চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড5%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81902 / ডাউনলোড: 7555
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

জীবনের শেষ শিখা

অস্থিরতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমগ্র মদীনা নগরীকে গ্রাস করেছিল। মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ অশ্রুসজল নয়নে এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে মহানবীর অসুস্থতার পরিণতি সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর ঘরের চারপাশে সমবেত হয়েছিলেন। ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আসা খবর মহানবীর স্বাস্থ্যের অবনতি ও সংকটজনক অবস্থার কথাই ব্যক্ত করছিল এবং তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি ও আরোগ্য সংক্রান্ত সব ধরনের আশা মিটিয়ে দিচ্ছিল এবং নিশ্চিত করছিল, মহানবীর জীবন প্রদীপের সর্বশেষ শিখা নির্বাপিত হবার আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অবশিষ্ট আছে।

মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী নিকট থেকে তাঁদের মহান নেতাকে দেখা ও তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে যে কক্ষের মধ্যে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, সেখানে তাঁর আহলে বাইত ব্যতীত আর কারো পক্ষে যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না।

মহানবী (সা.)-এর একমাত্র কন্যাসন্তান হযরত ফাতিমা (আ.) পিতার শয্যার পাশে বসেছিলেন এবং তাঁর উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি যখন পিতার কপাল ও মুখমণ্ডলের উপর মুক্তার দানার মতো মৃত্যু-ঘামের বারিবিন্দুসমূহ ঝরে পড়তে দেখলেন, তখন তিনি ভগ্ন হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে এবং রুদ্ধকণ্ঠে মহানবী (সা.)-এর শানে হযরত আবু তালিব রচিত এ কবিতাংশ মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছিলেন :

و ابيض يستسقى الغمام بوجهه

ثمال اليتامي عصمة للارامل

“ঐ উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, যাঁর মর্যাদার উসীলায় মেঘমালার বারিবিন্দুর জন্য প্রার্থনা করা হয়; তিনি অনাথদের আশ্রয়স্থল এবং বিধবা নারীদের রক্ষক।”

এ সময় মহানবী (সা.) চোখ মেলে তাকালেন এবং নিচু স্বরে কন্যার উদ্দেশে বললেন :

“এ কবিতা আবু তালিব আমার শানে আবৃত্তি করেছেন। তবে এর স্থলে পবিত্র কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত উত্তম৫৬৯ :

) و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرسل أفأن مات أو قُتل انقلبتم علي أعقابكم و من ينقلب علي عقبيه فلن يضرّ الله شيئا و سيجزى الله الشاكرين(

-মুহাম্মদ শুধু আল্লাহর রাসূল, তাঁর আগে রাসূলগণ প্রস্থান করেছেন। অতএব, যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত (শহীদ) হন, তা হলে কি তোমরা তোমাদের পেছন দিকে (পূর্বপুরুষদের ধর্মের দিকে) প্রত্যাবর্তন করবে? আর যারা তাদের দিকে ফিরে যাবে, তারা কখনোই মহান আল্লাহর ন্যূনতম ক্ষতিও করতে পারবে না। আর তিনি কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

হযরত ফাতিমা (আ.)-এর সাথে মহানবী (সা.)-এর কথোপকথন

অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, নিজ সন্তানদের প্রতি বড় বড় মনীষী ও ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের আবেগ-অনুভূতি অধিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মব্যস্ততার দরুন নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। কারণ মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সর্বজনীন চিন্তা- ভাবনা তাঁদেরকে এতটা আত্মমগ্ন করে রাখে যে, এর ফলে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ-অনুভূতি তাঁদের মাঝে বিকশিত হতে পারে না। তবে মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ এ নিয়মের ব্যতিক্রম। সবচেয়ে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বিশ্বজনীন ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের অধিকারী হওয়া সত্বেও তাঁরা প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী এবং তাঁদের অন্তরাত্মা মহান। আর এ কারণেই জীবনের একটি দিকে ব্যস্ত হওয়া কখনো তাঁদেরকে জীবনের অপর দিক থেকে নির্লিপ্ত করে না।

একমাত্র কন্যাসন্তানের প্রতি মহানবী (সা.)-এর প্রগাঢ় টান ও ভালোবাসা প্রকৃতপক্ষে মানবীয় আবেগ-অনুভূতির সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ। তাই মহানবী কন্যার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে কখনোই সফরে বের হতেন না এবং সফর থেকে ফিরে এসে সর্বাগ্রে তিনি তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ছুটে যেতেন। নিজের স্ত্রীগণের সামনে তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং সাহাবীগণকে বলতেন : ফাতেমা আমার দেহের টুকরা। যা তাকে সন্তুষ্ট করে, তা আমাকেও সন্তুষ্ট করে; আর তার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আমারই ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি।”৫৭০

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সাক্ষাৎ মহানবী (সা.)-কে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্রা ও মমতাময়ী নারী হযরত খাদীজার কথা স্মরণ করিয়ে দিত, যিনি তাঁর স্বামীর পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে বিস্ময়কর সব দুঃখ-কষ্ট বরণ করে নিয়েছিলেন এবং এ পথে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি ব্যয় করেছিলেন।

যে কয়েকটি দিন মহানবী (সা.) শয্যাশায়ী ছিলেন, সে ক টি দিন হযরত ফাতিমা (আ.) পিতার শয্যা পাশে বসে থাকতেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও পিতার কাছে থেকে দূরে সরেন নি। হঠাৎ মহানবী (সা.) ইঙ্গিতে বোঝালেন, তিনি তাঁর সাথে কথা বলবেন। নবীকন্যা একটু ঋজু হয়ে মহানবীর কাছে মাথা নিয়ে গেলেন। তখন মহানবী (সা.) তাঁর সাথে আস্তে আস্তে কথা বললেন। যাঁরা তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কেউ মহানবী ও তাঁর কন্যার কথোপকথনের বিষয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত হতে পারেন নি। মহানবী কথা বলা শেষ করলে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) কাঁদলেন এবং তাঁর দু চোখ বেয়ে বন্যার স্রোতের মতো অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এ অবস্থায় মহানবী (সা.) তাঁকে আবার ইশারা করে কাছে ডেকে তাঁর সাথে আস্তে আস্তে কথা বললেন। এবার হযরত যাহরা (আ.) হাসিমুখে মাথা উঠালেন। একই সময় পরস্পর বিপরীত এ দুই আচরণ উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে বিস্মিত করেছিল। তাঁরা নবীকন্যার কাছে অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাঁর সাথে মহানবীর যে কথা হয়েছে, তা তাঁদের জানান এবং এ দুই অবস্থার উদ্ভবের কারণও তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু যাহরা (আ.) বললেন : আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর রহস্য ফাঁস করব না।”

মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর হযরত যাহরা (আ.) হযরত আয়েশার পীড়াপীড়িতে তাঁদেরকে ঘটনার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত করেন এবং বলেন : আমার পিতা প্রথমে তাঁর ইন্তেকালের কথা জানিয়ে বলেন : আমি এ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করব না। এ কারণেই আমার তখন কান্না পেয়েছিল। তবে পরে তিনি আমাকে বললেন : আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে তুমিই প্রথম, যে আমার সাথে মিলিত হবে। এ সংবাদ আমাকে আনন্দিত করল এবং আমিও বুঝতে পারলাম, অল্প কিছুদিন পরেই আমি পিতার সাথে মিলিত হব।”৫৭১

দাঁত মুবারক মিসওয়াক

মহানবী (সা.) রাতের বেলা ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে জাগার পর মিসওয়াক করতেন। মহানবীর মিসওয়াক আরাক কাঠের ছিল, যা দাঁতের মাড়ি মজবুত করা এবং ময়লা ও খাদ্যকণা পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। একদিন হযরত আয়েশার ভাই আবদুর রহমান একটি সবুজ ও তাজা ডাল হাতে নিয়ে মহানবী (সা.)-কে দেখতে আসেন। হযরত আয়েশা মহানবীকে ঐ ডালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলেন, তিনি ডালটি দিয়ে মিসওয়াক করতে চাচ্ছেন। তাই তিনি তা নিয়ে মহানবীর হাতে রাখলেন। আর তখন মহানবী খুব যত্নের সাথে দাঁত মিসওয়াক করলেন।৫৭২

