চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79218
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79218 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

প্রতিনিধি দলের শর্তাবলী

মহানবী (সা.) তাদের অনেক শর্তই মেনে নেন। এমনকি একটি অঙ্গীকারপত্রে তিনি তায়েফ অঞ্চল ও তায়েফবাসীর ভূ-খণ্ডের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন। তবে তাদের কতিপয় শর্ত এতটা অবমাননাকর ছিল যে, এর ফলে মহানবী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাদের একটি অযৌক্তিক শর্ত ছিল। তারা বলেছিল, তায়েফের জনগণ ঐ অবস্থায় তাওহীদী আদর্শ ও ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়বে যখন তায়েফের সবচেয়ে বড় প্রতিমালয় তিন বছরের জন্য এই একই অবস্থায় থাকবে এবং ঐ সময় ধরে সাকীফ গোত্রের প্রধান প্রতিমা লাত’-এর পূজা করতে দেয়া হবে। কিন্তু তারা মহানবীর ক্ষোভের সম্মুখীন হয়ে তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে পুনরায় আবেদন করল, তাদের প্রতিমালয় ও মন্দিরগুলো এক মাসের জন্য বহাল রাখতে হবে।

যে নবীর মৌলিক লক্ষ্যই হচ্ছে একত্ববাদের প্রসার, প্রতিমালয়ের ধ্বংসসাধন এবং মূর্তিসমূহ ভেঙে ফেলা, তাঁর কাছে এ ধরনের আবেদন পেশ করা ছিল সত্যিই লজ্জাকর। তাদের এ বক্তব্য থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়, তারা এমন এক ইসলাম চাচ্ছে যা তাদের স্বার্থ ও অভ্যন্তরীণ ঝোঁকসমূহের ওপর মোটেই আঘাত হানবে না; আর তা না হলে তারা এ ধরনের ইসলাম মোটেই চাচ্ছে না। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা তাদের আবেদনের অবমাননাকর দিকগুলো বুঝতে পেরে সাথে সাথে অজুহাত পেশ করে বলল : আমরা আমাদের গোত্রের বোকা মহিলা ও পুরুষদের মুখ বন্ধ করা এবং তায়েফ ভূ-খণ্ডে ইসলাম ধর্মের আগমনের পথে বিদ্যমান সব ধরনের বাধা অপসারণের জন্য এ ধরনের আবেদন জানিয়েছিলাম। মহানবী যখন এ ধরনের শর্তের ব্যাপারে সম্মত হচ্ছেন না, তখন তিনি যেন প্রতিমা ও মূর্তিগুলো নিজেদের হাতে ধ্বংস করা থেকে সাকীফ গোত্রের অধিবাসীদের অব্যাহতি দেন এবং অন্য ব্যক্তিদের তায়েফের মূর্তিগুলো ধ্বংস করার দায়িত্ব প্রদান করেন।” মহানবী এ শর্ত মেনে নেন। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এটাই ছিল যে, বাতিল উপাস্যগুলো যেন মানব জাতির মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়- হোক তা স্বয়ং তায়েফবাসীদের হাতে বা অন্য কোন ব্যক্তির হাতে।

তাদের দ্বিতীয় শর্ত ছিল মহানবী (সা.) যেন তাদের নামায পড়া থেকে অব্যাহতি দেন। তারা ভেবেছিল, মহানবী (সা.) আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নেতাদের মতো মহান আল্লাহর শরীয়ত পরিবর্তন করে দিতে পারেন অর্থাৎ একদলকে আইনের অধীন করতে পারেন এবং আরেক দলকে আইন পালন থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। অথচ তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থেকে গিয়েছিল যে, তিনি ইলাহী ওহীর অনুসারী এবং শরীয়তের বিধান সামান্য খড়-কুটো পরিমাণও কম-বেশি করতে পারেন না।

