চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড7%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81900 / ডাউনলোড: 7554
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

মহানবী (সা.)-কে মুনাফিকদের হত্যার ষড়যন্ত্র

মহানবী (সা.) প্রায় দশ দিন৪৩৪ তাবুকে অবস্থান করেছিলেন এবং দাওমাতুল জান্দালে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে প্রেরণের পর তিনি মদীনার পথে রওয়ানা হন। বারো জন মুনাফিক, যাদের আট জন ছিল কুরাইশ বংশোদ্ভূত এবং বাকী চার জন ছিল মদীনার অধিবাসী, সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দুই পাহাড়ের মাঝের দুর্গম সরু পথের (গিরিপথ) উপর থেকে মহানবীর মদীনা ও শামের মাঝে পথ চলা উটকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করে দেবে এবং এভাবে তারা মহানবীকে উপত্যকার গভীরে ফেলে দিতে সক্ষম হবে। মুসলিম সেনাবাহিনী এ গিরিপথের কাছে পৌঁছলে মহানবী (সা.) বললেন : যে কেউ ইচ্ছা করলে উপত্যকা বা মরু-প্রান্তরের মাঝখান দিয়েও পথ চলতে পারে। কারণ মরু-প্রান্তর বেশ প্রশস্ত। কিন্তু স্বয়ং মহানবী এ গিরিপথ ধরে উঁচুতে উঠে গেলেন এবং পথ চলতে লাগলেন। হযরত হুযাইফা তাঁর উট চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির তার লাগাম ধরে টানছিলেন। তখনও মহানবী গিরিপথ ধরে ততটা উঁচুতে উঠেন নি, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি তাঁর পেছন দিকে তাকিয়ে ঐ আলোকোজ্জ্বল রাতে কতিপয় আরোহীকে দেখতে পেলেন, তারা তাঁকে অনুসরণ করছে এবং তারা যাতে শনাক্ত না হয়ে যায়, সেজন্য তাদের মুখমণ্ডল কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে এবং নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। মহানবী ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের প্রতি ভীতিপ্রদ আওয়াজ দিলেন এবং হযরত হুযাইফাকে লাঠি দিয়ে ঐ সব অনুসরণকারীর উটগুলোকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আওয়াজ, অনুসরণকারীদের অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার করেছিল এবং তারাও বুঝতে পেরেছিল, মহানবী তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তাই তারা তৎক্ষণাৎ যে পথে এসেছিল, সে পথেই ফিরে গিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল।

হুযাইফা বলেন : আমি তাদের উটগুলোর চিহ্ন দেখে তাদেরকে চিনতে পেরেছিলাম এবং মহানবী (সা.)-কে বলেছিলাম : আমি আপনার কাছে তাদের পরিচিতি তুলে ধরব, যাতে আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। মহানবী (সা.) তখন দয়ার্দ্রপূর্ণ কণ্ঠে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি যেন তাদের নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকি। সম্ভবত তারা তওবা করতে পারে। তিনি আরো বললেন : আমি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করলে বিধর্মীরা বলবে, মুহাম্মদ শক্তি ও ক্ষমতার তুঙ্গে পৌঁছানোর পর নিজ সঙ্গী-সাথীদের গর্দানের ওপর তরবারির আঘাত হেনেছে।”৪৩৫

নিয়্যত আমলের প্রতিনিধি

স্বদেশে বিজয়ী বেশে সেনাবাহিনীর প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য অপেক্ষা আর কোন দৃশ্যই অধিক জমকালো হয় না। একজন মুজাহিদ যোদ্ধার গৌরব ও মর্যাদা সংরক্ষণকারী এবং তাঁর অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধায়ক শত্রুর ওপর বিজয়ের চেয়ে আর কোন কিছুই তাঁর কাছে অধিকতর আনন্দদায়ক ও সুমিষ্ট হতে পারে না। ঘটনাক্রমে উভয় বিষয়ই মদীনায় ইসলামের বিজয়ী সেনাদলের প্রত্যাবর্তন মুহূর্তে পরিদৃষ্ট হয়েছিল।

তাবুক ও মদীনার অন্তর্বর্তী দূরত্ব অতিক্রমের পর বিজয়ী মুসলিম বাহিনী পূর্ণ গৌরব ও জাঁকজমক সহ মদীনায় প্রবেশ করল। ইসলামের সৈনিকরা তখন আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। সৈনিকদের গৌরব ও শত্রুর ওপর বিজয়ী হবার গর্ব তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। আর এর কারণও স্পষ্ট ছিল। কারণ শক্তিশালী রাষ্ট্র, যা নিজের শক্তিধর প্রতিপক্ষ ইরানকে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছিল, সেই শক্তিশালী রাষ্ট্রকেই তারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য ও তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করতে এবং শাম ও হিজাযের সকল সীমান্তবাসীকে নিজেদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেছে।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, শত্রুর ওপর বিজয় এমন এক গৌরব- যা এ সেনাবাহিনীর ভাগ্যে জুটেছিল এবং যারা কোন গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়াই মদীনায় বসে থেকেছিল (এবং যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত ছিল) তাদের ওপর এদের গর্ব করা ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত। তবে এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা ও বিজয়ী বেশে প্রত্যাবর্তন কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মাঝে মাত্রাতিরিক্ত গর্বের উদ্ভব ঘটাতে পারত এবং সেই সম্ভাবনাও ছিল। আর তা যুক্তিসংগত কারণবশত মদীনায় থেকে যাওয়া এবং দুঃখ ও আনন্দে আন্তরিকভাবে তাদের শরীকদের প্রতি অবমাননা, অবজ্ঞা ও ধৃষ্টতা বলে গণ্য হবার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণেই মহানবী (সা.) মদীনার কাছাকাছি স্থানে অল্প সময়ের জন্য ইসলামী বাহিনী যাত্রা বিরতি করলে তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন :

إن بالمدينة لأقواما ما سرتم سيرا و لا قطعتم واديا إلّا كانوا معكم، قالوا : يا رسول الله و هم بالمدينة؟ قال: نعم حبسهم العذر

