ইমামের জন্ম গ্রহণের খবর গোপন থাকার কারণ
ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দান করে বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের শাসনামলে বিশেষ করে ষষ্ঠ ইমাম হযরত সাদিকের পর থেকে আব্বাসীয় খলিফারা অন্যান্য ইমামগণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। তার কারণ হলো সমাজের মানুষের মাঝে তাদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আর যতই দিন যাচ্ছিল সমাজের ভিতর তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি মানুষের ভালবাসা বেড়েই চলছিল। তাই আব্বাসীয় খলিফারা
,নিজেদের খেলাফত হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা করত। বিশেষ করে ইমাম মাহ্দীর বিষয়ে সকলে জানত যে
,তিনি নবীর উত্তরসূরী ও মাসুম ইমামগণের বংশোদ্ভূত এবং হযরত আসকারীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে দুনিয়াকে সমস্ত প্রকার অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্ত করে ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবেন। এই কারণেই ইমাম হাসান আসকারীকে তারা কড়া নজরে রাখে। যেমনভাবে তাঁর দাদা ও পিতাকে তাদের (আব্বাসীয়) খেলাফতের রাজধানী সামাররাতে নিয়ে এসে কড়া নজরে রেখেছিল। আব্বাসীয়রা চেষ্টা করেছিল যে
,ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ ও বেড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে
,কিন্তু মহান স্রষ্টার অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছা ও অখণ্ডনীয় বিধি এটাই ছিল যে
,এই শিশু জন্ম গ্রহণ করবে এবং তাদের সমস্ত প্রকার অপচেষ্টাই অনর্থক হবে। আল্লাহ্ তা
’
য়ালা তাঁর জন্মকে হযরত মূসার (আ.) মতই গোপন করে রাখলেন। শুধুমাত্র ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) অতি নিকটের কিছু সাহাবা কয়েকবার ইমাম মাহ্দীকে (আ.) তাঁর পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় দেখেছেন। ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) ইন্তেকালের সময় তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং তাঁর পিতার জানাযার নামায পড়ান। সে সময় সাধারণ মানুষও তাকে দেখেছিল। নামায শেষে তিনি আবার অদৃশ্য হয়ে যান
।
জন্মের সময় থেকে শুরু করে তাঁর পিতার শাহাদতের সময় পর্যন্ত তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও পিতার নিকটতম সাহাবাগণ তাকে দেখতে সমর্থ হয়েছিল বা তারা ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর বাড়ীতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতো। আসলে ইমামের পদ্ধতি এমন ছিল যে
,তাঁর সর্বসম্মানিত সন্তানকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখলেও সময় ও সুযোগ মতো প্রকৃত সাহাবাদেরকে চাক্ষুসভাবে তাঁকে দেখিয়ে ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ সম্পর্কে জ্ঞাত করবেন এবং তারা অন্যান্য অনুসারীদের মধ্যে এ বিষয়টিকে পৌঁছে দেবে। ফলে তাঁর ইন্তেকালের পরে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লিখিত হলো :
1-আহমাদ বিন ইসহাক যিনি শিয়াদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর একজন প্রকৃত অনুসারী ছিলেন বলেন : ইমামের পরে কে তাঁর প্রতিনিধি তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : হে আহমাদ! আল্লাহ্ রাব্বুল আ
’
লামিন যখন আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন থেকে পৃথিবীকে তাঁর প্রতিনিধি বিহীন রাখেন নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিনিধি বিহীন রাখবেন না
।
পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি থাকার কারণেই পৃথিবী থেকে বালা-মুছিবত দূর হয়
,বৃষ্টি আসে
,বরকত বৃদ্ধি পায়।
বললাম : হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! আপনার পরে ইমাম বা প্রতিনিধি কে
?তিনি দ্রুত বাড়ীর ভিতরে গেলেন এবং তিন বছর বয়সের একটি শিশু যাকে দেখতে চাঁদের মত দেখাচ্ছিল ঘাড়ে করে ফিরে এসে বললেন : হে আহমাদ বিন ইসহাক! যদি তুমি আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের কাছে অতি প্রিয় না হতে তাহলে কখনই আমি তোমাকে আমার ছেলেকে দেখাতাম না। তাঁর নাম ও ডাক নাম নবী (সা.)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। সে এমনই এক ব্যক্তি যে
,এ পৃথিবীতে ন্যায় ও আদর্শের প্রতিষ্ঠা করবে
,তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। হে আহমাদ বিন ইসহাক! সে এই উম্মতের জন্য খিজির (আ.) ও যুলকারনাইনের মতই। আল্লাহর কসম সে অন্তর্ধানে থাকবে। তাঁর অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় ধ্বংস হওয়া থেকে কেউই রেহাই পাবে না। তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ্ তাকে মেনে নেয়া ও এ পথে দৃঢ় থাকার তওফীক দিবেন এবং তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত হওয়ার ব্যাপারে দোয়া করবে।
বললাম : হে আমার নেতা! এমন কোন আলামত আছে যা দেখলে আমার অন্তরে তাঁর ব্যাপারে অধিকতর বিশ্বাস স্থাপিত হবে
?