তাদের প্রদত্ত এ শর্ত থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায়, তখনও তাদের মধ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মনোবৃত্তি সৃষ্টি হয় নি এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি তাদের ঝোঁক এমন সব অবস্থার ফল ছিল, যা তাদেরকে বাহ্যত ইসলাম ধর্মের দিকে ধাবিত করেছিল; আর তা না হলে ইসলামের বিধানসমূহের ক্ষেত্রে বৈষম্যের পথ অবলম্বন অর্থাৎ কিছু বিধান পালন এবং অপর কিছু বিধান ত্যাগ করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। ইসলাম ও ঈমান (মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস) হচ্ছে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আত্মিক আত্মসমর্পণ, যার ছায়ায় মহান আল্লাহর যাবতীয় বিধান আগ্রহ সহকারে মেনে নেয়া ও পালন করা সম্ভব হয়। কেবল এ অবস্থায় ইলাহী বিধানসমূহ পালন করার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক চিন্তা ও আচরণ মানবাত্মা ও কল্পনার জগতে প্রবেশ করার পথ খুঁজে পাবে না।

মহানবী (সা.) তাদের এ শর্তের জবাবে বলেছিলেন :لا خير فِى دين لا صلاة معه অর্থাৎ যাতে নামায নেই, সে দীনে কোন কল্যাণ নেই।

যে মুসলমান রাত-দিনে নিজ স্রষ্টা ও প্রভুর সামনে বিনয়াবনত হয় না ও মাথা নত করে না এবং তাঁর কথা স্মরণ করে না, সে আসলে মুসলমানই নয়।

উভয় পক্ষ তাদের নিজ নিজ শর্তের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সমঝোতায় উপনীত হলে বেশ কিছু ধারা ও শর্ত সম্বলিত একখানা চুক্তিপত্র মহানবী (সা.) কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। মহানবী প্রতিনিধি দলকে বিদায় দিলেন যাতে তারা তাদের গোত্রের কাছে প্রত্যাবর্তন করে। (বিদায়ের প্রাক্কালে) ঐ ছয় সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে সবচেয়ে তরুণ ব্যক্তি, যিনি মদীনায় অবস্থানকালে পবিত্র কুরআন ও শরীয়তের বিধান শিক্ষা লাভে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, মহানবী তাঁকে (প্রতিনিধি দলের) প্রধান হিসেবে মনোনীত এবং তায়েফের সাকীফ গোত্রের মাঝে তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করলেন। আর সে সাথে নবনিযুক্ত প্রতিনিধিকে জামাআতে নামায পড়ানোর সময় দুর্বল ও অসুস্থ ব্যক্তিদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে নামায দীর্ঘায়িত না করার উপদেশ দিয়েছিলেন।

পরে মুগীরাহ্ ও আবু সুফিয়ান মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের সাথে তায়েফ গিয়ে সেখানকার প্রতিমা ও মূর্তিগুলো ধ্বংস করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। যে আবু সুফিয়ান আগের দিন পর্যন্ত মূর্তিগুলোর রক্ষক ছিল এবং সেগুলো সংরক্ষণ করার পথে রক্তবন্যা প্রবাহিত করেছিল, সে কুঠার নিয়ে তায়েফের মূর্তি ও প্রতিমাগুলো ভেঙে সেগুলোকে জ্বালানী কাঠের স্তূপে পরিণত করেছিল এবং প্রতিমাগুলোর অলংকার বিক্রি করে মহানবীর নির্দেশ মতো উরওয়াহ্ ও তাঁর ভাই আসওয়াদের সকল ঋণ পরিশোধ করেছিল।443

ছাপ্পান্নতম অধ্যায় : নবম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মিনা দিবসের ঘোষণাপত্র

হিজরতের নবম বর্ষের শেষের দিকে ওহীর ফেরেশতা সূরা তাওবার কয়েকখানা আয়াত নিয়ে এসে মহানবী (সা.)-কে দায়িত্ব প্রদান করলেন, তিনি যেন হজ্বের মৌসুমে 4 ধারা সম্বলিত ঘোষণাপত্র সহ এ আয়াতসমূহ পাঠ করার জন্য এক ব্যক্তিকে পবিত্র মক্কায় প্রেরণ করেন। এ সব আয়াতে মুশরিকদের যে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হয় এবং (চুক্তি সম্পাদনকারীরা যে সব চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে এবং কার্যত লঙ্ঘন করে নি, কেবল সে সব চুক্তি ব্যতীত) সকল চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয় এবং মুশরিক নেতারা ও তাদের অনুসারীদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়, চার মাসের মধ্যে তাওহীদী আদর্শে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমতের সাথে যেন নিজেদের সম্পর্ক ও দায়িত্বটা সুস্পষ্ট করে নেয় এবং তারা যদি এ চার মাস সময়সীমার মধ্যে শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ না করে, তা হলে তাদের থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হবে।

