চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড7%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81918 / ডাউনলোড: 7558
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

মহানবী (সা.)-এর গায়েব সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্য

এতে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই যে, পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট কালাম৪২১ অনুসারে মহানবী (সা.) গায়েব অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালের জগৎ সম্পর্কে খবর দিতে এবং পর্দার অন্তরালের রহস্যাবলী- যা মানব জাতির কাছে গোপন রয়েছে,- সেগুলো উন্মোচন করতে সক্ষম ছিলেন। তবে মহানবীর এ জ্ঞান সীমিত ছিল এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ কারণেই এটা সম্ভব যে, কখনো কখনো সবচেয়ে সরল বিষয় সম্পর্কে তাঁর কোন তথ্য জানা নাও থাকতে পারে, যেমন কখনো কখনো তিনি ঘরের চাবি বা টাকা-পয়সা হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং কোথায় তা রেখেছেন বা হারিয়েছেন, তা তাঁর জানা নাও থাকতে পারে। আবার কখনো কখনো তিনি সবচেয়ে জটিল ও দুর্বোধ্য গায়েবী বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে বিশ্ববাসীদের বুদ্ধিমত্তাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিতেও সক্ষম। মহান আল্লাহ্ ইচ্ছা করলেই তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালের বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাপন করবেন। আর তা না হলে সাধারণ মানুষের মতো তাঁরও কোন তথ্য থাকবে না।৪২২

পথিমধ্যে মহানবী (সা.)-এর উট হারিয়ে যায়। মহানবীর একদল সাহাবী সেই উটের খোঁজে বের হন। তখন এক মুনাফিক দাঁড়িয়ে বলেছিল : তিনি বলেন : আমি মহান আল্লাহর নবী এবং আমি ঊর্ধ্বজগতের তথ্য প্রদান করি। অথচ এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, নিজের উট কোথায় আছে, তা তিনি জানেন না! এ কথা মহানবীর কানে পৌঁছায়। তিনি একটি বলিষ্ঠ ভাষণ প্রদান করে সত্য উন্মোচন করে বলেছিলেন :

و انى و الله ما اعلم الا ما علمنى الله و قد دلنى الله عليها وهي من هذا الوادي فى شعب كذا قد حبستها شجرة بزمامها فانطلقوا حتى تأتونى بها

-মহান আল্লাহর শপথ! তিনি যা আমাকে শিখিয়েছেন, কেবল তা-ই আমি জানি। এখন মহান আল্লাহ্ আমাকে উষ্ট্রীটি কোথায় আছে দেখিয়েছেন। উষ্ট্রীটি এ মরু এলাকার অমুক উপত্যকায় আছে এবং ওটার রশি একটি গাছের সাথে জড়িয়ে গেছে এবং এর ফলে সে আর হাঁটতে পারছে না। তোমরা ওখানে গিয়ে উষ্ট্রীটিকে নিয়ে এস।৪২৩ তৎক্ষণাৎ কয়েকজন লোক যে স্থানটির ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছিলেন, সেখানে গেলেন এবং তিনি যেভাবে বলেছিলেন, ঠিক সেভাবে তাঁরা উষ্ট্রীটিকে পেয়েছিলেন।

গায়েবী জগৎ সম্পর্কে আরেক তথ্য প্রদান

হযরত আবু যার গিফারী (রা.)-এর উট পথ চলা বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে তিনি ইসলামী সেনাবাহিনী থেকে পিছে পড়ে যান। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন এবং ভাবলেন, সম্ভবত উটটি দাঁড়িয়ে যাবে এবং আবার তা পথ চলা শুরু করবে। কিন্তু তাঁর অপেক্ষায় কোন ফল হলো না। এ কারণে তিনি উটটিকে ঐ স্থানে ফেলে রেখে সফরের সাজ-সরঞ্জাম পিঠে নিয়ে পথ চলা শুরু করলেন, যাতে তিনি যত শীঘ্র সম্ভব মুসলিম বাহিনীর সাথে মিলিত হতে পারেন। ইসলামী বাহিনী মহানবীর নির্দেশে বিশ্রামের জন্য একটি স্থানে যাত্রাবিরতি করে। হঠাৎ অত্যন্ত ভারী বোঝা পিঠে নিয়ে পথ চলা এক ব্যক্তির মুখমণ্ডল দূর থেকে পরিদৃষ্ট হলো। একজন সাহাবী মহানবীকে এ ঘটনা জানালে তিনি বলেছিলেন : সে আবু যার; মহান আল্লাহ্ আবু যারকে ক্ষমা করুন; সে একাকী পথ চলে, একাকী মৃত্যুবরণ করবে এবং একাকী পুনরুত্থিত হবে।

ভবিষ্যৎ অর্থাৎ পরবর্তী যুগ বা বছরগুলোয় মহানবী (সা.)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণরূপে বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তিনি জনবসতি থেকে দূরে অবস্থিত রাবযার মরুপ্রান্তরে নিজ কন্যার পাশে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় ইন্তেকাল করেছিলেন।৪২৪

তাবুক যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)-এর প্রদত্ত এ ভবিষ্যদ্বাণী দীর্ঘ ২৩ বছর পর বাস্তবায়িত হয়েছিল। স্বাধীনচেতা-মুক্তমনা ও বেহেশতী ব্যক্তি সত্য বলা এবং জনগণকে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করার আহবান জানানোর অপরাধে রাবযা’ এলাকায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। সেখানে ধীরে ধীরে তিনি দৈহিক শক্তি ও স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলেন এবং তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করা কালে তাঁর স্ত্রী তাঁর নূরানী মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তীব্র দুঃখ ও কষ্ট সহকারে কাঁদছিলেন এবং স্বামীর কপালের ঘামের বিন্দুগুলো মুছে দিচ্ছিলেন। হযরত আবু যার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কেন কাঁদছ? স্ত্রী উত্তর দিলেন : এ কারণে কাঁদছি যে, আপনি এখন মারা যাবেন এবং যে কাপড় দিয়ে আপনাকে কাফন দেব, তা আমার কাছে নেই।”

দিকচক্রবাল রেখার উপর অস্তগামী সূর্যের মতো অতি কষ্টে স্মিত হাসির রেখা হযরত আবু যারের ওষ্ঠদ্বয়ের উপর ফুটে উঠল। তিনি বললেন : শান্ত হও। কেঁদো না। একদিন আমি মহানবী (সা.)-এর কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সান্নিধ্যে বসেছিলাম। মহানবী আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন : তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি এক মরু এলাকায় একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে এবং একদল মুমিন তাকে দাফন করবে।

ঐ সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সবাই জনগণের মাঝে জনপদে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন আমি ছাড়া তাঁদের মধ্যেকার আর কোন ব্যক্তিই জীবিত নেই। তাই আমি নিশ্চিত, মহানবী (সা.) যে ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেই ব্যক্তিটি আমি। আমার মৃত্যুর পর ইরাকের হাজীদের যাত্রাপথে বসে থাকবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে একদল মুমিন আসবে। তখন তাদেরকে আমার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করবে।

হযরত আবু যারের স্ত্রী বললেন : এখন হজ্ব কাফিলাসমূহের গমনাগমনের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।” হযরত আবু যার তখন বললেন : তুমি রাস্তার উপর লক্ষ্য রাখবে। মহান আল্লাহর শপথ! না আমি মিথ্যা বলছি আর না আমি মিথ্যা শুনেছি।” এ কথা বলার পরপরই হযরত আবু যারের প্রাণপাখি ঊর্ধ্বলোকের বেহেশতের দিকে পাখা মেলে উড়ে যায়।৪২৫

হযরত আবু যার সত্য বলেছিলেন। মুসলমানদের একটি কাফিলা দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে আসছিল, যাঁদের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, হুজর ইবনে আদী ও মালিক আশতারের মতো বড় বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ দূর থেকে এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখতে পেলেন। একটি নিস্প্রাণ দেহ রাস্তার পাশে পড়ে আছে এবং তার কাছে একজন মহিলা ও একটি ছোট ছেলে কাঁদছে।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ ঐ দু জনের কাছে গিয়ে লাগাম টেনে সওয়ারী পশুকে থামালে কাফিলার অন্যান্য সদস্যও তাঁকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ যখনই ঐ মৃতদেহের দিকে তাকালেন, তখনই তাঁর দৃষ্টি তাঁর দীনী ভাই ও বন্ধু আবু যারের উপর স্থির হয়ে গেল।

তাঁর নয়নযুগল অশ্রুসজল হয়ে গেল। তিনি আবু যারের পবিত্র লাশের কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং তাবুক যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে বললেন : মহানবী (সা.) সত্য বলেছিলেন : তুমি একাকী পথ চলবে, একাকী মৃত্যুবরণ করবে এবং একাকী কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত হবে।৪২৬

অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ হযরত আবু যারের জানাযার নামায পড়লেন।৪২৭ এরপর তাঁর লাশ দাফন করা হয়। লাশ দাফন শেষ হলে মালিক আশতার তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন :

“হে প্রভু! এ আবু যার মহানবী (সা.)-এর সাহাবী ছিলেন, যিনি জীবনভর আপনার ইবাদত-বন্দেগী করেছেন; আপনার পথে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন এবং কখনই তিনি সত্য ধর্ম অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নিজ আদর্শ, পথ ও পদ্ধতি পরিবর্তন করেন নি। তবে তিনি মুখের ভাষা ও অন্তর দিয়ে দুর্নীতি, অসৎ ও মন্দ কাজের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন বলে অত্যাচারিত, বঞ্চিত, অপদস্থ এবং নির্বাসিত হয়েছিলেন এবং অবশেষে বিদেশ-বিভূঁইয়ে নির্বাসনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।”

তাবুক অঞ্চলে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রবেশ

তাওহীদী বাহিনী হিজরতের নবম বর্ষের শাবান মাসের শুরুতে তাবুক অঞ্চলে প্রবেশ করে। তবে রোমান বাহিনীর কোন চিহ্ন তারা সেখানে দেখতে পেল না, যেন রোমের নেতৃবৃন্দ ইসলামের সৈনিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের অতুলনীয় সাহসিকতা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগ (যার একটি ক্ষুদ্র নমুনা তারা কাছে থেকে মুতার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করেছিল) সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত হয়েছিল এবং তারা এ বিষয়কে কল্যাণকর বলে বিবেচনা করেছিল যে, তারা তাদের সেনাবাহিনী তাদের রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাবে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের সৈন্য সমাবেশের খবর অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে এমন একটা ভাব দেখাবে যে, কোন সময়ই (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) আক্রমণের চিন্তা তাদের মনে ছিল না; যার ফলে তারা এভাবে আরব উপদ্বীপে যে সব ঘটনা প্রবাহের উদ্ভব হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়।৪২৮

এ সময় মহানবী তাঁর উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণকে একত্রিত করে و شاورهم فِى الأمر   (এবং তাঁদের সাথে সকল বিষয়ে পরামর্শ করুন)- ইসলামের এ দৃঢ় মূলনীতির ভিত্তিতে শত্রুপক্ষের ভূ-খণ্ডের অভ্যন্তরে অগ্রসর হওয়া বা মদীনা নগরীতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে তাঁদের সাথে পরামর্শ করলেন।

