চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79200
ডাউনলোড: 7043


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79200 / ডাউনলোড: 7043
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

ঈমানদার মহিলার বিস্ময়কর স্মৃতি

ইসলামের ইতিহাসের পাতায় ঈমানদার নারীগণের আত্মত্যাগের ইতিহাস বিস্ময়কর। বিস্ময়কর বলছি এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,আমরা এর দৃষ্টান্ত বা নযীর সমকালীন নারীদের মাঝে কদাচিৎ দেখতে পাই।63

স্বামী,পিতা ও ভাইকে এ যুদ্ধে হারানো বনী দীনার গোত্রের এক মহিলা,একদল মহিলার মাঝে বসে অশ্রুপাত করছিলেন। অন্য মহিলারাও শোকগাথা গেয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। হঠাৎ মহানবী (সা.) ঐ মহিলাদের পাশ দিয়ে গমন করেন। শোকে কাতর এ মহিলা তাঁর চারপাশে যাঁরা ছিলেন,তাঁদের কাছ থেকে মহানবীর খবর জিজ্ঞেস করেন। সবাই বললেন,আলহামদুলিল্লাহ্,আল্লাহর রাসূল সুস্থ আছেন। তিনি বলেন : আমার বড় আগ্রহ নিকট থেকে আমি মহানবীকে দেখব। যে স্থানে মহানবী দাঁড়িয়েছিলেন,তা নারীদের বসার জায়গা থেকে বেশি দূরে ছিল না। তারা তাঁকে দেখিয়ে বলল : ঐ যে রাসূলুল্লাহ্।

মহিলার দৃষ্টি যখন রাসূল (সা.)-এর পবিত্র মুখমণ্ডলের উপর পড়ল,মুহূর্তে তিনি সব শোক,দুঃখ-বেদনা ভুলে গেলেন। তাঁর অন্তরের অন্তস্থল থেকে এমন এক ধ্বনি বের হয়ে এল,যা একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। ঐ মহিলা বললেন : হে রাসূলাল্লাহ্! আপনার পথে সকল দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ আমার জন্য অতি সহজ। আপনি জীবিত থাকলে আমাদের ওপর যত বড় বিপদই আসুক না কেন,তা অত্যন্ত তুচ্ছ;তার প্রতি আমরা মোটেই ভ্রুক্ষেপ করি না।

সাবাশ এই দৃঢ়তা ও অবিচলতার প্রতি! মুবারকবাদ সেই ঈমানের জন্য যা মহাসাগরগামী বিশাল জাহাজের নোঙরের মতো মানুষের অস্তিত্বের তরীকে ভয়ঙ্কর ঝড়-তুফানের মোকাবেলায় অস্থিরতা ও পদস্খলন থেকে রক্ষা করে!64

আত্মত্যাগী নারীগণের আরেক দৃষ্টান্ত

ইতোপূর্বে আমরা আমর ইবনে জামূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তিনি খোঁড়া এবং জিহাদ তাঁর ওপর ফরয না হলেও অনেক পীড়াপীড়ি করে মহানবীর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করেন এবং মুজাহিদদের প্রথম সারিতে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর ছেলে খাল্লাদ এবং তাঁর শ্যালক আবদুল্লাহ্ ইবনে আমরও এ পবিত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা তিনজনই শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী হিন্দ ছিলেন আমর ইবনে হাযামের মেয়ে এবং জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারীর ফুফু। তিনি উহুদ প্রান্তরে যান। তিনি তাঁর প্রিয়ভাজন শহীদগণকে মাটির উপর থেকে তুলে একটি উটের ওপর রাখেন এবং মদীনায় চলে যান।

মদীনার গুজব রটেছিল,মহানবী (সা.) যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয়েছেন। নারীরা মহানবীর ব্যাপারে সঠিক খবর পাওয়ার জন্য উহুদের দিকে রওয়ানা হন। তিনি পথিমধ্যে মহানবীর স্ত্রীগণের সাক্ষাৎ পান। তাঁরা তাঁর কাছ থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অবস্থা জানতে চান। এই নারী তাঁর স্বামী,ভাই ও সন্তানদের লাশ উটের উপর বেঁধে মদীনা নিয়ে যাচ্ছিলেন। এহেন অবস্থায়ও মনে হলো তাঁর যেন কোন বিপদই হয় নি! অত্যন্ত উৎফুল্ল কণ্ঠে তিনি বললেন : আমার কাছে আনন্দের খবর আছে। আল্লাহর রাসূল জীবিত আছেন। এই বিরাট নেয়ামতের মুকাবেলায় সকল দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ নগণ্য ও তুচ্ছ।

