চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড0%

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড লেখক:
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: হযরত মোহাম্মদ (সা.)

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ জাফার সুবহানী
: মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 79237
ডাউনলোড: 7054


পাঠকের মতামত:

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-প্রথম খণ্ড চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 238 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 79237 / ডাউনলোড: 7054
সাইজ সাইজ সাইজ
চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

চিরভাস্বর মহানবী (সা.)-দ্বিতীয় খণ্ড

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

মুনাফিক দলের ভূমিকা

মুনাফিক দলের ভূমিকা ছিল ইহুদীদের চেয়েও মারাত্মক। কেননা মুনাফিকরা বন্ধুর বেশে পেছন থেকে পিঠে ছুরি মারছিল। এদের নেতা ছিল আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ও মালেক ইবনে উবাই। এরা মুসলমানদের সামনে বন্ধুত্বের মুখোশ পরেছিল। এরা দ্রুত বনী নাযীর গোত্রের নেতাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায় যে,আমরা দু হাজার সৈন্য দিয়ে তোমাদের সাহায্য করব। আর তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রসমূহ অর্থাৎ বনী কুরাইযাহ্ ও বনী গাতফান তোমাদের একাকী ছেড়ে দেবে না। এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দানের কারণে ইহুদীদের সাহস বেড়ে যায়। শুরুতে তারা আত্মসমর্পণ করে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। তারা দুর্গের প্রবেশদ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয় এবং যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়,যে কোন মূল্যেই হোক,প্রতিরক্ষার লড়াই করবে এবং বিনামূল্যে তাদের ক্ষেত-খামার মুসলমানদের হাতে তুলে দেবে না।

বনী নাযীর গোত্রের অন্যতম সর্দার সালাম ইবনে মুশকাম,আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের অঙ্গীকারকে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করে এবং বলে,কল্যাণজনক হচ্ছে সবার চলে যাওয়া। কিন্তু হুয়াই ইবনে আখতাব জনসাধারণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানায়।

রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের বার্তা সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনায় স্থলবর্তী হিসেবে রেখে যান এবং তাকবীর ধ্বনি দিয়ে বনী নাযীর গোত্রের দুর্গ অবরোধের জন্য অগ্রসর হন। বনী নাযীর ও বনী কুরাইযার মধ্যবর্তী স্থানে তিনি শিবির স্থাপন করেন এবং উভয় গোত্রের মধ্যেকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী87 ছয় দিন ছয় রাত এবং অন্য কয়েকজনের বর্ণনা মোতাবেক 15 দিন তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু ইহুদীরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং দৃঢ়তা প্রদর্শন করে। মহানবী (সা.) দুর্গের আশ-পাশের খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দেন,যাতে ইহুদীরা এ ভূখণ্ডের প্রতি লোভের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়।

এ সময় দুর্গের ভেতর থেকে ইহুদীদের চিৎকার শুরু হয় এবং তারা বলে : হে আবুল কাসেম (মুহাম্মদ)! আপনি সব সময় আপনার সৈন্যদের গাছ-পালা কাটতে নিষেধ করেছেন। এখন কেন সে কাজ করার নির্দেশ দিলেন?”   তবে এর কারণ যেটি ছিল তা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইহুদীরা আগের ফয়সালা মেনে নিতে রাযী হয়ে যায়। তারা একমত হয়ে বলল : আমরা দেশত্যাগ করে চলে যেতে রাযী আছি;তবে শর্ত হলো আমাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি আমাদের সাথে নিয়ে যাব। মহানবী (সা.) এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং বললেন,তারা অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে যেতে পারবে,তবে অস্ত্রগুলো নিতে পারবে না;সেগুলো মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করতে হবে।

লোভাতুর ইহুদীরা তাদের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে যাবার ব্যাপারে যারপর নাই চেষ্টা চালায়। এমনকি ঘরের দরজাগুলোও চৌকাঠসহ নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়। বাকী ঘরগুলো নিজেদের হাতে ভেঙে ফেলে। তাদের একদল খাইবর ও আরেক দল সিরিয়ায় চলে যায়। তবে তাদের কেবল দু ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে। পরাজিত ও অপদস্থ এ জাতিটি এ পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার জন্য দফ বাজিয়ে,গান গেয়ে মদীনা ত্যাগ করে এবং এ আচরণের মধ্য দিয়ে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে,এ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তারা ততটা চিন্তিত বা মনঃক্ষুণ্ণ হয় নি।

