ইসলামী উৎসসমূহে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দীর উপর বিশ্বাস
ইসলামের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং নিষ্পাপ ইমামগণ
,বিভিন্ন সময়ে বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব
,উত্থান
,দীর্ঘদিন মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকা এবং তার আরও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে খবরা খবর দিয়েছিলেন। তাদের অনেক অনুসারী বা ছাত্ররাই এই খবর বা হাদীসসমূহকে উল্লেখ করেছেন।
“
ইমাম মাহ্দী
”
গ্রন্থের লেখক তার এই গ্রন্থে নবী (সা.)-এর 50 জন সাহাবী ও 50 জন তাবেইন (যারা সরাসরি নবীকে (সা.) দেখেন নি কিন্তু তার সাহাবাদেরকে দেখেছেন) যারা হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে লিপিবদ্ধ করেছে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন।
কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও নামকরা কবি অনেক বছর ধরে এমনকি ইমাম মাহ্দীর জন্মগ্রহণের একশত বছর আগে থেকেই এই হাদীসসমূহের ভাবার্থের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের কবিতা রচনা করেছেন :
কুমাইত একজন বিপ্লবী শিয়া কবি (মৃত্যু 126 হিজরী) ইমাম মাহ্দী
(আ.)-এর উপর রচিত একটি কবিতা ইমাম বাকির (আ.)-এর সামনে পাঠ করে তাঁর আবির্ভাবের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল।
ইসমাইল হামিরী (মৃত্যু 173 হিজরী ) ইমাম সাদিক (আ.)-এর সংস্পর্শে এসে তাঁর মাধ্যমে হেদায়েত পাওয়ার পর
,একই ছন্দে গাঁথা প্রশংসা মূলক একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করে যা নিম্নে উল্লিখিত হলো :
وَ اُشْهِدُ رَبِّى أَنَّ قَوْلَكَ حُجَّةٌ
|
|
عَلَى الْخَلْقِ طُرّاً مِنْ مُطِيعٍ وَ مُذْنِبٍ
|
بِاَنَّ وَلِىَّ الْامْرِ وَ الْقاَئِمَ الَّذِى
|
|
تَطَلَّعَ نَفْسِى نَحْوَهُ بِتَطَرُّبٍ
|
لَهُ غَيْبَةٌ لا بُدَّ مِنْ أَنْ يَغِيبَها
|
|
فَصَلِّىَ عَلَيْهِ اللَّهُ مِنْ مَتَغَيِّبٍ
|
فَيَمْكُثُ حِيناً ثُمَّ يَظْهَرُ حِينَهُ
|
|
فَيَمْلَأُ عَدْلاً كُلَّ شَرْقٍ وَ مَغْرِبٍ
|
(আর আমার আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি যে আপনার (ইমাম সাদিক) মুখের কথা সমস্ত সৃষ্টির উপর যারা অনুগত ও যারা পাপী
,তাদের সবার উপর দলিল স্বরূপ।
(বলেছিলেন যে) ওয়ালীয়ে আমর (নির্দেশের অধিকর্তা) ও কায়েম (উত্থানকারী) যার জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল
,তাঁর অন্তর্ধান থাকবে যাতে কোন সন্দেহ নেই
,ঐ অন্তর্ধানের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
একটি নির্দিষ্ট সময় অদৃশ্যে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। আর পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত অত্যাচার ও জুলুমকে অপসারণ করে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
দে
’
বেল খুযা
’
ই হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন (মৃত্যু 246 হিজরী)। তিনিও এসম্পর্কে একটি প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা রচনা করে ইমাম রেজা (আ.)-এর সামনে পাঠ করেন
,যা এরূপ :
فَلَوْلاَ الَّذِى اَرْجُوهُ فِى الْيَوْمِ اَوْ غَدٍ
|
|
تَقَطَّعَ نَفْسِى اَثْرَهُمْ حَسَراتٍ
|
خُرُوجَ اِمامٍ لاَ مُحالَةَ خاَرِجٌ
|
|
يَقُومُ عَلَى اسْمِ اللَّهِ وَ الْبَرَكاَتِ
|
يُمَيِّزُ فِيناَ كُلَّ حَقٍّ وَ باطِلٍ
|
|
وَ يَجْزِى عَلَى النَّعْماءِ وَ النَّقَماتِ
|
আজ অথবা কাল যা কিছু ঘটবে সে বিষয়ে যদি আমি আশান্বিত না থাকতাম তাহলে আমার অন্তর আহলে বাইতের দুঃখে ও অনুতাপে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।
এবং সেই আশা
,এমন এক ইমামের অবির্ভাবের জন্য যিনি নিঃসন্দেহে আবির্ভূত হবেন। যিনি আল্লাহর নাম ও বরকত সাথে নিয়ে কিয়াম করবেন। আর তিনি আমাদের মধ্যকার সত্য ও বাতিলকেও পৃথক করবেন এবং ভাল কাজের পুরস্কার ও খারাপ কাজের শাস্তি দিবেন।
যখন দে
’
বেল এই কবিতাটি পাঠ করলো ইমাম রেজা (আ.) মাথা তুলে বললেন : ওহে খুযা
’
ই! এই কবিতাটিকে রুহুল কুদুস তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন। আরও বললেন : তুমি কি জান সেই ইমাম কে
?
