চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড3%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 84020 / ডাউনলোড: 7998
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

দোয়াত ও কলম নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য একটি পত্র লিখে দিতে পারি

খিলাফত কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর ঘরের বাইরে যে সব তৎপরতা চলছিল, সে ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ কারণে তিনি মতবিরোধের উদ্ভব ঠেকানো এবং তাঁর মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটার আগেই তা রোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর আহলে বাইতের খিলাফতের ভিত্তি লিখিত আকারে মজবুত করবেন এবং খিলাফত প্রসঙ্গে একখানা জীবন্ত দলিল রেখে যাবেন।

এ কারণেই যেদিন নেতৃত্বাস্থানীয় সাহাবীগণ তাঁকে দেখার জন্য আসেন, সেদিন তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : আমার জন্য কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য কিছু বিষয় লিখে দিতে পারি যে, এরপর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”৫৪৯

ইবনে আব্বাস এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন : এটাই ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ যে একদল সাহাবীর মত-পার্থক্য ও ঝগড়া-বিবাদ মহানবী (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত পত্র লেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।”৫৫০

বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এর অর্থ ছিল তিনি পত্রের বিষয়বস্তু মুখে বলবেন এবং তাঁর একজন লেখক তা লিপিবদ্ধ করবেন। আর তা না হলে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো কলম হাতে নেন নি এবং এক লাইনও লিখেন নি। অধিক স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমার প্রণীত দার মাকতাবে ওয়াহী’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন।

এ ঐতিহাসিক ঘটনা একদল সুন্নী ও শিয়া হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবিদ্যার নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ প্রধানত হযরত উমরের উক্তি অর্থগতভাবে উদ্ধৃত করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাঁর ধৃষ্টতামূলক উক্তির মূল পাঠ ব্যক্ত করেন নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, হযরত উমরের উক্তি উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকা এজন্য নয় যে, ধৃষ্টতার কথা উল্লেখ করা আসলে মহানবী (সা.)-এর প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন; বরং দ্বিতীয় খলীফার মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাঁর উক্তিতে হাত দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তন করা হয়েছে, পাছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর অবমাননাকর উক্তি শুনে তাঁর ব্যাপারে হতাশ না হয় (এবং কুধারণা পোষণ না করে)।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আস সাকীফাহ্’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু বকর জওহারী যখন তাঁর গ্রন্থে এ অধ্যায়ে উপনীত হন, তখন তিনি হযরত উমরের উক্তিটি এভাবে বর্ণনা করেন :

و قال عمر كلمة معناها أنّ الوجع قد غلب علي رسول الله

এবং হযরত উমর একটি কথা বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর ওপর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়েছে।”৫৫১

তবে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাদের মধ্য থেকে যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় খলীফার উক্তির মূল পাঠ হুবহু উদ্ধৃত করতে চান, তখন তাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন এবং এতটুকু লিখেন :فقالوا هجر رسول الله অতঃপর তারা বলল : রাসূলুল্লাহ্ রোগের কারণে প্রলাপ বকেছেন।”৫৫২

নিশ্চিতভাবে এ ধরনের অশালীন ও জঘন্য উক্তি যে কোন ব্যক্তিরই হয়ে থাকুক না কেন, তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। কারণ পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য অনুসারে মহানবী (সা.) সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত এবং তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলেন না।

নিষ্পাপ নবীর সান্নিধ্যে সাহাবীদের বিবাদ এতটা বিরক্তিকর ও মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কয়েকজন স্ত্রী পর্দার অন্তরাল থেকে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : কেন আপনারা মহানবীর নির্দেশ অমান্য করছেন? দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর তাঁদেরকে চুপ করানোর জন্য বলেছিলেন : আপনারা হযরত ইউসুফের সঙ্গীদের স্ত্রীদের সদৃশ। যখন মহানবী অসুস্থ হন, তখন আপনারা তাঁর জন্য নিজেদের নয়নগুলোয় চাপ দেন (অশ্রুপাত করেন) এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তখন আপনারা তাঁর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।”৫৫৩

কতিপয় গোঁড়া ব্যক্তি বাহ্যত দ্বিতীয় খলীফার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন।৫৫৪ তবে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে তাঁরা তাঁকে এ কাজের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন এবংحسبنا كتاب الله (মহান আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট)- তাঁর এ উক্তিকে তাঁরা অসার গণ্য করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন, ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত এবং পবিত্র কুরআন কখনোই উম্মতকে মহানবীর হাদীস ও বাণীসমূহের ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করে নি।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মুহাম্মদের জীবনী’ গ্রন্থের রচয়িতা ড. হাসানাইন হাইকাল ইশারা-ইঙ্গিতে দ্বিতীয় খলীফার এ কাজ সমর্থন করে লিখেছেন : এ ঘটনার পর ইবনে আব্বাস বিশ্বাস করতেন, মহানবী (সা.) যে বিষয়টি লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লেখার ক্ষেত্রে বাধা দান করে মুসলমানরা আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে হারিয়েছে। কিন্তু হযরত উমর তাঁর বিশ্বাসের ওপর বহাল থেকেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :

) ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء(

আমরা পবিত্র কুরআনে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ সবকিছু এ গ্রন্থে বর্ণনা করেছি)। ৫৫৫

তিনি যদি এ আয়াতের আগের ও পরের অংশের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তা হলে তিনি কখনোই এ আয়াতের এ রকম অপব্যাখ্যা করতেন না এবং নিষ্পাপ মহানবীর বিপরীতে হযরত উমরের এ কাজ সমর্থন করতেন না। কারণ আয়াতে উল্লিখিত কিতাব বা গ্রন্থের অর্থ বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ এবং অস্তিত্বের পত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর এ অস্তিত্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আসলে সৃষ্টিগ্রন্থের এক একটি পৃষ্ঠা এবং সমগ্র সৃষ্টি এ সৃষ্টিগ্রন্থের সমুদয় পৃষ্ঠাতুল্য।

) و ما من دابّة فِى الأرض و لا طائر يطير بجناحيه الّا أمم أمثالكم ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء ثمّ الى ربّهم يُحشرون(

“পৃথিবীতে (বিচরণকারী) প্রতিটি জীব-জন্তু এবং (আকাশে) স্বীয় ডানা মেলে উড্ডয়নকারী প্রতিটি বিহঙ্গ তোমাদের মতোই এক একটা প্রজাতি (أمم ), আমরা (সৃষ্টি) গ্রন্থে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ আমরা এ সৃষ্টিলোকে যা যা সৃষ্টি করা সম্ভব, সেগুলো সবই সৃষ্টি করেছি) এবং সব কিছুই তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সূরা আনআম : ৩৮)

