ইমাম ও আব্বাসীয় শাসন
ইমাম মূসা ইবনে জা
’
ফর কাযেম (আ.)-এর চার বছর বয়সের সময় স্বেচ্ছাচারী উমাইয়্যা শাসনের মূলোৎপাটিত হয়েছিল
।
উমাইয়্যা শাসকদের আরবীয়করণ নীতি
,অন্যায় অত্যাচার
,লুন্ঠন প্রক্রিয়া ইরান বিরোধী শাসন ব্যবস্থা জনগণ
,বিশেষ করে ইরানীরা যারা প্রকৃত ইসলামী ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা আশা করত
,বিশেষ করে যারা ইমাম আলী (আ.)-এর স্বল্পকালীন খেলাফত আমলের শাসনব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি আশা করত তারা উমাইয়্যা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন
।
এমতাবস্থায় তদানিন্তন রাজনীতিবিদরা মানুষের এ প্রবণতাকে বিশেষ করে
ইরানীদের হযরত আলীর বংশধর ও আলীরূপ শাসনব্যবস্থার প্রতি তাদের আকর্ষণকে অপব্যবহার করেছিল
।
তারা যার অধিকার তার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নামে
,আবু মুসলিম খোরাসানীর সহযোগিতায় উমাইয়্যাদেরকে পদচ্যুত করালেন
।
কিন্তু তারা ষষ্ঠ ইমাম জা
’
ফর সাদেক (আ.)-এর পরিবর্তে আবুল আব্বাস সাফ্ফাহ আব্বাসীকে খেলাফতের মসনদে এবং প্রকৃত পক্ষে রাজ সিংহাসনে বসালেন
।
এভাবেই 123 হিঃ সনে রাজতন্ত্রের এক নব ধারার পত্তন ঘটল
,তবে তা খেলাফত ও নবী (সা.)-এর উত্তরসূরীর পোশাকে তারা ধর্মহীনতা
,অত্যাচার ও কপটতার দিক থেকে উমাইয়্যাদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না
,বরং এগুলোর দিক থেকে তারা উমাইয়্যাদেরকেও হার মানিয়েছিল
।
পার্থক্য শুধু এটুকু যে উমাইয়াদের কু-শাসন খুব বেশী স্থায়ী হতে পারেনি
।
আর আব্বাসীয়রা 656 হিজরী পর্যন্ত অর্থাৎ 524 বছর একইভাবে বাগদাদ থেকে খেলাফতের নামে রাজত্ব করেছিল
।
যাহোক
,সপ্তম ইমাম তাঁর জীবদ্দশায় আবুল আব্বাস আস সাফফাহ
,মানসূর দাওয়ানিকী
,হাদী
,মাহদী ও হারুনের খেলাফতামল তাদের সকল অত্যাচার
,মানহানি ও বল প্রয়োগের ঘটনাপঞ্জী সহ অতিবাহিত করেছিলেন
।
ইমামের জীবন দর্পন
,দুঃখের তাম্রমলে ঢেকে দেয়ার কিংবা বেদনার অমানিশায় আচ্ছাদিত করার জন্য কেবলমাত্র এ শয়তান প্রকৃতির মানুষগুলোর দুষ্ট ও নিষ্ঠুর আত্মার কলুষতাই যথেষ্ট ছিল
।
অথচ এদের প্রত্যেকেই (মানসূর থেকে হারুন পর্যন্ত) এ মহাত্মনের দেহ ও মনের উপর চরম নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট অত্যাচার চালাতে কুন্ঠাবোধ করেনি
।
যদি কিছু না করে থাকে তবে তা অপারগতা বশত
,করতে চায় নি যে
,তা নয়
।
আবুল আব্বাস আস সাফফাহ 136 হিজরীতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে তার ভ্রাতা মানসূর দাওয়ানিকী তার স্থলাভিষিক্ত হলো
।
সে বাগদাদ নগরী গড়ল এবং আবু মুসলিমকে হত্যা করল
।
যদোবধি খেলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হলো হযরত আলীর সন্তানগণকে হত্যা কারারুদ্ধ ও নির্যাতন করা এবং তাদের ধনসম্পদ লুট-তরাজ করা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও ক্ষান্ত হয়নি
।
সে এ বংশের সকল মহান ব্যক্তিদেরকে হত্যা করেছিল
।
আর তাদের শীর্ষে ছিলেন ইমাম সাদেক (আ.)