সামরিক পরামর্শের ফলাফল এই দাঁড়াল যে, তাবুক গমনপথ অতিক্রম করার ক্ষেত্রে ইসলামী বাহিনীকে যে অপরিসীম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, সে কারণে পুনঃ শক্তি সঞ্চয় করার জন্য তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবে। অধিকন্তু মুসলিম সেনাবাহিনী তাদের এ সামরিক অভিযানে রোমান বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার সুমহান লক্ষ্য অর্জন করেছিল এবং রোমীয়দের অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করেছিল। আর এ ভীতি তাদের দীর্ঘকাল পর্যন্ত আক্রমণ ও সামরিক শক্তি পুনর্গঠন থেকে বিরত রাখবে। এতটুকু ফলাফল, যা বেশ কিছু কাল উত্তর দিক থেকে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করছিল, তা ভবিষ্যতে মহান আল্লাহ্ কী ইচ্ছা করেন, সে পর্যন্ত আমাদের (মুসলমানদের) জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরামর্শ সভার প্রধান পরামর্শদাতাগণ মহানবীর মর্যাদা ও অবস্থান রক্ষা করার জন্য এবং যাতে করে তাঁদের অভিমত প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়, সেজন্য এ কথাও বলেছিলেন : এ সত্বেও আল্লাহ্পাকের পক্ষ থেকে যদি আপনি (শত্রু ভূ-খণ্ডে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে) আদিষ্ট হয়ে থাকেন, তা হলে আপনি যাত্রা শুরু করার আদেশ দান করুন এবং আমরাও আপনার পেছনে আছি।৪২৯

মহানবী (সা.) বললেন : মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আদেশ আসে নি। আর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আদেশ এসে থাকলে আমি তোমাদের সাথে পরামর্শ করতাম না। আমি পরামর্শ সভার অভিমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এখান থেকেই মদীনায় ফিরে যাব। যে সব শাসনকর্তা সিরিয়া ও হিজায সীমান্তে বসবাস করত, তারা সবাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ছিল এবং তাদের নিজেদের গোত্র ও আবাসভূমিতে তাদের অভিমতের কার্যকরী প্রভাব ছিল। এ কারণেই এ সম্ভাবনাও ছিল যে, রোমান বাহিনী একদিন তাদের স্থানীয় সেনাশক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং তাদের সহায়তা নিয়ে হিজায আক্রমণ করতে পারে। এ কারণেই এটা অপরিহার্য হয়ে গিয়েছিল যে, মহানবী (সা.) তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করবেন এবং এভাবে তিনি তাদের পক্ষ থেকে হুমকির সম্মুখীন না হওয়ার ব্যাপারে স্বস্তি লাভ করবেন এবং অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন।

তিনি তাবুকের কাছে বসবাস রত সীমান্তরক্ষী ও শাসনকর্তাদের সাথে নিজেই যোগাযোগ করেন এবং বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন। তিনি বেশ কিছু দলকেও তাবুক থেকে দূরে অবস্থিত অঞ্চলগুলোয় প্রেরণ করেছিলেন যাতে মুসলমানদের জন্য অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

আইলা, আযরু ও জার্বার শাসনকর্তাদের সাথে তিনি নিজে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন। সমুদ্র তীরবর্তী নগরী আইলা লোহিত সাগরের তীরে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং শামের সাথে এ নগরীর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না। সেখানকার শাসনকর্তা ইউহান্না ইবনে রৌবাহ্ বুকে স্বর্ণনির্মিত ক্রুশ ঝুলিয়ে তাঁর শাসনকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তাবুক অঞ্চলে এসে মহানবীকে একটি সাদা খচ্চর উপঢৌকন দিয়েছিলেন এবং মহানবীর প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। মহানবীও তাঁকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে উপঢৌকন প্রদান করেছিলেন।

তিনি খ্রিষ্টধর্মে বহাল থেকে প্রতি বছর তিন শ’ দীনার জিযিয়া (প্রত্যেক বিধর্মী নাগরিক ইসলামী হুকুমতের আওতা ও তত্ত্বাবধানে বসবাস করে ইসলামী প্রশাসনকে যে কর প্রদান করে) এবং আইলা অঞ্চল অতিক্রমকারী মুসলমানকে আপ্যায়ন করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। এ মর্মে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নরূপ একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় :

“এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে ইউহান্না ও আইলার অধিবাসীদের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি। এ চুক্তি মোতাবেক জল ও স্থলপথে ব্যবহৃত তাদের সমুদয় যানবাহন এবং শাম, ইয়েমেন ও সমুদ্র পথে যারা তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাদের সবাইকে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদান করা হলো। তবে তাদের মধ্য থেকে যে কেউ কোন অপরাধ করবে এবং আইনবিরোধী কোন কাজ করবে, তার সম্পত্তি তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। সকল জল ও স্থলপথ তাদের জন্য উন্মুক্ত এবং এ সব পথে তাদের যাতায়াতের অনুমতিও প্রদান করা হলো।৪৩০

এ সন্ধিপত্র থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কোন জাতি মুসলমানদের সাথে আপোষ ও সন্ধি করলে তাদের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হতো।

মহানবী (সা.) আযরু ও জার্বা অঞ্চলের অধিবাসীদের ন্যায় অন্য সকল সীমান্তবর্তী জনপদ, যাদের ভূ-খণ্ড সৈন্য সমাবেশের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের সাথেও বেশ কিছু চুক্তি সম্পাদন করে উত্তর দিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।

দাওমাতুল জান্দাল অঞ্চলে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে প্রেরণ

দাওমাতুল জান্দাল এক জন-অধ্যুষিত অঞ্চলকে বলা হতো, যা সবুজ গাছপালা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল এবং সেখানে নহর ও ঝরনার প্রবহমান পানি ছিল। এ অঞ্চলটি একটি শক্তিশালী দুর্গের পাশে অবস্থিত ছিল এবং শামের সাথে এ অঞ্চলের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫০ ফারসাখ।৪৩১

তখন উকাইদার ইবনে আবদুল মালিক মাসীহী দাওমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা ছিলেন। মহানবী (সা.) আশংকা করছিলেন, রোমান বাহিনী পুনরায় আক্রমণ চালালে দাওমার খ্রিষ্টান শাসনকর্তা তাদেরকে সাহায্য করবে। আর এভাবে আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য তিনি বিদ্যমান সেনাশক্তির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার এবং খালিদের নেতৃত্বে একটি সেনাদল প্রেরণ করে দাওমা অঞ্চলকে (ইসলামী হুকুমতের প্রতি) বশ্যতা স্বীকার করানোর বিষয়কে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করছিলেন।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ দ্রুত একদল অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দাওমাতুল জান্দালের কাছাকাছি চলে যান এবং দুর্গের বাইরে গোপনে অবস্থান গ্রহণ করেন।

আলোকোজ্জ্বল ঐ চাঁদনী রাতে ভাই হাসসানকে সাথে নিয়ে উকাইদার শিকারের উদ্দেশ্যে দুর্গের বাইরে আসেন। তখনও তিনি দুর্গ থেকে দূরে যান নি; হঠাৎ তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীসহ খালিদের সেনাদলের মুখোমুখি হন। তাদের ও মুসলিম সৈন্যদের মাঝে ছোট একটি সংঘর্ষ হয়। এতে উকাইদারের ভাই নিহত হয়। উকাইদারের সঙ্গীরা দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেয় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু উকাইদার মুসলিম সেনাদলের হাতে বন্দী হন।

খালিদ তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, দুর্গের অধিবাসীরা তাঁর নির্দেশে ইসলামী সেনাদলের জন্য দুর্গের দরজা খুলে দিলে এবং অস্ত্র সমর্পণ করলে তিনি তাঁর দোষ উপেক্ষা করবেন এবং তাঁকে মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাবেন।

উকাইদার মুসলমানদের সত্যবাদিতা এবং চুক্তির প্রতি তাদের নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত থাকার ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন। এ কারণেই তিনি দুর্গের দরজা খুলে দেয়া ও অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলেন। দুর্গের মধ্যে বিদ্যমান অস্ত্র ছিল নিম্নরূপ : চার শ’ বর্ম, পাঁচ শ’ তরবারি এবং চার শ’ বর্শা। খালিদ এসব যুদ্ধলব্ধ গনীমত ও উকাইদারকে সাথে নিয়ে পবিত্র মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হন।

মদীনায় প্রবেশ করার প্রাক্কালে খালিদ উকাইদারের স্বর্ণখচিত হাতাহীন আলখাল্লা, যা তিনি রাজাদের মতো কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিতেন এবং যা খালিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা মহানবী (সা.)-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। স্বর্ণখচিত এ রেশমী পোশাকটির উপর দৃষ্টি পড়লে একদল দুনিয়া-অন্বেষী লোকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। অথচ মহানবী (সা.) ঐ পোশাকটির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন : বেহেশতবাসীদের পোশাক এর চেয়েও অধিক শানদার ও আশ্চর্যজনক।”

উকাইদার মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালেন। তবে তিনি মুসলমানদের কর প্রদানের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করলেন। মহানবী (সা.) ও তাঁর মাঝে একটি চুক্তিনামা সম্পাদিত হলো। এরপর মহানবী (সা.) তাঁকে অত্যন্ত মূল্যবান উপহার প্রদান করলেন এবং তাঁকে নিরাপদে দাওমাতুল জান্দালে পৌঁছে দেবার জন্য আব্বাদ ইবনে বিশ্রকে দায়িত্ব দিলেন।৪৩২

তাবুক অভিযান মূল্যায়ন

মহানবী (সা.) অত্যন্ত কষ্টকর এ অভিযানে শত্রুপক্ষের মুখোমুখি হন নি এবং তাদের সাথে কোন সংঘর্ষেও লিপ্ত হন নি। তবে তিনি কিছু আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক কল্যাণ লাভ করেছিলেন, যেসব হচ্ছে নিম্নরূপ :

১. এর মাধ্যমে তিনি ইসলামী সেনাবাহিনীর মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন এবং হিজাযের অধিবাসীদের ও শামের সীমান্ত এলাকাগুলোর বাশিন্দাদের অন্তরে তাঁর সম্মান ও ক্ষমতা দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর শত্রু-মিত্র সবাই বুঝতে পেরেছিল, ইসলাম ও মুসলমানদের সামরিক শক্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মোকাবেলা করতে এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম।

বিরুদ্ধাচরণ ও সীমালঙ্ঘন যে আরব গোত্রগুলোর অস্তিত্ব ও স্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল, তাদের মাঝে এ বিষয়টি প্রচারিত হয়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছুকালের জন্য তাদের মন থেকে (ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর) বিরুদ্ধাচরণ ও বিদ্রোহ করার চিন্তা উবে গিয়েছিল এবং তারা এ ধরনের চিন্তার ধারে-কাছেও আর যায় নি।

এ কারণেই মদীনা নগরীতে মহানবীর প্রত্যাবর্তনের পর যে সব গোত্র তখনও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নি, তাদের প্রতিনিধিরা মদীনা নগরীতে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণ এবং মহানবীর প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিতে থাকে। ফলে হিজরতের নবম বর্ষকে আমুল উফূদ’ (عام الوفود ) অর্থাৎ প্রতিনিধি দলগুলোর বর্ষ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

