের মধ্যে দুর্বল আকীদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফিকও ছিল। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে স্বচ্ছ ও পবিত্র অন্তরের মুমিন-মুক্তাকী লোকও অনেক ছিলেন। আজ আহলে সুন্নাতের একদল লেখক এ জাতীয় অনেক অন্যায় কাজ ধামাচাপা দিতে চান,যার নমুনা উহুদ যুদ্ধের বর্ণনায় আপনারা শুনলেন। তারা বাস্তবতা বহির্ভূত ব্যাখ্যা দিয়ে সকল সাহাবীর মর্যাদা রক্ষা করতে চান অথচ এসব ব্যাখ্যা অপরিপক্ব ও অপর্যাপ্ত এবং গোঁড়ামি ও পক্ষপাতদুষ্টতার পর্দা সত্যের প্রকৃত চেহারা দর্শনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কোন্ লেখক নিচের আয়াতের প্রতিপাদ্য অস্বীকার করতে পারবে? সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে : তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলে এবং কারো দিকে তাকাচ্ছিলে না;অথচ নবী পেছন থেকে তোমাদের ডাকছিলেন;তোমরা তাঁর কথায় কর্ণপাত কর নি;বরং তোমাদের পলায়ন অব্যাহত রেখেছিলে। ৩৭

এ আয়াত সে সব লোক এবং তাদের মতো লোকদের সম্পর্কে,যাদেরকে আনাস ইবনে নযর নিজের চোখে দেখেছেন,তারা এক কোণায় বসে আছে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন রয়েছে। এর চেয়েও স্পষ্ট হচ্ছে নিচের এ আয়াত : যারা দু দলের মুখোমুখি হবার দিন পালিয়ে গিয়েছিল,শয়তান তাদেরকে তাদের কতিপয় কাজের ফলে পদস্খলিত করে দিল। তবে মহান আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্ও ক্ষমাকারী ও সহনশীল। ৩৮

যারা নবীর নিহত হবার গুজবকে নিজেদের বাহানা হিসেবে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল এবং এ ফন্দি আঁটছিল যে,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের সহায়তায় আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে,তাদেরকে তিরস্কার করে পবিত্র কুরআন বলেছে :

) و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرّسل أفائن مات أو قتل انقلبتم علي أعقابكم و من ينقلب علي عقبيه فلن يضرّ الله شيئا و سيجزى الله الشّاكرين(

মুহাম্মদ (আল্লাহর পক্ষ হতে) একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন-তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনোই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না;বরং আল্লাহ্ কৃতজ্ঞদের শীঘ্রই পুরস্কার দান করবেন। ৩৯

তিক্ত অভিজ্ঞতা

উহুদের ঘটনাবলী পর্যালোচনার দ্বারা তিক্ত ও মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। একদলের দৃঢ় ও অবিচল থাকার শক্তি ও ক্ষমতা এবং আরেক দলের দৃঢ়পদ ও অবিচল না থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে এ তথ্য হস্তগত হয় যে,মহানবী (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মুসলমানকে ন্যায়পরায়ণ ও মুত্তাকী সাব্যস্ত করা যায় না বা সম্ভবপর নয়। কেননা যে টিলা তীর নিক্ষেপকারী সৈন্যদের অবস্থানস্থল ছিল,যারা তা ত্যাগ করেছে অথবা স্পর্শকাতর মুহূর্তে (রণাঙ্গন ত্যাগ করে ) পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে এবং মহানবীর আহবানের প্রতি তোয়াক্কা করে নি,তারাও মহানবীর সাহাবী ছিল।

বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক ওয়াকিদী লিখেছেন,উহুদের দিন আট ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মহানবী (সা.)-এর সাথে থাকার বাইয়াত করেন। তাঁরা ছিলেন মুজাহিরগণের মধ্য থেকে তিনজন-আলী,তালহা,যুবাইর এবং আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন। এই আটজন ছাড়া সবাই বিপজ্জনক মুহূর্তে পলায়ন করে।