“মদীনায় এমন কিছু ব্যক্তি ও দল আছে, যারা এ অভিযানে তোমাদের শরীক ছিল এবং তোমরা যেখানেই পা রেখেছ, তারাও সেখানে পা রেখেছে।” তখন মহানবীকে জিজ্ঞেস করা হলো: এটা কিভাবে কল্পনা করা সম্ভব যে, তারা মদীনায় অবস্থান করছে, অথচ আমাদের সাথে এ অভিযানে রয়েছে? তখন তিনি বললেন : তারা ঐ সব ব্যক্তি, যারা ইসলামের এক সুমহান দায়িত্ব অর্থাৎ জিহাদের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহ পোষণ করা সত্বেও কোন যুক্তিসংগত কারণবশত জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে।৪৩৬

মহানবী (সা.) তাঁর এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের একটি শিক্ষণীয় কর্মসূচী ও নীতির দিকে ইঙ্গিত করেন এবং সেই সাথে তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, পবিত্র চিন্তাধারা ও সদিচ্ছা নেক আমল বা পুণ্যময় কর্মের স্থলবর্তী হয় এবং যে সব ব্যক্তি শক্তি-সামর্থ্য না থাকার কারণে এবং উপায়-উপকরণের অভাবে পুণ্যের কাজ আঞ্জাম দেয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, আত্মিক আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করার কারণে তারাও পুণ্য অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যদের শরীক হতে পারবে।

ইসলাম যদি বাহ্য অবস্থা সংস্কার করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়, তা হলে অভ্যন্তরীণ (আত্মিক) অবস্থা সংশোধন ও সংস্কারের ব্যাপারে এ ধর্মের আগ্রহ আরো বেশি হবে। কারণ সকল সংস্কার কার্যক্রমের উৎস হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস এবং চিন্তা-প্রক্রিয়ার সংশোধন এবং আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আমাদের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা উদ্ভূত ও উৎসারিত।

মহানবী (সা.) তাঁর বক্তব্যের দ্বারা মুজাহিদদের অসমীচীন অহংকার বিলুপ্ত করে দিলেন এবং সংগতভাবে বিরত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মর্যাদা রক্ষা করলেন। তবে যে সব লোক বিনা কারণে যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত ছিল তাদেরকে শিক্ষা দেয়া এবং তাদের বিচরণক্ষেত্র সংকীর্ণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

নেতিবাচক সংগ্রাম ও প্রতিরোধ

যেদিন মদীনায় সর্বসাধারণ রণপ্রস্তুতি ও সেনা পুনর্গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সেদিন তিন ব্যক্তি হিলাল, কা ব ও মুরারাহ্ মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে এ জিহাদে যোগদান না করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। তাদের অজুহাত ছিল এই যে, তখনও ক্ষেত-খামার ও বাগান থেকে শস্য তোলা, মাড়াই ও সংগ্রহের কাজ শেষ হয় নি এবং তাদের ফসল তোলা ও মাড়াইয়ের কাজ কেবল অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। তবে তারা মহানবীকে কথা দিয়েছিল যে, কয়েক দিনের ব্যবধানে ফসল গুছিয়ে ঠিক করার পর তারা যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগ দেবে।

এ ধরনের ধর্ম ও অর্থ, বস্তুগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধকারী লোকেরা আসলে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তারা দ্রুত অপসৃয়মান বন্তুগত আনন্দ উপভোগকে চিন্তাগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার পতাকাতলে বাস্তবায়িত মর্যাদাকর মানব জীবনের সমকক্ষ বলে মনে করে, এমনকি কখনো কখনো তারা ঐ সব বস্তুগত আনন্দ ও উপভোগকে মর্যাদাকর মানব জীবনের উপরও প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

মহানবী (সা.) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর এ ধরনের লোকদের যথোপযুক্ত শাস্তি দান করে সমাজের অন্যান্য সদস্য ও ব্যক্তির মধ্যে এ ব্যাধি সংক্রমণের পথ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তারা কেবল এ জিহাদে অংশগ্রহণ তো করেই নি; বরং নিজেদের প্রতিশ্রুতিও পালন করে নি। তারা ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এতটা মশগুল হয়ে গিয়েছিল যে, মদীনায় বিজয়ী বেশে মহানবীর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ হঠাৎ করেই প্রচারিত হয়ে গেল। এ তিন জন ক্ষতিপূরণের আশায় মহানবীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দ্রুত ছুটে এসেছিল এবং অন্যদের মতো তারাও মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছিল।

মহানবী (সা.) তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঐ গৌরবময় সমাবেশে এবং আনন্দের মধ্যে তিনি ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। প্রথম যে কথা তিনি ঐ বিশাল সমাবেশে বলেছিলেন তা হলো :

হে লোকসকল! এ তিন ব্যক্তি ইসলামের বিধানকে হালকা করে দেখেছে ও উপেক্ষা করেছে এবং তারা আমার সাথে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে অনুসারে কাজ করে নি এবং তারা তাওহীদের মর্যাদাকর জীবনের ওপর নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। সুতরাং এদের সাথে তোমরা তোমাদের যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেল।”

যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরতদের সংখ্যা নব্বই জন হওয়া সত্বেও যেহেতু এদের অধিকাংশই ছিল মুনাফিক এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে তারা যে অংশগ্রহণ করবে, তা তাদের কাছ থেকে কখনই আশা করা যায় না, সেহেতু এ তিন মুসলমানের ওপরই বয়কট ও তাদেরকে একঘরে করে রাখার মূল চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এ তিন ব্যক্তির মধ্যে মুরারাহ্ ও হিলাল বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মুসলমানদের মাঝে তাদের সুনাম ছিল।

মহানবী (সা.)-এর প্রাজ্ঞ নীতি, যা তাঁর ধর্ম তথা শরীয়তেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, অতি বিস্ময়কর প্রভাব রেখেছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে যারা বিরত ছিল, তাদের কেনা-বেচা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের পণ্য-সামগ্রী বিক্রি হতো না। তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট লোকজনও তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল, এমনকি তাদের সাথে কথা বলা ও তাদের কাছে যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল।

তাদের সাথে জনগণের সম্পর্কচ্ছেদ তাদের আত্মা ও মন-মানসিকতার ওপর এতটা চাপ প্রয়োগ করেছিল যে, পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্বেও তাদের দৃষ্টিতে তা একটি খাঁচার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।৪৩৭

এ তিন ব্যক্তি পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা সহ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, মুসলমানদের কাতারে সত্যিকারভাবে শামিল হওয়া ছাড়া ইসলামী সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস মোটেই সম্ভব নয় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে সংখ্যাস্বল্পদের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হবে না, বিশেষ করে এ সংখ্যাস্বল্পরা যদি উচ্চাভিলাষী, মতলববাজ ও দুরভিসন্ধি সম্পন্ন হয়।

