চতুর্থ ভাগ
:কাঙ্ক্ষিতের সাক্ষাৎ
অদৃশ্যকালীন সময়ে শিয়াদের সবচেয়ে বড় কষ্ট হল যে
,তারা তাদের
মাওলার থেকে দুরে এবং তার নজির বিহীন নূরানী চেহারাকে দেখতে পায়
না। অদৃশ্যের পর থেকে আবির্ভাবের জন্য প্রতিক্ষাকারীরা সর্বদা তাকে
দেখার আশায় জ্বলছে এবং তার দুরত্বের কারণে আর্তনাদ করছে। তবে
স্বল্পমেয়াদী অদৃশ্যকালীন সময়ে শিয়ারা ইমামের নায়েবদের
(প্রতিনিধিদের) মাধ্যমে ইমামের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারত এবং
কেউ কেউ আবার সরাসরি ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন
করতেন। এ সম্পর্কে অনেক হাদীসও রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানের
(যাকে পরিপূর্ণ অদৃশ্য বলা যেতে পারে) পর সরাসরি যোগাযোগ সম্পূর্ণ
ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি বিশেষ নায়েবদের মাধ্যমেও ইমামের সাথে
যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
তারপরও অধিকাংশ আলেমগণ বিশ্বাস করেন যে
,এ সময়েও তার
সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব এবং তা বহুবার ঘটেছে। আল্লামা বাহরুল উলুম
,মোকাদ্দাস আরদেবেলী
,সাইয়্যেদ ইবনে তাউস এবং আরো অনেক বড়
আলেমগণ তার সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
ইমাম মাহ্দীর সাথে সাক্ষাতের আলোচনায় নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর
লক্ষ্য করুন:
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে: কখনো অসহায় ও অতি জরুরী অবস্থায় ইমামের
সাথে সাক্ষাৎ হয়ে থাকে
,কখনো আবার সাভাবিক অবস্থাতেই এ সাক্ষাৎ
হয়ে থাকে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে কখনো মানুষ কোন সমস্যা বা
বিপদে পড়ে অসহায় অনুভব করলে ইমাম মাহ্দী (আ.) তাদেরকে সাহায্য
করেন। অনেকেই বিভিন্ন স্থানে যেমন হজ্বে যাওয়ার পথে পথ ভুলে গেলে
ইমাম মাহদী (আ.) অথবা তার কোন প্রতিনিধি তাদেরকে এ পরিস্থিতি থেকে
মুক্তি দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ মোলাকাতই এ ধরণের। কিন্তু কখনো
আবার স্বাভাবিক অবস্থাতেই মোলাকাতকারী তার আধ্যাত্মিক মর্যাদার
মাধ্যমে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করে থাকেন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে
,ইমামের সাথে মোলাকাতের
দাবি সবার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে: দীর্ঘমেয়াদী অদৃশ্যকালে বিশেষ করে বর্তমান
সময়ে যারা ইমামের সাথে সাক্ষাতের দাবি করে থাকে তারা কেবল
নিজেদের চারপাশে লোক জড়ো করা এবং রুজি ও খ্যতি অর্জন করার
জন্যেই একাজ করে থাকে। এভাবে তারা অনেককেই পথভ্রষ্ট করেছে এবং
তাদের আক্বীদা ও আমল নষ্ট করেছে। তারা বিভিন্ন দোয়া এবং বিশেষ
কিছু আমলের মাধ্যমে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব বলে থাকে কিন্তু
তার কোন ভিত্তি নেই। তারা দাবি করে এসব করলে অতি সহজেই
ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব। যেখানে আল্লাহর নির্দেশে ইমাম দীর্ঘ
মেয়াদী অদৃশ্যে রয়েছেন এবং অতি বিশেষ এবং খুবই মুষ্টিমেয় মহান
আলেমরা ব্যতীত কেউই তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে: তখনই মোলাকাত সম্ভব যখন ইমাম মাহ্দী (আ.)
নিজেই তা প্রয়োজন মনে করবেন। সুতরাং যখন কোন সাক্ষাৎ পিপাসু অতি
আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করতে না পারে তখন তাকে
নিরাশ হলে চলবে না এবং যেন মনে না করে যে
,ইমাম তাকে ভালবাসে
না বা তার প্রতি ইমামের কোন দৃষ্টি নেই। অনুরূপভাবে যিনি তার সাথে
সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে সে যেন মনে না করে যে
,ইমাম
তাকে সবার চেয়ে বেশী ভালবাসে এবং সে তাকওয়া ও ফজিলতের শীর্ষে
অবস্থান করছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে যদিও ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করা ও কথা বলা অতি
সৌভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু আমাদের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম মাহ্দী (আ.)
