চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79206
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79206 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

উহুদ যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাবলী

একটি সংখ্যাস্বল্প শ্রেণীর প্রাণ বাজি রেখে লড়াইয়ের কারণে মহানবীর জীবন নিশ্চিত বিপদ থেকে রক্ষা পায়। সৌভাগ্যবশত,অধিকাংশ শত্রুই মনে করেছিল মহানবী (সা.) নিহত হয়েছেন এবং তারা নিহতদের সারিতে মহানবীকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অন্যদিকে যে স্বল্প সংখ্যক লোক মহানবী নিরাপদে আছেন জেনে আক্রমণ করেছিল,তাদেরকে আলী,আবু দুজানাহ্ ও (সম্ভবত) আরও কয়েকজন প্রতিহত করেছিলেন। এ সময় মহানবীর নিহত হবার গুজব যেন অস্বীকার না করাটাই ভালো মনে করা হয়েছিল। মহানবী তখন তাঁর সাথীদের নিয়ে গিরিপথের দিকে গমন করেন।

পথিমধ্যে মহানবী একটি গর্তে পড়ে যান যা মুসলমানদের জন্য আবু আমের খনন করেছিল। তৎক্ষণাৎ আলী মহানবীর হাত ধরে ফেলেন এবং তাঁকে গর্ত থেকে উঠিয়ে ফেলেন। মুসলমানদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম মহানবীকে চিনতে পেরেছিলেন,তিনি ছিলেন কা ব ইবনে মালিক। তিনি দেখলেন,শিরস্ত্রাণের নিচে মহানবীর চোখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি তৎক্ষণাৎ চিৎকার দিয়ে বললেন: হে মুসলমানরা! মহানবী এখানে। তিনি জীবিত আছেন। আল্লাহ্ তাঁকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন!

মহানবী জীবিত আছেন -এ সংবাদের কারণে যখন পাল্টা আক্রমণ জোরদার হচ্ছিল,তখন মহানবী আদেশ দিলেন : কা ব! এ তথ্য তুমি গোপন রাখ। আর তিনিও তাতে নিশ্চুপ হয়ে যান।

শেষ পর্যন্ত মহানবী (সা.) গিরিপথের মুখে পৌঁছেন। এ সময় আশেপাশে যেসব মুসলমান ছিলেন,মহানবী জীবিত আছেন দেখে তাঁরা খুশী হলেন। তাঁরা মহানবীর সম্মুখে লজ্জিত ও অনুতপ্তভাবে উপস্থিত হন। আবু উবাইদা জাররাহ্ মহানবীর মুখের ভেতর ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের দু টি বলয় টেনে বের করেন। আমীরুল মুমিনীন তাঁর ঢালে পানি ভর্তি করে আনেন। মহানবী তাঁর মুখমণ্ডল ও মাথা ধৌত করেন এবং এ বাক্য বলেন :

أشتد غضب الله علي من أدمي وجه نبيّه

যে জাতি তার নবীর মুখমণ্ডলকে রক্তাক্ত করেছে,তার ওপর আল্লাহর ক্রোধ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুযোগের সন্ধানে দুশমন

যে মুহূর্তে মুসলমানরা বিরাট বিপর্যয় ও পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিল,সে সময় সুযোগ সন্ধানী শত্রুরা তাদের মিথ্যা আকীদা-বিশ্বাসের মোক্ষম সুযোগ নেয়। তারা সরলপ্রাণ মানুষকে প্রতারিত করতে পারে এমন স্লোগান তাওহীদী বিশ্বাস ও ধর্মের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করে। সাম্প্রতিককালের একজন লেখকের বক্তব্য অনুসারে মানুষের চিন্তা,মন ও বিশ্বাসে অনুপ্রবেশ ও প্রভাব বিস্তার করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগণ বা জাতির বড় বড় বিপদে পতিত হওয়া বা পরাজয় বরণের চাইতে অন্য কোন পরিবেশ ও সুযোগ অধিকতর অনুকূল নয়। প্রচণ্ড বিপদকালে অত্যাচারিত জাতির মনোবল এতই দুর্বল ও নড়বড়ে হয়ে যায় যে,ঐ জাতির বিবেক-বুদ্ধি নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ সুযোগেই পরাজিত জাতির মন-মগজে অপপ্রচার অতি সহজে অনুপ্রবেশ করতে বা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