যেহেতু আমরা এ গ্রন্থের মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি’- এ বাক্যের আগের বাক্য জীবকূল ও পক্ষীকূল’ সৃষ্টি করার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এর পরের বাক্য কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত করণ প্রক্রিয়া বা হাশরের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়াতে উল্লিখিত গ্রন্থ’ যার মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয় নি, তা বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ (সৃষ্টিগ্রন্থ) এবং অস্তিত্বের পত্রকেই বোঝানো হয়েছে।

অধিকন্তু আমরা যদি মেনেও নিই যে, আয়াতের গ্রন্থ’ শব্দ আসলে পবিত্র কুরআন, তা হলে পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে এ গ্রন্থ বোঝার জন্য মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও দিক-নির্দেশনা আবশ্যক।

) و أنزلنا إليك الذّكر لتبيّن للنّاس ما نزل إليهم(

“আর আমরা আপনার কাছে এ স্মরণ’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি জনগণের কাছে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।” (সূরা নাহল : ৪৪)

এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতেلتقرأ অর্থাৎ যাতে আপনি পাঠ করেন’ বলেন নি, বরং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেনلتبيّن অর্থাৎ যাতে আপনি ব্যাখ্যা করেন । সুতরাং মহান আল্লাহর গ্রন্থই যদি মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবুও মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি এ গ্রন্থের তীব্র প্রয়োজন রয়েছে।৫৫৬

উম্মত যদি এ ধরনের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্রের মুখাপেক্ষী না-ই হতো, তা হলে যখন ইসলাম ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস (রা.)-এর গণ্ডদেশ বেয়ে মুক্তার মতো অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকত, তখন কেন তিনি বলতেন :

يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ جعل تسيل دموعه حتّي رؤيت علي خدّيه كأنها نظام اللؤلؤ قال رسول الله : ايتونِى بالكتف و الدّواة أو اللوح و الدّواة اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً فقالوا...

“হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! এরপর তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল; আর তাঁর গণ্ডদেশদ্বয়ের উপর তা মুক্তার মতো দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন : মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার কাছে তোমরা কাঁধের হাড় ও দোয়াত বা কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো। তা হলে আমি তোমাদের জন্য এমন একটি পত্র (নির্দেশনামা) লিখে দেব যে, এরপর তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর একদল লোক বলল : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ৫৫৭ ...

এ ধরনের তীব্র শোক যা ইবনে আব্বাস প্রকাশ করেছেন, তা সত্বেও এবং মহানবী (সা.) নিজেই যে তাকীদ দিয়েছেন তার ভিত্তিতে কিভাবে এ কথা বলা সম্ভব যে, পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর এ পত্রের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে অমুখাপেক্ষী করেছে?

এখন যখন মহানবী (সা.) এ ধরনের একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করাতে পারলেন না, তখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের ভিত্তিতে কি ধারণা করা সম্ভব যে, এ নির্দেশনা লেখানোর পেছনে মহানবীর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

এ পত্রের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

পবিত্র কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে নতুন অথচ দৃঢ় পদ্ধতি,- যা বর্তমানে সকল গবেষক ও আলেমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,- হচ্ছে কোন একটি বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতের দ্ব্যর্থবোধকতা ও সংক্ষিপ্ততা ঐ একই বিষয়ে অবতীর্ণ অপর কোন আয়াতের মাধ্যমে দূর করা হয়, যা অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর পারিভাষিক অর্থে আমরা এভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াতকে অপর এক আয়াতের সাহায্যে তাফসীর (ব্যাখ্যা) করি।

এ পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যার সাথেই একান্তভাবে শুধু সংশ্লিষ্ট নয়, বরং হাদীসসমূহের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাই এক হাদীসের সাহায্যে অনুরূপ আরেক হাদীসের সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা যায়। কারণ আমাদের মহান ইমামগণ সংবেদনশীল ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপকারী ও পুনরাবৃত্তিমূলক অনেক বক্তব্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যার সবই অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের ও একই পর্যায়ের নয়; কখনো কখনো সেসব অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার; আবার কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও লক্ষ্য ইশারা-ইঙ্গিতে বর্ণনা করতে হয়েছে।

বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) রোগশয্যায় শায়িতাবস্থায় একটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য সাহাবীগণকে কাগজ-কলম আনার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়েও দেন, এ নির্দেশনামার কারণে তারা কখনো পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়বে না।৫৫৮ অতঃপর মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তিনি ঐ চিঠি বা প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্র লেখানো থেকে বিরত থাকেন।

এ ক্ষেত্রে কেউ হয় তো প্রশ্ন করতে পারে, যে পত্র মহানবী (সা.) লেখাতে চেয়েছিলেন, তা কী প্রসঙ্গে ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। কারণ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তার আলোকে অবশ্যই বলা যায়, আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ওয়াসায়াত এবং খিলাফত দৃঢ়ীকরণ এবং তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তুলে ধরা ছাড়া মহানবীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ বিষয় হাদীসে সাকালাইন বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, হাদীসে সাকালাইনের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকল হাদীসবিশারদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) যে পত্র লিখাতে চেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বলেছেন : যাতে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হও, সেজন্য আমি এ পত্রটি লিখাচ্ছি।” আর হাদীসে সাকালাইনেও তিনি হুবহু এ বাক্যই (অর্থাৎ আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না) বলেছেন এবং কিতাব ও তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার কারণ তিনি এটাই বিবেচনা করেছেন যে, এ দুই মূল্যবান ও ভারী বিষয়ের অনুসরণই হচ্ছে পথভ্রষ্ট না হবার কারণ।

انّى تارك فيكم الثّقلين ما ان تمسّكتم بِهما لن تضلّوا : كتاب الله و عترتى اهل بيتِى

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত এ দু টি তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুই অতি মূল্যবান জিনিস হচ্ছে : মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত)।”

এ দুই হাদীসের৫৫৯ শব্দমালা এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কি যে, কাগজ ও কলম চাওয়ার পেছনে মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল হাদীসে সাকালাইনের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বা এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর চেয়েও উন্নত কিছু লিপিবদ্ধ করা; আর তা ছিল মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী ও উত্তরাধিকারীর বেলায়েত (নেতৃত্ব) এবং ওয়াসায়াত দৃঢ়ীকরণ যা ১৮ যিলহজ্ব ইরাক, মিশর ও হিজাযের হাজীগণের পৃথক হবার স্থান গাদীরে খুমের মহাসমাবেশে মৌখিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল?

