প্রথম ভাগ
:অদৃশ্য
বিশ্ব মানবতার মুক্তিদাতা
,হযরত আদম থেকে শেষ নবী হযরত
মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকারী এবং আল্লাহর শেষ গচ্ছিত সম্পদ
হযরত হুজ্জাত ইবনেল হাসান আসকারী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার
পর এখন তার জীবনের অপর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অর্থাৎ অদৃশ্য সম্পর্কে কথা
বলব।
অদৃশ্যের তাৎপর্য
প্রথম লক্ষণীয় বিষয়টি হল অদৃশ্য অর্থাৎ দৃষ্টির অন্তরালে থাকা
,অনুপস্থিত থাকা নয়। সুতরাং এ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব যে
ইমাম মাহদী (আ.) লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন এবং তারা তাকে দেখতে
পায়না কিন্তু তিনি তাদের মাঝে উপস্থিত রয়েছেন এবং তাদের সাথে
জীবন-যাপন করছেন। এ সত্যটি মাসুম ইমামগণের হাদীসে বিভিন্নভাবে
বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:
আমার প্রভুর শপথ মানুষের মাঝে আল্লাহর হুজ্জাত রয়েছে এবং তিনি
মানুষের মাঝেই বিচরণ করেন। মানুষের বাড়ীতেও আসা যাওয়া করেন।
তিনি পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজমান। মানুষের কথোপকথোন শোনেন এবং
তাদেরকে সালাম দেন। তিনি দেখেন কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত
কেউ তাকে দেখতে পাবে না।
তবে আরেক ধরনের অদৃশের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর দ্বিতীয় প্রতিনিধি বলেন:
ইমাম মাহদী (আ.) প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে সেখানে উপস্থিত হন।
তিনি সবাইকে দেখেন এবং চেনেন
।
আর মানুষও তাকে দেখতে পায় কিন্তু
তাকে চিনতে পারে না।
সুতরাং হযরত মাহদী (আ.) সম্পর্কে দুই ধরনের অদৃশ্য ঘটতে পারে:
তিনি কখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন আবার কখনো পরিদৃষ্ট হয়ে
থাকেন কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারে না। ইমাম সর্বদাই মানুষের মাঝে
বিরাজমান।
অদৃশ্যের ইতিকথা
অদৃশ্য তথা দৃষ্টির অন্তরালে জীবন-যাপন এমন বিষয় নয় যা কেবলমাত্র
আল্লাহর শেষ প্রতিনিধির বেলায় ঘটেছে। বরং হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে
এটা জানা যায় যে
,আল্লাহর বিশেষ কয়েকজন নবীও তাদের জীবনের
কিয়দাংশকে অদৃশ্যে তথা দৃষ্টির অন্তরালে অতিবাহিত করেছেন। এ ঘটনা
আল্লাহর নির্দেশেই ঘটেছিল তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা বা পারিবারিক স্বার্থ
সিদ্ধির জন্য নয়।
সুতরাং অদৃশ্য হচ্ছে আল্লাহর একটি পন্থা
যা বিভিন্ন নবী যেমন:
হযরত ইদ্রিস
,নূহ
,সালেহ
,ইব্রাহীম
,ইউসুফ
,মুসা
,শোয়েব
,ইলিয়াস
,সুলাইমান
,দানিয়াল (আ.)-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে। আল্লাহর নির্দেশে তাদের
প্রত্যেকেই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অদৃশ্যে থেকেছেন
এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর ক্ষেত্রে তা এখনো অব্যহত রয়েছে।
একারণেই ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যকে নবীগণের একটি সুন্নত বা
রীতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে
।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যের একটি
দলিল হচ্ছে তার জীবনে নবীদের সুন্নত বাস্তবায়িত হবে। ইমাম জা
’
ফর
সাদিক (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েমের জন্য অদৃশ্য রয়েছে যা দীর্ঘায়িত হবে
।
রাবী প্রশ্ন
করল: হে রাসূলাল্লাহর সন্তান এ অদৃশ্যের কারণ কি
?