আবু সুফিয়ান ও ইকরামাহ্ তখন বড় বড় মূর্তিগুলো হাতের উপর নিয়ে বিজয়োল্লাসে মত্ত হয়ে পড়ল;তারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে স্লোগান দিল : উলু হুবল,উলু হুবল (জয় হুবল,জয় হুবল) অর্থাৎ আমাদের বিজয় মূর্তিপূজার সাথে সংশ্লিষ্ট। হুবল ছাড়া যদি কোন খোদা থাকত এবং তাওহীদবাদের বাস্তবতা থাকত,তা হলে তোমরাই (মুসলমানেরা) বিজয়ী হতে।

মহানবী বুঝতে পারলেন,প্রতিপক্ষ অত্যন্ত স্পর্শকাতর সময়ে এক জঘন্য কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। সুযোগের সদ্ব্যবহারে তারা মেতে উঠেছে। ফলে তিনি যাবতীয় দুঃখ-বেদনার কথা ভুলে যান। তৎক্ষণাৎ তিনি আলী এবং সব মুসলমানকে নির্দেশ দেন,শিরকের এ আহবানকারীদের জয়ধ্বনির জবাবে তোমরা পাল্টা স্লোগান দাও : الله أعلي و أجلّ، الله أعلي و أجلّ আল্লাহ্ অতি উচ্চ,অতি মহান। আল্লাহ্ অতি উচ্চ,অতি মহান।

অর্থাৎ আমাদের এ পরাজয় মহান আল্লাহর বন্দেগীর কারণে নয়,বরং অধিনায়কের আদেশ লঙ্ঘনের ফলে এ (সাময়িক) পরাজয়।

আবু সুফিয়ান এবারও তার বিষাক্ত চিন্তাধারা প্রচার করা থেকে বিরত হলো না এবং বলল :

 نحن لنا العزّي و لا عزّي لكم আমাদের আছে উজ্জা দেবতা। তোমাদের কোন উজ্জা নেই। মহানবী শত্রুর কাছ থেকে সুযোগ কেড়ে নেন। তিনি মুসলমানদের উপত্যকার মাঝে বলিষ্ঠ স্লোগান দেবার নির্দেশ দেন যা ছন্দগত দিক থেকে ছিল মুশরিকদের স্লোগানের পাল্টা জবাব। মুসলমানরা উহুদ প্রান্তর কাঁপিয়ে সমস্বরে বলে উঠলেন :الله مولانا و لا مولى لكم আল্লাহ্ আমাদের প্রভু এবং তোমাদের কোন প্রভু নেই। অর্থাৎ তোমরা মূর্তি-যা পাথর বা কাঠের তৈরি ভাস্কর্য ছাড়া আর কিছু নয়-এর ওপর নির্ভরশীল;আর আমাদের ভরসা ও আশ্রয়স্থল স্বয়ং আল্লাহ্।

শিরকের প্রবক্তারা তৃতীয় বার বলল : আজকের দিন,বদরের দিনের বদলা। মুসলমানরাও মহানবীর নির্দেশে বললেন : এই দু দিন কখনো সমান নয়;আমাদের নিহতরা বেহেশতে আর তোমাদের নিহতরা দোযখে।

আবু সুফিয়ান এসব বজ্রকঠিন জবাবের মোকাবেলায়-যা শত শত মুসলমানের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছিল,ভীষণভাবে বিচলিত হয় এবং একটি বাক্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মক্কার উদ্দেশে ময়দান ত্যাগ করে- আগামী বছর তোমাদের আর আমাদের মধ্যে আবার দেখা হবে। 58

এখন মুসলমানরা কয়েক শ আহত এবং সত্তর জন শহীদকে নিয়ে ক্লান্ত। এরপরও খোদায়ী দায়িত্ব পালন (যুহর ও আসর নামায আদায়) করতে হবে। মহানবী (সা.) ভীষণ দুর্বলতার কারণে বসা অবস্থায় জামাআত সহকারে নামায আদায় করেন। এরপর তিনি উহুদের শহীদগণের দাফন-কাফনের কাজে নিয়োজিত হন।