এছাড়াও যে ব্যক্তি মহানবীর ওফাতের পরপর সাকীফায়ে বনী সায়েদায় খিলাফতের জন্য শূরা বা পরামর্শসভার আয়োজন করে নিজের পুরনো বন্ধুকে বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে খিলাফতের জন্য প্রার্থী করেছিলেন এবং তাঁর বন্ধু নিজের মৃত্যুকালে তাঁকে তাঁর সেবার নগদ পুরস্কারও দিয়েছিলেন এবং তাঁকে সকল মূলনীতির বিপরীতে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেছিলেন, সেই ব্যক্তির দুর্দমনীয় বিরোধিতা এ বিষয়ের সাক্ষী যে, মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা এবং তাঁর কাছে সাহাবীগণের এ সমাবেশে এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান ছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.) খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভারের ব্যাপারে কিছু কথা লিখাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি (হযরত উমর) কাগজ-কলম আনার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। আর তা না হলে এতটা জবরদস্তির কোন কারণ থাকত না।

মহানবী (সা.) কেন এ পত্র লেখার ব্যাপারে আর তাকীদ দিলেন না?

মহানবী (সা.) যিনি তাদের বিরোধিতা সত্বেও নিজ সচিবকে ডেকে এ পত্র লেখাতে পারতেন, তিনি কেন (ঐ পত্র লেখানোর ক্ষেত্রে) শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন?

এ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট। কারণ মহানবী (সা.) যদি এ পত্র লেখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করতেন, তা হলে যারা বলেছিলেন যে, রোগযন্ত্রণা মহানবীর ওপর প্রবল হয়েছে’, তারাই মহানবীর সাথে আরো বেয়াদবীর চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করত এবং তাদের সমর্থকরাও জনগণের মধ্যে তা রটনা করে তাদের দাবী প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এ অবস্থায় মহানবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আচরণের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেত ও অব্যাহত থাকত, তেমনি মহানবীর পত্রের কার্যকারিতাও আর থাকত না। এ কারণেই কেউ কেউ যখন তাদের বেয়াদবী ও মন্দ আচরণ লাঘব করার জন্য মহানবীর কাছে বলেছিলেন : আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আমরা কাগজ-কলম নিয়ে আসি? তখন তাঁর চেহারা প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ছিল, তা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাদের বলেছিলেন : এতসব কথা-বার্তার পর তোমরা কাগজ-কলম আনতে চাচ্ছ? কেবল এতটুকু তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, আমার বংশধরদের সাথে সদাচরণ করবে।” এ কথা বলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং আলী, আব্বাস ও ফযল ব্যতীত তারা সবাই সেখান থেকে উঠে চলে যায়।৫৬০

অন্তিম পত্র লিখতে না পারার ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টা

কতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা যদিও মহানবীকে পত্র লেখার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তবুও তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতিতে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) রোগযন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্বেও এক হাত আলীর কাঁধে এবং অন্য হাত মায়মুনার কাঁধের উপর রেখে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষকারী তীব্র কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিম্বারে আরোহণ করেন। জনতার নয়ন অশ্রুজলে ভিজে গিয়েছিল এবং মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। জনতা তখন মহানবীর সর্বশেষ বাণী ও উপদেশাবলী শোনার অপেক্ষা করছিল। মহানবী (সা.) সভাস্থলের নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন : আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল : ঐ দুই মূল্যবান জিনিস কী? (উষ্মায়) মহানবীর মুখমণ্ডল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন : আমি নিজেই এর ব্যাখ্যা দেব; তাই প্রশ্ন করার কোন কারণ নেই।” অতঃপর তিনি বললেন : এক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং অন্যটি আমার বংশধর।”৫৬১

ইবনে হাজর আসকালানী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এ দু টি বর্ণনাই৫৬২ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। তিনি লিখেছেন : মহানবী (সা.) যখন অসুস্থ তখন কোন একদিন যখন সাহাবীগণ তাঁর বিছানার চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে মুখ করে বলেছিলেন : হে লোকসকল! আমার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় নেব। তোমরা জেনে রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। এরপর তিনি হযরত আলীর হাত ধরে তা উঁচুতে তুলে বললেন :

هذا علىّ مع القرآن و القرآن مع علىّ لا يفترقان

-এই আলী পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআন আলীর সাথে আছে। এরা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”৫৬৩

মহানবী (সা.) যদিও তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগে একাধিক উপলক্ষে৫৬৪ হাদীসে সাকালাইন বিভিন্ন আঙ্গিক ও ভাষাগত অবয়বে বর্ণনা করেছিলেন এবং এ দুই অতি মূল্যবান বিষয়ের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবু যেহেতু তিনি রোগশয্যায় শায়িত হয়ে আবারও পবিত্র কুরআন ও তাঁর বংশধরদের (ইতরাত) আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি তাঁর অন্তিম পত্র লেখার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই উপস্থিতিতে তিনি পবিত্র কুরআন ও ইতরাতের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু ধারণা করা যায়, হাদীসে সাকালাইনের পুনরাবৃত্তিই ছিল ঐ অন্তিম পত্রের শূন্যতা পূরণ করা, যা তিনি লিখতে পারেন নি।

দীনার বণ্টন

‘বাইতুল মাল’ সংক্রান্ত মহানবী (সা.)-এর নীতি ও পদ্ধতি এই ছিল যে, উপযুক্ত সময় ও সুযোগে প্রথমেই তিনি বাইতুল মালের সম্পদ দুঃস্থ, অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন এবং বাইতুল মালে দীর্ঘদিন সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। এ কারণেই রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁর এক স্ত্রীর কাছে কিছু দীনার গচ্ছিত থাকার কথা তাঁর স্মরণে আসামাত্রই তিনি তাঁর সামনে সেগুলো নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। দীনারগুলো তাঁর সামনে রাখা হলে তিনি সেগুলো হাতে নিয়ে বলেছিলেন :ما ظنّ محمّد بالله لو لقى الله و هذه عنده মহান আল্লাহ্ সম্পর্কে মুহাম্মদ কী ভাবছে, যখন সে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে, অথচ তার কাছে এগুলো এখনও রয়ে গেছে? এরপর তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে ঐ দীনারগুলো দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।৫৬৫

ঔষধ সেবন করানোর জন্য মহানবী (সা.)-এর তীব্র অসন্তোষ

আসমা বিনতে উমাইস মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী মাইমুনার একজন নিকটাত্মীয় ছিলেন। হাবাশায় (আবিসিনিয়া) অবস্থানকালে তিনি কয়েকটি উদ্ভিদের নির্যাস থেকে এক ধরনের ঔষধ প্রস্তুত করার পদ্ধতি শিখেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মহানবীর অসুস্থতা ফুসফুস ও বক্ষগহ্বরের আবরক ঝিল্লীর প্রদাহ-ঘটিত ব্যাধি (অর্থাৎ তিনি প্লুরিসি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন) এবং হাবাশায় এ ধরনের রোগের জন্য এ ঔষধ ব্যবহার করা হতো। আসমা মহানবীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন দেখতে পান এবং মহানবী তীব্র বেদনায় অচেতন হয়ে পড়লে তিনি ঐ ঔষধ বা সিরাপের কিছু অংশ মহানবীর মুখে ঢেলে দেন। জ্ঞান ফেরার পর মহানবী (সা.) ব্যাপারটি বুঝতে পারেন এবং রাগান্বিত হয়ে বলেন : মহান আল্লাহ কখনোই তাঁর রাসূলকে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত করেন না।”৫৬৬