ইমাম বললেন: আল্লাহ চান যে নবীদের সুন্নত তার জীবনে বাস্তবায়িত
হোক।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে
,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর
অদৃশ্যের বিষয়টি তার জন্মের পূর্বেই আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে স্থান
পেয়েছিল। ইসলামের নেতাগণ অর্থাৎ রাসূল (সা.) থেকে শুরু করে হযরত
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) পর্যন্ত সকলেই ইমাম মাহ্দীর অদৃশ্যের ঘটনা
,তার বৈশিষ্ট্য এবং তা ঘটার সময় সস্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। এমনকি সে
সময়ে মুসলমানদের কর্তব্যও বর্ণনা করেছেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন:
মাহ্দী আমার সন্তানদের মধ্য থেকে সে অদৃশ্যে থাকবে যখন মানুষ
পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে তখন সে আবির্ভূত হবে উজ্জল তারার ন্যায়। সে
পৃথিবীকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবে যেমনিভাবে পৃথিবী
জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল।
অদৃশ্যের দর্শন
সত্যি
,কেন ইমাম তথা আল্লাহর হুজ্জাত দৃষ্টির অন্তরালে আছেন এবং
কি কারণে জনগণ তার আবির্ভাবের বরকত থেকে বঞ্চিত রয়েছে
?
এ বিষয়ে অনেক বক্তব্য রয়েছে এবং বহুসংখ্যক হাদীসও বর্ণিত
হয়েছে। তবে উপরিউক্ত প্রশ্নসমূহের উত্তর দেওয়ার পূর্বে একটি মৌলিক
বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করাকে প্রয়োজন মনে করছি।
আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ তা
’
আলার কোন কাজই তাই সে ছোট
হোক আর বড়ই হোক নিরর্থক নয়। তিনি প্রতিটি কর্মই হিকমতের সাথে
করে থাকেন এখন আমরা তা বুঝি আর নাই বুঝি। তাছাড়াও পৃথিবীর অতি
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাও আল্লাহর নির্দেশে সংঘটিত হয়ে থাকে আর তার মধ্যে
অন্যতম হল ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের ঘটনাটি। সুতরাং তার
অদৃশ্যের ঘটনাটিও আল্লাহর হিকমতের মাধ্যমেই ঘটেছে যদিও আমরা
তার দর্শন না জেনে থাকি।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
নিঃসন্দেহে আমাদের সাহেবুল আমর
দৃষ্টির অন্তরালে থাকবে এবং
অসত্যপন্থিরা বিভ্রান্তিতে পড়বে।
রাবী এর কারণ সম্পর্কে ইমাম
(আ.)
-এর কাছে জানতে চাইলে
,ইমাম
(আ.)
বলেন:
যে কারণে অন্তর্ধান ঘটবে তা বলা নিষিদ্ধ...। অদৃশ্য আল্লাহর রহস্যের
মধ্যে একটি। যেহেতু আমরা জানি যে
,মহান আল্লাহ হাকিম সুতরাং
আমরা তা মেনে নিয়েছি। আল্লাহর প্রতিটি কর্মই হিকমতপূর্ণ তাই আমরা
তার কারণ জানি বা নাই জানি।
তবে এমনটিও হতে পারে একজন মানুষ আল্লাহর সকল কার্যাবলীকে
হিকমতপূর্ণ মেনে নেওয়ার পরও আত্মিক তৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সৃষ্টির
কিছু কিছু রহস্য জানার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে। সুতরাং ইমাম
মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের হিকমত সম্পর্কে বিশ্লেষণ করব এবং সে
সম্পর্কিত কিছু রেওয়ায়াতের প্রতি আলোকপাত করব:
ক)- মানুষের শিক্ষার জন্য
যখন উম্মত নবী ও ইমামের মর্যাদা বোঝেনা এবং তাদের প্রতি কর্তব্য
পালন করে না বরং তাদের নির্দেশ লঙ্ঘন করে। এমতাবস্থায় আল্লাহ
তাদের নেতাকে তাদের থেকে পৃথক করে দেন যেন তারা তাদের ভুল
বুঝতে পারে এবং ইমামের অদৃশ্যকালীন সময়ে তার বাহ্যিক উপস্থিতির
বরকত ও মর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পারে। অতএব ইমামের অদৃশ্য
উম্মতের জন্য কল্যাণকর যদিও তারা তা উপলব্ধি করতে অক্ষম।
ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
আল্লাহ যখন কোন সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের ওঠা-বসাকে অপছন্দ
করেন তখন আমাদেরকে তাদের মাঝ থেকে উঠিয়ে নেন।
ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ার কারণে যারা
কোন পরিবর্তন ও বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টায় থাকে তারা সংগ্রামের প্রথমে