শিয়াদেরকে বলেন নি যে তোমরা আমাকে দেখার জন্য চিল্লায় বস অথবা
জঙ্গলে বসবাস কর। বরং তারা বলেছেন যে
,তার আবির্ভাবের জন্য দোয়া
কর এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা কর। তার মহান
উদ্দেশ্যের পথে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবেই তার আবির্ভাবের পথ
সুগম হবে এবং সারা বিশ্ব তার থেকে সরাসরি উপকৃত হবে।
ইমাম মাহদী (আ.) নিজেই বলেছেন:
اکثر الدعاء بتعجیل الفرج فان ذالک فرجکم
আমার আবির্ভাব ত্বরান্বিত হওয়ার জন্য বেশী বেশী দোয়া কর কেননা তার
মধ্যেই তোমাদের সৌভাগ্য নিহীত রয়েছে
।
এখানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথে মরহুম হাজী আলী বাগদাদীর
মোলাকাতের সুন্দর ঘটনাটি বর্ণনা করা উপযুক্ত মনে করছি।
ওই যোগ্য ও পরহেজগার ব্যক্তি সর্বদা বাগদাদ থেকে কাযেমাইনে
যেতেন এবং দু
’
মহান ইমাম হযরত ইমাম জাওয়াদ (আ.) এবং হযরত ইমাম
কাযেম (আ.)-এর যিয়ারত করতেন। তিনি বলেন: আমার উপর কিছু খুমস
ও যাকাত ওয়াজিব ছিল। এ কারণেই নাজাফে আশরাফ গেলাম এবং তা
থেকে 20 তুমান মহান আলেম ও ফকীহ শেইখ আনসারীকে দিলাম এবং
20 তুমান আয়াতুল্লাহ শেইখ মুহাম্মদ হাসান কাযেমী (রহ.)-কে দিলাম। 20
তুমান আয়াতুল্লাহ শেইখ মুহাম্মদ হাসান শুরুকী (রহ.)-কে দিলাম এবং
সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি দেনাকে ফেরার পথে হযরত আয়াতুল্লাহ আলে
ইয়সীনকে দিব। পঞ্চম দিনে বাগদাদে ফিরে এসে প্রথমে দু
’
মাহন ইমামকে
যিয়ারত করার জন্য কাযেমাইনে গেলাম। অতঃপর আয়াতুল্লাহ আলে
ইয়াসীনের বাড়ী গেলাম এবং আমার শরিয়তী দেনার বাকি অংশ তাকে
দিলাম। তার কাছে অনুমতি চাইলাম যে
,বাকিটা ক্রমে ক্রমে তাকে অথবা
অন্যদেরকে দিব। তিনি আমাকে তার কাছে থাকতে বললেন কিন্তু জরুরী
কাজ থাকাতে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাগদাদের দিকে রওনা হলাম।
তিন ভাগের এক ভাগ পথ জাওয়ার পর একজন মহান সাইয়্যেদের সাথে
সাক্ষাৎ হল। তার মাথায় সবুজ পাগড়ী এবং চোয়ালে একটি সুন্দর কালো
তিল ছিল। তিনি যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কাযেমাইনে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার
নিকটে এসে আমাকে সালাম এবং হাতে হাত দিলেন
,আমাকে টেনে
জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানিয়ে বললেন
,কোথায় যাচ্ছ
?