যুদ্ধ শেষ

যুদ্ধের আগুন নিভে গেলো। উভয়পক্ষ পরস্পর থেকে দূরে সরে গেল। মুসলমানদের নিহতের সংখ্যা ছিল কুরাইশদের নিহতের সংখ্যার তিন গুণ। কাজেই এ প্রিয়জনদের তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে পড়েছিল।

কুরাইশ মহিলারা তাদের বিজয়কালে দেখতে পেয়েছিল,যে কোন অপরাধ সংঘটনের জন্য ময়দান একেবারে উন্মুক্ত। মুসলমানরা শহীদদের কাফন-দাফনের ব্যবস্থার আগে এ মহিলারা এক জঘন্য পৈশাচিকতায় লিপ্ত হয়। এ ধরনের অপরাধ ইতিহাসে বলতে গেলে বিরল ঘটনা। তারা তাদের বাহ্যিক বিজয়ের ওপর সন্তুষ্ট হয় নি,বরং আরো অধিক প্রতিশোধ নেবার জন্য মাটিতে পড়ে থাকা (শহীদ) মুসলমানদের নাক-কান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়। আসলে এর মাধ্যমে তারা নিজেদের গায়ে জঘন্য কালিমা লেপন করে। বিশ্বের সকল জাতির কাছেই শত্রুপক্ষের নিহতরা অসহায় এবং তারা সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু আবু সুফিয়ানের স্ত্রী মুসলমান শহীদগণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গেঁথে গলার মালা তৈরি করে। ইসলামের আত্মত্যাগী বীর সেনাপতি হযরত হামযাহর পেট চিরে ফেলে। তাঁর কলিজা বের করে নিয়ে তা চিবায় এবং খাওয়ার জন্য বহু চেষ্টা করার পরও সে তা খেতে পারে নি। এ কাজটি এত জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক ছিল যে,স্বয়ং আবু সুফিয়ানও বলেছিল : এ কাজের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি এ ধরনের নির্দেশ দিই নি। তবে এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি অসন্তুষ্টও নই।

এ জঘন্য কাজটির কারণে হিন্দ মুসলমানদের মাঝেهند آكلة الأكباد কলিজা ভক্ষণকারিণী হিন্দ নামে কুখ্যাত হয়। পরবর্তীতে হিন্দ্-এর সন্তান-সন্ততিরা কলিজা ভক্ষণকারিণীর সন্তান হিসেবে পরিচিত হয়। মুসলমানরা মহানবীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যান। তাঁরা ঐ সত্তর জন শহীদের লাশ দাফনের প্রস্তুতি নেন। হঠাৎ রাসূলের নযর পড়ে হামযাহর লাশের উপর। হামযাহর মৃতদেহের করুণ অবস্থা দেখে তিনি ভীষণভাবে মর্মাহত হন। ক্রোধের প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায় তাঁর অন্তরে। তিনি মন্তব্য করেন : আমার মধ্যে এখন যে ক্রোধের উদ্রেক ঘটেছে,আমার জীবনে এর আগে কখনো তা হয় নি।

ইতিহাসবেত্তা ও মুফাসসিরগণ সর্বসম্মতভাবে বলেন,মুসলমানরা প্রতিজ্ঞা করল যে (কেউ কেউ মহানবীকেও এই প্রতিজ্ঞায় শামিল বলে উল্লেখ করেন),যদি তারা মুশরিকদের ওপর জয়ী হতে পারে,তা হলে তাদের নিহতদের সাথেও এমন আচরণ করবে। তারা একজনের বদলা ওদের ত্রিশ জনের লাশ বিকৃত করবে (অর্থাৎ লাশগুলোর হাত,পা,নাক,কান কেটে ফেলবে)। তাদের এ সিদ্ধান্তের পর সময় অতিবাহিত না হতেই হযরত জিবরীল এ আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ

হন :