মহানবী (সা.)-এর অন্তিম ওসিয়ত

মহানবী (সা.) অসুস্থ থাকার দিনগুলোয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদি স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর অসুস্থতার শেষ দিনগুলোয় নামায এবং দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন : তোমরা দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করবে, তাদের খাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে খেয়াল রাখবে, তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলবে এবং মানুষের সাথে সুন্দরভাবে মেলামেশা ও জীবন যাপন করবে।”

একদিন কা ব আল আহবার দ্বিতীয় খলীফাকে জিজ্ঞেস করলেন : মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অবস্থায় কী বলেছিলেন? দ্বিতীয় খলীফা সভায় উপস্থিত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : আপনি তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।” আলী (আ.) বললেন : মহানবী (সা.)-এর মাথা যখন আমার কাঁধের উপর রাখা ছিল, তখন তিনি বলছিলেন: (الصّلوة الصّلوة ) নামায, নামায।” এ সময় কা ব বললেন : পূর্ববর্তী নবীগণও এ পদ্ধতির ওপর বহাল ছিলেন (অর্থাৎ তাঁরাও ওফাতকালে নামাযের ব্যাপারেই তাঁদের উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন)। ৫৭৩

জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোয় মহনবী (সা.) চোখ খুলে বললেন : আমার ভাইকে ডাক যাতে সে এসে আমার শয্যার পাশে বসে।” সবাই বুঝতে পারলেন, তাঁর এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছেন আলী। আলী (আ.) তাঁর শয্যার পাশে এসে বসলেন। তিনি অনুভব করলেন, মহানবী (সা.) বিছানা থেকে উঠতে চাচ্ছেন। আলী (আ.) মহানবীকে বিছানা থেকে উঠালেন এবং নিজের বুকের সাথে তাঁকে হেলান দিয়ে ধরে রাখলেন।৫৭৪

আর ঠিক তখনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার লক্ষণগুলো মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহে প্রকাশ পেল। এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেছিল : মহানবী (সা.) কার বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন? তখন ইবনে আব্বাস বলেছিলেন : মহানবী (সা.) আলীর কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।” ঐ লোকটি আবার বলল : হযরত আয়েশা দাবী করেন, মহানবী তাঁর বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।” ইবনে আব্বাস হযরত আয়েশার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন : মহানবী (সা.) হযরত আলীর কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর আলী ও আমার ভাই ফযল তাঁকে গোসল দিয়েছেন।”৫৭৫

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর এক ভাষণে এ বিষয় স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন :

و لقد قُبض رسول الله و إنّ رأسه لعلي صدرى... و لقد ولّيت غسله و الملائكة أعوانِى

“মহানবী (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন... আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”৫৭৬

কতিপয় মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সর্বশেষ যে কথা বলেছিলেন, তা ছিলلا، مع الرّفيق الأعلي (না, বরং সবচেয়ে মহান বন্ধুর সাথে) যেন ওহীর ফেরেশতা তাঁর রূহ কবজ করার সময় তাঁকে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে এ পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তন বা ফেরেশতা কর্তৃক তাঁর রূহ কবজ করা ও অন্য জগতে (বারযাখে) দ্রুত চলে আসার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিলে তিনি এ বাক্য বলে ফেরেশতাকে জানিয়েছিলেন, তিনি মৃত্যুপরবর্তী জগতে চলে যেতে এবং সেখানে নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সাথে বসবাস করতে চান।

) فأولئك مع الّذين أنعم الله عليهم من النّبيّين و الصّدّيقين و الشّهداء و الصّالحين و حسن أولئك رفيقا(

“তাঁরা ঐ ব্যক্তিদের সাথে আছেন যাঁদের ওপর মহান আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; আর এসব অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ হচ্ছেন নবী, পরম সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দাগণ এবং তাঁরা কত (উত্তম) ভালো বন্ধু! ৫৭৭

মহানবী (সা.) এ বাক্য বললেন এবং সাথে সাথে তাঁর দু চোখ ও ওষ্ঠ বন্ধ হয়ে গেল।৫৭৮

মহানবী (সা.)-এর ওফাত দিবস

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মহান আত্মা ২৮ সফর সোমবার দুপুর বেলা চিরস্থায়ী আবাসস্থলের দিকে উড়ে যায়। তখন তাঁর পবিত্র দেহ একটি ইয়েমেনী চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় এবং অল্প সময়ের জন্য কক্ষের এক কোণে রেখে দেয়া হয়। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণের বিলাপ এবং নিকটাত্মীয়গণের ক্রন্দনধ্বনি শুনে বাইরে অবস্থানরত জনতা নিশ্চিত হন যে, মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ সমগ্র মদীনা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর কতিপয় কারণবশত ঘরের বাইরে চিৎকার করে বলেছিলেন : মহানবী (সা.) মৃত্যুবরণ করেন নি এবং তিনি মূসা (আ.)-এর মতো মহান আল্লাহর কাছে গেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি মাত্রাতিরিক্ত তাকীদ দিতে লাগলেন এবং তিনি একদল জনতাকে তাঁর অভিমতের সমর্থকও প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলেন। ইত্যবসরে মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী৫৭৯ নিম্নোক্ত আয়াত হযরত উমরকে পাঠ করে শোনালেন৫৮০ :

) و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرسل أفأن مات أو قُتل انقلبتم علي أعقابكم(

“মুহাম্মদ কেবল আল্লাহর রাসূল; তাঁর আগে রাসূলগণ গত হয়ে গেছেন। যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত হন, তা হলে কি তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে?

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহ মুবারক গোসল দেন এবং কাফন পরান। কারণ মহানবী (সা.) বলেছিলেন : আমার সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি আমাকে গোসল দেবে। ৫৮১ আর এ ব্যক্তি আলী ব্যতীত আর কেউ ছিলেন না। যা হোক, এরপর তিনি মহানবীর পবিত্র মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করলেন। তখন তাঁর দু নয়ন বেয়ে প্লাবনের মতো অশ্রু ঝরছিল। তিনি তখন এ কথাসমূহ বলছিলেন : আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আপনার ওফাতের মাধ্যমে নবুওয়াতের সূত্র ছিন্ন এবং মহান আল্লাহর ওহী ও আকাশের (ঊর্ধ্ব জগতের) খবরা-খবর বন্ধ হয়ে গেল, যা অন্য কারো মৃত্যুতে কখনো বন্ধ হয় নি। আপনি যদি আমাদের অপ্রীতিকর অবস্থায় ধৈর্যধারণ করার আহবান না জানাতেন, তা হলে আমি আপনার বিচ্ছেদে এতটা কাঁদতাম ও অশ্রু ঝরাতাম যে, এর ফলে আমি অশ্রুর উৎসই শুষ্ক করে ফেলতাম। তবে এ পথে আমাদের দুঃখ ও শোক সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। আপনার পথে এ পরিমাণ শোক আসলে নগণ্য এবং এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আমাদেরকে আপনি পরলোকে স্মরণ করুন এবং স্মরণে রাখুন। ৫৮২

সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর জানাযার নামায আদায় করেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ দলে দলে এসে তাঁর জানাযার নামায আদায় করলেন। আর এ অনুষ্ঠান মঙ্গলবারের দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মহানবী (সা.) যে কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হবে। তাঁর কবর আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এবং যাইদ ইবনে সাহল প্রস্তুত করেছিলেন। হযরত আলী (আ.), ফযল ও আব্বাসের সহায়তায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।

পরিণামে, যে ব্যক্তিত্ব তাঁর নিরলস আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানব জাতির ভাগ্যে পরিবর্তন এনেছিলেন এবং তাদের সামনে সভ্যতার এক নতুন ও উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবতারণা করেছিলেন, তাঁর ইহজীবন-সূর্য অস্ত গেল। তাঁর ওফাতের সাথে সাথে তাঁর মহতী রিসালতী মিশন অব্যাহত রাখা এবং তাঁর মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অনেক বাধা ও সমস্যার উদ্ভব হয়, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট সমস্যা ছিল খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বিষয়ক সমস্যা। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের আগেই মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভক্তির লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসের অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায়৫৮৩ আমাদের এ আলোচনার বিষয়বস্তুর [ইসলামের আজীমুশশান নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ] গণ্ডির বাইরে। তাই আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ করছি এবং এ মহান নেয়ামতের জন্য মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সমাপ্ত