ইবনে আবিল হাদীদ৪০ লিখেছেন,৬০৮ সালে বাগদাদে এক অনুষ্ঠানে মজলিসে ওয়াকিদীর মাগাযী গ্রন্থটি একজন বড় মুসলিম মনীষী মুহাম্মদ ইবনে মাআদ আলাভীর কাছে পাঠ করছিলাম। বিষয়টি যখন এ পর্যন্ত পৌঁছল যে,মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ্ স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন : আমি উহুদের দিন নিজের চোখে দেখেছি,মুসলমানরা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল,আর মহানবী (সা.) তাদেরকে নাম ধরে ধরে ডাকছিলেন এবং বলছিলেন : হে অমুক! আমার কাছে এসো;হে অমুক! আমার কাছে এসো (إلَىّ يا فلان! إلَىّ يا فلان !),কেউই রাসূলের ডাকে অনুকূল সাড়া দিচ্ছিল না। উস্তাদ (মুহাম্মদ ইবনে মাআদ) আমাকে বললেন যে, অমুক, অমুক বলতে ঐ লোকদেরই বুঝানো হয়েছে,যাঁরা মহানবী (সা.)-এর পরে (রাষ্ট্রীয়) পদমর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের নাম স্পষ্টভাবে বললে বর্ণনাকারীর আশংকা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য থাকার কারণে স্পষ্টভাবে তাঁদের নাম উল্লেখ করতে চান নি।

অনুরূপভাবে তিনি (ইবনে আবিল হাদীদ) তাঁর ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,প্রায় সকল বর্ণনাকারীই এ কথায় ঐকমত্য পোষণ করেন যে,তৃতীয় খলীফা ঐসব লোকদের মধ্যে ছিলেন,যারা সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে রণাঙ্গনে অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন না। আপনারা সামনে ইসলামের একজন মহীয়সী নারী নাসীবা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর এক উক্তি পড়বেন। উল্লেখ্য,এ মহীয়সী নারী উহুদের ময়দানে মহানবীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঐ বাণীতে পরোক্ষভাবে পলাতক দলটির মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে খাটো করা হয়েছে। আমরা মহানবীর সঙ্গীগণের কারো ব্যাপারেই কখনো মন্দ ধারণা রাখি না। উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন এবং বাস্তবতা প্রকাশ করা। তাদের পলায়নকে যে পরিমাণ নিন্দা করি,ঠিক তেমনি যুদ্ধের ময়দানে আরেক দল,যাঁদের কাহিনী আপনারা পরে পাঠ করবেন,তাঁদের (রণাঙ্গনে) দৃঢ়পদ থাকারও প্রশংসা করি এবং তাঁদের কাজের মর্যাদা দিই।

মহানবী (সা.)-কে হত্যার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পাঁচ ব্যক্তি

যে মুহূর্তে ইসলামী বাহিনী বিক্ষিপ্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল,তখন চতুর্দিক থেকে মহানবীকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হচ্ছিল। এ সত্বেও কুরাইশ বাহিনীর নামকরা পাঁচজন যোদ্ধা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন কিছুর বিনিময়েই হোক,মহানবীর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে ফেলবে। এই লোকেরা ছিল :

১. আবদুল্লাহ্ ইবনে শিহাব,যে মহানবীর কপালে আঘাত করে।

২. আবু ওয়াক্কাসের পুত্র উতবা;সে চারটি পাথর নিক্ষেপ করে হযরতের ডান পাশের রুবাঈ দাঁত মুবারক৪১ ভেঙে দেয়।

৩. ইবনে কুমিআহ্ লাইসী,যে মহানবীর মুখমণ্ডলে আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ আঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে,শিরস্ত্রাণের আংটাগুলো তাঁর মুখমণ্ডলের উপরিভাগ ছিদ্র হয়ে ঢুকে গিয়েছিল। আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বের করে আনেন। এর ফলে তাঁর নিজের চারটি দাঁত ভেঙে যায়।

৪. আবদুল্লাহ্ ইবনে হামীদ,যে হামলা চালানো অবস্থায়ই মুসলিম বাহিনীর বীর যোদ্ধা আবু দুজানার আক্রমণে নিহত হয়।

