চতুর্থ ভাগ
:ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের বৈশিষ্টসমূহ
পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের উদ্দেশ্য
,সাফল্য বা অবদান সম্পর্কে কথা বলেছি। এখর আমরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-
এর হুকুমতের কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন: হুকুমতের পরিধি
,ও তার রাজধানী
,হুকুমতের সময় সীমা ও তার কার্যপদ্ধতি ও তার পরিচয় এবং মহান নেতার
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব।
1) - হুকুমতের পরিধি ও তার রাজধানী
এতে কোন সন্দেহ নেই যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত হচ্ছে
বিশ্বজনীন। কেননা তিনি হচ্ছেন সমগ্র মানব জাতির মুক্তিদাতা ও তাদের
সকল আশার বাস্তবায়নকারী। সুতরাং তার হুকুমতের সকল সৌন্দর্য
,সৎকার্য ও সুফল সারা বিশ্বকে আচ্ছন্ন করবে। এ সত্য বিভিন্ন রেওয়াত
থেকে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়
,নিম্নে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া
হল:
ক
)- অধিক সংখ্যক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে: পৃথিবী অন্যায়- অত্যাচারে পরিপূর্ণ হওয়ার পর ইমাম মাহ্দী (আ.) পূনরায় পৃথিবীকে ন্যায়-
নীতিতে পূর্ণ করবেন।
الارض
বা মাটি শব্দের অর্থ সমগ্র পৃথিবী এবং
সেটাকে পৃথিবীর কিছু অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন দলিল আমাদের
কাছে নেই।
খ
)- যে সকল রেওয়ায়াতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর
ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে সে সকল স্থানের গুরুত্ব ও ব্যাপকতা থেকে
বোঝা যায় যে
,তিনি সমগ্র বিশ্বের উপর হুকুমত করবেন। রেওয়ায়াতে যে
সকল শহর ও দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কেবল উদাহরণ মাত্র
এবং রেওয়ায়াতে সে সময়ের মানুষের উপলব্ধির দিকেও দৃষ্টি রাখা
হয়েছে।
বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.) চীন
,রোম
,দেইলাম
,তুরস্ক
,সিন্ধু
,ভারত
,কাসতানতানিয়া এবং কাবুল বিজয়
করবেন।
বলাবাহুল্য যে
,ইমামদের যুগ এই সকল এলাকার পরিধি অনেক বেশী
ছিল যেমন: রোম বলতে সমগ্র ইউরোপ এমনকি আমেরিকার কিছু
অংশকেও বোঝানে হয়েছে। চীন বলতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ
যেমন: জাপান
,করিয়া ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে ভারত
বলতে ভারত উপমহাদেশকে বোঝানো হয়েছে। কাসতাননিয়া বা
ইসতামবুল সে সময়ে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারি ছিল এবং তা বিজয় করা
অতি গৌরবের বিষয় ছিল। কেননা
,তা ইউরোপে প্রবেশ করার একটি
প্রধান কোরিডোর ছিল।
মোটকথা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহের বিজয়ই হচ্ছে ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর বিশ্বজনীন হুকুমতের পরিচায়ক।
গ
)- প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর রেওয়ায়েত ছাড়াও আরও অনেক
রেওয়ায়েত রয়েছে যা থেকে বোঝা যায় যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত
বিশ্বজনীন।
রাসূল (সা.) বলেছেন যে
,আল্লাহ তা
’
আলা বলেছেন:
আমি তাদের
(
বার
ইমামের
)
মাধ্যমে ইসলামকে সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করব এবং তাদের
মাধ্যমে আমার নির্দেশকে বাস্তবয়ন করব। আার সর্বশেষ জনের
(
ইমাম
মাহ্দীর
)
মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে শ
ত্রুর হাত থেকে মুক্ত করব এবং তাকে
প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের অধিপতি করব।
ইমাম বাকের
(
আ
.)