অপর খবর হলো,মহান আল্লাহ্ কাফেরদেরকে ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত অবস্থার মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছেন।65 এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো : এই লাশগুলো কার?”   তিনি বললেন : সবই আমার নিজের লোক। একজন আমার স্বামী,অপর আমার সন্তান,তৃতীয় আমার ভাই;মদীনায় দাফন করার জন্য তাদের নিয়ে যাচ্ছি।

আমরা পুনরায় ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যায়ে ঈমানের আরেক দৃষ্টান্ত পাই। অর্থাৎ দুঃখ ও বিপদাপদ তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং পবিত্র লক্ষ্যের জন্য সকল দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করা। এ ঘটনা তারই জ্বলন্ত সাক্ষী। বস্তুবাদী আদর্শ কখনো এ ধরনের আত্মত্যাগী নারী ও পুরুষকে প্রশিক্ষিত করতে পারে নি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,এই ব্যক্তিরা লক্ষ্য ও আদর্শের জন্য লড়াই করেন;পার্থিব ভোগ-লিপ্সা বা পদমর্যাদার জন্য নয়।

এ ঘটনার পর আরো ঘটনা আছে,যা আরো বিস্ময়কয়,যা বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ও যারা ঐতিহাসিক বিষয়াদি বিশ্লেষণ করার জন্য প্রণয়ন করেছে,সেগুলোর আলোকে কখনোই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কেবল মহান আল্লাহর মনোনীত বান্দাগণ এবং ঊর্ধ্ব জগতের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার প্রতি যাঁদের অটুট ঈমান রয়েছে এবং অলৌকিকত্ব ও কারামাতের বিষয়গুলো যাদের কাছে স্পষ্ট,কেবল তাঁরাই এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম এবং সবদিক থেকে সঠিক ও বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করতে পারবেন।

ঘটনার বিবরণ

উটের লাগাম তাঁর হাতে ছিল। মদীনার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু উটটি খুব কষ্টে পথ চলছিল। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে একজন বললেন : নিশ্চয়ই উটের বোঝা খুব ভারী হয়েছে। জবাবে হিন্দ বললেন : এই উট খুব শক্তিশালী। একাই দুই উটের বোঝা বহন করতে পারে। বরং এর অন্য কারণ আছে। তা হচ্ছে,যখনই আমি উটটি উহুদের দিকে নিয়ে যাই,উটটি খুব স্বচ্ছন্দে পথ চলে। আবার যখন মদীনার দিকে নিতে চাই,তখন খুব কষ্টে টেনে নিতে হয় বা হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। হিন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন,উহুদে ফিরে যাবেন এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে এ ঘটনা জানাবেন। তিনি সেই উটটি ও লাশগুলো নিয়ে উহুদ প্রান্তরে যান। উটের পথ চলার বৃত্তান্ত মহানবীকে শোনান। মহানবী বললেন : তোমার স্বামী যখন উহুদ আসছিল,তখন আল্লাহর কাছে কী দুআ করেছিল?”   তিনি জবাব দিলেন : আমার স্বামী আল্লাহর কাছে হাত তুলে মুনাজাত করেছিলেন : হে আল্লাহ্! আমাকে আমার ঘরে ফিরিয়ে আনবেন না।

মহানবী বললেন : তোমার স্বামীর দুআ কবুল হয়েছে। আল্লাহ্ চান না,এ লাশ আমরের ঘরে ফিরে যাক। তোমার এখন কর্তব্য,এই তিনটি লাশই উহুদ প্রান্তরে দাফন করা। জেনে রেখ,পরকালে তারা তিনজনই একত্রে থাকবে।

হিন্দ অশ্রুসিক্ত নয়নে মহানবীর কাছে একটি আবেদন করেন। তা হলো,তিনি যেন দুআ করেন যাতে তিনিও (হিন্দ) তাঁদের সাথে থাকতে পারেন।66

মহানবী (সা.) তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রিয় কন্যা ফাতিমার দৃষ্টি পিতার বিমর্ষ চেহারার উপর পড়ল। তাঁর দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মহানবী তাঁর নিজের তরবারিখানা ধোয়ার জন্য হযরত ফাতিমা যাহরাকে দিলেন।

হিজরী সপ্তম শতাব্দীর দিকে ঐতিহাসিক আরবালী বলেন : মহানবী (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা পানি আনলেন,যাতে পিতার পবিত্র মুখমণ্ডলের রক্ত ধুয়ে ফেলেন। আমীরুল মুমিনীন পানি ঢালছিলেন। কিন্তু আঘাতজনিত ক্ষত গভীর ছিল বলে রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি মাদুরের একটি টুকরো জ্বালিয়ে সেটির ছাই মুখমণ্ডলের ক্ষতস্থানসমূহের উপর লাগিয়ে দেন। ফলে মুখমণ্ডলের ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।67

