প্রথম ভাগ
:এক দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী
(আ
.)
শিয়া মাযহাবের শেষ ইমাম এবং রাসূল (সা.)-এর বারতম উত্তরাধিকারী
225 হিজরীর 15ই শাবান শুক্রবার প্রভাতে (868 খ্রীষ্টাব্দে) ইরাকের
সামেররা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
শিয়া মাযহাবের একাদশ ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.) তার
মহান পিতা। মাতা হযরত নারজিস খাতুন। নারজিস খাতুনের পিতা হলেন
রোমের যুবরাজ
,আর মাতা আশ্ শামউন সাফার বংশধর হযরত ঈসা (আ.)-
এর ওয়াসি এবং নবীগণের বন্ধু হিসাবে পরিচিত। নারজিস খাতুন স্বপ্নের
মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর নির্দেশ
অনুযায়ী যুদ্ধের ময়দানে যান এবং সেখানে অন্যান্য মুসলমানদের সাথে
বন্দি হন। ইমাম হাদী আন্ নাকী (আ.) একজনকে প্রেরণ করেন এবং সে
নারজিস খাতুনকে কিনে সামেররায় ইমামের বাড়িতে নিয়ে আসে।
এসম্পর্কে আরও কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে
তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
হল হযরত নারজিস কিছুদিন যাবৎ ইমাম হাদী (আ.)-এর বোন হযরত
হাকিমা খাতুনের বাড়িতে ছিলেন এবং তিনি তাকে অনেক কিছু শিক্ষা-দীক্ষা
দিয়েছিলেন। হযরত হাকিমা খাতুন নারজিস খাতুনকে অধিক সম্মান
করতেন। নারজিস খাতুন হলেন সেই রমনী যার প্রশংসা করে পূর্বেই
রাসূল (সা.)
,
আলী (আ.)
ও ইমাম জাফর সাদিক (আ.)
হতে হাদীস বর্ণিত
হয়েছে। তাকে সর্বোত্তম দাসী এবং তাদের নেত্রী হিসাবেও উল্লেখ করা
হয়েছে।
উল্লেখ্য যে ইমাম মাহদী (আ.)-এর মাতা আরও কয়েকটি নামে যেমন:
সুসান
,রেহানা
,মালিকা এবং সাইকাল (সাকিল) নামে পরিচিত।
নাম
,কুনিয়া ও উপাধি
ইমাম মাহদী (আ.)-এর নাম ও কুনিয়া
রাসূল (সা.)-এর নাম ও কুনিয়ার
অনুরূপ। কিছু সংখ্যক হাদীসে তার আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত তাকে নাম ধরে
ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে।
ইমাম যামানার প্রসিদ্ধ উপাধিসমূহ হচ্ছে: মাহ্দী
,কায়েম
,মুনতাযার
,বাকিয়াতুল্লাহ
,হুজ্জাত
,খালাফে সালেহ
,মানসুর
,সাহেবুল আমর
,সাহেবুয্
যামান এবং ওলী আসর আর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হল মাহ্দী।
প্রতিটি উপাধিই মহান ইমাম সম্পর্কে এক বিশেষ বাণীর বার্তাবাহক।
ঐ মহান ইমামকে
“
মাহ্দী
”
বলা হয়েছে। কারণ তিনি নিজে হেদায়াত
প্রাপ্ত এবং অন্যদেরকে সঠিক পথে হেদায়াত করবেন। তাকে
“
কায়েম
”
বলা হয়েছে। কেননা তিনি সত্যের জন্য সংগ্রাম করবেন। তাকে
“
মুনতাযার
”
বলা হয়েছে। কেননা সকলেই তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
তাকে
“
বাকিয়াতুল্লাহ
”
বলা হয়েছে। কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর হুজ্জাত
এবং গচ্ছিত শেষ সম্পদ।
“
হুজ্জাত
”
অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর স্পষ্ট দলিল এবং
“
খালাফে
সালেহ
”
-এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর ওয়ালিগণের উত্তরাধিকারী। তিনি
“
মানসুর
”
কেননা আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন। তিনি
