চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79219
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79219 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মহানবী (সা.)-এর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র

আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে বনী আমের গোত্রের নেতারা ঔদ্ধত্য এবং অপকর্ম ও দুর্বৃত্তপনার জন্য কুখ্যাত ছিল।। তাদের মধ্যে আমীর, আরবাদ ও জাব্বার নামের তিন ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, তারা বনী আমের গোত্রের একটি প্রতিনিধি দলের প্রধান হয়ে মদীনা গিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে আলোচনাসভায় মিলিত হবে এবং তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করবে। হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল এরূপ : আমীর মহানবীর সাথে আলোচনায় রত হবে এবং সে যখন মহানবীর সাথে আলোচনায় মশগুল থাকবে, তখন আরবাদ তরবারীর আঘাতে মহানবীকে হত্যা করবে।

প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্য এ তিনজনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল ছিলেন না এবং তাঁদের সবাই ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি তাঁদের বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য ব্যক্ত করেন। কিন্তু আমীর মহানবী (সা.)-এর সামনে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং মহানবীকে অনবরত বলছিল : নির্জনে আপনার সাথে আমাকে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। এ কথা বলার পর সে আরবাদের দিকে তাকায়। কিন্তু সে যতই তার চেহারার দিকে তাকাচ্ছিল, ততই সে তাকে শান্ত দেখতে পাচ্ছিল। মহানবী (সা.) তাকে বললেন, সে যতক্ষণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা (নির্জনে আলোচনা) সম্ভব হবে না। যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, তা আরবাদের পক্ষ থেকে বাস্তবায়িত হবার ব্যাপারে অবশেষে আমীর নিরাশ হয়ে গেল। আরবাদ যখনই তরবারি হাতে নিয়ে মহানবী (সা.)-কে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছিল, ঠিক তখনই যেন মহানবীর মহান ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য ও মর্যাদাজনিত ভীতি তাকে তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখছিল। আলোচনার শেষে আমীর তার স্থান থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং মহানবীর বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শন করে বলল : আমি আপনার বিরুদ্ধে অশ্ব ও সৈন্য দিয়ে মদীনা নগরী ভরে ফেলব।” মহানবী যে বিশেষ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অধিকারী ছিলেন, সে কারণে তার কথার উত্তর দিলেন না এবং মহান আল্লাহর কাছে এ দু ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। তাঁর দুআয় সাড়া দান করা হলো। আমীর পথিমধ্যে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে বনী সালূল গোত্রের এক মহিলার ঘরে শোচনীয় অবস্থায় প্রাণত্যাগ করে এবং আরবাদও মরু-প্রান্তরে বজ্রপাতে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মহানবীর শত্রুদের ভাগ্যে যে এ দুই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, সে কারণে বনী আমের গোত্রের লোকদের অন্তরে ঈমানের বন্ধন মজবুত হয়েছিল।500

ইয়েমেনে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)

হিজাযের অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণ এবং আরব গোত্রগুলোর পক্ষ থেকে মহানবী (সা.) যে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়েছিলেন, সে কারণে হিজাযের প্রতিবেশী দেশগুলোয় ইসলাম ধর্মের শক্তি ও ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত করার সুবর্ণ সুযোগ এসে যায়। মহানবী প্রথম বারের মতো তাঁর এক জ্ঞানী সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেনের অধিবাসীদের কাছে তাওহীদের আহবান এবং ইসলাম ধর্মের নীতিমালা ব্যাখ্যা করার জন্য সে দেশে প্রেরণ করেন। তিনি মুয়াযের প্রতি প্রদত্ত দীর্ঘ নির্দেশমালায় বলেছিলেন :

“কঠোরতা অবলম্বন থেকে বিরত থাকবে। মুমিনদের জন্য খোদায়ী শুভ সংবাদ জনগণকে প্রদান করবে। ইয়েমেনে আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে : বেহেশতের চাবি কী? তখন তুমি তাদেরকে উত্তর দেবে : মহান আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বের স্বীকারোক্তি।”

পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্ সংক্রান্ত জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য থাকা সত্বেও স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের পর্যাপ্ত জবাব মুয়ায দিতে পারেন নি501 বিধায় মহানবী (সা.) তাঁর আদর্শের শ্রেষ্ঠ অনুসারী আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে ইয়েমেনে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তিনি নিরবচ্ছিন্ন প্রচার কার্যক্রম, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য, দৈহিক ক্ষমতা এবং অতুলনীয় সাহস ও ঔদার্য দ্বারা সে দেশে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে সক্ষম হন।

এছাড়াও খালিদ ইবনে ওয়ালীদ হযরত আলী (আ.)-এর কিছু দিন আগে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন502 যাতে তিনি ইয়েমেনে ইসলাম প্রসারের পথে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসন করেন। কিন্তু তিনিও এ সময়ের মধ্যে কোন কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হন নি। এ কারণেই মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে ডেকে পাঠান এবং বলেন : তোমাকে ইয়েমেনে প্রেরণ করব, যাতে তুমি ইয়েমেনবাসীদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান কর এবং তাদের কাছে মহান আল্লাহর বিধি-বিধান অর্থাৎ তাঁর হালাল ও হারামের বিধান বর্ণনা কর; আর মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে নাজরানের অধিবাসীদের সম্পদের যাকাত এবং সেখানকার অধিবাসীদের প্রদেয় কর উসূল করে বাইতুল মালে পৌঁছে দেবে।”

হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাছে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আরয করলেন : আমি একজন যুবক; আমি আমার জীবনে এ পর্যন্ত বিচারকাজ করি নি এবং বিচারকের আসনে বসি নি।” মহানবী তাঁর বুকের উপর হাত রেখে তাঁর ব্যাপারে দুআ করলেন : হে ইলাহী! আলীর অন্তঃকরণকে হিদায়েত (পরিচালনা) করুন এবং তাঁর জিহ্বাকে স্খলন থেকে হেফাযত করুন।” এরপর তিনি বললেন, আলী! কারো সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়ো না। জনগণকে যুক্তি ও সদ্ব্যবহারের দ্বারা সত্য পথে পরিচালিত করো। মহান আল্লাহর শপথ! মহান আল্লাহ্ যদি তোমার মাধ্যমে কাউকে সত্য পথে পরিচালিত করেন, তা হলে তা যা কিছুর উপর সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে উত্তম।”

শেষে তিনি হযরত আলীকে উপদেশ প্রদান করলেন :

“দুআকে নিজের পেশায় (ধ্যান-ধারণা) পরিণত করবে; কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুআয় সাড়া দেয়া হয়। সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। কারণ কৃতজ্ঞতা নেয়ামত বৃদ্ধির কারণ। যদি কারো সাথে বা কোন গোষ্ঠীর সাথে চুক্তি করো, তা হলে সে চুক্তির প্রতি সম্মান করবে এবং ষড়যন্ত্র করা ও জনগণকে ধোঁকা দেয়া থেকে বিরত থাকবে। কারণ অসৎকর্ম সম্পাদনকারীদের ষড়যন্ত্র নিজেদের দিকেই ফিরে আসে।”

হযরত আলী (আ.) ইয়েমেনে অবস্থান কালে অনেক বিস্ময়কর বিচারকাজ সম্পাদন করেছিলেন, যেসবের বিবরণ ইতিহাস ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান।