বলেছেন
:
কায়েম হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর বংশ থেকে এবং তিনি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের অধিপতি হবেন
,আল্লাহ তাকে অপর সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করবেন
,মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও।
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের রাজধানী হচ্ছে ঐতিহাসিক কুফা শহর। সে সময়ে কুফার পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং নাজাফও কুফার মধ্যে পড়বে আর সে কারণেই কিছু কিছু হাদীসে নাজাফকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের রাজধানী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের রাজধানী হচ্ছে কুফা শহর এবং বিচার কার্যের স্থান হচ্ছে কুফার মসজিদ।
বলাবাহুল্য যে
,কুফা শহর বহু দিন আগে থেকেই রাসূল (সা.)-এর
বংশের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আলী (আ.) সেখানে হুকুতম করতেন
,কুফার মসজিদ ইসলামের চারটি নামকরা মসজিদের একটি সেখানে হযরত
আলী (আ.) নামাজ পড়াতেন
,খোৎবা দিতেন
,বিচার করতেন এবং শেষ
পর্যন্ত তিনি ঐ মসজিদের মেহরাবে শাহাদত বরণ করেন।
2) - হুকুমতের সময় সীমা
দীর্ঘ দিন ধরে মানুষ জালেম ও অত্যাচারী শাসকদের হুকুমতের মধ্যে
থাকার পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে পৃথিবী ভালর দিকে
ধাবিত হবে। তখন সৎকর্মশীলদের মাধ্যমে পৃথিবী পরিচালিত হবে এবং
এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি যা অবশ্যই বাস্তবাইত হবে।
সৎকর্মশীলদের হুকুমত যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নেতৃত্বে শুরু হবে
এবং দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং আর কখনোই জালেমদের
হুকুমত আসবে না
।
হাদীসে কুদসীতে আরও বর্ণিত হয়েছে:
ইমাম মাহ্দী হুকুমতে অধিষ্টিত
হওয়ার পর তা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং এ হুকুমত আল্লাহর
ওয়ালী ও তাদের বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।
সুতরাং ইমাম মাহ্দী (আ.) যে
,ন্যায়পারায়ণ হুকুমত গড়ে তুলবেন তা
কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তারপর আর কোন সরকার আসবে না এবং
প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে
,যেখানে
সকলেই ঐশী হুকুমতের ছত্রছায়ায় জীবন-যাপন করবে।
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:
আমাদের সরকার শেষ সরকার
,
অন্য
সকলেই আমাদের পূর্বে রাজত্ব করবে। কাজেই আমাদের শাসনব্যাবস্থা
দেখে আর কেউ বলতে পারবে না যে
,
আমরা থাকলেও ঠিক এভাবেই
শাসন করাতাম
।
সুতরাং আবির্ভাবের পর থেকে ঐশী হুকুমত কিয়ামত পর্যন্ত চলতে
থাকবে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) তার জীবনের শেষ পর্যন্ত হুকুমত করবেন।
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময় সীমা এতটা হতে হবে যে
,তিনি
সে সময়ের মধ্যে পারবেন পৃথিবীকে ন্যায়নীতিতে পরিপূর্ণ করতে। কিন্তু এ
উদ্দেশ্য কয় বছরের মধ্যে সাধিত হবে তা ধারণা করে বলা সম্ভব নয়। এ
জন্য পবিত্র ইমামদের হাদীসের স্মরণাপন্ন হতে হবে। তবে ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর যোগ্যতা
,আল্লাহর সাহায্য
,যোগ্য সাথী
,পৃথিবীর মানুষের
প্রস্তুতি সব মিলিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি তার মহান উদ্দেশ্যে
উপনীত হবেন। যুগ যুগ ধরে মানুষ যা অর্জন করতে পারে নি ইমাম
মাহ্দী (আ.) 10 বছরের কম সময়ে তা অর্জন করবেন।
যে সকল রেওয়ায়াতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময়সীমা
বর্ণিত হয়েছে তা বিভিন্ন ধরনের। কিছু হাদীসে 5 বছর
,কিছুতে 7 বছর
,কিছুতে 8/9 বছর