।
হারুন ছিল রক্তপিপাসু
,প্রতারক
,চরম হিংসুক
,কৃপণ
,লোভী ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী
।
আবু মুসলিমের ক্ষেত্রে তার বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা সাধারণের কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল
।
কারণ সে এক জীবন কষ্টের বিনিময়ে তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল
।
যখন
,ইমাম কাযেম (আ.)-এর মহান পিতাকে শহীদ করা হয়েছিল
,তখন তাঁর বয়স ছিল বিশ বছর
।
তিনি তাঁর জীবনের ত্রিশ বছর পর্যন্ত মানসূরের ভয়-ভীতি
,ত্রাস ও শ্বাসরুদ্ধকর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য গোপনে সংবাদ প্রেরণ করতেন ও তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন
।
মানসূর 158 হিজরীতে নিহত হলে রাজ সিংহাসনের দায়িত্ব ভার তার পুত্র মাহদীর উপর ন্যস্ত হলো
।
মাহদী আব্বাসীর রাজনীতি ছিল প্রবঞ্চনা ও প্রতারণামূলক
।
সে তার পিতার শাসনামলের রাজবন্দীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত প্রায় সকলকেই মুক্তি দিয়েছিল
,যাদের অধিকাংশই ছিলেন ইমাম কাযিমের অনুসারী
।
সে তাদের লুন্ঠিত মালামালও ফিরিয়ে দিয়েছিল
।
কিন্তু তাদের কাজ কর্মের প্রতি নজর রেখেছিল এবং অন্তরে তীব্র ক্ষোভ গোপন রেখেছিল
।
এমনকি যে সকল কবিরা হযরত আলীর বংশকে দুর্নাম করত
,তাদেরকে অগণিত পুরস্কার দিত
।
যেমন : একবার বাশার ইবনে বুরদকে সত্তর হাজার দেরহাম দিয়েছিল এবং মারওয়ান ইবনে আবি হাফসকে একলক্ষ দেরহাম দিয়েছিল
।
মুসলমানদের বাইতুলমালের টাকা তার আরাম
,আয়েশ
,মদপান ও নারীর পিছনে উদার হস্তে খরচ করত
।
সে তার পুত্র হারুনের বিবাহে পঞ্চাশ মিলিয়ন দেরহাম খরচ করেছিল
।
মাহদী আব্বাসীর সময় ইমামের খ্যাতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল
।
কল্যাণ
,তাকওয়া
,জ্ঞান ও নেতৃত্বের আকাশে তিনি পূর্ণ শশীসম কিরণ দিচ্ছিলেন
।
দলে দলে লোকজন গোপনে তার নিকট আসত এবং অনাদি কল্যাণের ঐ ঝর্ণাধারা থেকে স্বীয় আত্মিক পিপাসা মিটাত
।
মাহদীর গুপ্তচররা এ সকল ঘটনার সংবাদ তার কাছে পৌঁছালে স্বীয় খেলাফতের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত হলো এবং ইমামকে মদীনা থেকে বাগদাদে এনে বন্দী করার নির্দেশ দিল
।
‘
আবু খালিদ যাবালেয়ী
’
বলেন : এ আদেশ অনুসারে যে নিযুক্ত ব্যক্তিরা হযরতের জন্য মদীনায় গিয়েছিল
,ফিরে আসার সময় যাবালেতে হযরতকে সহ আমার গৃহে অবস্থান নিয়েছিল
।
ইমাম ক্ষুদ্র সময়ের সুযোগে
,নিযুক্তদের চোখের আড়ালে আমাকে তাঁর জন্য কিছু জিনিস ক্রয় করার নির্দেশ দিলেন
।
আমি খুব হৃদয় ভারাক্রান্ত ছিলাম এবং সবিনয়ে নিবেদন করলাম : আপনি যে
,রক্তলোলুপের কাছে যাচ্ছেন
,তাতে আপনার জন্যে খুব ভয় হয়
।
তিনি বলেলেন : আমি তাকে ভয় করি না
।
তুমি ঐ দিন ঐ স্থানে আমার জন্য অপেক্ষা কর
।
তিনি (ইমাম) বাগদাদ গেলেন
।
আমি আশঙ্কার সাথে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম
।
প্রতিশ্রুত দিবস আসল