মুহাজিরগণের মধ্যে বনী নাযীরের ক্ষেত-খামার বণ্টন

ইসলামের সৈনিকগণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া শত্রুপক্ষের কাছ থেকে যে সম্পদ গনীমত হিসেবে লাভ করেন,পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী88 তা সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর মালিকানাধীন। তিনি যেভাবে ভালো মনে করেন,ইসলামের কল্যাণে তা ব্যয় করবেন। মহানবী এটাই কল্যাণকর মনে করলেন যে,এই ক্ষেত-খামার,পানির উৎস ও বাগানগুলো মুহাজিরগণের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কেননা মক্কা থেকে হিজরত করে আসার কারণে তাঁদের হাতে জাগতিক সহায়-সম্পদ ছিল না বললেই চলে। তাঁরা আনসারগণের উপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের মেহমান হিসেবেই ছিলেন। এ মতটিকে সা দ ইবনে উবাদা ও সা দ ইবনে মায়ায সমর্থন করেন। এ কারণে সকল জমি মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণের মধ্যে বণ্টন করা হয় এবং আনসারগণের মধ্যে অত্যন্ত দরিদ্র হবার কারণে সাহল ইবনে হাদীদ এবং আবু দুজানাহ্ ছাড়া অন্য কেউ তার ভাগ পান নি। এভাবে সকল মুসলমানের সার্বিক অবস্থার উন্নতির একটি ব্যবস্থা হয়। বনী নাযীর গোত্রের জনৈক নেতার মূল্যবান তরবারিটি সা দ ইবনে মায়াযকে প্রদান করা হয়।

হিজরী চতুর্থ শতকের রবিউল আউয়াল মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। সূরা হাশরও এ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। আমরা দীর্ঘতা এড়ানোর জন্য এ সূরার আয়াতসমূহের অনুবাদ ও তাফসীর হতে বিরত থাকছি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন,এ ঘটনায় কোনরূপ রক্তপাত ঘটে নি। কিন্তু মরহুম শেখ মুফীদ বলেন,বিজয়ের রাতে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে বনী নাযীর গোত্রের দশজন ইহুদী নিহত হয় এবং তারা নিহত হবার ফলে ইহুদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।89

পঁয়ত্রিশতম অধ্যায় : চতুর্থ হিজরীর ঘটনাপ্রবাহ

মদ ও নেশাকর পানীয় নিষিদ্ধকরণ

মদ এবং সামগ্রিকভাবে মাদকদ্রব্য মানব সমাজের অন্যতম জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক আপদ ছিল এবং এখনো রয়েছে। এ ধ্বংসকারী বিষাক্ত দ্রব্যাদির নিন্দায় এটুকুই যথেষ্ট যে,অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্যের সর্বপ্রধান সম্বল জ্ঞান-বু্দ্ধির সাথে এ মাদকদ্রব্য সাংঘর্ষিক। মানুষের সৌভাগ্য ও কলাণের নিয়ামক হচ্ছে তার জ্ঞান ও বিবেক। অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের যে ব্যবধান,তা মানুষের এ অভ্যন্তরীণ শক্তির উপরই নির্ভরশীল। এলকোহল (মদ) বা মাদকদ্রব্য এর চরম শত্রু। এ কারণে মদ ও নেশাকর পানীয় অর্থাৎ মাদকদ্রব্য সেবন প্রতিরোধ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নবী-রাসূলগণের অন্যতম কর্মসূচী ছিল। একই কারণে সকল শরীয়তে মদ সম্পূর্ণ হারাম ঘোষিত হয়েছে।90

আরব উপদ্বীপে মদপান একটি গণ-মুসিবত ও মহামারী আকারে বিদ্যমান ছিল। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তার মূলোৎপাটনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। পরিবেশের চাহিদা এবং সাধারণভাবে সব আরবের অবস্থা ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দিচ্ছিল না যে,মহানবী (সা.) কোন পটভূমি ছাড়াই তা হারাম ঘোষণা করবেন। বরং একজন দক্ষ চিকিৎসকের ন্যায় সমাজের মন-মানসিকতাকে আগে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ছিল যাতে চূড়ান্ত ও নিশ্চিত সংস্কার সম্ভবপর হয়। এ কারণে মদপানের নিন্দায় নাযিলকৃত চারখানা আয়াতের ভাষা এক রকম নয়। বরং প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এ আয়াতসমূহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা মহানবীর দ্বীন প্রচারের কর্মকৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। আমাদের মতে বড় বড় বক্তা ও লেখকরা এ পদ্ধতির অনুসরণ করতে পারেন এবং এ পদ্ধতিতেই তাঁরা সমাজের কলুষ ও অনাচারগুলো দূর করার চেষ্টা করতে পারেন।

