চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড1%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 81872 / ডাউনলোড: 7553
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

1

ইসলামের মুবাল্লিগগণের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড

আদাল (عضل ) ও কারা (قاره ) গোত্রের একদল প্রতিনিধি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলে : হে রাসূলাল্লাহ্! আমাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে এবং আমাদের সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আপনি দয়া করে আপনার একদল সাহাবীকে প্রেরণ করুন তাঁরা আমাদের মাঝে ধর্ম প্রচার করবেন,আমাদেরকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবেন এবং মহান আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত হালাল ও হারাম সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবেন। ৭৫

মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব ছিল এই যে,কতিপয় বড় গোত্রের প্রতিনিধি এ দলটির আহবানে সাড়া দেবেন। আর মুসলমানদেরও দায়িত্ব ছিল যে কোন কিছুর বিনিময়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। এ কারণে মহানবী (সা.) মুরসেদ নামক এক সাহাবীর অধিনায়কত্বে একটি দলকে গোত্রগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে উল্লিখিত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তাঁরা গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে মদীনা এবং মুসলমানদের শক্তি ও কর্তৃত্বের আওতার বাইরে চলে যান এবং রাযী নামক এক পানির উৎসের স্থানে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে গোত্রীয় প্রতিনিধিরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটায়। তারা হুজাইল গোত্রের সাহায্য নিয়ে মদীনা থেকে প্রেরিত লোকদের বন্দী ও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ঐ অঞ্চলে মুসলমানরা (মদীনা থেকে প্রেরিত মুবাল্লিগ) যখন শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন,তখন তরবারি ছাড়া তাঁদের আর কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। এ কারণে তরবারির বাঁট শক্ত করে হাতে ধরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য তাঁরা তৈরি হয়ে যান। কিন্তু শত্রুপক্ষ শপথ করে বলে : তোমাদের বন্দী করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হলো তোমাদের জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করে কুরাইশ নেতাদের হাতে তুলে দেয়া এবং তার বিনিময়ে কিছু অর্থ লাভ করা।

মুসলিম মুবাল্লিগগণ একে অপরের দিকে তাকালেন এবং তাঁদের অধিকাংশই সিদ্ধান্ত নিলেন,তাঁরা লড়াই করবেন। তাঁরা বললেন : আমরা মূর্তিপূজারী ও মুশরিকদের কোন প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করব না। অতঃপর তাঁরা তরবারি কোষমুক্ত করেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় ও মহানবী (সা.)-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত লাভ করেন। কিন্তু যাইদ ইবনে দাসিনাহ্,খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ্ তরবারি কোষবদ্ধ করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অর্ধেক পথে এসে আবদুল্লাহ্ আত্মসমর্পণ করার কারণে অনুতপ্ত হন। তিনি হাতের বাঁধন খুলে ফেলেন এবং তরবারি কোষমুক্ত করে শত্রুর ওপর আক্রমণ করেন। শত্রুরা পশ্চাদপসরণ করে এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে ধরাশায়ী করে। তারা তাঁর দিকে এত বেশি পাথর নিক্ষেপ করে যে,তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই প্রাণ হারান। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। কিন্তু অপর দুই বন্দীকে মক্কার কাফেরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বিনিময়ে মুসলমানদের যারা বন্দী করেছিল তাদের দুই বন্দীকে কুরাইশরা মুক্তি দেয়।

সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা,যার পিতা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল,বন্দী যাইদকে ক্রয় করে যাতে একজন ইসলাম প্রচারককে হত্যার মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো যে,এক বিশাল জনতার সামনে যাইদকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। তানঈমে৭৬ ফাঁসিকাষ্ঠ টানানো হয়।

কুরাইশরা ও তাদের মিত্ররা নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে সমবেত হয়। তার মৃত্যুর জন্য কয়েক মুহূর্তের বেশি বাকী ছিল না।

মক্কার ফিরআউন আবু সুফিয়ান সকল ঘটনায় নিজে দূরে থেকে নেপথ্যে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। আবু সুফিয়ান এবার যাইদকে লক্ষ্য করে বলে : তুমি যে আল্লাহকে বিশ্বাস করো,তার শপথ দিয়ে বলছি-আমাকে বলো,তুমি কি চাও যে,মুহাম্মদ তোমার পরিবর্তে নিহত হোক? তা হলে তুমি মুক্তি পাবে এবং নিজ ঘরে ফিরে যাবে।