“
সাহেবুল আমর
”
কেননা ঐশী ন্যায়পরায়ণ সরকার গঠনের দায়িত্ব তার উপর ন্যান্ত হয়েছে।
তিনি
“
সাহেবুয্ যামান
”
এবং
“
ওয়ালি আসর
”
কেননা তিনি হচ্ছেন তার
সময়ের একছত্র অধিপতি।
জন্মের ঘটনা
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হতে বহুসংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে
তার বংশ হতে মাহ্দী নামক একজন ব্যক্তি অভ্যূত্থান করবেন এবং তিনি
অত্যাচারের ভিতকে সমূলে উৎপাটন করবেন। অত্যাচারী আব্বাসীয়
শাসকরা এঘটনা জানতে পেরে ইমাম মাহদী (আ.)-কে তার জন্মলগ্নেই হত্যা
করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুতরাং ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর সময় থেকে মাসুম
ইমামগণের জীবন-যাপন কড়া সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলে আসে এবং ইমাম
হাসান আসকারী (আ.)-এর সময়ে এ পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌছায়।
এমনকি ইমাম (আ.)-এর গৃহের অতি সামান্য আসা যাওয়ার বিষয়ও
শাসকবর্গের নখদর্পনে থাকত। অতএব এমতাবস্থায় শেষ ইমাম তথা ঐশী
নবজাতকের জন্ম গোপনে বা লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। ঠিক
একারণেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর অতি নিকট আত্মীয়রাও ইমাম
মাহদী (আ.)-এর জন্মের ঘটনা সম্পর্কে জানতেন না। এমনকি জন্মের
কয়েক ঘন্টা পূর্বেও হযরত নারজিস খাতুনের গর্ভবতী অবস্থা পরিদৃষ্ট ছিল
না।
হযরত ইমাম মুহাম্মদ তকী আল জাওয়াদ (আ.)-এর কন্যা হাকিমাহ
বলেন যে
,ইমাম হাসান আসকারী (আ.) তাকে বললেন:
“
ফুপি আম্মা আজকে 15ই শাবান
,আমাদের সাথে ইফতার করুন।
কেননা
,আজ রাতে (রাতের শেষ ভাগে) আল্লাহ তার বরকতময় হুজ্জাতকে
দুনিয়াতে প্রেরণ করবেন।
”
আমি বললাম:
“
এই বরকতময় নবজাতকের জননী কে
?”
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বললেন:
“
নারজিস
।
”
আমি বললাম:
“
কিন্তু আমি তো তার কোন আলামত দেখছি না!
”
ইমাম (আ.) বললেন:
“
কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত
,আমি যা বলেছি তা
ঘটবেই ইনশা আল্লাহ
।
”
আমি নারজিস খাতুনের ঘরে প্রবেশ করে সালাম করে বসলাম
,সে
আমার পায়ের থেকে জুতা খুলে বলল: শুভ রাত্র হে আমার
,নেত্রী।
আমি বললাম:
“
তুমি আমার এবং আমাদের পরিবারের মহারাণী।
”
নারজিস খাতুন বললেন:
“
না! আমি কোথায় আর এ মর্যাদা কোথায়।
”
আমি বললাম:
“
হে আমার কন্যা! আল্লাহপাক তোমাকে আজ রাত্রে
এমন একটি সন্তান দান করবেন যে দুনিয়া ও আখেরাতের নেতা।
”
একথা শোনার পর সে বিনয় ও লাজুকতার সাথে বসে পড়ল। আমি
নামায-কালাম পড়ে ইফতার করে শুয়ে পড়লাম।
মধ্যরাত্রে উঠে তাহাজ্জুতের নামায পড়লাম। নারজিস ঘুমাচ্ছিল কিন্তু
বাচ্চা হওয়ার কোন আলামত দেখতে পেলাম না। নামায শেষে পুনরায়
শুয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙ্গে গেল দেখলাম নারজিস নামায পড়ছে কিন্তু
বাচ্চা হওয়ার কোন আলামত দেখতে পেলাম না। তখন আমার সন্দেহ হল
ইমাম হয়ত ঠিক বুঝতে পারে নি।
এমন সময় ইমাম হাসান আসকারী তার শোয়ার ঘর থেকে
উচ্চস্বরে বললেন
,(আ.)
