চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84017 / ডাউনলোড: 7998
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

বিদায় হজ্বে মহানবী (সা.)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ

ঐদিন আরাফাতের ময়দানে এক মহতী মর্যাদপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হিজাযের অধিবাসীরা সে দিন পর্যন্ত এমন সমাবেশ কখনো প্রত্যক্ষ করে নি। একত্ববাদের ধ্বনি ও আহবান আরাফাতের ময়দানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এই আরাফাতের ময়দানে মাত্র ক’দিন আগেও মুশরিক ও পৌত্তলিকদের অবস্থানস্থল ও ঘাঁটি ছিল। এখন চিরতরে তা তাওহীদপন্থী ও মহান এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতকারীদের মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। মহানবী (সা.) আরাফাতের ময়দানে এক লক্ষ মানুষের সাথে যুহর ও আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে ঐ দিন (৯ যিলহজ্ব ১০ হি.) তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও উচ্চকণ্ঠের অধিকারী তাঁর এক সাহাবী তাঁর ভাষণ পুনরাবৃত্তি করে দূরবর্তী লোকদের কর্ণগোচর করেছিলেন।

মহানবী (সা.) এভাবে তাঁর ভাষণ শুরু করেন :

“হে লোকসকল! তোমরা আমার কথা শ্রবণ কর। সম্ভবত এরপর তোমাদের সাথে এ স্থানে আমার আর সাক্ষাৎ হবে না। হে লোকসকল! তোমাদের ধন-সম্পদসমূহ৫১৩ , যেদিন তোমরা মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ করবে, সেদিন পর্যন্ত আজকের এ দিন এবং এ মাসের ন্যায় সম্মানিত এবং এগুলোর ওপর যে কোন ধরনের আগ্রাসন ও সীমা লঙ্ঘন হারাম হবে।”

মহানবী (সা.) মুসলমানদের জান-মালের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার ব্যাপারে তাঁর বাণী (জনগণের অন্তরে) বদ্ধমূল হওয়া এবং এর গভীর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য রবীয়াহ্ ইবনে উমাইয়্যাকে বললেন : তাদের কাছে এ কয়েকটি বিষয় জিজ্ঞেস কর এবং বল, এটি কোন মাস? তখন সবাই বলেছিলেন : এটি হারাম মাস। এ মাসে যুদ্ধ ও রক্তপাত নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) রবীয়াহকে বললেন : তাদেরকে বল : যেদিন তোমরা এ জগৎ থেকে বিদায় নেবে, সেদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ্ তোমাদের ধন-সম্পদ তোমাদের একে অপরের জন্য হারাম এবং (তোমাদের পরস্পরের নিকট) সম্মানিত করে দিয়েছেন।”

তিনি পুনরায় নির্দেশ দিলেন : তাদেরকে আবার জিজ্ঞেস কর : এ স্থান কেমন? তখন সবাই বলেছিলেন : এ হচ্ছে সম্মানিত স্থান এবং এখানে রক্তপাত ও সীমা লঙ্ঘন নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) (রবীয়াহকে) বললেন : তাদেরকে জানিয়ে দাও, তোমাদের রক্ত (প্রাণ) ও ধন-সম্পদ এ স্থান ও অঞ্চলের মতো সম্মানিত এবং এগুলোর ওপর যে কোন ধরনের আগ্রাসন ও সীমা লঙ্ঘন নিষিদ্ধ।” মহানবী (সা.) পুনরায় আদেশ দিলেন : তাদেরকে প্রশ্ন কর : আজ কোন্ দিবস? তাঁরা বললেন : আজ হজ্ব-ই-আকবার (বড় হজ্জ্বের) দিবস।” তিনি নির্দেশ দিলেন : তাদেরকে জানিয়ে দাও, আজকের মতো অর্থাৎ এ দিবসের ন্যায় তোমাদের রক্ত এবং ধন-সম্পদ সম্মানিত। ৫১৪

“হে জনতা! তোমরা জেনে রাখ, জাহিলীয়াতের যুগে যে সব রক্ত ঝরানো হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই ভুলে যেতে হবে এবং সেগুলোর ব্যাপারে প্রতিশোধ গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি ইবনে রবীয়ার (মহানবীর এক আত্মীয়) রক্তও (রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি) ভুলে যেতে হবে।

তোমরা শীঘ্রই মহান আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। ঐ জগতে তোমাদের ভাল ও মন্দ কাজগুলোর বিচার করা হবে। আমি তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি, যার কাছে কোন আমানত থাকে, তার উচিত অবশ্যই তা প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত দেয়া।

হে জনতা! তোমরা জেনে রাখ, ইসলাম ধর্মে সুদ হারাম। যারা নিজেদের ধন-সম্পদ সুদ অর্জন করার পথে ব্যবহার করে, তারা কেবল তাদের মূলধন ফেরত নিতে পারবে। না তারা অত্যাচার করবে, না তারা অত্যাচারিত হবে। যে লাভ (সুদ) আব্বাস ইসলামের আগে ঋণীদের কাছে তলব করত, তা এখন বাতিল এবং তা তলব করার অধিকার তার নেই।

হে লোকসকল! যেহেতু শয়তান তোমাদের ভূ-খণ্ডে আর পূজিত হবে না, সেহেতু সে এখন নিরাশ হয়ে গেছে। তবে তোমরা যদি ছোট ছোট বিষয়ে শয়তানের অনুসরণ কর, তা হলে সে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। তাই তোমরা সে শয়তানের অনুসরণ করো না। হারাম মাসসমূহে পরিবর্তন৫১৫ আনয়ন চরম পর্যায়ের কুফর, খোদাদ্রোহিতা ও অবিশ্বাস থেকে উৎসারিত। আর যে সব কাফির ব্যক্তি হারাম মাসসমূহের সাথে অপরিচিত, তারা এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে পথভ্রষ্ট হয়। আর এ ধরনের পরিবর্তন আনার ফলে হারাম মাস এক বছর হালাল মাসে এবং অন্য এক বছর তা হারাম মাস হয়ে যাবে। তাদের জানা উচিত, এ ধরনের কাজের দ্বারা তারা মহান আল্লাহর হারাম বিষয়কে হালাল এবং মহান আল্লাহর হালাল বিষয়কে হারাম করে দেয়।

অবশ্যই হালাল ও হারাম মাসসমূহ ঐ দিনের মতো হওয়া বাঞ্ছনীয়, যে দিন মহান আল্লাহ্ আকাশ, পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য সৃষ্টি করেছিলেন। মহান আল্লাহর কাছে মাসসমূহের সংখ্যা বারো। এ বারো মাসের মধ্যে চার মাসকে মহান আল্লাহ্ হারাম করেছেন। এ চার মাস হচ্ছে যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মুহররম এবং রজব। যিলক্বদ, যিলহজ্ব ও মুহররম- এ তিন মাস একের পর এক আগমন করে।

হে লোকসকল! তোমাদের ওপর তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার আছে। আর তাদের ওপরও তোমাদের অধিকার আছে। তোমাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তোমাদের অনুমতি ও সম্মতি ব্যতীত তারা (তোমাদের) ঘরে কাউকে বরণ ও আপ্যায়ন করবে না এবং কোন পাপ করবে না। এর অন্যথা হলে মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাদের সাথে এক শয্যায় শয়ন ত্যাগ এবং তাদের শাসন করার অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি তারা সঠিক পথে প্রত্যাবর্তন করে, তা হলে তাদের ওপর তোমাদের স্নেহ ও ভালোবাসার ছায়া প্রসারিত করবে এবং প্রাচুর্য সহকারে তাদের জীবন-যাপনের যাবতীয় উপকরণের আয়োজন করবে।