২. হিজায ও সিরিয়ার সীমান্তবাসীদের সাথে বেশ কিছু সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার মাধ্যমে মুসলমানরা আরব উপদ্বীপের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছিল এবং নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, ঐ সব অঞ্চলের গোত্রপতি ও নেতারা রোমান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করবে না।

৩. মহানবী (সা.) কষ্টকর এ অভিযান পরিচালনা করে আসলে পরবর্তী কালে শাম বিজয়ের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণকে এ ক্ষেত্রে সঠিক পথ প্রদর্শন এবং এ অঞ্চলে বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার সাথে তাঁদেরকে পরিচিত করিয়েছিলেন। আর সে সাথে তখনকার পরাশক্তিগুলোর মোকাবেলায় কিভাবে সৈন্য পরিচালনা করতে হবে, তাও তিনি তাঁদেরকে শিখিয়েছিলেন। তাই মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলমানরা সর্বপ্রথম যে অঞ্চল জয় করেছিলেন, তা ছিল শাম ও সিরিয়া।৪৩৩

৪. তাবুক অভিযানে গণবাহিনী পুনর্গঠনের সময় মুমিন ও মুনাফিক পরস্পর চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর এর ফলে মুসলিম সমাজে ব্যাপক শুদ্ধি প্রক্রিয়াও সাধিত হয়েছিল।

পঁচিশতম পত্র

১৬ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   এ হাদীসের প্রতি তাঁর বিশ্বাস।

২।   এ বিষয়ে আরো আলোচনার আহবান।

১। সেই শক্তির প্রতি ঈমান আনছি যিনি আপনার জ্ঞানের আলোয় আমার অন্ধকারকে দূরীভূত করে আলোকিত করেছেন ও আমার অস্পষ্টতাকে দূর করেছেন। সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি আপনাকে তাঁর নিদর্শন ও চিহ্নে পরিণত করেছেন।

২। এ বিষয়ে আরো প্রামাণ্য হাদীস উপস্থাপন করুন।

ওয়াসসালাম

ছাব্বিশতম পত্র

১৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হযরত আলী (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে দশটি ফজীলত বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কারো মধ্যে ছিল না।

২।   কেন আমরা এ হাদীস হতে দলিল পেশ করেছি?

১। হাদীসে দার (যে হাদীসটি বিংশতম পত্রে উল্লেখ করেছি) ছাড়াও আরেকটি হাদীস এখানে বর্ণনা করছি আপনার অবগতির জন্য।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে,ইমাম নাসায়ী তাঁর খাছায়েসুল আলাভীয়া তে,হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে,যাহাবী তাঁর তালখিস গ্রন্থে (হাদীসটির বিশুদ্ধতাকে স্বীকার করে) ও সুনান লেখকগণ তাঁদের সুনানে আমর ইবনে মাইমুন হতে এ হাদীসটি এনেছেন এবং এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে একমত হয়েছেন। আমর বলেন, ইবনে আব্বাসের নিকট বসেছিলাম,নয় দল লোক তাঁর নিকট এসে বলল : আমাদের সঙ্গে আসুন নতুবা আপনার নিকট হতে সবাইকে চলে যেতে বলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। ইবনে আব্বাস বললেন : তোমাদের সঙ্গে যাব। আমর ইবনে মাইমুন বলেন, ইবনে আব্বাস তখনও অন্ধ হন নি,তাঁর চোখ ভাল ছিল। ইবনে আব্বাস তাদের সঙ্গে একদিকে চলে গেলেন। তাঁরা কি কথা বললেন তা আমরা শুনি নি। কিছুক্ষণ পর ইবনে আব্বাস তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এলেন ও বলতে লাগলেন : এমন ব্যক্তির তারা নিন্দা করছে যার দশটি ফজীলত রয়েছে যা কোন ব্যক্তির মধ্যেই নেই। তারা এমন ব্যক্তির নিন্দা করছে যার সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল (সা.) বলেছেন : এমন ব্যক্তিকে আমি আজ যুদ্ধে প্রেরণ করবো যাকে আল্লাহ্ কোনদিনই লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন না,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তাকে ভালবাসে আর সেও আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে। যখন রাসূল এ মর্যাদার কথা বলছিলেন তখন সকলেই ঘাড় টান করে অপেক্ষা করছিল এ সৌভাগ্য তার ভাগ্যে জুটুক। তখন রাসূল (সা.) বললেন : আলী কোথায়? আলী আসলেন,তাঁর তখন চক্ষু পীড়া ছিল,তিনি কিছু দেখতে পারছিলেন না। রাসূল নিজ জিহ্বার পানি তাঁর চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তিনবার যুদ্ধের পতাকাটি এদিক-ওদিক নাড়িয়ে আলীর হাতে দিলেন। আলী তা নিয়ে খায়বারে গেলেন ও যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইহুদী গোত্রপতি হুয়াইয়ের কন্যা সাফিয়াসহ অন্যান্যদের বন্দী করে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) অমুককে (হযরত আবু বকর) মক্কাবাসীদের জন্য সূরা তওবা পাঠ করে শুনানোর জন্য প্রেরণ করলেন এবং তারপর আলীকে তাঁর নিকট হতে তা গ্রহণ করতে বললেন ও ঘোষণা করলেন : এমন ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করবে যে আমা হতে এবং আমি তার হতে।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) তাঁর সকল চাচা ও চাচার পুত্রদের প্রতি আহবান জানালেন দুনিয়া আখেরাতে তাঁর সহযোগী হতে কিন্তু তারা তা করতে সম্মত না হলে আলী দাঁড়িয়ে বললেন: আমি দুনিয়া ও আখেরাতে আপনার সহযোগী হব। রাসূল (সা.) বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার বন্ধু,আমার সহযোগী। অতঃপর পুনরায় তাদের প্রতি এ আহবান জানালেন। তবুও তারা কেউ সম্মত হলো না,শুধু আলী দাঁড়িয়ে সাড়া দিলেন। আর রাসূল বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সহযোগী ও বন্ধু।

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী হযরত খাদিজাহর পর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়নকারী প্রথম ব্যক্তি।

তিনি আরো বলেন : রাসূল (সা.) নিজ চাদরকে আলী,ফাতিমা,হাসান ও হুসাইনের ওপর বিছিয়ে দিলেন ও বললেন : হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ ইচ্ছা করেছেন তোমাদের হতে সকল

পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে ও তোমাদের পবিত্র করতে।২৩৪

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রাসূল (সা.)-এর ঘুমানোর স্থানে তাঁর পোষাক পড়ে শুয়েছিলেন,রাসূলের জন্য তাঁর জীবনকে আল্লাহর নিকট বিক্রয় করেছিলেন,তখন কাফেররা তাঁর প্রতি পাথর বর্ষণ করছিল।

তিনি বলেন : নবী তাবুকের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করলেন,মদীনায় লোকেরাও তাঁর সঙ্গে মদীনা হতে বের হলো। আলী তাঁকে বললেন : আমিও আপনার সঙ্গে যাব। রাসূল (সা.) বললেন : না। আলী কেঁদে ফেললেন। নবী তাঁকে বললেন : তুমি কি এতে খুশী নও,তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে হারুন ও মূসার মধ্যকার সম্পর্কের মত হোক? তবে পার্থক্য এই,আমার পর কোন নবী নেই। এটি ঠিক হবে না যে,আমি চলে যাব অথচ তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে না।

নবী (সা.) তাঁকে (আলীকে) বলেছেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي و مؤمنة   অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর অভিভাবক।

ইবনে আব্বাস আরো বলেন : নবী মসজিদের মধ্যে অতিক্রমকারী সকল দ্বার বন্ধ করে দেন শুধু আলীর দ্বার ব্যতীত। আলী অপবিত্র (জুনুব) অবস্থায়ও মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং ঐ দ্বার ব্যতীত বাইরে যাবার অন্য কোন পথও ছিল না। নবী (সা.) বলেছেন : আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।

উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করে হাকিম বলেছেন, এ হাদীস সনদের দিক থেকে সঠিক,তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি। তদ্রুপ যাহাবীও তাঁর তালখিস গ্রন্থে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।

২। এ হাদীসের মধ্যে যে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে তা কারো নিকট গোপন নেই। এ হাদীস এটিই প্রমাণ করে যে,হযরত আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত।

আপনি কি এখানে লক্ষ্য করেছেন রাসূল (সা.) কিরূপে আলী (আ.)-কে দুনিয়া ও আখেরাতের মাওলা বা অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করে তাঁকে তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি তাঁদের সম্পর্ককে হারুন ও মূসার মত বলেছেন শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,তাঁর পর কেউ নবী নেই অর্থাৎ নবুওয়াতের মর্যাদা ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর অন্য সকল মর্যাদা আলী (আ.)-এরও রয়েছে।

আপনি সম্যক জ্ঞাত,হযরত হারুন ও মূসা (আ.)-এর মধ্যে সম্পর্কের ধরন কিরূপ ছিল। হযরত হারুন (আ.) মূসা (আ.)-এর সঙ্গে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে অংশীদার ছিলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর সহযোগী,পরামর্শদাতা,খলীফা ও প্রতিনিধিও ছিলেন। তাই হযরত মূসা (আ.)-এর মত হযরত হারুনের অনুসরণ সকল উম্মতের জন্য অপরিহার্য বা ওয়াজিব ছিল। এজন্যই হযরত মূসা (আ.) দোয়া করেছিলেন, আমার আহল (পরিবার) হতে একজনকে আমার সহযোগী কর,আমার ভাই হারুনকে ও তার মাধ্যমে আমার কোমরকে মজবুত কর ও তাকে আমার কাজের অংশীদার কর। (সূরা ত্বাহা : ২৯)

হযরত মূসা (আ.) হারুনকে বললেন, আমার জাতির মধ্যে আমার স্থলাভিষিক্ত হও। তাদেরকে সংশোধন কর ও অন্যায়কারীদের পথ অবলম্বন কর না। ২৩৫ আল্লাহ্ হযরত মূসা (আ.)-কে বললেন, তুমি আমার নিকট যা চেয়েছিলে তা তোমাকে দেয়া হলো। ২৩৬

সুতরাং এ হাদীস অনুযায়ী আলী (আ.) এ জাতির মধ্যে রাসূল (সা.)-এর খলীফা,তাঁর পরিবারের মধ্যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও তাঁর কাজে (খেলাফতের বিষয়ে,নবুওয়াতের বিষয়ে নয়) অংশীদার। তাই আলী (আ.) রাসূলের উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আনুগত্য সর্বাবস্থায় হযরত হারুনের মত যাঁর আনুগত্য মূসা (আ.)-এর উম্মতের ওপর অপরিহার্য ছিল। বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট।

যে কেউ এ হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) শ্রবণ করবে আলী সম্পর্কে এসব মর্যাদা তার স্মরণে আসবে এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নবীও তাই এ বিষয়টি সকলের জন্য সুস্পষ্ট করে বলেছেন, এটি ঠিক হবে না,তোমাকে আমার স্থলভিষিক্ত না করেই আমি চলে যাব।

এটি আলী (আ.)-এর খেলাফতের পক্ষে স্পষ্ট দলিল যে,আলীকে নিজের খলীফা মনোনীত না করে যাওয়াকে রাসূল (সা.) সঠিক মনে করেন নি। রাসূল (সা.) তাঁর এ কাজটি আল্লাহর নির্দেশেই করেছিলেন,যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে এসেছে-