) و إن عاقبتم فعاقبوا بمثل ما عوقبتم به و لئن صبرتم لهو خير للصّابرين(

তোমরা যদি তাদের শাস্তি দাও,তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে,যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্যধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তা-ই উত্তম। 59

এ আয়াত হচ্ছে ইসলামী আইনের সুনিশ্চিত ও সর্বগৃহীত মূলনীতি। পুনরায় এর মাধ্যমে ইসলাম তার আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন আধ্যাত্মিক চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। সে চরিত্র হচ্ছে,ইসলামের আসমানী আদর্শ ও বিধান প্রতিশোধ গ্রহণের ধর্ম বা বিধান নয়। যে কঠিনতম পরিস্থিতিতে মানুষের গোটা অস্তিত্ব জুড়ে ক্রোধের আগুন বইতে থাকে এবং প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে,তখনও ইসলাম ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দানের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করে না। আর এর মাধ্যমে ইসলাম সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচারের মূলনীতি বিবেচনায় এনেছে এবং তা প্রতিষ্ঠিত করেছে।

হামযার বোন সাদিয়া ভাইয়ের লাশ দেখার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন;কিন্তু মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর ছেলে যুবাইর মাকে ভাইয়ের লাশের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছিল। তখন সাদিয়া তাঁর সন্তানকে বলেছিলেন : আমি শুনেছি,আমার ভাইকে তারা বিকৃত করেছে। আল্লাহর শপথ! আমি যদি তাঁর শিয়রে যাই,আমি অস্থিরতা প্রকাশ করব না। আমি আল্লাহর রাস্তায় এই মুসিবতকে মাথা পেতে নেব।

এই প্রশিক্ষিত নারী যথাযথ সংযম সহকারে ভাইয়ের মৃতদেহের শিয়রে যান। তাঁর জন্য নামায পড়েন এবং তাঁর মাগফিরাত কামনা করে ফিরে যান। সত্যই ঈমানের শক্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ। কঠিনতম ঝড়-তুফান ও উত্তেজনাকে এ শক্তি প্রশমিত করে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে তা প্রশান্তি ও মর্যাদা দান করে।

এরপর মহানবী (সা.) উহুদের শহীদগণের জানাযার নামায পড়েন। এরপর তাঁদেরকে কবরে একজন একজন করে বা দু জন দু জন করে দাফন করা হয়। মহানবী (সা.) আমর ইবনে জমূহ ও আবদুল্লাহ্ আমরকে এক কবরে দাফন করার নির্দেশ দেন। তাঁরা পূর্বেও পরস্পর বন্ধু ছিলেন। তাই মৃতাবস্থায়ও তাঁদের পরস্পরের একত্রে থাকা কতই না উত্তম!60

সা দ ইবনে রবীর শেষ কথা

সা দ ইবনে রবী ছিলেন মহানবী (সা.)-এর আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত সাহাবী। বিশ্বাস ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর হৃদয়। বারোটি আঘাতে জর্জরিত হয়ে যখন তিনি মাটিতে পড়েছিলেন,তখন তাঁর পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি যাচ্ছিল। সে তাঁকে বলল : মুহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। সা দ তাকে বললেন : মুহাম্মদের খোদা তো জীবিত আছেন। আমরা মহান আল্লাহর দীনের প্রচার-প্রসারের জন্য জিহাদ করছি এবং তাওহীদের সীমানা রক্ষায় তৎপর রয়েছি।

যুদ্ধের লেলিহান শিখা নির্বাপিত হলে সা দের কথা মহানবী (সা.)-এর মনে পড়লো। তিনি বললেন :