কোন একটি অন্যায় ও অনাচার প্রতিরোধ করার জন্য মৌলিক শর্ত হলো,প্রথমে সমাজের লোকদের চিন্তা-চেতনা ও বৃহত্তর জনমতকে ঐ অনাচারের ক্ষয়-ক্ষতি ও অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ করা। যতদিন পর্যন্ত সমাজে মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ চেতনার সৃষ্টি না হবে,ততদিন পর্যন্ত কোন অনাচার মৌলিকভাবে মোকাবেলা করা যাবে না। কেননা স্বয়ং মানুষই তো এ সংস্কার-সংশোধনের যিম্মাদার।

যে সমাজে মদপান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল,পবিত্র কুরআন এ দৃষ্টিকোণ থেকে সেখানে প্রথম বারের মতো খেজুর ও আঙুর দ্বারা মদ তৈরিকে উত্তম জীবিকা বা রিয্কে হাসান -এর পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছে। এভাবে সমাজের ঘুমন্ত অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে তা জাগ্রত ও সচেতন করা হয়। এরশাদ হয়েছে :

) و من ثمرات النّخيل و الأعناب تتخذون منه سكرا و رزقا حسنا(

তোমরা খেজুর গাছের ফল ও আঙুর থেকে মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। (সূরা নাহল : 67)

পবিত্র কুরআন প্রথম বারের মতো এ তথ্য কর্ণগোচর করে যে,খেজুর ও আঙুর থেকে মদ তৈরি করা উত্তম খাদ্য নয়;বরং উত্তম খাদ্য হচ্ছে উভয় ফলকে খেজুর ও আঙুর রূপে আহার করা।

এ আয়াত মানুষের চিন্তায় নাড়া দেয় এবং তাদের মানসিকতা এমনভাবে প্রস্তুত করে যাতে পরবর্তীতে আল্লাহ্ তাঁর ভাষাকে আরো কঠোরতর করেন এবং আরেকখানা আয়াতের মাধ্যমে এ কথা ঘোষণা করেন যে,মদ ও জুয়ার দ্বারা যে  আংশিক (পার্থিব) মুনাফা হয়,তা সমুদয় ক্ষয়-ক্ষতির প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তুচ্ছ। নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে এ বক্তব্য সমাজের সামনে পেশ করা হয় :

) يسألونك عن الخمر و الميسر قل فيهما اثم كبير و منافع للنّاس و إثمهما أكبر من نفعهما(

তারা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জানতে চায়। বলুন,উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও;কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। 91

নিঃসন্দেহে লাভ ও ক্ষতির মাঝে তুলনা করা এবং লাভের চাইতে ক্ষতির পাল্লা ভারী দেখানো চিন্তাশীল লোকদের মনে ঐ কাজটির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য যথার্থ। কিন্তু সাধারণ লোকদের যতক্ষণ পরিষ্কার ভাষায় নিষেধ করা না হবে,ততক্ষণ নিছক এ ধরনের বাচনভঙ্গি ও বর্ণনা পদ্ধতির দ্বারা তারা অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত হয় না।

এমনকি এ আয়াত নাযিল হওয়া সত্বেও আবদুর রহমান ইবনে আউফ এক ভোজসভার আয়োজন করে তাতে খাবার দস্তরখানে মদ পরিবেশন করেন। মেহমানরা মদ পান করার পর নামাযে দাঁড়ান। তাঁদের একজন নামাযে (মদের নেশায়) পবিত্র কুরআনের আয়াত ভুলভাবে তেলাওয়াত করেন,যার ফলে ঐ আয়াতের অর্থই পাল্টে যায়!