) يا أَيُّهَا الرَّسُوْل بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّك وَ إِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ(

হে নবী! যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে তাঁর রেসালতের কিছুই আপনি পৌঁছান নি।২৩৭

যদি কেউ এ আয়াতের আপনি তাঁর রেসালতের কিছুই পৌঁছান নি অংশটি লক্ষ্য করেন এবং এর সঙ্গে রাসূলের এ কথাটি নিশ্চয়ই এটি সঠিক হবে না,তোমাকে খলীফা নিযুক্ত না করেই চলে যাব মিলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন দু টি বাণীই একটি লক্ষ্যকে অনুসরণ করছে।

আমাদের রাসূল (সা.)-এর এ বাণীটি কখনোই ভুলে গেলে চলবে না, তুমি আমার পর সকল মুমিনদের অভিভাবক। এটি অকাট্য দলিল হিসেবে হাদীসে এসেছে যে,আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত। প্রসিদ্ধ কবি কুমাইত (আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করুন) যেমনটি বলেছেন-

কত সুন্দর অভিভাবক তিনি সেই শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের পর,যিনি তাকওয়ার কেন্দ্র ও আদবের শিক্ষকের পর মনোনীত হয়েছেন।

ওয়াসসালাম

সাতাশতম পত্র

১৮ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

 ‘ মানযিলাত -এর হাদীসের বিষয়ে সন্দেহ।

মানযিলাত -এর হাদীসটি সহীহ ও মুস্তাফিয (খবরে ওয়াহেদের চেয়ে বহুল প্রচারিত) কিন্তু বিশিষ্ট হাদীসবিদ আমেদী এ হাদীসের সনদের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাই আপনাদের অনেক শত্রুরই দ্বিধান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। আপনি কিরূপে তাদের নিকট এটি প্রমাণ করবেন। উত্তর জানিয়ে বাধিত করুন।

ওয়াসসালাম

আটাশতম পত্র

১৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   মানযিলাত -এর হাদীস প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের অন্যতম।

২।   এ সত্যের সপক্ষে প্রমাণ।

৩।   আহলে সুন্নাহর যে সকল রাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪।   এ হাদীসটির বিষয়ে আমেদীর সন্দেহ পোষণের কারণ।

১। আমেদী এ সন্দেহের মাধ্যমে নিজের ওপরই জুলুম করেছেন। কারণ মানযিলাত -এর হাদীসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের একটি।

২। এ হাদীসের সনদের বিশুদ্ধতার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হাদীসটি সম্পর্কে দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই এবং এর প্রামাণিকতার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন উঠাতে পারেন না,এমন কি যাহাবী অত্যন্ত কঠোরতা সত্ত্বেও মুসতাদরাক গ্রন্থের সারসংক্ষেপে হাদীসটির সহীহ হবার কথা স্বীকার করেছেন।৩৩৮ ইবনে হাজার হাইসামী বিভিন্ন বিষয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁর সাওয়ায়েক গ্রন্থের দ্বাদশ পর্বে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন ও এর বিশুদ্ধতার বিষয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদদের (এ বিষয়ে যাঁদের প্রতি রুজু করা উচিত) সূত্রে বর্ণনা করেছেন।৩৩৯ আপনি এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন। যদি হাদীসটি এতটা প্রমাণ্য না হত তাহলে বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে তা উল্লেখ করতেন না। কারণ বুখারী হযরত আলীর বৈশিষ্ট্য,ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্ক ও পারতঃপক্ষে বিরত থাকতেন ও এ বিষয়ে তিনি নিজের ওপর জুলুম করেছেন। মুয়াবিয়া যিনি আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও সব সময় তাঁর প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করতেন,এমন কি মিম্বারে আলীর ওপর লানত পড়ার জন্য নির্দেশ জারী করেছিলেন তদুপরি তিনি মানযিলাত -এর হাদীসটি অস্বীকার করেন নি। মুসলিমের৩৪০ সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে : একবার মুয়াবিয়া সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে বললেন : কি কারণে আবু তোরাবের (আলী [আ.]-এর) নিন্দা কর না? সা দ জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) তাঁর বিষয়ে তিনটি কথা বলেছেন সেগুলো মনে হওয়ায় এ কাজ হতে আমি বিরত হলাম। ঐ তিনটি বৈশিষ্ট্যের যদি একটিও আমার থাকত তাহলে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হতেও তা আমার নিকট প্রিয়তর বলে গণ্য হত। নবী (সা.) কোন কোন যুদ্ধের সময় তাঁকে মদীনায় রেখে যেতেন ও বলতেন : তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত হোক তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও? শুধু পার্থক্য এটিই আমার পর তুমি নবী নও।২৪১ মুয়াবিয়া একথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন ও সা দকে আলীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হতে বিরত থাকার অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।

আরো বাড়িয়ে বললে বলা যায় স্বয়ং মুয়াবিয়া মানযিলাত -এর হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার তাঁর সাওয়ায়েক ২৪২ গ্রন্থে বলেছেন, আহমাদ বর্ণনা করেছেন : এক ব্যক্তি কোন একটি বিষয়ে মুয়াবিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন : আলী এ বিষয়ে অধিকতর জ্ঞাত,তাকে প্রশ্ন কর। লোকটি বলল : আলী অপেক্ষা তোমার উত্তর আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। মুয়াবিয়া বললেন : মন্দ কথা বলেছ,এমন ব্যক্তি হতে তুমি বীতশ্রদ্ধ যাঁকে রাসূল (সা.) জ্ঞানের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল মুখ মনে করতেন ও তাঁকে বলেছেন :

أَنْتَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنِ مُوْسى إِلّا أَنَّهُ لا نَبِيَّ بَعْدِي

তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত,শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পর কোন নবী নেই।

যখনই হযরত উমরের জন্য কোন সমস্যা দেখা দিত,তিনি আলী (আ.)-কে ডাকতেন।

সুতরাং মানযিলাত -এর হাদীসটি এমন একটি বিষয় যাতে মুসলমানদের সকল মাজহাব ও দল ঐকমত্য পোষণ করে,হাদীসটির বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

৩। আল জাম বাইনাস্ সিহাহ আস সিত্তাহ্ ২৪৩ আল জাম বাইনাস্ সহীহাইন ২২৪ গ্রন্থের লেখকদ্বয়ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারীতে তাবুকের যুদ্ধের২৪৫ বর্ণনায় হাদীসটি রয়েছে।

সহীহ মুসলিমে২৪৬ হযরত আলীর ফাজায়েল অধ্যায়ে হাদীসটি এসেছে। এছাড়া সুনানে ইবনে মাজাহ্তে২৪৭ নবী (সা.)-এর সাহাবীদের ফাজায়েল অধ্যায়ে ও মুসতাদরাকে হাকিম -এ হযরত আলীর মানাকিব ২৪৮ বা বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় এ হাদীসটি আনা হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হতে কয়েকটি সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন২৪৯

আহমাদ তাঁর মুসনাদে ইবনে আব্বাস২৫০ ,আসমা বিনতে উমাইস২৫১ ,আবু সাঈদ খুদরী২৫২ এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান২৫৩ ও আরো কয়েকটি সূত্রে অন্যান্য সাহাবী হতেও হাদীসটি নকল করেছেন।

তাবরানী এ হাদীসটি আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হাবিশ ইবনে জুনাদাহ্,ইবনে উমর,ইবনে আব্বাস,জাবির ইবনে সামুরাহ্,যায়েদ ইবনে আরকাম,বাররাহ্ ইবনে আযেব এবং আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণনা করেছেন।

বাযযার তাঁর মুসনাদে ও তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বার তাঁর ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচিতি পর্বে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসটি বিশুদ্ধতম ও সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠিত হাদীস যা সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, সা দ হতে এত অধিক সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে,ইবনে আবি খাইসামাহ্ ও অন্যরাও তা বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বারের মতে হাদীসটির অন্যান্য বর্ণনাকারীরা হলেন ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,উম্মে সালামাহ্,আসমা বিনতে উমাইস,জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ অনসারী ও আরো কয়েকজন সাহাবী।

যে সকল মুহাদ্দিস,সীরাহ্ লেখক ও হাদীস বর্ণনাকারী তাবুকের যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাঁরা এ হাদীসটি তাঁদের বর্ণনায় এনেছেন।

পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের সকল রিজাল লেখকই (শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে) হযরত আলী

(আ.)-এর পরিচিতি বর্ণনায় এ হাদীসটি এনেছেন।

আহলে বাইতের মানাকিব (বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা) বর্ণনাকারী ব্যক্তিরা যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল ও তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটি এমন এক হাদীস যা সকল যুগেই প্রতিষ্ঠিত হাদীসগুলোর একটি বলে পরিগণিত হত।

৪। অতএব,আমেদীর সন্দেহ (হাদীসটির বিষয়ে) এ ক্ষেত্রে কোন মূল্যই রাখে না,বরং বলা যায় তিনি কোন হাদীসবেত্তা নন ও এ বিষয়ে তাঁর কোন জ্ঞান নেই। উসূলশাস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে হাদীসের সনদ ও সূত্র পর্যালোচনা সম্ভব নয়। তাই সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হাদীসের সনদে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

উনত্রিশতম পত্র

২০ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হাদীসটির সনদের বিশুদ্ধতার সত্যায়ন।

২।   হাদীসটির সার্বিকতার বিষয়ে সন্দেহ।

৩।   হাদীসের প্রামাণিকতার (প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের উপযোগিতার) বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন।

১। হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) যে সুপ্রতিষ্ঠিত সে বিষয়ে আপনার বর্ণনায় আমার সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমেদী যে ভুল করেছেন এর কারণ হাদীসশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞানের অভাব। আমি তাঁর বিশ্বাস ও মত উপস্থাপন করে আপনাকে কষ্টে ফেলেছি তাতে আপনি বাধ্য হয়েছেন এ বিষয়ে  প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতে। এ ভুলের জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি বিষয়টিকে ক্ষমার চোখে দেখবেন।

২। আপনাদের বিরোধীদের মধ্যে আমেদী ছাড়াও অনেকেই মনে করেছেন মানযিলাত -এর হাদীসটি সর্বজনীন নয়,বরং তা বিশেষভাবে তাবুকের যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সে সময়ের জন্যই তিনি রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা এ হাদীসের প্রেক্ষাপট যেখানে রাসূল (সা.) আলীকে মদীনায় তাঁর স্থানে রেখে যাচ্ছেন তার উল্লেখ করেন। ইমাম আলী (আ.) যখন রাসূল (সা.)-কে বললেন, আমাকে কি মহিলা ও শিশুদের মাঝে রেখে যাচ্ছেন? তখন নবী (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে মূসার স্থলাভিষিক্ত হারুনের মত তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হও এ পার্থক্য সহ যে আমার পর কোন নবী নেই? বাহ্যিকভাবে রাসূলের উদ্দেশ্য ছিল এটিই বলা,রাসূলের সাথে আলীর সম্পর্ক মূসা (আ.)-এর সঙ্গে হারুন (আ.)-এর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ হযরত মূসা (আ.) তুর পর্বতে যাবার সময় নিজের জাতির মধ্যে হারুন (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান।

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেন তাবুকের যুদ্ধের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে আলী তাঁর স্থলাভিষিক্ত যেমনভাবে মূসা ইবাদতের জন্য তুর পর্বতে যাবায় সময় হারুনকে স্থলাভিষিক্ত করে যান।

৩। তাছাড়া হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ্য না হবারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যদিও হাদীসটি সর্বজনীন তবুও নবুওয়াতের বিষয়টি বাদ যাওয়ায় বাক্যটির বাকী অংশ সর্বজনীনতা হারিয়েছে। তাই হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্যতা  রাখে না।

ওয়াসসালাম

 

পঁচিশতম পত্র

১৬ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   এ হাদীসের প্রতি তাঁর বিশ্বাস।

২।   এ বিষয়ে আরো আলোচনার আহবান।

১। সেই শক্তির প্রতি ঈমান আনছি যিনি আপনার জ্ঞানের আলোয় আমার অন্ধকারকে দূরীভূত করে আলোকিত করেছেন ও আমার অস্পষ্টতাকে দূর করেছেন। সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি আপনাকে তাঁর নিদর্শন ও চিহ্নে পরিণত করেছেন।

২। এ বিষয়ে আরো প্রামাণ্য হাদীস উপস্থাপন করুন।

ওয়াসসালাম

ছাব্বিশতম পত্র

১৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হযরত আলী (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে দশটি ফজীলত বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কারো মধ্যে ছিল না।

২।   কেন আমরা এ হাদীস হতে দলিল পেশ করেছি?