চৌত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   যেদিন আলী (আ.)-এর পুত্রদের শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির বলেছেন।

২।   ভ্রাতৃবন্ধনের দিন।

৩।   মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারসমূহ রুদ্ধ করার দিন।

রাসূল (সা.)-এর জীবনী অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে দেখবেন তিনি আলী ও হারুন (আ.)-কে আসমানের দুই যুগ্ম তারকা ও মানবদেহের দুই চোখের সাথে তুলনা করেছেন। এ দুই উম্মতের মধ্যে তাঁদের থেকে অন্য কেউই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না।

১। আর এজন্যই তিনি চান নি আলী (আ.)-এর সন্তানদের নাম হারুনের সন্তানদের হতে ভিন্ন কিছু হোক। এজন্য তাঁদের হাসান,হুসাইন ও মুহসিন২৬৪ নাম রেখেছেন ও বলেছেন, তাদের নাম হারুনের সন্তানদের সহনামে রাখলাম কারণ তাদের (হারুনের সন্তানদের নাম) শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির ছিল। রাসূল (সা.) তাঁর এই কর্মের মাধ্যমে এ দুই হারুনের মধ্যের মিলকে তুলে ধরে সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বজনীনতা দান করতে চেয়েছিলেন।

২। এজন্যই আলী (আ.)-কে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করে অন্যদের ওপর হারুনের প্রাধান্যের সর্বজনীনতার বিষয়টিকে উল্লেখ করার মাধ্যমে বিষয়টিকে তাকীদ দিয়েছেন। যে দু বার ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠ করা হয় দু বারই তিনি আগ্রহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করুক। এজন্য প্রথম আকদের সময় সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু বকরকে হযরত উমরের সাথে,হযরত উসমানকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টি করলেও দ্বিতীয় আকদের সময় হযরত আবু বকরকে খারাজা ইবনে যাইদের ভ্রাতা এবং হযরত উমরকে উতবান ইবনে মালিকের ভ্রাতা মনোনীত করেন। অথচ উভয় আকদেই আলীকে নিজের ভ্রাতা বলে মনোনীত ও ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে (যার অধিকাংশই সহীহ) তার উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়।

এজন্য ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর,যাইদ ইবনে আরকাম,যাইদ ইবনে আবি আউফি,আনাস ইবনে মালিক,হুজাইফা ইবনে ইয়ামান,মুখদাজ ইবনে ইয়াযীদ,উমর ইবনে খাত্তাব,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ লক্ষ্য করুন।

মহানবী (সা.) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন,أنت أخي في الدّنيا و الآخرة অর্থাৎ তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।২৬৫ আমরা আমাদের বিংশতম পত্রে বর্ণনা করেছি রাসূল (সা.) আলীর স্কন্ধে হাত রেখে বললেন, এ আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত ও তোমাদের মাঝে আমার প্রতিনিধি,তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।

একদিন রাসূল (সা.) হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাসূলকে তাঁর আনন্দের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূল উত্তরে বললেন, আমার ভাই ও পিতৃব্যপুত্র এবং আমার কন্যার ব্যাপার আমার প্রভুর পক্ষ হতে আমার নিকট সুসংবাদ এসেছে যে,মহান আল্লাহ্ ফাতিমাকে আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন...। সাওয়ায়েক গ্রন্থের ১০৩ পৃষ্ঠায় আবু বকর খাওয়ারেজমী সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

যখন নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আলী (আ.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হলো তখন নবী (সা.) উম্মে আইমানকে বললেন, আমার ভ্রাতাকে ডাক। উম্মে আইমান বললেন, তিনি আপনার ভ্রাতা এবং আপনি তাঁকে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিচ্ছেন? রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ,উম্মে আইমান। অতঃপর তিনি আলীকে ডেকে আনলেন।২৬৬

মহানবী (সা.) বারবার আলীর প্রতি ইশারা করে বলতেন,

هذا أخي و ابن عمّي و صهري و أبو ولدي

অর্থাৎ এ আমার ভাই,আমার চাচার পুত্র,আমার জামাতা ও আমার সন্তানদের পিতা।২৬৭

একদিন রাসূল (সা.) আলীর সঙ্গে আলোচনা করার সময় বললেন, তুমি আমার ভাই ও বন্ধু। ২৬৮ অন্য একবার তিনি বলেন, তুমি আমার ভ্রাতা এবং বেহেশতে বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবে। ২৬৯ অন্য একদিন আলী,তদীয় ভ্রাতা জা ফর এবং যাইদ ইবনে হারিসার মধ্যে কোন একটি ঘটনায় তাঁকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা.) বলেন, হে আলী! তুমি আমার ভ্রাতা,আমার বংশধরদের পিতা,তুমি আমার হতে এবং আমার প্রতিই তোমার প্রত্যাবর্তন। ২৭০  

অনুরূপ এক দিন আলীকে উপদেশ দিয়ে বললেন, তুমি আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে,আমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করবে। ২৭১ যখন তাঁর (আমার মাতাপিতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত) মৃত্যুকাল উপস্থিত হলো তখন মহানবী বললেন, আমার ভাইকে ডাক। হযরত আলী (আ.) আসলে বললেন, আমার নিকটে আস। তিনি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর পবিত্র মাথা নিজের বুকের ওপর টেনে নিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) তাঁকে অনেক কথা বললেন এবং কথা বলতে বলতেই তাঁর পবিত্র আত্মা দেহ হতে ঊর্ধ্বে যাত্রা করল২৭২ এবং তাঁর বর্ণিত কথাগুলোর একটি হলো : বেহেশতের দ্বারে নিম্নোক্ত কথাটি লেখা রয়েছে-

 لا إله إلّا الله مُحمّد رّسول الله عليّ أخو رسول الله

অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই মুহাম্মদ তাঁর রাসূল আলী রাসূলের ভ্রাতা।২৭৩

মহান আল্লাহ্ লাইলাতুল মাবি তে (অর্থাৎ হিজরতের রাত্রি যে রাত্রিতে হযরত আলী রাসূলের বিছানায় তাঁর স্থানে রাসূলের প্রাণ রক্ষার জন্য শয়ন করেছিলেন) হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.)-কে বললেন, আমি তোমাদের দু জনের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করলাম এবং তোমাদের একজনকে অন্যজন অপেক্ষা দীর্ঘজীবন দান করতে চাই। তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছো তার জীবন সংক্ষিপ্ত ও অন্যজনের জীবন দীর্ঘ হোক। তাঁরা দু জনই নিজ জীবনের দীর্ঘতা চাইলেন। তখন মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে ওহী প্রেরণ করে বললেন, তোমরা আলী ইবনে আবি তালিবের মত হতে পারবে না। আমি মুহাম্মদ ও আলীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছি। আলী মুহাম্মদের বিছানায় শয়ন করেছে যাতে নিজেকে তার জন্য উৎসর্গ করতে পারে এবং এভাবে তার জীবনকে নিজের জীবনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তোমরা পৃথিবীতে নেমে যাও এবং তার জীবন রক্ষা কর। তাঁরা পৃথিবীতে অবতরণ করলেন এবং জিবরাঈল ও মিকাঈল যথাক্রমে হযরত আলী (আ.)-এর মাথা ও পায়ের নিকট অবস্থান নিলেন। হযরত জিবরাঈল আহবান করে বললেন, বাহ! বাহ! হে আবু তালিবের পুত্র! তোমাকে নিয়ে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করছেন। এ ঘটনার পটভূমিতেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ(

এবং মানুষের মাঝে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে বাজী রাখে আর মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।২৭৪ (সূরা বাকারা : ২০৭)

হযরত আলী (আ.) সব সময় বলতেন, আমি আল্লাহর বান্দা,রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা এবং আমিই সিদ্দীকে আকবর। আমি ব্যতীত অন্য কেউ এ দাবী করলে সে মিথ্যাবাদী বৈ কিছু নয়। ২৭৫