সাহাবীগণের সাথে শেষ বিদায়

মহানবী (সা.) অসুস্থাবস্থায় কখনো কখনো মসজিদে যেতেন এবং মুসল্লীগণের সাথে নামায আদায় করতেন ও তাদেরকে কতিপয় বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতেন।

তাঁর অসুস্থতার কোন একদিন মাথায় একটি কাপড় দিয়ে পট্টি বাঁধা অবস্থায় আলী (আ.) ও ফযল ইবনে আব্বাস তাঁর বগলদ্বয়ের নিম্নদেশ ধরে রেখেছিলেন এবং তাঁর পদদ্বয় মাটির উপর দিয়ে হেঁচড়ে যাচ্ছিল। ঐ অবস্থায় তিনি মসজিদে প্রবেশ করে মিম্বারে আরোহণ করেন এবং ভাষণ শুরু করেন : হে লোকসকল! তোমাদের মধ্য থেকে আমার যাবার সময় চলে এসেছে। আমি যদি কাউকে কোন অঙ্গীকার করে থাকি, তা হলে তা পালন করার ব্যাপারে আমি প্রস্তুত। আর আমার কাছে যদি কারো পাওনা থেকে থাকে, তা হলে সে যেন তা আমাকে বলে এবং আমি তা প্রদান করব।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল : কিছু দিন আগে আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমি যদি বিয়ে করি, তা হলে আপনি আমাকে কিছু পরিমাণ অর্থ সাহায্য করবেন।” মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ ফযলকে ঐ ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিলেন এবং মিম্বার থেকে নেমে ঘরে চলে গেলেন। এরপর মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে শুক্রবার মহানবী (সা.) মসজিদে এসে ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণের মাঝে বললেন : আমার ওপর যদি কারো কোন হক (অধিকার) থেকে থাকে, তা হলে সে দাঁড়িয়ে তা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করুক। কারণ এ পৃথিবীতে কিসাস (প্রতিশোধ) গ্রহণ আমার কাছে আখেরাতে কিসাস গ্রহণের চেয়ে অধিকতর প্রিয়

 )القصاص فِى دار الدّنيا احبّ الَىّ من القصاص فِى دار الآخرة “ (

এ সময় সাওয়াদাহ্ ইবনে কাইস দাঁড়িয়ে বলল : তায়েফের জিহাদ থেকে ফেরার পথে আপনি একটি উটের পিঠে সওয়ার ছিলেন। ঐ সময় আপনার হাতের চাবুক উটের উপর আঘাত করার জন্য উঠিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে আমার পেটে ঐ চাবুকের আঘাত লেগেছিল। আমি এখন আমার কিসাস নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।”

মহানবী (সা.)-এর আহবান নিছক ভদ্রতামূলক সৌজন্য ছিল না, বরং তিনি এমনকি এ ধরনের অধিকারগুলো, যা কখনো জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে না৫৬৭ সেগুলো পর্যন্ত আদায় করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করতেন। মহানবী (সা.) তাঁর পরণের জামা উঠালেন যাতে করে সাওয়াদাহ্ তার কিসাস গ্রহণ করে। মহানবীর সাহাবীগণ দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও অশ্রুসজল চোখে, কাঁধ প্রসারিত করে এবং প্রাণ বিদীর্ণকারী কান্না বিজড়িত কণ্ঠে প্রতীক্ষা করছিলেন, এ ঘটনা কোথায় গিয়ে সমাপ্ত হয়! আসলেই কি সাওয়াদাহ্ প্রতিশোধ (কিসাস) গ্রহণ করবে? হঠাৎ সবাই দেখতে পেল, সাওয়াদাহ্ অনিচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মহানবী (সা.)-এর পেট ও বক্ষদেশ চুম্বন করছে। এ সময় মহানবী (সা.) সাওয়াদার জন্য দুআ করে বললেন : হে আল্লাহ্! সাওয়াদাহ্ যেভাবে নবীকে ক্ষমা করে দিয়েছে সেভাবে তাকে আপনিও ক্ষমা করে দিন।”৫৬৮

পঁয়ষট্টিতম অধ্যায় : একাদশ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

আরব বাহিনীর কতিপয় বীর যোদ্ধার পরিখা অতিক্রম

আমর ইবনে আবদে উদ,ইকরামাহ্ ইবনে আবী জাহল,হুবাইরা ইবনে ওয়াহাব,নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ্ এবং যিরার ইবনে খাত্তাব নামের পাঁচ বীর যোদ্ধা যুদ্ধের পোশাক পরে দর্পভরে বনী কিনানার সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল : তোমার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। আজ তোমরা বুঝতে পারবে,কারা আরব বাহিনীর প্রকৃত বীর যোদ্ধা।” এরপর অশ্ব চালনা করে পরিখার যে অংশটির প্রস্থ কম ছিল,সেখান দিয়ে ঘোড়া সহ লাফ দিয়ে এ পাঁচ বীর যোদ্ধা সেখানে প্রহরারত মুসলিম তীরন্দায সৈন্যদের নাগালের বাইরে চলে যায়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে পরিখা পার হবার স্থান ঘেরাও করে ফেলা হয় এবং অন্যদের তা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে বাধা দান করা হয়।

মল্ল (দ্বৈত) যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আসা এ পাঁচ বীর যোদ্ধা পরিখা ও সালা পাহাড়ের (ইসলামী সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় শিবির) মাঝখানে এসে দাঁড়াল। এ আরব বীরেরা সেখানে অহংকারবশত নিজেদের অশ্বগুলোর সাথে ক্রীড়ায় লিপ্ত হলো এবং ইশারায় তাদের প্রতিপক্ষকে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাতে লাগল।129

এ পাঁচ জনের মধ্যে বীরত্ব ও কৌশলের দিক থেকে বেশ বিখ্যাত বীর যোদ্ধাটি মুসলমানদের সামনে এসে দ্বৈত যুদ্ধে লিপ্ত হবার আহবান জানাল। সে মুহূর্তের পর মুহূর্ত ধরে নিজের কণ্ঠ উচ্চকিত করতে লাগল এবং মাতলামিপূর্ণ হুঙ্কারধ্বনি দিয়ে বলতে লাগল :هل من مبارز؟ তোমাদের মধ্যে কি কোন যোদ্ধা আছে?”   তার এ আস্ফালন সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এবং মুসলিম সৈন্যদের দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। মুসলমানদের নীরবতা তার স্পর্ধা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে (ব্যঙ্গচ্ছলে) বলছিল : বেহেশতের দাবীদাররা কোথায়? তোমরা মুসলমানরা কি বলো না যে,তোমাদের নিহত ব্যক্তিরা বেহেশতে এবং আমাদের নিহতরা জাহান্নামে যাবে? তোমাদের মধ্য থেকে কি একজনও আমাকে দোযখে পাঠানোর জন্য বা আমার পক্ষ থেকে তাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়?