প্রাচ্যবিদরা যখনই ইসলামের ইতিহাসের এ পর্যায়ে উপনীত হন, তখনই তারা ইসলামের প্রতি তাদের তীক্ষ্ণ আক্রমণগুলো চালনা করতে থাকেন এবং (মুশরিকদের প্রতি ইসলাম ও মহানবীর) এ চূড়ান্ত কঠোর আচরণকে আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বিবেচনা করেন। তবে তারা যদি সব ধরনের গোঁড়ামি পরিহার করে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করতেন এবং এ বিষয়, যা সূরা তাওবা এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে বর্ণিত হয়েছে, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করতেন, তা হলে সম্ভবত তারা কম ভ্রান্তির শিকার হতেন এবং প্রত্যয়ন করতেন যে, এ পদক্ষেপ কখনই আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, যা বিশ্বের সকল বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সম্মানার্হ। এ ঘোষণাপত্র জারির মূল উদ্দেশ্যসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

1. জাহিলীয়াতের যুগে আরবদের প্রথা ছিল এই যে, পবিত্র কাবা তাওয়াফ ও যিয়ারতকারী প্রত্যেক ব্যক্তি যে পোশাক পরে কাবা তাওয়াফ করত, তা দরিদ্রকে দান করত এবং তার একটির বেশি পোশাক না থাকলে পোশাক ধার করে তা পরে তাওয়াফ করত, যাতে সে দরিদ্রকে তার পোশাক দান করতে বাধ্য না হয়। আর ধার করা সম্ভব না হলে তাকে পোশাকবিহীন অবস্থায় তাওয়াফ করতে হতো।

একদিন এক সুন্দরী মহিলা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলে তার একটির বেশি পোশাক না থাকায় তখনকার কুসংস্কারমূলক প্রথা অনুসারে সে বিবস্ত্র হয়ে তাওয়াফ করতে বাধ্য হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানে এ ধরনের তাওয়াফ, তাও আবার বিবস্ত্র হয়ে, কতই না মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে!

2. সূরা তাওবা অবতীর্ণ হওয়ার সময় মহানবী (সা.)-এর বে সাত অর্থাৎ নবুওয়াতের মাকামে আনুষ্ঠানিক সমুন্নতির পর থেকে বিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল এবং এ সময় আরব উপদ্বীপের মুশরিক ও মূর্তিপূজকদের কানে পৌত্তলিকতাবাদ ও মূর্তিপূজায় বাধাদান সংক্রান্ত ইসলামের শক্তিশালী যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ পৌঁছে গিয়েছিল; আর ঐ দিন পর্যন্ত মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী শিরক্, পৌত্তলিকতা ও মূর্তি পূজা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে জবরদস্তি করে থাকলে একমাত্র অন্ধ গোঁড়ামি ও আক্রোশ ছাড়া এর আর কোন কারণ ছিল না। এ কারণেই তখন সমাজ সংস্কারের জন্য সর্বশেষ ঔষধ প্রয়োগ তথা শক্তি ব্যবহার করে মূর্তিপূজা, শিরক ও পৌত্তলিকতার সকল রূপ ও নিদর্শন গুঁড়িয়ে ফেলা, এ মূর্তিপূজাকে মহান আল্লাহ্ ও মানুষের সমুদয় অধিকার লঙ্ঘন বলে গণ্য করা এবং এভাবে মানব সমাজে শত শত মন্দ প্রথার মূলোৎপাটনের সময় এসে গিয়েছিল।