হযরত আলী (আ.) আরো বলেছেন, আল্লাহর শপথ,আমি রাসূলের ভ্রাতা,তাঁর চাচার সন্তান ও তাঁর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী,তাই তাঁর কাছে আমা হতে কে অধিকতর যোগ্য? ২৭৬ তৃতীয় খলীফা নির্বাচনের দিন শুরার সদস্য উসমান,আবদুর রহমান,সা দ ও যুবাইরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের কসম দিয়ে বলছি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের দিন রাসূল (সা.) আমাকে ব্যতীত তোমাদের মধ্য হতে কাউকেই কি নিজের ভ্রাতা হিসেবে মনোনীত করেছেন? তাঁরা বললেন, আল্লাহ্ জানেন,না। ২৭৭

বদরের যুদ্ধে যখন আলী (আ.) ওয়ালিদের মুখোমুখি হন তখন ওয়ালিদ তাঁকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আলী (আ.) বলেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের ভ্রাতা। ২৭৮

অনুরূপ একবার হযরত উমরের খিলাফতের সময় আলী (আ.) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, যদি বনি ইসরাঈলের একজন লোক আপনার নিকট আসে ও তাদের একজন বলে : আমি মূসা (আ.)-এর চাচাত ভাই তবে অন্যান্যদের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন কি? হযরত উমর বললেন, অবশ্যই। আলী বললেন, আমি খোদার কসম করে বলছি আমি রাসূলের ভ্রাতা ও চাচাত ভাই। হযরত উমর নিজের গায়ের চাদর খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন ও আল্লাহর শপথ করে বললেন, আপনি অবশ্যই এর ওপর বসবেন যতক্ষণ না আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। রাসূলের  ভ্রাতা ও চাচাত ভাই হবার কারণেই হযরত উমর তাঁর প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেন।২৭৯

৩। আমার কলম আমার এখতিয়ারের বাইরে চলে গিয়েছিল। যা হোক রাসূল (সা.) মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা এবং অন্যায় ও অপবিত্রতা হতে মসজিদ মুক্ত রাখার নিমিত্তে যেসকল সাহাবীর ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন কিন্তু হযরত আলীর ঘরকে পূর্বের মত খোলা রাখেন ও আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত হয়ে আলী (আ.)-এর জন্য অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ মুবাহ ঘোষণা করেন যেমনটি হযরত হারুন (আ.)-এর জন্যও ছিল। এ বিষয়েও আলী ও হযরত হারুন (আ.)-এর মধ্যে আমরা সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যে সকল ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত সেগুলোকে বন্ধ করে দেন আলীর ঘর ব্যতীত। আলী ঐ পথেই মসজিদে প্রবেশ ও অতিক্রম করতেন। যেহেতু ঐ পথ ব্যতীত অন্য পথ ছিল না তাই অপবিত্র অবস্থাতেও সে পথেই বের হতেন। ২৮০

বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ২৮১ একটি হাদীসানুযায়ী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব বলেন, আলীকে তিনটি বস্তু দান করা হয়েছে,এর একটি যদি আমার হত তবে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ (লাল চুলের উষ্ট্র) হতে তা আমার নিকট উত্তম বলে পরিগণিত হত। তাঁর স্ত্রী রাসূলের কন্যা। তাঁর ঘর রাসূলের ঘর ও মসজিদ সংলগ্ন ছিল;সেখানে রাসূলের জন্য যা হালাল ছিল তা তাঁর জন্যও হালাল ছিল এবং খায়বারের দিন রাসূল তাঁর হাতেই পতাকা তুলে দেন। অন্য একটি সহীহ হাদীস মতে একদিন সা দ ইবনে মালিক আলী (আ.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ও অন্যান্যদের মসজিদ হতে বাইরে যাবার নির্দেশ দিলে আব্বাস বললেন : আমাদের বের হতে বলছ অথচ আলীকে কাছে রেখেছ? রাসূল বললেন : আমি তোমাদের বের হতে বা তাকে থাকার নির্দেশ দেই নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বাইরে যেতে ও তাকে এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮২

হযরত যাইদ ইবনে আরকাম বলেন, রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবীরই দরজা মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল ও তাঁরা সে পথে বাইরে যেতেন। রাসূল (সা.) আলীর গৃহ ব্যতীত অন্য সকল গৃহের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা এ বিষয়ে কথা উঠালে রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে বললেন : আমিই মসজিদের দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বারকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি আলীর দ্বার ব্যতীত এবং আমি এরূপ করতে নির্দেশিত হয়েই তা করেছি। ২৮৩

তাবরানী তাঁর আল কাবীর গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) একদিন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন : আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাদের মসজিদ হতে বের হবার নির্দেশ দান করি নি এবং তাকে (আলী)-ও অবস্থান করতে বলি নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বের হতে ও তাকে এখানে অবস্থান করতে বলেছেন। আমি বান্দা হিসেবে তাঁর নির্দেশ পালনকারী মাত্র। ওহীর মাধ্যমে যা আমাকে নির্দেশ দান করা হয় তা ব্যতীত আমি অন্য কিছু করি না। ২৮৪

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তুমি ও আমি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে বৈধ নয় অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করা। ২৮৫

সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আজেব,ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর ও হুজাইফা ইবনে উসাইদ গাফফারী সকলেই বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) মসজিদে আসলেন ও বললেন : মহান আল্লাহ্ মূসাকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্য পবিত্র মসজিদ নির্মাণ কর এবং সেখানে তুমি ও হারুন ব্যতীত কেউ যেন সর্বাবস্থায় অবস্থান না করে। তিনি আমাকেও নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র মসজিদ নির্মাণের সেখানে যেন আমি ও আমার ভাই আলী ব্যতীত অন্য কেউ অবস্থান (সর্বাবস্থায়) না করে। ২৮৬

আমাদের এ ক্ষুদ্র লেখায় এ সম্পর্কিত সকল হাদীস ও রেওয়ায়েত একত্রিত করা সম্ভব নয়। এমন কি নির্ভরযোগ্য যে সকল বর্ণনা ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,যাইদ ইবনে আরকাম,আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হুজাইফা ইবনে উসাইদ,সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব,উমর ইবনে খাত্তাব,আবু যর,আবু তুফাইল,বুরাইদা আসলামী,আবু রাফে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কৃতদাস,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী ও অন্যান্যদের হতে এসেছে তাও লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।

রাসূল (সা.) হতে একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা এরূপ- হে আল্লাহ! আমার ভ্রাতা মূসা আপনার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষকে প্রসারিত করে দিন ও আমার জন্য আমার কাজকে সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন যাতে করে জনগণ আমার কথা বুঝতে পারে। আমার পরিবার হতে আমার ভ্রাতা হারুনকে আমার সহযোগী মনোনীত করুন। তার মাধ্যমে আমার মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করুন ও আমার কাজে তাকে সহযোগী করুন। আপনি তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেছিলেন : অতিশীঘ্রই তোমার ভ্রাতার মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমি শক্তিশালী করবো ও তোমাদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করবো।

হে পরওয়ারদিগার! আমি মুহাম্মদ আপনার বান্দা ও রাসূল। আমার বক্ষকে আপনি প্রসারিত করুন। আমার কর্মকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আমার পরিবার হতে আমাকে একজন সহযোগী দান করুন এবং সে হলো আলী।২৮৭

বাযযার অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে নবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত ধরে বললেন, হযরত মূসা আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন যেন হযরত হারুনের মাধ্যমে তাঁর মসজিদকে পবিত্র রাখেন এবং আমি তাঁর নিকট আলীর মাধ্যমে আমার মসজিদ পবিত্র রাখার প্রার্থনা করছি। অতঃপর একজনকে হযরত আবু বকরের নিকট পাঠালেন যেন তাঁর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারটি বন্ধ করে দেন। তিনি বললেন, শুনলাম ও মেনে নিলাম। অতঃপর একে একে হযরত উমর,হযরত আব্বাসসহ সকল সাহাবীর নিকট এ নির্দেশ পাঠালেন। অতঃপর বললেন, আমি তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করি নি বা আলীর দ্বার উন্মুক্ত রাখি নি,বরং আল্লাহ্ই আলীর দ্বার উন্মুক্ত করেছেন ও তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করেছেন। ২৮৮