১। হাদীসে দার (যে হাদীসটি বিংশতম পত্রে উল্লেখ করেছি) ছাড়াও আরেকটি হাদীস এখানে বর্ণনা করছি আপনার অবগতির জন্য।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে,ইমাম নাসায়ী তাঁর খাছায়েসুল আলাভীয়া তে,হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে,যাহাবী তাঁর তালখিস গ্রন্থে (হাদীসটির বিশুদ্ধতাকে স্বীকার করে) ও সুনান লেখকগণ তাঁদের সুনানে আমর ইবনে মাইমুন হতে এ হাদীসটি এনেছেন এবং এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে একমত হয়েছেন। আমর বলেন, ইবনে আব্বাসের নিকট বসেছিলাম,নয় দল লোক তাঁর নিকট এসে বলল : আমাদের সঙ্গে আসুন নতুবা আপনার নিকট হতে সবাইকে চলে যেতে বলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। ইবনে আব্বাস বললেন : তোমাদের সঙ্গে যাব। আমর ইবনে মাইমুন বলেন, ইবনে আব্বাস তখনও অন্ধ হন নি,তাঁর চোখ ভাল ছিল। ইবনে আব্বাস তাদের সঙ্গে একদিকে চলে গেলেন। তাঁরা কি কথা বললেন তা আমরা শুনি নি। কিছুক্ষণ পর ইবনে আব্বাস তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এলেন ও বলতে লাগলেন : এমন ব্যক্তির তারা নিন্দা করছে যার দশটি ফজীলত রয়েছে যা কোন ব্যক্তির মধ্যেই নেই। তারা এমন ব্যক্তির নিন্দা করছে যার সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল (সা.) বলেছেন : এমন ব্যক্তিকে আমি আজ যুদ্ধে প্রেরণ করবো যাকে আল্লাহ্ কোনদিনই লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন না,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তাকে ভালবাসে আর সেও আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে। যখন রাসূল এ মর্যাদার কথা বলছিলেন তখন সকলেই ঘাড় টান করে অপেক্ষা করছিল এ সৌভাগ্য তার ভাগ্যে জুটুক। তখন রাসূল (সা.) বললেন : আলী কোথায়? আলী আসলেন,তাঁর তখন চক্ষু পীড়া ছিল,তিনি কিছু দেখতে পারছিলেন না। রাসূল নিজ জিহ্বার পানি তাঁর চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তিনবার যুদ্ধের পতাকাটি এদিক-ওদিক নাড়িয়ে আলীর হাতে দিলেন। আলী তা নিয়ে খায়বারে গেলেন ও যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইহুদী গোত্রপতি হুয়াইয়ের কন্যা সাফিয়াসহ অন্যান্যদের বন্দী করে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) অমুককে (হযরত আবু বকর) মক্কাবাসীদের জন্য সূরা তওবা পাঠ করে শুনানোর জন্য প্রেরণ করলেন এবং তারপর আলীকে তাঁর নিকট হতে তা গ্রহণ করতে বললেন ও ঘোষণা করলেন : এমন ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করবে যে আমা হতে এবং আমি তার হতে।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) তাঁর সকল চাচা ও চাচার পুত্রদের প্রতি আহবান জানালেন দুনিয়া আখেরাতে তাঁর সহযোগী হতে কিন্তু তারা তা করতে সম্মত না হলে আলী দাঁড়িয়ে বললেন: আমি দুনিয়া ও আখেরাতে আপনার সহযোগী হব। রাসূল (সা.) বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার বন্ধু,আমার সহযোগী। অতঃপর পুনরায় তাদের প্রতি এ আহবান জানালেন। তবুও তারা কেউ সম্মত হলো না,শুধু আলী দাঁড়িয়ে সাড়া দিলেন। আর রাসূল বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সহযোগী ও বন্ধু।

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী হযরত খাদিজাহর পর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়নকারী প্রথম ব্যক্তি।

তিনি আরো বলেন : রাসূল (সা.) নিজ চাদরকে আলী,ফাতিমা,হাসান ও হুসাইনের ওপর বিছিয়ে দিলেন ও বললেন : হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ ইচ্ছা করেছেন তোমাদের হতে সকল

পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে ও তোমাদের পবিত্র করতে।২৩৪

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রাসূল (সা.)-এর ঘুমানোর স্থানে তাঁর পোষাক পড়ে শুয়েছিলেন,রাসূলের জন্য তাঁর জীবনকে আল্লাহর নিকট বিক্রয় করেছিলেন,তখন কাফেররা তাঁর প্রতি পাথর বর্ষণ করছিল।

তিনি বলেন : নবী তাবুকের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করলেন,মদীনায় লোকেরাও তাঁর সঙ্গে মদীনা হতে বের হলো। আলী তাঁকে বললেন : আমিও আপনার সঙ্গে যাব। রাসূল (সা.) বললেন : না। আলী কেঁদে ফেললেন। নবী তাঁকে বললেন : তুমি কি এতে খুশী নও,তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে হারুন ও মূসার মধ্যকার সম্পর্কের মত হোক? তবে পার্থক্য এই,আমার পর কোন নবী নেই। এটি ঠিক হবে না যে,আমি চলে যাব অথচ তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে না।

নবী (সা.) তাঁকে (আলীকে) বলেছেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي و مؤمنة   অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর অভিভাবক।

ইবনে আব্বাস আরো বলেন : নবী মসজিদের মধ্যে অতিক্রমকারী সকল দ্বার বন্ধ করে দেন শুধু আলীর দ্বার ব্যতীত। আলী অপবিত্র (জুনুব) অবস্থায়ও মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং ঐ দ্বার ব্যতীত বাইরে যাবার অন্য কোন পথও ছিল না। নবী (সা.) বলেছেন : আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।

উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করে হাকিম বলেছেন, এ হাদীস সনদের দিক থেকে সঠিক,তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি। তদ্রুপ যাহাবীও তাঁর তালখিস গ্রন্থে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।

২। এ হাদীসের মধ্যে যে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে তা কারো নিকট গোপন নেই। এ হাদীস এটিই প্রমাণ করে যে,হযরত আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত।

আপনি কি এখানে লক্ষ্য করেছেন রাসূল (সা.) কিরূপে আলী (আ.)-কে দুনিয়া ও আখেরাতের মাওলা বা অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করে তাঁকে তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি তাঁদের সম্পর্ককে হারুন ও মূসার মত বলেছেন শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,তাঁর পর কেউ নবী নেই অর্থাৎ নবুওয়াতের মর্যাদা ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর অন্য সকল মর্যাদা আলী (আ.)-এরও রয়েছে।

আপনি সম্যক জ্ঞাত,হযরত হারুন ও মূসা (আ.)-এর মধ্যে সম্পর্কের ধরন কিরূপ ছিল। হযরত হারুন (আ.) মূসা (আ.)-এর সঙ্গে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে অংশীদার ছিলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর সহযোগী,পরামর্শদাতা,খলীফা ও প্রতিনিধিও ছিলেন। তাই হযরত মূসা (আ.)-এর মত হযরত হারুনের অনুসরণ সকল উম্মতের জন্য অপরিহার্য বা ওয়াজিব ছিল। এজন্যই হযরত মূসা (আ.) দোয়া করেছিলেন, আমার আহল (পরিবার) হতে একজনকে আমার সহযোগী কর,আমার ভাই হারুনকে ও তার মাধ্যমে আমার কোমরকে মজবুত কর ও তাকে আমার কাজের অংশীদার কর। (সূরা ত্বাহা : ২৯)

হযরত মূসা (আ.) হারুনকে বললেন, আমার জাতির মধ্যে আমার স্থলাভিষিক্ত হও। তাদেরকে সংশোধন কর ও অন্যায়কারীদের পথ অবলম্বন কর না। ২৩৫ আল্লাহ্ হযরত মূসা (আ.)-কে বললেন, তুমি আমার নিকট যা চেয়েছিলে তা তোমাকে দেয়া হলো। ২৩৬

সুতরাং এ হাদীস অনুযায়ী আলী (আ.) এ জাতির মধ্যে রাসূল (সা.)-এর খলীফা,তাঁর পরিবারের মধ্যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও তাঁর কাজে (খেলাফতের বিষয়ে,নবুওয়াতের বিষয়ে নয়) অংশীদার। তাই আলী (আ.) রাসূলের উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আনুগত্য সর্বাবস্থায় হযরত হারুনের মত যাঁর আনুগত্য মূসা (আ.)-এর উম্মতের ওপর অপরিহার্য ছিল। বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট।

যে কেউ এ হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) শ্রবণ করবে আলী সম্পর্কে এসব মর্যাদা তার স্মরণে আসবে এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নবীও তাই এ বিষয়টি সকলের জন্য সুস্পষ্ট করে বলেছেন, এটি ঠিক হবে না,তোমাকে আমার স্থলভিষিক্ত না করেই আমি চলে যাব।

এটি আলী (আ.)-এর খেলাফতের পক্ষে স্পষ্ট দলিল যে,আলীকে নিজের খলীফা মনোনীত না করে যাওয়াকে রাসূল (সা.) সঠিক মনে করেন নি। রাসূল (সা.) তাঁর এ কাজটি আল্লাহর নির্দেশেই করেছিলেন,যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে এসেছে-

) يا أَيُّهَا الرَّسُوْل بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّك وَ إِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ(

হে নবী! যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে তাঁর রেসালতের কিছুই আপনি পৌঁছান নি।২৩৭

যদি কেউ এ আয়াতের আপনি তাঁর রেসালতের কিছুই পৌঁছান নি অংশটি লক্ষ্য করেন এবং এর সঙ্গে রাসূলের এ কথাটি নিশ্চয়ই এটি সঠিক হবে না,তোমাকে খলীফা নিযুক্ত না করেই চলে যাব মিলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন দু টি বাণীই একটি লক্ষ্যকে অনুসরণ করছে।