لا تجعلی یا عمه فإنّ الامر قد قرب
“
ফুপি আম্মা ব্যস্ত হবেন না বাচ্চা হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
”
একথা শোনার পর আমি সুরা সাজদা এবং সুরা ইয়াছিন পড়তে
লাগলাম। এর মধ্যে হটাৎ নারজিস লাফিয়ে উঠলে আমি কাছে গিয়ে
জিজ্ঞাসা করলাম তোমার ব্যথা অনুভব হচ্ছে
?বলল
,“
হ্যাঁ ফুপি।
”
আমি বললাম: চিন্তার কোন কারণ নেই ধৈর্য ধর
,তোমাকে যে সুসংবাদ
দিয়েছিলাম এটা তারই পূর্বাভাস।
অতঃপর আমি ও নারজিস সামান্য ঘুমালাম
,জেগে দেখি সেই চোখের
মণি জন্মগ্রহণ করেছে এবং সেজদা করছে। তাকে কোলে নিয়ে দেখলাম
সম্পুর্ণ পাক ও পবিত্র কোন ময়লা তার গায়ে নেই। এমন সময় ইমাম
হাসান আসকারী (আ.) বললেন
,“
ফুপি আম্মা আমার সন্তানকে আমার কাছে
নিয়ে আসুন।
”
আমি নবজাতককে তার কাছে নিয়ে গেলাম তিনি শিশুটিকে বুকে
জড়িয়ে নিলেন এবং নিজের জিহ্বাকে তার মুখে দিলেন এবং চোখে ও
কানে হাত বুলালেন এবং বললেন:
تکلم یا ابی
“
আমার সাথে কথা বল হে আমার পুত্র।
”
পবিত্র শিশুটি বলল:
اشهد ان لا اله الا الله وحده لا شریک له و اشهد انّ محمد رسول الله
অতঃপর ইমাম আলী (আ.) সহ সকল ইমাম (আ.) গণের উপর দরুদ পাঠ
করলেন।
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বললেন:
“
ফুপি! তাকে তার মায়ের কাছে
নিয়ে যান সে মাকে সালাম করবে
,তারপর আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে
আসুন।
”
তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম
,সে মাকে সালাম করল নারজিস
সালামের উত্তর দিল এবং আবার তাকে তার পিতার কাছে নিয়ে গেলাম।
হাকিমা খাতুন বলেন
,‘
পরের দিন আমি ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-
এর কাছে গিয়ে সালাম করলাম এবং ঘরে ঢুকে নবজাতককে দেখতে
পেলাম না। ইমামের কাছে জানতে চাইলাম
,‘
ইমাম মাহ্দী কোথায়
,তাকে
দেখছিনা কেন
,তার কি হয়েছে
?ইমাম বললেন:
“
ফুপি
,তাকে তার কাছে
শপে দিয়েছি যার কাছে হযরত মুসার মাতা মুসা (আ.)-কে শপে
দিয়েছিলেন।
”
হাকিমা খাতুন বলেন
,‘
সপ্তম দিনে আবার ইমামের বাসায় গেলাম এবং
ইমাম আমাকে বললেন:
“
ফুপি
,আমার সন্তানকে আমার কাছে নিয়ে
আসুন! আমি তাকে ইমামের কাছে নিয়ে আসলাম। ইমাম বললেন:
“
হে
আমার সন্তান! কথা বল! শিশুটি মুখ খুললেন এবং কালিমা শাহাদত পাঠ
করলেন। অতঃপর মহানবী ও তার পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি দরুদ পাঠ
করলেন। অতঃপর এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন:
)
وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ
وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُم مَّا كَانُوا يَحْذَرُونَ
(
“
আমি ইচ্ছা করলাম পৃথিবীতে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল
,তাদের প্রতি
অনুগ্রহ করতে
,তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে
,তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে
এবং উত্তরাধিকারী করতে।
’
এবং তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত
করতে
,আর ফিরাউন হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা
তাদের নিকট তারা আশঙ্কা করত।
”
(সূরা আল কাসাস আয়াত নং 5
,6
)
আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য
রাসূল (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর বাণীতে ইমাম
মাহদী (আ.)-এর আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তার কিছু
এখানে তুলে ধরছি:
তার চেহারা যুবক এবং গৌরবর্ণেও
,কপাল প্রশস্ত ও উজ্বল
,ভ্রু চাঁদের
মত
,চোখের রং কালো ও টানা টানা
,টানা নাক ও সুন্দর
,দাঁতগুলো
চকচকে। ইমামের ডান চোয়ালে একটি কালো তিল আছে এবং কাধের
মাঝে নবীগণের মত চিহ্ন আছে। তার গঠন সুঠাম ও আকর্ষণীয়।
পবিত্র ইমামদের পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে যে সকল বৈশিষ্ট্য বর্ণিত
হয়েছে তার কিছু এখানে তুলে ধরা হল:
ইমাম মাহদী (আ.) তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন
,সংযমি এবং সাধারণ
,ধৈর্যশীল এবং দয়ালু
,সৎকর্মশীল ও ন্যায়পরায়ণ
।
তিনি সকল জ্ঞান-
বিজ্ঞানের ধনভান্ডার। তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব জুড়ে পবিত্রতা এবং বরকতের
ঝর্ণাধারা। তিনি জিহাদী ও সংগ্রামী
,বিশ্বজনীন নেতা
,মহান বিপ্লবী এবং
তিনি প্রতিশ্রুত শেষ সংষ্কারক ও মুক্তিদাতা। সেই জ্যোর্তিময় অস্তিত্ব
রাসূলের বংশধর
,হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরার সন্তান এবং সাইয়্যেদুশ্
শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নবম বংশধর। তিনি মক্কা শরিফে
আবির্ভূত হবেন এবং তার হাতে থাকবে রাসূল (সা.)-এর ঝাণ্ডা। তিনি
সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষা করবেন ও আল্লাহর শরিয়তকে
সারাবীশ্বে প্রচলিত করবেন। এ পৃথিবী অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ হওয়ার
পর তিনি তা ন্যায়-নীতিতে পরিপূর্ণ করবেন।