আমি বললাম: যিয়ারত করে এখন বাগদাদে ফিরে যাচ্ছি। তিনি
বললেন: আজ বৃহস্পতিবারের দিবগত রাত কাযেমাইনে ফিরে যাও এবং
এ রাতটা সেখানেই কাটাও। বললাম: সম্ভব হবে না! তিনি বললেন:
পারবে
,যাও ফিরে যাও তাহলে সাক্ষি দিব যে তুমি আলী (আ.)-এর প্রতি
এবং আমাদের প্রতি ভালবাসা পোষণকারী এবং শেইখও সাক্ষি দিবে।
আল্লাহ তা
’
আলা বলছেন:
و استشهد شهیدین
দু
’
জনকে সাক্ষি রাখ।
আলী বাগদাদী আরো বললেন: আমি ইতিপূর্বে আয়াতুল্লাহ আলে
ইয়াসিনকে বলেছিলাম যে
,আমার জন্য যেন তিনি একটি সনদ লিখেন
এবং তাতে যেন সাক্ষ্য দেন যে
,আমি আহলেবাইতের প্রতি ভালবাসা
পোষণকারী শিয়া এবং আমি সে সনদটাকে আমার কাফনের মধ্যে রাখব।
আমি সাইয়্যেদকে প্রশ্ন করলাম: আপনি কোথা থেকে আমাকে চেনেন এবং
কিভাবে এ সাক্ষ্য দিবেন
?তিনি বললেন: যদি কেউ কারো আধিকার
সম্পূর্ণরূপে দিয়ে দেয় তাহলে তাকে চেনা কি কঠিন
?বললাম: কোন
অধিকার
?তিনি বললেন: যে অধিকার তুমি আমার উকিলকে দিয়েছ।
বললাম: আপনার উকিল কে
?তিনি বললেন: শেইখ মুহাম্মদ হাসান। আমি
বললাম: তিনি কি আপনাপর উকিল
?বললেন: হ্যাঁ।
তার কথা শুনে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। মনে হচ্ছিল তিনি আমার পূর্ব
পরিচিত কেউ অথচ আমি তাকে ভুলে গেছি। তিনি প্রথম দেখাতেই
আমাকে আমার নাম ধরে ডেকেছিলেন। মনে করেছিলাম যে
,তিনি হয়ত
রাসূল (সা.)-এর সন্তান হিসাবে ওই খুমসের কিছু অংশ আমার কাছে
চাচ্ছেন। সুতরাং বললাম: আপনাদের অধিকারের কিছু পরিমাণ আমার
কাছে আছে
,তবে তা খরচ করার অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। তিনি মুচকি
হেসে বললেন: হ্যা
,আমাদের কিছু হককে নাজাফে আমাদের উকিলের
কাছে দিয়েছ। বললাম: আল্লাহ আমার এ কাজ গ্রহণ করবেন
?তিনি
বললেন: হ্যাঁ। আমার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হল যে
,তিনি কিভাবে আমাদের
সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেমকে তার উকিল হিসাব করছেন। কিন্তু আবার তা ভুলে
গেলাম।
আমি বললাম: হে আমার মাওলা এটাকি ঠিক যে
,যদি কেউ
বৃহস্পতিবারের দিবগত রাতে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে যিয়ারত করে তাহলে
সে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাবে
?তিনি বললেন: হ্যাঁ! এবং তখনই
তার চোখ অশ্রুতে ভরে গেল ও তিনি কেঁদে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর
দেখলাম যে
,কোন প্রকার পথ না হেটেই কাযেমাইনে পৌঁছে গেছি। প্রবেশ
দারে দাড়ালাম। তিনি বললেন: যিয়ারত পড়। আমি বললাম: হে আমার
মাওলা আমি ভাল পড়তে পারি না। তিনি বললেন: তুমি কি চাও যে
,আমি
পড়ব আর তুমি আমার সাথে যিয়ারত করবে
?বললাম: হ্যাঁ।
তিনি শুরু করলেন এবং রাসূল (সা.) ও ইমামদের প্রতি সালাম করলেন
এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.) পর্যন্ত পড়ার পর বললেন: তুমি তোমার
যামানার ইমামকে চেন
?বললাম: কেন চিনব না
?বললেন: তাহলে তার
প্রতি সালাম কর। বললাম
,
السلام علیک یا حجة الله یا صاحب الزمان یا ابن الحسن
তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন:
وعلیک السلام و رحمة الله و برکاته
অতঃপর মাযারে প্রবেশ করে যারিহতে চুমু খেলাম। তিনি বললেন:
যিয়ারত পড়। বললাম: হে আমার মাওলা আমি ভাল পড়তে পারি না।
তিনি বললেন: তুমি কি চাও যে
,আমি পড়ব আর তুমি আমার সাথে
যিয়ারত করবে
?বললাম: হ্যাঁ। তিনি যিয়ারতে
‘
আমিন আল্লাহ
’
পড়ে
বললেন: আমার পিতামহ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর যিয়ারত করতে চাও
?বললাম: হ্যাঁ আজকে বৃহস্পতিবারের দিবগত রাত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর
যিয়ারত করার রাত। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর যিয়ারত পাঠ করলেন।
মাগরিবের নামাজের সময় হলে তিনি বললেন
,‘
চল জামাতের সাথে নামাজ
পড়ি।
’
নামাজ পড়ার পর দেখলাম তিনি নেই এবং অনেক খোঁজা খুঁজি
করেও তাকে আর পেলাম না।
তখন বুঝলাম যে
,তিনি আমাকে নাম ধরে ডেকেছিলেন
,অনিচ্ছা
সত্ত্বেও তার সাথে কাযেমাইনে ফিরে গেলাম। তিনি বড় বড় আলেম ও
ফকীহদেরকে নিজের উকিল বললেন। শেষে আবার হঠাৎ করে দৃষ্টির
আড়ালে চলে গেলেন
।
অতঃএব
,তিনিই ইমাম মাহদী (আ.) ছিলেন এবং
হায় আফসোস যে
,আমি তাকে অনেক দেরীতে চিনতে পেরেছিলাম।