আমি এ স্থানে তোমাদের নিজ স্ত্রীদের প্রতি কল্যাণ ও সদাচরণের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ তারা তোমাদের হাতে মহান আল্লাহর আমানতস্বরূপ এবং মহান আল্লাহর বিধানসমূহের দ্বারা তারা তোমাদের ওপর হালাল হয়েছে।

হে লোকসকল! তোমরা আমার কথাগুলোয় মনোযোগ দাও এবং এগুলোর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা কর। আমি তোমাদের মাঝে দু টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা এ উভয়কে আঁকড়ে ধর, তা হলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না : একটি মহান আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কুরআন) এবং অন্যটি আমার সুন্নাহ্ (আমার বাণী)।”৫১৬

১০ যিলহজ্ব মহানবী (মাশআর থেকে) মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী এবং তাকসীর৫১৭ ইত্যাদি সম্পন্ন করে হজ্বের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান ও কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য পবিত্র মক্কা গমন করেন। আর এভাবে তিনি জনগণকে হজ্বের আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধানসমূহ শিক্ষা দেন। কখনো কখনো হাদীসবিদ্যা ও ইতিহাসে মহানবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক সফরকে বিদায় হজ্ব’, কখনো কখনো হজ্বে বালাগ’ (মহান আল্লাহর শাশ্বত বাণী পৌঁছে দেয়ার হজ্ব বা প্রচারের হজ্ব) এবং হজ্বে ইসলাম’ (ইসলামের হজ্ব) নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং এ সব নামের প্রতিটি এমন সব উপলক্ষের ভিত্তিতে রাখা হয়েছে, যেসবের অন্তর্নিহিত কারণ সূক্ষ্মদর্শী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের কাছে কোন গোপনীয় বিষয় নয়।

শেষে আমরা এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, হাদীসবিদগণের (মুহাদ্দিস) মধ্যে প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মহানবী (সা.) আরাফাতের দিবসে (৯ যিলহজ্ব) তাঁর এ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তবে কতিপয় মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, মহানবী (সা.) ১০ যিলহজ্ব এ ভাষণ দিয়েছিলেন।৫১৮

বাষট্টিতম অধ্যায় : দশম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

ধর্মের পূর্ণতা বিধান

শিয়া আলেমদের দৃষ্টিতে খিলাফত একটি ইলাহী পদ যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে যোগ্য ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়। ইমাম’ ও নবী র মধ্যকার স্পষ্ট পার্থক্যকারী সীমা-পরিসীমা হচ্ছে নবী’ শরীয়তের প্রতিষ্ঠাতা, ওহীর অবতরণস্থল এবং ইলাহী গ্রন্থের ধারক বা আনয়নকারী। ইমাম’ যদিও এ পদমর্যাদাসমূহের একটিরও অধিকারী নন, তবে হুকুমত (প্রশাসন), তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করার পদাধিকারী হওয়া ছাড়াও তিনি (ইমাম) ধর্মের ঐ অংশের ব্যাখ্যাকারী, যা সুযোগ-সুবিধার অভাবে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার কারণে নবী’ ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করতে সক্ষম হন নি এবং তা বর্ণনা করার দায়িত্ব তাঁর উত্তরাধিকারীদের (ওয়াসী) ওপর অর্পণ করেছেন।

অতএব, শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা কেবল যুগের শাসনকর্তা এবং ইসলাম ধর্মের সার্বিক বিষয়ের কর্তৃত্বশীল, (শরীয়তের) বিধি-বিধান বাস্তবায়নকারী, অধিকারসমূহ সংরক্ষণকারী এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অখণ্ডত্ব, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার রক্ষকই নন; বরং তিনি ধর্ম ও শরীয়তের জটিল ও দুরূহ বিষয়াদির স্পষ্ট ব্যাখ্যাকারী এবং বিধি-বিধানসমূহের ঐ অংশের পূর্ণতাদানকারী, যা বিভিন্ন কারণে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি।

তবে আহলে সুন্নাতের আলেমদের দৃষ্টিতে খিলাফত’ একটি গৌণ ও সাধারণ (লৌকিক) পদ এবং এ পদ সৃষ্টির লক্ষ্য মুসলমানদের বাহ্য অস্তিত্ব ও অবস্থা এবং তাদের জাগতিক বিষয়াদির সংরক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই নয়। যুগের খলীফা সর্বসাধারণের (মুসলিম জনতার) রায় ও অভিমতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হন। আর অন্যান্য বিষয় এবং শরীয়তের ঐসব বিধান, যেসব রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর যুগে সংক্ষিপ্তসারে প্রণয়ন করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর যুগে বিভিন্ন কারণবশত তা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি, সেই সব বিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মুসলিম আলেমদের সাথে সংশ্লিষ্ট, যাঁরা এ ধরনের সমস্যা ও জটিল বিষয় ইজতিহাদ প্রক্রিয়ায় সমাধান করেন।

এ ধরনের অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে খিলাফতের স্বরূপকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে দু টি ধারার উদ্ভব হয়েছে এবং মুসলিম উম্মাহ্ এ কারণে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আর আজও এ মতভিন্নতা বিদ্যমান।

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ইমাম’ কতিপয় দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে নবী র সাথে শরীক এবং একই রকম। আর যে সব শর্ত ও অবস্থা নবীর জন্য অপরিহার্য, সেসব ইমামের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। এ সব শর্ত নিম্নরূপ :

১. নবী অবশ্যই মাসূম (নিষ্পাপ) হবেন অর্থাৎ তিনি তাঁর জীবনে কখনো পাপ করবেন না এবং শরীয়তের বিধি-বিধান এবং ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও বাস্তব তাৎপর্য ব্যাখ্যা এবং জনগণের ধর্ম সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর জবাব দানের ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি ও স্খলনের শিকার হবেন না। আর ইমামও অবশ্যই এমনই হবেন এবং উভয় পক্ষের (অর্থাৎ নবী ও ইমামের নিষ্পাপ হবার) দলিল-প্রমাণ এক ও অভিন্ন।

২. নবী অবশ্যই শরীয়ত সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী হবেন এবং ধর্মের কোন বিষয়ই তাঁর কাছে গোপন থাকবে না। আর ইমামও যেহেতু শরীয়তের ঐ অংশের পূর্ণতাদানকারী ও ব্যাখ্যাকারী- যা নবীর ইহজীবনকালে বর্ণনা করা হয়নি, সেহেতু তিনি অবশ্যই ধর্মের যাবতীয় বিধান ও বিষয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী হবেন।

৩. নবুওয়াত নির্বাচনভিত্তিক পদ নয়; বরং তা হচ্ছে নিয়োগ বা মনোনয়নভিত্তিক। আর মহান আল্লাহ্ নবীকে অবশ্যই (জনগণের কাছে) পরিচিত করান এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। কারণ একমাত্র মহান আল্লাহ্ই নিষ্পাপ ব্যক্তিকে অনিষ্পাপ ব্যক্তিদের থেকে পৃথক করতে সক্ষম এবং কেবল তিনিই ঐ ব্যক্তিকে চেনেন যিনি খোদায়ী গায়েবী অনুগ্রহ এবং তত্ত্বাবধানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যিনি দীন ও শরীয়তের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত।