আর সে তার এ কথাগুলো বীরগাঁথায় এভাবে বলছিল :

و لقد بححت من النّداء

بجمعكم هل من مبارز

“উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার জন্য এবং মল্লযোদ্ধাকে আহবান জানাতে জানাতে আমার গলা বসে গেছে।”

ইসলামী বাহিনীর সমাবেশ কেন্দ্রে আমরের আস্ফালন ও দম্ভোক্তির বিপরীতে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। তখন মহানবী (সা.) বলছিলেন,মুসলমানদের মধ্য থেকে একজন বের হয়ে এ লোকের অনিষ্ট থেকে মুসলমানদের রেহাই দিক। কিন্তু একমাত্র হযরত আলী ইবনে আবী তালিব ছাড়া আর কেউই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন না।

ওয়াকিদী লিখেছেন : যখন আমর মুসলমানদের মধ্য থেকে তার সমকক্ষ যোদ্ধাকে এসে তার সাথে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাচ্ছিল,তখন সকল মুসলিম যোদ্ধার মাঝে এতটা নীরবতা বিরাজ করতে লাগল যে,এমন প্রতীয়মান হচ্ছিল,তাঁদের মাথার উপর যেন পাখিও বসে থাকতে পারবে। 130

অগত্যা এ সমস্যার সমাধান অবশ্যই হযরত আলী ইবনে আবী তালিবের হাতেই হতে হবে। মহানবী (সা.) তাঁর তরবারি হযরত আলী (আ.)-এর হাতে তুলে দিলেন এবং তাঁর বিশেষ পাগড়ী তাঁর মাথায় বেঁধে দিয়ে তাঁর জন্য দুআ করলেন : হে আল্লাহ্! আলীকে সব ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। হে প্রভু! বদরের যুদ্ধে উবাইদাহ্ ইবনে হারেসা এবং উহুদের যুদ্ধে শেরে খোদা (আল্লাহর ব্যাঘ্র) হামযাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। হে প্রভু! আলীকে শত্রুর আঘাত ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন।” এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন :

) ربّ لا تذرنِى فردا و أنت خير الوارثين(

“হে প্রভু! আমাকে একাকী করবেন না;আর আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী।” (সূরা

আম্বিয়া : 89)

হযরত আলী বিলম্ব পুষিয়ে দেয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রওয়ানা হয়ে গেলেন। এ সময় মহানবী তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক এ উক্তি করেছিলেন :

برز الإيمان كلّه إلى الشّرك كلّه

“পূর্ণ শিরকের মোকাবেলা করতে পূর্ণ ঈমান (রণক্ষেত্রে) আবির্ভূত হয়েছে।”

হযরত আলী (আ.) তাঁর প্রতিপক্ষের বীরগাঁথার অনুরূপ বীরগাঁথা রচনা করে বললেন :

لا تعجلن فقد أتاك

مجيب صوتك غير عاجز

তাড়াহুড়ো করো না।

কারণ তোমার আহবানে সাড়াদানকারী তোমার কাছে এসেছে,

যে অক্ষম (দুর্বল) নয়।

হযরত আলী (আ.)-এর সমগ্র দেহ লৌহ নির্মিত ভারী বর্ম ও অস্ত্র-শস্ত্রে আচ্ছাদিত ছিল এবং তাঁর চোখদ্বয় কেবল শিরস্ত্রাণের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করছিল। আমর প্রতিপক্ষকে চিনতে চাচ্ছিল। তাই সে হযরত আলী (আ.)-কে বলল : তুমি কে?”   স্পষ্টবাদিতার জন্য বিখ্যাত হযরত আলী বললেন : আলী ইবনে আবী তালিব।” আমর বলল : আমি তোমার রক্ত ঝরাব না। কারণ তোমার পিতা ছিলেন আমার পুরনো বন্ধু। আমি তোমার চাচাত ভাইয়ের ব্যাপারে ভেবে অবাক হচ্ছি,সে তোমাকে কোন ভরসায় আমার সাথে লড়ার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে? আমি তোমাকে না জীবিত,না মৃত এমন অবস্থার মধ্যে বর্শায় গেঁথে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে (শূন্যে) ঝুলিয়ে রাখতে পারি।”

ইবনে আবীল হাদীদ বলেন : আমার ইতিহাস বিষয়ক শিক্ষক (আবুল খাইর) ইতিহাসের এ অধ্যায় বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করতে গেলেই বলতেন : আমর আসলে আলীর সাথে দ্বৈত যুদ্ধে লিপ্ত হবার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল। কারণ সে বদর ও উহুদ যুদ্ধে উপস্থিত ছিল এবং হযরত আলীর বীরত্ব সে সচক্ষে দেখেছে। এ কারণেই সে আলীকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে চাচ্ছিল।”

হযরত আলী (আ.) বললেন : তুমি আমার মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি উভয় অবস্থায় (আমি নিহত হই বা তোমাকে হত্যা করি) সৌভাগ্যবান এবং আমার বাসস্থান বেহেশত। তবে সকল অবস্থায় দোযখ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” আমর মুচকি হেসে বলল : আলী! এ ধরনের বণ্টন ন্যায়ভিত্তিক নয় যে,বেহেশত ও দোযখ উভয়ই তোমার সম্পত্তি হবে।”

ঐ সময় আলী (আ.) আমর ইবনে আবদে উদকে ঐ প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন,যা একদিন কাবার পর্দা ছুঁয়ে নিজ প্রভুর (মহান আল্লাহর) সাথে করেছিল। আর তা ছিল,যুদ্ধের ময়দানে যদি কোন বীর তার প্রতিপক্ষকে তিনটি প্রস্তাব দেয়,তা হলে সেগুলোর যে কোন একটি তাকে গ্রহণ করতে হবে। এ কারণেই হযরত আলী (আ.) প্রস্তাব দিলেন,প্রথমে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। কিন্তু সে বলল : আলী! এটা বাদ দাও। কারণ তা সম্ভব নয়।” আলী (আ.) তাকে বললেন : যুদ্ধ থেকে ক্ষান্ত হও এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে চলে যাও।” সে বলল : এ প্রস্তাব আমার জন্য লজ্জাকর। কারণ আগামীকালই আরবের কবিরা আমার ব্যাপারে ব্যঙ্গ করবে এবং তারা ভাববে,আমি ভয় পেয়ে এ কাজ করেছি।” তখন আলী (আ.) বললেন : এখন যখন তোমার প্রতিপক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে,তখন তুমিও তোমার ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসো যাতে আমরা মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হই।” সে বলল: আলী! আসলে এটি একটি তুচ্ছ প্রস্তাব মাত্র। আমি কখনোই ভাবি নি যে,কোন আরব আমার কাছে এমন প্রস্তাব করতে পারে! 131