আমাদের রাসূল (সা.)-এর এ বাণীটি কখনোই ভুলে গেলে চলবে না, তুমি আমার পর সকল মুমিনদের অভিভাবক। এটি অকাট্য দলিল হিসেবে হাদীসে এসেছে যে,আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত। প্রসিদ্ধ কবি কুমাইত (আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করুন) যেমনটি বলেছেন-

কত সুন্দর অভিভাবক তিনি সেই শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের পর,যিনি তাকওয়ার কেন্দ্র ও আদবের শিক্ষকের পর মনোনীত হয়েছেন।

ওয়াসসালাম

সাতাশতম পত্র

১৮ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

 ‘ মানযিলাত -এর হাদীসের বিষয়ে সন্দেহ।

মানযিলাত -এর হাদীসটি সহীহ ও মুস্তাফিয (খবরে ওয়াহেদের চেয়ে বহুল প্রচারিত) কিন্তু বিশিষ্ট হাদীসবিদ আমেদী এ হাদীসের সনদের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাই আপনাদের অনেক শত্রুরই দ্বিধান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। আপনি কিরূপে তাদের নিকট এটি প্রমাণ করবেন। উত্তর জানিয়ে বাধিত করুন।

ওয়াসসালাম

আটাশতম পত্র

১৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   মানযিলাত -এর হাদীস প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের অন্যতম।

২।   এ সত্যের সপক্ষে প্রমাণ।

৩।   আহলে সুন্নাহর যে সকল রাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪।   এ হাদীসটির বিষয়ে আমেদীর সন্দেহ পোষণের কারণ।

১। আমেদী এ সন্দেহের মাধ্যমে নিজের ওপরই জুলুম করেছেন। কারণ মানযিলাত -এর হাদীসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের একটি।

২। এ হাদীসের সনদের বিশুদ্ধতার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হাদীসটি সম্পর্কে দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই এবং এর প্রামাণিকতার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন উঠাতে পারেন না,এমন কি যাহাবী অত্যন্ত কঠোরতা সত্ত্বেও মুসতাদরাক গ্রন্থের সারসংক্ষেপে হাদীসটির সহীহ হবার কথা স্বীকার করেছেন।৩৩৮ ইবনে হাজার হাইসামী বিভিন্ন বিষয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁর সাওয়ায়েক গ্রন্থের দ্বাদশ পর্বে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন ও এর বিশুদ্ধতার বিষয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদদের (এ বিষয়ে যাঁদের প্রতি রুজু করা উচিত) সূত্রে বর্ণনা করেছেন।৩৩৯ আপনি এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন। যদি হাদীসটি এতটা প্রমাণ্য না হত তাহলে বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে তা উল্লেখ করতেন না। কারণ বুখারী হযরত আলীর বৈশিষ্ট্য,ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্ক ও পারতঃপক্ষে বিরত থাকতেন ও এ বিষয়ে তিনি নিজের ওপর জুলুম করেছেন। মুয়াবিয়া যিনি আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও সব সময় তাঁর প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করতেন,এমন কি মিম্বারে আলীর ওপর লানত পড়ার জন্য নির্দেশ জারী করেছিলেন তদুপরি তিনি মানযিলাত -এর হাদীসটি অস্বীকার করেন নি। মুসলিমের৩৪০ সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে : একবার মুয়াবিয়া সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে বললেন : কি কারণে আবু তোরাবের (আলী [আ.]-এর) নিন্দা কর না? সা দ জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) তাঁর বিষয়ে তিনটি কথা বলেছেন সেগুলো মনে হওয়ায় এ কাজ হতে আমি বিরত হলাম। ঐ তিনটি বৈশিষ্ট্যের যদি একটিও আমার থাকত তাহলে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হতেও তা আমার নিকট প্রিয়তর বলে গণ্য হত। নবী (সা.) কোন কোন যুদ্ধের সময় তাঁকে মদীনায় রেখে যেতেন ও বলতেন : তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত হোক তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও? শুধু পার্থক্য এটিই আমার পর তুমি নবী নও।২৪১ মুয়াবিয়া একথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন ও সা দকে আলীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হতে বিরত থাকার অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।

আরো বাড়িয়ে বললে বলা যায় স্বয়ং মুয়াবিয়া মানযিলাত -এর হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার তাঁর সাওয়ায়েক ২৪২ গ্রন্থে বলেছেন, আহমাদ বর্ণনা করেছেন : এক ব্যক্তি কোন একটি বিষয়ে মুয়াবিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন : আলী এ বিষয়ে অধিকতর জ্ঞাত,তাকে প্রশ্ন কর। লোকটি বলল : আলী অপেক্ষা তোমার উত্তর আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। মুয়াবিয়া বললেন : মন্দ কথা বলেছ,এমন ব্যক্তি হতে তুমি বীতশ্রদ্ধ যাঁকে রাসূল (সা.) জ্ঞানের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল মুখ মনে করতেন ও তাঁকে বলেছেন :

أَنْتَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنِ مُوْسى إِلّا أَنَّهُ لا نَبِيَّ بَعْدِي

তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত,শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পর কোন নবী নেই।

যখনই হযরত উমরের জন্য কোন সমস্যা দেখা দিত,তিনি আলী (আ.)-কে ডাকতেন।

সুতরাং মানযিলাত -এর হাদীসটি এমন একটি বিষয় যাতে মুসলমানদের সকল মাজহাব ও দল ঐকমত্য পোষণ করে,হাদীসটির বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

৩। আল জাম বাইনাস্ সিহাহ আস সিত্তাহ্ ২৪৩ আল জাম বাইনাস্ সহীহাইন ২২৪ গ্রন্থের লেখকদ্বয়ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারীতে তাবুকের যুদ্ধের২৪৫ বর্ণনায় হাদীসটি রয়েছে।

সহীহ মুসলিমে২৪৬ হযরত আলীর ফাজায়েল অধ্যায়ে হাদীসটি এসেছে। এছাড়া সুনানে ইবনে মাজাহ্তে২৪৭ নবী (সা.)-এর সাহাবীদের ফাজায়েল অধ্যায়ে ও মুসতাদরাকে হাকিম -এ হযরত আলীর মানাকিব ২৪৮ বা বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় এ হাদীসটি আনা হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হতে কয়েকটি সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন২৪৯

আহমাদ তাঁর মুসনাদে ইবনে আব্বাস২৫০ ,আসমা বিনতে উমাইস২৫১ ,আবু সাঈদ খুদরী২৫২ এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান২৫৩ ও আরো কয়েকটি সূত্রে অন্যান্য সাহাবী হতেও হাদীসটি নকল করেছেন।

তাবরানী এ হাদীসটি আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হাবিশ ইবনে জুনাদাহ্,ইবনে উমর,ইবনে আব্বাস,জাবির ইবনে সামুরাহ্,যায়েদ ইবনে আরকাম,বাররাহ্ ইবনে আযেব এবং আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণনা করেছেন।

বাযযার তাঁর মুসনাদে ও তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বার তাঁর ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচিতি পর্বে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসটি বিশুদ্ধতম ও সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠিত হাদীস যা সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, সা দ হতে এত অধিক সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে,ইবনে আবি খাইসামাহ্ ও অন্যরাও তা বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বারের মতে হাদীসটির অন্যান্য বর্ণনাকারীরা হলেন ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,উম্মে সালামাহ্,আসমা বিনতে উমাইস,জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ অনসারী ও আরো কয়েকজন সাহাবী।

যে সকল মুহাদ্দিস,সীরাহ্ লেখক ও হাদীস বর্ণনাকারী তাবুকের যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাঁরা এ হাদীসটি তাঁদের বর্ণনায় এনেছেন।

পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের সকল রিজাল লেখকই (শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে) হযরত আলী

(আ.)-এর পরিচিতি বর্ণনায় এ হাদীসটি এনেছেন।

আহলে বাইতের মানাকিব (বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা) বর্ণনাকারী ব্যক্তিরা যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল ও তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটি এমন এক হাদীস যা সকল যুগেই প্রতিষ্ঠিত হাদীসগুলোর একটি বলে পরিগণিত হত।

৪। অতএব,আমেদীর সন্দেহ (হাদীসটির বিষয়ে) এ ক্ষেত্রে কোন মূল্যই রাখে না,বরং বলা যায় তিনি কোন হাদীসবেত্তা নন ও এ বিষয়ে তাঁর কোন জ্ঞান নেই। উসূলশাস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে হাদীসের সনদ ও সূত্র পর্যালোচনা সম্ভব নয়। তাই সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হাদীসের সনদে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

উনত্রিশতম পত্র

২০ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হাদীসটির সনদের বিশুদ্ধতার সত্যায়ন।

২।   হাদীসটির সার্বিকতার বিষয়ে সন্দেহ।

৩।   হাদীসের প্রামাণিকতার (প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের উপযোগিতার) বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন।

১। হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) যে সুপ্রতিষ্ঠিত সে বিষয়ে আপনার বর্ণনায় আমার সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমেদী যে ভুল করেছেন এর কারণ হাদীসশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞানের অভাব। আমি তাঁর বিশ্বাস ও মত উপস্থাপন করে আপনাকে কষ্টে ফেলেছি তাতে আপনি বাধ্য হয়েছেন এ বিষয়ে  প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতে। এ ভুলের জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি বিষয়টিকে ক্ষমার চোখে দেখবেন।

২। আপনাদের বিরোধীদের মধ্যে আমেদী ছাড়াও অনেকেই মনে করেছেন মানযিলাত -এর হাদীসটি সর্বজনীন নয়,বরং তা বিশেষভাবে তাবুকের যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সে সময়ের জন্যই তিনি রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা এ হাদীসের প্রেক্ষাপট যেখানে রাসূল (সা.) আলীকে মদীনায় তাঁর স্থানে রেখে যাচ্ছেন তার উল্লেখ করেন। ইমাম আলী (আ.) যখন রাসূল (সা.)-কে বললেন, আমাকে কি মহিলা ও শিশুদের মাঝে রেখে যাচ্ছেন? তখন নবী (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে মূসার স্থলাভিষিক্ত হারুনের মত তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হও এ পার্থক্য সহ যে আমার পর কোন নবী নেই? বাহ্যিকভাবে রাসূলের উদ্দেশ্য ছিল এটিই বলা,রাসূলের সাথে আলীর সম্পর্ক মূসা (আ.)-এর সঙ্গে হারুন (আ.)-এর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ হযরত মূসা (আ.) তুর পর্বতে যাবার সময় নিজের জাতির মধ্যে হারুন (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান।

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেন তাবুকের যুদ্ধের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে আলী তাঁর স্থলাভিষিক্ত যেমনভাবে মূসা ইবাদতের জন্য তুর পর্বতে যাবায় সময় হারুনকে স্থলাভিষিক্ত করে যান।

৩। তাছাড়া হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ্য না হবারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যদিও হাদীসটি সর্বজনীন তবুও নবুওয়াতের বিষয়টি বাদ যাওয়ায় বাক্যটির বাকী অংশ সর্বজনীনতা হারিয়েছে। তাই হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্যতা  রাখে না।

ওয়াসসালাম

 

পঁচিশতম পত্র

১৬ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   এ হাদীসের প্রতি তাঁর বিশ্বাস।

২।   এ বিষয়ে আরো আলোচনার আহবান।

১। সেই শক্তির প্রতি ঈমান আনছি যিনি আপনার জ্ঞানের আলোয় আমার অন্ধকারকে দূরীভূত করে আলোকিত করেছেন ও আমার অস্পষ্টতাকে দূর করেছেন। সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি আপনাকে তাঁর নিদর্শন ও চিহ্নে পরিণত করেছেন।

২। এ বিষয়ে আরো প্রামাণ্য হাদীস উপস্থাপন করুন।

ওয়াসসালাম

ছাব্বিশতম পত্র

১৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হযরত আলী (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে দশটি ফজীলত বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কারো মধ্যে ছিল না।

২।   কেন আমরা এ হাদীস হতে দলিল পেশ করেছি?