,কিছুতে 10বছর উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েকটি
রেওয়ায়াতে 19 বছর কয়েক মাস এমনকি কোন কোন হাদীসে 40 থেকে
309 বছর পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে রেওয়ায়াতে এ ভিন্নতার কারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় এবং
এত রেওয়ায়াতের মধ্য থেকে সঠিক সময় নির্ধারণ করা অতি কঠিন
ব্যাপার। তবে বড় বড় আলেমগণ 7 বছরকে নির্বাচন করেছেন।
অনেকে আবার বলেছেন ইমাম মাহ্দী (আ.) 7 বছর হুকুমত করবেন
কিন্তু তার হুকুমতের প্রতি এক বছর বর্তমান বছরের 10 বছরের সমান।
রাবী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের সময়সীমা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেন: ইমাম মাহ্দী (আ.) 7 বছর হুকুমত
করবেন তবে তা বর্তমান বছরের 70 বছরের সমান।
মরহুম মাজলিসী (রহ.) বলেছেন: ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের
সময়সীমা সম্পর্কে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টিপাত
করার প্রয়োজন মনে করছি: কিছুতে হুকুমতের পরের সময়কে বোঝানো
হয়েছে। কিছুতে হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়কে বোঝানো হয়েছে।
কিছুতে বর্তমান বছর ও মাসের কথা বলা হয়েছে এবং কিছুতে ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর সময়ের বছর ও সময়কে বুঝানো হযেছে
,হকিকত
আল্লাহই জানেন।
3)- ইমামের হুকুমতের আদর্শ
প্রতিটি শাসকই তার হুকুমত পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ আদর্শ
মেনে চলে যা তার হুকুমতের নিদর্শন। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এরও রাষ্ট্র
পরিচালনার একটি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যদিও এর পূর্বে ইমামের রাষ্ট্র
পরিচালন পদ্ধতির উপর কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে কিন্তু বিষয়টির গুরুত্বের
জন্য স্বতন্ত্রভাবে এ বিষয়ের প্রতি এখানে আলোচনা করা হল। আর ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমত সম্পর্কে আরও ভাল করে জানার জন্য রাসূল (সা.)
ও পবিত্র ইমামগণের বাণীর দিকে দৃষ্টি দিব।
প্রথমে যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হল রেওয়ায়াতের
আলোকে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আদর্শের যে চিত্র বর্ণিত হয়েছে তা
রাসূল (সা.)-এর আদর্শ ও পদ্ধতিরই অনুরূপ। রাসূল (সা.) যেভাবে অজ্ঞদের
সাথে সংগ্রাম করেছিলেন এবং চিরন্তন ইসলাম যা দুনিয়া ও আখেরাতের
সৌভাগ্যের সোপান তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইমাম মাহ্দী (আ.)ও তার
আবির্ভাবের মাধ্যমে আধুনিক অজ্ঞতার সাথে যা কিনা রাসূল (সা.)-এর
সময়ের অজ্ঞতার চেয়েও বেশী ভয়ঙ্কর তার সাথে সংগ্রাম করবেন এবং
ইসলামী ও ঐশী মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহ্দী
(
আ
.)
রাসূল
(
সা
.)-
এর মতই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। রাসূল
(
সা
.)
যেভাবে অজ্ঞদের সকল কুসংস্কারকে ধ্বংস করেছিলেন
,
ইমাম মাহ্দী
(
আ
.)
ও
আধুনিক সকল অজ্ঞতা ও কুসংস্কারকে দূর করে ইসলামের সঠিক স্বরূপকে
প্রতিষ্ঠা করবেন।
4) - ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যুদ্ধ পদ্ধতি
ইমাম মাহ্দী (আ.) তার বিশ্বজনীন বিপ্লবের মাধ্যমে কুফর ও শিরককে
পৃথিবী থেকে উৎখাৎ করবেন এবং সকলকে পবিত্র ইসলামের দিকে
আহবান করবেন।
এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন:
তার আদর্শ ও পদ্ধতি আমার আদর্শের
আনুরূপ। সে জনগণকে আমার দ্বীন ও শরিয়তে প্রতিষ্ঠিত করবে
।
তবে তিনি এমন সময় আবির্ভূত হবেন যখন সত্য এমনভাবে প্রকাশ
পাবে যে