তবে যে সব প্রাচ্যবিদ এ ধরনের পদক্ষেপকে আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যা পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও আধুনিক সভ্যতার মূল ভিত্ বলে গণ্য,- তার সাথে সাংঘর্ষিক ও পরিপন্থী বলে বিবেচনা করেন, তাঁরা একটি বিষয়ে অমনোযোগী থেকে গেছেন। কারণ আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে পর্যন্ত ব্যক্তি ও সমাজের সৌভাগ্যের ক্ষতি সাধন না করবে, সে পর্যন্ত তা সম্মানার্হ। এর অন্যথা হলে যুক্তি-বুদ্ধির আলোকে এবং বিশ্বের সকল চিন্তাশীল ব্যক্তির অনুসৃত রীতি অনুসারে এ ধরনের স্বাধীনতার শতকরা এক শ’ ভাগ অর্থাৎ পুরোপুরি বিরোধিতা করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে যাবে।

উদাহরণস্বরূপ , আজ ইউরোপে মুষ্টিমেয় ইন্দ্রিয়পরায়ণ যুবক কতকগুলো ভ্রান্ত চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে সমাজে নগ্নতাবাদের (Nudism)সমর্থক হয়ে যাচ্ছে এবং দেহের কিয়দংশ আবৃত করাই হচ্ছে ( যৌন কামনা - বাসনা কেন্দ্রিক ) উত্তেজনা এবং চারিত্রিক অবক্ষয় , দুর্নীতি অনাচারের মূল কারণ - ধরনের শতকরা এক ভাগ বালসুলভ যুক্তি ধারণার ভিত্তিতে গোপন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিবস্ত্র অবস্থায় আবির্ভূত হচ্ছে। সুস্থ মানব বিবেক মন কি অনুমতি দেয় যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার শিরোনামে এ সব তরুণদের হাত আমরা উন্মুক্ত রাখব এবং বলব যে, মতামত, চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বাসের প্রতি অবশ্যই সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, নাকি এ সব তরুণের ও সমাজের কল্যাণের জন্য আমাদের অবশ্যই এ ধরনের বোকামিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত? এটা শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসৃত পন্থাই নয়, বরং বিশ্বের সকল জ্ঞানী যে সব ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড মানব সমাজের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেন। আর এ সংগ্রাম আসলে অধঃপতিত দলগুলোর বোকামিপূর্ণ বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

মূর্তিপূজা কতকগুলো অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অলীক চিন্তা-ভাবনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। উল্লেখ্য, এ সব অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও অলীক চিন্তা-ভাবনা শত শত মন্দ অভ্যাস ও প্রথার প্রবর্তন করে। আর মহানবী (সা.) মূর্তিপূজক ও মুশরিকদের পথ প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন এবং বিশ বছর গত হবার পর এই ফ্যাসাদ ও অনাচারের মূলোৎপাটন করার জন্য সর্বশেষ মাধ্যম হিসেবে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার সময় হয়ে গিয়েছিল।

3. অপর দিকে হজ্ব হচ্ছে সর্ববৃহৎ ইসলামী ইবাদত, সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নিদর্শন। আর এ সূরা অবতীর্ণ হবার দিন পর্যন্ত শিরকের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে তিনি মুসলমানদের পবিত্র হজ্বের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান যথাযথভাবে ও সব ধরনের জাহিলী রীতি-নীতির বাইরে শিক্ষা দিতে পারেন নি। এ কারণে অত্যাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল যে, এ বিশাল ইসলামী জনসমাবেশে মহানবী (সা.) স্বয়ং অংশগ্রহণ করে ব্যবহারিকভাবে মুসলমানদের এ মহৎ ইবাদত অনুষ্ঠানের শিক্ষা দেবেন। তবে তিনি ঐ অবস্থায় কেবল এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন, যখন মহান আল্লাহর হারাম শরীফ এবং এর চারপাশের অঞ্চল মুশরিকদের- যারা ইবাদত-বন্দেগীর মাকাম কতকগুলো প্রস্তর ও কাঠের তৈরি মূর্তির কাছে সোপর্দ করেছিল,- থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে যাবে এবং মহান আল্লাহর হারাম তাঁর প্রকৃত বান্দা ও ইবাদতকারীদের জন্য একান্তভাবে নির্দিষ্ট হবে।