যাইদ পূর্ণ সাহসিকতার সাথে বললেন :  আমি কখনো রাজি হব না যে,মহানবী (সা.)-এর পায়ে কোন কাঁটা বিদ্ধ হোক,যদিও তার বিনিময়ে আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

যাইদের বলিষ্ঠ জবাব আবু সুফিয়ানকে বিব্রত করে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি সাহাবীগণের ভালোবাসার আধিক্য দেখে বিস্মিত হয়ে সে মন্তব্য করে : আমার দীর্ঘ জীবনে মুহাম্মদের সাথীদের মতো আর কারো সাথী দেখি নি,যারা এত বেশি ত্যাগী হতে পারে,এত অধিক ভালোবাসা পোষণ করতে পারে!

কিছুক্ষণের মধ্যেই যাইদকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। তাঁর প্রাণপাখি উড়ে যায় ঊর্ধ্বলোকের পানে। সত্য ও ন্যায়ের সীমান্ত রক্ষায়,ইসলামের সত্য বাণী প্রচারের লক্ষ্যে এঁরা শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি খুবাইব দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থায় কাটান। মক্কার পরামর্শসভা সিদ্ধান্ত নেয়,তাঁকেও তানঈম-এ ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হবে।৭৭

খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের পাশে মক্কার নেতা ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দু রাকাত নামায আদায়ের অনুমতি গ্রহণ করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে দু রাকাত নামায আদায় করেন এবং কুরাইশ নেতাদের লক্ষ্য করে বলেন : আমি মৃত্যুকে ভয় করি বলে তোমাদের ধারণা হতে পারে-এ সন্দেহ যদি না হতো,তা হলে এর চেয়ে বেশি নামায পড়তাম।৭৮ নামাযের রূকূ ও সিজদা দীর্ঘ করতাম। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আপনার নবীর পক্ষ হতে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা আমরা পালন করেছি। ঐ মুহূর্তে হত্যার আদেশ জারি করা হয়। খুবাইবকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো হয়। খুবাইব ফাঁসিকাষ্ঠের ওপর বলতে লাগলেন : হে আল্লাহ্! আপনি জানেন,আমার একজন বন্ধুও আশেপাশে নেই,যে আমার সালাম মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেবে। হে আল্লাহ্! আপনিই আমার সালাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিন।

হয় তো এই আধ্যাত্মিক পুরুষের ধর্মীয় আবেগ আবু উকবার সহ্য হচ্ছিল না। সে দাঁড়িয়ে খুবাইবের ওপর এক শক্ত আঘাত হানে এবং তাঁকে শহীদ করে।

ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী৭৯ খুবাইব প্রাণত্যাগের পূর্বক্ষণে শূলির উপর এ কয়েক পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন :

فوالله ما أرجو اذا مت مسلما

علي اى جنب كان فى الله مصرعى

وذلك فِى ذات االله و ان يشأ

يبـارك علي اوصـال شلـومـمزع

মহান আল্লাহর শপথ! যদি মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করি,

তা হলে কোন্ এলাকায় আমাকে দাফন করা হবে,তা নিয়ে চিন্তা করি না।

আমার এই হৃদয়বিদারক মৃত্যু আল্লাহর পথে,তিনি যদি চান,

এ শাহাদাত আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মুবারক করে দেবেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহানবী (সা.)-কে দারুণভাবে মর্মাহত করে এবং মুসলমানদের গভীর শোকে নিমজ্জিত করে। মুসলমানদের মহান কবি হাস্সান ইবনে সাবিত এ উপলক্ষে মর্মস্পর্শী কবিতা রচনা করেন যা ইবনে হিশাম তাঁর সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

রাসূল (সা.) এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন,এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এর ফলে বহু কষ্টে প্রশিক্ষিত ইসলাম প্রচারের বীর সেনানীর উপর অপূরণীয় আঘাত আসতে পারে। কুৎসিত অন্তরের ইতর লোকেরা পূত চরিত্রের ধর্মপ্রচারকগণের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যেতে পারে।

এই বীর মুজাহিদের লাশ বহু দিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলন্ত ছিল। একদল লোক লাশ পাহারা দিত। অবশেষে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে দু জন দুঃসাহসী মুসলমান রাতের বেলা ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাঁর লাশ নামিয়ে আনেন এবং দাফন করেন।৮০

