ইমামের জন্মলাভ
ইসলামের দ্বাদশ পথ নির্দেশক হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহ্দী (আ.) 255 হিজরীর 15ই শাবান (868 খৃস্টাব্দে) শুক্রবার ভোরে ইরাকের সামাররা শহরে একাদশ ইমামের গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন।
তাঁর পিতামাতা হচ্ছেন যথাক্রমে ইসলামের একাদশ পথ নির্দেশক হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ও সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিতা রমণী নারজীস। যিনি সুসান ও সাইকাল নামেও পরিচিত। তিনি রোমের বাদশার ছেলে ইউসায়া
’
র কন্যা এবং সামউ
’
ন (সে হযরত ঈসা (আ.) এর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি এমনই সম্মানিতা ছিলেন যে
,ইমাম হাদী (আ.)-এর বোন হাকিমা খাতুন তাকে নিজের ও তার বংশের নেত্রী এবং নিজেকে তার সেবিকা হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন।
যখন নারজীস খাতুন রোমে থাকতেন রাতে অসাধারণ স্বপ্ন দেখতেন। একবার তিনি স্বপ্নে নবী আকরাম (সা.) ও ঈসাকে (আ.) দেখলেন যে
,তাকে ইমাম হাসান আসকারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করালেন। অন্য আরও একটি স্বপ্নে দেখলেন যে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর দাওয়াতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়টিকে তিনি তার পরিবারের কাছে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে গোপন রেখেছিলেন।
তারপর মুসলমান ও রোমানদের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় রোমের বাদশাহ্ যুদ্ধের ময়দানের দিকে রওনা হলো। এদিকে নারজীস খাতুন স্বপ্নের মধ্যে নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন যে
,সৈন্যদের সেবা করার জন্য যে সকল দাসী বা সেবিকা যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হয় তাদের সাথে যেন অপরিচিতের মত একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি সৈন্যদের যে তাঁবু আছে সেখানে চলে আসেন। তিনি তাই করলেন। তাদের সাথে যাওয়ার সময় এপাশের মুসলমান সীমান্ত রক্ষীরা তাদেরকে বন্দী করলো। তাকে রাজ পরিবারের সদস্য বুঝতে না পেরে বা সেবিকা ভেবেই বন্দীদের সাথে বাগদাদে নিয়ে গেল।
এই ঘটনাটি ইসলামের দশম পথ প্রদর্শক ইমাম হাদী (আ.)-এর ইমামতের শেষের দিকে ঘটেছিল।
ইমাম হাদী (আ.) রোমান ভাষায় লেখা একটি চিঠি যা তিনি নিজেই লিখেছিলেন তা তাঁর এক ভৃত্যকে দিয়ে বাগদাদে নারজীস খাতুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইমামের সেই ভৃত্য তাকে দাসী বিক্রয়ের স্থান থেকে কিনে নিয়ে সামাররায় ইমামের কাছে নিয়ে এল। তিনি স্বপ্নের মধ্যে যা কিছু দেখেছিলেন ইমাম সেগুলো তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন
,তিনি একাদশ ইমামের স্ত্রী ও এমন এক সন্তানের জননী যে এই পৃথিবীর অধিকর্তা হবে। আর পৃথিবীর বুকে ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠাকারী। তারপর ইমাম হাদী (আ.) তাকে তাঁর বোন হাকিমা খাতুনের (যিনি নবী পরিবারের সম্মানিতা নারী ছিলেন) হাতে তুলে দেন।
হাকিমা খাতুন যখনই ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে আসতেন তার ব্যাপারে দোয়া করতেন যে
,আল্লাহ্ যেন তাকে সন্তান দান করেন। তিনি বলেন : একদিন ইমাম আসকারীকে দেখতে গেলাম ও আগের দোয়ারই পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন : যে সন্তানের জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ্ তা আমাকে দিয়েছেন। সে আজ রাতেই দুনিয়ায় আগমন করবে।
নারজীস খাতুন এগিয়ে এসে আমার পা থেকে জুতা খুলে নেওয়ার জন্য বলল :
আমার সম্মানিতা নেত্রী আপনার জুতোজোড়া আমাকে দিন।
বললাম : তুমিই তো আমার নয়ন মণি ও আমার কর্ত্রী। আল্লাহর কসম আপনাকে আমার জুতা খুলে নিতে বা আমার সেবা করতে দেব না। কেননা প্রকৃতপক্ষে আমিই আপনার সেবিকা।
ইমাম আসকারী (আ.) আমার কথাটি শুনতে পেয়ে বললেন : ফুফু আম্মা আল্লাহ্ আপনাকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কাছে থাকলাম। তারপর চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক দাসীকে আমার পোশাক আনতে বললাম। ইমাম বললেন : ফুফু আম্মা
,আজ রাত আমাদের কাছে থেকে যান। কেননা আজ রাতে এমন এক শিশু ভূমিষ্ঠ হবে যে আল্লাহর কাছে অনেক সম্মানিত ও প্রিয়। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ মৃত দুনিয়াকে আবার জীবিত করবেন।
বললাম : হে আমার পথনির্দেশক! আপনি কার ভুমিষ্ঠ হওয়ার কথা বলছেন
?আমি তো নারজীস খাতুনের মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই দেখলাম না!