মহানবী (সা.) এ পরিমাণ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেই ক্ষান্ত হন নি, বরং তিনি ইয়েমেনবাসীর উদ্দেশেও একটি পত্র লিখেছিলেন। ঐ পত্রে তিনি ইয়েমেনের অধিবাসীদের তাওহীদী আদর্শের দিকে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি পত্রখানা হযরত আলী (আ.)-কে দিয়েছিলেন এবং তাঁকে এ পত্র ইয়েমেনবাসীর উদ্দেশে পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বাররা বিন আযিব, যিনি হযরত আলী (আ.)-এর সাথে সর্বদা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, বলেন : হযরত আলী (আ.) যখন ইয়েমেনের প্রথম সীমান্ত অঞ্চলে এসে পৌঁছান, তখন খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে যে সব মুসলিম সৈন্য আগে থেকে সেখানে মোতায়েন ছিল, তাদেরকে পুনঃসজ্জিত করে তাদের নিয়ে ফজরের নামায জামাআতে আদায় করেন। এরপর তিনি ইয়েমেনের সর্ববৃহৎ গোত্র বনী হামদানের সবাইকে একত্রিত করে তাদেরকে মহানবী (সা.)-এর বাণী শ্রবণ করার আহবান জানান। তিনি মহানবীর বাণী পাঠ করার আগে মহান আল্লাহর প্রশংসা করেন। এরপর তিনি মহানবীর বাণী তাদের পাঠ করে শুনান। সভার ভাবগাম্ভীর্য, ভাষার সৌন্দর্য এবং মহানবী (সা.)-এর বাণীর মহত্ব বনী হামদান গোত্রকে এতটা মোহিত ও প্রভাবিত করেছিল যে, সবাই একদিনের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) পুরো ঘটনা মহানবী (সা.)-কে পত্রে অবহিত করেন। মহানবীও এ ব্যাপারে অবগত হয়ে এতটা আনন্দিত হন যে, তিনি সিজদা করার জন্য মাটিতে মাথা রেখে মহান আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং সিজদা থেকে মাথা উঠিয়ে বলেন : বনী হামদান গোত্রের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। কারণ এ গোত্রের দীন ইসলাম গ্রহণ করার কারণে ধীরে ধীরে ইয়েমেনের সকল অধিবাসী ইসলাম ধর্মে বাইআত হবে। 503

একষট্টিতম অধ্যায় : দশম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বিদায় হজ্ব

ইসলামের সামষ্টিক ইবাদতসমূহের মধ্যে হজ্ব বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মহতী ও আড়ম্বরপূর্ণ ইবাদত, যা (প্রতি বছর) মুসলমানরা পালন করে থাকেন। কারণ মহতী এ অনুষ্ঠান, যা বছরে একবার পালন করা হয়, আসলে মুসলিম উম্মাহর জন্য ঐক্যের সর্ববৃহৎ বহিঃপ্রকাশ, ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদার মোহ থেকে মুক্ত হবার পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন, মানব জাতির সাম্যের বাস্তব নমুনা এবং মুসলমানদের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক দৃঢ়ীকরণের মাধ্যম...। এখন আমরা মুসলমানরা যদি বিস্তৃত এ ইলাহী দস্তরখান অর্থাৎ হজ্ব অনুষ্ঠান থেকে স্বল্প লাভ গ্রহণ করি এবং বার্ষিক এই ইসলামী মহাসমাবেশ- যা আসলেই আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনার উৎস হতে পারে,- যদি পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা ছাড়া উদযাপিত হয়, তা হলে তা ইসলামী আইন ও শরীয়তের অপূর্ণাঙ্গতার নির্দেশক তো হবেই না, বরং তা মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের দোষ-ত্রুটি নির্দেশক বলেই গণ্য হবে, যারা এ ধরনের মহতী অনুষ্ঠানের সদ্ব্যবহার করতে অক্ষম।

যেদিন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ (আ.) পবিত্র কাবার ভিত্তি পুনঃনির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে মহান আল্লাহর বান্দাদেরকে এ ঘর যিয়ারত করার আহবান জানিয়েছিলেন, সেদিন থেকে এ অঞ্চল সকল আস্তিক জাতির অন্তরসমূহের কাবা ও তাওয়াফের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যায়। প্রতি বছর পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ ঘর যিয়ারত করার জন্য ছুটে আসে এবং যে আচার-অনুষ্ঠান হযরত ইবরাহীম (আ.) শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা সম্পন্ন করে।

কিন্তু কালক্রমে মহান নবীগণের নেতৃত্ব-ধারা থেকে হিজাযবাসী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কুরাইশদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং সমগ্র আরব বিশ্বের চিন্তাজগতের ওপর প্রতিমাগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে হজ্বের আচার-অনুষ্ঠানও স্থান-কালের দৃষ্টিকোণ থেকে বিকৃত হয়ে যায় এবং সত্যিকার খোদায়ী রূপ হারিয়ে ফেলে।