বীরে মাউনার ঘটনা

হিজরী চতুর্থ সালের সফর মাসে রাযী নামক স্থানে ইসলামের কৃতি সন্তানদের শাহাদাতের খবর মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছার আগে আবু বাররা আমেরী মদীনায় আগমন করে। মহানবী (সা.) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত কবুল করল না। তবে মহানবী (সা.)-এর খেদমতে আরয করল,যদি তিনি শক্তিশালী কোন ধর্ম প্রচারকারী দলকে নাজদ এলাকায় প্রেরণ করেন,তা হলে তাদের ঈমান আনার আশা করা যায়। কেননা তাওহীদের প্রতি তাদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। মহানবী (সা.) বললেন : নাজদবাসীদের প্রতারণা ও শত্রুতাকে আমি ভয় পাই। আবু বাররা বলল : আপনার প্রেরিত ব্যক্তিবর্গ আমার আশ্রয়ে থাকবেন। আমিই নিশ্চয়তা দিচ্ছি,আমি তাদেরকে যে কোন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করব।

মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে চল্লিশ জন ইসলাম ধর্ম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব,মুনযির-এর নেতৃত্বে নাজদের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁদের সবাই ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেয ও ধর্মীয় বিধানে পারদর্শী। তাঁরা বীরে মাউনার (মাউনার কূপ) কাছে গিয়ে যাত্রা বিরতি করেন। মহানবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একখানা পত্র নাজদ গোত্রীয় নেতা আমর ইবনে তুফাইলের উদ্দেশে লিখেছিলেন। তাঁর পত্র আমেরের কাছে পৌঁছানোর জন্য একজন মুসলমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমের শুধু যে মহানবী (সা.)-এর চিঠিখানা পড়ে নি,তা নয়;বরং পত্রবাহককেও হত্যা করে। এরপর সে তার গোত্রের লোকদের ইসলাম প্রচারকগণকে হত্যা করার আহবান জানায়। গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে এবং বলে,গোত্রের মুরব্বী আবু বাররা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিজ গোত্রের লোকদের সাহায্যের ব্যাপারে সে নিরাশ হয় এবং আশেপাশের গোত্র ও সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চায়। এভাবে ইসলামের মুবাল্লিগগণের অবস্থানস্থলটি আমেরের লোকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়।

ইসলামের প্রচারকারীরা শুধু যে বড় জ্ঞানী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন,তা-ই নয়;বরং বীর যোদ্ধাও ছিলেন। তাঁরা আত্মসমর্পণকে নিজেদের জন্য অবমাননাকর মনে করেন এবং তরবারি হাতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। শুধু কা ব ইবনে যাইদ আহত শরীর নিয়ে কোনমতে মদীনা পৌঁছেন এবং ঘটনাটি মহানবীকে অবহিত করেন।

এ হৃদয়বিদারক ঘটনা গোটা ইসলামী বিশ্ব ও মুসলমানদের দারুণভাবে মর্মাহত করে। মহানবী (সা.) বহু দিন ধরে বীরে মাউনার স্মরণ করতেন।৮১

এ দু টি ঘটনাই ছিল উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কেননা এর ফলে মুসলমানদের হত্যার জন্য আশেপাশের গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল।

প্রাচ্যবিদদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান

প্রাচ্যবিদরা যেখানে কোন মুশরিকের মুখে সামান্য আঁচড় লাগলেই সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের উপর মারমুখী হয়ে যান,আর জোর করে এ কথা বলার চেষ্টা করেন যে,ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে,তাঁরা এই বেদনাদায়ক দু টি ঘটনার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেন নি।

বিশ্বের কোথায় আছে যে,জ্ঞানের ঝাণ্ডাবাহীদের হত্যা করা হয়? ইসলাম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়ে থাকলে এই মিশনারী দলগুলো কেন প্রাণকে হাতের তালুতে রেখে ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন এবং শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেছেন?