,সর্ব দিকে থেকে তা সাবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে
।
তার পরও বিভিন্ন রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)
অবিকৃত তৌরাত ও ইঞ্জিলের মাধ্যমে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাথে আলোচনা
করবেন এবং তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে যাবে।
এর মধ্যে সবচেয়ে
বেশী যে জিনিসটি সবাইকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করবে তা হচ্ছে যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.) অদৃশ্য থেকে সাহায্য প্রাপ্ত হচ্ছেন এবং তার মধ্যে
নবীদের নিদর্শন রযেছে তা স্পষ্ট বুঝা যাবে। যেমন: হযরত
সুলাইমান (আ.)-এর আংটি
,হযরত মুসার লাঠি এবং রাসূল (সা.)-এর বর্ম
,তলোয়ার ও পতাকা তার কাছে থাকবে।
তিনি রাসূল (সা.)-এর উদ্দেশ্য
বাস্তবায়ন এবং বিশ্বজনীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সংগ্রাম করবেন।
এটা স্পষ্ট যে
,এই সুন্দর পরিবেশে যেখানে সত্য সম্পুর্ণরূপে সবার কাছে
স্পষ্ট হয়ে যাবে। কেবলমাত্র তারাই বাতিলের পক্ষে থাকবে যারা
সম্পূর্ণরূপে তাদের মানবতা ও ঐশী গুনাবলীকে নষ্ট করে ফেলছে। এরা
তারা
,যারা সারাজীবন অন্যায়-অত্যাচার
,ফ্যাসাদ ও কামনা-বাসনার মধ্যে
নিমজ্জিত ছিল এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পবিত্র হুকুমত থেকে তাদেরকে
উৎখাৎ করা হবে। তখন ইমাম মাহ্দী (আ.) তার তলোয়ার বের করবেন
এবং অত্যাচারিদের মাথা দিখণ্ডিত করবেন। এটা রাসূল (সা.) ও আলী (আ.)-
এর পদ্ধতিও বটে।
5) - ইমাম মাহদী(আ
.)-এর বিচার পদ্ধতি
যেহেতু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে গচ্ছিত
করে রাখা হযেছে
,তিনি তার দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি সুন্দর বিচার
বিভাগ গঠন করবেন। সুতরাং তিনি এ ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর নীতি
অনুসরণ করবেন এবং তার সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের হারিয়ে যাওয়া
অধিকারকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন।
তিনি এমন ন্যায়ের ভিত্তিতে আচরণ করবেন যে
,যারা জীবিত তারা
বলবে যে
,যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা যদি ফিরে আসত তাহলে ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়বিচার থেকে লাভবান হতে পারত।
বলাবাহুল্য যে
,কিছু কিছু রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে
,ইমাম
মাহ্দী (আ.) বিচারের আসনে হযরত সুলাইমান (আ.) ও হযরত দাউদ (আ.)-
এর মত আচরণ করবেন এবং তাদের মত ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে বিচার
করবেন
,সাক্ষ্য-প্রামাণের মাধ্যমে নয়।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েম যখন কিয়াম করবে তখন হযরত সুলাইমান
(
আ
.)
ও হযরত দাউদ
(
আ
.)-
এর মত বিচার করবে অর্থাৎ সাক্ষ্য
-
প্রামাণের প্রয়োজন হবে না
(
ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে বিচার করবেন
)
।
এ ধরনের বিচারের রহস্য হয়ত এটা হতে পারে যে
,ঐশী জ্ঞানের
মাধ্যমে বিচার করলে সঠিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা
,মানুষের
সাক্ষ্যর ভিত্তিতে বিচার করলে বাহ্যিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিা হতে পারে প্রকৃত
ন্যায়বিচার নয়। কারণ মানুষের দ্বারা ভুল হতেই পারে। তবে ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর বিচার পদ্ধতিকে উপলব্ধি করা অতি কঠিন ব্যাপার তবে
তার সময়ের সাথে এ পদ্ধতির মিল রয়েছে।
6) - ইমাম মাহদী (আ
.)-এর পরিচালনা পদ্ধতি
একটি হুকুমতের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে তার কর্মীরা। একটি প্রশাসনের
কর্মচারিরা যদি যোগ্য হয় তাহলে দেশের সকল কর্ম সঠিকভাবে পরিচালিত