৫. উবাই ইবনে খালফ,সে ঐ ব্যক্তি যে মহানবীর হাতে নিহত হয়। সে এমন সময় মহানবীর মুখোমুখি হয়,যখন তিনি কোনমতে গিরি উপত্যকায় পৌঁছেছিলেন এবং কয়েকজন সাহাবী তাঁকে চিনতে পেরে চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে রয়েছিলেন। সে মহানবীর দিকে এলে তিনি হারেস ইবনে সিম্মার কাছ থেকে একটি বর্শা নেন এবং তা তার ঘাড়ে বসিয়ে দেন। তাতে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। উবাই ইবনে খালফের জখম যদিও খুব সামান্য ছিল,কিন্তু ভয় তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে,তার বন্ধুরা যতই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল,সে শান্ত হচ্ছিল না। সে বারবার বলছিল : মুহাম্মদকে মক্কায় আমি বলেছিলাম,আমি তোমাকে হত্যা করব। তার উত্তরে সে আমাকে বলেছিল;বরং আমিই তোমাকে হত্যা করব। সে কখনো মিথ্যা বলে না। এ ভয় ও ক্ষতই তার দফা রফা করে। কয়েক দিন পরে (মক্কায়) ফেরার পথে সে মারা যায়।৪২

সত্যই এ বিষয়টি প্রমাণ করে,কুরাইশরা কতখানি হীনমন্য ও ঘৃণ্য মানসিকতার অধিকারী ছিল। তারা এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত এবং স্বীকার করত যে,মহানবী (সা.) সত্যবাদী;তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না। এ সত্বেও তারা চরম শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তাঁর রক্ত ঝরানোর জন্য এতসব চেষ্টা করেছে।

মহানবী পর্বতের মতো দৃঢ়তা ও অবিচলতা সহকারে নিজের ও ইসলামের প্রতিরক্ষা বিধান করেন। যদিও মৃত্যুর সাথে তাঁর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না এবং তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে শত্রুবাহিনী ঢেউয়ের মতো তাঁর ওপর হামলে পড়ছে,এ সত্বেও তাঁর এমন কোন কথা ও আচরণ পরিলক্ষিত হয় নি যার মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের সামান্যতম আভাস থাকতে পারে। কেবল কপালের রক্ত পরিষ্কার করার সময় এটুক কথা তাঁর মুখ দিয়ে বের হয়েছিল, যে জনগোষ্ঠী নিজেদের নবীর মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত করেছে,এমন অবস্থায় যে,তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছিলেন,তারা কিভাবে সফলকাম হবে? ৪৩

এ উক্তি মানুষের প্রতি,এমনকি নিজের শত্রুদের প্রতি তাঁর অতিশয় দয়া ও সহৃদয়তার প্রমাণ বহন করে।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন : মহানবী (সা.) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সবচেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যুদ্ধ ঘোরতর রূপ নিলেই তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কাজেই মহানবী যে নিরাপদ ছিলেন তার অন্যতম কারণ ছিল,তাঁর সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক সংগ্রাম,যা তিনি নিজের ও ইসলামের চৌহদ্দির প্রতিরক্ষার জন্য করেছিলেন।

অবশ্য নবীর জীবন রক্ষার পেছনে অন্য কারণও সক্রিয় ছিল। আর তা ছিল স্বল্পসংখ্যক জান কুরবান সাহাবীর আত্মত্যাগ,যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে তাঁকে রক্ষা করার এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকাকে নির্বাপিত হবার হাত থেকে সমুজ্জ্বল রাখার ব্যবস্থা করেন। উহুদ যুদ্ধের দিন মহানবী প্রচণ্ড যুদ্ধ করেন। তাঁর তূণে যত তীর ছিল সবই তিনি নিক্ষেপ করেন। তাঁর ধনুক ভেঙে গিয়েছিল এবং ধনুকের রশি ছিঁড়ে গিয়েছিল।৪৪

মহানবীর প্রতিরক্ষায় যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন,তাঁরা মাত্র কয়েকজন ছিলেন৪৫ যাঁদের সবার অবিচলতার বিষয়টি ঐতিহাসিক বিচারে নিশ্চিত নয়। ঐতিহাসিকদের মাঝে যে সত্যটি নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত,তা হচ্ছে,স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্বের দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা,যাঁদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষামূলক্ষ প্রচেষ্টার বিবরণ আমরা এখন পেশ করব।

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53