এ দু টি ঘটনার অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে। তাঁদের ঈমানের শক্তি,আত্মত্যাগ,জান বাজি রেখে যুদ্ধ ও সাহসিকতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়,বিস্ময়কর এবং মুসলমানদের জন্য প্রেরণার উৎস।

মুমিন কখনো একবারের বেশি প্রতারিত হয় না

রাযী ও বীরে মাউনার হৃদয়বিদারক ঘটনায় ইসলামের বহু মুবাল্লিগ শহীদ হওয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে দারুণ মর্মবেদনার সৃষ্টি হয়। এক অস্বাভাবিক ধরনের বিষাদ মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখানে এসে পাঠকদের মনে হয় তো প্রশ্ন জাগবে,মহানবী (সা.) কেন এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন? প্রথম ঘটনায় অর্থাৎ রাযীর নিকটে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে,তারপরও অপর চল্লিশ ব্যক্তিকে তিনি কেন বীরে মাউনায় পাঠালেন? মহানবী (সা.) কি নিজেই বলেন নি : لا يلدغ المؤمن من جُحر مرّتين মুমিন (সর্পের) এক গর্ত হতে দু বার দংশিত হয় না।

এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেননা ইসলাম প্রচারকারী দলটি আবু বাররার গোত্রের হাতে শহীদ হন নি। যদিও তার ভাতিজা আমের ইবনে তুফাইল আবু বাররার গোত্র-যা তার নিজেরও গোত্র-ইসলাম প্রচারকদের হত্যার জন্য প্ররোচিত করছিল,কিন্তু ঐ গোত্রের একজনও তার কথায় সায় দেয় নি। সবাই বলেছিল : তোমার চাচা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমের ইবনে তুফাইল পার্শ্ববর্তী ভিন্ন গোত্র সালীম যাকওয়ান -এর কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং ইসলাম প্রচারকগণকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইসলামের প্রচার সৈনিকরা আবু বাররার এলাকার উদ্দেশে গমনকালে নিজেদের মধ্য থেকে আমর ইবনে উমাইয়্যা ও হারিস ইবনে সিম্মাহকে৮২ তাঁদের উটগুলো চরানো ও দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁরা তাঁদের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় হঠাৎ আমের ইবনে তুফাইল তাঁদের ওপর চড়াও হয়। ফলে হারিস ইবনে সিম্মাহ্ নিহত হন এবং আমর ইবনে উমাইয়্যাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমর ইবনে উমাইয়্যা মদীনায় ফিরে আসার সময় দু জন লোকের সাক্ষাৎ পান। তিনি নিশ্চিত হন,তারা সেই গোত্রের লোক যারা দীনের মুবাল্লিগগণকে হত্যা করেছে। এ কারণে তিনি উভয়কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন।

তাঁর এ কাজটি ভুল ধারণার কারণে হয়েছিল। কেননা তারা আবু বাররার (বনী আমের) গোত্রের লোক ছিল,যারা আপন গোত্রপতির প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের দলের ওপর হামলা চালাতে রাযী হয় নি।

এ ঘটনার ফলেও মহানবী (সা.)-এর মর্মবেদনা বৃদ্ধি পায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন,ঐ দু জনের রক্তমূল্য তিনি পরিশোধ করবেন।

তবে এ ব্যাপারে তাবাকাতে ইবনে সা দ-এর৮৩ প্রণেতা স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন,উভয় দলের পরিণতির খবর একই রাতে মহানবী (সা.)-এর কাছে পৌঁছায়। দ্বিতীয় দলটি পাঠানোর সময় মহানবী (সা.) রাযীর শহীদদের ভাগ্যে কী ঘটেছে,তা জানতেন না।

চৌত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

বনী নাযীরের যুদ্ধ

মদীনার মুনাফিক ও ইহুদীরা উহুদে মুসলমানদের পরাজয় এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণের নিহত হবার ঘটনায় দারুণ খুশী হয়েছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল,মদীনায় কোন বিদ্রোহ ঘটাবে। এর মাধ্যমে মদীনার বাইরের গোত্রগুলোকে বোঝাবে যে,মদীনায় ন্যূনতম ঐক্য ও সংহতি বিদ্যমান নেই। কাজেই বহিঃশক্তি এসে ইসলামের নব্য প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করতে পারবে।

মহানবী (সা.) বনী নাযীর গোত্রের ইহুদীদের উদ্দেশ্য ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য একদল সৈনিকসহ তাদের দুর্গের দিকে গমন করেন। কিন্তু বনী নাযীরের সাথে যোগাযোগের পেছনে মহানবীর দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছিল আমর ইবনে উমাইয়্যার হাতে নিহত বনী আমের গোত্রের দুই আরবের রক্তমূল্য পরিশোধে তাদের সহায়তা নেয়া। কেননা বনী নাযীর গোত্র মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ওদিকে বনী আমেরের সাথেও তাদের মৈত্রীচুক্তি ছিল। চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলো সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