হবে একং উদ্দেশ্যে উপণীত হওয়া সহজতর হবে।
ইমাম মাহ্দী (আ.) বিশ্বের নেতা হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের জন্য
যোগ্য পরিচালক বা গভর্ণর নিয়োগ করবেন। যাদের মধ্যে একজন
ইসলামী নেতার সকল বৈশিষ্ট্য যেমন: জ্ঞান
,প্রতিজ্ঞা
,নিয়ত
,আমল এবং
বলিষ্ঠ সিন্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। তাছাড়াও ইমাম মাহ্দী (আ.) সমগ্র
বিশ্বের নেতা হিসাবে সবর্দা তাদের কাজের উপর দৃষ্টি রাখবেন এবং
তাদের কাছে হিসাব নিবেন। এই প্রধান বৈশিষ্ট্য যা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর
হুকুমতের পূর্বে সকলেই ভুলে গিয়েছিল হাদীসে তা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর
পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
ইামাম মাহ্দীর চিহ্ন হচ্ছে কর্মচারিদের কাজে কড়া নজর রাখবেন। অধিক
দান-খয়রাত করবেন এবং মিসকিনদের প্রতি অতি দয়ালূ হবেন।
7) - ইমাম মাহদী(আ.)-এর অর্থনৈতিক পদ্ধতি
অর্থ বিভাগে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পদ্ধতি হচ্ছে সাম্য অর্থাৎ সবার
মাঝে সমানভাবে অর্থ বণ্টন করা। যে নীতি রাসূল (সা.) নিজেও অবলম্বন
করতেন। রাসূল (সা.)-এর পর এ নীতির পরিবর্তন ঘটে এবং অর্থ বণ্টনের
ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা দেয়। তবে ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর
সময়ে আবারও মানুষের সমান অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কিন্তু তারপর উমাইয়্যা শাসকরা মুসলমানদের সম্পদকে নিজেদের
ব্যক্তিগত সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে এবং তাদের অবৈধ
হুকুতমকে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী করে। তারা মুসলমানদের সম্পত্তিসমূহকে
নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বণ্টন করে দেয়। এ
পদ্ধতি ওছমানের সময় থেকে শুরু হয় এবং উমাইয়্যাদের সময়ে তা একটি
নীতিতে পরিণত হয়।
ইমাম মাহ্দী (আ.) একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসাবে বাইতুলমালকে
সবার মাঝে সমানভাবে বণ্টন করবেন এবং মুসলমানদের সম্পদকে
(আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে) দান করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ
করবেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
আমাদের কায়েম যখন কিয়াম করবে তখন অত্যাচারি শাসকরা যে
সকল সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করেছিল বা আত্মীয়-স্বজন ও
বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বণ্টন করেছিল তা ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তাদের
নিকট আর কোন সম্পত্তি থাকবে না।
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
সকল মানুষের সমস্যার সমাধান করা এবং তাদের জন্য একটি সচ্ছল
জীবন গঠন করা। ইমাম মাহ্দী (আ.) প্রচুর সম্পদ মানুষকে দান করবেন
এবং নির্ভরশীল ব্যক্তিরা সাহায্য চাইলে তাদেরকে সাহায্য করবেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
সে অধিক সম্পদ দান
-
খয়রাত করবে
।
এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও সমাজকে সংশোধন করা সম্ভব যেটা ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর মহান উদ্দেশ্য। তিনি জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর
করার মাধ্যমে মানুষের ইবাদত-বন্দেগির পথকে সুগম করবেন।
8) - ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যক্তিগত আদর্শ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যক্তিগত আচরণ এবং জনগণের সাথে ব্যবহারে
তিনি একজন ইসলামী শাসকের উত্তম আদর্শ। তার দৃষ্টিতে হুকুমত হচ্ছে