বললেন : নারজীসের মাধ্যমেই হবে
,অন্য কারো মাধ্যমে নয়।
আমি উঠে গেলাম এবং নারজীসকে দ্বিতীয় বারের মত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু তার মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই পেলাম না। ইমামের কাছে ফিরে এলাম এবং আমার পর্যবেক্ষণের কথা তাকে জানালাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন : ভোরে আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে যে
,তার গর্ভে সন্তান ছিল। কেননা সে মূসা কালিমুল্লাহর মায়ের ন্যায়। সে কারণেই তার গর্ভাবস্থা প্রকাশিত নয়। আর কেউ তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কে জানতো না। কেননা ফেরাউন মূসার খোঁজে (এজন্য যে সে দুনিয়ায় আসতে না পারে) গর্ভবতী মহিলাদের পেট ফেঁড়ে বাচ্চা বের করে মেরে ফেলেছিল। আর যে শিশু আজ রাতে জন্ম নিবে সেও মূসার মতই (ফেরাউনদের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলবে) এবং তারাও তার খোঁজে আছে।
হাকিমা খাতুন বলেন : আমি ভোর পর্যন্ত নারজীস খাতুনের পরিচর্যায় ছিলাম। সে শান্ত হয়ে আমার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। কোন প্রকার নড়া-চড়াও করেনি। রাতের শেষের দিকে অর্থাৎ ছুবহ্ সাদেকের সময় আচমকা নড়ে উঠলে আমি তাকে আমার কোলের মধ্যে নিয়ে আল্লাহর নাম পড়ে তার শরীরে ফুঁক দিলাম।
ইমাম পাশের ঘর থেকে সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। নারজীসের কাছে তার শরীরের অবস্থা জানতে চাইলাম। সে বলল : যা কিছু আমার মাওলা আপনাকে বলেছিল তা পরিস্কার হয়ে গেছে।
আমি ইমামের নির্দেশ অনুযায়ী সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে থাকলাম। এই সময় তার পেটের শিশুটিও আমার সাথে একই সুরে সূরা পড়তে শুরু করল। আমি যাই পড়ি সেও আমার সাথে তাই পড়ে। সে আমাকে সালাম দিল। আমি দারুণভাবে চমকে উঠলাম। ইমাম পাশের ঘর থেকে আবারও বললেন : আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিনের কর্মে আশ্চর্যান্বিত হবেন না। আল্লাহ্ তা
’
য়ালা আমাদেরকে (ইমামদের) শিশু অবস্থাতেই তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা সজ্জিত করেন আর পরিপূর্ণ বয়সে দুনিয়াতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন।
ইমামের কথা শেষ না হতেই নারজীস আমার পাশ থেকে উধাও হয়ে গেল। বলা যায় যেন আমার ও তার মাঝে একটি পর্দা টাঙানো হয়েছে। কেননা তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। চিৎকার দিয়ে ইমামের কাছে ছুটে গেলাম। তিনি বললেন : ফুফু আম্মা ফিরে যান। তাকে অচিরেই আগের জায়গাতে দেখতে পাবেন।
ফিরে এলাম। কিছু সময় যেতে না যেতেই ঐ পর্দার প্রলেপটি আমাদের মধ্য থেকে সরে গেল। আমি নারজীসকে দেখলাম সে যেন নূরের আলোর মধ্যে ডুবে আছে। তাকে
দেখতে গেলে ঐ নূরের আলোক ছটায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। যে পুত্র সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাকেও দেখলাম
,সে সেজদারত অবস্থায় আছে এবং তর্জনী উঠিয়ে বলল :
اَشْهَدُ أَنْ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَ أَنَّ جَدِّى مُحَمَّداً رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ أَنَّ أَبِى اَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই
,তিনি অদ্বিতীয় ও তাঁর কোন শরিক নেই এবং বাস্তবিকই আমার পিতামহ মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং মু
’
মিনদের নেতা আলী (আ.) আমার পিতা।
তারপর একের পর এক নিজে সহ অন্যান্য ইমামগণের ইমামতের সাক্ষ্য দিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আমার প্রতিশ্রুতি প্রদানের স্থান ও কালকে ত্বরান্বিত কর
,আমার কাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাও
,আমার প্রতিটি পদক্ষেপ দৃঢ় করতে দাও এবং আমার মাধ্যমেই এই দুনিয়াতে ন্যায় ও নীতির প্রতিষ্ঠা কর ...
।