দুই বীরের লড়াই শুরু

দুই বীরের মধ্যে তীব্র মল্লযুদ্ধ শুরু হলো এবং তাদের দু জনের চারপাশ ধূলো-বালিতে ছেয়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারছিল না। ঢাল ও বর্মের উপর তরবারির আঘাতের শব্দ ছাড়া আর কিছুই তাদের কানে আসছিল না। বেশ কয়েকটা আঘাত ও পাল্টা আঘাতের পর আমর তার তরবারি দিয়ে হযরত আলীর মাথায় আঘাত হানলে আলী (আ.) তা তাঁর ঢাল দিয়ে প্রতিহত করলেন। এ সত্বেও তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি এ সুযোগে তরবারি দিয়ে প্রতিপক্ষের পায়ে তীব্র আঘাত হানলেন অথবা তিনি তার দু পা বা একটি পা কেটে ফেললেন। ফলে আমর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ধূলো-বালির মধ্য থেকে আলী (আ.)-এর বিজয়ী হবার নিদর্শন তাকবীর ধ্বনি উত্থিত হলো। যে সব আরব বীর আমরের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ছিল,আমরের ধরাশায়ী হবার দৃশ্য তাদের অন্তরে এতটা ভীতির সঞ্চার করল যে,তারা নিজেদের অজান্তেই লাগাম ধরে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে পরিখার দিকে চালনা করল এবং একমাত্র নওফেল ছাড়া তাদের সবাই তাদের নিজেদের সেনাশিবিরে ফিরে গেল। নওফেলের অশ্ব পরিখার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল এবং সে নিজেও মাটিতে পড়ে গিয়ে তীব্র আঘাত পেয়েছিল। পরিখায় প্রহরারত সৈন্যরা তার দিকে পাথর ছুঁড়তে থাকলে সে চিৎকার করে বলতে লাগল : এভাবে হত্যা করা মহানুভবতার পরিপন্থী। আমার সাথে মল্লযুদ্ধের জন্য একজন পরিখার ভেতরে নেমে এসো।” হযরত আলী (আ.) পরিখার ভেতরে নেমে তাকে হত্যা করলেন।

মুশরিক বাহিনীর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে প্রচণ্ড ভীতির সৃষ্টি হলো। আর আবু সুফিয়ানই সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে ভাবছিল,মুসলমানরা হামযার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নওফেলের লাশ বিকৃত করতে পারে। তাই সে নওফেলের লাশ দশ হাজার দীনারে ক্রয় করার জন্য এক ব্যক্তিকে পাঠালে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : লাশটা দিয়ে দাও। কারণ ইসলাম ধর্মে মৃতদেহের বিনিময়ে অর্থ নেয়া হারাম করা হয়েছে।”

হযরত আলী (আ.)-এর তরবারির এ আঘাতের মূল্য

বাহ্যত হযরত আলী (আ.) একজন বীরকে বধ করেছিলেন। তবে আসলেই তিনি ঐ সব ব্যক্তির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন,আমরের গগন বিদারী হুঙ্কারধ্বনি শুনে যাদের দেহে কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি দশ হাজার সৈন্যের যে বিশাল বাহিনী নবগঠিত ইসলামী হুকুমত ধ্বংস করার জন্য কোমর বেঁধে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল,তিনি তাদেরকেও ভীত-সন্তস্ত্র করে দিয়েছিলেন। আর যদি আমর জয়লাভ করত,তা হলে তখনই বোঝা যেত হযরত আলীর এ আত্মত্যাগের মূল্য কত অপরিসীম ছিল!

হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি এভাবে আলী (আ.)-এর এ আঘাতের মূল্যায়ন করে বলেছিলেন : আমার উম্মতের সমুদয় সৎকর্মের উপরে হচ্ছে এ আত্মত্যাগের গুরুত্ব। কারণ কুফরের সবচেয়ে বড় বীরের পরাজিত হবার কারণেই সকল মুসলমান মর্যাদাবান এবং সকল মুশরিক অপদস্থ হয়েছে। 132

আলী (আ.)-এর মহানুভবতা

আমরের বর্ম অত্যন্ত দামী ও মূল্যবান হলেও হযরত আলী (আ.) মহানুভবতার কারণে তা ছুঁয়েও দেখেন নি। এমনকি দ্বিতীয় খলীফা এ জন্য আলী (আ.)-কে ভর্ৎসনা করেছিলেন যে,কেন তিনি আমরের দেহ থেকে বর্মটি খুলে আনেন নি। আমরের বোন ঘটনা জানতে পেরে বলেছিল : আমি কখনই দুঃখ করব না যে,আমার ভাই নিহত হয়েছে। কারণ সে এক মহানুভব ব্যক্তির হাতেই নিহত হয়েছে। আর এর অন্যথা হলে আমার দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত আমি অশ্রুপাত করতাম। 133

এখন আমরা দেখব,আরবের বীর আমর ইবনে আবদে উদ নিহত হবার পর মুশরিক বাহিনীর কী পরিণতি হয়েছিল।

ছত্রভঙ্গ সম্মিলিত আরব বাহিনী

ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পেছনে আরব বাহিনী ও ইহুদীদের একক উদ্দেশ্য ছিল না। নব্য প্রতিষ্ঠিত তরুণ ইসলামী রাষ্ট্রের উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করার কারণে ইহুদীরা ভীত হয়ে পড়েছিল এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের পুরনো শত্রুতা তাদেরকে এ যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেছিল। সেখানকার ইহুদীরা গাতফান,ফিযারাহ ও অন্যান্য গোত্রকে খাইবরের শস্য প্রদান করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল,সে কারণেই তারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সুতরাং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে গোষ্ঠীগুলোকে সর্বশেষ যা প্ররোচিত করেছিল,তা ছিল একটি বস্তুগত বিষয়। আর এ লক্ষ্য যদি মুসলমানদের মাধ্যমে পূরণ করা হতো,তা হলে তারা পূর্ণ সন্তুষ্টি সহ নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরে যেত,বিশেষ করে যখন তীব্র শীত,খাদ্যাভাব এবং অবরোধকাল দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল এবং তাদের মন দুর্বল ও তাদের পশুগুলোও মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল।