প্রয়োজন শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন

উহুদের ঘটনার পর মুসলমানরা যে রাতে নিজ নিজ ঘরে ফিরে গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন,তা খুবই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল রাত ছিল। মুনাফিকরা,ইহুদীরা এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের অনুসারীরা এ পরিস্থিতির জন্য দারুণ খুশী হয়েছিল। অধিকাংশ ঘর থেকে শহীদগণের আত্মীয়-স্বজনের কান্নাকাটি ও বিলাপের আওয়ায শোনা যাচ্ছিল।

সবচেয়ে বড় কথা,মুসলমানদের বিরুদ্ধে মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীদের বিদ্রোহের আশংকা ছিল। অন্ততপক্ষে তারা মতবিরোধ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে ইসলামের প্রাণকেন্দ্রের রাজনৈতিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারত।

অভ্যন্তরীণ মতবিরোধজনিত ক্ষয়-ক্ষতি বহিঃশত্রুর আক্রমণের চেয়েও অনেক বেশি। এসব কারণে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের মাঝে ভীতি সঞ্চার করা মহানবী (সা.)-এর অন্যতম কর্তব্য ছিল। তাদেরকে এ কথা বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিল যে,তাওহীদী বাহিনীতে কোনরূপ বিশৃংখলা বা দুর্বলতা প্রবেশ করে নি। বরং অনৈক্য সৃষ্টির যে কোন পাঁয়তারা এবং ইসলামের শক্তিমূলে আঘাত হানার যে কোন তৎপরতা সর্বশক্তি দিয়ে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়া হবে।

মহানবীর ওপর আল্লাহর তরফ থেকে দায়িত্ব অর্পিত হয় যে,ঐ রাতের পরের দিনই শত্রুবাহিনীকে ধাওয়া করতে হবে। মহানবী এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন তিনি যেন সারা শহরে এ কথা ঘোষণা করে দেন যে,গতকাল যারা উহুদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল,তারা যেন আগামীকাল শত্রুবাহিনীকে ধাওয়া করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যারা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি,(আগামীকালের) এ জিহাদে আমাদের সাথে তাদের অংশগ্রহণের অধিকার নেই।

অবশ্য এ অভিযানে যাওয়ার ব্যাপারে উহুদ যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে নি,তাদের বাধা দেয়া বা সীমাবদ্ধতা আরোপের পেছনে কতকগুলো হিকমতপূর্ণ কারণ বিদ্যমান ছিল,যা আলোকিত হৃদয়ের রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের কাছে মোটেই অজ্ঞাত নয়।

প্রথমত এই নিষেধাজ্ঞা এক ধরনের আঘাত ছিল ঐ লোকদের উপর,যারা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। অন্য অর্থে তাদের থেকে যোগ্যতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল এবং প্রকারান্তরে বলা হচ্ছিল যে,প্রতিরক্ষার যুদ্ধে অংশগ্রহণের যোগ্যতা তারা হারিয়ে ফেলেছে।

দ্বিতীয়ত যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের জন্যও একটি শাস্তিমূলক শিক্ষা ছিল। কেননা তাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণেই ইসলাম ও মুসলমানদের এত বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কাজেই তাদেরকেই এই বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,একে পুষিয়ে দিতে হবে,যাতে তারা ভবিষ্যতে আর কখনো এমন শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাজ না করেন।

মহানবী (সা.)-এর পক্ষ হতে ঘোষণা দানকারীর আওয়ায বনী আবদুল আশহালের এক তরুণ শুনতে পায়। ঐ সময় সে তার ভাই সহ আহত শরীরে বিছানায় শুয়েছিল। এই আহবান তাদের এমনভাবে আলোড়িত করে যে,তাদের একটি মাত্র ঘোড়া এবং নানা কারণে তাদের জন্য যুদ্ধযাত্রা সমস্যাপূর্ণ হওয়া সত্বেও তারা পরস্পরকে বলল : আমাদের জন্য কিছুতেই উচিত হবে না যে,মহানবী (সা.) জিহাদের ময়দানে গমন করবেন,আর আমরা তাঁর পেছনে পড়ে থাকব। এই দু যুবক পালাক্রমে ঘোড়ায় চড়ে পরদিন ইসলামী বাহিনীর সাথে মিলিত হয়।68