মহানবী (সা.) দুর্গের প্রবেশদ্বারে অবতরণ করেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যের কথা গোত্রীয় প্রধানদের কাছে তুলে ধরেন। তারা দৃশ্যত খোলা মনে মহানবীকে অভ্যর্থনা জানায় এবং কথা দেয়,রক্তমূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারা তাঁকে সাহায্য করবে। তারা মহানবীকে তাঁর ডাকনাম আবুল কাসেম -এ সম্বোধন করে অনুরোধ করতে থাকে : আপনি আমাদের দুর্গে প্রবেশ করুন এবং একটি দিন এখানে অবস্থান করুন। রাসূল তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন না;বরং দুর্গের দেয়ালের ছায়ায় সাথী ও সৈনিকগণ সহ বসেন এবং বনী নাযীর গোত্রের সর্দারদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন।৮৪

মহানবী (সা.) উপলব্ধি করেন,তাদের মিষ্টি মিষ্টি কথার সাথে এক ধরনের সংশয়পূর্ণ রহস্যজনক তৎপরতা মিশে আছে। অন্যদিকে তিনি যেখানে বসে ছিলেন,সেখানে লোকজনের আনাগোনা বেশি করে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কানে কানে কথাবার্তা বেশি হচ্ছিল,যা থেকে সহজেই সন্দেহ জাগে। মূলত বনী নাযীরের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল,মহানবীকে অতর্কিত আক্রমণ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেবে। তাদের একজন আমর হাজ্জাশ প্রস্তুতি নিয়েছিল,সে ছাদের উপর যাবে এবং মহানবী (সা.)-এর উপর একটি পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করবে।

সৌভাগ্যজনকভাবে তাদের নীল-নকশা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের সন্দেহপূর্ণ ও অসংলগ্ন আচরণ থেকে তাদের চক্রান্ত আঁচ করা যাচ্ছিল। আল ওয়াকিদীর বর্ণনা অনুযায়ী ওহীর ফেরেশতা মহানবীকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তিনি তাঁর স্থান থেকে সরে বসেন এবং এমনভাবে মজলিস ছেড়ে উঠে যান যে,ইহুদীরা মনে করল,কোন কাজে তিনি বাইরে যাচ্ছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু রাসূল (সা.) মদীনার পথ ধরে অগ্রসর হন। তাঁর সাহাবীগণকেও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানালেন না। তাঁরা তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলেন। কিন্তু তাঁরা যতই অপেক্ষা করুন,তাতে কোন ফল হলো না।

বনী নাযীরের ইহুদীরা দারুণ দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেল। তারা একদিকে ধারণা করছিল যে,মহানবী (সা.) তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছেন। তা-ই যদি হয়,তবে তাদের বড় ধরনের শাস্তি পেতে হবে। অপরদিকে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল : মহানবী যেহেতু এখন আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছেন,তার প্রতিশোধ আমরা তার সাথীদের কাছ থেকেই নিই। তবে সাথে সাথে বলছিল যে,এ অবস্থায় পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে যাবে এবং মহানবী (সা.) নিঃসন্দেহে আমাদের কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেবেন।

এহেন পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.)-এর সাথে যাঁরা এসেছিলেন,তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন,মহানবীর খোঁজে তাঁরা যাবেন এবং তিনি কোথায় আছেন,তা সন্ধান করবেন। দুর্গের প্রাচীর থেকে বেশি দূরে যেতে না যেতেই তাঁরা এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান,যিনি মদীনা থেকে আসছিলেন। তিনি মহানবীর মদীনা প্রবেশের সংবাদ নিয়ে আসেন। তাঁরা তৎক্ষণাৎ মহানবীর নিকট উপস্থিত হন। সেখানেই তাঁরা ইহুদীদের চক্রান্তের কথা জানতে পারেন,যা ওহীর ফেরেশতা জিবরীল (আ.) তাঁকে জানিয়েছিলেন।৮৫

এ জঘন্য অপরাধ মোকাবেলায় করণীয়

এখন এ বিশ্বাসঘাতকদের ব্যাপারে মহানবীর করণীয় কি? এরাই সেই সম্প্রদায় যারা ইসলামী হুকুমতের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল। ইসলামের সৈনিকরা তাদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করছিলেন। জীবনভর তারা মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বচক্ষে দেখছিল। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে শেষ নবীর সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য ও প্রমাণ দেখতে পেয়েছে;অথচ তাঁকে আতিথেয়তার পরিবর্তে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছে। অত্যন্ত কাপুরুষোচিত পন্থায় তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছে।

এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের দাবী কী? এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরূপ বিশ্বাসঘাতকতার মূলোৎপাটন করা হয়,তার জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে?

এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) গৃহীত পদ্ধতি ছিল যুক্তিসঙ্গত। গোটা সেনাবাহিনীতে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমা আউসীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দেন,অতি সত্বর তাঁর পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত হুকুম যেন বনী নাযীরের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। তিনি বনী নাযীরের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বললেন : ইসলামের মহান নবী আমার মাধ্যমে তোমাদের কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছেন যে,দশ দিনের মধ্যে অবশ্যই তোমরা এই ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাবে। কেননা তোমরা চুক্তিভঙ্গ করেছ,প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছ। যদি দশ দিনের মধ্যে এ এলাকা ত্যাগ না কর,তা হলে তোমাদের রক্ত প্রবাহিত করা হবে।

এ বার্তা ইহুদীদের মধ্যে মারাত্মক হতাশার সৃষ্টি করে। তারা প্রত্যেকে এ ষড়যন্ত্রের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে। তাদের জনৈক নেতা সবাইকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব করে। কিন্তু অধিকাংশের গোয়ার্তুমী এ প্রস্তাব গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চরম অসহায়ত্ব তাদের ঘিরে ধরে। নিরুপায় হয়ে মুহাম্মদ ইবনে মুসলিমার উদ্দেশে বলে : হে মুহাম্মদ! আপনি আউস গোত্রের লোক। মহানবীর আগমনের পূর্বে আউস গোত্রের সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল। এখন কেন আমাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন?”   তিনি পূর্ণ সৎ সাহস ও বলিষ্ঠতা সহকারে বললেন : সেদিন পার হয়ে গেছে। এখন মানুষের মন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

এ সিদ্ধান্ত সেই চুক্তির আওতায় নেয়া হয়,যে চুক্তি মহানবীর মদীনা আগমনের প্রথম দিনগুলোয়ই তিনি মদীনার ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে সম্পাদন করেছিলেন। ঐ চুক্তিতে বনী নাযীর গোত্রের পক্ষে হুইয়াই ইবনে আখতাব স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির বিষয়বস্তু আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে : মহানবী তিন গোত্রের সাথেই (বনী নাযীর,বনী কাইনুকা ও বনী কুরাইযাহ্) চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন,তারা কখনো রাসূলুল্লাহ্ ও তাঁর সাহাবীগণের ক্ষতি করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেবে না;মুখে বা হাতে তাঁদের কোন ক্ষতি করবে না।... যদি ঐ তিন গোত্রের কোন একটি চুক্তির বিষয়বস্তুর বিরোধী আচরণ করে,তা হলে তাদের রক্তপাত ঘটানো,সম্পদ বাজেয়াফ্ত করা এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী করার অধিকার মহানবীর থাকবে।৮৬

কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন

প্রাচ্যবিদদের দেখা যায়,এখানে এসে তাঁরা পুনরায় কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন শুরু করে দেন। তাঁরা মায়ের চেয়ে মাসীর দরদের মতো বনী নাযীর গোত্রের বিশ্বাসঘাতক,চুক্তিভঙ্গকারী ইহুদীদের জন্য যারপর নাই অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তারা মহানবীর কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তাদের এ মায়াকান্না ও সমালোচনা সত্য উদ্ঘাটন বা প্রকৃত বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে নয়। কেননা সম্মানিত পাঠকবর্গ ইহুদীদের সাথে মহানবীর চুক্তির যে বিবরণ পাঠ করেছেন,তাতে এ মতটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে,মহানবী তাদের জন্য যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তা চুক্তিপত্রে উল্লিখিত শাস্তির চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক লঘু। আজকের দিনে এসব প্রাচ্যবিদের প্রভুদের পক্ষ থেকে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে কত জঘন্য অপরাধ করা হচ্ছে,অথচ এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্য হতে একজনও সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) যখন মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতককে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে উল্লিখিত শাস্তির চেয়েও কম শাস্তির ব্যবস্থা করেন,তখন কতিপয় লেখক সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন। অথচ এসব লেখক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ জাতীয় ঘটনাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকেন।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49

50

51

52

53