হযরত আলী (আ.)-এর হযরত হারুনের সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রমাণ হিসেবে এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট মনে করছি যেখানে তাঁদের পদমর্যাদা ও সম্মানের সর্বজনীনতা প্রমাণিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

পঁয়ত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলোও উল্লেখ করার আহবান।

আল্লাহ্ আপনার পিতাকে রহম করুন। এই আয়াতসমূহ ও হাদীসের দলিলগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং আপনার বর্ণনাও প্রাঞ্জল ও সাহিত্য মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য বর্ণনাসমূহও শোনার ও জানার আগ্রহ ব্যক্ত করছি। মুতাওয়াতির২৮৯ (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো আনুন। আপনার শেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন।

ওয়াসসালাম

ছত্রিশতম পত্র

২৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস।

২।   ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীস।

৩।   বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস।

৪।   যে হাদীসে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

৫।   আলী বর্ণিত হাদীস।

৬। ওয়াহাবের হাদীস।

৭।   ইবনে আবি আছেমের হাদীস।

১। এ বিষয়ে ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলীর জীবনীতে আবু দাউদ তাইয়ালেসী সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসটিই যথেষ্ট। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূল (সা.) আলীকে লক্ষ্য করে বললেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিনের অভিভাবক।

২। উপরোক্ত হাদীসের মত আরেকটি সহীহ হাদীস ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) একদল লোককে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন ও আলীকে সেনানায়ক নিযুক্ত করলেন। যুদ্ধ জয়ের পর আলী (আ.) খুমস হতে একটি ক্রীতদাসী নিজের জন্য গ্রহণ করলে সাধারণ সৈন্যরা এর প্রতিবাদ করল। তাদের চারজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো এ বিষয়ে রাসূলের নিকট অভিযোগ করতে। যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর এ চারজনের একজন রাসূলের নিকট অভিযোগ করে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি শুনেছেন আলী এরূপ এরূপ করেছে? নবী (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিও দাঁড়িয়ে একই অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তৃতীয় ব্যক্তিও প্রথম দু জনের মত অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন চতুর্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে চতুর্থবারের মত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলে রাসূল (সা.) তাদের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন : তোমরা আলী হতে কি চাও? আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আলী আমার পর সকল মুমিনের ওয়ালী (অভিভাবক)। ২৯০

৩। অনুরূপ বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস যা মুসনাদে আহমাদের ৫ম খণ্ডের ৩৫৬ পৃষ্ঠায় এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে দু দল সেনা প্রেরণ করেন। তাদের একদলের নেতৃত্ব আলী ইবনে আবি তালিবের হাতে ও অন্যদলের নেতৃত্ব খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতে ন্যস্ত করেন। নবী দু দলের উদ্দেশ্যে বললেন : যখন তোমরা দু দল একত্রে মিলিত হবে তখন আলী একক সেনাপতি হবে।২৯১ আর যদি মিলিত হতে না পার তবে সেনানায়ক ভিন্ন থাকবে।

বুরাইদাহ্ বলেন, ইয়েমেনের বনি যুবাইদা গোত্রের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং অনেককেই বন্দী করতে সক্ষম হই। আলী তাদের মধ্যে এক নারীকে নিজের জন্য মনোনীত করেন।

বুরাইদাহ্ বলেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ একটি পত্রে ঘটনার বর্ণনা লিখে আমার হাতে দিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বললেন। যখন পত্রটি নিয়ে রাসূলের নিকট গিয়ে পাঠ করলাম তখন তাঁর চেহারা রাগে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এখানে আশ্রয়ের কেন্দ্র,আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে এক ব্যক্তির অধীনে প্রেরণ ও তার নির্দেশ পালন করতে বলেছেন। তাই তার নির্দেশে এ পত্র বহন করে এনেছি। রাসূল (সা.) বললেন : আলীর বিষয়ে মন্দ বলো না। কেননা আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। ২৯২  

নাসায়ী তাঁর খাসায়িসুল আলাভীয়া গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন-

لا تبغضنّ يا بريدة فإنّ عليّا منّي و أنا منه و هو وليّكم بعدي

অর্থাৎ হে বুরাইদাহ্! যাতে আমি আলীর ওপর রাগান্বিত হই এমন কাজ কর না,কারণ আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।

ইবনে জারির২৯৩ বুরাইদাহ্ হতে এভাবে বর্ণনা করেছেন, রাসূলের চেহারা অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে গেল এবং তিনি বললেন :من كنت وليّه عليّ وليّه অর্থাৎ আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

বুরাইদাহ্ বলেন, যা আমার মনে ছিল সব ভুলে গেলাম। মনে মনে বললাম আলীর বিষয়ে আর কখনো মন্দ বলব না।

তাবরানী এ হাদীসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় এসেছে- যখন বুরাইদাহ্ ইয়েমেন হতে ফিরে মসজিদে গেলেন তখন তিনি দেখলেন কিছু সংখ্যক সাহাবী নবী (সা.)-এর ঘরের সামনে বসে রয়েছেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সালাম দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সফরের খবর কি? তিনি বললেন, উত্তম। আল্লাহ্ মুসলমানদের বিজয় দান করেছেন। তাঁরা বললেন, কেন অন্যদের পূর্বেই ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, আলী নিজের জন্য একজন দাসী খুমসের অংশ থেকে নিয়েছে। তাই আমি নবীকে এ খবর দিতে এসেছি যাতে করে সে নবী (সা.)-এর সুনজর হতে বঞ্চিত হয়। নবী (সা.) ঘরের মধ্য হতে একথা শুনে রাগান্বিত হয়ে বাইরে আসলেন ও বললেন, কেন একদল আলীর বিষয়ে মন্দ বলে? তাদের উদ্দেশ্য কি? যে কেউ আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে। যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হয়,সে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়। আলী আমা হতে,সে আমার মাটি হতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি ইবরাহীমের মাটি হতে। আমি ইবরাহীম হতে উত্তম।২৯৪ আমরা একই বংশের,একজন হতে অপরজনের সৃষ্টি। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। হে বুরাইদাহ্! তুমি কি জান না,আলী যে ক্রীতদাসীটি নিয়েছে তদাপেক্ষা অনেক বেশী গণীমতের অধিকারী? তার এ অধিকার রয়েছে কারণ সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।২৯৫

এই হাদীসটি যে রাসূল হতে বর্ণিত এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং বুরাইদাহ্ হতে কয়েকটি সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে যার সবগুলোই নির্ভরযোগ্য।

৪। এরূপ আরেকটি মূল্যবান হাদীস হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন যেখানে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে,তন্মধ্যে নবী (সা.) আলীকে বলেছেন, আমার পর তুমি সকল মুমিনের অভিভাবক হবে। ২৯৬

৫। আরেক স্থানে নবী (সা.) একটি হাদীসে আলী (আ.)-কে বলেছেন, হে আলী! তোমার জন্য আল্লাহর নিকট পাঁচটি বস্তু চেয়েছিলাম। তন্মধ্যে চারটি তিনি দিয়েছেন ও একটি দেন নি.। যেগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো তুমি আমার পর মুমিনদের অভিভাবক হবে। ২৯৭

৬। আল ইসাবাহ্ গ্রন্থে ওয়াহাবের পরিচিতি পর্বে ইবনে সাকান ওয়াহাব ইবনে হামযাহ্ হতে বর্ণনা করেছেন, আলীর সঙ্গে সফরে গিয়ে তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রাসূল (সা.)-এর নিকট তার বিষয়ে অভিযোগ করবো। মদীনায় ফিরে রাসূলের নিকট আলী সম্পর্কে অভিযোগ করলে রাসূল বললেন : আলীর বিষয়ে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের অভিভাবক।

তাবরানীও তাঁর কাবীর গ্রন্থে ওয়াহাব হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে রাসূলের কথাটি এভাবে এসেছে-আলী সম্পর্কে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অধিকারী।২৯৮

৭। ইবনে আবি আছেম মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন : আমি কি মুমিনদের নিজেদের হতে তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

এ বিষয়ে আহলে বাইতের ইমামদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির। এখানে এটুকু বর্ণনাই যথেষ্ট মনে করছি। তদুপরি বেলায়েতের আয়াতটি আমাদের দাবীর সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর।