বিরোধীদের কারো কারো সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়
,যার মাধ্যমে তারা
উদ্দেশ্যের পানে অগ্রসর হন। কিন্তু প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দী (আ.) এমনই
একজন সংস্কারক যিনি বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিশ্বজনীন ন্যায় পরায়ণ
শাসন ব্যাবস্থার প্রচলন ঘটাতে কোন অত্যাচারী শক্তির সাথে আপোস
করবেন না। কেননা হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি হচ্ছেন সকল প্রকার
অত্যাচার ও অত্যাচারীর প্রকাশ্য নির্মূলকারী। আর একারণেই বিপ্লবের
প্রেক্ষাপট প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অদৃশ্যে থাকবেন যেন তাকে কোন
অত্যাচারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ না হতে হয়। ইমাম রেযা (আ.) অদৃশ্যের কারণ
সম্পর্কে বলেছেন:
এ জন্য যে
,যখন তিনি সংগ্রাম করবেন তখন যেন কারো সাথে তার
চুক্তিবদ্ধতা না থাকে।
খ)- মানুষের পরীক্ষার জন্য
মানুষকে পরীক্ষা করা আল্লাহর সুন্নতসমূহের একটি। তিনি তার
বান্দাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন যার মাধ্যমে সত্যের পথে
তাদের দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়। যদিও পরীক্ষার ফলাফল স্পর্কে আল্লাহ জ্ঞাত
কিন্তু এই পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দাগণ শিক্ষা পাবে এবং নিজেদের সম্পর্কে
বিশেষভাবে জানতে শিখবে।
ইমাম কাযেম (আ.) বলেছেন:
যখন আমার বংশের পঞ্চম পুরুষ অদৃশ্যে থাকবে তখন তোমরা দ্বীনের
প্রতি যত্নবান থেকো। তেমাদের মধ্য থেকে কেউ যেন বিচ্যুত না হয়।
আমাদের মাহ্দী (আ.) অদৃশ্যে থাকবে এবং এ সময় অনেকেই বিভ্রান্তিতে
পড়বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করবেন।
গ)- ইমামের জীবন রক্ষার জন্য
উম্মতের কাছ থেকে নবীগণের অদৃশ্য হয়ে থাকার অপর একটি কারণ
হল নিজের জীবন রক্ষা করা। তারা পরবর্তীতে নিজেদের দায়িত্ব পালন
করার তাগিদে বিপদের সময়ে অদৃশ্য হতেন যেমন রাসূল (সা.) মক্কা থেকে
বেরিয়ে গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। তবে এ সবই আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছায়
ঘটে থাকে। ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্য হওয়ার কারণ সম্পর্কেও বিভিন্ন
রেওয়ায়েতে ঠিক একই দলিল বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম জা
’
ফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহ্দী (আ.) তার সংগ্রামের পূর্বে কিছুদিন যাবত অদৃশ্যে থাকবে।
কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ইমাম বলেন: জীবন রক্ষার জন্য।
যদিও ঐশী মহামানবরা শহীদ হওয়ার প্রার্থনা করে থাকেন। তবে সেই
শাহাদত অর্থবহ যখন তা কর্তব্যপালন করতে গিয়ে এবং সমাজ ও
আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু যদি হত্যার মাধ্যমে মানুষের
উদ্দেশ্য অর্জিত না হয় ও তা বৃথা যায় তখন জীবন বাচাঁনো ফরজ এবং তা
বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পছন্দনীয়। দ্বাদশ ইমাম যিনি আল্লাহর শেষ
গচ্ছিত সম্পদ তিনি যদি এভাবে মারা যান তাহলে মানুষের সকল আশা
বৃথা যাবে এবং সকল নবীদের শ্রম ব্যর্থ হবে। আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
যে
,ন্যায়নিষ্ঠ্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিভিন্ন হাদীসে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যের আরও অনেক কারণ
বর্ণিত হয়েছে
,তবে সংক্ষিপ্ততার জন্য তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা
হল। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল যা পূর্বেও বলা হয়েছে
,“
অদৃশ্য
”
আল্লাহর
রহস্যের মধ্যে একটি এবং এই অদৃশ্যের প্রকৃত কারণ ইমাম মাহ্দীর
আবির্ভাবের পর উদঘাটিত হবে। (এতটুকু বলা যেতে পারে) যা আলোচনা
করা হয়েছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্যে তার প্রভাব রয়েছে।