একদিকে এ সব হিসাব-নিকাশ এবং অন্যদিকে মানব প্রকৃতির (ফিতরাত) আকর্ষণ, তাদেরকে পুনরায় প্রকৃত ঈমানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তারা তওবা করে এবং মহান আল্লাহর দরবারে নিজেদের কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখিত ও অনুতপ্ত হয়। মহান আল্লাহ্ও তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে বলে মহানবীকে অবগত করেন এবং সাথে সাথে মহানবীর পক্ষ থেকেও তাদেরকে একঘরে করে রাখার নির্দেশ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়।৪৩৮

মসজিদে যিরারের ঘটনা

আরব উপদ্বীপে মদীনা ও নাজরান আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের জন্য দু টি বিশাল কেন্দ্র বলে গণ্য হতো। এ কারণেই আউস ও খাযরাজ গোত্রীয় কিছু আরব ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

উহুদ যুদ্ধের একজন বিখ্যাত শহীদ হানযালার পিতা আবু আমীর জাহিলীয়াতের যুগে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি প্রচণ্ডভাবে ঝুঁকে পড়েছিল এবং খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ইসলামের নব তারকা মদীনা থেকে উদিত হয়ে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজের মাঝে বিলীন করে দেয়ায় আবু আমীর খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। আর তখন থেকেই সে আউস ও খাযরাজ গোত্রের মুনাফিকদের সাথে আন্তরিক সহযোগিতা শুরু করে দেয়। মহানবী (সা.) তার ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্পর্কে জ্ঞাত হলে তাকে গ্রেফতার করতে চাইলেন। কিন্তু সে প্রথমে মদীনা থেকে মক্কায় পালিয়ে যায় এবং সেখান থেকে তায়েফে এবং তায়েফের পতন হলে সেখান থেকে সে শামে পালিয়ে যায়। সে সুদূর শাম থেকে মুনাফিক গোষ্ঠীর গোপন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করত।

সে বন্ধুদের প্রতি লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিল : কুবা গ্রামে তোমরা মুসলমানদের বিপক্ষে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে এবং নামাযের ওয়াক্তে সেখানে জড়ো হবে। ফরয নামায আদায় করার বাহানায় সেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি এবং গোষ্ঠীগত কর্মসূচী ও পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে পরস্পর আলোচনা ও মতবিনিময় করবে।

আবু আমীর এ কালের ইসলামের শত্রুদের মতো অনুধাবন করেছিল যে, যে দেশে ধর্ম পূর্ণরূপে প্রচলিত, সেখানে ধর্মের মূলোৎপাটনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে ধর্মের নামের অপব্যবহার। ধর্মের ক্ষতিসাধন করার জন্য অন্য যে কোন উপাদানের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ধর্মের নাম ব্যবহার করা যেতে পারে।

সে খুব ভালোভাবেই জানত, মহানবী (সা.) যে কোন শিরোনামে মুনাফিকদের সমাবেশকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেবেন না। তবে এ কেন্দ্রের গায়ে যদি ধর্মীয় লেভেল আঁটা যায় এবং মসজিদ ও ইবাদতগাহ্ নির্মাণ করার বহিরাবরণে যদি নিজেদের একটি সমাবেশস্থল নির্মাণ করা যায়, সে ক্ষেত্রে হয় তো বা মহানবী (সা.) তাদেরকে অনুমতি দেবেন।

মহানবী (সা.)-এর তাবুক অভিযানে বের হওয়ার সময় মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা মহানবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অন্ধকার ও বর্ষণমুখর রাতে তাদের বৃদ্ধ ও রোগীরা ঘর থেকে কুবা মসজিদের দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না- এ বাহানায় তাদের মহল্লায় একখানা মসজিদ নির্মাণের অনুমতি চায়। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের আবেদন অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করা সংক্রান্ত কোন কথাই বললেন না এবং এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় অভিযান থেকে ফেরা পর্যন্ত স্থগিত রাখলেন।৪৩৯

মুনাফিক গোষ্ঠী মহানবী (সা.)-এর অনুপস্থিতিতে একটি স্থান নির্বাচন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ স্থানে মসজিদের নামে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় প্রত্যাবর্তনের দিন তারা মহানবীর কাছে এসে আবেদন জানাল, তিনি যেন কয়েক রাকাআত নামায আদায় করার মাধ্যমে এ ইবাদতগাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে মহানবীকে পুরো ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত করলেন এবং এ ইমারতকে মসজিদ-ই যিরার’ (مسجد ضرار ) বলে অভিহিত করলেন যা রাজনৈতিক শ্রেণীবিভক্তি এবং মসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে।৪৪০

মহানবী (সা.) মসজিদে যিরারের ইমারত ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া, সেখানকার কড়িকাঠগুলো জ্বালিয়ে ফেলা এবং বেশ কিছুকাল তা ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ জারী করেছিলেন।৪৪১

মুনাফিক-গোষ্ঠীর ললাটের উপর মসজিদে যিরার ধ্বংস করা ছিল এক বিরাট মারণ আঘাত। এরপর থেকে এ গোষ্ঠীর সূত্র ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইও তাবুক যুদ্ধের পর দু মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে। তাবুক অভিযান ছিল সর্বশেষ ইসলামী গায্ওয়া যাতে মহানবী (সা.) নিজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি আর কোন সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ করেন নি।

পঞ্চান্নতম অধ্যায় : নবম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মদীনায় সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দল

তাবুক অভিযান অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল এবং মুজাহিদগণ ক্লান্ত দেহে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যোদ্ধারা এ সামরিক অভিযানে পথিমধ্যে কোন শত্রুর মুখোমুখি হন নি এবং তাদের কোন গনীমতও অর্জিত হয় নি। এ কারণে একদল সরলমনা লোক এ অভিযানকে বৃথা বলে বিবেচনা করত। তবে তারা এ অভিযানের অদৃশ্য ফলাফল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ অভিযানের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে গেল এবং আরবের সবচেয়ে অনমনীয় গোত্র- যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং মহানবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে মোটেই প্রস্তুত ছিল না,- মহানবীর নিকট প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে নিজেদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা দিয়েছিল এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দুর্গগুলোর দরজাগুলো খুলে দিয়েছিল যাতে তাঁরা এ গোত্রের প্রতিমা ও মূর্তিগুলো ধ্বংস করে সেগুলোর স্থানে তাওহীদের পতাকা উড্ডীন করেন।