১। হাদীসে দার (যে হাদীসটি বিংশতম পত্রে উল্লেখ করেছি) ছাড়াও আরেকটি হাদীস এখানে বর্ণনা করছি আপনার অবগতির জন্য।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে,ইমাম নাসায়ী তাঁর খাছায়েসুল আলাভীয়া তে,হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে,যাহাবী তাঁর তালখিস গ্রন্থে (হাদীসটির বিশুদ্ধতাকে স্বীকার করে) ও সুনান লেখকগণ তাঁদের সুনানে আমর ইবনে মাইমুন হতে এ হাদীসটি এনেছেন এবং এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে একমত হয়েছেন। আমর বলেন, ইবনে আব্বাসের নিকট বসেছিলাম,নয় দল লোক তাঁর নিকট এসে বলল : আমাদের সঙ্গে আসুন নতুবা আপনার নিকট হতে সবাইকে চলে যেতে বলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। ইবনে আব্বাস বললেন : তোমাদের সঙ্গে যাব। আমর ইবনে মাইমুন বলেন, ইবনে আব্বাস তখনও অন্ধ হন নি,তাঁর চোখ ভাল ছিল। ইবনে আব্বাস তাদের সঙ্গে একদিকে চলে গেলেন। তাঁরা কি কথা বললেন তা আমরা শুনি নি। কিছুক্ষণ পর ইবনে আব্বাস তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এলেন ও বলতে লাগলেন : এমন ব্যক্তির তারা নিন্দা করছে যার দশটি ফজীলত রয়েছে যা কোন ব্যক্তির মধ্যেই নেই। তারা এমন ব্যক্তির নিন্দা করছে যার সম্পর্কে স্বয়ং রাসূল (সা.) বলেছেন : এমন ব্যক্তিকে আমি আজ যুদ্ধে প্রেরণ করবো যাকে আল্লাহ্ কোনদিনই লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন না,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তাকে ভালবাসে আর সেও আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে। যখন রাসূল এ মর্যাদার কথা বলছিলেন তখন সকলেই ঘাড় টান করে অপেক্ষা করছিল এ সৌভাগ্য তার ভাগ্যে জুটুক। তখন রাসূল (সা.) বললেন : আলী কোথায়? আলী আসলেন,তাঁর তখন চক্ষু পীড়া ছিল,তিনি কিছু দেখতে পারছিলেন না। রাসূল নিজ জিহ্বার পানি তাঁর চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তিনবার যুদ্ধের পতাকাটি এদিক-ওদিক নাড়িয়ে আলীর হাতে দিলেন। আলী তা নিয়ে খায়বারে গেলেন ও যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইহুদী গোত্রপতি হুয়াইয়ের কন্যা সাফিয়াসহ অন্যান্যদের বন্দী করে রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলেন।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) অমুককে (হযরত আবু বকর) মক্কাবাসীদের জন্য সূরা তওবা পাঠ করে শুনানোর জন্য প্রেরণ করলেন এবং তারপর আলীকে তাঁর নিকট হতে তা গ্রহণ করতে বললেন ও ঘোষণা করলেন : এমন ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করবে যে আমা হতে এবং আমি তার হতে।

ইবনে আব্বাস বলেন : নবী (সা.) তাঁর সকল চাচা ও চাচার পুত্রদের প্রতি আহবান জানালেন দুনিয়া আখেরাতে তাঁর সহযোগী হতে কিন্তু তারা তা করতে সম্মত না হলে আলী দাঁড়িয়ে বললেন: আমি দুনিয়া ও আখেরাতে আপনার সহযোগী হব। রাসূল (সা.) বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার বন্ধু,আমার সহযোগী। অতঃপর পুনরায় তাদের প্রতি এ আহবান জানালেন। তবুও তারা কেউ সম্মত হলো না,শুধু আলী দাঁড়িয়ে সাড়া দিলেন। আর রাসূল বললেন : তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সহযোগী ও বন্ধু।

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী হযরত খাদিজাহর পর রাসূলের ওপর ঈমান আনয়নকারী প্রথম ব্যক্তি।

তিনি আরো বলেন : রাসূল (সা.) নিজ চাদরকে আলী,ফাতিমা,হাসান ও হুসাইনের ওপর বিছিয়ে দিলেন ও বললেন : হে আহলে বাইত! আল্লাহ্ ইচ্ছা করেছেন তোমাদের হতে সকল

পাপ-পঙ্কিলতা দূর করতে ও তোমাদের পবিত্র করতে।২৩৪

ইবনে আব্বাস বলেন : আলী নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রাসূল (সা.)-এর ঘুমানোর স্থানে তাঁর পোষাক পড়ে শুয়েছিলেন,রাসূলের জন্য তাঁর জীবনকে আল্লাহর নিকট বিক্রয় করেছিলেন,তখন কাফেররা তাঁর প্রতি পাথর বর্ষণ করছিল।

তিনি বলেন : নবী তাবুকের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করলেন,মদীনায় লোকেরাও তাঁর সঙ্গে মদীনা হতে বের হলো। আলী তাঁকে বললেন : আমিও আপনার সঙ্গে যাব। রাসূল (সা.) বললেন : না। আলী কেঁদে ফেললেন। নবী তাঁকে বললেন : তুমি কি এতে খুশী নও,তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে হারুন ও মূসার মধ্যকার সম্পর্কের মত হোক? তবে পার্থক্য এই,আমার পর কোন নবী নেই। এটি ঠিক হবে না যে,আমি চলে যাব অথচ তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে না।

নবী (সা.) তাঁকে (আলীকে) বলেছেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي و مؤمنة   অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর অভিভাবক।

ইবনে আব্বাস আরো বলেন : নবী মসজিদের মধ্যে অতিক্রমকারী সকল দ্বার বন্ধ করে দেন শুধু আলীর দ্বার ব্যতীত। আলী অপবিত্র (জুনুব) অবস্থায়ও মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং ঐ দ্বার ব্যতীত বাইরে যাবার অন্য কোন পথও ছিল না। নবী (সা.) বলেছেন : আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।

উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করে হাকিম বলেছেন, এ হাদীস সনদের দিক থেকে সঠিক,তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি। তদ্রুপ যাহাবীও তাঁর তালখিস গ্রন্থে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।

২। এ হাদীসের মধ্যে যে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে তা কারো নিকট গোপন নেই। এ হাদীস এটিই প্রমাণ করে যে,হযরত আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত।

আপনি কি এখানে লক্ষ্য করেছেন রাসূল (সা.) কিরূপে আলী (আ.)-কে দুনিয়া ও আখেরাতের মাওলা বা অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করে তাঁকে তাঁর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি তাঁদের সম্পর্ককে হারুন ও মূসার মত বলেছেন শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,তাঁর পর কেউ নবী নেই অর্থাৎ নবুওয়াতের মর্যাদা ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর অন্য সকল মর্যাদা আলী (আ.)-এরও রয়েছে।

আপনি সম্যক জ্ঞাত,হযরত হারুন ও মূসা (আ.)-এর মধ্যে সম্পর্কের ধরন কিরূপ ছিল। হযরত হারুন (আ.) মূসা (আ.)-এর সঙ্গে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে অংশীদার ছিলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর সহযোগী,পরামর্শদাতা,খলীফা ও প্রতিনিধিও ছিলেন। তাই হযরত মূসা (আ.)-এর মত হযরত হারুনের অনুসরণ সকল উম্মতের জন্য অপরিহার্য বা ওয়াজিব ছিল। এজন্যই হযরত মূসা (আ.) দোয়া করেছিলেন, আমার আহল (পরিবার) হতে একজনকে আমার সহযোগী কর,আমার ভাই হারুনকে ও তার মাধ্যমে আমার কোমরকে মজবুত কর ও তাকে আমার কাজের অংশীদার কর। (সূরা ত্বাহা : ২৯)

হযরত মূসা (আ.) হারুনকে বললেন, আমার জাতির মধ্যে আমার স্থলাভিষিক্ত হও। তাদেরকে সংশোধন কর ও অন্যায়কারীদের পথ অবলম্বন কর না। ২৩৫ আল্লাহ্ হযরত মূসা (আ.)-কে বললেন, তুমি আমার নিকট যা চেয়েছিলে তা তোমাকে দেয়া হলো। ২৩৬

সুতরাং এ হাদীস অনুযায়ী আলী (আ.) এ জাতির মধ্যে রাসূল (সা.)-এর খলীফা,তাঁর পরিবারের মধ্যে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও তাঁর কাজে (খেলাফতের বিষয়ে,নবুওয়াতের বিষয়ে নয়) অংশীদার। তাই আলী (আ.) রাসূলের উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তাঁর আনুগত্য সর্বাবস্থায় হযরত হারুনের মত যাঁর আনুগত্য মূসা (আ.)-এর উম্মতের ওপর অপরিহার্য ছিল। বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট।

যে কেউ এ হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) শ্রবণ করবে আলী সম্পর্কে এসব মর্যাদা তার স্মরণে আসবে এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নবীও তাই এ বিষয়টি সকলের জন্য সুস্পষ্ট করে বলেছেন, এটি ঠিক হবে না,তোমাকে আমার স্থলভিষিক্ত না করেই আমি চলে যাব।

এটি আলী (আ.)-এর খেলাফতের পক্ষে স্পষ্ট দলিল যে,আলীকে নিজের খলীফা মনোনীত না করে যাওয়াকে রাসূল (সা.) সঠিক মনে করেন নি। রাসূল (সা.) তাঁর এ কাজটি আল্লাহর নির্দেশেই করেছিলেন,যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীরে এসেছে-

) يا أَيُّهَا الرَّسُوْل بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّك وَ إِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ(

হে নবী! যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে তাঁর রেসালতের কিছুই আপনি পৌঁছান নি।২৩৭

যদি কেউ এ আয়াতের আপনি তাঁর রেসালতের কিছুই পৌঁছান নি অংশটি লক্ষ্য করেন এবং এর সঙ্গে রাসূলের এ কথাটি নিশ্চয়ই এটি সঠিক হবে না,তোমাকে খলীফা নিযুক্ত না করেই চলে যাব মিলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন দু টি বাণীই একটি লক্ষ্যকে অনুসরণ করছে।

আমাদের রাসূল (সা.)-এর এ বাণীটি কখনোই ভুলে গেলে চলবে না, তুমি আমার পর সকল মুমিনদের অভিভাবক। এটি অকাট্য দলিল হিসেবে হাদীসে এসেছে যে,আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত। প্রসিদ্ধ কবি কুমাইত (আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করুন) যেমনটি বলেছেন-