অর্থাৎ সূরা কাফিরুন-এلا أعبد ما تعبدون (হে কাফেররা!) তোমরা যার (মূর্তির) উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি না -এর পরিবর্তে এভাবে তেলাওয়াত করেন :أعبد ما تعبدون তোমরা যার উপাসনা করো,আমি তার উপাসনা করি -যার অর্থ আয়াতের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়।

এসব ঘটনা মানুষের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করতে থাকে যাতে পরিবেশ ও পরিস্থিতি এ অনুমতি দেয় যে,অন্তত বিশেষ বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে শরাব (মদ) হারাম ঘোষিত হোক। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ঘোষণা করা হয় যে,মাতাল অবস্থায় নামায পড়ার অধিকার কোন মুসলমানের নেই।

আর এ বিধান বা নির্দেশ নিম্নোক্ত আয়াতে ঘোষণা করা হয় :

) لا تقربوا الصّلاة و أنتم سكاري حتّي تعلموا ما تقولوا(

অর্থাৎ মাতাল অবস্থায় নামায পড়ো না। কারণ তোমরা (মাতাল অবস্থায় নামাযে) কী বলছ,তা জান না।

এ আয়াতের প্রভাব এতটা তীব্র ছিল যে,একদল লোক চিরতরে মদ পান ত্যাগ করে এবং তাদের যুক্তি ছিল এই যে,যে জিনিস তোমাদের নামাযের ক্ষতি করে,তা অবশ্যই তোমাদের জীবনের কর্মসূচী থেকেই নিরঙ্কুশভাবে বাদ দিতে হবে।

তবে আরেকটি দল এরপরও মদ পানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে নি;এমনকি আনসারগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উল্লিখিত আয়াত অবতীর্ণ হওয়া সত্বেও এমন ভোজসভার আয়োজন করে যাতে মদ পরিবেশন করার পর অতিথিবৃন্দ (নেশাগ্রস্ত হয়ে) পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হয় এবং পরস্পরের হাত ভেঙে দেয় ও মাথা ফাটিয়ে দেয়। এরপর মহানবী (সা.)-এর কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করা হয়।

দ্বিতীয় খলীফা ঐ দিন পর্যন্ত মদ পান করতেন। তিনি পূর্ববর্তী আয়াতসমূহ মদ পান সুনিশ্চিতভাবে হারাম করার জন্য যথেষ্ট নয় -এ ধারণার বশবর্তী হয়ে দু হাত তুলে প্রার্থনা

করেন :

اللهم بيّن لنا بيانا شافيا فِى الخمر

হে আল্লাহ্! মদ সম্পর্কে আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সন্তোষজনক বিধান সম্বলিত ব্যাখ্যা অবতীর্ণ করুন।

বলার অপেক্ষা রাখে না,এ ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা মদ পান নিশ্চিতভাবে হারাম হবার বিধান মেনে নেয়ার জন্য (তদানীন্তন) মুসলিম সমাজকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। এ কারণেই মদ পান নিষিদ্ধ করার স্পষ্ট ও চূড়ান্ত বিধান অবতীর্ণ হয়। এ আয়াত হলো :

) يا أيّها الّذين آمنوا إنّما الخمر و الميسر و الأنصاب و الأزلام رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই শরাব (মদ),জুয়া,মূর্তিপূজার বেদী এবং আযলাম (এক ধরনের ভাগ্য পরীক্ষা) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। কাজেই সবাই তা থেকে বেঁচে থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 92

এ স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ঘোষণার ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে,যারা তখনো শরীয়তের স্পষ্ট ও পরিষ্কার বিধান না আসার যুক্তিতে মদ পান করত,তারাও মদ পান ত্যাগ করল। সুন্নী ও শিয়া সূত্রের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে,এ আয়াত শোনার পর দ্বিতীয় খলীফা বলেন :انتهينا يا ربّ

হে প্রভু! এখন থেকে আমরা বিরত হলাম। 93

বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিষয়ক সংযুক্তি

দ্বিতীয় খলীফা উল্লিখিত তিনখানা আয়াত শোনার পর ক্ষান্ত হন নি। তিনি মদ হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাদকদ্রব্য হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত আয়াত নাযিল হলে তিনি সন্তষ্টি লাভ করেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর হুকুম ছিল :

) رجس من عمل الشّيطان فاجتنبوه لعلّكم تُفلحون(

(শরাব) অপবিত্র বস্তু,শয়তানের কাজ। অতএব,তোমরা তা থেকে বিরত থাক। আশা করা যায়,তোমরা সফলকাম হবে। 94

কিন্তু আমাদের যুগের পাশ্চাত্যপন্থীরা এসব আয়াতকে যথেষ্ট মনে করে না;বরং তারা বলতে চায়,মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারেحرام (হারাম) বাحُرّم হুররিমা (হারাম করা হলো) পরিভাষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় মদ যে নিষিদ্ধ,তা বোঝা যায় না।