এ সব কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের দশম বর্ষে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন যে, তিনি নিজে ঐ বছর হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহকে ব্যবহারিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পরিচিত করাবেন এবং উপরিউক্ত কারণসমূহের জন্য এ হজ্বকে কেন্দ্র করে যে সব বিকৃতির উদ্ভব ঘটেছিল, সেগুলোর মূলোৎপাটন করবেন এবং জনগণকে আরাফাত ও মিনার সীমানা এবং ঐসব স্থান থেকে বের হবার সঠিক সময়ও শিখিয়ে দেবেন।

মহানবী (সা.) ইসলামী বর্ষপঞ্জীর একাদশ মাস অর্থাৎ যিলক্বদ মাসে নির্দেশ জারী করেন, তিনি ঐ বছর মহান আল্লাহর ঘর (কাবা শরীফ) যিয়ারত করতে যাবেন। এ ঘোষণা মুসলমানদের এক বিরাট অংশের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মদীনার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করে মহানবীর হজ্ব যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।504

মহানবী (সা.) 26 যিলক্বদে আবু দুজানাকে মদীনায় নিজের স্থলবর্তী নিযুক্ত করে 60টি কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি যূল হুলাইফায়505 পৌঁছে দু টি সেলাইবিহীন বস্ত্র পরে মসজিদে শাজারাহ্’ থেকে ইহরাম করেন এবং ইহরাম করার সময় হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আহবানে সাড়া দানস্বরূপ প্রসিদ্ধ দুআ,506 লাব্বাইকা (لبّيك ) আবৃত্তি করেন। আর যখনই তিনি কোন বহনকারী পশু (সওয়ারী) দেখতে পেয়েছেন বা উঁচু বা নীচু স্থানে উপনীত হয়েছেন, তখনই তিনি লাব্বাইকা বলেছেন। তিনি পবিত্র মক্কার নিকটবর্তী হয়ে লাব্বাইকা উচ্চারণ বন্ধ করে দেন। 4 যিলহজ্ব তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন এবং সরাসরি মসজিদুল হারামের পথ ধরে এগিয়ে যান। তিনি বনী শাইবার ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। ঐ অবস্থায় তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করছিলেন এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ওপর দরূদ পাঠাচ্ছিলেন।

তাওয়াফের সময় তিনি হাজরে আসওয়াদের (কালো পাথর) মুখোমুখি হলে প্রথমে একে স্পর্শ করেন507 এবং এর উপর হাত বুলান এবং পবিত্র কাবা সাত বার প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করেন। এরপর তিনি তাওয়াফের নামায আদায়ের জন্য মাকাম-ই ইবরাহীমের পশ্চাতে গিয়ে দু রাকাআত নামায আদায় করেন। তিনি নামায সমাপ্ত করে সাফা-মারওয়ার508 মাঝখানে সাঈ শুরু করেন। অতঃপর তিনি হাজীদের উদ্দেশে বলেন :

“যারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু আনে নি, তারা ইহরাম ত্যাগ করবে এবং তাকসীর (অর্থাৎ চুল ছাটা বা নখ কাটা) করার মাধ্যমে তাদের জন্য ইহরামকালীন হারাম হয়ে যাওয়া বিষয়গুলো হালাল হয়ে যাবে। তবে আমি এবং যারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু এনেছে, তারা অবশ্যই ইহরামের অবস্থায় থাকবে ঐ সময় পর্যন্ত, যখন তাদের কুরবানীর পশুগুলোকে তারা কুরবানী করবে।”

মহানবী (সা.)-এর এ কথা একদল লোকের কাছে খুব অসহনীয় বলে মনে হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল : মহানবী (সা.) ইহরামের অবস্থায় থাকবেন, আর আমরা ইহরামমুক্ত থাকব- এ অবস্থাটা আমাদের কাছে কখনই প্রীতিকর লাগবে না।