হামরাউল আসাদ69

মহানবী (সা.) ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনায় স্থলবর্তী রূপে রেখে যান। তিনি মদীনা থেকে আট মাইল দূরে হামরাউল আসাদে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। খুযাআহ্ গোত্রপ্রধানের নাম ছিল মা বাদ খুযায়ী। তিনি মুশরিক হলেও মহানবীকে সমবেদনা জানান। খুযাআহ্ গোত্রের সকল লোকই ইসলামী সেনাবাহিনীর সহায়তা করে। মা বাদ মহানবীকে সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে হামরাউল আসাদ থেকে কুরাইশ বাহিনীর অবস্থানকেন্দ্র রওহা গমন করেন এবং আবু সুফিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বুঝতে পারেন,আবু সুফিয়ান মদীনায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুসলমানদের অবশিষ্ট শক্তি গুঁড়িয়ে দেয়া তার উদ্দেশ্য। মা বাদ আবু সুফিয়ানকে মদীনা প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করেন এবং বলেন :

হে আবু সুফিয়ান! মুহাম্মদ এখন হামরাউল আসাদে আছেন। তিনি মদীনা থেকে অনেক বেশি সেনাশক্তি নিয়ে এসেছেন। গতকাল যারা যুদ্ধে অংশ নেয় নি,তারাও আজ তাঁর সাথে যোগ দিয়েছে।

আবু সুফিয়ান! আমি এমন কতক চেহারা দেখেছি যা ক্রোধে,ক্ষোভে জ্বলজ্বল করছিল। আমি জীবনে এমন ক্রোধান্বিত লোক দেখি নি। মুসলমানরা গতকালের বিশৃঙ্খলার জন্য খুবই অনুতপ্ত।

তিনি মুসলমানদের বাহ্যিক ও মানসিক শক্তি ও শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে কথা বলে আবু সুফিয়ানকে তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করেন।

মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীগণ সহ সারা রাত হামরাউল আসাদে অবস্থান করেন। তিনি গোটা প্রান্তর জুড়ে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন যাতে শত্রুবাহিনী মনে করে,মুসলমানদের যোদ্ধা ও সমরশক্তি গতকাল উহুদ প্রান্তরে যা ছিল,তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। সাফওয়ান উমাইয়্যা আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বলে : মুসলমানরা আঘাতে জর্জরিত,ক্ষত-বিক্ষত ও ক্ষুব্ধ। আমার মনে হয়,এতটুকুই যথেষ্ট;বরং আমাদের উচিত মক্কায় ফিরে যাওয়া। 70

একবারের বেশি প্রতারিত হয় না ঈমানদার

এ উপশিরোনাম মহানবী (সা.)-এর এক বিখ্যাত উক্তির সার কথা। তিনি বলেছেন :

لا يُلدغ المؤمن من جحر مرّتين

মহানবী (সা.) এ উক্তি তখনই করেন,যখন আবু আররা জামহী তাঁর কাছে মুক্তির আবেদন জানায়। লোকটি ইতোপূর্বে বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। বদর যুদ্ধে মহানবী তার কাছ থেকে এই শর্তে প্রতিশ্রুতি নেন যেতাকে মুক্তি দেন এবং,ইসলামের বিরোধিতায় সে মুশরিকদের সহায়তা করবে না। সেও শর্তটি মেনে নেয়। কিন্তু উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়ে সে তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ঘটনাচক্রে হামরাউল আসাদ থেকে ফেরার পথে মুসলমানরা তাকে বন্দী করে। এবারও সে মহানবীর কাছে মুক্তির জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু মহানবী তার অনুরোধের প্রতি কর্ণপাত করেন নি। তিনি এ মন্তব্য করে তার প্রাণদণ্ড কার্যকর করার হুকুম দেন। আর এভাবে উহুদ যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের সমাপ্তি ঘটে।71

অবশেষে সত্তরজন বা চুয়াত্তরজন বা বর্ণনান্তরে একাশি জন শহীদের বিনিময়ে উহুদ যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। অন্যদিকে কুরাইশ বাহিনীর নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র বাইশ জন। এ পরাজয়ের কারণ ছিল গিরিপথের প্রহরীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ। এর বিবরণ ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে। এভাবেই উহুদ যুদ্ধ তৃতীয় হিজরীর 7 শাওয়াল শনিবার সংঘটিত হয় এবং একই সপ্তাহের শুক্রবার হামরাউল আসাদের ঘটনাপ্রবাহ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। 14 শাওয়াল এ যুদ্ধের পূর্ণ সমাপ্তি ঘটে।