ওয়াসসালাম

চৌত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   যেদিন আলী (আ.)-এর পুত্রদের শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির বলেছেন।

২।   ভ্রাতৃবন্ধনের দিন।

৩।   মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারসমূহ রুদ্ধ করার দিন।

রাসূল (সা.)-এর জীবনী অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে দেখবেন তিনি আলী ও হারুন (আ.)-কে আসমানের দুই যুগ্ম তারকা ও মানবদেহের দুই চোখের সাথে তুলনা করেছেন। এ দুই উম্মতের মধ্যে তাঁদের থেকে অন্য কেউই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না।

১। আর এজন্যই তিনি চান নি আলী (আ.)-এর সন্তানদের নাম হারুনের সন্তানদের হতে ভিন্ন কিছু হোক। এজন্য তাঁদের হাসান,হুসাইন ও মুহসিন২৬৪ নাম রেখেছেন ও বলেছেন, তাদের নাম হারুনের সন্তানদের সহনামে রাখলাম কারণ তাদের (হারুনের সন্তানদের নাম) শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির ছিল। রাসূল (সা.) তাঁর এই কর্মের মাধ্যমে এ দুই হারুনের মধ্যের মিলকে তুলে ধরে সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বজনীনতা দান করতে চেয়েছিলেন।

২। এজন্যই আলী (আ.)-কে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করে অন্যদের ওপর হারুনের প্রাধান্যের সর্বজনীনতার বিষয়টিকে উল্লেখ করার মাধ্যমে বিষয়টিকে তাকীদ দিয়েছেন। যে দু বার ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠ করা হয় দু বারই তিনি আগ্রহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করুক। এজন্য প্রথম আকদের সময় সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু বকরকে হযরত উমরের সাথে,হযরত উসমানকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টি করলেও দ্বিতীয় আকদের সময় হযরত আবু বকরকে খারাজা ইবনে যাইদের ভ্রাতা এবং হযরত উমরকে উতবান ইবনে মালিকের ভ্রাতা মনোনীত করেন। অথচ উভয় আকদেই আলীকে নিজের ভ্রাতা বলে মনোনীত ও ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে (যার অধিকাংশই সহীহ) তার উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়।

এজন্য ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর,যাইদ ইবনে আরকাম,যাইদ ইবনে আবি আউফি,আনাস ইবনে মালিক,হুজাইফা ইবনে ইয়ামান,মুখদাজ ইবনে ইয়াযীদ,উমর ইবনে খাত্তাব,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ লক্ষ্য করুন।

মহানবী (সা.) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন,أنت أخي في الدّنيا و الآخرة অর্থাৎ তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।২৬৫ আমরা আমাদের বিংশতম পত্রে বর্ণনা করেছি রাসূল (সা.) আলীর স্কন্ধে হাত রেখে বললেন, এ আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত ও তোমাদের মাঝে আমার প্রতিনিধি,তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।

একদিন রাসূল (সা.) হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাসূলকে তাঁর আনন্দের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূল উত্তরে বললেন, আমার ভাই ও পিতৃব্যপুত্র এবং আমার কন্যার ব্যাপার আমার প্রভুর পক্ষ হতে আমার নিকট সুসংবাদ এসেছে যে,মহান আল্লাহ্ ফাতিমাকে আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন...। সাওয়ায়েক গ্রন্থের ১০৩ পৃষ্ঠায় আবু বকর খাওয়ারেজমী সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

যখন নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আলী (আ.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হলো তখন নবী (সা.) উম্মে আইমানকে বললেন, আমার ভ্রাতাকে ডাক। উম্মে আইমান বললেন, তিনি আপনার ভ্রাতা এবং আপনি তাঁকে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিচ্ছেন? রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ,উম্মে আইমান। অতঃপর তিনি আলীকে ডেকে আনলেন।২৬৬

মহানবী (সা.) বারবার আলীর প্রতি ইশারা করে বলতেন,

هذا أخي و ابن عمّي و صهري و أبو ولدي

অর্থাৎ এ আমার ভাই,আমার চাচার পুত্র,আমার জামাতা ও আমার সন্তানদের পিতা।২৬৭

একদিন রাসূল (সা.) আলীর সঙ্গে আলোচনা করার সময় বললেন, তুমি আমার ভাই ও বন্ধু। ২৬৮ অন্য একবার তিনি বলেন, তুমি আমার ভ্রাতা এবং বেহেশতে বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবে। ২৬৯ অন্য একদিন আলী,তদীয় ভ্রাতা জা ফর এবং যাইদ ইবনে হারিসার মধ্যে কোন একটি ঘটনায় তাঁকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা.) বলেন, হে আলী! তুমি আমার ভ্রাতা,আমার বংশধরদের পিতা,তুমি আমার হতে এবং আমার প্রতিই তোমার প্রত্যাবর্তন। ২৭০  

অনুরূপ এক দিন আলীকে উপদেশ দিয়ে বললেন, তুমি আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে,আমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করবে। ২৭১ যখন তাঁর (আমার মাতাপিতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত) মৃত্যুকাল উপস্থিত হলো তখন মহানবী বললেন, আমার ভাইকে ডাক। হযরত আলী (আ.) আসলে বললেন, আমার নিকটে আস। তিনি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর পবিত্র মাথা নিজের বুকের ওপর টেনে নিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) তাঁকে অনেক কথা বললেন এবং কথা বলতে বলতেই তাঁর পবিত্র আত্মা দেহ হতে ঊর্ধ্বে যাত্রা করল২৭২ এবং তাঁর বর্ণিত কথাগুলোর একটি হলো : বেহেশতের দ্বারে নিম্নোক্ত কথাটি লেখা রয়েছে-

 لا إله إلّا الله مُحمّد رّسول الله عليّ أخو رسول الله

অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই মুহাম্মদ তাঁর রাসূল আলী রাসূলের ভ্রাতা।২৭৩

মহান আল্লাহ্ লাইলাতুল মাবি তে (অর্থাৎ হিজরতের রাত্রি যে রাত্রিতে হযরত আলী রাসূলের বিছানায় তাঁর স্থানে রাসূলের প্রাণ রক্ষার জন্য শয়ন করেছিলেন) হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.)-কে বললেন, আমি তোমাদের দু জনের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করলাম এবং তোমাদের একজনকে অন্যজন অপেক্ষা দীর্ঘজীবন দান করতে চাই। তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছো তার জীবন সংক্ষিপ্ত ও অন্যজনের জীবন দীর্ঘ হোক। তাঁরা দু জনই নিজ জীবনের দীর্ঘতা চাইলেন। তখন মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে ওহী প্রেরণ করে বললেন, তোমরা আলী ইবনে আবি তালিবের মত হতে পারবে না। আমি মুহাম্মদ ও আলীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছি। আলী মুহাম্মদের বিছানায় শয়ন করেছে যাতে নিজেকে তার জন্য উৎসর্গ করতে পারে এবং এভাবে তার জীবনকে নিজের জীবনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তোমরা পৃথিবীতে নেমে যাও এবং তার জীবন রক্ষা কর। তাঁরা পৃথিবীতে অবতরণ করলেন এবং জিবরাঈল ও মিকাঈল যথাক্রমে হযরত আলী (আ.)-এর মাথা ও পায়ের নিকট অবস্থান নিলেন। হযরত জিবরাঈল আহবান করে বললেন, বাহ! বাহ! হে আবু তালিবের পুত্র! তোমাকে নিয়ে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করছেন। এ ঘটনার পটভূমিতেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ(

এবং মানুষের মাঝে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে বাজী রাখে আর মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।২৭৪ (সূরা বাকারা : ২০৭)

হযরত আলী (আ.) সব সময় বলতেন, আমি আল্লাহর বান্দা,রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা এবং আমিই সিদ্দীকে আকবর। আমি ব্যতীত অন্য কেউ এ দাবী করলে সে মিথ্যাবাদী বৈ কিছু নয়। ২৭৫