কত সুন্দর অভিভাবক তিনি সেই শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের পর,যিনি তাকওয়ার কেন্দ্র ও আদবের শিক্ষকের পর মনোনীত হয়েছেন।

ওয়াসসালাম

সাতাশতম পত্র

১৮ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

 ‘ মানযিলাত -এর হাদীসের বিষয়ে সন্দেহ।

মানযিলাত -এর হাদীসটি সহীহ ও মুস্তাফিয (খবরে ওয়াহেদের চেয়ে বহুল প্রচারিত) কিন্তু বিশিষ্ট হাদীসবিদ আমেদী এ হাদীসের সনদের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তাই আপনাদের অনেক শত্রুরই দ্বিধান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। আপনি কিরূপে তাদের নিকট এটি প্রমাণ করবেন। উত্তর জানিয়ে বাধিত করুন।

ওয়াসসালাম

আটাশতম পত্র

১৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   মানযিলাত -এর হাদীস প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের অন্যতম।

২।   এ সত্যের সপক্ষে প্রমাণ।

৩।   আহলে সুন্নাহর যে সকল রাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪।   এ হাদীসটির বিষয়ে আমেদীর সন্দেহ পোষণের কারণ।

১। আমেদী এ সন্দেহের মাধ্যমে নিজের ওপরই জুলুম করেছেন। কারণ মানযিলাত -এর হাদীসটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হাদীসসমূহের একটি।

২। এ হাদীসের সনদের বিশুদ্ধতার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হাদীসটি সম্পর্কে দ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই এবং এর প্রামাণিকতার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন উঠাতে পারেন না,এমন কি যাহাবী অত্যন্ত কঠোরতা সত্ত্বেও মুসতাদরাক গ্রন্থের সারসংক্ষেপে হাদীসটির সহীহ হবার কথা স্বীকার করেছেন।৩৩৮ ইবনে হাজার হাইসামী বিভিন্ন বিষয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা সত্ত্বেও তাঁর সাওয়ায়েক গ্রন্থের দ্বাদশ পর্বে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন ও এর বিশুদ্ধতার বিষয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদদের (এ বিষয়ে যাঁদের প্রতি রুজু করা উচিত) সূত্রে বর্ণনা করেছেন।৩৩৯ আপনি এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করুন। যদি হাদীসটি এতটা প্রমাণ্য না হত তাহলে বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে তা উল্লেখ করতেন না। কারণ বুখারী হযরত আলীর বৈশিষ্ট্য,ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্ক ও পারতঃপক্ষে বিরত থাকতেন ও এ বিষয়ে তিনি নিজের ওপর জুলুম করেছেন। মুয়াবিয়া যিনি আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও সব সময় তাঁর প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করতেন,এমন কি মিম্বারে আলীর ওপর লানত পড়ার জন্য নির্দেশ জারী করেছিলেন তদুপরি তিনি মানযিলাত -এর হাদীসটি অস্বীকার করেন নি। মুসলিমের৩৪০ সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে : একবার মুয়াবিয়া সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে বললেন : কি কারণে আবু তোরাবের (আলী [আ.]-এর) নিন্দা কর না? সা দ জবাবে বললেন : মহানবী (সা.) তাঁর বিষয়ে তিনটি কথা বলেছেন সেগুলো মনে হওয়ায় এ কাজ হতে আমি বিরত হলাম। ঐ তিনটি বৈশিষ্ট্যের যদি একটিও আমার থাকত তাহলে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হতেও তা আমার নিকট প্রিয়তর বলে গণ্য হত। নবী (সা.) কোন কোন যুদ্ধের সময় তাঁকে মদীনায় রেখে যেতেন ও বলতেন : তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত হোক তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও? শুধু পার্থক্য এটিই আমার পর তুমি নবী নও।২৪১ মুয়াবিয়া একথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন ও সা দকে আলীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হতে বিরত থাকার অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।

আরো বাড়িয়ে বললে বলা যায় স্বয়ং মুয়াবিয়া মানযিলাত -এর হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার তাঁর সাওয়ায়েক ২৪২ গ্রন্থে বলেছেন, আহমাদ বর্ণনা করেছেন : এক ব্যক্তি কোন একটি বিষয়ে মুয়াবিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন : আলী এ বিষয়ে অধিকতর জ্ঞাত,তাকে প্রশ্ন কর। লোকটি বলল : আলী অপেক্ষা তোমার উত্তর আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। মুয়াবিয়া বললেন : মন্দ কথা বলেছ,এমন ব্যক্তি হতে তুমি বীতশ্রদ্ধ যাঁকে রাসূল (সা.) জ্ঞানের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল মুখ মনে করতেন ও তাঁকে বলেছেন :

أَنْتَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنِ مُوْسى إِلّا أَنَّهُ لا نَبِيَّ بَعْدِي

তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত,শুধু এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পর কোন নবী নেই।

যখনই হযরত উমরের জন্য কোন সমস্যা দেখা দিত,তিনি আলী (আ.)-কে ডাকতেন।

সুতরাং মানযিলাত -এর হাদীসটি এমন একটি বিষয় যাতে মুসলমানদের সকল মাজহাব ও দল ঐকমত্য পোষণ করে,হাদীসটির বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

৩। আল জাম বাইনাস্ সিহাহ আস সিত্তাহ্ ২৪৩ আল জাম বাইনাস্ সহীহাইন ২২৪ গ্রন্থের লেখকদ্বয়ও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারীতে তাবুকের যুদ্ধের২৪৫ বর্ণনায় হাদীসটি রয়েছে।

সহীহ মুসলিমে২৪৬ হযরত আলীর ফাজায়েল অধ্যায়ে হাদীসটি এসেছে। এছাড়া সুনানে ইবনে মাজাহ্তে২৪৭ নবী (সা.)-এর সাহাবীদের ফাজায়েল অধ্যায়ে ও মুসতাদরাকে হাকিম -এ হযরত আলীর মানাকিব ২৪৮ বা বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় এ হাদীসটি আনা হয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হতে কয়েকটি সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন২৪৯

আহমাদ তাঁর মুসনাদে ইবনে আব্বাস২৫০ ,আসমা বিনতে উমাইস২৫১ ,আবু সাঈদ খুদরী২৫২ এবং মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান২৫৩ ও আরো কয়েকটি সূত্রে অন্যান্য সাহাবী হতেও হাদীসটি নকল করেছেন।

তাবরানী এ হাদীসটি আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হাবিশ ইবনে জুনাদাহ্,ইবনে উমর,ইবনে আব্বাস,জাবির ইবনে সামুরাহ্,যায়েদ ইবনে আরকাম,বাররাহ্ ইবনে আযেব এবং আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণনা করেছেন।

বাযযার তাঁর মুসনাদে ও তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বার তাঁর ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচিতি পর্বে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, হাদীসটি বিশুদ্ধতম ও সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠিত হাদীস যা সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, সা দ হতে এত অধিক সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে যে,ইবনে আবি খাইসামাহ্ ও অন্যরাও তা বর্ণনা করেছেন। ইবনে আবদুল বারের মতে হাদীসটির অন্যান্য বর্ণনাকারীরা হলেন ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,উম্মে সালামাহ্,আসমা বিনতে উমাইস,জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ অনসারী ও আরো কয়েকজন সাহাবী।

যে সকল মুহাদ্দিস,সীরাহ্ লেখক ও হাদীস বর্ণনাকারী তাবুকের যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাঁরা এ হাদীসটি তাঁদের বর্ণনায় এনেছেন।

পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের সকল রিজাল লেখকই (শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে) হযরত আলী

(আ.)-এর পরিচিতি বর্ণনায় এ হাদীসটি এনেছেন।

আহলে বাইতের মানাকিব (বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা) বর্ণনাকারী ব্যক্তিরা যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল ও তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটি এমন এক হাদীস যা সকল যুগেই প্রতিষ্ঠিত হাদীসগুলোর একটি বলে পরিগণিত হত।

৪। অতএব,আমেদীর সন্দেহ (হাদীসটির বিষয়ে) এ ক্ষেত্রে কোন মূল্যই রাখে না,বরং বলা যায় তিনি কোন হাদীসবেত্তা নন ও এ বিষয়ে তাঁর কোন জ্ঞান নেই। উসূলশাস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে হাদীসের সনদ ও সূত্র পর্যালোচনা সম্ভব নয়। তাই সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হাদীসের সনদে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

উনত্রিশতম পত্র

২০ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   হাদীসটির সনদের বিশুদ্ধতার সত্যায়ন।

২।   হাদীসটির সার্বিকতার বিষয়ে সন্দেহ।

৩।   হাদীসের প্রামাণিকতার (প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের উপযোগিতার) বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন।

১। হাদীসটি ( মানযিলাত -এর হাদীস) যে সুপ্রতিষ্ঠিত সে বিষয়ে আপনার বর্ণনায় আমার সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে আমেদী যে ভুল করেছেন এর কারণ হাদীসশাস্ত্রে তাঁর জ্ঞানের অভাব। আমি তাঁর বিশ্বাস ও মত উপস্থাপন করে আপনাকে কষ্টে ফেলেছি তাতে আপনি বাধ্য হয়েছেন এ বিষয়ে  প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতে। এ ভুলের জন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি বিষয়টিকে ক্ষমার চোখে দেখবেন।

২। আপনাদের বিরোধীদের মধ্যে আমেদী ছাড়াও অনেকেই মনে করেছেন মানযিলাত -এর হাদীসটি সর্বজনীন নয়,বরং তা বিশেষভাবে তাবুকের যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সে সময়ের জন্যই তিনি রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা এ হাদীসের প্রেক্ষাপট যেখানে রাসূল (সা.) আলীকে মদীনায় তাঁর স্থানে রেখে যাচ্ছেন তার উল্লেখ করেন। ইমাম আলী (আ.) যখন রাসূল (সা.)-কে বললেন, আমাকে কি মহিলা ও শিশুদের মাঝে রেখে যাচ্ছেন? তখন নবী (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে মূসার স্থলাভিষিক্ত হারুনের মত তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হও এ পার্থক্য সহ যে আমার পর কোন নবী নেই? বাহ্যিকভাবে রাসূলের উদ্দেশ্য ছিল এটিই বলা,রাসূলের সাথে আলীর সম্পর্ক মূসা (আ.)-এর সঙ্গে হারুন (আ.)-এর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ হযরত মূসা (আ.) তুর পর্বতে যাবার সময় নিজের জাতির মধ্যে হারুন (আ.)-কে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রেখে যান।

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেন তাবুকের যুদ্ধের সময় তাঁর অনুপস্থিতিতে আলী তাঁর স্থলাভিষিক্ত যেমনভাবে মূসা ইবাদতের জন্য তুর পর্বতে যাবায় সময় হারুনকে স্থলাভিষিক্ত করে যান।

৩। তাছাড়া হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ্য না হবারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যদিও হাদীসটি সর্বজনীন তবুও নবুওয়াতের বিষয়টি বাদ যাওয়ায় বাক্যটির বাকী অংশ সর্বজনীনতা হারিয়েছে। তাই হাদীসটি এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্যতা  রাখে না।

ওয়াসসালাম

 


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53