এ কারণেই মহানবী (সা.) উল্লিখিত গোত্রগুলোর নেতাদের সাথে চুক্তি করার জন্য একটি প্রতিনিধিদলকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি প্রতিনিধিদলকে এ গোত্রগুলোর কাছে এ কথা বলে দেয়ার আদেশ দেন যে,মুসলমানরা তাদেরকে মদীনার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত ফল প্রদানে সম্মত আছে। তবে এ শর্তে যে,তাদেরকে সম্মিলিত বাহিনী থেকে বের হয়ে নিজেদের এলাকায় ফিরে যেতে হবে। মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধিগণ এ গোত্রগুলোর নেতাদের সাথে বসে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি করে তা চূড়ান্ত অনুমোদন ও স্বাক্ষরের জন্য মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থাপন করেন। তবে মহানবী (সা.) সা দ ইবনে মায়ায ও সা দ ইবনে উবাদাহ্ নামক তাঁর দু জন সেনাকর্মকর্তার সাথে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা দু জনই একই অভিমত ব্যক্ত করে বললেন, এ চুক্তি যদি মহান আল্লাহর নির্দেশে হয়ে থাকে,তা হলে তা মেনে নিতে হবে। আর এটি যদি আপনার ব্যক্তিগত বিবেচনায় হয়ে থাকে এবং আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাদের অভিমত চেয়ে থাকেন,তা হলে আমাদের অভিমত হচ্ছে এই যে,চুক্তিটি এখানেই স্থগিত রাখতে হবে এবং তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হবে না। কারণ আমরা অতীতে কখনই এসব গোত্রকে সেলামি দিই নি এবং এসব গোত্রের মধ্য থেকে একজনেরও জোর করে আমাদের কাছ থেকে এক টুকরো খেজুর পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়ার সাহস হয় নি। আর এখন যখন মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এবং আপনার নেতৃত্বে আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি এবং আমরা এ দ্বীনের বদৌলতে মর্যাদাবান ও শক্তিশালী,তখন এ সব গোষ্ঠী ও দলকে সেলামী দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

و الله لا نعطيهم إلّا السيف حتى يحكم الله بيننا و بينكم

-“মহান আল্লাহর শপথ! মহান আল্লাহ্ কর্তৃক আমাদের ও তাদের মাঝে তরবারি দিয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের সকল বৃথা ও অন্যায় আব্দারের উত্তর তরবারি দিয়েই দেব।”

মহানবী বললেন : এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করার ব্যাপারে আমার চিন্তা-ভাবনার কারণ ছিল এই যে,যেহেতু তোমরা সম্মিলিত আরব বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছ এবং চতুর্দিক থেকে তোমরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছ,সেহেতু আমি দেখতে পেলাম,শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার মধ্যেই উদ্ধার পাবার পথ বিদ্যমান। এখন যখন তোমাদের আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে,তখন আমি এ চুক্তি স্থগিত করে দিচ্ছি এবং তোমাদের বলছি মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে অপদস্থ করবেন না এবং শিরকের ওপর তাওহীদের বিজয়ের ব্যাপারে তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্যই বাস্তবায়িত করবেন। ঐ সময় সা দ ইবনে মায়ায মহানবীর অনুমতি নিয়ে চুক্তিপত্রের বিষয়বস্তু মুছে ফেলে বললেন : মূর্তিপূজারীরা আমাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা তা করুক,আমরা কোন অবস্থায়ই তাদেরকে সেলামি দেব না। 134

সম্মিলিত আরব বাহিনীর ছত্রভঙ্গ ও ব্যর্থতার কারণ

1. বিজয়ের প্রথম কারণ ছিল গাতফান ও ফাযারাহ্ গোত্রের নেতাদের সাথে মহানবী (সা.)-এর প্রতিনিধিগণের সংলাপ। কারণ এ চুক্তি যদিও চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়নি,তবু তা বাতিল করারও ঘোষণা দেয়া হয় নি। এ গোত্রগুলো এভাবে নিজেদের মিত্রদের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে দোদুল্যমান হয়ে যায় এবং দিনের পর দিন তারা এ চুক্তি সম্পাদনের প্রতীক্ষা করতে থাকে। যখন তাদেরকে সর্বাত্মক আক্রমণ করার অনুরোধ জানানো হতো,তখনই তারা এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আশায় কতকগুলো বিশেষ অজুহাত দাঁড় করিয়ে কুরাইশদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করত।

2. সম্মিলিত আরব বাহিনীর শক্তিশালী বীর আমরের নিহত হওয়া,যার মল্লযুদ্ধে বিজয়ী হবার ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী ছিল। যুদ্ধে আমর নিহত হলে সম্মিলিত আরব বাহিনীর মাঝে তীব্র ভীতির উদ্ভব হয়। বিশেষ করে তার নিহত হবার পরপরই আরব বাহিনীর অন্যান্য বীর যোদ্ধা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেছিল।

3. নব বাইয়াতপ্রাপ্ত মুসলমান নুআইম ইবনে মাসউদ সম্মিলিত আরব বাহিনীর ঐক্য ভেঙে দেবার ব্যাপারে অসাধারণ প্রভাব রেখেছিলেন। তিনি মুশরিক বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন এবং এ কালের দক্ষ গুপ্তচরদের কর্মতৎপরতার চেয়ে তাঁর কর্মকাণ্ড কোন অংশে কম ছিল না;বরং ছিল আরো উন্নত এবং গুরুত্বপূর্ণ।

নুআইম ইবনে মাসউদ মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন : আমি একজন নও মুসলিম। আগে থেকেই সকল গোত্রের সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে। তারা আমার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কথা জানে না। আপনার যদি কোন নির্দেশ থাকে তা হলে আমাকে তা বলুন,আমি তা বাস্তবায়ন করব।” মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন : এমন একটা কাজ কর যার ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অর্থাৎ কতকগুলো মহান কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য যদি তুমি একটি উপায় বের করার চিন্তা-ভাবনা কর এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন কর,তা হলে এতে কোন আপত্তি নেই। 135

নুআইম একটু চিন্তা করে তৎক্ষণাৎ বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের কাছে গেলেন। আর এ গোত্র আসলেই শত্রুর পঞ্চম বাহিনী ছিল এবং তাদের মাধ্যমে পেছনে থেকে মুসলমানদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকায় তারা ছিল প্রত্যক্ষ হুমকিস্বরূপ। তিনি বনী কুরাইযার দুর্গে প্রবেশ করে তাদের কাছে তাঁর বন্ধুত্ব,আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। তিনি তাদের সাথে এমনভাবে কথাবার্তা বললেন যেন তিনি তাদের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হন। এরপর তিনি বললেন : জোটবদ্ধ দলগুলো অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের সাথে তোমাদের অবস্থার পার্থক্য আছে। কারণ মদীনা হচ্ছে তোমাদের সন্তান ও নারীদের আবাসস্থল এবং তোমাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ এখানেই রয়েছে। তাই কোন অবস্থায়ই এখান থেকে অন্য কোথাও তোমাদের চলে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে মিত্র ও জোটভুক্ত গোষ্ঠী,যারা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এখানে এসেছে,তাদের আবাসস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা মদীনার বাইরে ও এখান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।