মূলত অগভীর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তিরা সবসময় দৃশ্যমান ও তথাকথিত মুঠিপূর্ণকারী ফলাফলের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামের সৈনিকরা যদি পথিমধ্যে কোন শত্রুর মুখোমুখি হয়ে তাকে হত্যা করতেন এবং তার অর্থ-সম্পদ জব্দ করতেন, তা হলে তারা বলত, যুদ্ধের ফলাফল খুবই উজ্জ্বল ছিল। তবে গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন; যে কাজ লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে, সে কাজের প্রশংসা করেন এবং সেটাকে ফলপ্রসূ বলে বিবেচনা করেন।

মহানবী (সা.)-এর লক্ষ্য ছিল সমগ্র আরব জাতির ইসলাম গ্রহণ, সে ক্ষেত্রে তাবুক যুদ্ধ ঘটনাচক্রে বেশ উপযোগী প্রভাব রেখেছিল। কারণ সমগ্র হিজাযে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল, রোমানরা (যে রোমান জাতি সর্বশেষ যুদ্ধে তদানীন্তন সভ্য বিশ্বের অর্ধেক অংশ যে ইরানী জাতি,- এমনকি ইয়েমেন ও তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহের ওপর শাসন ও কর্তৃত্ব করত,- তাদেরকে পরাজিত করে তাদের কাছ থেকে ক্রুশ উদ্ধার করে তা বাইতুল মুকাদ্দাস তথা জেরুজালেমে নিয়ে গিয়েছিল) মুসলমানদের সামরিক শক্তি দেখে ভীত হয়ে মুসলিম সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা থেকে বিরত থেকেছে। এ সংবাদ প্রচারিত হবার ফলে কঠোর (মানসিকতাসম্পন্ন) আরব গোত্রগুলো, যারা আগের দিন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ এবং মুসলমানদের সাথে সন্ধি করতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, তারা মুসলমানদের সাথে সহযোগিতা করার চিন্তা শুরু করে এবং তদানীন্তন বিশ্বের পরাশক্তিগুলো, যেমন রোম ও ইরানের আগ্রাসন থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ইসলাম গ্রহণ করার প্রবণতা প্রদর্শন করে।

সাকীফ গোত্রে মতবিরোধ

আরব জাতির মধ্যে সাকীফ গোত্র অবর্ণনীয় ঔদ্ধত্য, অবাধ্যতা ও একগুঁয়েমীর জন্য কুখ্যাত ছিল। এ গোত্র তায়েফের মজবুত দুর্গে আশ্রয় নিয়ে পুরো এক মাস মুসলিম বাহিনীকে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছিল এবং তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে নি।৪৪২

সাকীফ গোত্রের একজন নেতা উরওয়াহ্ ইবনে মাসউদ সাকীফ তাবুক অঞ্চলে ইসলামী বাহিনীর বিরাট বিজয় সম্পর্কে অবগত হলেন। মহানবী (সা.)-এর মদীনায় প্রবেশের আগেই উরওয়াহ্ মহানবী সকাশে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মহানবীর কাছে তায়েফ গিয়ে নিজ গোত্রের কাছে একত্ববাদী ধর্মের দাওয়াত প্রদানের অনুমতি চান। মহানবী এ দাওয়াতের পরিণতির ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করে বললেন : আমি ভয় পাচ্ছি, তুমি এ পথে প্রাণ হারাবে।” তিনি জবাবে বলেছিলেন, তারা তাদের নিজেদের চোখের চেয়েও তাঁকে অধিক ভালোবাসে।

উরওয়াহ্ ইসলামের যে মহত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তা তখনও তাঁর গোত্র ও গোত্রের অন্য নেতারা বুঝতে পারে নি। তখনও তাদের মন-মগজে মিথ্যার অহংকার বিদ্যমান ছিল। এ কারণেই তারা প্রথমে ইসলামের প্রচারকারীকে নিজ কক্ষে দাওয়াতরত অবস্থায়ই তীর বর্ষণ করে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশেষে তারা তাঁকে হত্যা করে। শাহাদাত লাভের মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন : আমার মৃত্যু হচ্ছে একটি অলৌকিক বিষয় যে ব্যাপারে মহানবী (সা.) আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন।”

সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দল

উরওয়াহ্ ইবনে মাসউদ সাকীফকে হত্যা করার পর সাকীফ গোত্রের অধিবাসীরা অত্যন্ত অনুতপ্ত হলো এবং বুঝতে পারল, যে হিজাযের সর্বত্র তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে, সেখানে তাদের আর বসবাস সম্ভব নয় এবং তাদের সকল চারণক্ষেত্র ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ মুসলমানদের পক্ষ থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়ে গেছে। নিজেদের সমস্যাগুলো পর্যালোচনার জন্য আয়োজিত সভায় তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের তরফ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে মহানবীর সাথে আলোচনা এবং কতিপয় শর্তসাপেক্ষে সাকীফ গোত্রের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয় ঘোষণার জন্য এক ব্যক্তিকে মদীনায় প্রেরণ করা হবে।

তারা সর্বসম্মতিক্রমে আবদা ইয়ালাইলকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যে মদীনায় গিয়ে মহানবীর কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে : আমার যাবার পর তোমাদের অভিমত যে পাল্টে যাবে এবং আমাকেও উরওয়ার মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে, তা মোটেই অসম্ভব নয়।” এরপর সে আরো বলেছিল: সাকীফ গোত্রের আরো পাঁচ ব্যক্তি আমার সাথে থাকলে আমি তোমাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করব। আর এ ছয় ব্যক্তিকে সমানভাবে এ প্রতিনিধি দলের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে।”

আবদা ইয়ালাইলের প্রস্তাব গৃহীত হলো। ছয় ব্যক্তি মদীনার উদ্দেশে তায়েফ নগরী ছেড়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর মদীনা নগরীর অদূরে একটি ঝরনার পাশে যাত্রাবিরতি করে। মুগীরাহ্ ইবনে শুবাহ্ সাকীফ, যে মহানবীর সাহাবীগণের ঘোড়াগুলো চারণভূমিতে নিয়ে এসেছিল, সে নিজ গোত্রপতিদের ঝরনার পাশে দেখতে পায়। তৎক্ষণাৎ সে তাদের কাছে দ্রুত ছুটে যায় এবং তাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনে নেয়। অতঃপর মহানবীকে একগুঁয়ে সাকীফ গোত্রের অধিবাসীদের গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য সে ঐ ছয় ব্যক্তির কাছে ঘোড়াগুলো সোপর্দ করে দ্রুত মদীনার পথে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে হযরত আবু বকরের সাথে তার দেখা হলে সে তাঁকে পুরো ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত করে। আবু বকর তাকে অনুরোধ করেন যাতে করে সে তাঁকে সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমনের শুভ সংবাদ মহানবীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়। অবশেষে হযরত আবু বকর মহানবীকে সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমন সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, কতিপয় শর্তসাপেক্ষে এবং (মহানবীর পক্ষ থেকে) একটি প্রতিশ্রুতিপত্র প্রদানের ভিত্তিতে তারা ইসলাম গ্রহণে প্রস্তুত।

মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর কাছে সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের থাকা ও আপ্যায়নের জন্য একটি তাঁবু স্থাপন করে খালিদ ইবনে সাঈদ এবং মুগীরাকে এ প্রতিনিধি দলের আপ্যায়ন ও দেখাশোনার নির্দেশ দেন।

প্রতিনিধি দল মহানবীর নিকট উপস্থিত হয়। যদিও মুগীরাহ্ ইবনে শুবাহ্ তাদেরকে বলেছিল যে, তারা যেন জাহিলীয়াতের যুগের অভিবাদন পদ্ধতি পরিহার করে মুসলমানদের ন্যায় সালাম দেয়, কিন্তু অহংকার তাদের অস্থি-মজ্জার সাথে মিশে গিয়েছিল বিধায় তারা জাহিলী যুগের পদ্ধতিতেই মহানবীকে সালাম জানাল এবং তাঁকে ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত সাকীফ গোত্রের বার্তা ও প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করল। অতঃপর তারা আরো বলল : ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমাদের কতিপয় শর্ত আছে, যেগুলো আমরা পরবর্তী বৈঠকে আপনার কাছে পেশ করব।” সাকীফ গোত্র প্রতিনিধি দলের সংলাপ কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে। আর মহানবী (সা.) খালিদ ইবনে সাঈদের মাধ্যমে এসব সংলাপের সারবস্তু সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন।

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম

বারতম পত্র

২২ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

কোরআনের আয়াত হতে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ

আলহামদুলিল্লাহ্! আপনি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা কোরআনের জ্ঞানে সম্যক জ্ঞাত এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে সচেতন। রাসূলের পবিত্র বংশধরগণ সম্পর্কে কোরআনে যেরূপ স্পষ্ট আয়াতসমূহ রয়েছে অন্য কারো সম্পর্কে সেরূপ স্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?

কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহে যেরূপ তাঁদের বিষয়ে বলা হয়েছে যে,পাপ ও পঙ্কিলতা হতে তাঁরা সম্পূর্ণ পবিত্র সেরূপ অন্য কারো বিষয়ে বলা হয়েছে কি?৫০

আয়াতে তাতহীর অন্য কারো বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে কি? কোরআন তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রতি ভালবাসা পোষণকে ফরয ঘোষণা করেছে কি?৫১

হযরত জিবরাঈল (আ.) মোবাহিলার আয়াতটি তাঁরা ব্যতীত অন্য কারো জন্য এনেছেন কি? অবশ্যই না,বরং তাঁদের ব্যাপারেই বলেছেন,

বলুন,এসো আমরা আমাদের সন্তানদের,নারীদের ও নিজ সত্তাদেরকে আহবান করি এবং আল্লাহকে বলি মিথ্যাবাদীদের ধ্বংস করুন। (সূরা আলে ইমরান : ৬১)

هل أتى هل أتى بِمدح سواهم لا و مولى بذكرهم حلّاها

সূরা হাল আতা (সূরা দাহর) তাঁদের ব্যতীত অন্য কারো প্রশংসায় অবতীর্ণ হয় নি,বরং শুধু তাঁদের লক্ষ্য করেই অবতীর্ণ হয়েছে।

আহলে বাইত কি আল্লাহর রজ্জু নন যেখানে কোরআনে বলা হয়েছে-

) و اعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرّقوا(

তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না৫২

তাঁরা কি কোরআনে বর্ণিত সত্যপন্থী নন যেখানে আল্লাহ্ বলছেন,

 ( وكونوا مع الصادقين ) এবং সত্যপন্থীদের সঙ্গে থাক। (সূরা তওবা : ১১৯)

সত্যপন্থী বলতে আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসানুসারে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত। ইবনে হাজার তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় ৫ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা আমি ৬ষ্ঠ পত্রে উল্লেখ করেছিলাম।

আল্লাহ্ কি তাঁদেরকে সিরাতুল্লাহ্ বলে উল্লেখ করেন নি-

) و إنّ هذا صراطي مستقيما فاتبعوه(

নিশ্চয়ই এটি আমার সরল সঠিক পথ, এ পথের অনুসরণ কর। (সূরা আনআম : ১৫৩)

অন্যরা আল্লাহর পথ নন। তাই বলেছেন,

) ولا تتبعوا السبل فتفرق بكم عن سبيله(

বিচ্ছিন্নতা ও বক্রতার পথসমূহ অবলম্বন কর না, তাহলে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরে যাবে ৫৩

এবং কোরআনে বর্ণিত উলিল আমর কি তাঁরাই নন যেখানে বলা হয়েছে-

) يا ايها الذين آمنوا اطيعوا الله و اطيعوا الرسول و اولي الامر منكم(

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের (উলিল আমরের) আনুগত্য কর   ৫৪

তাঁরাই কি কোরআনে বর্ণিত আহলুয যিকর নন-

) فسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون(

যদি তোমরা না জান তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। ৫৫

সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতে যে মুমিনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তাঁরাই কি সেই মুমিনীন নন? বলা হয়েছে- যে কেউ সত্য প্রকাশিত হবার পর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করবে ও মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ গ্রহণ করবে আমরা তাদেরকে সেই পথেই পরিচালিত করবো এবং অবশেষে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। ৫৬

তাঁরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যারা আল্লাহর দিকে মানুষদের হেদায়েত করেন। যেমন সূরা রাদের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

) انما انت منذر و لكل قوم هاد(

নিশ্চয়ই আপনি কেবল ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক জাতি ও গোত্রের জন্যই হেদায়েতকারী রয়েছে। ৫৭

এরাই কি সেই ব্যক্তিবর্গ নন যাঁদেরকে মহান আল্লাহ্ নিয়ামত দান করেছেন?