এ তিন শর্ত যেমনভাবে নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (অপরিহার্য), ঠিক তেমনি ইমাম ও নবীর স্থলবর্তীর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

তবে দ্বিতীয় অভিমতের ভিত্তিতে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তাবলীর একটিও ইমামের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। তাই না নিষ্পাপত্ব (ইসমাত), না ন্যায়পরায়ণতা (আদালত), আর না জ্ঞান (ইলম) অপরিহার্য, আর না শরীয়তের ওপর পূর্ণ দখল, না খোদায়ী নিয়োগ ও মনোনয়ন (অপরিহার্য) শর্ত বলে বিবেচিত, আর না গায়েবী জগতের সাথে সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য। বরং এতটুকুই যথেষ্ট যে, তিনি (ইমাম বা খলীফা) নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার দ্বারা এবং মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করে ইসলাম ধর্মের সম্মান, মর্যাদা এবং বাহ্য অস্তিত্ব রক্ষা করবেন, শরীয়তের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করে ইসলামী রাষ্ট্র ও দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করবেন এবং মুসলমানদের জিহাদ করার প্রতি আহবান জানানোর মাধ্যমে ইসলামের রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করার প্রয়াস চালাবেন। আসলে ইমামত কি একটি মনোনয়নভিত্তিক পদ, নাকি নির্বাচনভিত্তিক পদ? এটা কি অপরিহার্য ছিল যে, মহানবী (সা.) নিজেই তাঁর উত্তরাধিকারী ও স্থলবর্তী (খলীফা) মনোনীত করবেন বা খলীফা মনোনীত করার দায়িত্ব উম্মতের ওপর ছেড়ে দেবেন?- আমরা এখন বেশ কতকগুলো সামাজিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে এসব প্রশ্নের সমাধান করার চেষ্টা করব এবং আপনারা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারবেন, সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে অবধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, স্বয়ং মহানবী (সা.) তাঁর ইহজীবনকালে স্থলবর্তী ও উত্তরাধিকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করবেন এবং তা উম্মাহর নির্বাচন ও মনোনয়নের ওপর ছেড়ে দেবেন না। এখন আমরা এ সংক্রান্ত আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করব।

খলীফা ও উত্তরাধিকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যায়ন

এতে কোন সন্দেহ নেই, ইসলাম বিশ্বজনীন ও সর্বশেষ (এবং চিরকালীন প্রেক্ষিত সহ চূড়ান্ত) দীন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মহানবী (সা.) জীবিত ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণকে নেতৃত্বদান ও পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত। আর তাঁর ওফাতের পর নেতৃত্বের পদ অবশ্যই মুসলিম উম্মাহর যোগ্যতম ব্যক্তিদের কাছে অর্পিত হবে।

মহানবী (সা.)-এর পর নেতৃত্বের পদ কি মনোনয়নভিত্তিক, না তা নির্বাচনভিত্তিক পদ- এ ব্যাপারে দু ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমত প্রচলিত আছে। শিয়ারা বিশ্বাস করে, নেতৃত্বের পদ আসলে মনোনয়নভিত্তিক এবং মহানবী (সা.)-এর স্থলবর্তীকে অবশ্যই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হতে হবে। অথচ আহলে সুন্নাত বিশ্বাস করে, এ পদ নির্বাচনভিত্তিক এবং অবশ্যই মহানবীর পর উম্মাহ্ এক ব্যক্তিকে ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বিক বিষয় পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করবে। উভয় মাযহাবই নিজ নিজ অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে দলিলসমূহ পেশ করেছে, যেসব আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে বিদ্যমান। তবে এখানে যা উত্থাপন করা যেতে পারে, তা হলো মহানবী (সা.)-এর যুগে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবেশ-পরিস্থিতির (সঠিক) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যা এ দৃষ্টিভঙ্গিদ্বয়ের যে কোন একটিকে প্রমাণ করবে।

মহানবী (সা.)-এর যুগে ইসলামের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি অবধারিত হয়ে যায় যে, মহান আল্লাহ্ মহানবী (সা.)-এর খলীফা কেবল মহানবীর মাধ্যমেই নিযুক্ত করবেন। কারণ তখনকার ইসলামী সমাজ এক ত্রিভুজীয় অক্ষশক্তির (রোম, পারস্য ও মুনাফিক চক্রের সমন্বয়ে গঠিত) পক্ষ থেকে সর্বদা যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অশান্তি এবং অনৈক্যের মতো হুমকির সম্মুখীন ছিল। আর একইভাবে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এটি অত্যাবশ্যক হয়ে যায় যে, মহানবী (সা.) রাজনৈতিক নেতা মনোনয়নের মাধ্যমে সমগ্র উম্মাহকে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে এক কাতারে দাঁড় করাবেন এবং শত্রুর আধিপত্য খর্ব করবেন। কারণ উম্মাহর অভ্যন্তরীণ অনৈক্য তাদের মাঝে শত্রুর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এ ত্রিভুজীয় অক্ষশক্তির একটি বাহু ছিল রোমান সাম্রাজ্য। এ পরাশক্তি তখন আরব উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থান করছিল এবং তা সবসময় মহানবীর চিন্তা-ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এমনকি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত রোমীয়দের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারছিলেন না। রোমের খ্রিষ্টীয় সেনাবাহিনীর সাথে মুসলমানদের প্রথম সামরিক সংঘাত হিজরতের অষ্টম বর্ষে ফিলিস্তিনে সংঘটিত হয়েছিল। এ সংঘর্ষে জাফর তাইয়্যার, যাইদ ইবনে হারিসাহ্ এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা নামের তিন সেনাপতি শাহাদাত বরণ করেন এবং মুসলিম সেনাবাহিনী পরাজিত হয়।

কুফরী সেনাশক্তির সামনে মুসলিম বাহিনীর পশ্চাদপসরণ কাইসার অর্থাৎ রোমান সম্রাটের সেনাবাহিনীর স্পর্ধার কারণ হয়েছিল এবং যে কোন সময় ইসলামের প্রাণকেন্দ্র (পবিত্র মদীনা নগরী) আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বিরাজ করছিল। এ কারণেই মহানবী (সা.) হিজরতের নবম বর্ষে এক বিশাল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল সেনাবাহিনী নিয়ে শামের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিকে যাত্রা করেন, যাতে তিনি নিজেই সেখানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কষ্টে পরিপূর্ণ এ অভিযানের মাধ্যমে ইসলামী বাহিনী তাদের পুরনো মর্যাদা ফিরে পেয়েছিল এবং নিজেদের রাজনৈতিক জীবনের নবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।

এ আংশিক বিজয় মহানবী (সা.)-কে সন্তুষ্ট করতে পারে নি এবং তাঁর অসুস্থ হবার কয়েক দিন আগেও তিনি উসামা ইবনে যায়েদের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনীকে শাম সীমান্তে গমন করে রণাঙ্গনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

প্রাগুক্ত ত্রিভুজীয় শত্রুশক্তির দ্বিতীয় বাহু ছিল পারস্য সাম্রাজ্য (ইরান)। কারণ পারস্য-সম্রাট খসরু প্রচণ্ড আক্রোশ সহকারে মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত পত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিল এবং মহানবীর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। সে মহানবী (সা.)-কে বন্দী বা প্রতিরোধ করলে হত্যার নির্দেশ দিয়ে ইয়েমেনের গভর্নরের কাছে চিঠি লিখেছিল।

খসরু পারভেয মহানবীর ইহজীবনকালে মৃত্যুবরণ করে। তবে ইয়েমেন অঞ্চল, যা দীর্ঘকাল পারস্য সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল, সেই ইয়েমেনের স্বাধীনতার বিষয়টি পারস্যের সম্রাটদের চিন্তা-ভাবনার বাইরে ছিল না। আর তীব্র অহংকারের কারণে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শাসকশ্রেণী (আরব উপদ্বীপে) এ ধরনের শক্তির (মহানবীর নেতৃত্বে) অস্তিত্ব মোটেই মেনে নিতে পারছিল না।

তৃতীয় বিপদ ছিল মুনাফিকচক্রের পক্ষ থেকে, যারা সর্বদা পঞ্চম বাহিনী’ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম ও (অশুভ) তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। এমনকি তারা মহানবীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করেছিল অর্থাৎ তারা তাঁকে তাবুক ও মদীনার সড়কে হত্যা করতে চেয়েছিল। মুনাফিকদের মধ্যকার একটি দল নিজেদের মধ্যে গোপনে বলাবলি করত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলামী আন্দোলনেরও পরিসমাপ্তি হবে; আর তখন সবাই প্রশান্তিলাভ করবে।৫১৯

মহানবী (সা.) এর ওফাতের পর আবু সুফিয়ান এক অশুভ পাঁয়তারা করেছিল এবং হযরত আলীর হাতে বাইয়াত করার মাধ্যমে মুসলমানদের দু দলে বিভক্ত করে পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত করাতে চেয়েছিল যাতে সে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আলী (আ.) তাঁর বিচক্ষণতার কারণে আবু সুফিয়ানের নোংরা অভিপ্রায়ের কথা জেনে যান বলেই তিনি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন :

“মহান আল্লাহর শপথ! ফিতনা ছাড়া তোমার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। কেবল আজকেই (প্রথম বারের মতো) তুমি ফিতনার অগ্নি প্রজ্বলিত করতে চাচ্ছ না; বরং তুমি (এর আগেও) বারবার অনিষ্ট সাধন করতে চেয়েছ। তুমি জেনে রাখ, তোমার প্রতি আমার কোন প্রয়োজন নেই। ৫২০

মুনাফিকদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এতটাই ছিল যে, পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা, সূরা মায়েদাহ্, সূরা আনফাল, সূরা তাওবা, সূরা আনকাবুত, সূরা আহযাব, সূরা হাদীদ, সূরা মুনাফিকীন এবং সূরা হাশরে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে।

গোপনে ওঁৎ পেতে থাকা এসব ক্ষমতাবান শত্রুর উপস্থিতি সত্বেও এটা কি সঠিক হবে যে, মহানবী (সা.) নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজের ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতৃত্বে তাঁর কোন স্থলবর্তী নিযুক্ত করবেন না? সামাজিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনাসমূহ ব্যক্ত করে যে, মহানবী (সা.) অবশ্যই নেতা, প্রধান ও দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে তাঁর (ওফাতের) পর সব ধরনের মতবিরোধের পথ রুদ্ধ এবং একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে ইসলামী ঐক্যের নিশ্চয়তা বিধান করে যাবেন।

কেবল নেতা নিযুক্ত করা ছাড়া ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানো এবং নেতা অবশ্যই আমাদের মধ্য থেকে হবে’- মহানবীর ওফাতের পর কোন গোষ্ঠীকে এ ধরনের কথা থেকে বিরত রাখা মোটেই সম্ভব ছিল না।

এ সব সামাজিক মূল্যায়ন আমাদেরকে মহানবীর পরে নেতৃত্ব যে মনোয়নভিত্তিক- এ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিমতের সঠিক হওয়ার দিকেই পরিচালিত করে। সম্ভবত এ কারণ এবং অন্যান্য কারণেও মহানবী (সা.) বে সাতের (নবুওয়াতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়া) প্রথম দিনগুলো থেকে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত তাঁর স্থলবর্তী নিযুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর রিসালতের শুরুতে এবং শেষে তাঁর উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে গেছেন।

১. নবুওয়াত ও ইমামত পরস্পর সংযুক্ত

খিলাফত সংক্রান্ত প্রথম দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা নিশ্চিতভাবে প্রমাণকারী সামাজিক মূল্যায়নসমূহের অনুকূলে বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক দলিল-প্রমাণ ছাড়াও মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহও শিয়া আলেমগণের দৃষ্টিভঙ্গির সত্যায়ন করে। মহানবী (সা.) তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনকালে তাঁর উত্তরসূরি নিযুক্ত করার কথা বারবার ঘোষণা করেছেন এবং এভাবে তিনি ইমামত অর্থাৎ নেতৃত্বকে নির্বাচন তথা সর্বসাধারণের রায় ও অভিমতের মুখাপেক্ষী হওয়ার গণ্ডি থেকে বের করে এনেছেন।

মহানবী (সা.) কেবল তাঁর জীবনের শেষভাগে তাঁর উত্তরসূরি নিযুক্ত করেন নি; বরং রিসালাতের সূচনায় যখন মাত্র কয়েক শ’ লোক ছাড়া আপামর জনতা তাঁর প্রতি ঈমান আনে নি, সে মুহূর্তেও তিনি জনগণের সামনে তাঁর ওয়াসী (নির্বাহী ও ওসিয়ত বাস্তবায়নকারী) ও উত্তরসূরিকে পরিচিত করিয়েছিলেন।

একদিন মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নিকটাত্মীয়দের (বনী হাশিম) মহান আল্লাহর আযাব থেকে সতর্ক করা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি আহবান জানানোর পূর্বে তাদের তাওহীদী ধর্মের দিকে আহবান জানানোর জন্য আদিষ্ট হলেন। তিনি বনী হাশিমের ৪৫ জন নেতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সভায় বলেছিলেন : আপনাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করবে, সে আপনাদের মাঝে আমার ভাই, ওয়াসী এবং স্থলবর্তী হবে।” হযরত আলী (আ.) তাঁদের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর রিসালাতের স্বীকৃতি দিলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিলেন : এ যুবকই আমার ভাই, ওয়াসী এবং স্থলবর্তী (খলীফা)। ৫২১

এ হাদীসই মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণের কাছে হাদীসু ইয়াওমিদ দার’ (বাড়িতে আয়োজনকৃত সমাবেশ-দিবসের হাদীস) বা হাদীসু বিদ ইদ দাওয়াহ্’ (প্রচার কার্যক্রম শুরুর হাদীস) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

মহানবী (সা.) শুধু রিসালাতের সূচনায়ই নয়; বরং বিভিন্ন উপলক্ষে- কি সফরে, কি নিজ এলাকায় অবস্থান কালে হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়েত (নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব) এবং স্থলবর্তী ও খলীফা হবার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তবে এসবের মধ্যে কোনটিই মর্যাদা, তাৎপর্য, স্পষ্টতা, অকাট্যতা এবং সর্বজনীনতার দিক থেকে হাদীসে গাদীরে খুম’-এর (গাদীরে খুমের হাদীস) সমপর্যায়ের নয়।

মুসলমানদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক

পবিত্র মদীনা নগরীতে বসবাসের শুরুর দিন থেকে মহানবী (সা.) ইসলামের প্রভাব বলয়ের চৌহদ্দির বাইরে শত্রুদের সার্বিক অবস্থা,গতিবিধি ও তৎপরতা সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সর্বদা দক্ষ ও নিপুণ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মদীনার আশেপাশে প্রেরণ করতেন। এ কারণেই গোয়েন্দা তথ্য প্রদানকারীরা গোপন তথ্য প্রদান করেন যে,ইসলামের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট গঠিত হয়েছে এবং এ জোটের লোকেরা একটি নির্দিষ্ট দিনে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হবে এবং মদীনা নগরী অবরোধ করবে। মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন,যাতে সবাই উহুদ যুদ্ধে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হন। একদল দুর্গে আশ্রয় নিয়ে দুর্গের টাওয়ার ও উচ্চ স্থান থেকে যুদ্ধ পরিচালনাকে শহরের বাইরে গিয়ে শত্রু সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। তবে এ পরিকল্পনা যথেষ্ট ছিল না। কারণ উত্তাল সৈন্যদের আক্রমণ দুর্গ ও টাওয়ারগুলোকে ধ্বংস করে ফেলত এবং মুসলমানদের ভূলুণ্ঠিত করে ফেলত। তাই তখন এমন কোন কাজ করা প্রয়োজন ছিল,যার ফলে তারা মদীনা নগরীর নিকটবর্তী হতে সক্ষম না হয়।

ইরানীদের রণকৌশলের সাথে পরিচিত সালমান ফার্সী বললেন : যখনই পারস্যবাসী ভয়ঙ্কর শত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি হয়,তখন তারা শহর ও নগরীর চারপাশে গভীর পরিখা খনন করে শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করে থাকে। তাই মদীনা নগরীর যে সব স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে অর্থাৎ শত্রুবাহিনীর যানবাহন এবং যুদ্ধের হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি যে সব স্থান দিয়ে সহজেই আনা-নেয়া করা যাবে,সেসব স্থানে গভীর পরিখা খনন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মদীনা নগরীর এ অঞ্চলে শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি অবশ্যই থামিয়ে দিতে হবে। আর পরিখার পাশে বাঙ্কার নির্মাণ করে সেখান থেকে শহরের প্রতিরক্ষা কার্যকর করতে হবে এবং পরিখার আশে-পাশের টাওয়ারগুলো থেকে শত্রুবাহিনীর উপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করে পরিখা অতিক্রম করে শহরের ভিতরে তাদের প্রবেশ প্রতিহত করতে হবে। 116

সালমানের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রতিরক্ষামূলক এ পরিকল্পনাটি ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,মহানবী (সা.) কয়েক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে যে সব স্থানের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা বিদ্যমান,সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে একটি বিশেষ রেখা টেনে পরিখা খননের স্থান নির্ধারণ করলেন। ঠিক হলো,উহুদ থেকে রাতিজ পর্যন্ত একটি পরিখা খনন করা হবে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রতি চল্লিশ হাত অন্তর স্থানের প্রহরা দশ যোদ্ধার ওপর ন্যস্ত করা হবে।

মহানবী (সা.) নিজে সর্বপ্রথম গাঁইতি দিয়ে পরিখা খনন কাজ শুরু করলেন এবং হযরত আলী (আ.) খননকৃত মাটি সেখান থেকে বের করে আনতে লাগলেন। মহানবীর কপাল ও মুখমণ্ডল বেয়ে ঘাম ঝরছিল। ঐ সময় নিম্নোক্ত বাক্য তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো :

لا عيش إلّا عيش الآخرة اللهم اغفر الأنصار و المهاجرة

“পারলৌকিক জীবনই হচ্ছে প্রকৃত জীবন। হে আল্লাহ! মুহাজির ও আনসারদের আপনি ক্ষমা করে দিন।”

মহানবী (সা.) তাঁর এ কাজের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের কর্মসূচীর একটি দিক উন্মোচন করেছেন এবং ইসলামী সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছেন,সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং জনগণের নেতাকে অবশ্যই অন্য ব্যক্তিদের মতো সবার শোক-দুঃখে অংশীদার হতে হবে এবং সর্বদা তাদের কাঁধ থেকে বোঝা নিজের কাঁধেও বহন করতে হবে। এ কারণেই মহানবীর এ কর্ম মুসলমানদের মধ্যে এক বিস্ময়কর কর্মোদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা সবাই ব্যতিক্রম ছাড়াই পরিখা খনন কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এমনকি বনী কুরাইযা গোত্রের ইহুদীরা-যারা মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেছিল,তারা পর্যন্ত খনন করার সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করে খনন কাজের অগ্রগতিতে সাহায্য করেছিল।117

মুসলমানরা ঐ সময় তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে ছিলেন। তা সত্বেও অবস্থাপন্ন পরিবারসমূহের পক্ষ থেকে ইসলামের সৈনিকদের সাহায্য করা হচ্ছিল। যখন বিশাল বিশাল পাথরের স্তর বের হওয়ার কারণে পরিখা খনন কাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল,তখন তাঁরা মহানবীর শরণাপন্ন হলে তিনি খুব জোরে আঘাত করে ঐ সব প্রকাণ্ড পাথর ভেঙে টুকরো টুকরো করেছিলেন।

খননকারী শ্রমিকদের সংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে পরিখার দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা যায়। কারণ ঐ সময় মুসলমানদের সংখ্যা (প্রসিদ্ধ রেওয়ায়েত অনুসারে) ছিল তিন হাজার118 এবং নির্ধারণ করা হয়েছিল যে,প্রত্যেক দশ জন যোদ্ধা চল্লিশ হাত ভূমি প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন। এ অবস্থায় পরিখার দৈর্ঘ্য বারো হাজার হাত অর্থাৎ প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার হবে এবং এর প্রস্থ এতটা ছিল যে,চৌকস অশ্বারোহীরাও অশ্ব নিয়ে তা অতিক্রম করতে পারছিল না। স্বভাবতই এ পরিখার গভীরতা কমপক্ষে পাঁচ মিটার এবং এর প্রস্থও পাঁচ মিটার হয়ে থাকবে।

সালমান ফার্সী সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর প্রসিদ্ধ উক্তি

লোকদেরকে ভাগ করে দেয়ার সময় সালমানের ব্যাপারে মুহাজির ও আনসারগণ পরস্পর কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হন। তাঁদের সবাই বলছিলেন : সালমান আমাদের মধ্যে এবং তিনি অবশ্যই আমাদের সহকর্মী হবেন।” মহানবী (সা.) তখন তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে বিতর্কের অবসান ঘটালেন : سلمان منّا أهل البيت সালমান আমাদের আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। 119

মহানবী (সা.) দিন-রাত পরিখার পাশে কাটাতে লাগলেন যাতে পরিখা খনন কাজ (যথাসময়ে) শেষ হয়। তবে মুনাফিক চক্র বিভিন্ন ধরনের ঠুনকো অজুহাত দাঁড় করিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি নিয়ে,কখনো কখনো অনুমতি না নিয়েই নিজেদের বাড়ীতে ফিরে যেত। তবে মুমিনগণ দৃঢ় সংকল্প সহকারে কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শিয়ে সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই তাঁরা দায়িত্ব থেকে অবসর নিতেন এবং প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে তাঁরা আবার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতেন। পুরো বিষয়টা স্পষ্টভাবে সূরা নূরের 62 ও 63 তম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

আরব ও ইহুদী যৌথ বাহিনীর মদীনা অবরোধ

যে গভীর পরিখা সম্মিলিত আরব বাহিনীর আগমনের ছয়দিন আগে খনন করা হয়েছিল,তারা পঙ্গপালের মতো তার পাশে এসে সমবেত হলো। তারা উহুদ পর্বতের পাদদেশে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখী হবার আশা করেছিল। কিন্তু উহুদের ময়দানে পৌঁছে তারা সেখানে মুসলিম বাহিনীর কোন চিহ্নই দেখতে পেল না। তাই তারা তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং অবশেষে পরিখার ধারে এসে উপস্থিত হয়। মদীনার সংবেদনশীল অঞ্চলে একটি গভীর পরিখা দেখতে পেয়ে তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তারা সবাই বলছিল : মুহাম্মদ এ রণ-কৌশলটা একজন ইরানীর কাছ থেকে শিখেছে। তা না হলে আরবরা এ ধরনের রণ-কৌশলের সাথে মোটেই পরিচিত নয়।

উভয় পক্ষের সামরিক শক্তির একটি সূক্ষ্ণ পরিসংখ্যান

আরব বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরিখার অপর প্রান্তে তাদের তারবারিগুলোর ঝলকানি সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। ইমতা’ গ্রন্থে মাকরীযীর উদ্ধৃতি অনুসারে কেবল কুরাইশ গোত্রই চার হাজার সৈন্য,তিন শ’ অশ্ব এবং পনেরো শ’ উট নিয়ে পরিখার পাশে তাঁবু স্থাপন করেছিল। কুরাইশদের মিত্র বনী সালীম গোত্র মাররুয যাহরান এলাকায় সাত শ সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের সাথে যোগ দিয়েছিল। বনী ফিযারাহ্ এক হাজার যোদ্ধা এবং বনী আশজা ও বনী মুররাহ্ গোত্রের প্রতিটিই চার শ’ সৈন্য সহ এবং অবশিষ্ট গোত্রগুলো,যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার পাঁচ শ’ , অন্য একটি স্থানে তাঁবু স্থাপন করেছিল;আর এভাবে সম্মিলিত আরব বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

মুসলমানদের সংখ্যা তিন হাজার অতিক্রম করে নি। সালা (سلع ) পর্বতের প্রান্তদেশ উঁচু ভূমিতে তারা তাঁবু স্থাপন করেছিল। এ অঞ্চল পরিখা ও পরিখার বাইরের অবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখছিল এবং শত্রু বাহিনীর যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও গতিবিধি সেখান থেকে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। একদল মুসলিম সৈন্য পরিখার উপর দিয়ে গমানাগমন নিয়ন্ত্রণ এবং এর প্রতিরক্ষা বিধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে নির্মিত বাঙ্কারসমূহে অবস্থান নিয়ে শত্রু বাহিনীর পরিখা অতিক্রম করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করছিলেন।

মুশরিক বাহিনী প্রায় এক মাস পরিখার অপর প্রান্তে অবস্থান করেছিল। কেবল সীমিত সংখ্যক সৈন্য ব্যতীত তারা পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় নি। আর পরিখা অতিক্রম করার চিন্তা যাদের মাথায় ছিল,তারা আধুনিককালে ব্যবহৃত গোলার পরিবর্তে তখন ব্যবহৃত পাথর নিক্ষেপ করার কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ঐ সময় আগ্রাসনকারী আরব বাহিনীকে নিয়ে মুসলমানদের বেশ কিছু মিষ্টি-মধুর কাহিনী আছে যেসব ইতিহাসে বর্ণিত আছে।120

তীব্র শীত ও খাদ্য-সামগ্রীর অভাব

পরিখার যুদ্ধ শীতকালে সংঘটিত হয়েছিল। ঐ বছর মদীনা অনাবৃষ্টি ও এক ধরনের দুর্ভিক্ষ কবলিত হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে মুশরিক বাহিনীর খাদ্য ও রসদপত্র এতটা ছিল না যে,তারা সেখানে দীর্ঘ দিন অবস্থান করতে সক্ষম হবে। তারা ভাবতেও পারে নি যে,পরিখার পাশে তাদেরকে এক মাস আটকে থাকতে হবে। বরং তারা নিশ্চিত ছিল,অতর্কিত হামলা চালিয়ে ইসলামের সকল সাহসী যোদ্ধাকে ধরাশায়ী এবং মুসলমানদের হত্যা করবে।

কয়েকদিন অতিবাহিত হবার পর যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনকারীরা (ইহুদীরা) এ সমস্যা উপলব্ধি করল। তারা বুঝতে পারল,সময় গত হওয়ার সাথে সাথে সম্মিলিত মুশরিক বাহিনীর সেনাপতিদের ইচ্ছাশক্তিও হ্রাস পেতে থাকবে এবং খাদ্য ও রসদপত্রের অভাব এবং শীতের প্রকোপ বাড়ার কারণে তাদের প্রতিরোধ ও দৃঢ়তাও হ্রাস পাবে। এ কারণেই তারা এ চিন্তা করতে লাগল যে,মদীনা নগরীর ভেতরে বসবাসকারী বনী কুরাইযার কাছে তারা সাহায্য চাইবে যাতে তারা মদীনার অভ্যন্তরে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে সম্মিলিত আরব বাহিনীর সামনে মদীনা নগরীতে প্রবেশ করার পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

বনী কুরাইযার দুর্গে হুইয়াই ইবনে আখতাবের আগমন

বনী কুরাইযাহ্ ছিল একমাত্র ইহুদী গোত্র যারা মদীনায় মুসলমানদের সাথে শান্তিতে বসবাস করত এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করার কারণে মুসলমানরাও তাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করত।

হুইয়াই ইবনে আখতাব বুঝতে পারল,সম্মিলিত আরব বাহিনীর স্বার্থে মদীনার ভেতর থেকে সাহায্য নেয়াই হচ্ছে বিজয় লাভের একমাত্র পথ। মুসলমান এবং বনী কুরাইযার ইহুদীদের মাঝে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করার জন্য এবং গৃহযুদ্ধে মুসলমানদের ব্যস্ত হওয়া সম্মিলিত আরব বাহিনীর বিজয় লাভের অনুকূল বিবেচনায় সে মহানবীর সাথে বনী কুরাইযার ইহুদীদের শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করার আহবান জানায়। এ পরিকল্পনা মোতাবেক সে বনী কুরাইযার দুর্গের দ্বারে উপস্থিত হয়ে তাদের কাছে নিজের পরিচিতি তুলে ধরে। বনী কুরাইযার সর্দার কা ব দুর্গের ফটক না খোলার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সে খুব মিনতি করতে থাকে এবং চিৎকার করে বলতে থাকে : হে কা ব! তুমি কি তোমার রুটি-রোযগারের ব্যাপারে ভীত যে,এ কারণে তুমি আমার জন্য দুর্গের ফটক খুলছ না?”   এ কথা কা বের অনুভূতিকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। সে দুর্গের ফটক খোলার নির্দেশ দিল। তার নির্দেশে দুর্গের ফটক খোলা হলো এবং যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনকারী (হুয়াই ইবনে আখতাব) অভিন্ন ধর্মানুসারী কা বের পাশে বসে বলল : আমি তোমার জন্য এক দুনিয়া সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে এসেছি। কুরাইশ গোত্রপতিরা,আরবের নেতারা এবং গাতফান গোত্রের সর্দাররা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অভিন্ন শত্রু অর্থাৎ মুহাম্মদকে ধ্বংস করার জন্য পরিখার পাশে এসে অবস্থান নিয়েছে এবং আমাকে কথা দিয়েছে মুহাম্মদ ও মুসলমানদের পাইকারীভাবে হত্যা না করে তারা নিজেদের বাসস্থানে প্রত্যাবর্তন করবে না।”

কা ব জবাবে তাকে বলল, তুমি এক দুনিয়া অপদস্থতা ও অসম্মান সাথে নিয়ে এসেছ। আমার দৃষ্টিতে আরব বাহিনী ঐ মেঘসদৃশ,যা কেবল গর্জনই করে,তবে এক ফোঁটা বৃষ্টিও এ থেকে বর্ষিত হয় না। হে আখতাব তনয়! হে যুদ্ধের উস্কানিদাতা ও যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনকারী! আমাদের ওপর থেকে তোমার হাত গুটিয়ে নাও। মুহাম্মদের সুকুমার চারিত্রিক বৈশিষ্টাবলীর কারণে আমরা তাঁর সাথে আমাদের শান্তি চুক্তি উপেক্ষা করতে পারব না। আমরা তাঁর থেকে সত্যবাদিতা,নির্মলতা,সততা ও পবিত্রতা ছাড়া আর কিছুই প্রত্যক্ষ করি নি। তাই আমরা কিভাবে তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব?

কিন্তু হুইয়াই ইবনে আখতাব একজন দক্ষ উষ্ট্রচালকের মতো-যে কুঁজের উপর হাত বুলিয়ে পাগলা উটকে শান্ত করে-এতটা কথা বলল যে,কা ব শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। হুইয়াই তাকে কথা দিল,সম্মিলিত আরব বাহিনী যদি মুহাম্মদের ওপর বিজয়ী নাও হয়,স্বয়ং সে দুর্গে প্রবেশ করে (তাদের সুখ-দুঃখের) ভাগীদার হবে। কা ব হুইয়াই এর উপস্থিতিতে ইহুদী নেতাদের ডেকে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করল এবং সে তাদের মতামত জানতে চাইল। তারা সবাই বলল : তোমার অভিমতই আমাদের অভিমত। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে,আমরা তা মানতে প্রস্তুত আছি। 121

যুবাইর বাতা ছিল একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি। সে বলল : আমি তাওরাতে পড়েছি,শেষ যুগে মক্কা থেকে এক নবী আবির্ভূত হবেন এবং মদীনায় হিজরত করবেন। তাঁর ধর্ম সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হবে। আর কোন বাহিনীই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখবে না। মুহাম্মদ যদি ঐ প্রতিশ্রুত নবী হয়ে থাকেন,তা হলে এ সম্মিলিত বাহিনী তাঁর ওপর বিজয়ী হবে না।” হুইয়াই ইবনে আখতাব সাথে সাথে বলল : ঐ (প্রতিশ্রুত) নবী বনী ইসরাঈল বংশোদ্ভূত হবেন। আর মুহাম্মদ হচ্ছে ইসমাঈলের বংশধর যে যাদু ও ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে এ দলটিকে (মুসলমানদের) জড়ো করেছে।” সে এ প্রসঙ্গে এতটা দৃঢ়তার সাথে বুঝালো,যা অবশেষে তাদের সবাইকে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করতে প্ররোচিত করল (এবং তারা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিল)। এ সময় হুইয়াই তাদের ও মহানবী (সা.)-এর মাঝে সম্পাদিত শান্তিচুক্তিপত্র চাইল এবং তাদের সবার চোখের সামনে তা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল। এরপর সে বলল : সবকিছু এখন শেষ হয়ে গেছে। কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন তোমরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। 122

বনী কুরাইযার চুক্তি ভঙ্গের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর অবগতি

মহানবী (সা.) তাঁর দক্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বনী কুরাইযাহ্ কর্তৃক শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করার ব্যাপারে ঐ অতি সংবেদনশীল মুহূর্তে অবগত হলেন এবং খুবই চিন্তিত ও ব্যথিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মুসলিম সাহসী সেনা কর্মকর্তা এবং আউস ও খাযরাজ গোত্রের সর্দার সা দ ইবনে মায়ায এবং সা দ ইবনে উবাদাকে দায়িত্ব দিলেন,তাঁরা এ সংক্রান্ত সূক্ষ্ম তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং বনী কুরাইযার বিশ্বাসঘাতকতা করার খবর সঠিক হয়ে থাকলে তাঁরা মহানবীকে আযাল ওয়া কারাহ্’123 (عضل و قاره )-এ সাংকেতিক শব্দ উচ্চারণ করে অবহিত করবেন। আর তারা তাদের চুক্তির ওপর অটল থাকলে যেন তাঁরা প্রকাশ্যে এ বিষয়টি অস্বীকার করেন।

সা দ ইবনে মায়ায এবং সা দ ইবনে উবাদাহ্ আরো দু জন কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে বনী কুরাইযার দুর্গের ফটকের কাছে আগমন করলেন এবং কা বের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হবার মুহূর্তেই মহানবী (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে তার গালি-গালাজ,নিন্দাবাদ ও কটূক্তি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না। সা দ তাঁর অভ্যন্তরীণ অনুপ্রেরণার (ইলহাম) ভিত্তিতে বললেন : মহান আল্লাহর শপথ! সম্মিলিত আরব বাহিনী এ ভূ-খণ্ড থেকে চলে যাবে এবং মহানবী (সা.) এ দুর্গ অবরোধ করে তোমার মুণ্ডুপাত করবেন এবং তোমার গোত্রকে অপদস্থ করবেন।” এরপর তাঁরা সাথে সাথে ফিরে এসে মহানবীকে বললেন : ‘আযাল ওয়া কারাহ্’ ।

মহানবীও উচ্চকণ্ঠে বললেন :الله أكبر أبشروا يا معشر المسلمين بالفتح আল্লাহু আকবার (আল্লাহ্ মহান)। হে মুসলিম জনতা! তোমাদের সুসংবাদ (দিচ্ছি),বিজয় অতি নিকটে।”

ইসলামের মহান নেতার সাহসিকতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক এ বাক্য তিনি এজন্য বলেছিলেন যাতে বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের চুক্তি ভঙ্গের সংবাদ শুনে মুসলমানদের মনোবল দুর্বল না হয়ে পড়ে।124

বনী কুরাইযাহ্ পরিচালিত প্রাথমিক আগ্রাসন

বনী কুরাইযা গোত্রের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল এই যে,প্রথমে তারা মদীনা নগরীতে লুটতরাজ চালাবে এবং যে মুসলমান নারী ও শিশু ঘরে আশ্রয় নিয়েছে,তারা তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করবে। আর তারা মদীনায় তাদের এ পরিকল্পনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত করবে।

যেমন বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের বীরেরা রহস্যজনকভাবে মদীনা নগরীতে টহল দেয়া শুরু করে ও ঘোরাফেরা করতে থাকে। সাফীয়াহ্ বিনতে আবদুল মুত্তালিব এ ব্যাপারে বলেছেন : আমি হাস্সান ইবনে সাবিতের ঘরে ছিলাম এবং হাস্সানও স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সহ সেখানে বসবাস করছিল। হঠাৎ আমি একজন ইহুদী লোককে দেখতে পেলাম,সে দুর্গের চারপাশে রহস্যজনকভাবে ঘোরাফেরা করছে। আমি হাস্সানকে বললাম : এ লোকটির মনে কুমতলব আছে। হাস্সান বললেন : হে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা! তাকে হত্যা করার সাহস আমার নেই এবং এ দুর্গ থেকে বের হলে আমার ক্ষতি হতে পারে বলে আমি শঙ্কা বোধ করছি। আমি নিরুপায় হয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে আমার কোমর বাঁধলাম এবং এক টুকরো লোহা নিলাম এবং এক আঘাতে ঐ ইহুদী লোকটাকে ধরাশায়ী করে ফেললাম।”

মুসলমানদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মহানবী (সা.)-কে গোপন রিপোর্ট প্রদান করে অবহিত করলেন,বনী কুরাইযাহ্,কুরাইশ গোত্র এবং বনী গাতফানের কাছে দু হাজার সৈন্য চেয়েছে যাতে তারা বনী কুরাইযার দুর্গের ভেতর দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করে মদীনা নগরী তছনছ ও লুটপাট করতে সক্ষম হয়। এ সংবাদ ঐ সময় পৌঁছে যখন মুসলমানরা পরিখার পারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন,যাতে শত্রু সেনারা তা অতিক্রম করে মদীনায় প্রবেশ করতে না পারে। মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ যাইদ ইবনে হারিসা ও মাসলামাহ ইবনে আসলাম নামের দু জন সেনানায়ককে পাঁচ শ’ সৈন্য নিয়ে মদীনার অভ্যন্তরে টহল দেয়া এবং তাকবীর দিয়ে বনী কুরাইযার আগ্রাসন প্রতিহত করার নির্দেশ দেন যাতে করে মদীনার মুসলিম নারী ও শিশুরা তাদের তাকবীর ধ্বনি শুনে শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন থাকে।125

মুখোমুখি ঈমান ও কুফর

মুশরিক ও ইহুদীরা পরিখার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধ পরিচালিত করেছিল। তবে এ সব যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছিল এবং সেগুলো সমগ্র আরবোপদ্বীপকে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার মত ব্যাপক ও সর্বজনীন দিকসম্পন্ন ছিল না। শত্রুরা এতসব চেষ্টা করেও নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সরকার ও রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয় নি বলে এবার তারা বিভিন্ন গোত্রের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সম্মিলিত সেনাবাহিনী গঠন করে ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করতে এবং তূণের সর্বশেষ তীরটি মুসলমানদের দিকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। তারা সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করে। মুসলমানদের পক্ষ থেকে মদীনা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে শত্রুবাহিনী এ যুদ্ধে বিজয় লাভ করত।

এ কারণেই ইসলামের শত্রুরা আরবদের সেরা বীর যোদ্ধা আমর ইবনে আবদে উদকে সাথে করে এনেছিল এ উদ্দেশ্যে যে,তার বাহুবলের দ্বারা তারা তাদের বিজয় আরো ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে।

সুতরাং পরিখা যুদ্ধের দিনগুলোয় শিরক ও ইসলামের দুই বীরের মুখোমুখী হবার মুহূর্তে আসলে ইসলাম ও কুফরই মুখোমুখী হয়েছিল;আর এ দ্বৈত সমর ছিল ঈমান ও কুফরের পরস্পর মুখোমুখী হবার প্রাঙ্গন।

সম্মিলিত আরব বাহিনীর ব্যর্থ হবার অন্যতম কারণ ছিল তাদের সামনে খনন করে রাখা ঐ গভীর পরিখা। শত্রু বাহিনী ঐ পরিখা অতিক্রম করার জন্য রাতদিন চেষ্টা করেছিল। তবে তারা পরিখা রক্ষাকারী সৈন্যদের তীব্র আক্রমণ এবং মহানবী (সা.)-এর গৃহীত প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপসমূহের মুখোমুখী হতে থাকে।

ঐ বছরের তীব্র হাঁড়-কাঁপানো শীত,খাদ্যসামগ্রী এবং খড়-কুটার অভাব আরব বাহিনীর অস্তিত্ব ও তাদের পশুগুলোর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হুয়াই ইবনে আখতাব বনী কুরাইযার ইহুদীদের কাছ থেকে 20টি উট বোঝাই খেজুর সাহায্য পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। কিন্তু মুসলিম কর্মকর্তারা সেগুলো আটক করেছিলেন। এরপর সেগুলো মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছিল।126

একদিন আবু সুফিয়ান মহানবী (সা.)-এর কাছে প্রেরিত এক পত্রে লিখেছিল : আমি এক বিশাল ব্যয়বহুল সেনাবাহিনী নিয়ে আপনার ধর্মকে উচ্ছেদ করার জন্য এসেছি। কিন্তু কী আর করব। আপনি যেন আমাদের মুখোমুখী হতে পছন্দ করছেন না! আপনি আমাদের ও আপনার মাঝে একটি গভীর পরিখা খনন করে রেখেছেন। জানি না,আপনি এ সমরকৌশল কার কাছ থেকে শিখেছেন! তবে এ কথা বলে রাখছি যে,উহুদের মতো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ না বাঁধিয়ে আমি মক্কায় ফিরে যাচ্ছি না।”

মহানবী (সা.) তাকে উত্তরে লিখেছিলেন : আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের কাছে মহান আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে... অনেক দিন যাবত আত্মদর্পে বিভোর হয়ে তুমি ভাবছ,ইসলাম ধর্মের চির উজ্জ্বল প্রদীপ তুমি নিভিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তবে তুমি এটা জেনে নাও,এ ব্যাপারে সফল হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে তুমি অনেক হীন ও নীচ। অতি শীঘ্রই তুমি পরাজিত হয়ে ফিরে যাবে। আর আমি ভবিষ্যতে কুরাইশদের বড় বড় প্রতিমা তোমার চোখের সামনেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব। 127

পত্রলেখকের দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করা এ পত্রের উত্তর ছিল নিক্ষিপ্ত তীরতুল্য যা মুশরিক-বাহিনীর সেনাপতির হৃদপিণ্ডে গেঁথে গিয়েছিল। কুরাইশরা মহানবীর সত্যবাদিতায় আস্থা রাখত বলে তারা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। তবে তারা তাদের চেষ্টা চালানো থেকে হাত গুটিয়ে নেয় নি। এক রাতে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ একটি বিশেষ সেনাদল নিয়ে এ পরিখা অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু উসাইদ ইবনে হুযাইরের নেতৃত্বে দু শ’ মুসলিম সৈন্যের প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতার কারণে সে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

মহানবী (সা.) মুসলিম সেনাবাহিনী ও যোদ্ধাদের মনোবল শক্তিশালী করার ব্যাপারে ক্ষণিকের জন্যও অমনোযোগী হন নি। তিনি তাঁর অগ্নিগর্ভ ভাষণ এবং আকর্ষণীয় ও প্রাণোদ্দীপক বাণীর দ্বারা তাঁদেরকে চিন্তা-বিশ্বাসের স্বাধীনতার পবিত্র অঙ্গনের প্রতিরক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত রাখতেন। একদিন তিনি এক বিশাল মহতী সমাবেশে সৈনিক ও সেনাধ্যক্ষগণের দিকে তাকিয়ে এক সংক্ষিপ্ত দুআর পর বলেছিলেন :

أيّها النّاس إذا لقيتم العدوّ فاصبروا و اعلموا أنّ الجنّة تحت ظلال السّيُوف

“হে ইসলামের সৈনিকবৃন্দ! শত্রুবাহিনীর মোকাবেলায় প্রতিরোধ করে যাও এবং জেনে রাখ,বেহেশত হচ্ছে ঐসব তরবারির ছায়ায় যেসব সত্য,ন্যায় ও মুক্তির পথে উন্মুক্ত করা হয়। 128


13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53