4. মহানবী (সা.)-এর সংগ্রাম বিশ্বাসের স্বাধীনতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। আকীদা-বিশ্বাস এমন এক বিষয় যা বলপ্রয়োগ করে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। আকীদা-বিশ্বাসের কেন্দ্র হচ্ছে মানুষের হৃদয়, যা অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এবং সহজে বশীভূত হয় না। আর আকীদা-বিশ্বাসের উদ্ভব কতকগুলো মূল ভিত ও পূর্ব পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল। এ সব মূল ভিত ও পূর্ব পদক্ষেপ আকীদা-বিশ্বাসের উৎপত্তির প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু মূল ভিত ও নীতিমালার অনুপস্থিতিতে আকীদা-বিশ্বাসের উদ্ভব একেবারে অসম্ভব। সুতরাং আকীদা-বিশ্বাস আসলে বল প্রয়োগের বিষয় নয়। বরং মহানবী (সা.)-এর সংগ্রাম ছিল এই শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের বাহ্য অবয়বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর মূর্তিপূজা ছিল এ শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের বাহ্য রূপ ও নিদর্শনস্বরূপ। এ কারণেই মহানবী (সা.) প্রতিমালয়গুলো ধ্বংস করেছিলেন এবং সকল প্রতিমা ও মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই তিনি আকীদা-বিশ্বাসের জগৎ ও হৃদয়গুলোর মধ্যেকার বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তনের বিষয়কে কালের আবর্তনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যা আপনাআপনি এ ধরনের বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন আনয়ন করবে।444

উল্লিখিত চার কারণের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) হযরত আবু বকরকে ডেকে এনে সূরা তাওবার প্রথম কয়েক আয়াত শিক্ষা দেন এবং চল্লিশ জন মুসলমানকে445 সাথে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা এবং যে সব আয়াতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা উল্লিখিত আছে, ঈদুল আযহার দিনে সেসব (মিনায় হাজীগণের সমাবেশে) পাঠ করার নির্দেশ দেন।

হযরত আবু বকর মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে সফরের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। এর কিছুক্ষণ পরই ওহীর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে (বিশেষ নির্দেশ সম্বলিত) এক বাণী (মহানবীর ওপর) অর্পণ করলেন। তা ছিল এই যে, মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি স্বয়ং মহানবী বা তাঁর আহলে বাইতভুক্ত কোন ব্যক্তিকে জনগণের কাছে ঘোষণা করতে হবে।446 এ কারণেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে ডেকে এনে পুরো বিষয়টি তাঁকে জানালেন ও তাঁর বিশেষ সওয়ারী পশুটি তাঁকে দিলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যত শীঘ্র সম্ভব মদীনা ত্যাগ করেন, যাতে তিনি পথিমধ্যে হযরত আবু বকরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর কাছ থেকে আয়াতসমূহ নিয়ে নেন এবং ঈদুল আযহার দিন মিনার বিশাল হজ্ব সমাবেশ, যেখানে আরব উপদ্বীপের সকল অঞ্চল থেকে জনগণ অংশগ্রহণ করবে, সেখানে একটি ঘোষণাপত্র সমেত মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত (সূরা তাওবার) আয়াতসমূহ পাঠ করেন।

এ ঘোষণাপত্রের ধারাসমূহ ছিল নিম্নরূপ :

ক. মহান আল্লাহর ঘরে (কাবা শরীফ) মূর্তিপূজকদের প্রবেশাধিকার নেই;

খ. উলঙ্গাবস্থায় তাওয়াফ নিষিদ্ধ;

গ. এরপর থেকে কোন মূর্তিপূজকই আর হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে না;