হযরত আলী (আ.) আরো বলেছেন, আল্লাহর শপথ,আমি রাসূলের ভ্রাতা,তাঁর চাচার সন্তান ও তাঁর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী,তাই তাঁর কাছে আমা হতে কে অধিকতর যোগ্য? ২৭৬ তৃতীয় খলীফা নির্বাচনের দিন শুরার সদস্য উসমান,আবদুর রহমান,সা দ ও যুবাইরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের কসম দিয়ে বলছি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের দিন রাসূল (সা.) আমাকে ব্যতীত তোমাদের মধ্য হতে কাউকেই কি নিজের ভ্রাতা হিসেবে মনোনীত করেছেন? তাঁরা বললেন, আল্লাহ্ জানেন,না। ২৭৭

বদরের যুদ্ধে যখন আলী (আ.) ওয়ালিদের মুখোমুখি হন তখন ওয়ালিদ তাঁকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আলী (আ.) বলেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের ভ্রাতা। ২৭৮

অনুরূপ একবার হযরত উমরের খিলাফতের সময় আলী (আ.) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, যদি বনি ইসরাঈলের একজন লোক আপনার নিকট আসে ও তাদের একজন বলে : আমি মূসা (আ.)-এর চাচাত ভাই তবে অন্যান্যদের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন কি? হযরত উমর বললেন, অবশ্যই। আলী বললেন, আমি খোদার কসম করে বলছি আমি রাসূলের ভ্রাতা ও চাচাত ভাই। হযরত উমর নিজের গায়ের চাদর খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন ও আল্লাহর শপথ করে বললেন, আপনি অবশ্যই এর ওপর বসবেন যতক্ষণ না আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। রাসূলের  ভ্রাতা ও চাচাত ভাই হবার কারণেই হযরত উমর তাঁর প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেন।২৭৯

৩। আমার কলম আমার এখতিয়ারের বাইরে চলে গিয়েছিল। যা হোক রাসূল (সা.) মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা এবং অন্যায় ও অপবিত্রতা হতে মসজিদ মুক্ত রাখার নিমিত্তে যেসকল সাহাবীর ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন কিন্তু হযরত আলীর ঘরকে পূর্বের মত খোলা রাখেন ও আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত হয়ে আলী (আ.)-এর জন্য অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ মুবাহ ঘোষণা করেন যেমনটি হযরত হারুন (আ.)-এর জন্যও ছিল। এ বিষয়েও আলী ও হযরত হারুন (আ.)-এর মধ্যে আমরা সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যে সকল ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত সেগুলোকে বন্ধ করে দেন আলীর ঘর ব্যতীত। আলী ঐ পথেই মসজিদে প্রবেশ ও অতিক্রম করতেন। যেহেতু ঐ পথ ব্যতীত অন্য পথ ছিল না তাই অপবিত্র অবস্থাতেও সে পথেই বের হতেন। ২৮০

বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ২৮১ একটি হাদীসানুযায়ী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব বলেন, আলীকে তিনটি বস্তু দান করা হয়েছে,এর একটি যদি আমার হত তবে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ (লাল চুলের উষ্ট্র) হতে তা আমার নিকট উত্তম বলে পরিগণিত হত। তাঁর স্ত্রী রাসূলের কন্যা। তাঁর ঘর রাসূলের ঘর ও মসজিদ সংলগ্ন ছিল;সেখানে রাসূলের জন্য যা হালাল ছিল তা তাঁর জন্যও হালাল ছিল এবং খায়বারের দিন রাসূল তাঁর হাতেই পতাকা তুলে দেন। অন্য একটি সহীহ হাদীস মতে একদিন সা দ ইবনে মালিক আলী (আ.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ও অন্যান্যদের মসজিদ হতে বাইরে যাবার নির্দেশ দিলে আব্বাস বললেন : আমাদের বের হতে বলছ অথচ আলীকে কাছে রেখেছ? রাসূল বললেন : আমি তোমাদের বের হতে বা তাকে থাকার নির্দেশ দেই নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বাইরে যেতে ও তাকে এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮২

হযরত যাইদ ইবনে আরকাম বলেন, রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবীরই দরজা মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল ও তাঁরা সে পথে বাইরে যেতেন। রাসূল (সা.) আলীর গৃহ ব্যতীত অন্য সকল গৃহের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা এ বিষয়ে কথা উঠালে রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে বললেন : আমিই মসজিদের দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বারকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি আলীর দ্বার ব্যতীত এবং আমি এরূপ করতে নির্দেশিত হয়েই তা করেছি। ২৮৩

তাবরানী তাঁর আল কাবীর গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) একদিন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন : আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাদের মসজিদ হতে বের হবার নির্দেশ দান করি নি এবং তাকে (আলী)-ও অবস্থান করতে বলি নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বের হতে ও তাকে এখানে অবস্থান করতে বলেছেন। আমি বান্দা হিসেবে তাঁর নির্দেশ পালনকারী মাত্র। ওহীর মাধ্যমে যা আমাকে নির্দেশ দান করা হয় তা ব্যতীত আমি অন্য কিছু করি না। ২৮৪

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তুমি ও আমি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে বৈধ নয় অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করা। ২৮৫

সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আজেব,ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর ও হুজাইফা ইবনে উসাইদ গাফফারী সকলেই বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) মসজিদে আসলেন ও বললেন : মহান আল্লাহ্ মূসাকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্য পবিত্র মসজিদ নির্মাণ কর এবং সেখানে তুমি ও হারুন ব্যতীত কেউ যেন সর্বাবস্থায় অবস্থান না করে। তিনি আমাকেও নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র মসজিদ নির্মাণের সেখানে যেন আমি ও আমার ভাই আলী ব্যতীত অন্য কেউ অবস্থান (সর্বাবস্থায়) না করে। ২৮৬

আমাদের এ ক্ষুদ্র লেখায় এ সম্পর্কিত সকল হাদীস ও রেওয়ায়েত একত্রিত করা সম্ভব নয়। এমন কি নির্ভরযোগ্য যে সকল বর্ণনা ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,যাইদ ইবনে আরকাম,আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হুজাইফা ইবনে উসাইদ,সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব,উমর ইবনে খাত্তাব,আবু যর,আবু তুফাইল,বুরাইদা আসলামী,আবু রাফে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কৃতদাস,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী ও অন্যান্যদের হতে এসেছে তাও লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।

রাসূল (সা.) হতে একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা এরূপ- হে আল্লাহ! আমার ভ্রাতা মূসা আপনার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষকে প্রসারিত করে দিন ও আমার জন্য আমার কাজকে সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন যাতে করে জনগণ আমার কথা বুঝতে পারে। আমার পরিবার হতে আমার ভ্রাতা হারুনকে আমার সহযোগী মনোনীত করুন। তার মাধ্যমে আমার মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করুন ও আমার কাজে তাকে সহযোগী করুন। আপনি তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেছিলেন : অতিশীঘ্রই তোমার ভ্রাতার মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমি শক্তিশালী করবো ও তোমাদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করবো।

হে পরওয়ারদিগার! আমি মুহাম্মদ আপনার বান্দা ও রাসূল। আমার বক্ষকে আপনি প্রসারিত করুন। আমার কর্মকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আমার পরিবার হতে আমাকে একজন সহযোগী দান করুন এবং সে হলো আলী।২৮৭

বাযযার অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে নবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত ধরে বললেন, হযরত মূসা আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন যেন হযরত হারুনের মাধ্যমে তাঁর মসজিদকে পবিত্র রাখেন এবং আমি তাঁর নিকট আলীর মাধ্যমে আমার মসজিদ পবিত্র রাখার প্রার্থনা করছি। অতঃপর একজনকে হযরত আবু বকরের নিকট পাঠালেন যেন তাঁর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারটি বন্ধ করে দেন। তিনি বললেন, শুনলাম ও মেনে নিলাম। অতঃপর একে একে হযরত উমর,হযরত আব্বাসসহ সকল সাহাবীর নিকট এ নির্দেশ পাঠালেন। অতঃপর বললেন, আমি তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করি নি বা আলীর দ্বার উন্মুক্ত রাখি নি,বরং আল্লাহ্ই আলীর দ্বার উন্মুক্ত করেছেন ও তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করেছেন। ২৮৮