তারা যদি সুযোগ পেয়ে এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়,তা হলে তো তারা তাদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উপনীত হবেই। আর যদি তারা এ যুদ্ধে পরাজিত হয়,তখন তারা তৎক্ষণাৎ এ স্থান ত্যাগ করে নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে যাবে,যা মুহাম্মদের নাগালের বাইরে।

তবে তোমাদের এ কথা ভেবে দেখা উচিত,যদি জোটভুক্ত দলগুলো এ যুদ্ধে বিজয়ী না হয় এবং তারা যদি তাদের কেন্দ্রে ফিরে যায়,তা হলে তোমরা মুসলমানদের হাতের মুঠোর মধ্যে পড়ে যাবে। আমি মনে করি,এখন যেহেতু তোমরা জোটভুক্ত দলগুলোর সাথে যোগ দিয়েই ফেলেছ,সেহেতু এ সিদ্ধান্তের ওপর তোমাদের অটল থাকা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তবে যাতে করে সম্মিলিত জোটভুক্ত দলগুলো য্দ্ধু চলাকালে তোমাদের ত্যাগ করে নিজ নিজ ভূ-খণ্ডে প্রত্যাবর্তন না করে,সেজন্য তাদের কয়েকজন নেতা ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিকে যিম্মী রাখ,যেন তারা তোমাদের দুর্দিনে তোমাদের একাকী রেখে যেতে না পারে। কারণ তখন তারা তাদের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও নেতাদের মুক্তির জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে বাধ্য হবে।

বনী কুরাইযার দুর্গে কুরাইশ প্রতিনিধিদের গমন

আবু সুফিয়ান যুদ্ধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য শনিবার রাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ কারণেই কুরাইশ ও গাতফান গোত্রপতি ও নেতারা কয়েকজন প্রতিনিধিকে বনী কুরাইযার দুর্গে প্রেরণ করে এবং তারা তাদেরকে জানায় : এ স্থান আমাদের আবাসভূমি নয়;আমাদের পশুগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা আগামীকাল পেছন থেকে আক্রমণ চালাবে যাতে আমরা এ যুদ্ধের একটা চূড়ান্ত রফা করতে পারি।” সম্মিলিত আরব গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদেরকে বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের সেনাপতি বলেছিল : আগামীকাল শনিবার। আর আমরা ইহুদী জাতি এ দিন কোন কাজ করি না। কারণ আমাদের একদল পূর্বপুরুষ এ দিনে কাজে হাত দিয়েছিল বলে আল্লাহর শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল। অধিকন্তু আমরা ঐ অবস্থায় যুদ্ধ করব যখন আরব দল ও গোষ্ঠীগুলোর কতিপয় নেতা যিম্মী হিসেবে আমাদের দুর্গে অবস্থান করবে যাতে করে তোমরা তাদের মুক্তির জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে যেতে থাকবে এবং যুদ্ধ চলাকালে তোমরা আমাদের একাকী ফেলে পলায়ন করবে না।”

কুরাইশ প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে গোত্রপতি ও নেতাদের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করে। তখন সবাই বলেছিল : নুআইম সহানুভূতি প্রকাশ করে যা বলেছে,তা ঠিকই (সত্যই) ছিল। আসলে বনী কুরাইযা আমাদের সাথে চালাকী করতে চাচ্ছে।” আবারো কুরাইশ প্রতিনিধিরা বনী কুরাইযার নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে বলল : আমাদের কতিপয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে দেব,তা আসলে বাস্তব নয়। এমনকি আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজন লোককেও তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নই। যদি তোমরা চাও,কাল মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে পার। তা হলে আমরাও তোমাদের সাহায্য করব।”

‘আমরা আমাদের মধ্য থেকে একজনকেও তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে তুলে দেব না’ -কুরাইশ প্রতিনিধিদলের এ ধরনের উক্তি নুআইমের কথা সত্য হবার ব্যাপারে বনী কুরাইযার সকল সংশয় দূর করে দিল এবং সবাই অভিমত ব্যক্ত করল : নুআইম যা বলেছে,তা-ই সত্য। কুরাইশরা আসলে নিজেদের স্বার্থ ও পরিণতি নিয়েই কেবল ভাবে। যদি তারা এ যুদ্ধে জয়ী হবার সম্ভাবনা না দেখে,তা হলে তারা নিজেদের পথ ধরবে এবং এভাবে তারা মুসলমানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। 136

সর্বশেষ কারণ

উপরিউক্ত কারণগুলো,আরেকটি কারণ-যা আসলে গায়েবী সাহায্য’ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে-এর সাথে যুক্ত হয়ে জোটভুক্ত দল ও গোষ্ঠীগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল। অন্য কারণটি ছিল হঠাৎ করে আবহাওয়া তীব্রভাবে ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং ঝড় বইতে থাকে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তন এতটা তীব্র ছিল যে,তাঁবুগুলোকে উল্টে ফেলে দেয়;ফানুস ও প্রদীপগুলো নিভে যায় এবং প্রজ্বলিত অগ্নিরাশি মরুর বুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় মহানবী (সা.) হুযাইফাকে পরিখা অতিক্রম করে শত্রুদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আনার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেন : আমি আবু সুফিয়ানের কাছে গেলাম। তাকে সম্মিলিত আরব বাহিনীর সেনাপতিদের মাঝে বক্তৃতা করতে দেখলাম এবং তখন সে বলছিল : আমরা যে অঞ্চলে এসেছি তা আমাদের বসবাসের কেন্দ্র নয়। আমাদের পশুগুলো ধ্বংস হয়েছে এবং ঝড়ো হাওয়া আমাদের তাঁবু,আস্তাবল ও প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডগুলো অবশিষ্ট রাখে নি। আর বনী কুরাইযাও আমাদের সাহায্য করে নি। আমাদের এ স্থান ত্যাগ করাই হচ্ছে কল্যাণকর। এরপর সে তার হাঁটুবাঁধা উটের উপর আরোহণ করে সেটাকে চাবুক দিয়ে কষে আঘাত করতে লাগল। বেচারা আবু সুফিয়ান এতটা ভীত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল যে,তার উটের পাগুলো যে বাঁধা রয়েছে,সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না।”

তখনও ভোরের আলো ফুটে বের হয় নি;সম্মিলিত আরব বাহিনী এ সময় ঐ স্থান ত্যাগ করে এবং তাদের একটি লোকও সেখানে অবশিষ্ট থাকে নি।137

আটত্রিশতম অধ্যায় : পঞ্চম হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53