এ দলটি কুপ্রবৃত্তির কামনা-বাসনার পূজারী এবং অজুহাত খুঁজে বেড়াতে অভ্যস্ত। এরা শয়তানী বোতলটার মধ্যে ডুবে থাকতে ও বুকে জড়িয়ে রাখতে এবং এ জাতীয় অনর্থক কথা বলতে চায়;অথচ পবিত্র কুরআন এ ধরনের শয়তানী চিন্তাধারা দমন করার উদ্দেশ্যে শরাব হারাম হওয়ার বিষয়ে অন্যভাবে হারাম পরিভাষা ব্যবহার করেছে। পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতে বলা হয়েছে :و إثمهما أكبر من نفعهما এতদুভয়ের (মদ ও জুয়া) গুনাহ,উভয়ের উপকারের চেয়ে বড় (জঘন্য)। 95

অর্থাৎ মদপানকে বড় গুনাহ ও পাপ বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর এক আয়াতে সকল পাপকর্মকে (إثم ) হারাম ঘোষণা করে বলা হয়েছে :

) قل إنّما حرّم ربّى الفواحش ما ظهر منها و ما بطن و الأثم(

বলুন,আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও গোপন সকল অশ্লীলতা এবং পাপকর্ম হারাম ঘোষণা করেছেন। 96

এত স্পষ্ট বিবরণের পরও কি পাশ্চাত্যপূজারী নোংরা মানসিকতার লোকেরা মদ হারাম হওয়া সংক্রান্ত আরো পর্যাপ্ত ও স্পষ্ট ব্যাখ্যার অপেক্ষায় বসে থাকবে?

আমাদের মতে এ বিষয়ে যুক্তিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কেননা মদ সম্পর্কিত চার আয়াতে মদকে নোংরা,অপবিত্র এবং মূর্তি,জুয়া ও শয়তানের কাজের সমপর্যায়ের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে,মদ হারাম। আর স্বার্থ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়-এমন সহজ সরল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ সব আয়াত সবচেয়ে কার্যকরী বর্ণনা ও ব্যাখ্যা।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন,তা হচ্ছে মহানবী (সা.) এ চার আয়াতের সাহায্যে তাঁর চারপাশের পরিবেশকে এই অপবিত্র বস্তু থেকে পবিত্র করেন এবং স্বয়ং ঈমানদারদের ঈমানই আল্লাহর হুকুম কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য জগৎ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েও এ ব্যাপারে তেমন কোন সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। এই প্রাণ হরণকারী বস্তুটি বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রে তাদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিস্ফল প্রমাণিত হয়েছে। 1933-1935 সালে এলকোহল জাতীয় পানীয় নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। এটি বিরাট ট্র্যাজেডি এবং পাঠকগণ এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ইতিহাসের শরণাপন্ন হতে পারেন।

যাতুর রিকা অভিযান

রিকা (رقاع ) আরবদের পরিভাষায় তালি নামে পরিচিত। কাজেই এই পবিত্র জিহাদকে যাতুর রিকা অভিযান নামকরণের কারণ হচ্ছে এ অভিযানে মুসলমানরা বহু চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হন,যা তালিযুক্ত জামার সাথে তুলনীয়। কখনো কখনো বলা হয়,এ অভিযানকে যাতুর রিকা বলার কারণ মুসলিম সৈনিকগণ পায়ে হেঁটে পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য তাঁদের পায়ে পট্টি জড়িয়েছিলেন।

যা হোক,অন্যান্য অভিযানের মতো এ অভিযান প্রথম পর্যায়ের কোন লড়াই ছিল না;বরং প্রজ্বলিত হবার উপক্রম যুদ্ধের স্ফূলিঙ্গ নির্বাপিত করার জন্যই এ অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ গাতফান -এর দু টি শাখা-গোত্র বনী মাহারির বনী সালাবাহ্ -এর পক্ষ হতে যে অশুভ তৎপরতা চালানো হচ্ছিল,তা দমিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান পরিচালিত হয়।