আমার কাছে কে সা দের সংবাদ নিয়ে আসতে পারে?”   যাইদ ইবনে সাবিত সা দের মৃত বা জীবিত থাকার ব্যাপারে সঠিক সংবাদ মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে নিজেই উদ্যোগী হলেন। তিনি সা দকে নিহতদের মাঝে পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাঁকে বললেন : মহানবী (সা.) আমাকে তোমার অবস্থা অনুসন্ধান করে দেখার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। তোমার সঠিক খবর যেন তাঁর কাছে নিয়ে যাই। সা দ বললেন : মহানবী (সা.)-কে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে : সা দের জীবনের কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র বাকী আছে। হে রাসূলাল্লাহ্! মহান আল্লাহ্ আপনাকে একজন নবীর জন্য উপযুক্ত সর্বোত্তম পুরস্কার দান করুন। তিনি আরো বললেন : মহানবীর সাথীগণ এবং আনসারগণের কাছে আমার সালাম পৌঁছাবে এবং বলবে : যদি মহানবীর কোন ক্ষতি হয় আর তোমরা জীবিত থাক,তা হলে কখনোই তোমরা আল্লাহর দরবারে কৈফিয়ত দিতে পারবে না।

সা দের পাশ থেকে মহানবী (সা.)-এর দূত তখনো দূরে চলে যান নি,সা দের প্রাণ অপর জগতের দিকে উড়ে চলে যায়।61

মানুষের নিজের প্রতি আগ্রহ তথা পণ্ডিতদের ভাষায় আত্মপ্রেম এতই শক্তিশালী,মৌলিক ও দৃঢ় প্রোথিত যে,মানুষ কখনো নিজেকে ভোলে না। নিজের সবকিছুকে তার নিজের জন্য কুরবানী করে। কিন্তু ঈমানী শক্তি,আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকর্ষণ ও প্রেম আত্মপ্রীতির চাইতেও শক্তিশালী। কেননা ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ইসলামের এই বীর সৈনিক মৃত্যুর সাথে ব্যবধান কয়েক মুহূর্তের বেশি নয় এমন সময়ও নিজেকে ভুলে যান। তখনও প্রিয়নবীর জীবন নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল। কেননা তিনি মনে করতেন,যে পবিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন,তা পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে হলে মহানবী (সা.)-এর বেঁচে থাকার গুরুত্বই সর্বাধিক। যাইদ ইবনে সাবেতের মাধ্যমে তিনি একমাত্র যে বার্তাটি পাঠান,তা ছিল সাহাবিগণ এক মুহূর্তও যেন মহানবীর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে গাফিলতি প্রদর্শন না করেন।

মহানবী (সা.)-এর মদীনায় প্রত্যাবর্তন

সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছিল। তার সোনালী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল অপর গোলার্ধে। উহুদ প্রান্তর জুড়ে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। ঐ সময়ই প্রচুর হতাহত নিয়ে রণক্লান্ত মুসলমানদের নতুন করে শক্তি সঞ্চয় এবং আহতদের সেবা-শুশ্রুষার জন্য তাদের ঘরে ফেরার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সর্বাধিনায়কের পক্ষ থেকে মদীনা ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়।

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন,তাঁদের সাথে নিয়ে মহানবী মদীনায় প্রবেশ করেন। মদীনায় তখন অধিকাংশ ঘর থেকে পুত্রহারা মা ও স্বামীহারা স্ত্রীদের কান্না ও আহাজারি শোনা যাচ্ছিল।

মহানবী (সা.) বনী আবদুল আশহালের মহল্লায় পৌঁছেন। সেখানকার নারীদের কান্নাকাটি মহানবীকে মর্মাহত করে। তাঁর পবিত্র উজ্জ্বল গণ্ডদেশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি মৃদুস্বরে বললেন :و لكن حمزة لا بواكي له কিন্তু কেউ হামযার জন্য কাঁদছে না। 62

সা দ ইবনে মাআয ও আরো কতিপয় ব্যক্তি মহানবীর উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। তাঁরা একদল নারীকে ইসলামের বীর সেনানায়ক হামযাহর বিয়োগান্ত শাহাদাত সম্পর্কে অবহিত করেন ও ক্রন্দনের আহবান জানান। মহানবী এ ব্যাপারে জানার পর ঐ নারীদের জন্য দুআ করেন এবং বলেন : আমি সব সময়ই আনাসারদের বস্তুগত ও নৈতিক সাহায্য পেয়েছি। অতঃপর তিনি বললেন : ক্রন্দনকারী নারীরা তাদের ঘরে ফিরে যাক।