হযরত আলী (আ.)-এর হযরত হারুনের সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রমাণ হিসেবে এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট মনে করছি যেখানে তাঁদের পদমর্যাদা ও সম্মানের সর্বজনীনতা প্রমাণিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

পঁয়ত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলোও উল্লেখ করার আহবান।

আল্লাহ্ আপনার পিতাকে রহম করুন। এই আয়াতসমূহ ও হাদীসের দলিলগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং আপনার বর্ণনাও প্রাঞ্জল ও সাহিত্য মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য বর্ণনাসমূহও শোনার ও জানার আগ্রহ ব্যক্ত করছি। মুতাওয়াতির২৮৯ (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো আনুন। আপনার শেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন।

ওয়াসসালাম

ছত্রিশতম পত্র

২৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস।

২।   ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীস।

৩।   বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস।

৪।   যে হাদীসে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

৫।   আলী বর্ণিত হাদীস।

৬। ওয়াহাবের হাদীস।

৭।   ইবনে আবি আছেমের হাদীস।

১। এ বিষয়ে ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলীর জীবনীতে আবু দাউদ তাইয়ালেসী সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসটিই যথেষ্ট। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূল (সা.) আলীকে লক্ষ্য করে বললেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিনের অভিভাবক।

২। উপরোক্ত হাদীসের মত আরেকটি সহীহ হাদীস ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) একদল লোককে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন ও আলীকে সেনানায়ক নিযুক্ত করলেন। যুদ্ধ জয়ের পর আলী (আ.) খুমস হতে একটি ক্রীতদাসী নিজের জন্য গ্রহণ করলে সাধারণ সৈন্যরা এর প্রতিবাদ করল। তাদের চারজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো এ বিষয়ে রাসূলের নিকট অভিযোগ করতে। যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর এ চারজনের একজন রাসূলের নিকট অভিযোগ করে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি শুনেছেন আলী এরূপ এরূপ করেছে? নবী (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিও দাঁড়িয়ে একই অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তৃতীয় ব্যক্তিও প্রথম দু জনের মত অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন চতুর্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে চতুর্থবারের মত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলে রাসূল (সা.) তাদের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন : তোমরা আলী হতে কি চাও? আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আলী আমার পর সকল মুমিনের ওয়ালী (অভিভাবক)। ২৯০

৩। অনুরূপ বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস যা মুসনাদে আহমাদের ৫ম খণ্ডের ৩৫৬ পৃষ্ঠায় এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে দু দল সেনা প্রেরণ করেন। তাদের একদলের নেতৃত্ব আলী ইবনে আবি তালিবের হাতে ও অন্যদলের নেতৃত্ব খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতে ন্যস্ত করেন। নবী দু দলের উদ্দেশ্যে বললেন : যখন তোমরা দু দল একত্রে মিলিত হবে তখন আলী একক সেনাপতি হবে।২৯১ আর যদি মিলিত হতে না পার তবে সেনানায়ক ভিন্ন থাকবে।

বুরাইদাহ্ বলেন, ইয়েমেনের বনি যুবাইদা গোত্রের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং অনেককেই বন্দী করতে সক্ষম হই। আলী তাদের মধ্যে এক নারীকে নিজের জন্য মনোনীত করেন।

বুরাইদাহ্ বলেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ একটি পত্রে ঘটনার বর্ণনা লিখে আমার হাতে দিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বললেন। যখন পত্রটি নিয়ে রাসূলের নিকট গিয়ে পাঠ করলাম তখন তাঁর চেহারা রাগে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এখানে আশ্রয়ের কেন্দ্র,আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে এক ব্যক্তির অধীনে প্রেরণ ও তার নির্দেশ পালন করতে বলেছেন। তাই তার নির্দেশে এ পত্র বহন করে এনেছি। রাসূল (সা.) বললেন : আলীর বিষয়ে মন্দ বলো না। কেননা আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। ২৯২  

নাসায়ী তাঁর খাসায়িসুল আলাভীয়া গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন-

لا تبغضنّ يا بريدة فإنّ عليّا منّي و أنا منه و هو وليّكم بعدي

অর্থাৎ হে বুরাইদাহ্! যাতে আমি আলীর ওপর রাগান্বিত হই এমন কাজ কর না,কারণ আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।

ইবনে জারির২৯৩ বুরাইদাহ্ হতে এভাবে বর্ণনা করেছেন, রাসূলের চেহারা অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে গেল এবং তিনি বললেন :من كنت وليّه عليّ وليّه অর্থাৎ আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

বুরাইদাহ্ বলেন, যা আমার মনে ছিল সব ভুলে গেলাম। মনে মনে বললাম আলীর বিষয়ে আর কখনো মন্দ বলব না।

তাবরানী এ হাদীসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় এসেছে- যখন বুরাইদাহ্ ইয়েমেন হতে ফিরে মসজিদে গেলেন তখন তিনি দেখলেন কিছু সংখ্যক সাহাবী নবী (সা.)-এর ঘরের সামনে বসে রয়েছেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সালাম দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সফরের খবর কি? তিনি বললেন, উত্তম। আল্লাহ্ মুসলমানদের বিজয় দান করেছেন। তাঁরা বললেন, কেন অন্যদের পূর্বেই ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, আলী নিজের জন্য একজন দাসী খুমসের অংশ থেকে নিয়েছে। তাই আমি নবীকে এ খবর দিতে এসেছি যাতে করে সে নবী (সা.)-এর সুনজর হতে বঞ্চিত হয়। নবী (সা.) ঘরের মধ্য হতে একথা শুনে রাগান্বিত হয়ে বাইরে আসলেন ও বললেন, কেন একদল আলীর বিষয়ে মন্দ বলে? তাদের উদ্দেশ্য কি? যে কেউ আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে। যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হয়,সে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়। আলী আমা হতে,সে আমার মাটি হতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি ইবরাহীমের মাটি হতে। আমি ইবরাহীম হতে উত্তম।২৯৪ আমরা একই বংশের,একজন হতে অপরজনের সৃষ্টি। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। হে বুরাইদাহ্! তুমি কি জান না,আলী যে ক্রীতদাসীটি নিয়েছে তদাপেক্ষা অনেক বেশী গণীমতের অধিকারী? তার এ অধিকার রয়েছে কারণ সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।২৯৫

এই হাদীসটি যে রাসূল হতে বর্ণিত এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং বুরাইদাহ্ হতে কয়েকটি সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে যার সবগুলোই নির্ভরযোগ্য।

৪। এরূপ আরেকটি মূল্যবান হাদীস হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন যেখানে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে,তন্মধ্যে নবী (সা.) আলীকে বলেছেন, আমার পর তুমি সকল মুমিনের অভিভাবক হবে। ২৯৬

৫। আরেক স্থানে নবী (সা.) একটি হাদীসে আলী (আ.)-কে বলেছেন, হে আলী! তোমার জন্য আল্লাহর নিকট পাঁচটি বস্তু চেয়েছিলাম। তন্মধ্যে চারটি তিনি দিয়েছেন ও একটি দেন নি.। যেগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো তুমি আমার পর মুমিনদের অভিভাবক হবে। ২৯৭

৬। আল ইসাবাহ্ গ্রন্থে ওয়াহাবের পরিচিতি পর্বে ইবনে সাকান ওয়াহাব ইবনে হামযাহ্ হতে বর্ণনা করেছেন, আলীর সঙ্গে সফরে গিয়ে তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রাসূল (সা.)-এর নিকট তার বিষয়ে অভিযোগ করবো। মদীনায় ফিরে রাসূলের নিকট আলী সম্পর্কে অভিযোগ করলে রাসূল বললেন : আলীর বিষয়ে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের অভিভাবক।

তাবরানীও তাঁর কাবীর গ্রন্থে ওয়াহাব হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে রাসূলের কথাটি এভাবে এসেছে-আলী সম্পর্কে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অধিকারী।২৯৮

৭। ইবনে আবি আছেম মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন : আমি কি মুমিনদের নিজেদের হতে তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

এ বিষয়ে আহলে বাইতের ইমামদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির। এখানে এটুকু বর্ণনাই যথেষ্ট মনে করছি। তদুপরি বেলায়েতের আয়াতটি আমাদের দাবীর সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর।

ওয়াসসালাম


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53