দে
’
বেল : না জানিনা। শুধু এতটুকুই শুনেছি যে
,একজন ইমাম আপনার বংশ থেকে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইমাম : ওহে দে
’
বেল! আমার পরে আমার ছেলে মুহাম্মদ (ইমাম জাওয়াদ) ইমাম ও তারপর তার ছেলে আলী (ইমাম হাদী)
,তারপর তার ছেলে হাসান (ইমাম আসকারী) এবং তারপর তার ছেলে
‘
হুজ্জাতে কায়েম
’
যে থাকবে লোক চক্ষুর অন্তরালে আর মানুষ থাকবে তার অপেক্ষায়। যখন তাঁর আবির্ভাব ঘটবে সবাই তাকে অনুসরণ করে চলবে। যদি দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার মাত্র আর একদিনও বাকি থাকে আল্লাহ্ সেই দিনকে এতটা দীর্ঘ করে দিবেন যাতে করে সেই কায়েমের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং দুনিয়াতে অত্যাচার ও জুলুমের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। অত্যাচার ও জুলুমের পরিমান যতই বেশী হোক না কেন।
অন্যান্য আরও কিছু সংখ্যক কবি ও লেখক যারা ইমামগণের সমসাময়িক অথবা ইমামগণের সমসাময়িক কবিদের ছাত্র ছিল
,তারা তাদের কবিতায় পরিষ্কারভাবে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিষয়ে ইশারা করেছে।
কখনও কখনও এমন হয়েছে যে ইমামদের কাছে অনেকেই প্রশ্ন করত
,আপনি কি রাসূলের বংশের সেই উত্থানকারী (কায়েম আলে মুহাম্মদ) অথবা প্রতীক্ষিত মাহ্দী (মাহ্দী মুনতাযার)
?ইমামগণ তাদের প্রশ্নের উত্তরে স্থান
,কাল
,পাত্র ভেদে ইমাম মাহদী আল কায়েম (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরতেন।
আর এ সম্পর্কিত (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের) হাদীসসমূহের প্রসিদ্ধির কারণেই তাঁর জন্মের পূর্ব থেকেই অনেকেই নিজেদেরকে মাহ্দী হওয়ার মিথ্যা দাবী করেছে অথবা তাদেরকে মাহ্দী বলে অভিহিত ও প্রচার চালিয়ে অন্যরা এই পথে সুবিধা আদায় করেছে। উদাহরণ স্বরূপ : কিসানিয়াহ্ ফেরকার অনুসারীরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের প্রায় দুইশত বছর আগে মুহাম্মদ হানাফিয়াকে ইমাম ও প্রতীক্ষিত মাহ্দী বলে মনে করত। আর তাদের ধারণা ছিল যে
,সে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। একদিন আবার আবির্ভূত হবে। তারা তাদের দাবি অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে নবী (সা.) ও অতীত ইমামগণের নিকট থেকে যে সকল হাদীস শুনেছিল তা মুহাম্মদ হানাফিয়ার ব্যাপারে বলতে শুরু করলো।
আব্বাসীয় খলিফা মাহ্দীও নিজেকে
“
প্রতিশ্রুত মাহ্দী
”
বলে মানুষের মাঝে পরিচিত করাতে চেয়েছিল যাতে করে ইমাম মাহ্দীর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও শিয়া মাযহাবের অনেক আলেমই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত ও হাদীস তাদের লিখিত বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন।
মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল (মৃত্যু 241 হিজরী) ও সহীহ বুখারী (মৃত্যু 256 হিজরী) যা আহলে সুন্নতের আলেমদের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য তাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের অনেক আগেই তাঁর ব্যাপারে হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
হাসান বিন মাহবুব কর্তৃক লিখিত
“
মাশিখাহ্
”
বইটি যা মরহুম তাবরাসীর ভাষ্য অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দীর্ঘ কালীন অন্তর্ধানের একশত বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে। তাতে ইমামের অন্তর্ধান সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
মরহুম তাবারসী আরও বলেন যে
,ইমাম বাকির ও সাদিক (আ.)-এর সময়কার শিয়া মুহাদ্দিসরা ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানে থাকার বিষয়টিকে তাদের গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন।