মহানবী (সা.)-এর নিয়ম ছিল তিনি বিচক্ষণ ও সচেতন ব্যক্তিদের আশে-পাশের এলাকায় পাঠাতেন যাতে তাঁরা সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর কাছে প্রতিবেদন প্রদান করেন। হঠাৎ তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে,এ গোত্র দু টি মদীনা নগরী দখল করার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের চিন্তা-ভাবনা করছে। মহানবী একটি বিশেষ বাহিনী নিয়ে নজ্দের উদ্দেশে গমন করেন এবং শত্রু-ভূখণ্ডের খুব কাছে অবতরণ করেন। ইসলামী বাহিনীর অতীত শৌর্য-বীর্য,ত্যাগ-তিতিক্ষার ঐতিহ্য গোটা আরব উপদ্বীপকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। তাদের আগমনের খবর পেয়ে শত্রুবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে এবং কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়াই পাহাড়ী অঞ্চল ও উচ্চভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

তবে মহানবী যেহেতু এ অভিযানে ফরয নামাযসমূহ সালাতে খাওফ অর্থাৎ ভীতিকর পরিস্থিতিতে নামায আদায়ের নিয়মে পড়েন এবং এ ধরনের নামায কীভাবে পড়তে হবে,তা সূরা নিসার 102তম আয়াতে বলা হয়,সেহেতু অনুমান করা যায়,শত্রু বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র ও রণপ্রস্তুতি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং যুদ্ধ বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন।

বীরত্বের স্বাক্ষর

ইবনে হিশাম97 ও আমীনুল ইসলাম তাবারসী-এর মতো সীরাত রচয়িতা ও মুফাসসিরগণ এ অভিযানের বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কতক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন,যা শত্রুবাহিনীর মোকাবেলায় মহানবী (সা.)-এর বীরত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এর সাদৃশ্যপূর্ণ বর্ণনা আমরা যি আমর অভিযান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি। বর্ণনা সংক্ষেপ করার প্রয়োজনে আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না।

ইসলামের ধৈর্যশীল রক্ষীগণ

ইসলামের সৈনিকগণ যদিও এ অভিযানে সম্মুখ লড়াই ছাড়াই মদীনায় ফিরে আসেন,তবুও সামান্য কিছু মালে গনীমত তাঁদের হস্তগত হয়। ফেরার পথে একটি বিশাল উপত্যকায় তাঁরা রাতটা বিশ্রামে কাটান। মহানবী (সা.) দু জন বীর যোদ্ধাকে উপত্যকার প্রবেশপথ সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁদের নাম ছিল আব্বাদ আম্মার । তাঁরা দু জন রাতের ঘণ্টাগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। সে হিসেবে রাতের প্রথম ভাগের পাহারার দায়িত্ব পড়ে আব্বাদের উপর।

গাতফান গোত্রের এক লোক মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করার মানসিকতা পোষণ করছিল। সে যে কোন ভাবে মুসলমানদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছিল। লোকটি রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নামাযরত প্রহরীর দিকে তীর নিক্ষেপ করে। কিন্তু প্রহরী নামাযে এতখানি বিভোর ছিলেন যে,তিনি তীরের আঘাত খুব সামান্যই অনুভব করেন এবং তীরটি নিজের পা থেকে বের করে পুনরায় নামাযে মশগুল হয়ে যান। কিন্তু শত্রুর আক্রমণের তিন বার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তৃতীয় বারে তীরটি খুব শক্তভাবে তাঁর পায়ে বিদ্ধ হয়। ফলে মনের মাধুরি মিশিয়ে আর নামাযে তন্ময় হয়ে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। কাজেই খুব সংক্ষিপ্ত রূকূ ও সিজদা সহকারে নামায শেষ করে আম্মারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন।

আব্বাদের হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখে আম্মার দারুণভাবে মর্মাহত হন এবং অনেকটা প্রতিবাদী সুরে বলেন : কেন তুমি আমাকে শুরুতে জানালে না?”   আহত প্রহরী তাঁকে বললেন : আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাতে মশগুল ছিলাম এবং পবিত্র কুরআনের একখানা সূরা তেলাওয়াত করছিলাম। হঠাৎ প্রথম তীরটি আমাকে আঘাত করে। মহান আল্লাহর কাছে নিভৃতে দুআ এবং তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করার স্বাদ আমাকে নামায ভঙ্গ করতে বারণ করে। যদি মহানবী (সা.) আমাকে এ উপত্যকার পাহারার দায়িত্ব প্রদান না করতেন,তা হলে কিছুতেই আমার নামায এবং যে সূরা পাঠ করছিলাম,তাতে বিরতি টানতাম না;বরং মহান আল্লাহর কাছে মুনাজাতরত অবস্থায় আমার প্রাণটি দিয়ে দিতাম। কখনো নামায মাঝখানে শেষ করার চিন্তাও করতাম না 98