কখনো কখনো তারা বলছিল : এটা ঠিক নয় যে, আমরা বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারীদের অন্তর্ভুক্ত হব, অথচ আমাদের মাথা ও ঘাড় থেকে গোসলের পানি ঝরতে থাকবে।”509

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি তখনও ইহরামের অবস্থায় থাকা হযরত উমরের উপর পড়ে। তিনি হযরত উমরকে বললেন : তুমি কি তোমার সাথে কুরবানীর পশু এনেছ? তিনি জবাবে বললেন : না। মহানবী তাঁকে বললেন : তা হলে কেন তুমি ইহরামমুক্ত হও নি? তখন হযরত উমর বললেন : আমার কাছে এটা প্রীতিকর বোধ হচ্ছে না যে, আমি ইহরামমুক্ত থাকব, আর আপনি ইহরাম অবস্থায় থাকবেন।” মহানবী তাঁকে বললেন : তুমি কেবল বর্তমানে নয়, বরং সব সময় এ বিশ্বাসের ওপরই থাকবে।”

মহানবী (সা.) জনগণের সন্দেহ ও দ্বিধা দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন :

لو كنت استقبلت من أمرى ما استدبرت لفعلت كما أمرتكم

“ভবিষ্যৎ যদি আমার কাছে অতীতের মতো স্পষ্ট হতো এবং তোমাদের দ্বিধা সম্পর্কে আমি জানতাম, তা হলে আমিও তোমাদের মতো কুরবানীর পশু নিজের সাথে না এনে মহান আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে আসতাম। তবে কী করব? কুরবানীর পশু নিজের সাথে নিয়ে এসেছি। কুরবানীর পশু তার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত (حتى يبلغ الهدى محلّه ) -মহান আল্লাহর এ বিধান অনুসারে মিনার দিবসে (10 যিলহজ্ব) কুরবানী দেয়ার স্থানে আমার কুরবানীর পশু যবেহ করা পর্যন্ত আমাকে অবশ্যই ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে। তবে যে ব্যক্তি নিজের সাথে কুরবানীর পশু আনে নি, তাকে অবশ্যই ইহরামমুক্ত হতে হবে এবং সে যা আঞ্জাম দিয়েছে, তা উমরাহ্’ বলে গণ্য হবে এবং পরে হজ্বের জন্য তাকে ইহরাম করতে হবে।”510

ইয়েমেন থেকে হযরত আলী (আ.)-এর প্রত্যাবর্তন

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) পবিত্র হজ্বে যোগদান করার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.)-এর রওয়ানা হবার ব্যাপারে অবগত হলেন এবং তিনিও 42টি কুরবানীর পশু এবং নিজ সৈন্যদেরকে সাথে নিয়ে হজ্বে অংশগ্রহণের জন্য (ইয়েমেন থেকে) যাত্রা শুরু করেন। তিনি নাজরানবাসীর কাছ থেকে ইসলামী কর (জিযিয়া) হিসেবে যে সব বস্ত্র উসূল করেছিলেন, সেগুলোও সাথে নিলেন। হযরত আলী তাঁর অধীন এক সামরিক অফিসারের হাতে সৈন্যদের নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব অর্পণ করে পবিত্র মক্কা নগরীর দিকে দ্রুত যাত্রা করে মহানবী সকাশে উপস্থিত হন। মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে দেখে খুব খুশী হন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন : তুমি (হজ্বের জন্য) কেমন নিয়্যত করেছ? তিনি জবাবে বলেন : আমি ইহরাম করার সময় আপনি যে নিয়্যতে ইহরাম করেছেন, সেই নিয়্যত করেছি এবং আমি বলেছি :اللهم إهلالا كإهلال نبيّك -হে আল্লাহ! যে নিয়্যত করে আপনার নবী ইহরাম বেঁধেছেন, আমিও সেই নিয়্যতে ইহরাম বাঁধলাম। 511 এরপর তিনি কুরবানী করার জন্য যে সব পশু নিজের সাথে এনেছিলেন, মহানবী (সা.)-কে সেগুলো সম্পর্কে অবহিত করেন। মহানবী (সা.) তখন বললেন : এ ক্ষেত্রে আমার ও তোমার শরীয়তগত দায়িত্ব একই এবং কুরবানীর পশুগুলো কুরবানী করা পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে।” এরপর মহানবী হযরত আলীকে তাঁর সৈন্যদের কাছে প্রত্যাবর্তন করে তাদেরকে পবিত্র মক্কায় নিয়ে আসার আদেশ দেন।

হযরত আলী (আ.) তাঁর সৈন্যদের কাছে ফিরে গিয়ে দেখতে পেলেন, নাজরানবাসীর কাছ থেকে মুবাহালা দিবসে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে যে সব বস্ত্র উসূল করা হয়েছিল, তা সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে এবং সবাই ঐসব বস্ত্র ইহরামের পোশাক হিসেবে পরিধান করেছে। আলী (আ.)-এর স্থলবর্তী ব্যক্তি তাঁর অনুপস্থিতিতে এ কাজ করায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং তাকে বলেছিলেন : মহানবী (সা.)-এর হাতে বস্ত্রগুলো অর্পণ করার আগেই কেন তুমি সৈন্যদের মধ্যে সেগুলো বিতরণ করেছ? তখন সে বলেছিল : তারা চাপ দিচ্ছিল যেন আমি আমানতস্বরূপ তাদেরকে বস্ত্রগুলো প্রদান করি এবং হজ্বের পর তাদের কাছ থেকে সেগুলো ফেরত নিই।” আলী (আ.) তাকে বললেন : তোমাকে এ ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হয় নি।” অতঃপর তিনি তাদের কাছ থেকে সব বস্ত্র সংগ্রহ করে সেগুলো গাঁট বেঁধে রেখে দিলেন এবং পবিত্র মক্কায় পৌঁছে তিনি মহানবীর কাছে সেগুলো হস্তান্তর করলেন।

একদল লোক, যাদের পক্ষে সব সময় ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা মেনে চলা কষ্টকর ছিল এবং যারা চাইত, সব সময় তাদের ইচ্ছানুসারে সব কিছু হোক, তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে হযরত আলী (আ.) কর্তৃক বস্ত্রসমূহ ফেরত দেয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে নিজেদের অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছিল।

মহানবী (সা.) তাঁর একজন সাহাবীকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন অভিযোগকারীদের মাঝে গিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দেন :

ارفعوا ألسنتكم عن علىّ فإنّه خَشِنٌ فِى ذاتِ الله غير مداهنٍ فِى دينه

“আলীর ব্যাপারে কটূক্তি করা থেকে তোমরা হাত উঠিয়ে নাও। কারণ সে মহান আল্লাহর বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে কঠোর ও নির্ভীক এবং ধর্মের ব্যাপারে চাটুকারিতা পছন্দ করে না। 512

হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

উমরার আমলসমূহ সমাপ্ত হয়। উমরা ও হজ্বের আমলসমূহ শুরু হওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সময় কারো কাবায় (মসজিদুল হারাম ও মক্কা নগরীতে) অবস্থান করার ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্মত ছিলেন না। তাই তিনি মক্কার বাইরে তাঁর তাঁবু স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন।

8 যিলহজ্ব বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারীগণ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করেন, যাতে তাঁরা 9 যিলহজ্ব দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান (উকূফ) করতে পারেন। মহানবী (সা.) তারবীয়ার দিবসে (8 যিলহজ্ব) মিনার পথে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাত্রা করেন এবং 9 যিলহজ্বের সূর্যোদয় পর্যন্ত তিনি মিনায় অবস্থান করেন। এরপর তিনি নিজ উটের উপর সওয়ার হয়ে আরাফাতের পথে অগ্রসর হন এবং নামিরাহ্’-এ অবতরণ করেন। উল্লেখ্য, এ স্থানেই মহানবী (সা.)-এর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিল। ঐ মহতী মহাসমাবেশে মহানবী (সা.) উটের পিঠে আসীন অবস্থায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। আর এ ঐতিহাসিক ভাষণই বিদায় হজ্বের ভাষণ’ নামে খ্যাতি লাভ করে।