সূরা ফাতিহা যার অপর নাম হলো সাবয়ুল মাছানী এবং কোরআনে সেই সূরাতে আমাদের সরল সঠিক পথে ও যাদের প্রতি আপনি নিয়ামত দান করেছেন তাদের পথে পরিচালিত করুন বলতে কাদের পথকে বুঝানো হয়েছে?৫৮

সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে,সে কিয়ামতের দিন তাঁদের সঙ্গে থাকবে যাঁদের ওপর আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন,(তাঁরা হলেন) নবী,সিদ্দীক,শহীদ ও সৎ কর্মশীল বান্দাগণ।

নিঃসন্দেহে আহলে বাইতের ইমামগণ সিদ্দীক,শহীদ ও সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত। তবে কি আল্লাহ্ সর্বসাধারণের সার্বিক নেতা হিসেবে তাঁদেরকেই মনোনীত করেন নি? নবীর পরবর্তীতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানের ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত করেন নি?

যদি বিষয়টি না জানেন তবে দেখুন-

নিশ্চয়ই তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক) হলেন শুধু আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান আনে,নামায কায়েম করে এবং রুকুরত অবস্থায় যাকাত দেয়। যারা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয় তারাই জয়ী হবে,কারণ আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।৫৯  

মহান আল্লাহ্ ক্ষমা ও মাগফেরাতের শর্ত হিসেবে তওবা,ঈমান আনা,সৎ কর্ম করা ও আহলে বাইতের ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন যেমনটি সূরা ত্বহার ৮২ নং আয়াতে এসেছে-

আমি আমার ক্ষমাকে তওবার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন,ঈমান আনয়ন,সৎ কর্ম সম্পাদন এবং হেদায়েত প্রাপ্তির৬০ মধ্যেই রেখেছি (অর্থাৎ তারাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে যারা তওবা করেছে,ঈমান আনয়ন করেছে,সৎ কর্ম সম্পাদন করেছে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে)।

তাহলে তাঁদের বেলায়েত কি একটি আমানত নয় যা সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

আমরা আমানতকে আসমান,যমীন ও পর্বতের নিকট পেশ করেছিলাম কিন্তু তারা তা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল এবং তারা বোঝা বহনের ভয় করছিল কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেছিল। কারণ মানুষ (নিজের প্রতি) অত্যাচারী এবং অজ্ঞ।৬১  

তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও অভিভাবকত্বকেই আল্লাহ্ কোরআনেسِلْمٌ (সিল্ম) বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেখানে প্রবেশের জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, হে ঈমানদারগণ,সকলেই সমবেতভাবে সিল্ম বা শান্তি ও মুক্তির মধ্যে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। ৬২

তাঁদের বেলায়েত বা অভিভাবকত্বকেই কি মহান আল্লাহ্ কোরআনেنعيم (নাঈম) বলে উল্লেখ করেন নি যে বিষয়ে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে( ثم لتسئلن يومئذ عن النعيم )৬৩

রাসূল (সা.) কি তাঁদের বেলায়েতকে ঘোষণার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন নি? এবং এ বিষয়ে রাসূলকে প্রদত্ত নির্দেশ অনেকটা রাসূলকে ভীতি প্রদর্শনের মত ছিল,নয় কি? যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন,

হে রাসূল!যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছান। যদি তা না করেন আপনি আপনার রেসালতের দায়িত্বই পালন করেন নি এবং আল্লাহ্ আপনাকে মানুষ হতে (সম্ভাব্য বিপদ হতে) রক্ষা করবেন। ৬৪

রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে এ বাণী প্রচারের জন্য কি ব্যাপক পদক্ষেপ নেন নি? পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণাঙ্গরূপে বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন নি? মহান আল্লাহ্ তখনই সূরা মায়েদার এ আয়াত নাযিল করেন- আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের মনোনীত দীন হিসেবে গ্রহণ করলাম। ৬৫

তাহলে কি আপনি জানেন না মহান আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তি যে তাঁদের (আহলে বাইতের) বেলায়েত ও নেতৃত্বকে সরাসরি অস্বীকার করেছিল এবং নবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছেন? ঐ ব্যক্তি চিৎকার করে বলেছিল, হে আল্লাহ্! যদি এটি সত্য ও আপনার পক্ষ হতে হয়ে থাকে,তবে আসমান হতে আমার ওপর পাথর বর্ষণ করুন এবং আজাব নাযিল করুন। আল্লাহ্পাক ঐ ব্যক্তিকে হস্তীবাহিনীর ন্যায় ধ্বংস করেন। তখনই এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য এবং যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।৬৬ (*১৪)

অতিশীঘ্রই পুনরুত্থান দিবসে আহলে বাইতের বেলায়েত ও নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে যেমনটি সূরা সাফ্ফাতের ২৪ নং আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে( وقفوهم إنّهم مسئولون )’ এবং তাদেরকে থামাও,তারা জিজ্ঞাসিত হবে।৬৭ এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় কারণ তাঁদের নেতৃত্ব ও বেলায়েত এমন একটি বিষয় যা ঘোষণার জন্য সকল নবীর আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা বিশ্বে আল্লাহর সর্বোত্তম নিদর্শন। নবীদের স্থলাভিষিক্ত ওলী ও ঐশী প্রতিনিধিগণ মানুষের কাছে এ সত্যটি প্রকাশ করে গিয়েছেন,যেমন সূরা যুখরুফের ৪৫ নং আয়াতে এসেছে-

) وأسأل من أرسلنا من قبلك من رسلنا(

তোমার পূর্বে আমাদের রাসূলদের মধ্য থেকে যাদের প্রেরণ করেছিলাম তাদের নিকট এ বিষয়ে প্রশ্ন কর।৬৮

আহলে বাইত সম্পর্কে এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্পাক আমি কি তোমাদের প্রভু নই -এর প্রতিশ্রুতি থেকেই গ্রহণ করেছেন যা সূরা আ রাফের ১৭২ নং আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।(*১৫) আয়াতটি হলো : আল্লাহ্ বনি আদম হতে তার জন্মের পূর্বে এ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন (তার পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বের করে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন) যে,আমি কি তোমাদের প্রভু নই? তারা বলল,হ্যাঁ। এ বিষয় আহলে সুন্নাহর হাদীসসমূহেও উল্লিখিত হয়েছে।

এবং আদম তাঁর স্রষ্টা হতে কয়েকটি বাক্য প্রাপ্ত হলেন,তার মাধ্যমে ক্ষমা চাইলেন এবং আল্লাহ্ তাঁর তওবাকে গ্রহণ করলেন। ৬৯

তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ তাদের (এ উম্মতকে) আজাব দান করবেন না যখন তুমি তাদের মধ্যে বর্তমান। ৭০

পৃথিবীর অধিবাসীদের জন্য তাঁরা নিরাপত্তাস্থল এবং আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচার মাধ্যম। তাঁরাই যে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্যদের হিংসার পাত্র তা সূরা নিসার ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে (নবী ও তার পরিবারবর্গকে) আল্লাহ্ তাঁর নিয়ামত হতে যা দান করেছেন তারা তার প্রতি হিংসা করে। ৭১

তাঁদের বিষয়েই আল্লাহ্ বলেছেন, জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ বলে : আমরা ঈমান এনেছি। ৭২

আমাদের জানা উচিত আ রাফের ব্যক্তিবর্গ তাঁরাই। এজন্য আল্লাহ্পাক বলেছেন, এবং আ রাফে একদল ব্যক্তি রয়েছেন যাদের চেহারা দেখে সবাই চিনবে। ৭৩

তাঁরাই আল্লাহ্ বর্ণিত সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ। কোরআন বলেছে, মুমিনদের মধ্যে একদল লোক রয়েছে তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন করেছে,তাদের একদল দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে (শহীদ হয়েছে) এবং অপর দল অপেক্ষমান রয়েছে (তাদের সাথে মিলিত হবার),তারা তাদের সংকল্প কখনোই পরিবর্তন করে নি। ৭৪

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ তাঁর গুণকীর্তনকারী বলে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ্ যে সকল গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,সেখানে (একদল লোক) সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন লোকেরা,যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। ৭৫

তাদের ঘরসমূহ হলো সেই ঘরসমূহ যার সম্পর্কে আল্লাহ্পাক বলেছেন, আল্লাহ্ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। ৭৬

তাঁদের সম্পর্কেই মহান আল্লাহ্ সূরা নূরের ৩৫ আয়াতে বলেছেন, তাদের উদাহরণ হলো কুলঙ্গি এবং তাদের অস্তিত্ব আমারই নূরের অস্তিত্ব।৭৭ অথচ আল্লাহর জন্য আসমান ও জমীনে সর্বোত্তম উদাহরণ বিদ্যমান এবং তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রজ্ঞাবান।

তাঁরা আল্লাহ্ বর্ণিত অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে-

( السّابقون السّابقون أولَائك المقرّبون)

অর্থাৎ অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই,তারাই নৈকট্যশীল।৭৮

এবং সত্যবাদী,শহীদ,সাক্ষ্য প্রদানকারী এবং সৎ কর্মশীল বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়েছে।৭৯

আহলে বাইত এবং তাঁদের ইমামগণ সম্পর্কেই আল্লাহ্পাক বলেছেন,

( وممن خلقنا أمة يهدون بالْحقّ و به يعدلون)

আর যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা সত্যের দিকে মানুষকে হেদায়েত করে (পথ দেখায়) এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। ৮০

আহলে বাইতের অনুসারী এবং বিরোধী ও শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

( لا يستوي أصحاب النّار و أصحاب الْجَنَّة أصحاب الْجَنَّة هم الفائزون)

জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসীগণ সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।৮১

তাঁদের পক্ষের ও বিপক্ষের দল সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন,

( أم نجعل الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات كالمفسدين في الأرض أم نجعل المتّقين كالفجّار)

আমি কি বিশ্বাসী ও সৎ কর্মশীলদেরকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফেরদের সমতুল্য করে দেব,না খোদাভীরুদেরকে পাপাচারীদের সমান করে দেব? ৮২  

এই দু দল সম্পর্কে অন্যত্র বলেছেন,

( أم حسب الّذين اجترحوا السيّئات أن نجعلهم كالذين آمنوا و عملوا الصّالِحات سواء محياهم و مَماتُهم ساء ما يحكمون)

যারা দুষ্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে আমি তাদেরকে সে লোকদের মত করে দেব যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে ও তাদের জীবন ও মৃত্যু কি সমান হবে? ৮৩

আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে-

( إنّ الّذين آمنوا و عملوا الصّالِحات أولَائك هم خيرُ البريّة)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।৮৪

আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে-

এই দু বাদী-বিবাদী,তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব,যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোষাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে।৮৫

এবং আহলে বাইত ও তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কেই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- মুমিন কি কখনো ফাসেকের মত হতে পারে? তারা সমান নয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে তাদের বাসস্থান হলো চিরস্থায়ী জান্নাত তাদের সৎ কর্মের বিনিময়স্বরূপ আর যারা গুনাহ করেছে তারা তাদের বাসস্থানকে জাহান্নামের মধ্যে প্রস্তুত করেছে। যখনই তারা চাইবে তা হতে বের হতে,তাদেরকে জোরপূর্বক ফিরিয়ে দেয়া হবে ও বলা হবে,যে জাহান্নামকে অস্বীকার করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।৮৬

অন্যত্র ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা হাজীদের পানি পান করানো ও কাবা শরীফের খাদেম হওয়ার কারণে অহংকার ও গর্ব পোষণ করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে কর যে ঈমান রাখে আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে? এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়,আর আল্লাহ্ জালেম লোকদের হেদায়েত করেন না। ৮৭

তেমনিভাবে আল্লাহ্পাক আহলে বাইতের বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় সফলতার কথা কোরআনে বর্ণনা করেছেন-

( و من النّاس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله و الله رءوف بالعباد)

এবং মানুষের মধ্যে একদল লোক আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।৮৮

অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ্ মুমিনদের জীবন ও সম্পদকে বেহেশতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে,হত্যা করে ও নিহত হয়। এ প্রতিশ্রুতি সত্য ও অবশ্যম্ভাবী যা তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে এসেছে- এবং আল্লাহ্ হতে কে অধিক ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী?

সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর যা তোমরা আল্লাহর সঙ্গে করেছ। তারা (এ মুমিনগণ) তওবাকারী,ইবাদতকারী,কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী,দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী,রুকু ও সিজদাকারী,সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী,আল্লাহর দেয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। (সূরা তওবা : ১১১ ও ১১২)

যারা স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে (দান করে) রাত্রে ও দিনে,গোপনে ও প্রকাশ্যে। তাদের জন্য তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার নিকট সংরক্ষিত। তাদের কোন আশঙ্কা নেই এবং তারা

চিন্তিতও হবে না। (বাকারা : ২৭৪)৮৯

তাঁরাই সত্যকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছেন, যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে ও সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,তারাই তো খোদাভীরু ও মুত্তাকী (পরহেজগার)।৯০

সুতরাং তাঁরাই রাসূল (সা.)-এর গোত্রের সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় যাঁদের মহান আল্লাহ্ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন,

( و أنذر عشيرتك الأقربين )“ এবং তোমার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন কর। এবং তাঁরাই কোরআনে বর্ণিত উলুল আরহাম বা নিকটাত্মীয় যেমনটি বলা হয়েছে সূরা আনফালের ৭৫ নং আয়াতে( أولوا الأرحام بعضهم أولى ببعض ) অর্থাৎ বস্তুত যারা নিকটাত্মীয় তারা পরস্পর অধিক হক্বদার এবং এদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে তাঁদের মর্যাদা কিয়ামতের দিন বাড়িয়ে দেয়া হবে এবং নবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জান্নাতুন নাঈমে অবস্থান করবেন। এর প্রমাণ কোরআনের এ আয়াত যাতে বলা হয়েছে-

যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের পরিবার ও বংশের যারা তাদের (ঈমানের ক্ষেত্রে) অনুসরণ করেছে সেই বংশধরদেরও আমি তাদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল হতে কিছুই কম করা হবে না। ৯১

তাঁরাই সেই ব্যক্তিবর্গ যাঁদের অধিকারকে আল্লাহ্ আদায় করতে বলেছেন-

وآت ذا القربىحقّه অর্থাৎ নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায় কর। তাঁরাই খুমসের অধিকারী যা আদায় না করলে তাঁদের হক্ব আমাদের ওপর কিয়ামতের দিনও থেকে যাবে- জেনে রাখো,তোমরা যা কিছু অর্জন কর,তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল এবং তাঁর নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের.। (সূরা আনফাল : ৪১)

তাঁরা ফাই সম্পদেরও অধিকারী কারণ আল্লাহ্ বলেছেন, যা মহান আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে রাসূলকে দিয়েছেন তা আল্লাহর,রাসূলের,তাঁর আত্মীয়-স্বজনের,ইয়াতিমদের,অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের। (সূরা হাশর : ৭)

নবীর আহলে বাইতকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ বলেছেন,

( إنّما يريد الله ليذهب عنكم الرّجس أهل البيت و يطهّركم تطهيرا)

হে আহলে বাইত! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ চান তোমাদের হতে পাপ পঙ্কিলতা দূরীভূত করতে ও সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সূরা আহযাব : ৩৩)

তাঁদেরকেই আল্লাহ্ আলে ইয়াসিন বলে সম্বোধন করে সালাম দিয়েছেন-و سلام على الياسين অর্থাৎ আলে ইয়াসিনের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।৯২ (সূরা সাফ্ফাত : ১৩০)

তাঁরাই রাসূলের বংশধর যাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের জন্য নামাযে ওয়াজিব করেছেন-

﴿ إنّ الله و ملائكته يصلّون على النَّبِيّ يا أيّها الّذين آمنوا صلّوا عليه و سلّموا تسليما

নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর দরূদ পড়েন,হে ঈমানদারগণ! তোমরাও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ কর।৯৩

সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার ওপর সালাম কিরূপে পাঠ করতে হবে জানি কিন্তু দরূদ কিরূপে পড়ব? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলে মুহাম্মাদ অর্থাৎ হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ কর।

এ হাদীস হতে বুঝা যায় আহলে বাইতের ওপর দরূদ পাঠও এই আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই আলেমগণ এই আয়াতকে আহলে বাইতের শানে বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর আসসাওয়ায়েক গ্রন্থের ১১ অধ্যায়েও তাই করেছেন।৯৪

طوبى لهم তাদের জন্যই সুসংবাদ ও তাদের জন্যই চিরস্থায়ী বেহেশত এবং তার দ্বারগুলো উন্মুক্ত রয়েছে।৯৫

আরব কবি বলেছেন,

من يباريهم و في الشّمس معنى؟ مجهد متعب لمن باراها

কে পারে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে অর্থাৎ সূর্যের সাথে যে প্রতিযোগিতা করে তার ওপরই ক্লান্ত ও শ্রান্তের অর্থ বর্তায় (অর্থাৎ সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে)।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তাঁরা মনোনীত,আল্লাহর অনুমতিক্রমে পুণ্যকর্মে তাঁরা অন্যদের হতে অগ্রগামী। তাঁরা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী এবং তাঁদের সম্পর্কেই আল্লাহ্ বলেছেন,

অতঃপর কিতাবকে (আল কোরআন) তাঁর বান্দাদের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিদের হাতে সমর্পণ করলাম। আর বান্দাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে এবং তারা ইমামদের নেতৃত্বকে মেনে নেয় নি।

তাদের (বান্দাগণের) অনেকেই মধ্যপন্থী ও ন্যায়পরায়ণ এবং তারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী। যেমন কোরআনে এসেছে-

এবং তাদের অনেকেই পুণ্যকর্মে অগ্রগামী হয়েছে এবং তারাই ইমাম। এটি একটি বড় নিয়ামত।৯৬

আহলে বাইতের ফজীলত বর্ণনা করে যে সকল আয়াত এসেছে তা বর্ণনার জন্য এ পর্যন্তই যথেষ্ট বলে মনে করেছি। তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি হযরত আলী (আ.)-এর শানে কোরআনে ৩০০ আয়াত বর্ণিত হয়েছে।৯৭

অন্য আরেকজন তাফসীরকারক বলেছেন, কোরআনের এক চতুর্থাংশ আয়াত আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে এবং এটি আশ্চর্যের কোন বিষয় নয়,কারণ আহলে বাইত ও কোরআন একই সত্তার দুই অংশ।

এখন পর্যন্ত যে সমস্ত স্পষ্ট আয়াত আপনার নিকট বর্ণনা করলাম তা কোরআনের মূল ও ভিত্তি( هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب ) । এ আয়াতগুলো খুব সহজে গ্রহণ করুন (মেনে নিন)। আর ভক্তি ও উদারতার সাথে সূক্ষ্মভাবে এসব আয়াত অধ্যয়ন করুন এবং এসব আয়াত সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহর বাণী হতে গ্রহণ করুন যে সম্পর্কে অন্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আপনাকে অবগত করবে না।

ওয়াসসালাম


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53