এ সময় ঐ শিশু পরিশুদ্ধ আরবী ভাষায় আমাকে বলল :
হে আহমাদ বিন ইসহাক! জমিনের বুকে আমিই হচ্ছি
“
বাকিয়াতুল্লাহ্ (আল্লাহর সঞ্চিত সম্পদ)
”
যে আল্লাহর শত্রুদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। সুতরাং এর চেয়ে
বেশী আলামত খোঁজা থেকে বিরত থাক ...।
মরহুম সাদুক বলেন এই রেওয়ায়েতটি আলী বিন আবদুল্লাহর হাতে লেখা অবস্থায় পেয়েছি। সে এই রেওয়ায়েতটি কোথা থেকে পেয়েছে জানতে চাইলে সাঈদ বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে আহমাদ বিন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে আমার কাছে বর্ণনা করল।
2-আহমাদ বিন হাসান বিন ইসহাক বলেন : যখন পুত পবিত্র শিশু হযরত মাহ্দী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন আমার মাওলা আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারীর (আ.) পক্ষ থেকে আমার দাদা আহমাদ বিন ইসহাকের নিকট একটি চিঠি এসেছিল। যার মধ্যে ইমাম নিজের হাতে লিখেছিলেন : আমাদের একটি সন্তান
জন্মগ্রহণ করেছে। তাঁর জন্মের বিষয়টি গোপন থাকার প্রয়োজন আছে। কাউকে এ বিষয়ে অবহিত করবে না। আমরা এই শিশুর জন্মকে কারো কাছে বলব না। শুধুমাত্র অতি নিকট ব্যক্তিবর্গ
,আত্মীয়-স্বজন
,বন্ধু-বান্ধব ছাড়া। তোমাকে ভালবাসি বলেই খবরটি তোমাকে দিয়েছি। যেন আল্লাহ্ তা
’
য়ালা এর মাধ্যমে
তোমাকে আনন্দিত করেন যেমনভাবে আমাদেরকে আনন্দিত করেছেন। ওয়াস-সালাম।
3-ইমামের ফুফু হাকিমা খাতুন
,ইমামের খাদেম নাসিম
,শিষ্য আবু জা
’
ফার মুহাম্মদ বিন উসমান আমরী
,হুসাইন বিন হাসান আলাবী
,আমর আল আহ্ওয়াযী
,খাদেম আবু নাসর
,কামেল বিন ইবরাহীম
,আলী বিন আ
’
সেম কুফী
,আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস আলাবী
,ইসমাইল বিন আলী
,ইয়াকুব বিন ইউসুফ যাররাব
,
ইসমাইল বিন মুসা বিন জা
’
ফার
,আলী বিন মুতাহ্হার
,ইবরাহীম বিন ইদরিস
,তারিফ খাদেম
,
আবু সাহল নৌবাখতি
,
এ সকল ব্যক্তিত্বরা ইমাম মাহ্দীর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে জানতেন এবং এ সম্পর্কে খবর দিয়েছেন।
4-জা
’
ফার বিন মুহাম্মদ বিন মালেক একদল শিয়ার পক্ষ থেকে বর্ণনা করে যে
,ইমাম আসকারী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আমার পরবর্তী হুজ্জাতের কাছে প্রশ্ন করার জন্য তোমরা এসেছো।
তারা বলল : হ্যাঁ
,আমরা তাঁর কাছে প্রশ্ন করার জন্য এসেছি।
হঠাৎ চাঁদের মত দেখতে একটি শিশু সেখানে উপস্থিত হলো। তাঁকে দেখতে অনেকটা ইমামের মতই লাগছিল অর্থাৎ তাঁর চেহারা ও ইমামের চেহারাতে বেশ মিল ছিল। ইমাম বললেন : এই হচ্ছে আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত বা তোমাদের ইমাম। তাঁর নির্দেশকে মেনে চলবে এবং তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে না তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। জেনে রাখ! তোমরা আজ তাকে দেখার পরে আর দেখবে না
,যতক্ষণ না তাঁর বয়স পরিপূর্ণ হবে। উসমান বিন সাঈদ যা কিছু বলবে তাই মেনে নিবে কেননা সে তোমাদের ইমামের প্রতিনিধি এবং কাজ-কর্ম যা কিছু আছে তা সবই তার দায়িত্বে।
5-ঈসা বিন মুহাম্মদ জৌহারী বলেন : আমরা কয়েকজন মিলে দল বেঁধে ইমাম মাহ্দীর জন্মের শুভেচ্ছা জানাতে ইমাম আসকারীর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের অন্যান্য ভায়েরা আগেই আমদেরকে খবর দিয়েছিল যে
,হযরত মাহ্দী শা
’
বান মাসের 15 তারিখে শুক্রবার ভোরে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমরা সেখানে পৌঁছে তাকে সালাম দেওয়ার আগেই তাকে শুভেচ্ছা জানালাম... আর কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে তার অন্তরে আমার সন্তান মাহ্দী কোথায় এই প্রশ্নটি মনে পোষণ করে রেখেছে। আমি তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছি যেমনভাবে মূসার মা মূসাকে যখন বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল তখন তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছিল এই বলে যে
,তিনি যেন তাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন।