চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড5%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81867 / ডাউনলোড: 7552
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

সাফল্যজনক প্রতিরক্ষা লড়াই ও পুনঃ বিজয়

ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যায়কে যদি পুনঃবিজয় বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে অতিরঞ্জিত কিছু বলা হবে না। এ বিজয় বলতে আমরা এ কথাই বুঝাতে চাই যে,মুসলমানরা শত্রুর প্রত্যাশার বিপরীতে মহানবীর জীবনকে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। মুসলিম বাহিনীর ভাগ্যে জুটে যাওয়া এটিই ছিল পুনঃবিজয়।

যদি এ বিজয়ে মুসলিম বাহিনীর সবাই অংশীদার বলে আখ্যায়িত করি,তা হলে মুসলিম বাহিনীর প্রতি সম্মান প্রদশর্ন হিসেবে তা যথার্থই হবে। কিন্তু এ বিজয়ের আসল দায়িত্ব বহন করেছেন গুটিকতক মুসলমান,যাঁরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর জীবন রক্ষা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মহাসম্পদ অক্ষত থাকা এবং হেদায়েতের এই আলোকবর্তিকা নির্বাপিত না হওয়া এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির ত্যাগের ফল ছিল।

এখন এই আত্মত্যাগী মহান ব্যক্তিগণের সম্পর্কে কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করছি :

১. (উহুদের রণাঙ্গনে) প্রথম ব্যক্তি যিনি অবিচল ও দৃঢ়পদ ছিলেন তিনি ছিলেন সেই তরুণ,যাঁর জীবনের মাত্র ২৪টি বসন্ত অতিক্রম হয়েছিল এবং জীবনের শুরু থেকে মহানবীর ওফাতের দিন পর্যন্ত তাঁর পাশেই ছিলেন এবং এক মুহূর্তও তাঁর সাহচর্য ও তাঁর জন্য আত্মত্যাগ থেকে বিরত হন নি।

এই বীর সেনাপতি,এই প্রকৃত আত্মত্যাগী ছিলেন মুত্তাকীদের মওলা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর আত্মত্যাগ ও অবদানের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

মূলত এই পুনর্বার বিজয় সেই প্রথম বিজয়ের মতোই এই জান-নিসার বীর যোদ্ধার ত্যাগ ও বীরত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। কেননা যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের পলায়নের কারণ ছিল এই যে,তাদের পতাকাবাহীরা একের পর এক আলীর তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল। ফলে কুরাইশ বাহিনীর অন্তরে প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়েছিল এবং তাদের অটল থাকার শক্তি লোপ পেয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণকারী সমসাময়িক মিশরীয় লেখকগণ,হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদা যতখানি প্রাপ্য বা অন্ততপক্ষে ইতিহাসে যতখানি লিপিবদ্ধ হয়েছে,ততখানি হক আদায় করেন নি। তাঁরা আমীরুল মুমিনীনের আত্মত্যাগকে অন্যদের ত্যাগের পর্যায়ভুক্ত করেছেন। এ কারণে হযরত আলীর আত্মত্যাগের বিবরণ এখানে দেয়া সমীচীন মনে করছি।

১. ইবনে আসীর তাঁর ইতিহাসে৪৬ লিখেছেন : মহানবী (সা.) সবদিক থেকে কুরাইশ বাহিনীর বিভিন্ন দলের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। যে দলই হযরতের ওপর আক্রমণ চালাতো,হযরত আলী মহানবীর নির্দেশে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতেন এবং তাদের কতিপয় লোককে হত্যা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতেন। উহুদ যুদ্ধে এ ঘটনার কয়েকবার পুনরাবৃত্তি হয়। এ আত্মত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে ওহীর ফেরেশতা আগমন করেন এবং মহানবীর কাছে হযরত আলীর আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন এবং বলেন : এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ যা এ বীর সেনানায়ক তাঁর নিজ থেকে প্রদর্শন করেছেন। মহানবীও ওহীর বাহক ফেরেশতার উক্তি সত্যায়ন করে বলেন : আমি আলী হতে এবং সে আমা হতে। এরপর রণাঙ্গনে একটি আহবান-ধ্বনি শোনা গেল,যার বিষয়বস্তু হচ্ছে এ দু টি বাক্য :

لا سيف إلّا ذو الفقار لا فتى إلّا علىّ

অর্থাৎ একমাত্র যে তরবারী যুদ্ধে অবদান রাখতে পারে,তা হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিবের তরবারী,আর আলীই হচ্ছে একমাত্র বীর জোয়ান।

ইবনে আবীল হাদীদ ঘটনাপ্রবাহের আরো বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং বলেছেন : যারা মহানবী (সা.)-কে হত্যা করার জন্য আক্রমণ করছিল,তাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ। আলী বাহন পশুর উপর সওয়ার না হয়ে পায়ের উপর দাঁড়িয়েই তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করছিলেন। এরপর হযরত জিবরীলের অবতরণের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন : এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়াও আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রচিত গায্ওয়া (য্দ্ধু) সম্পর্কিত গ্রন্থের কয়েকটি হস্তলিখিত অনুলিপিতে জিবরীলের অবতরণের বিষয়টি দেখতে পেয়েছি। এমনকি একদিন আমার শিক্ষক আবদুল ওয়াহাব সাকীনার কাছে এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা সঠিক। আমি তাঁকে বললাম : এ সত্য ঘটনা সিহাহ্ সিত্তার৪৭ গ্রন্থকারগণ কেন লিখেন নি?”   তিনি উত্তরে বলেছিলেন : অনেক সহীহ্ রেওয়ায়েত আছে যেসব উল্লেখ করার ব্যাপারে সিহাহ্-এর গ্রন্থকারগণ অবহেলা করেছেন। ৪৮

২. আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) তাঁর একদল অনুসারীর উপস্থিতিতে রা স-উল ইয়াহুদে যে দীর্ঘ ভাষণ পেশ করেন,তাতে নিজের আত্মত্যাগের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেছিলেন : কুরাইশ বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আনসার ও মুহাজিররা তাদের বাড়ির পথ ধরে ছুটে পালিয়েছিল। আর তখন আমি সত্তরটি জখম নিয়ে মহানবী (সা.)-এর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর তিনি আমার জামা উঠিয়ে ক্ষতস্থানগুলোর উপর হাত বুলিয়ে দেন যেগুলোর চিহ্ন (তখনও) বিদ্যমান ছিল।৪৯

এমনকি এলালুশ শারায়ে গ্রন্থে শেখ সাদুক-এর বর্ণনা অনুযায়ী আলী (আ.) মহানবীর (সা.) জীবন রক্ষা করার সময় এতটা ত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন যে,তাঁর তরবারী ভেঙে যায় এবং মহানবী (সা.)তাঁর তরবারি যুলফিকার তাঁকে দান করেন। সেই তরবারি নিয়েই তিনি মহান আল্লাহর পথে জিহাদ চালিয়ে যান।

ইবনে হিশাম তাঁর স্বনামধন্য সীরাত গ্রন্থে৫০ মুশরিক বাহিনীর নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বাইশ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের নাম ও গোত্র-পরিচয় ইত্যাদি লিখেছেন। এদের মধ্যে বারো জন আলীর হাতে নিহত হয়েছিল। বাকীরা অন্যান্য মুসমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। উল্লিখিত সীরাত লেখক নিহতদের নাম ও পরিচয় বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা সংক্ষিপ্ততার জন্য আর বেশি লিখছি না।

আমরা স্বীকার করছি,আহলে সুন্নাহ্ ও শিয়াদের গ্রন্থসমূহে,বিশেষ করে বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে৫১ হযরত আলী ( আ.)-এর অবদান সংক্রান্ত যে বর্ণনা রয়েছে,এখানে তা উল্লেখ করতে পারি নি। এ ব্যাপারে যে সব বিক্ষিপ্ত রেওয়ায়েত ও বর্ণনা রয়েছে,সেসব পর্যালোচনা করার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে,উহুদ যুদ্ধে তাঁর মতো কেউ দৃঢ়পদ থাকেন নি।

২. আবু দুজানাহ্ : তিনি হচ্ছেন আমীরুল মুমিনীনের পর দ্বিতীয় সৈনিক,যিনি মহানবীর প্রতিরক্ষায় এমন ভূমিকা পালন করেন যে,তিনি নিজেকে মহানবীর ঢালে পরিণত করেন। তাঁর পিঠের উপর তীর বিদ্ধ হচ্ছিল। এভাবে তিনি মহানবীকে তীরের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রক্ষা করেন। মরহুম সেপেহের প্রণীত নাসিখুত্ তারিখ গ্রন্থে আবু দুজানাহ্ সম্পর্কে একটি বাক্য আছে। এ কথার সূত্র ও প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় নি। তিনি লিখেছেন৫২ :

মহানবী (সা.) ও আলী যখন মুশরিকদের অবরোধের মধ্যে পড়েছিলেন,তখন আবু দুজানার প্রতি মহানবীর দৃষ্টি পড়ে এবং তিনি তাঁকে বলেন : আবু দুজানাহ্! আমি তোমার কাছ থেকে আমার বাইয়াত ফেরৎ নিলাম;তবে আলী আমা হতে আর আমি আলী হতে। আবু দুজানাহ্ তীব্রভাবে কাঁদলেন এবং বললেন : আমি কোথায় যাব,আমার স্ত্রীর কাছে যাব,সে তো মৃত্যুবরণ করবে;আমি কি আমার বাড়িতে ফিরে যাব;তা তো বিরান হয়ে যাবে;আমার ধন-সম্পদের দিকে যাব,তা তো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মৃত্যুর দিকেই ছুটে যাব,যা আমার দিকে এসে পৌঁছবে।

আবু দুজানার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। তাঁর প্রতি মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি পড়লে তিনি তাঁকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেন আর তিনি ও আলী কুরাইশদের একের পর এক আক্রমণ থেকে মহানবীকে হেফাযত করেন।

ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে আসিম ইবনে সাবিত,সাহাল ইবনে হুনাইফ,তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ প্রমুখের নামের উল্লেখ দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ,যে সব ব্যক্তিত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়পদ ছিলেন,তাঁদের সংখ্যা ছত্রিশ জন বলে উল্লেখ করেছেন। যা হোক,ইতিহাসের আলোকে যা নিশ্চিত,তা হচ্ছে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.),আবু দুজানাহ,হামযাহ্ এবং উম্মে আমের নামক একজন মহিলার দৃঢ়তা। এ চারজন ছাড়া বাকীদের দৃঢ়পদ থাকার বিষয়টি অনুমাননির্ভর। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তা মূল থেকেই সন্দেহযুক্ত।

৩. হামযাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব : মহানবী (সা.)-এর চাচা হামযাহ্ ছিলেন আরবের বীরকেশরী এবং ইসলামের একজন বিখ্যাত সেনানায়ক। তিনি সেই ব্যক্তিগণের অন্যতম,যাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মক্কায় অত্যন্ত নাযুক পরিস্থিতিতে মহানবীকে মূর্তিপূজারীদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন। কুরাইশদের সভায় আবু জাহল মহানবীর অবমাননা করেছিল এবং তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছিল,তার প্রতিশোধস্বরূপ তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঐ সময় তাঁকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো ছিল না।

তিনি ছিলেন সেই বীরকেশরী,বদরের যুদ্ধে যিনি কুরাইশ বাহিনীর বীর অধিনায়ক শাইবাকে হত্যা করেন। এছাড়া অপর একদলকে হত্যা ও আরো কতককে আহত করেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল সত্যকে রক্ষা এবং মানব জীবনে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী,ওতবার মেয়ে হিন্দ মনে মনে হামযার প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,যে কোন মূল্যেই হোক,মুসলমানদের কাছ থেকে তার পিতার প্রতিশোধ নেবে।

ওয়াহ্শী ছিল এক হাবশী বীর যোদ্ধা। সে যুবাইর ইবনে মুতয়েমের ক্রীতদাস ছিল। যুবাইরের চাচাও বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। হিন্দের পক্ষ থেকে সে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল যে,সে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার মনের আশা পূরণ করবে। হিন্দ্ ওয়াহ্শিকে প্রস্তাব দিয়েছিল,আমার পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তোমাকে তিনজনের (মুহাম্মদ,আলী ও হামযাহ্) মধ্যে যে কোন একজনকে হত্যা করতে হবে। বীর ওয়াহ্শী জবাবে বলেছিল : আমি কখনোই মুহাম্মদের নাগাল পাব না। কেন না তার সাহাবীরা যে কারো চাইতে তার নিকটবর্তী। আলীও যুদ্ধের ময়দানে অসম্ভব রকমের সজাগ। কিন্তু যুদ্ধের সময় হামযার ক্রোধ ও উত্তেজনা এত প্রবল থাকে যে,লড়াই চলাকালীন তার আশপাশে কি হচ্ছে,সে তা বুঝতে পারে না। হয় তো আমি তাকেই ধোঁকায় ফেলে হত্যা করতে পারব। হিন্দ্ ঐটুকুতেই রাজি হয়ে যায়। তাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়,এক্ষেত্রে যদি সে সফল হয়,তা হলে তাকে মুক্তি দান করবে।

একদল মনে করেন,যুবাইর নিজেই তার গোলামের সাথে এ চুক্তি সম্পাদন করে। কেননা,বদর যুদ্ধে তার চাচা নিহত হয়েছিল। হাবশী গোলাম ওয়াহ্শী নিজেই বলেছে : উহুদের দিন আমি কুরাইশের বিজয় লাভের সময়টিতে হামযার খোঁজে ছিলাম। তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের মতো প্রতিপক্ষের ব্যূহের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং তাঁর সামনে যে-ই আসছিল,তাকেই তিনি ধরাশায়ী করছিলেন। আমি এমনভাবে গাছ ও পাথরের পেছনে লুকিয়ে রইলাম যে,এর ফলে তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি তুমুল লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। আমি আমার গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি হাবশী ছিলাম বিধায় হাবশীদের মতোই বর্শা নিক্ষেপ করতাম। এজন্য তা খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। এ কারণে আমি একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে বিশেষ এক ভঙ্গিতে দুলিয়ে তাঁর দিকে আমার দুই ফলা বিশিষ্ট বর্শা নিক্ষেপ করলাম। বর্শা তাঁর পাঁজর ও জঙ্ঘার মধ্যবর্তী পার্শ্বদেশে আঘাত করল এবং তাঁর দু পায়ের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি আমার ওপর আক্রমণ করতে চাইলেন;কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা তাঁকে এই সুযোগ দেয় নি। ঐ অবস্থায় তিনি পড়ে রইলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর প্রাণ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর আমি খুব সতর্কতার সাথে তাঁর দিকে গেলাম। আমার বর্শাটি বের করে এনে কুরাইশ বাহিনীর শিবিরে ফিরে গেলাম;আর নিজের মুক্তির জন্য দিন গুণতে লাগলাম।

উহুদ যুদ্ধের পর বহু দিন আমি মক্কায় ছিলাম। অতঃপর মুসলমানরা মক্কা জয় করলে আমি তায়েফে পালিয়ে গেলাম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামের কর্তৃত্ব সেখান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আমি শুনতে পেয়েছিলাম,যে যত মারাত্মক অপরাধীই হোক না কেন,যদি ইসলাম গ্রহণ করে,মহানবী (সা.) তার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। আমি মুখে কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে মহানবী সকাশে উপস্থিত হলাম। মহানবীর দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। তিনি বললেন : তুমি কি সেই হাবশী ওয়াহ্শী? আমি বললাম : জ্বি হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কিভাবে হামযাহকে হত্যা করেছ? আমি হুবহু ঘটনাটি বললাম। মহানবী খুবই মর্মাহত হলেন এবং বললেন : যতদিন জীবিত আছ,ততদিন আমি যেন তোমার চেহারা না দেখি। কেননা আমার চাচাকে হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা তোমার দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে। ৫৩

এ হচ্ছে নবুওয়াতের সেই মহান আত্মা এবং অন্তরের সীমাহীন প্রশস্ততা,যা স্বয়ং মহান আল্লাহ্ ইসলামের সুমহান নেতাকে দান করেছেন। তিনি বহু অজুহাত দাঁড় করিয়ে আপন চাচার হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দিতে পারতেন। কিন্তু এরপরও তাকে মুক্ত করে দেন। ওয়াহ্শী বলেছে : মহানবী (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন,আমি তাঁর সামনে থেকে আমার চেহারা লুকিয়ে রাখতাম। মহানবীর ইন্তেকালের পর নবুওয়াতের দাবীদার ভণ্ড মুসাইলিমা কায্যাব-এর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আমি ইসলামী সেনাবাহিনীতে যোগদান করলাম। আমি মুসাইলিমাকে হত্যার জন্য সেই যুদ্ধাস্ত্রটি ব্যবহার করলাম। একজন আনসারের সহায়তায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হলাম। আমি যদি এ অস্ত্র দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি হামযাহ্ কে হত্যা করে থাকি,নিকৃষ্টতম ব্যক্তি মুসাইলিমাও তো এ অস্ত্রের বিপদ থেকে রক্ষা পায় নি।

মুসাইলিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াহ্শীর অংশগ্রহণের বিষয়টি তার নিজের দাবীমাত্র। তবে ইবনে হিশাম বলেন,ওয়াহ্শী জীবনের শেষপ্রান্তে একটি কালো কাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। মদ পানের কারণে সে মুসলমানদের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল এবং তাকে প্রায় সময়ে মদ পানের দায়ে বেত্রাঘাত করা হতো। বারবার মন্দ কাজের জন্য সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে তার নাম কেটে দেয়া হয়। উমর ইবনে খাত্তাব বলতেন,হামযার হত্যাকারী আখেরাতে অবশ্যই সফলকাম হবে না।৫৪

৪. উম্মে আমের : এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অবকাশ নেই যে,ইসলামে মহিলাদের জন্য জিহাদ নিষিদ্ধ। এ কারণে যখন মদীনার মহিলাদের প্রতিনিধি মহানবীর নিকট উপস্থিত হন,তখন তাঁরা এই বঞ্চনার ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলেন এবং অভিযোগ করেন : আমরা সাংসারিক জীবনে স্বামীদের জন্য সকল কাজ সম্পাদন করি। আর তারা নিশ্চিন্তে জিহাদে অংশগ্রহণ করে;অথচ আমরা নারী সমাজ এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

মহানবী (সা.) তাঁর মাধ্যমে মদীনার নারী সমাজের প্রতি বার্তা পাঠান : তোমরা যদিও কতক সৃষ্টিগত ও সামাজিক কারণে এই মহা সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়েছ;কিন্তু তোমরা সাংসারিক ও বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জিহাদের সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম। অতঃপর তিনি এই ঐতিহাসিক উক্তি করেন :و إنّ حُسن التّبعّل يعدل ذلك كلّه সুচারুরূপে ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনই জিহাদের সমকক্ষ। তবে কখনো কখনো কিছু অভিজ্ঞ নারী ইসলামের যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য তাঁদের সাথে মদীনার বাইরে আসতেন। তাঁরা পিপাসার্তদের পানি পান করানো,সৈনিকদের কাপড় ধোয়া ও আহতদের সেবা করার মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় লাভে সাহায্য করতেন।

উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। তিনি বলেন : আমি ইসলামের মুজাহিদগণের পানি সরবরাহের জন্য উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আমি দেখতে পেলাম,বিজয়ের হাওয়া মুসলমানদের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ মোড় ঘুরে গেল। মুসলমানরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। মহানবী (সা.)-এর প্রাণ নিয়ে আশংকা দেখা দিল। আমি নিজ দায়িত্ব মনে করলাম যে,জীবন যতক্ষণ আছে,মহানবীর প্রাণ রক্ষা করব। পানির মশক মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। একটি তরবারি সংগ্রহ করে নিয়ে শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করলাম। কখনো কখনো তীর নিক্ষেপ করছিলাম। এ ঘটনা ঘটার সময় তাঁর কাঁধে যে ক্ষত হয়েছিল,তা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : লোকেরা যখন শত্রুবাহিনীর বিপরীত দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল,তখন পলায়নরত এক ব্যক্তির উপর মহানবীর দৃষ্টি পড়ে। তিনি বললেন : এখন যে পালিয়ে যাচ্ছ,অন্তত তোমার ঢালটি ফেলে যাও। সে ঢালটি মাটিতে ফেলে দিল। আমি সেই ঢালটি নিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ইবনে কুমিআ নামক এক ব্যক্তি সজোরে চিৎকার দিয়ে বলছে,মুহাম্মদ কোথায় আছে? সে মহানবীকে চিনতে পেরে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ করতে আসে। আমি ও মুসআব তাকে তার লক্ষ্যের দিকে যেতে বাধা দিলাম। সে আমাকে পেছনে তাড়ানোর জন্য আমার কাঁধের উপর একটি আঘাত করে। আমি যদিও তাকে কয়েক বার আঘাত করেছি;কিন্তু তার আঘাত আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিল,যা এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তার শরীরে দু টি বর্ম ছিল। এজন্য আমার আঘাত তার ওপর কার্যকর প্রভাব রাখে নি।

আমার কাঁধের ওপর যে আঘাত লাগে,তা খুবই মারাত্মক ছিল। মহানবী (সা.) আমার আঘাতের কথা বুঝতে পারেন। তিনি দেখতে পেলেন,তা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার এক ছেলেকে ডেকে বললেন : তোমার মায়ের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দাও। সে আমার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। আমি আবার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত হলাম।

এর মধ্যে আমি দেখতে পেলাম,আমার এক ছেলে আহত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ আহতদের পট্টি বাঁধার জন্য যে কাপড় সাথে এনেছিলাম,তা দিয়ে আমার ছেলের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলাম। এ সময় মহানবীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির দিকে আমার ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করে

বললাম :قم فضارب القوم হে বৎস! ওঠ,যুদ্ধে অবতীর্ণ হও।

মহানবী (সা.) এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য বিস্ময়বোধ করলেন। যখনই তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন,তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক। প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী,যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল,এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে,তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল। এবার মহিলার বীরত্বের ব্যাপারে মহানবীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি বিস্ময়ে হেসে ফেললেন এমনভাবে যে,তাঁর পেছনের সারির দাঁতগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তিনি বললেন : তোমার সন্তানের যথার্থ প্রতিশোধ নিয়েছ। ৫৫

পরের দিন যখন মহানবী (সা.) তাঁর সেনাদলকে হামরাউল আসাদ -এর দিকে পরিচালিত করলেন,নাসীবাও সেনাবাহিনীর সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হবার কারণে তাঁকে যাবার অনুমতি দেয়া হয় নি। মহানবী হামরাউল আসাদ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে এক ব্যক্তিকে নাসীবার ঘরে পাঠান যাতে তিনি নাসীবার অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবগত করেন। মহানবী তাঁর সুস্থতার সংবাদ পেয়ে খুশী হন।

এই নারী এত ত্যাগের বিনিময়ে মহানবীর কাছে আবেদন করেন,যাতে তিনি তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন,মহান আল্লাহ্ যেন তাঁকে বেহেশতে মহানবীর নিত্য সহচর করেন। মহানবীও তাঁর জন্য দুআ করেন এবং বলেন : হে আল্লাহ্! এদেরকে বেহেশতে আমার সাথী করে দিন। ৫৬

এই মহিয়সী নারীর বীরত্বের দৃশ্য মহানবীকে এতখানি আনন্দিত করে যে,তিনি এই মহিলা সম্পর্কে বলেছিলেন :لمقام نسيبة بنت كعب اليوم خير من فلان و فلان আজ নাসীবা বিনতে কা ব-এর মর্যাদা অমুক অমুকের চাইতে শ্রেষ্ঠ।

ইবনে আবীল হাদীদ লিখেছেন,হাদীস বর্ণনাকারী মহানবীর প্রতি খেয়ানত করেছেন। কেননা এ দু ব্যক্তির নাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন নি।৫৭ তবে আমি মনে করি,অমুক অমুক বলতে ঐ লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,যাঁরা রাসূলের পরে মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন;বর্ণনাকারী তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাজনিত ভীতির কারণেই কথাটি অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন।

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53