হিজরী তৃতীয় সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ইমামতের উজ্জ্বল রত্ন ইমাম মুজতাবা হাসান ইবনে আলীর জন্ম। তিনি হিজরী তৃতীয় সালের রমযান মাসের মধ্যভাগে (15 রমযান) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর জন্মগ্রহণের দিন তাঁর ওপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হয়। তাঁর জন্মের সময় এমন আনুষ্ঠানিকতা উদ্যাপন করা হয়,যার বিবরণ শিয়াদের মহান ইমামগণের জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তেত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

প্রচার-সৈনিকদের ট্র্যাজেডী

যুদ্ধ শেষ হবার পর উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের রাজনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। মুসলমানরা যদিও বিজয়ী বাহিনীর সম্মুখে দৃঢ়তা দেখায় এবং শত্রুবাহিনীর পুনরায় ফিরে এসে আঘাত হানার চেষ্টা প্রতিরোধ করে,কিন্তু উহুদের ঘটনার পর ইসলাম উৎখাত করার লক্ষ্যে ভেতরের ও বাইরের চক্রান্ত ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীদের,শহরের বাইরের মুশরিকদের এবং দূর-দূরান্তের মুশরিক গোত্রগুলোর সাহস বেশ বেড়ে যায়। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সৈন্য সমাবেশ করা থেকে বিরত হচ্ছিল না।

মহানবী (সা.) পূর্ণ দক্ষতার সাথে অভ্যন্তরীণ চক্রান্তগুলো নস্যাৎ করে দেন এবং মদীনার বাইরের যে সব গোত্র মদীনা নগরী আক্রমণের ইচ্ছা পোষণ করছিল,মুজাহিদ যোদ্ধাদের পাঠিয়ে তাদের দমন করেন। এ সময়ই তিনি গোপন সংবাদ পান,বনী আসাদ গোত্র মদীনা দখল করে মুসলমানদের হত্যা ও ধন-সম্পদ লুটপাট করার ষড়যন্ত্র করছে। মহানবী (সা.) তৎক্ষণাৎ একশ পঞ্চাশ সৈন্যের একটি দলকে আবু সালামার অধিনায়কত্বে চক্রান্তকারীদের এলাকায় প্রেরণ করেন। মহানবী অধিনায়ককে নির্দেশ দেন : এ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখবে এবং ভিন্ন পথ ধরে গমন করবে। দিনের বেলা বিশ্রাম নেবে আর রাতের বেলা পথ চলবে। তিনি মহানবীর আদেশ মান্য করেন এবং রাতের বেলা বনী আসাদ গোত্রকে ঘেরাও করে ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেন। তিনি বিজয়ী বেশে বেশ কিছু গনীমতের সম্পদ নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এ ঘটনা হিজরতের পঁয়ত্রিশতম মাসে সংঘটিত হয়।72

ধর্ম প্রচারকগণের হত্যার গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা

মহানবী (সা.) ছোট ছোট সেনাদল পাঠিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিচ্ছিলেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মপ্রচারক দল পাঠিয়ে নিরপেক্ষ গোত্রগুলোর লোকদের মনকে ইসলামের মহান শিক্ষার দিকে আহবান করেছিলেন।

পবিত্র কুরআন,ধর্মীয় বিধানাবলী ও মহানবী (সা.)-এর হাদীস কণ্ঠস্থ ও হৃদয়ঙ্গমকারী দক্ষ মুবাল্লিগগণ (ধর্মপ্রচারক) একান্তই প্রস্তুত ছিলেন,নিজ নিজ জীবন বিপন্ন করেও ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণনা ও সবচেয়ে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছে দেবেন।

মহানবী (সা.) সামরিক বাহিনী ও ধর্মপ্রচারকগণের বিভিন্ন দল প্রেরণ করে মহান নবুওয়াত ও রিসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট দু টি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে সেনাদলসমূহ প্রেরণ ছিল মাথা চাড়া দেয়ার উপক্রম ঐ সব ফিতনা ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে,যাতে নিরাপদ ও মুক্ত পরিবেশে ধর্ম প্রচারকারীগণ তাঁদের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আর সে দায়িত্ব ছিল মানুষের চিন্তা ও মনকে আলোকিত করা ও তাদের হৃদয় জয় করা।

কিন্তু কতিপয় বর্বর ও নীচ গোত্র ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তিরূপ ধর্ম প্রচারক দল-যাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর প্রসার এবং কুফর ও মূর্তিপূজার উচ্ছেদ-তাঁদের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তের জাল বিস্তার করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখানে এই নিবেদিতপ্রাণ ধর্ম প্রচারকারী দলের কাহিনী উপস্থাপন করছি যাঁদের সংখ্যা ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী ছয়73 এবং ইবনে সা দের বর্ণনা মোতাবেক দশ জন।74