,আমি কথিত স্থানের দিকে ধাবিত হলাম
;হৃদয় আমার দুরুদুরু কাঁপছিল
,সামান্য শব্দেই লাফিয়ে উঠতাম
;অপেক্ষার আগুনে জ্বলছিলাম
।
একটু একটু করে দিগন্ত রক্তিম হতে লাগল
,সূর্য নিশীথের কোলে ঢলে পড়তে লাগল
।
হঠাৎ দূর থেকে ছায়ার মত কাউকে দেখলাম ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছিল
।
হৃদয় আমার চাইল তাদের নিকট উড়ে যাব
;আবার ভয় পাচ্ছিলাম যে
,যদি তিনি না হয়ে থাকেন
;পাছে আমাদের গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়ে যায়
।
যথাস্থানেই অপেক্ষমান থাকলাম
,ইমাম আমার নিকটবর্তী হলেন
।
তিনি একটি খচ্চরের পৃষ্ঠে ছিলেন
।
যখনই তাঁর দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ হলো
;বললেন : আবা খালিদ
,দ্বিধা করো না এবং বলতে লাগলেন : পরবর্তীতে আমাকে আবার বাগদাদে নিবে
,আর তখন আর ফিরে আসব না
।
পরিতাপের বিষয় তেমনটিই ঘটে ছিল ...
।
যাহোক এ সফরেই যখন আব্বাসীয় খলিফা মাহদী ইমামকে বাগদাদ নিয়ে আসল ও কারারুদ্ধ করল
,তখন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে স্বপ্নে দেখল যে তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে এ আয়াতটি পাঠ করছেন :
)
فهل عسيتم ان تو لّيتم ان تفسدوا في الارض و تقطّعوا ارحامكم
(
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তোমরা সম্ভবত পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে
।
রাবী বলেন : মধ্যরাত্রিতে আব্বাসীয় খলিফা মাহদী আমাকে ডেকে পাঠাল
।
খুব সন্ত্রস্ত
হলাম ও তার নিকট দ্রুত উপস্থিত হলাম
;দেখলাম
(
..
.فهل عسيتم
)
আয়াতটি পাঠ করছিল
।
অতঃপর বলল : যাও
,মুসা ইবনে জা
’
ফরকে কারাগার থেকে আমার নিকট নিয়ে আস
।
আমি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসলাম
;মাহদী ওঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে চুম্বন করে নিজের নিকট বসাল
,অতঃপর নিজের স্বপ্নের কথা তাঁর নিকট ব্যক্ত করল
।
অতঃপর তৎক্ষণাৎ ইমামকে মদীনায় ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল
।
রাবী বলেন : পাছে কোন বাধা আসে
,এ ভয়ে ঐ রাতেই ইমামের যাত্রা কালীন জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তার যাত্রার ব্যবস্থা করলাম প্রভাত আলোয় তিনি মদীনার পথে ছিলেন...
।
ইমাম মদীনায় আব্বাসীয়দের শ্বাসরূদ্ধকর প্রহরা সত্ত্বেও মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন
,জ্ঞান বিতরণ ও শিয়াদেরকে (আধ্যাত্মিক ভাবে) গড়ে তোলার জন্য ব্যস্ত ছিলেন...
।
ইতোমধ্যে 169 হিজরীতে মাহদী নিহত হলে তার পুত্র হাদী আব্বাসী রাজতন্ত্রের মসনদে অধিষ্ঠিত হলো
।
হাদী তার পিতার অনুরূপ জনসাধারণের ন্যূনতম অধিকারটুকুও রক্ষা করত না এবং প্রকাশ্যে হযরত আলী (আ.)-এর বংশধরদের সাথে কঠোর আচরণ করত
;এমন কি যা কিছু তার পিতা তাদেরকে (হযরত আলীর বংশধরদের) দিয়েছিল তা-ও ছিনিয়ে নিয়েছিল
।
তার ঘৃণ্যতম কৃষ্ণকর্ম হলো ফাখের নৃশংস ও নির্মম হত্যাকান্ড
।