ঘ. যারা মহানবী (সা.)-এর সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল এবং পুরো সময় ধরে নিজেদের চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে (চুক্তি রক্ষা করেছে), তাদের চুক্তি এবং চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রাণ ও সম্পদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। তবে যে সব মুশরিক মুসলমানদের সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় নি বা কার্যত চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তাদেরকে এ তারিখ (10 যিলহজ্ব) থেকে 4 মাসের সময় দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা ইসলামী হুকুমতের সাথে তাদের অবস্থান ও দায়িত্ব স্পষ্ট করে নেয় অর্থাৎ হয় তারা তাওহীদপন্থীদের কাতারভুক্ত হবে এবং শিরক ও দ্বিত্ববাদের সকল নিদর্শন ও বহিঃপ্রকাশের ধ্বংসসাধন করবে অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।447

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) একটি কাফেলাকে সাথে নিয়ে মহানবীর বিশেষ সওয়ারী পশুর উপর আরোহণ করে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ কাফেলায় জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারীও ছিলেন। জুহ্ফাহ্’ নামক স্থানে হযরত আলী (আ.) হযরত আবু বকরের সাথে মিলিত হয়ে মহানবী (সা.)-এর বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে দিলেন; আর তিনিও হযরত আলীর কাছে আয়াতসমূহ হস্তান্তর করলেন।

শিয়া মুহাদ্দিসগণ এবং কতিপয় সুন্নী মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী (আ.) বললেন: মহানবী (সা.) আপনাকে আমার সাথে মক্কা গমন বা এখান থেকে মদীনায় ফিরে যাবার ব্যাপারে ইখতিয়ার দিয়েছেন।” হযরত আবু বকর মক্কাভিমুখে যাত্রা অব্যাহত রাখার চেয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকে অগ্রাধিকার দিলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন : আপনি আমাকে এমন এক কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন, যা সম্পন্ন করার জন্য অন্যরাও আগ্রহী ছিল এবং সবাই মনে মনে তা সম্পন্ন করার গৌরব অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করত। যখন আমি খানিকটা পথ অতিক্রম করেছি, তখনই আপনি আমাকে এ দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছেন। তা হলে কি আমার ব্যাপারে মহান আল্লাহর ওহী অবতীর্ণ হয়েছে? মহানবী (সা.) তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন : হযরত জিবরীল (আ.) এসে আমার কাছে মহান আল্লাহর নির্দেশবাণী পৌঁছে দিয়ে বলেছেন : আমি এবং যে ব্যক্তি আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত, সে ব্যতীত আর কেউ এ কাজ সম্পন্ন করার যোগ্য নয়।”448 তবে আহলে সুন্নাত বর্ণিত কতিপয় রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ্ব অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দায়িত্ব হযরত আবু বকরের উপর ন্যস্ত ছিল এবং হযরত আলী (আ.) কেবল মিনা দিবসে জনসমক্ষে মহানবীর ঘোষণাপত্র এবং (মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের) আয়াতসমূহ পাঠ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।449

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন। 10 যিলহজ্ব তিনি জামরা-ই-আকাবার উপর দাঁড়িয়ে সূরা তাওবার প্রথম 13 আয়াত পাঠ করলেন। এরপর তিনি দৃঢ় মনোবল সহকারে উচ্চকণ্ঠে মহানবীর ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন, যেন তা সবাই শুনতে পায়। মুসলমানদের সাথে যেসব মুশরিকের কোন চুক্তি ছিল না, তিনি তাদের সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে, তাদেরকে কেবল চার মাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের উচিত নিজেদের আবাসস্থল ও চারপাশের পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিরক ও মূর্তিপূজার সকল নিদর্শন থেকে মুক্ত ও পবিত্র করা। এর অন্যথা হলে তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা উঠিয়ে নেয়া হবে।

এ সব আয়াত ও এ ঘোষণাপত্রের ফলাফল এই হয়েছিল যে, চার মাস অতিবাহিত হতে না হতেই মুশরিক ও মূর্তিপূজকরা দলে দলে একত্ববাদ অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং হিজরতের দশম বর্ষের মাঝামাঝিতে সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে মূর্তিপূজা মূলোৎপাটিত হয়ে যায়।