মানুষকে খেদমত করার একটি মাধ্যম এবং তাদেরকে পরিপূর্ণতায়
পৌঁছানোর একটি স্থান। সেখানে পুজিবাদি ও অত্যাচারিদের কোন স্থান
নেই।
তিনি রাসূল (সা.) ও আলী (আ.)-এর ন্যায় জীবন-যাপন করবেন। সকল
ধন-সম্পদ তার আয়ত্বে থাকা সত্ত্বেও তিনি অতি স্বাভাবিক জীবন-যাপন
করবেন।
ইমাম আলী (আ.) তার সম্পর্কে বলেছেন:
সে (মাহ্দী বিশ্বের নেতা হওয়া সত্ত্বেও) প্রতিজ্ঞা করবে যে
,প্রজাদের মত চলাফেরা করবে
,পোশাক পরিধান করবে ও তাদের মতই বাহনে চড়বে এবং অতি অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকবে।
ইমাম আলী (আ.)ও পার্থিব জগতে খাদ্য
,পোশাক ও অন্যান্য সকল দিক
দিয়ে রাসূল (সা.)-এর অনুরূপ ছিলেন। ইমাম মাহ্দী (আ.)ও তার অনুসরণ
করবেন।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েম যখন কিয়াম করবেন হযরত আলী
(
আ
.)-
এর পোশাক
পরিধান করবেন এবং তার পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালনা করবেন।
তিনি নিজে কষ্টে জীবন-যাপন করবেন কিন্তু উম্মতের সাথে একজন
দয়ালু পিতার ন্যায় আচরণ করবেন। তাদের কল্যাণ ও সৌভাগ্য কামনা
করবেন
,ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন:
ইমাম
,সহধর্মি
,সহপাটি
,দয়ালু পিতা
,আপন ভাই
,সন্তানদের প্রতি
মমতাময়ী মাতা এবং কঠিন মুহুর্তে মানুষের আশ্রয়স্থল।
হ্যাঁ তিনি সবার সাথে এত ঘনিষ্ট ও এত বেশী নিকটবর্তী যে
,সকলেই
তাকে নিজেদের আশ্রয়স্থল মনে করবে।
রাসূল (সা.) ইমাম মাহ্দী (আ.) সম্পর্কে বলেছেন:
তার উম্মত তার কাছে
আশ্রয় নিবে যেভাবে মৌমাছিরা রানী মাছির কাছে আশ্রয় নেয়।
তিনি জন নেতার উত্তম দৃষ্টান্ত
,তিনি তাদের মধ্যে তাদের মতই জীবন-
যাপন করবেন। এ কারণেই তিনি তাদের সমস্যাকে সহজেই উপলব্ধি
করবেন এবং তার প্রতিকারও তিনি জানেন। তিনি একমাত্র আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা
করবেন। এমতাবস্থায় কেনইবা উম্মত তার পাশে নিরাপত্তা ও শান্তি অনুভব
করবে না এবং কোন কারণে তাকে ছেড়ে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হবে
?
9) - জনপ্রিয়তা
হুকুমতসমূহের একটি বড় চিন্তা হচ্ছে কিভাবে জনগণের কাছে প্রিয়
হবে। কিন্তু তাদের নানাবিধ ত্রুটির জন্য কখনোই তারা মানুষের কাছে
প্রিয়ভাজন হতে পারে নি। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর হুকুমতের একটি বিশেষ
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনপ্রিয়তা। তার হুকুমত শুধুমাত্র পৃথিবীর অধিবাসিদের
জন্যই জনপ্রিয় হবে না বরং তা আসমানের অধিবাসি ফেরেশতাগণের
কাছেও প্রিয় হবে।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
তোমাদেরকে মাহ্দীর সুসংবাদ দান করছি যার
প্রতি আসমান ও যমিনের সকলেই রাজি ও সন্তুষ্ট থাকবে। আর কেনইবা
তারা সন্তুষ্ট থাকবে না যখন জানতে পারবে যে
,দুনিয়া ও আখেরাতের
কল্যাণ ও সৌভাগ্য কেবলমাত্র তার ঐশী হুকুমতের ছায়াতলেই অর্জন করা
সম্ভব।
এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ইমাম আলী
(আ.)
-এর অমিয় বাণী দিয়ে ইতি
টানব:
আল্লাহ তা
’
আলা তাকে ও তার সাহায্যকারীদেরকে ফেরেশতাদের
মাধ্যমে সাহায্য করবেন এবং নিজের নিদর্শনের মাধ্যমেও তাকে সাহায্য
করবেন। তাকে পৃথিবীর উপর বিজয় দান করবেন এবং সকলেই তার
দিকে আকৃষ্ট হবে। তিনি পৃথিবীকে ন্যায়নীতিতে আলোকিত করবেন।
সকলেই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং কাফেরদের কোন অস্তিত্ব থাকবে
না
,অত্যাচারি থাকবে না
,এমনকি পশু-পাখিরাও একত্রে বসবাস করবে।
পৃথিবীর সকল সম্পদ বেরিয়ে আসবে
,আসমানও তার বরকত বর্ষন করবে
এবং যমিনের সকল গুপ্তধন প্রকাশ পাবে। সুতরাং তাদের প্রতি সুসংবাদ
যারা তার সময়কে দেখবে এবং তার কথা শুনতে পাবে।