আরও কিছু শিয়া ও সুন্নি মনীষী প্রতীক্ষিত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন
যার কিছু কিছু তার জন্মের পূর্বেই রচিত হয়েছে। রাওয়াজনী (মৃত্যু 250 হিজরী) একজন সুন্নি আলেম
,তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের আগেই তাঁর সম্পর্কে
“
আখবারুল মাহ্দী
”
নামে একটি বই লিখেন।
ইমামদের কিছু সাহাবাও যেমন : আনমাতী
,মুহাম্মদ বিন হাসান বিন জুমহুর ইমামের জন্ম ও তাঁর অন্তর্ধানের পূর্বেই তাঁর সম্বন্ধে বই লিখেন।
তাঁর বিষয়ে এত পরিমানে হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে
,ইসলামের অন্য কোন বিষয়ে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয় নি। শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের আলেমদের দৃষ্টিতে এই সকল হাদীসগুলো সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত। শুধুমাত্র শিয়া আলেমরাই নন বরং অনেক সুন্নি আলেমও এগুলোকে মুতাওয়াতির বলে স্বীকার করেছেন।
যেমন সাজযী (মৃত্যু 363 হিজরী) তার
“
মানাকিবুস শাফিয়ী
”
নামক গ্রন্থে লিখেছেন : হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ যা নবী (সা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা
হয়েছে তা মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে।
শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের সূত্রসমূহে ইমাম মাহ্দীর ব্যাপারে যত হাদীস পাওয়া গেছে তা যদি গণনা করা হয় নিঃসন্দেহে তা এত অধিক পরিমানে হবে যে
,ইসলামের নিশ্চিত বিশ্বাসের বিষয়েও অর্থাৎ যে সকল বিষয়ে মুসলমানরা কোন প্রকার সংশয় রাখেনা বা যে বিষয়গুলোকে মেনে চলা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে তার ব্যাপারেও এত পরিমান হাদীস বর্ণিত হয় নি।
এ কারণেই মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাসের সেই প্রথম থেকেই মাহ্দী মওউদের (প্রতিশ্রুত মাহদী) আবির্ভাব ও উত্থানের বিষয়ে অবগত ছিল। বিশেষ করে শিয়া মাযহাবের অনুসারী যারা নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের হাতে দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছিল। এ জন্যেই তারা এই বিষয়ের উপর শক্ত ও মজবুত বিশ্বাস রাখতো এবং অন্যান্য ইমামদের জীবদ্দশাতেও ইমাম মাহ্দীর জন্মের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতো।
বিভিন্ন হাদীসে হযরত মাহ্দীর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তিনি হাশেমী বংশের হযরত ফাতিমা (সা.)-এর সন্তান
,শহীদদের সর্দার ইমাম হুসাইনের বংশধারা হতে হবেন। তাঁর পিতার নাম হচ্ছে হাসান এবং তাঁর নিজের নাম ও ডাক নাম নবী (সাঃ)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। গোপনে জন্মগ্রহণ করবেন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন-যাপন করবেন। দুইটি অন্তর্ধান হবে। যার একটি স্বল্প মেয়াদী অপরটি দীর্ঘ মেয়াদী। যতদিন আল্লাহ্ চাইবেন অন্তর্ধানে থাকবেন। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে আবির্ভূত ও কিয়াম (মহাবিপ্লব) করবেন। আর সারা বিশ্বে দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। পৃথিবীকে অত্যাচার
,জুলুম থেকে মুক্ত করে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
এই হাদীসগুলোতে দ্বাদশ ইমামের শারীরিক ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এখানে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি হাদীস তুলে ধরব। সুন্নি ও শিয়া মাযহাবের হাদীসগুলোকে আমরা এখানে পৃথক পৃথকভাবে তুলে ধরবো যাতে করে পাঠকের বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।